আলভা এডিসন (১৮৪৭–১৯৩১) – সর্বাধিক আবিষ্কারের জনক
যে মহান বিজ্ঞানী সারা জীবনে সর্বমোট প্রায় তেরোশটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা উদ্ভাবন- প্রক্রিয়ার জনক, যা কোনো কালে কোনো বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং যাঁর প্রতিভার গুণে উদ্ভাবিত এসব আবিষ্কার দিয়ে বর্তমানে গোটা পৃথিবীর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কমপক্ষে সাত লক্ষ কোটি ডলারের ব্যবসা করে থাকে, সেই কালজয়ী মহান বিজ্ঞানীর নাম টমাস আলভা এডিসন (Thomas Alva Edison )।
তাঁর জন্ম ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিয়ো রাজ্যের মিলান শহরে। তাঁর বাবার নাম ছিল স্যামুয়েল এডিসন এবং মায়ের নাম ছিল ন্যান্সি এডিসন। বাবা ছিলেন ডাচ বংশীয় এবং মা ছিলেন কানাডিয়ান। টমাসের যখন কিশোর বয়স তখন তাঁদের পরিবার চলে আসে পোর্ট।
এডিসন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত কৌতূহলপ্রবণ। সবকিছু সম্পর্কেই তাঁর ছিল অন্তহীন জিজ্ঞাসা, জানবার অশেষ আগ্রহ। স্কুলে গিয়েও তিনি প্রশ্নের পর পশ্ন করে শিক্ষকদের অতিষ্ঠ করে তুলতেন। তাই শিক্ষকরা তাঁর মায়ের কাছে এসে একদিন এই বলে অভিযোগ করেছিলেন যে, আপনার ছেলে মাথা গোলমালে ভরা অর্থাৎ আস্ত একটা পাগল। ওকে আর স্কুলে পাঠাবেন না। কিন্তু মা জানতেন, এটা পাগলামো নয়। সবকিছু সম্পর্কে জানবার অসীম আগ্রহ থেকেই তার ছেলে এমনটা করছে।
এডিসনের তখন মাত্র ছয় বছর বয়স। একদিন তাঁর বাবা-মা দেখতে পেলেন যে, তাঁদের ছেলে হাঁসের খাঁচার মধ্যে ঢুকে আছে। কী ব্যাপার? ব্যাপার আর কিছুই নয়, হাঁসেরা কেমন করে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায়, মুরগির খাঁচায় ঢুকে সেটাই তিনি পরখ করছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি নিজেও একদিন হাঁসের ডিম তুলে নিয়ে তা দিয়ে দিয়ে বাচ্চা ফোটাবার চেষ্টা করেন।
আরেক দিন করেছিলেন আরও এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড। তখন তাঁর সাত বছর বয়স। বাবার ছিল মস্তবড় কৃষিখামার। বাড়ির পাশে ছিল খড়ের এক প্রকাণ্ড গাদা। খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিলে ব্যাপারটি কেমন দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্যই তাতে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। সেদিন লোকজন ছুটে আসায় কোনোমতে আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছিল, নইলে ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে যেত।
তাঁর বাল্যজীবনের এধরনের আরেকটি পাগলামোর ঘটনা আছে। একবার তিনি পত্রিকা পড়ে জানতে পারলেন, বেলুনের ভেতর গরম বাতাস ভরে দিলে তা পাখির মতো আকাশে উড়তে পারে। ফলে তারও খেয়াল চেপে গেল—গরম বাষ্প পেটে ভরলে যদি বেলুন আকাশে উড়তে পারে, তা হলে মানুষের পেটে গরম বাষ্প ভরে দিলে সেও আকাশে উড়তে পারবে না কেন!
যেই কথা, সেই কাজ। তখন তখনই তিনি খেলার সাথি মাইকেলকে ডেকে আনলেন। ছেলেটা ছিল একটু বোকা ধরনের। এডিসন মাইকেলকে সিডনিজ পাউডার খাইয়ে দিলেন। বললেন, এই পাউডার খাওয়ার পর সে দিব্যি পাখির মতো আকাশে উড়তে পারবে।
তারপর ফল যা হবার তা-ই হলো। মাইকেলের আর পাখি হয়ে আকাশে ওড়া হলো না। পাউডার খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো তার অসহ্য পেটের ব্যথা-বেদনা। অবশেষে তাকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। আর এই অপকর্মের জন্য কিশোর এডিসনের কপালেও জুটল উত্তমমধ্যম।
ধনীর ঘরের সন্তান হলেও বাল্যকাল থেকেই এডিসন ছিলেন খুব আত্মসচেতন। তিনি চেষ্টা করতেন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে। তাই বাবার অনুমতি নিয়ে স্বাবলম্বী হবার জন্য রেলগাড়িতে খবরের কাগজ বিক্রির কাজ নিলেন। পরে তিনি রেলগাড়িতে খাবারও বিক্রি করেন। একাজে তাঁকে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হতো।
এমনি করে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পোর্ট হিউরনে দুটো দোকান কিনে ফেললেন। আরও পরে নিজেই ‘উইকলি হেরাল্ড’ নামে একটি কাগজ বের করলেন। কাগজটি কিন্তু বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তার থেকে আয়ও ভালোই হতো।
তাঁর এই পত্রিকার অফিস ছিল ট্রেনের মাল রাখার একটি পরিত্যক্ত কক্ষে। কিন্তু একদিন সেখানে ঘটল একটা দুর্ঘটনা। তাতে আগুন লেগে তাঁর সবকিছু পুড়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, এই দুর্ঘটনার পর রেল কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি খেপে গেলেন। তারা এসে বন্ধ করে দিলেন তাঁর পত্রিকা অফিস। এডিসনের সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টারও সেখানেই ঘটল ইতি।
কাগজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি মাসিক পঁচিশ ডলার বেতনে চাকরি নিলেন টেলিফোন অপারেটরের।
এডিসনের টেলিগ্রাফি শেখার পেছনেও রয়েছে চমৎকার একটি গল্প।
১৮৬২ সালের কথা। তিনি একটা কাজের উপলক্ষে গিয়েছিলেন মাউন্ট ক্লিমেন্ট রেল স্টেশনে। এমন সময় তিনি দেখলেন স্টেশন মাস্টার ম্যাকেঞ্জির ছোট ছেলেটা রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে খেলছে। আর ওদিকে মেলট্রেন এগিয়ে আসছে যমদূতের মতো। দুর্ঘটনা এই ঘটল বলে! তাই মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে এডিসন লাফিয়ে পড়লেন ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য। তিনি ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কোনোমতে পড়ে গেলেন পাশে, আর মেলট্রেনটি বাঁশি বাজিয়ে চলে গেল তাদের পাশ দিয়ে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন দু’জনই।
কৃতজ্ঞ স্টেশন মাস্টার ম্যাকেঞ্জি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, এডিসন, তুমি আমার সন্তানের জীবন রক্ষা করেছ, কিন্তু আমি তো গরিব মানুষ, আমার দেবার সাধ্য কিছু নেই। তবে তুমি যদি চাও তো আমি তোমাকে টেলিগ্রাফ শেখাতে পারি।
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন এডিসন। তারপর মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ম্যাকেঞ্জির কাছ থেকে টেলিগ্রাফি শিখে ফেললেন তিনি। তারপর পোর্ট হিউরনে রাত্রিকালীন টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি পেয়ে গেলেন এডিসন। কিন্তু চাকরিটা ধরে রাখতে পারলেন না। একদিনের এক অভিনব ঘটনার জন্য চলে গেল সেটা। সেও এক মজার ঘটনা।
টেলিফোন অপারেটরকে তখন সারা রাত জেগে কাজ করতে হতো। ফলে অপারেটর জেগে আছে কি না, তার প্রমাণ দেবার জন্য প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর ‘সিক্স’ বলে একটি সংকেত পাঠাতে হতো মূল অফিসকক্ষে। একদিন অফিসের সুপারভাইজার ভাবলেন, এডিসনের সাথে একটু কথা বলা যাক। কিন্তু টেলিফোন আর কেউ ধরে না। অথচ কয়েক মিনিট আগেও তিনি তাঁর ‘সিক্স’ সংকেত পেয়েছেন। তা হলে তো তার জেগে থাকার কথা, কিন্তু বার্তার উত্তর আসছে না কেন? নিশ্চয়ই একটা কিছু অঘটন ঘটেছে।
তিনি দৌড়ে ছুটে এলেন এডিসনের অপারেটিং রুমে। ঢুকেই শুনতে পেলেন নিদ্রামগ্ন এডিসনের নাকের ডাক। তবে যে একটু আগে যে ‘সিক্স’ ধ্বনি হয়েছিল, তার রহস্যটা কী? তিনি এডিসনকে ডাকলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন চুপ করে। ঠিক সময়মতো এডিসনের অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে বেজে উঠল ‘সিক্স’ ধ্বনি-সংকেত।
সুপারভাইজার এডিসনের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের চমৎকারিত্বে খুশি হলেও কর্তব্যে অবহেলার দায়ে তাঁর চাকরি চলে গেল।
এ ধরনের কর্তব্যে অবহেলার জন্য এডিসনের জীবনে আরও কয়েকবার চাকরি গেছে। এরকম বহু জায়গায় চাকরি নিয়ে আবার তা হারিয়ে অবশেষে বিপর্যস্ত অবস্থায় একুশ বছর বয়সে তিনি ফিরে আসেন নিজের বাড়িতে। এখানে তিনি প্রায় ১৭/১৮ মাসের মতো ছিলেন। কিন্তু তাঁর মতো কর্মঠ ছেলের তো ঘরে বসে থাকবার নয়। এরপর তিনি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে যান বোস্টনে সেখানেও তাঁকে রাতের বেলায় কাজ করতে হতো। রাতে অফিসে কাজ করতেন, আর দিনের বেলা পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করতেন। পুরনো বইয়ের দোকানে গিয়েও বই কিনতেন।
এই সময়ই তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের রচনাবলি পড়ে শেষ করে ফেলেন। পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজ করতে গিয়ে এই সময়টায় তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে, একদিন তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, জীবন এত সংকীর্ণ, অথচ আমার অনেক কিছু করার আছে। তাই আজ থেকে আর একটি মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না।
আসলেও তা-ই, তিনি জীবনের একটি মুহূর্তকেও নষ্ট করেননি।
নিঃস্ব অবস্থায় পোর্ট হিউরনে ফিরে এসে এডিসন চাকরি নিলেন স্টেশনে। এখানেই তিনি প্রথম আবিষ্কার করেন ইলেকট্রিক ভোল্ট রেকর্ড। এর সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোট গণনা করা হতো। কিন্তু আবিষ্কারটি তেমন স্বীকৃতি পায়নি।
এরপর তিনি নিউ ইয়র্কে ফিরে এসে চাকরি নেন গোল্ড ইন্ডিকেটর কোম্পানিতে। এখানে তিনি আবিষ্কার করেন ‘গোল্ড কোটেশন’ নামের মুদ্রণ যন্ত্র। এই যন্ত্রটি গোল্ড অ্যান্ড স্টক টেলিগ্রাফ কোম্পানি কিনে নেয় চল্লিশ হাজার ডলার মূল্যে।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থলাভ করেই এডিসনের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। দূর হয়ে যায় তাঁর অর্থকষ্ট। এই অর্থ ব্যয় করে তিনি নিজেই খুলে ফেলেন একটা কারখানা। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা তিনি মেতে ওঠেন আবিষ্কারের নেশায়।
আমরা আজ বিজ্ঞানী গ্রাহাম বেলকেই টেলিফোনের আবিষ্কর্তা বলে জানি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বেলেরও এক মাস আগে এডিসন ১৮৭৬ সালের ১৪ জানুয়ারি উদ্ভাবন করেছিলেন টেলিফোন এবং পেটেন্টের জন্য আবেদনও করেছিলেন। অবশ্য এডিসনের টেলিফোন কথা বলার জন্য নয়, ছিল শব্দতরঙ্গ বিশ্লেষণের জন্য।
তবু তিনি টেলিফোনের জন্য বেলকেই স্বীকৃতি কুণ্ঠারোধ করেননি। শুধু তা-ই নয়, বেল টেলিফোন আবিষ্কার করলেও কার্বন ট্রান্সমিটারকে কাজে লাগিয়ে তাকে কার্যোপযোগী করে তোলেন স্বয়ং এডিসন।
তিনি গ্রাহাম বেলের টেলিফোনের অনেক সংস্কার সাধনেও সাহায্য করেন। বেলের টেলিফোনে হেডপিস বা ইয়ারপিস বলে কিছু ছিল না। একই চুঙ্গিতে কথা বলতে এবং শুনতে হতো। তিনি লক্ষ্য করেন, মাউথপিসের সাহায্যে বাতাসের মধ্য দিয়ে শব্দ প্রেরণ করা যায় এবং ইয়ারপিস দিয়ে তা শোনাও যায়। তখন এডিসন টেলিফোনে ইয়ারপিস ও মাউথপিস একসাথে জুড়ে দেন।
টেলিফোনের উন্নতিসাধন করে তিনি যন্ত্রটি নিয়ে যান ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন অফিসে। কোম্পানি তাঁর কাছ থেকে যন্ত্রটি এক লক্ষ্য ডলার দিয়ে কিনে নেয়।
তাঁর আর একটি বিশিষ্ট আবিষ্কার বৈদ্যুতিক বাল্ব, বিশেষ করে বাঁশের আঁশ দিয়ে তৈরি বৈদ্যুতিক বাল্ব। তিনি বৈদ্যুতিক বাল্ব এবং তার হোল্ডারও তৈরি করেন।
তাঁর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী আবিষ্কারের গ্রামোফোন বা কথকযন্ত্র। ১৮৭৭ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই তিনি এটি আবিষ্কার করে বসেন। তিনি টেলিফোনের কার্বন ট্রান্সমিটার ঘোরাচ্ছিলেন আর মাউথপিসে গান গাইছিলেন। যন্ত্রপাতির মধ্যে একটি ছোট সুচ তাঁর গলার আওয়াজে দুলছিল। এর থেকেই তাঁর মনে হলো, তাহলে শব্দতরঙ্গ রেকর্ড করার মতো যন্ত্রও তিনি তৈরি করে ফেলেছেন!