ক্লডিয়াস টলেমি (১০০–১৮০ খ্রি.) – জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম কোষগ্রন্থ প্রণেতা
প্রাচীনকালের ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম কোষগ্রন্থের প্রণেতা, মিশরের মহাজ্ঞানী পুরুষ টলেমি (Ptolemy), যাঁর প্রকৃত নাম ক্লডিয়াস টলেমাউস (Claudius Ptolemaeus), তিনি ছিলেন প্রাচীনকালে ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম কোষগ্রন্থ প্রণেতা।
অন্য আরো অনেক জ্ঞানী ও মহাপুরুষের মতো তাঁর জীবনের কাহিনীও হারিয়ে গেছে কালের অতলগর্ভে। আজ শুধু জানা যায়, তাঁর জন্মস্থান ছিল মিশর এবং তিনি প্রসিদ্ধ আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে খ্রিস্টীয় ১২৭ অব্দ থেকে ১৫১ অব্দ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। কেউ কেউ এই জোতির্বিজ্ঞানীকে নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি করেন। মিশরে এক সময় টলেমি রাজবংশ রাজত্ব করতেন। এই রাজবংশে অনেক বিদ্যোৎসাহী নরপতিরও জন্ম হয়েছিল। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি এই রাজবংশের কেউ ছিলেন না। তিনি আরও অনেক পরের লোক।
মিশরের টলেমি রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারিণী ছিলেন রানি ক্লিওপেট্রা। তাঁর মৃত্যুর (৩০ খ্রি. পূ.) ভেতর দিয়েই এই রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞানী টলেমির জন্ম এর আরো ১৩০ বছর পর। তাই মিশরের টলেমি রাজবংশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
সুদীর্ঘকালের ব্যবধানে টলেমির জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ হারিয়ে গেলেও তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে তাঁর জন্মস্থান এবং একটা আনুমানিক জন্ম-তারিখ ঠিক করা যায় এভাবে-
তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করতে শুরু করেন ১২৭ খ্রিস্টাব্দে এবং সর্বশেষ তারিখ পাওয়া যায় ১৪১ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কার্যকাল বিস্তৃত ছিল ১২৭ থেকে ১৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁর জীবনের এই কালপর্বের হিসেবে পাওয়া গেছে তাঁর রচিত ‘অ্যালমাজেস্ট’ (Almagest) গ্রন্থ থেকে। তবে এই গ্রন্থ রচনা করার পরও তিনি আরও প্রায় বছর দশেক জীবিত ছিলেন।
এই থেকেই অনুমান করা হয় তিনি হয়তো রোম সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস-এর সমসাময়িক লোক ছিলেন। অরেলিয়াসের রাজত্বকাল শেষ হয় ১৮০ খ্রিস্টাব্দে।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক অনুমান করেন, তিনি হয়তো ৭৬ খ্রিস্টাব্দে কিংবা তার সামান্য কিছু পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গবেষণগুলো সমাপ্ত করেছিলেন ১৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তাঁর মৃত্যুকাল সম্ভবত ১৮০ খ্রিস্টাব্দ। কালের অনেক উত্থান-পতনের পরও তাঁর দুটো মূল্যবান গ্রন্থ এখনও টিকে আছে। এই গ্ৰন্থ দুটো টলেমির প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। নাম যথাক্রমে ‘গাইড টু জিওগ্রাফি’ (Guide to Geography) এবং ‘অ্যালমাজেস্ট।’
টলেমির ‘গাইড টু জিওগ্রাফি’ গ্রন্থটি হলো প্রাচীনকালের বিজ্ঞানভিত্তিক ভূগোল- রচনার প্রথম প্রচেষ্টা। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সাহায্যে কোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য তিনি একটি মানচিত্র অঙ্কন করেন। তবে এ বিষয়ে প্রথম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিপারকাস। টলেমি তাঁর ঋণ স্বীকার করে গেছেন।
টলেমির এই মানচিত্রে অনেক বিভ্রান্ত থাকলেও তাঁর ভৌগোলিক বিবরণটি পরবর্তীকালে বিশ্ববাসীর কাছে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে সমাদর লাভ করেছিল।
টলেমির ভৌগোলিক বিবরণে প্রাচীন ভাতবর্ষেরও অনেক ভৌগোলিক পরিচয় দেওয়া আছে। এসব থেকেই সেকালের ভারতবর্ষের অনেক জনপদ, নগর ও বন্দরের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ভারতের অনেক বড় বড় পাহাড়-পর্বত এবং নদীরও নামোল্লেখ করে গেছেন। টলেমির এই বিবরণ থেকেই ভারতের বহু প্রাচীন হারানো নগরী ও জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
শুধু ভারতবর্ষ নয়, টলেমির ‘গাইড টু জিওগ্রাফি’ গ্রন্থে বিশ্বের আরও বহু দেশের বর্ণনা, সেখানকার পাহাড়-পর্বত, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ, মানুষ ইত্যাদির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কথিত আছে, ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত এই মূল্যবান গ্রন্থখানা পাঠ করেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম সমুদ্রযাত্রায় অনুপ্রাণিত হন।
টলেমির অপর মূল্যবান কোষগ্রন্থ ‘অ্যালমাজেস্ট’ মোট তেরো খণ্ডে বিভক্ত। এতে মহান জ্যামিতিবিদ ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’-এর যাবতীয় জ্যামিতিক তথ্যও সংকলিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও আছে জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমির নিজস্ব আবিষ্কারসমূহের বিবরণ। তবে এই গ্রন্থে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিপারকাস। অ্যালমাজেস্টের প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচিত হয়েছে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহের গতি, পৃথিবীর আহ্নিক গতি সংক্রান্ত বিষয়াদি। তৃতীয় খণ্ডে আলেচিত হয়েছে সূৰ্যবিষয়ক তথ্যাবলি এবং পঞ্জিকার কথা। চতুর্থ খণ্ডে আছে চন্দ্রের গতি এবং চন্দ্রগ্রহণের কথা। পঞ্চম খণ্ডে আছে সেকালের বহুলব্যবহৃত জ্যোতিষীর পর্যবেক্ষণ যন্ত্র ‘আস্তারলাভ’-এর বর্ণনা। ষষ্ঠ খণ্ডে আছে গ্রহণবিষয়ক তথ্যাবলি। সপ্তম ও অষ্টম খণ্ডে আলোচিত হয়েছে নক্ষত্র পরিচিতি এবং নবম থেকে ত্রয়োদশ খণ্ডে আলোচিত হয়েছে গ্রহদের গতিবিধি এবং ভূকেন্দ্রিক মতবাদ।
‘অ্যালমাজেস্ট’ বইটির প্রকৃত নাম ছিল ‘মেগেল ম্যাথেম্যাটিক সাই নট্যাক্সি’স’ (Megale Mathematike syntaxi’s)। সাধারণভাবে এর অর্থ হলো অঙ্কশাস্ত্রের বড় কাজ। বইটির পাণ্ডুলিপি একসময় হারিয়েই গিয়েছিল। গোটা গ্রিক সাম্রাজ্যে এর কোনো কপিই ছিল না। মূল্যবান এই বইটিকে শেষরক্ষা করেছিলেন আরবের মনীষীরা। আরবি অনুবাদ করার সময় তাঁর বইটির আরবিকরণ করে নাম রাখেছিলেন ‘অ্যালমাজেস্ট’ ( Almagest )।
টলেমির এই বিখ্যাত গ্রন্থটি তাঁর সময় থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত বিশ্বের সেরা গ্রন্থরূপে পরিচিত ছিল। একাদশ শতাব্দীতে এটি আরবি ভষায় অনূদিত হয়। মধ্যযুগে এই অমূল্য গ্রন্থটি ‘জ্যোতিষশাস্ত্রের বাইবেল’ বলে সম্মানিত হয়েছিল। এটি আরব ও ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিল।
টলেমির আগে কোনো কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানী সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের (সৗরজগৎ) কথা বলেছিলেন। টলেমির জন্মেরও কয়েক শতাব্দী আগেই ইজিয়ান অঞ্চলের চিয়স দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যারিস্টারকাস বলেছিলেন, বিশ্বের (তখন বিশ্ব বলতে সৌরজগৎকেই বোঝানো হতো) কেন্দ্রবিন্দু হলো সূর্য। সূর্যকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের যাবতীয় বস্তুসমূহ, তথা গ্রহ-নক্ষত্র আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু অ্যারিস্টারকাসের এই বৈপ্লবিক ঘোষণাও কিন্তু সেইকালে তেমন সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি। বরং এর বিরোধী অর্থাৎ ভূকেন্দ্রিক ভ্রান্ত মতবাদেই সেকালে সবাই বেশি সোচ্চার ছিলেন। এই দলের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন টলেমি।
এঁরাই প্রচার করতে থাকেন, বিশ্বের যাবতীয় বস্তুসমূহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। তাঁরা তাঁদের ভ্রান্ত মতবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হাজারো রকমের নকশা ও বিশ্বকাঠামোর মডেল তৈরি করেছিলেন। যদিও টলেমিরা তাঁদের সৃষ্ট জটিল বিশ্ব-মডেলকে কখনও ত্রুটিশূন্য করতে সক্ষম হননি।
তাঁরা বলতেন, বিশ্বের সকল বস্তুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। কিন্তু আকাশের ধ্রুব নক্ষত্র কেন স্থির থাকে তার কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারেননি।
তারপরও এই ভ্রান্ত মতবাদই প্রায় বারোশো বছর ধরে সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করে রেখেছিল। টলেমি, হিপারকাস এবং অ্যারিস্টটলের মতো জ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তিরাও এই ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাস করতেন।
বহু বছর পরে এই ভ্রান্ত মতবাদের যিনি প্রতিবাদ করেন, তিনি হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাস। তিনি বললেন, সূর্য ঘোরে না, পৃথিবীই ঘোরে। সেদিন যদি টলেমি অ্যারিস্টারকাস-এর মত সমর্থন করতেন, তা হলে হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসকেই নতুন করে লিখতে হতো।
শুধু এই একটি বিষয়েই নয়, এ ধরনের আরও অনেক ভ্রান্ত মতবাদের তিনি প্রবর্তক ও সমর্থক ছিলেন। যেমন, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত, এটা নির্ণয় করতে গিয়ে টলেমি বলেছেন, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হলো পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের ১৮ থেকে ২০ গুণ বেশি।
এর চেয়ে সত্যের আরেকটুকু কাছাকাছি গিয়েছিলেন হিপারকাস। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হলো পৃথিবীর ব্যাসের তিরিশ গুণ।
এ দুটো মতবাদের কোনোটাই সত্যের কাছাকাছি নয়। কারণ, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হলো ৩,৮২, ১৭১ কিলোমিটার এবং পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৪ কোটি ৯৬ লক্ষ কিলোমিটার। পৃথিবীর ব্যাস ১২, ৬৮৩ কিলোমিটার।
জ্যোতিষ ও ভূগোলবিদ্যা ছাড়াও আলোকবিদ্যার ওপরও টলেমির একটি বই ছিল। এর নাম ‘অপটিক্’। কিন্তু বইটির পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। কেবল সিসিলির নৌবাহিনী-প্রধান ইউজেন অব পালের্মোর আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা এই গ্রন্থের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে।