সোনার হরিণ নেই – ৭

সাত

মিষ্টি এলো। বারান্দায় পা দিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

স্লিপটা পেয়ে আগ্রহ নিয়ে নেমে এসেছিল মনে হয়। কারণ বাপীর পুরো পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি। কিন্তু চোখাচোখি হওয়া মাত্র তার দু’চোখে ধাক্কা খেল। বানারজুলির বাপী তরফদার এই লোক সেটা কল্পনার মধ্যেও ছিল না। শুধু অবাক নয়, অপ্রস্তুতও। কারণ এখন হয়তো দেখা মাত্র মনে হয়েছে এই লোক বা এমন লোক বাপী তরফদার ছাড়া আর কে হতে পারে?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে থাকলে বাপী এদিকে সরে আসত না। চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। চেয়ে রইল। দু চোখে হাসি ছুঁয়ে আছে কি নেই। বাকিটুকু প্রতীক্ষা। দেখার পর আর চেনার পর ওই মেয়ে এখন যদি মুখ ঘুরিয়ে আবার ভিতরে চলে যায়, জীবনের পুরনো অধ্যায় পুরোপুরি শেষ করে নিয়ে বাপীও নিজের পা দুটোকে গেটের বাইরে টেনে নিয়ে যাবে।

শেষ নয়। বারান্দা থেকে নামল।

…পরনে গাঢ় খয়েরি রঙের ওপর চকচকে সাদা বুটির শাড়ি। গায়ে ধপধপে সাদা ব্লাউজ। পায়ে হালকা শৌখিন স্যান্ডাল। বাপী ভোলে না কিছু। বানারজুলির সাহেব বাংলোয় লাল ডুরে শাড়ি পরা দশ বছরের মিষ্টিকে দেখে। রূপকথার রাজকন্যার মতো মনে হয়েছিল। ওর সেই ঝলমলে শাড়ি সামলানোর বিড়ম্বনাটুকুও মনে আছে। …এখন এই পাতলা দামী শাড়ি দেহের ভাঁজে ভাঁজে অনায়াসে লেপটে আছে। একটুও বাড়তি নয়।

পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আসার এই নিস্পৃহ ধরনটা বানারজুলির বাংলোর থেকে সেই মিষ্টির নেমে আসার সঙ্গে মেলে কিছুটা। আসার আগ্রহ যদি থাকেও, বুঝতে দিতে আপত্তি। দেড় গজ তফাতে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর একটুকরো হাসি ঠোটের ফাঁকে যেন এসেই গেল।

—এত দিনে চিনতে পেরেছ তাহলে?

বাপীর গলায় বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। অভিমানও না।

সোজা মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি দেখছে ওকে। বানারজুলির সেই দুরন্ত দস্যি ছেলেটাই যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাসল। মাথা নাড়ল। চিনতে পেরেছে। হাসিমাখা কালো দুচোখ ওর মুখের ওপর নড়াচড়া করল একটু। জিজ্ঞাসা করল, তুমি চিনলে কি করে?

চোখে এর মধ্যে ওকে অনেকবার দেখেছে। আর মনে মনে তো অবিরাম দেখে চলেছে। আট বছর বাদে গলা এই প্রথম শুনল। কচি ছেলের মতো হাল্কা মিষ্টি

বাপী কি জবাব দেবে? বলবে গত আট বছরের মধ্যে আটটা দিনের জন্যেও তুমি আমার চোখের আড়ালে ছিলে না—আমি চিনব না কেন? গদ্যাকারের সত্যি কথাই বেরুলো মুখ দিয়ে। বলল, তোমাদের বাড়ির রাস্তার এ মাথায় এক জ্যোতিষীর চেম্বারে রাত্রে মায়ের পাশে বসে বসে তুমি হাত দেখাচ্ছিলে…আমি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছিলাম।

মাত্র দিন কতক আগে মা জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গেছল সেটা মনে না পড়ার কথা নয়। মিষ্টি হাসছে অল্প অল্প আর দেখছে। একসঙ্গে অনেক দেখার আছে যেন। বলল, মা সঙ্গে ছিল বলে চিনেছ। ডেকে কথা বললে না কেন?

—এভাবে হঠাৎ তোমার দেখা পেয়ে খুব অবাক হয়ে গেছলাম।… তোমাদের বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিলাম।

—তারপর? মিষ্টি উৎসুক।

তোমরা বেরিয়ে এলে। তখনো আমাকে হাঁ করে তোমার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে তোমার মা ঝাঁঝালো গলায় স্টুপিড বলে গাড়িতে উঠলেন। তুমিও খুব বিরক্ত হয়েছিলে—

মিষ্টির মুখে মিষ্টি বিড়ম্বনার খেলা। — কক্ষনো না, আমার কিছু মনে পড়ছে না।

মনে পড়ছে কি পড়ছে না তা নিয়ে বাপীর কোনো মাথাব্যথা নেই। মন বলছে আট বছর বাদে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে ওকে দেখে আর চিনে এই মেয়ে অখুশি নয়। আট বছর আগের সেই বানারজুলির দিনগুলি এই দুটো কালো চোখে এক—সঙ্গে ভিড় করে এসেছে। আসছে।

—তোমার ক্লাস আছে?

—ছিল। হাত উল্টে ঘড়ি দেখে নিল।—ক্লাস বসে গেছে, আর ঢোকা যাবে না।

—খুব ক্ষতি হল?

মিষ্টি হেসেই মাথা নাড়ল—খুব না।

—এ ঘণ্টার পরে ছুটি?

—না, আর একটা ক্লাস আছে।

একদিন এ ক্লাসও কামাই হলে?

হাসি-ছাওয়া দু’চোখ মুখের ওপর থমকালো একটু। নাকচ করার কথা কেন যেন ভাবাও গেল না। জবাব দিল, হলে আর কে কি কচ্ছে।…আচ্ছা একটু দাঁড়াও আসছি—

কয়েক পা এগিয়েই ঘুরে তাকালো।—এই একদিনই তো?

বাপী চেয়ে রইল। জবাব দেবার মতো প্রশ্ন কিছু নয়। কান-মন ভরে দেবার মতো কিছু। হালকা পা ফেলে মিষ্টি চলে গেল।

চারদিকে চেয়ে বাপী দেখছে। এটা গতকালের সেই পার্ক নয়। মিষ্টির এই আসা বা যাওয়া গতকালের মতো দিবাস্বপ্ন নয়। কিন্তু গতকালের সেই আমেজটুকুর সঙ্গে এই বাস্তবের বড় অদ্ভুত মিল। এক আশ্চর্য শান্তিতে সেই রকমই ভিতর-বার ডুবে যাবার মতো। পার্কে পুলিশের লাঠির খোঁচায় ঘোর কাটার পরেও ঘরের দিকে পা চালিয়ে বাপী ভাবছিল, আটটা বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে কোনো নিভৃতে এই মেয়ের মুখোমুখি হতে পারলে পার্কের সেই কল্পনার ছবিটা একেবারে মিথ্যে হয়ে যাবে না। হতে পারে না।

মিথ্যে হয়নি। বিস্ময়ের সেই হাবুডুবু ব্যাপারই দেখেছে। খুশির চাপা তরঙ্গ দেখেছে। হাসিটুকুও সেই রকমই।

মানুষের ভিতরের কোন দিকটা আসল সত্য, অনুভূতির এই জোয়ারে তারও হদিস মেলা ভার। জ্যোতিষীর ঘরে মায়ের পাশে এই মিষ্টিকে দেখা মাত্ৰ অনেক—অনেক দিনের ক্ষুধার্ত স্নায়ুগুলো একসঙ্গে টান-টান হয়ে উঠেছিল। তারা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানশূন্যের মতো এই বাপী তরফদার দু’হাতের মধ্যে এসে মাকে ছেড়ে ওই মেয়েকে ব্যভিচারী দুটো চোখের বাঁধনে আগলে রাখতে চেয়েছিল। পিছনে লাল আলো জ্বেলে সাদা গাড়িটা চলে যাচ্ছিল যখন তখনো চৌদ্দ বছর বয়সের সেই প্রবৃত্তির আগুন বাইশ বছরের দেহের শিরায় শিরায় দাউ দাউ করে জ্বলছিল। পরেও সাতাশি নম্বরের বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে যতবার দেখেছে ওকে, বাসনার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলেছে। আর গতকাল বাড়ির দোতলার বারান্দার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত মুখে ওর ওপর কতগুলো হায়নার হামলা দেখছিল আর মজা পাচ্ছিল যে মেয়ে—তাকে কোন পাতালে টেনে নিয়ে যেতে পারলে সঠিক জবাব হয়, বুকের তলায় সেই নরক খুঁজে বেড়াচ্ছিল। প্রবৃত্তির সেই নিষ্ঠুর আদিম অভিলাষে সমস্ত মেয়ে জাতটাকেই দগ্ধে নিঃশেষ করতে চেয়েছে। ভিতরের পশুটা থাবা চেটেছে। তারপর একজনকে না পাওয়ার আক্রোশে আর একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে। কমলা বনিক কতটা দেখেছে কতটা বুঝেছে বাপী জানে না।

আজ?

পার্কের গতকালের অনুভূতিটুকুই ঠাণ্ডা প্রলেপের মতো ভিতরের আনাচে—কানাচে ছড়িয়ে আছে। বুকের তলায় দুমড়ানো গুমরানো সেই ভীষণ যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই। সেই ভয়ংকর আক্রোশ নেই। সুড়ঙ্গপথের সেই জানোয়ারটাও উধাও। তার পরিত্যক্ত শূন্য গুহা-গহ্বর খুঁজে বাপীর শান্ত দৃষ্টি আবার ওই হলঘরের বারান্দার দিকে।

আর ঘড়ি দেখেনি। তবু আট-ন’ মিনিটের বেশি হবে না বোধ হয়। মিষ্টি আসছে। হাতে দুটো মোটা বই আর একটা বাঁধানো খাতা। লালচে মুখ। চোখে এখনো হাসি চিকচিক করছে। বানারজুলির বাপী ভাবত মিষ্টি কবে বড় হবে। বড় হয়েছে। বড় হবার পর বানারজুলির সেই সব কাণ্ড যদি মনে পড়ে তাহলে কোন মেয়ের মুখে না লালের আভা ছড়াবে?

বাপী হলপ করে বলতে পারে মনে পড়েছে। নইলে আসত না। পাত্তা দিত না।

কাছে এসে হাসি মুখে মিষ্টি বলল, দাদুকে অফিস চেম্বারে একটা ফোন করলাম। গাড়ি নিয়ে আসার দরকার নেই বলে দিলাম।

এই পুরস্কারটুকুও বাপী দুটো চোখ দিয়েই গ্রহণ করল। এখানে আর দাঁড়ানোর ইচ্ছে নেই। বানারজুলির মতো এই মিষ্টি মায়ের খুব পরোয়া করে মনে হয় না। তবু গেটের দিকে পা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, তোমার মা ভাববেন না?

মিষ্টির কথাবার্তায় আগেও ঘোরপ্যাঁচ ছিল না খুব, এখনো অনেকটা তাই, পাশে চলতে চলতে হালকা সুরে বলল, মাকে নিয়েই মুশকিল, সব সময় বেশি ভাবে—

—কি রকম?

—তাঁর ধারণা, দুনিয়ার সব ছেলে তাঁর মেয়েকে গিলে খাবার জন্য হাঁ করে আছে। হেসে ফেলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো একবার।—কোথায় যাচ্ছি, এখানে তো বানারজুলির মতো জঙ্গল নেই…

কথাগুলো ডবল হলেও একেবারে সবল ভাবা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে সহজ হবার দায় বাপীরই। সেও তাকালো একবার। স্বীকার করে নিয়েই জবাব দিল।— না, এখানকার জঙ্গল বানারজুলির মতো নয়…।

—এখানকার জঙ্গল মানে? মিষ্টির মুখে পলকা বিস্ময়।

বাপী হাসছে অল্প অল্প। গেটের বাইরে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। হালকা করে একটু ভারী জবাবই দিয়ে বসল।—বানারজুলির জঙ্গলে আর যাই বলো কোনরকম কৃত্রিমতা আর ছলনা নেই। পাঁচ মাস হল এসে দেখছি এখানে সবটাই তাই। শব্দ করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সামাল দেবার চেষ্টা। বলল, কেবল এই খানিকক্ষণ হল অন্য রকম লাগছে—

অর্থাৎ খানিক আগের এই যোগাযোগের পর থেকে কৃত্রিমতা বা ছলনা দূরে সরেছে। মিষ্টির আয়ত দু চোখ ওর মুখের ওপর।

কি দেখছে বাপী অনায়াসে বলে দিতে পারে। নিজের গায়ের রং কোনদিনই ফর্সা নয়। কিন্তু ছাঁদ-ছিরির কিছু প্রশংসা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে। ড্রইং—মাস্টার ললিত ভড় বলতেন, ললিত-ঋজু-দাক্ষিণ্যে পুষ্টু হলে তবে পুরুষ। লক্ষ্য করলে ওর মধ্যেও পুরুষের এই দাক্ষিণ্যটুকুর এখন মেয়েদের চোখে পড়ে। রতন বনিকের বউ কমলা বনিকের চোখে পড়েছে। মণিদার বউ গৌরী বউদির চোখে পড়েছে। ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোমের মেয়ে ঊষার চোখে পড়েছে। মিষ্টির চোখেও পড়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ভেতর দেখে নেওয়ার চেষ্টা। বানারজুলি জঙ্গলের চৌদ্দ বছরের বেপরোয়া ছেলের সেই হিংস্র লোলুপ তাড়না কতটা আড়াল নিয়ে আছে বোঝার চেষ্টা।

বাপীর মজা লাগছে। মুখে কিছু না বলে ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। মিষ্টি সচকিত। বাংলো থেকে ওকে বার করে জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হাতের ওপর দখল নিত তাও মনে না পড়ার কথা নয়।—কি?

বইখাতা আমাকে দাও।

মিষ্টি হেসে ফেলল। দিয়েও দিল।

বাপী বলল, শহরের রীতি অনুযায়ী এখন কোথাও গিয়ে তোমাকে একটু চা খাওয়ানোর প্রস্তাব করা উচিত বোধ হয় …

তেমন হেসেই মিষ্টি জবাব দিল, শহরের রীতি অনুযায়ী আমারও সায় দেওয়া উচিত।

সামনের দিকে এগলো দুজনে। বইখাতায় নরম হাতের স্পর্শ লেগে আছে। সংগোপনে সেটুকু অনুভব করার লোভ বাপীর।

মিষ্টি এদিকে ফিরল। দু চোখে কৌতূহল ছেয়ে আছে।—জ্যোতিষীর ওখানে দেখে তুমি আমাদের বাড়ি চিনলে কি করে?

বাপী ঘটা করে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা।—সেজন্য অনেক মেহনত করতে হয়েছে। প্রথম সেই জ্যোতিষীর কাছ থেকে মিথ্যে অজুহাতে ঠিকানা আদায় করতে গিয়ে চোরের দায়ে ধরা পড়ার দাখিল হয়েছিল।

চলতে চলতে সকৌতুকে আবার ঘাড় ফেরালো মিষ্টি।—তারপর?

—তার পরের দিন দুপুর থেকে তোমাদের ওই রাস্তা চষেও কোনো হদিস পাওয়া গেল না। শেষে কলেজ স্ট্রীটে এক বন্ধুর বাড়ি এসে টেলিফোন ডাইরেকটরিতে তোমার বাবার নাম খোঁজা হল—

—বাবা তো অল ইণ্ডিয়া সার্ভিসে চলে গেছেন, এখন মধ্যপ্রদেশে পোস্টেড, আমি আর মা দাদুর কাছে থাকি, টেলিফোন দাদুর নামে—পাবে কি করে।

—পাইনি। এরপর তোমাদের গাড়ীর নম্বর সম্বল। সেটা মনে ছিল। বন্ধুর সাহায্যে মোটর ভেহিকিলস-এ এসে একজন দালালকে এক টাকা ঘুষ দিয়ে তবে ঠিকানা হাত করা গেল।

সাদামাটা সত্যি কথার সহজ প্রতিক্রিয়াটুকু লক্ষ্য করছে বাপী। মিষ্টি হাসছে। আগের কথা ভোলেনি বলেই অবিশ্বাস করছে না। বলল, ঠিকানা হাতে পেয়েও বাড়িতে না ঢুকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে কেন?

—তোমার মায়ের ভয়ে।

বিব্রত মুখে মিষ্টি বলল, ভিতরে এলে মা কি তোমাকে সেই বানারজুলির মতো তাড়া করে আসত নাকি?

তেমনি সাদাসিদে মুখে বাপী জবাব দিল, না চিনেই স্টুপিড বলেছিলেন, চিনলে তাড়া করার কথা নয়?

মিষ্টি আর যেন তেমন জোর দিয়ে অস্বীকার করতে পারল না। বাপী বলল, তবু গতকাল কপাল ঠুকে ঢুকেই পড়ব ভেবেছিলাম। অদৃষ্টে দুর্ভোগ লেখা ছিল। তোমার পাড়ার ভক্তের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে টানা-ছেঁড়া শুরু করে দিল। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে তুমি সেই দুর্দশা দেখেছিলে। তোমার ভক্তদের তাইতে আমাকে শায়েস্তা করার উৎসাহ আরো বেড়ে গেছল।

এও সত্যি। মিষ্টির সহজ হবার চেষ্টা।—আজ তাই অন্য রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলে?…আমার এই কলেজ জানলে কি করে?

—গাড়ি থেকে আমাকে দেখে তুমি বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলে। তখন ট্যাক্সিতে ফলো করে তোমাকে এই কলেজে ঢুকতে দেখলাম।

একটুও বাড়িয়ে বলেনি। রং ফলায়নি। আট বছর আগের ছেলেবেলার সেই দুরন্ত দস্যিকে এর সঙ্গে মেলানো সহজ নয়। কিন্তু মিলছেও আবার। জিগ্যেস করল, তারপর এই বেলা দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করে স্লিপ পাঠালে?

বাপী হাসল। বলল, স্লিপ পেয়েও তুমি আসবে কি আসবে না সন্দেহ ছিল। এতবার দেখেও যখন চিনতে পারলে না, ভাবলাম ভুলেই গেছ।

সামান্য ফিরে মিষ্টি তেরছা চোখে আর একবার দেখে নিল ওকে। পাতলা দুই ঠোট কৌতুকে টসটস করছে। তারপর সংকোচের কথাটা বেশ সহজেই বলে ফেলল।—তোমাকে চিনতে না পারলেও বানারজুলির বাপীকে ভোলা শক্ত।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে হল আট বছরের ফারাকের অর্ধেকটাই জুড়ে গেছে। তরল সুরে মিষ্টি আবার বলল, তবু কদিন দেখে তোমাকে চেনা আমার উচিত ছিল।

—কেন?

—তুমি ছাড়া এত কাণ্ড আর কে করবে। কাল তো আরো চেনা উচিত ছিল।

—কেন? দু’ কান ভরে কেবল শুনতেই ইচ্ছে করছে বাপীর।

—পাড়ার ওই পাজীগুলো যখন তোমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তুমি দোতলার দিকে একবার ফিরে তাকিয়েছিলে। এমন তাকানো যেন অতটা দূর থেকেই একেবারে ভস্ম করে ফেলবে আমাকে।…আট বছর আগে বাবা বানারজুলি থেকে দিনাজপুরে বদলি হতে আমরা যখন বাংলো ছেড়ে জিপে করে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন ওই রকম করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে তুমি। আমার ভয়ই করছিল, এই বুঝি চলন্ত জিপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে একেবারে শেষ করে ছাড়বে।

বাপী সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেললে একটা। এ কথার পর এতদিনের ব্যবধান আরো কিছুটা জুড়ে গেল। লঘু সুরে জিজ্ঞাসা করল, কালও ভয় করছিল নাকি?

হাসি মুখে মাথা দোলালো।—তা অবশ্য করছিল না।…এখন আর কোনো ভয়-ডরের ধার ধারি না।

শেষেরটুকু যেন পুরনো দিনের এক দামাল ছেলেকে শোনানোর জন্যেই। বাপী সামনে হাঁটছে, কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। চেয়েই আছে। সেটুকু অনুভব করার ফলে আবার চোখোচোখি। মিষ্টির ভুরুর মাঝে পলকা একটু।—কি দেখছ?

—মিষ্টি।

হেসে উঠল।—জল দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে কচ্ছে?

বাপীর হাসিতে খুশির বিড়ম্বনা। আট বছরের ফারাক এবারে জুড়েই গেল বুঝি। দিনমানের এই কলকাতা না হলে হাত বাড়িয়ে আগের মতো ওর একখানা হাতের ওপর দখল নেওয়াও একেবারে অসম্ভব কিছু হত না।

এবারে মিষ্টি গম্ভীর একটু। কিন্তু হাসির ছোঁয়া লেগেই আছে। বলল, এখানে আমি মালবিকা, এক মা আর দাদু শুধু মিষ্টি বলে ডাকে।

—দীপুদা?

—দাদা বিলেতে!

ভালো খবর। তাকে নিয়ে বাপীর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। বলল, আমি মিষ্টি ছাড়া আর কিছু ডাকতে পারব না—

তার দিকে না ফিরে এবার একটু নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল, তেমন ডাকা—ডাকির চান্স পাচ্ছ কোথায়…।

বাপী ভিতরে ভিতরে থমকালো। এই জবাব আশা করেনি। আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে হাল্কা গলায় জোর দিয়ে বলল, আমি কোনো চান্সের ওপর নির্ভর করি না, গত আট বছর ধরেই ডেকে চলেছি, কোনো একটা দিনও বাদ পড়েনি।

মিষ্টি ঘাড় ফিরিয়ে সোজা তাকালো এবার। মুখ আরো একটু গম্ভীর। কিন্তু ঠোঁটে হাসির আভাস। চোখের কোণেও। তবু বাপীর মনে হল এতক্ষণের সহজ স্পষ্টতা থেকে ওর যেন একটু তফাতে সরার চেষ্টা। মন্তব্যের সুরে মিষ্টি বলল, ভালো কথা নয়। সঙ্গে সঙ্গে এ-প্রসঙ্গ বাতিল।—কটা দোকান তো পার হয়ে গেল, চা খাওয়াবে কোথায়?

বাপী অপ্রস্তুত।—তাই তো, তোমাকে কাছে পেয়ে কেমন দিশেহারা দেখো…ভুলেই গেছলাম।

কাছে পাওয়ার কথাটা এমন নিঃসংকোচে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে যে মিষ্টি আবারও না তাকিয়ে পারল না। বাপী বুঝল। কিন্তু বুকের ভিতরটা তার ভরাট এখন। মনে মুখে লাগাম নেই। বরং ওই মুখের বিড়ম্বনাটকু রসিয়ে দেখার মতো।

সামনের বড় রেস্তরাঁয় ঢুকে পড়ল। পাশে মিষ্টি। বাপীর বাদশাই মেজাজ। পর্দা ঠেলে একটা ক্যাবিনে বসল। মুখোমুখি মিষ্টি। বেয়ারা হাজির।

—চায়ের সঙ্গে আর কি খাবে বলো।

দু চোখ মুখের ওপর তুলে মিষ্টি কিছু বুঝতে চেষ্টা করল।—সেই সকাল দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করলে, সমস্ত দিনে তোমার খাওয়া হয়েছে কিছু?

কথাগুলো একটু দরদের স্পর্শের মতো কানের ভিতর দিয়ে বুকের দিকে এগোতে থাকল। বাপীর খুব ইচ্ছে হল মাথা নাড়ে, বলে হয়নি। বলা গেল না। এই দিনে কোনো মিথ্যের জায়গা নেই। সরস সত্যি জবাবই দিল।—ভাগ্যটাকে ভালো করার ঝোঁকে অন্য দিনের থেকে আজ বরং ভালো খাওয়া হয়েছে।

—তাহলে শুধু চা-ই হোক।

—তা কখনো হয়। বাপী সাগ্রহে টেবিলের মেনু কার্ড দেখতে লাগল। কিন্তু কি ছেড়ে কি আনতে বলবে ভেবে পেল না। আজ কোনো হিসেবের দিন নয়। মেনু কার্ডে যা আছে সব আনতে বললে কি হয়?

কিন্তু চায়ের সঙ্গে মিষ্টি শুধু একটা মাছের ফ্রাই ছাড়া আর কিছু নিতে রাজি হল না। অগত্যা দুজনেরই তাই। অর্ডার নিয়ে বেয়ারা চলে গেল। মিষ্টি বাপীর দিকেই চেয়ে আছে। ব্যস্ততা দেখে টিপটিপ হাসছে।

—ছেলেবেলায় তুমি কিন্তু বেশ খেতে ভালবাসতে।

—মিষ্টি চট করে জবাব দিল, ছেলেবেলা আর কদিন থাকে।

বাপীর আবারও মনে হল, প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর এই মেয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিচ্ছে। কথা কম বলছে। শুনছে বেশি। দেখছে আরো বেশি। শোনা বা দেখাটা নিরাসক্ত নয় অবশ্য। দেখে শুনে বা বুঝে পা ফেলার মতো শুধু নিজের সম্পর্কেই সতর্ক একটু। অস্বাভাবিক নয়। বাপীর ছেলেবেলাটা এই মেয়ের কাছে এক বিষম স্মৃতি বটেই। তাই ছেলেবেলা নাকচ করে ওকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা।

কিন্তু বাপীর কাছে তার ছেলেবেলার জোরটাই সব। সেই জোরেই এ মেয়ের আজ দু-দুটো ক্লাস কামাই। সেই জোরেই আট বছর বাদে মুখোমুখি হবার সঙ্গে সঙ্গে কালো চোখের গভীরে আগ্রহের বন্যা। নিজেকে নিয়ে ও এখন একটু হিসেবী হয়ে উঠছে মনে হতে বাপীর মজাই লাগছে।

বয় বড় ডিশে দুটো ফ্রাই এনে দুজনের সামনে রাখল। আনুষঙ্গিক টুকি-টাকি আরো কিছু সাজিয়ে দিয়ে গেল। অভ্যস্ত হাতে মিষ্টি কাঁটা-চামচ তুলে নিতে সপ্রতিভ মুখে বাপী বলল, আমি এখনো জংলিই থেকে গেছি—এ দুটো ঠিক চলবে না।

জবাবে অতি-আধুনিকতার বক্রাভাস কিছু দেখা গেল না। বরং শুনে এবং বুঝে যা করল সেটুকু আরো মিষ্টি। নিজের কাঁটা-চামচ ডিশের একপাশে রেখে বেল বাজালো। বয় আসতে বলল, ওয়াটার বোউল—

হাতের চায়ের পট আর পেয়ালা সমতে ট্রে-টা টেবিলে রেখে বয় গেল আর ফিরল। এক ট্রেতে মাঝারি আকারের দুটো সাদা বাটি। তাতে হাত ধোয়ার গরম জল।

আট বছর বাদে দাক্ষিণ্যের ভরা ডালিসুদ্ধ খসে পড়ার মতোই দিন এটা। বাপীর দুচোখে লোভ চিকিয়ে উঠছে কিনা জানে না। উঠলেও এখন আর বাপী একে ঠিক লোভ বলতে রাজি নয়। সামনে যে বসে তাকে আর নিছক লোভের দোসর ভাবতে চায় না। আরো কিছু। ঢের বেশি কিছু।

মিষ্টি টান হয়ে বসে আছে এখন। পরিপুষ্ট দু হাতের কনুই টেবিলের ওপর। দু হাতের দু জোড়া আঙুলের মাথায় ফ্রাইটা ঝুলছে। অল্প অল্প দাঁতে কাটছে আর টুকটাক এটা সেটা জিজ্ঞাসা করছে। বাপী জবাব দেবে, না এই সহজ সুঠাম ভঙ্গীটুকু দেখবে?

মিষ্টি পিসীর কথা জিজ্ঞাসা করল। তারপর বাবার কথা। কেউ নেই শুনে চাউনি উতলা একটু।—তোমার আর কে থাকল তাহলে?

কে থাকল বলায় একটা অদম্য লোভ ঠেলে তল করতে হল। কিন্তু চোখে গোপন থাকল না বোধ হয়। কারণ এই চোখে চোখ পড়তে মিষ্টির দুই হাতের আঙুলে ঝোলানো ফ্রাইয়ে বড় কামড় পড়ল একটা। চকচকে দাঁতের সারি দেখা গেল। দৃষ্টিও প্লেটের দিকে নেমে এলো।

একটু পরেই ঠোঁটের ফাঁকে আবার চাপা হাসি।—তোমাদের সেই বনমায়ার খবর কি?

প্রসঙ্গান্তর সরস বটে।—গত চার-পাঁচ বছরের খবর রাখি না। তার আগে পর্যন্ত বছরে একবার করে সাধ্বী মেয়ের মতো বনমায়া সেই একই পুরুষ-হাতির সঙ্গে শিকল ছিঁড়ে পালিয়েছে আর ওর সময়মতো ফিরেও এসেছে। এখনো সেই রকমই চলছে মনে হয়।

মিষ্টির মুখে লালের ছোপ একপ্রস্থ। সেধে বিড়ম্বনা ডেকে আনা। তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করল, আর তোমার জঙ্গল-গুরু সেই আবু রব্বানী?

বাপী হাসছে মিটিমিটি।…বীটম্যান হবার পর সেও এক বীটম্যানের বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে দেখেছিলাম। সেই লোকটা মদে বেহুঁশ হয়ে থাকে, আর হুঁশ ফিরলে বউ ঠেঙায়। আবু তার লিভার পচে মরার অপেক্ষায় ছিল, এতদিনে বউটাকে নিজের ঘরে এনে তুলতে পেরেছে বোধ হয়।

—কি বিচ্ছিরি। মিষ্টির মুখ আরো লাল। ফ্রাইয়ের শেষের সামান্যটুকু ডিশে ফেলে রুমালে হাত মুছে চায়ের পটসুদ্ধ ট্রে-টা কাছে টেনে নিল।

বাপীর আগেই খাওয়া হাত-মোছা শেষ। টেবিল থেকে মিষ্টির মোটা বইটা হাতে তুলে নিল। খুলে দেখল, ইংরেজি ইতিহাস বই। আর একটু কাছে তুলে সন্তর্পণে নিঃশ্বাস নিল। প্রত্যাশিত একটা সুবাস বইটার মধ্যেও ছড়িয়ে থাকতে পারে।

বইটা আবার যথাস্থানে রেখে জিগ্যেস করল, হিস্ট্রি অনার্স পড়ছ?

চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে মিষ্টি মাথা নেড়ে সায় দিল।

—থার্ড ইয়ার তো?

—তুমি জানলে কি করে?

—আমার হিসেব আছে। ম্যাট্রিকে তুমি ইতিহাস আর সংস্কৃতয় লেটার পেয়েছিলে, আই-এতে শুধু ইতিহাসে। হিংসেয় আমার বুক চড়চড় করেছিল। এখন আনন্দ হচ্ছে।

মিষ্টির দু চোখ এবার যথার্থ বিস্ফারিত।

খুশির মেজাজে রহস্যটা এবারে নিজেই ফাঁস করল বাপী। তোমার পাশের দু বছরের দুটো গাবদা গেজেট আমাকে পড়তে হয়েছে—কলকাতার সব কটা মালবিকা নন্দীর থেকে ঠিক তোমাকে বেছে নিয়েছি।

এই ছেলের অসাধ্য কি, মিষ্টি যেন নতুন করে আবার তাই দেখছে। চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিল। নিজের পেয়ালা কাছে টেনে নিল। এখন গম্ভীর-গম্ভীর। কেন বাপী আঁচ করতে পারে। আজও ও কত আগ্রহ আর কত কৌতূহল নিয়ে বসে আছে সেটা বড় বেশি স্পষ্ট।

—গেজেট পড়ে তোমার হিংসে হত কেন? নিজে ওদিক মাড়াওনি?

আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে বাপীর নিজেরও বলার তাগিদ। জানানোর তাগিদ ছেলেবেলার মতো প্রবৃত্তিসর্বস্ব হয়েই গত আটটা বছর কাটিয়ে দেয়নি। নিজের বিদ্যে-বুদ্ধির বড়াই কখনো করেনি, আজও করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এই একজনেরই যেন ওর সবটুকু জানা দরকার, চেনা দরকার, বোঝা দরকার।

তাই বরাতজোরে নিজের ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করার কথাটা এসেই গেল। পাশের পরে জঙ্গলের ছোট কেরানীর চাকরি না নেওয়ার জন্য বাবার সঙ্গে মন-কষাকষি আর বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি পালানোর কথাও। তারপর চার-চারটে বছর টিউশনের জোরে আর কপালজোরে আই. এসসি. আর ডিস্টিংশনে বি. এসসি. উতরে যাওয়ার বৃত্তান্ত

হালকা চালেই বলেছে। প্রাণান্তকর অনিশ্চয়তা বা অনটনের দিকটাও ফাঁপিয়ে তোলেনি। মিষ্টির অপলক দু চোখ ওর মুখের ওপর। যেটুকু বোঝার বুঝেছে হয়তো।

—তারপর কলকাতায় কি, চাকরি না এম. এসসি.?

বাপী হাসতে লাগল।—চাকরি। এখানকার এক বন্ধুর সাহায্যে একটা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি যোগাড় করে চলে এসেছিলাম। দেড় মাসের ওপর হয়ে গেল সেটাও গেছে—

পরের প্রশ্নটা যাতে করে সেই আশা নিয়েই বাপী ওরকম হাসছিল। —চাকরি গেল কেন?

—যুদ্ধের আপিসের টেম্পোরারি চাকরি…তবে আমার গেল অন্য কারণে। হাসিটুকু এখন শুধু চোখে লেগে আছে বাপীর।— সেখানকার বড়বাবুর এক মাত্র মেয়েকে বিয়ে করে গলায় ঝোলাতে রাজি হলে চাকরিতে প্রমোশন হত আর তাদের বাড়িটাও দখলে আসত। রাজি হলাম না বলে সেই মেয়ে যেমন মনমরা তার বাপের তেমনি রাগ। এই দুইয়ের ধাক্কায় চাকরি খুইয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম।

যেভাবে বলল, মিষ্টিরও হেসে ফেলার কথা। কিন্তু মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। শোনার পর চায়ে মনোযোগ।

মিনিট পনের বাদে পায়ে পায়ে বড় ময়দানের দিকে আসছিল দুজনে। ময়দানের অন্য প্রান্তে সেই সভা। গান্ধী-প্রয়াণের শোকসভা। আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারির দশ কি এগারো তারিখ এটা। এরই মধ্যে বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। দুজনের কারো সঙ্গেই গরম কিছু নেই। কিন্তু বাপী অন্তত ঠাণ্ডা গরম কিছুই টের পাচ্ছে না।

এবারে সামনের রাস্তার দিকে এসে মিষ্টি দাঁড়িয়ে গেল। স্বাভাবিক সুরেই বলল, আর দেরি করলে মায়ের বকুনি খেতে হবে।

বাপীও মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ যাবৎ কেন যেন চিনচিন করছে ভিতরটা। সেটা আরো বাড়ল। আবার কবে দেখা হবে?

—অনার্স ক্লাস তো বেশি কামাই করা চলে না, ওদিকে ক্লাস শেষ হবার আগেই দাদুর গাড়ি এসে হাজির হয়—

—আমি জিজ্ঞেস করছি, আবার কবে দেখা হবে?

মিষ্টির দু চোখ এবারে ওর মুখের ওপর থমকে রইল।—তুমি থাকো কোথায়?

শিরায় রক্তের তাপ বাড়ছে বাপীর। গড়গড় করে বলে গেল, ভবানীপুরের টালি কোয়াটারস-এ। আসলে সেটা একটা টালির বস্তি। পঁচিশ ঘর বাসিন্দা থাকে। চাকরি যাবার পর সে অফিসের পিওন রতন বনিক আর তার বউ কমলা বনিক সেখানে তাদের একটা খুপরি ঘরে আমাকে আদর করে রেখেছে।…শুনে আরো ঘাবড়ে গেলে বোধ হয়?

হকচকিয়ে গেল যে তাতে কোনো ভুল নেই। বাপীর দু চোখ তার মুখের ওপর এঁটে বসল আরো।—শোনো মিষ্টি, কেরানীগিরির চাকরির আশায় আমি কলকাতায় ছুটে আসিনি—এসেছি একদিন না একদিন তোমার দেখা পাব বলে! আজই আমি খুব ভালো করে জেনেছি, লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হওয়াটা যেমন

আমার অদৃষ্ট নয়, রতন বনিকের বস্তিতে থাকাটাও তেমনি আর বেশিদিনের সত্যি নয়। সব বদলাবে, একেবারে অন্য রকম হয়ে যাবে—তুমি চাইলেই হবে।

মিষ্টি শুনছে। চেয়েও আছে। ঠোটের ফাঁকে একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা।— ভালো কথা তো, আমি চাইব না কেন…

—তাহলে কবে দেখা হবে, কাল বিকেলে তোমাদের বাড়ি যাব?

মিষ্টি যেন নিজের সঙ্গেই যুঝছে।—পাড়ার সেই ছেলের দঙ্গল আছে না? বাড়িতে মা আছে না? মায়ের আজকালকার মেজাজ জানো?

বাপী কানেও নিতে চাইল না। পাড়ার ছেলেদের আমি পরোয়া করি না। মায়ের ভাবনা তোমার। যাব?

মিষ্টির ঠোটের ফাঁকের আয়াসের হাসিটুকু মিলিয়ে যেতে লাগল। আয়ত কালো দু চোখ বাপীর মুখের ওপর স্থির হয়ে বসতে লাগল। দেখছে। দেখছেই। অপলক।

—দেখা করতেই হবে?

—দেখা করতেই হবে।

—তাহলে এসো।…তবে বাড়িতে নয়।

—কোথায়?

—লেক চেনো?

মাথা নাড়ল। চেনে!

একটা নিশানা বলে দিল।——কাল বিকেল সাড়ে চারটেয় এসো। আমি বাসে চলে যাচ্ছি, সঙ্গে আসার দরকার নেই।

উল্টো দিক থেকে বাস আসছে একটা। হনহন করে রাস্তা পার হয়ে গেল। বাস এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে উঠে পড়ল।

বাসটা ছেড়ে যাবার পরেও বাপী নিশ্চল দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষণের একটা দমবন্ধ নিঃশ্বাস আস্তে আস্তে মুক্তি পেয়ে বাঁচছে।

.

রাতের খাবার কে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছল বাপী জানে না। সকালে আজও চা-রুটি নিয়ে রতন বনিক ঢুকল। কমলা নয় অর্থাৎ কমলা বনিকের রাগ হোক বা আর কিছু হোক এই দুদিনেও সেটা তেমনি আছে।

সে না আসায় গতকালের থেকে আজ আরো বেশি স্বস্তি।…কমলা বনিকের সামনে সেদিনের সেই হিংসলোলুপ মুহূর্তের ছায়াসুদ্ধু মুছে দিতে পারলে বাপী তরফদারের আত্মশুদ্ধি হত। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কমলার পরের আচরণ ভোলেনি। আজকের এই দিনে বাপী সেই স্মৃতি থেকেও নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসতে চায়।

রতন বলল, আজ আবার একটু ফ্যাসাদ হয়েছে বিপুলবাবু, নাইট ডিউটি পড়েছে। ওই দেমাকীকে বুঝিয়ে বললাম, আজকের রাতে অন্তত আপনার খাবারটা যেন দিয়ে যায়। কিছু বলল না… দেবে নিশ্চয়, রাগ করুক আর যাই করুক, আপনার ওপর দরদ তো একটু আছেই—

বাপীর মুখে গরম চায়ের ছেঁকা লেগে গেল। তাড়াতাড়ি বাধা দিল, না-—না, তার কিছু দরকার নেই, রাতে আমি খেয়ে আসব।

—তা কি হয়!

বাপী সত্যি বিরক্ত।—–কথা শোনো, রাতে আমার এক জায়গায় খাবার কথা আছে, আমি নিজেই তোমাকে বলতাম—ওকে বারণ করে দাও আজ খাবার রাখার দরকার নেই।

বাপী মিথ্যে বলেনি খুব। সকালে ঘুম ভাঙতেই ভেবে রেখেছে বিকেলের কথাবার্তার পর সন্ধ্যায় মিষ্টিকে কোনো ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাতের খাওয়া সারবে। মিষ্টির কোনো ওজরআপত্তি শুনবে না।

বেলা বারোটা নাগাদ একেবারে তৈরি হয়ে বেরুলো। আগে ব্যাঙ্ক থেকে কিছু টাকা তুলতে হবে। এ মাসের খরচটা হিসেবের মধ্যে থাকবে না। সঙ্গে কিছু টাকা থাকা ভালো। তারপর দুপুরে কোথাও যা হোক কিছু খেয়ে নেওয়া। তারপরের সময়টুকু কি করে কাটাবে সে দেখা যাবে।

ঘরের বাইরে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে পড়তে হল। ও-ঘরের দাওয়ার সামনে কাঠের থামে ঠেস দিয়ে কমলা দাঁড়িয়ে। একঝাঁক খোলা শুকনো চুল পিঠে ছড়ানো। চান করেনি এখনো।

ওকে দেখে একটুও নড়ল না। চোখ বেঁকিয়ে তাকালো।

বাপী তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে উঠোনে নামল। তারপরেই সহজ হওয়ার তাড়না একটু। না এগিয়ে কমলার দিকে ফিরল।—রাতে খাবার রাখার দরকার নেই, রতন বলেছে তো?

কমলা জবাব দিল না। মাথাও নাড়ল না। সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। সেই রকমই চেয়ে রইল।

এবারে বাপীর দ্রুত প্রস্থান। ওই চাউনি নিয়েই কমলা যেন সারা গায়ে জলবিছুটি ছড়িয়ে দিল খানিকটা। আর বলতে চাইল, যত ভালো মুখ করেই থাকো, তোমার ভেতর দেখা চেনা আর বোঝা আমার হয়ে গেছে।

বাইরে এসে বাপী সেই দিনটার জন্য নিজেকেই চাবকাতে চাইল আর এক প্ৰস্থ।

অনেক ধৈর্য আর অনেক প্রতীক্ষার সেই বিকেল। ঘড়িতে চারটা পঁচিশ। দূরে দাঁড়িয়ে বাপী দেখল যেখানে থাকার কথা, মন্থর পায়ে মিষ্টি সেদিকে চলেছে। বাপী আরো বিশ মিনিট আগে থেকে একটু আড়াল নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে।

দু’চোখে খুশি উপচে উঠল। ডাকল না। নিজেও তক্ষুনি এগিয়ে এলো না। এই দেখাটুকু বাড়তি পাওনার মতো। আজ ফিকে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। মিষ্টি তো জানেও না এই রংটা বাপীর কত পছন্দ।

মিষ্টি বেঞ্চিতে বসল না। পায়ে পায়ে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। পিছন ফিরে একবার চারদিক থেকে নিয়ে আবার জল দেখতে লাগল।

বাপী এগিয়ে এলো। হাসিতে খুশিতে উদ্ভাসিত মুখ। মিষ্টি ঘুরে দাঁড়াল।

তার ঠোঁটে বা চোখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। কাল বাসে ওঠার আগে যেমন দেখেছিল তেমনি চাউনি। তারপর সামনের রাস্তাটায় দৃষ্টি ফেরালো একবার।

বাপী অবাক একটু।—কি?

মিষ্টি জবাব দিল না। তেমনি চেয়ে রইল। পরক্ষণে দু’চোখ আবার ওই রাস্তার দিকে। কি ব্যাপার ভেবে না পেয়ে বাপীও সেদিকে ঘাড় ফেরাতেই সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি একটা। মাথার মধ্যিখানে আচমকা একটা মুগুরের ঘা পড়েছে।

…হনহন করে এদিকে আসছে একজন। এসে গেছে। চেনা মুখ। পরনে ট্রাউজার আর সিল্কের শার্ট। ফর্সা রং। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। মিষ্টিদের উল্টো দিকের বাড়ির দোতলার সেই একজন। পাড়ার ছেলেদের অসিতদা।

বিমূঢ় মুখে মিষ্টির দিকে ফিরল বাপী। পরমুহূর্তে শরীরের সমস্ত রক্ত মাথার দিকে ধাওয়া করল। মিষ্টির ঠোটের ফাঁকে এখন একটু হাসির আভাস।

সোনালি চশমা হাজির।—এই যে ব্রাদার, মালবিকার কাছে তোমার ছেলেবেলার কিছু কথা আর কালকের অ্যাডভেঞ্চারের কথা শুনলাম। সেদিন গলাধাক্কা খেয়েও শিক্ষা হল না, আজ যে ভায়া আরো কপাল মন্দ।

মুখের কথা শেষ হবার আগেই কোথা থেকে আরো তিন-তিনটে ছেলে ছুটে এলো। পাড়ার সেই ছেলেরাই। এসেই একজন জামার বুকের কাছটা মুঠো করে ধরল।

—এই যে চাঁদ, আজ তোমাকে কোন বাবা রক্ষা করবে?

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বলে উঠল, না অসিতদা, আজ আর তোমার কোনো কথা শুনছি না—চাঁদুকে তুমি আমাদের হাতে ছেড়ে দাও, আমরা ওদিকে নিয়ে গিয়ে যা বোঝাবার বেশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু পলকের মধ্যে যা ঘটে গেল তার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। যে ছেলেটা জামা চেপে ধরেছিল, মিষ্টির দু হাতের আচমকা ধাক্কায় তার হুমড়ি খেয়ে পড়ার দাখিল। মিষ্টির মুখ টকটকে লাল, ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত গলার স্বর।—এ কি? এদের কে আসতে বলেছে। ও যাতে বুঝতে পারে সেইজন্য আমি তোমাকে আসতে বলেছিলাম—তুমি এদের এনেছ কেন?

সোনালি চশমার ভেবাচেকা মুখ। ছেলে তিনটেরও। ওই তিনজনের দিকে ঘুরে মিষ্টি আবার ফুঁসে উঠল, যাও বলছি এখান থেকে—চলে যাও!

ছেলে তিনটে গুটিগুটি সরে দাঁড়াল একটু। রমণীর মতিগতির কুলকিনারা পাচ্ছে না তারা।

কিন্তু বাপীর পৃথিবী উল্টে গেছে। মাথায় সেই পুরনো আগুন দ্বিগুণ জ্বলে উঠেছে। বুকের পাতালের শূন্য গুহায় সেই জানোয়ারের দাপাদাপি। সবার আগে ওই মেয়ের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্রূর অভিলাষ।

বাপী গলার স্বর চড়া নয়, কিন্তু সকলের শোনার মতো। মিষ্টিকে বলল, আর বোঝানোর দরকার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি।…তোমার এই বীরপুরুষেরা যদি মায়ের ছেলে হয়, একে একে আসতে বলো, এই চারজনকেই লেকের জল খাইয়ে আনতে পারি কিনা দাঁড়িয়ে দেখো।

….কি! সোনালি চশমা রুখে এলো।

চকিতে মিষ্টি এগিয়ে এসে বাধা দিল আবার।—থাক্ হয়েছে। বাপীর দিকে ফিরল। গলার স্বর তপ্ত।—বুঝে থাকলে চলে যাও। আর এসো না।

.

রাত অনেক। সেদিনের পুলিশের লাঠির খোঁচা মনে ছিল। এত হেঁটেও পা দুটোকে অবশ করা গেল না। বাপী তরফদার ঘরের দিকে চলেছে এখন। মুখে আবার আট বছর আগের সেই রক্তের স্বাদ। ভিতরের জানোয়ারটা অবিরাম ফুঁসছে। গজরাচ্ছে।

টালি এলাকার নিঝুম উঠোন পেরিয়ে নিঃশব্দে দাওয়ায় উঠে এলো। খুপরি ঘরের দরজা ঠেলতে ক্যাঁচ করে সেই পুরনো শব্দ একটু। আজ খাবার ঢাকা নেই, তাই ডীম-করা হারিকেনও নেই। জামাটা খুলে ঘুটঘুটি অন্ধকারে দড়ির ওপর ফেলল। তারপর শরীরটা খাটিয়ার ওপর আছড়ে পড়তে চাইল।

কিন্তু এ কি! এ কি! এ কি!

মাথায় বিদ্যুত্তরঙ্গ। ভালো করে বোঝার আগেই অন্ধকারে ওই শয্যা থেকে দুটো হাত অমোঘ নিবিড় বেষ্টনে তাকে বুকের ওপর টেনে নিল। রমণীর হাত। রমণীর বুক। সর্বাঙ্গে তপ্ত স্পর্শের তড়িৎপ্রবাহ। শুকনো দুটো ঠোঁট বিস্মৃতির উষ্ণ ঘন অধরের গ্রাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *