সোনার হরিণ নেই – ৩৩

তেত্রিশ

পরের একটা মাস বাপী কাজের মধ্যে ডুবে থাকল। মেয়েদের রূপ সাজে, পুরুষের কাজে। মনের অবস্থা যেমনই থাক, পুরুষের এই রূপটাকে বাপী কোনদিন অবহেলা করেনি। প্রাকপ্রচারের চটকে আর পার্টির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার ফলে শুরু থেকেই সোনা ফলার লক্ষণ দেখা গেছে। আবু রব্বানী এর মধ্যে তিনদফা ট্রাক বোঝাই মাল চালান দিয়েছে। চিঠিতে তার একবার কলকাতায় ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছের কথাও লিখেছে। দোকে এতদিন না দেখে ওর ভালো লাগছে না।

কিন্তু বাপীর কাছে আগে কাজ পরে দোস্তি। আর এক প্রস্থ মালের অর্ডার দিয়ে ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে। তাকে এখন আসতে নিষেধ করেছে। বানারজুলিতে এখন অনেক কাজ। ওর ওপরেই সব থেকে বেশি নির্ভর। গেল মাসে সেখানকার লেনদেনের হিসেব যা পাঠিয়েছে, তা দেখে বাপী আরো নিশ্চিন্ত। তার অনুপস্থিতিতে সেখানকার লাভের অঙ্ক কোথাও মার খায়নি। ফাঁক পেলে বাপী নিজেই একবার যাবে লিখেছে। কিন্তু তেমন ফুরসৎ যে শিগগির হবে না তা-ও জানে। জিত্ মালহোত্রার কাজেকর্মে বাপী খুশি। লোকটা যেমন চৌকস তেমনি তৎপর। বাপী কি চায় বা কতটা চায় মুখ চেয়ে বুঝতে পারে। তবু একা সে কত দিক সামলাবে। তেমন বিশ্বস্ত কাউকে পেলে বাপী এক্ষুনি টেনে নেয়। কিন্তু অজানা অচেনা লোক ঢুকিয়ে এতটুকু ঝুঁকি নেবার মধ্যে সে নেই। সেরকম দরকার হলে আবুকেই বরং বানারজুলি থেকে বুঝে শুনে কাউকে পাঠাতে বলবে।

কাজের চাপের মধ্যেও মাস্টারমশাইকে একবার করে দেখতে আসতে চেষ্টা করে। রোজ হয় না। যেদিন পারে না, জিকে খবর নিতে বলে দেয়। এ ব্যাপারেও লোকটার কিছু গুণ লক্ষ্য করেছে বাপী। মনিবের মাস্টার, তাই ওরও মাস্টারজি! তার মেয়েকে বলে মিস ভড়। অসুস্থ মাস্টারের প্রতি মনিবের এত দরদের হেতু ওই মেয়ে কিনা মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এই চালাক লোকটার মুখে কৌতূহলের আভাসও দেখেনি।

বাপীর ফ্ল্যাটে এখন দুজন কাজের লোক মোতায়েন। একজন আধাবুড়ো বাবুর্চি রোশন। ইউ-পিতে ঘর। খাসা রাঁধে। এক হোটেল থেকে জিত্ ওকে খসিয়ে এনেছে। জিতের রাতের ডিনার এখন এখানে বরাদ্দ। দুটো বেডরুমের একটাকে অফিস ঘর করা হয়েছে। সকাল দুপুরের বেশির ভাগ ঘোরাঘুরির মধ্যে কাটে। বিকেলের দিকে সে অফিস খুলে বসে। রাতে খেয়েদেয়ে মেসে ফেরে। বাইরে কাজ না থাকলে সকাল দশটা থেকে লাঞ্চ লাইম পর্যন্ত বাপী অফিসে বসে।

দ্বিতীয় কাজের লোকটার নাম বলাই। মিষ্টির মা মনোরমা নন্দীর সংগ্রহ। কথায় কথায় বাপী একদিন দীপুকে বলেছিল, ঘরের কাজ জানে আবার ফোন ধরে নাম-ঠিকানা লিখে রাখতে পারে এমন একজন বিশ্বাসী লোক খুঁজছে। তার দু’দিনের মধ্যে মনোরমা নন্দী একে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন। বছর উনিশ কুড়ি বয়েস। নাম ঠিকানা লিখতে পড়তে পারে কিনা জিগ্যেস করতে মুখে জবাব দিয়েছিল, ক্লাস ফাইভ ফেল, বাবা পড়ালে না বলে এই দুগ্যতি। বাপী তক্ষুনি তাকে বহাল করেছে। ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই দেখে মেঝেতে ইংরেজি কাগজ বিছিয়ে বলাই গম্ভীর মুখে চোখ বোলাচ্ছে। আর কিছু না হোক, এই কাগজ পড়া দেখেই বাবুর্চি রোশন তাকে সমীহ করে। নাম-ধাম খবর প্রয়োজন ইত্যাদি শুনে নিয়ে একটা খাতায় লিখে রাখে। মনিব ফিরলেই গড়গড় করে তাকে জানায়।

দীপুদার সঙ্গে মনোরমা নন্দীও একদিন এসে ফ্ল্যাট দেখে গেছেন। দরদী মাসির মতোই যতটুকু সম্ভব গোছগাছ করে দিয়ে গেছেন। বলাই আর রোশনকে সদাব্যস্ত সাহেবের খাওয়া-দাওয়া যত্ন আত্তি সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন। দীপুদা বাপীকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর কথা তুলতে বাপীই তাড়াতাড়ি বাধা দিয়েছে। ঘরের ছেলে, যখন খুশি যাব, গল্প করব, খাব—নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন করলেই নিজেকে পর পর লাগবে মাসিমা।

মাসিমা খুশি। কিন্তু ঘরের ছেলের এ পর্যন্ত তার বাড়ি যাওয়ার ফুরসৎ হয়নি। দীপুদা এ নিয়ে টেলিফোনে অনুযোগ করেছে। বাপী বলেছে, সকাল থেকে রাত কি করে কাটছে যদি দেখতে তোমার মায়া হত দীপুদা।

অন্তরঙ্গ আপ্যায়ন অসিত চ্যাটার্জির দিক থেকেও এসেছে। বাপীর একই জবাব। যাবে, কিন্তু আপাতত দম নেবার সময় নেই। তারপর সাদা মুখ করে জিজ্ঞাসা করেছে, নেমন্তন্নটা তোমার না মিলুর?

অসিত চ্যাটার্জি ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছে, আমি আর মিলু কি আলাদা? জানো আমার জন্য ও বাপের বাড়ি যাওয়াও ছেড়েছে প্রায়!

—তোমার জন্যে কেন?

লালচে দু ঠোঁট পুলকে টসটস।…পতির নিন্দা সতীর কাঁহাতক সয়। গেলেই তো আমার ঝুড়ি ঝুড়ি নিন্দে শুনতে হবে—

হেসেছে বাপীও। আর মনে মনে লোকটাকে জাহান্নমে পাঠিয়েছে।

ঊর্মিলা টেলিগ্রামে তাদের পৌঁছানো সংবাদ পাঠিয়েছিল। চার সপ্তাহ বাদে তার লম্বা চিঠি। বিজয় কাজে জয়েন করেছে। সকালে বেরোয়, রাতের আগে তার টিকির দেখা মেলে না। সপ্তাহে পাঁচদিন ওখানকার সব মানুষই কাজ-পাগল। বাকি দু’দিন ফুর্তি আর বেড়ানো। কিন্তু ঘরকন্নার কাজে ওরা এত ব্যস্ত যে বেড়ানোর ফুরসৎ মেলেনি। ঘরের সমস্ত কাজ মায় রান্না পর্যন্ত ঊর্মিলাকে নিজের হাতে করতে হয়। প্রথম প্রথম কান্নাই পেয়েছে। কিন্তু সকলেই তাই করছে দেখে সয়েও যাচ্ছে। লিখেছে, এত দূরে গিয়ে এখন সব থেকে বেশি মনে পড়ে বানারজুলির কথা। তাজ্জব দেশ অনেক আছে, কিন্তু বানারজুলি বোধ হয় আর কোথাও নেই। মা-কে শুধু মনে পড়ে না, মনে হয় মা যেন সেখানে তার অবাধ্য ছেলেটার আশায় একলা বলে দিন গুনছে। মায়ের সঙ্গে কোয়েলা, বাদশা ড্রাইভার, আর পাহাড়ের বাংলোর ঝগড়ুকেও খুব মনে পড়ে। মায়ের এই আশ্রিতদের ফ্রেন্ড কি ভুলে যাবে? তার পরেই খোঁচা। বানারজুলির আকাশ বাতাস পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে না পেলে ছেলেবেলার মিষ্টিকে কি আর অত মিষ্টি লাগত?

ঊর্মিলার দুষ্টুমি বাপী বুঝতে পারে। এইরকম করে মায়ের কথা আর বানারজুলির কথা লিখে ওকে কলকাতা থেকে সরাতে চায়। কিন্তু মিথ্যে লেখেনি। কাজে ডুবে থাকলেও মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে। বানারজুলি তখন বিষম টানে। ওই ঊর্মিলার থেকেও ঢের বেশি ঘরছাড়া মনে হয় নিজেকে। তার চিঠিটা পাওয়ার পর দু-তিন দিনের জন্য একবার বানারজুলি ঘুরে আসবে ঠিক করল। গিয়ে কাজ নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ওখানকার পাহাড়ে জঙ্গলে আগের মতোই নিজেকে ছড়িয়ে দেবে।

হল না। মাস্টারমশাই মারা গেলেন। ললিত ভড় চলে গেলেন।

আজীবন মানুষটা একটাই মুক্তি চেয়েছিলেন। ক্ষুধার মুক্তি। শুধু নিজের নয়, সক্কলের। এমন চাওয়ার খেসারত অনেক দিয়েছেন। এবারে সত্যিই মুক্তি। তাঁর বেঁচে থাকার মধ্যে তবু কিছু সোরগোল ছিল। গেলেন বড় নিঃশব্দে। গভীর রাতে বাপীর একবার খোঁজ করেছিলেন নাকি। একটু ছটফটও করেছিলেন। এমন প্রায়ই হয়। তাই শেষ ঘনিয়েছে কুমকুম ভাবেনি, কারণ অন্যদিনের মতোই খেয়েছেন। ঘুমিয়েছেন। রাত তিনটে নাগাদ মেয়েকে ডেকেছেন। ভোর হতে দেরি কত জিজ্ঞেস করেছেন। তখনো সাংঘাতিক কিছু কষ্ট হচ্ছে বলেননি। কেবল বলেছেন, ঘরে বাতাস এত কম কেন! বাবার মুখ দেখে আর শ্বাসকষ্ট দেখে কুমকুমের অবশ্য খারাপ লেগেছে। কিন্তু অত রাতে কি আর করবে সকালের অপেক্ষায় ছিল।

সকাল পাঁচটার মধ্যে শেষ।

বাপী কুমকুমের টেলিফোন পেয়েছে সকাল ছ’টায়। বাড়িঅলার ঘর থেকে ফোন করেছে, বলাই ধরেছিল। সাহেবের নিকট-কেউ অসুস্থ খুব, এ ক’দিনের মধ্যে বলাইয়ের জানা হয়ে গেছিল। কারণ, এই মেয়ে-গলার টেলিফোন সে আরো দিন দুই ধরেছে, আর একজনের শরীরের খবর সাহেবকে জানাতে হয়েছে। যেতে না পারলে সন্ধ্যার পর টেলিফোনে খবর দেবার কথা কুমকুমকে বাপীই বলে রেখেছিল।

দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি বার করে বাপী বেরিয়ে পড়ল। উল্টো দিকে দু মাইল গাড়ি হাঁকিয়ে জিকে তার মেস থেকে তুলে নিল। আজ পর্যন্ত নিজের চোখে তিন-তিনটে মৃত্যু দেখেছে। পিসি, বাবা, গায়ত্রী রাই। না, আরো দুটো দেখেছে। বনমায়ার আর রেশমার। এই এক ব্যাপারে বাপীর নিজের ওপর এতটুকু আস্থা থাকে না। ভিতরে কিছু গোলমেলে ব্যাপার হতে থাকে।

…প্রসন্ন ঘুমে গা ছেড়ে শুয়ে আছে মানুষটা। চোখ দুটো আধ-বোজা। দুনিয়ার কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অভিযোগ রেখে গেছেন মনে হয় না। বাপী অপলক চোখে দেখছিল।

—শেষের ক’টা দিন বড় ভালো কাটিয়ে গেলাম রে। আর কত খেলাম! বাপী চমকে এদিক-ওদিক তাকালো।…ক’দিন আগে মাস্টারমশাই বলেছিলেন কথাগুলো। মনে হল, এখনো তাই বলছেন।

কুমকুমের মুখে রাতের বৃত্তান্ত শুনল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টনটনে জ্ঞান ছিল। কুমকুমের বিবর্ণ, বিষণ্ণ মুখ। কিন্তু কাঁদছে না। বাপী তাইতেই স্বস্তি বোধ করছে। এ-সময়ে কারো আছাড়ি-বিছাড়ি কান্না শুনলে বা দেখলে আরো দম বন্ধ হয়ে আসে। ভেবেছিল, সেই রকমই দেখবে। আশ্রয় বা অবলম্বন খোয়ানোর ত্রাসে শোক অনেক সময় বেশি সরব হয়ে ওঠে। কুমকুমের বেলায় সেরকমই হবার কথা। বাপী মেয়েটার বিবেচনা আর সংযমের প্রশংসাই করল মনে মনে!

এক ঘণ্টার মধ্যে জিত্ সৎকার সমিতির গাড়ি ভাড়া করে খাট আর ফুল নিয়ে হাজির। আর যা-কিছু দরকার শ্মশানে পাওয়া যাবে।

চিতা জ্বলে উঠতে জিকে বাপী তার ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিল, কাজের মৌসুমে একসঙ্গে দুজনেই আটকে থাকলে চলে না।

বিকেল তিনটের মধ্যে মর-দেহ ছাই। কুমকুমকে আগে নিজের গাড়িতে তার বাড়ি পৌঁছে দিল। ওপরতলার বাড়ি-অলা আর তার স্ত্রী সদয় হয়ে ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে ঘর দুটো ধোয়ার কাজ সেরে এসেছে। দাহ-অন্তে কুমকুম গঙ্গায় স্নান করেছে। জিতের কেনা চওড়া খয়রা-পেড়ে কোরা শাড়ি পরেছে। অত শোকের মধ্যেও মুখখানা কমনীয় লাগছিল। নিজের ফ্ল্যাটের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বাপী তার কথাই ভাবছিল। আগে মাস্টারমশাইকে নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন তিনি নেই বলে সমস্যা।

ফ্ল্যাটে পা দিতেই বলাই জানালো, পার্টির ফোন পেয়ে জিত্ সাহেব বেরিয়ে গেছেন। আর, খানিক আগে জামাইবাবু টেলিফোন করেছিলেন।

বাপী অবাক।—জামাইবাবু কে?

—আজ্ঞে…..ও বাড়ির দিদিমণির বর, নন্দী সাহেবের ভগ্নীপতি….

এবারে বুঝল। বাপীর কেন যেন মনে হল মনোরমা নন্দীর পাঠানো লোককে রাখার ব্যাপারে আর একটু চিন্তা করা উচিত ছিল। জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি আর জামাইবাবুকে তুমি চেনো?

খবর দিয়ে আবার কি ফ্যাসাদে পড়া গেল বেচারা ভেবে পেল না। জামাইবাবু বা দিদিমণি বললে নিজের কদর হবে ভেবেছিল। সাহেবের চাউনি দেখে অন্যরকম লাগছে। এবারে সত্যি জবাব দিল। পিওনের চাকরির আশায় নন্দী সাহেবের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে যেত, সেখানে ওঁদের দুই-একদিন দেখেছে…ও চেনে, তাঁরা ওকে চেনেন না।

ফোনে কি বলল জিজ্ঞাসা করতে বলাই আর জামাইবাবু শব্দটা মুখে আনল না। জানালো, সাহেব নেই শুনে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন কোথায় গেছেন, কখন ফিরবেন। বলাই বলেছে কখন ফিরবেন ঠিক নেই, সাহেবের একজন নিকটজন মারা যেতে খুব সকালে সেখানে গেছেন, পরে সেখান থেকে শ্মশানে চলে গেছেন। কে নিকটজন ভদ্রলোক তাও জিগ্যেস করেছিলেন কিন্তু ও আর কিছু জানে না বলে এর বেশি বলতে পারে নি।

শোকের খবর নিতে অসিত চ্যাটার্জি বিকেলে এসে হাজির হতে পারে ভেবেও বিরক্তি।

অবেলায় অনেকক্ষণ ধরে চান করল। তারপর কিছু খেয়ে বিছানায় গা ছেড়ে দিল। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। মাস্টারমশায়ের অনেক স্মৃতি চোখে ভাসছে। সে—সব ঠেলে সরিয়ে মাথাটাকে খানিকক্ষণের জন্য শূন্য করে দেওয়ার চেষ্টা।

একটু বাদে তাতেও বাধা পড়ল। হলঘরে ফোন বেজে ওঠার শব্দ কানে এলো। পাঁচটার পরে পার্টির টেলিফোন আসে না বড়। জিত্ হতে পারে। দু-হাতে ফোনটা নিয়ে বলাই ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল। সাহেব শোবার ঘরে থাকলে তাই রীতি। হল-ঘর ছাড়া অন্য দুটো ঘরেও ফোন রিসিভ করার প্লাগ পয়েন্ট করে নেওয়া হয়েছে এই জন্যেই। বলাই-এর শঙ্কিত মুখ দেখে বাপীর মনে হল অসিত চ্যাটার্জিরই ফোন আবার। শোকের খবর নেবার আগ্রহে চলেই আসে নি সেটা মন্দের ভালো। আসতে চাইলে কোনো অজুহাতে বারণ করা যাবে। প্লাগ করে দিয়ে বলাই তক্ষুনি সরে গেল।

বাপী শুয়ে শুয়েই রিসিভার কানে লাগিয়ে ক্লান্ত-গম্ভীর সাড়া দিল, হ্যালো…

—আমি মিষ্টি।

শোয়া থেকে বাপী উঠে বসল একেবারে। ঠাণ্ডা স্পষ্ট দুটো কথা কানের ভিতর দিয়ে ভিতরের কোথাও নামতে থাকল। বাপী ফের সাড়া দিতে ভুলে গেল।

নীরবতার ফলে লাইন কেটে গেল ভেবে ওদিকের গলার স্বর সামান্য চড়ল।—হ্যালো।

—হ্যাঁ, বলো।

—তোমার কে আত্মীয় মারা গেলেন শুনলাম…কে?

জেনেও বাপী জিজ্ঞেস করল, কার কাছ থেকে শুনলে?

—অফিস থেকে টেলিফোন করেছিল। বলল, তোমার কোন আত্মীয় মারা গেছেন, তুমি শ্মশানে চলে গেছ।…তোমার তেমন নিকট-আত্মীয় কে আছেন আমি ভেবে পেলাম না।

—আত্মীয় নয়। খুব কাছের একজন।

চুপ একটু।—কে?

—তুমি চিনবে না।

—ও আচ্ছা, এই জন্যেই ফোন করছিলাম।

—কোথা থেকে?

—অফিস থেকে।

—আসবে?

—কোথায়? তোমার ওখানে?

এদিক থেকে নীরবতাটুকুই জবাব।

ওদিকেও থমকালো মনে হল একটু।—আজ না, তাছাড়া শ্মশানে গেছিলে শুনলাম। তুমি ক্লান্ত নিশ্চয় খুব।

বাপীর গলায় উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই। জবাব দিল, তুমি এলে ক্লান্তি বাড়বে না।

ওদিকে হাসির চেষ্টা। সুরও বিব্রত একটু।—আজ থাক্।…তোমার আপনার কেউ মারা গেলেন খবর পেয়ে অফিস থেকে টেলিফোনে বলেছিল…

বিকেলের দিকে আমাকে তুলে নিয়ে তোমার ওখানে যাবে। আমি রাজি হইনি। তাকে ফেলে একলা চলে গেছি শুনলে কি ভালো হবে?

মনে যাই থাক, বাপী তক্ষুনি ঠাণ্ডা জবাব দিল, ভালো হবে না।

ওদিকের পরের সুর আরো সহজ।— তোমারও তো আমার ওখানে আসার কথা ছিল একদিন—

—তোমার হাজব্যান্ড বলেছিলেন। সাহস হয়নি….

—কেন?

তোমার রাগ কতটা পড়েছে বুঝতে পারিনি।

গলার স্বরে কৌতুকের আভাস।—আমি রাগ কখন করলাম যে পড়বে।

—মাসখানেক আগে যেদিন ঊর্মিলাকে নিয়ে গেছিলাম। তোমার হাবভাবে মনে হয়েছিল জীবনে আর আমার মুখ দেখতে চাও না।

হাসি।—আমি তোমার মতো অত রাগ পুষে বসে থাকি না। সেদিন কেন অত রাগ হয়েছিল তুমি ভালোই জানো।

—কথার খেলাপ করে তোমার হাজব্যান্ড যদি ড্রিংক করে বাড়ি ফেরে তার দায় আমার ঘাড়ে কেন?

চুপ একটু। তারপর কথা শোনা গেল।—যেতে দাও, আগেও তুমি কক্ষনো কিছু বুঝতে চাইতে না—এখনো না।

—আগে বলতে? বাপীর এখনো না বোঝার ভান।

আগে বলতে অনেক আগে। সেই বানারজুলি থাকতে। চট করে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল।—ঊর্মিলা বাইরে চলে গেল?

—হ্যাঁ।

—আমার সম্পর্কে যাচ্ছেতাই ভেবেছে নিশ্চয়?

—না। আমাকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বানারজুলি চলে যেতে পরামর্শ দিয়ে গেছে।

—কেন?

—কোন দিন মারধর খেতে পারি ভেবেছে হয়তো।

হাসল।—তোমাকে হয়তো তার চিনতে এখনো কিছু বাকি আছে তাহলে। আচ্ছা, আজ ছাড়ি?

—হ্যাঁ।

ওদিকে টেলিফোন নামানোর শব্দ।

হাতের রিসিভারটা বাপী বার কয়েক নিজের গালে ঘষল। কানের ভেতর দিয়ে একটা স্পর্শ এতক্ষণ ধরে তাকে লোভাতুর করে তুলেছিল। ফোন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। মিষ্টি এই তার দ্বিতীয় জীবনের গোড়া থেকেই আপস চেয়ে আসছে। এখনো চায়। কেন চায়, বাপীর কাছে তা একটুও অস্পষ্ট নয়। মন থেকে ছেঁটে দিতে পারলে তাকে নিয়ে ও-মেয়ের এতটুকু মাথাব্যথা থাকত না। পারছে না। বাপীর মন বলে দিচ্ছে পারা সম্ভব নয়।

বাপী তরফদার শেষ দেখবে। যদি আরো ছিন্ন-ভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়— হবে। তবু মিষ্টির আপোসের দোসর হতে রাজি নয়।

মাস্টারমশায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ পুরোহিতকে বলে কয়ে বাপী এক মাসের জায়গায় তেরোদিনে টেনে নিয়ে এলো। আড়ম্বরের ধার দিয়েও যায়নি। তা বলে আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি রাখেনি। কুমকুম কালীঘাটে কাজ করেছে। শেষ হতে বেলা তিনটে গড়িয়েছে। বাপী এতক্ষণ থাকতে পারবে নিজেও ভাবে নি। সাহায্যের জন্য জিত্ উপস্থিত ছিল। তাকে রেখে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু কাজ শুরু হবার পর কেন যেন আর নড়তেই পারল না। জিত্কে চলে যেতে বলল।

খুব ছেলেবেলায় বাপী পিসির কাজ করেছিল। একটু বড় হতে বাবার কাজ করেছে। মনে রাখার মতো কোন ছাপই তখন পড়েনি। এখনো অভিভূত হয়েছে এমন নয়। পড়ার নেশায় আত্মার খবর বইয়ে যা একটু-আধটু পড়েছে। তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। আজ এই কাজ দেখতে ভালো লাগার স্বাদটুকু নতুন গঙ্গায় স্নান করে চওড়া লালপেড়ে কোরা শাড়ি পরে কুমকুম কাজের আসনে বসেছে। একপিঠ ছড়ানো চুল। যজ্ঞের আগুনের আভা বার বার মুখে এসে পড়ছে। এই সময়টুকু অন্তত ওর সমস্ত অস্তিত্ব একাগ্র নিষ্ঠায় অবনত। ওর দিকে তাকিয়ে শুচিতা যে ঠিক কাকে বলে বাপী ভেবে পেল না। মৃতের আত্মা বলে কোথাও যদি কিছু থেকে থাকে, তার প্রসাদ থেকে এই কুমুকে অন্তত বঞ্চিত ভাবা যাচ্ছে না।

পরদিন থেকেই আবার বাস্তব চিন্তা। মেয়েটাকে কোন কাজে লাগানো যেতে পারে ভাবছে। একটা কাজ হাতে মজুত। বানারজুলি থেকে মদ চালান আনার প্রস্তাব দিয়েছিল জিত্ মালহোত্রা। এখনো সে-আশা একেবারে ছাড়ে নি। তার মতে ওখান থেকে এখানে এতে ঢের বেশি লাভ। আবুকে জানালেই ব্যবস্থা পাকা করতে তার সময় লাগবে না। রেশমা হলে বাপী একটুও ভাবত না। রেশমার থেকে এই মেয়ে ঢের বেশি নরকের আবর্তে ডুবেছে, বাপীর তবু দ্বিধা একটু। মাস্টারমশায়ের মেয়ে বলেই হয়তো। জীবন-যুদ্ধে এ-রকম ভাবপ্রবণতার ঠাঁই নেই ভেবেই কুমকুমের মধ্যে অনেক সময় রেশমাকে দেখতে চেয়েছে সে। তবু মন স্থির করে উঠতে পারছিল না।

পরের সন্ধ্যায় কুমকুম নিজেই তুলল কথাটা। প্রথমে বাড়ির কথা। জিজ্ঞাসা করল, মাসের বাকি কটা দিন ও এখানেই থাকতে পাবে, না তার আগেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।

বাপীর ভিতরে একটা তির্যক আঁচড় পড়ল তক্ষুনি। চুপচাপ চেয়ে রইল একটু। জিজ্ঞাসা করল, বাড়ি ছাড়ার কথা উঠছে কি করে, তুমি কোথায় যাবে?

কুমকুম অবাক একটু।—বিব্রতও। বলল, বাবার জন্য যা করেছ — করেছ, এখন আমার জন্যে এত ভাড়া শুনে এ বাড়ি তুমি আটকে রেখে দেবে নাকি? ভেতরটা তেতে উঠছে বাপী নিজেই টের পাচ্ছে। জবাবও নীরস। তোমার জন্য কিছু দান খয়রাত করার কথা আমি ভাবছি না। আমি জিগ্যেস করছি, বাড়ি ছাড়লে তুমি কি করবে?

পুরুষের গলার আওয়াজ পেয়ে সামনের দরজায় একটি মাঝবয়সী রমণী মুখ বাড়ালো। পলার মা। পলা কুমকুমের ছোকরা চাকর। মাস্টারমশাই চোখ বুজতে কুমকুমের কাছে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। বাপীকে দেখে চট করে সরে গেল।

শুকনো গলায় কুমকুম বলল, পলার মা বলেছিল তাদের বস্তিতে একটা ঘর খালি আছে। অসহায় অথচ ঠাণ্ডা দু’ চোখ বাপীর মুখের ওপর থমকালো একটু। আবার বলল, নিজের ভাবনা-চিন্তা আমি অনেক দিন ছেড়েছি বাপীদা। বাবাকে নিয়ে আমার যেটুকু সাধ ছিল তার ঢের বেশি তুমি মিটিয়ে দিয়েছ। আমার মতো একটা মেয়ের জন্য তুমি ভেবো না।

বাপী চেয়ে আছে। দেখছে….এই দু’ আড়াই মাস ভালো থেকে ভালো খেয়ে ভালো পরে মেয়েটার শ্রী অনেক ফিরেছে। পুরুষের ক্ষুধার মুখে অনায়াসে নিজেকে এখন আগের থেকেও বেশি লোভনীয় করে তুলতে পারবে হয়তো। এই জোরেই বাড়ি ছাড়ার কথা বলছে কিনা বাপীর বোঝার চেষ্টা। গলা দিয়ে রাগ আর ব্যঙ্গ একসঙ্গে ঠিকরে বেরুলো। বাড়ি ছেড়ে বস্তিতে যাবে আর আগের মতো রাস্তায় দাঁড়াবে ঠিক করেছ তাহলে?…নাকি পলার মা তোমাকে ভালো খদ্দের জোটানোর আশ্বাসও দিয়েছে?

কুমকুমের সমস্ত মুখ পলকে বিবর্ণ পাংশু। মাথা নীচু করে একটা চাবুকের যন্ত্রণা নিঃশব্দে সহ্য করল। আস্তে আস্তে মুখ তুলল তারপর। —বাপীদা, তুমি এত বড় যে বাবা চলে যাবার পর তোমার কাছে আসতেও আমার অস্বস্তি। তাই তোমার বোঝা আর না বাড়িয়ে নিজের অদৃষ্ট নিয়েই আবার ভেসে যাওয়ার কথা বলছিলাম—

তিক্ত রূঢ় গলায় বাপী বলে উঠল, আমি একটুও বড় না। অনেক কাজ আমাকে করতে হয় যা কেউ বড় বলবে না বা ভালো বলবে না! আমি কারো মতামতের ধার ধারি না। সে-রকম কোনো কাজে আমি তোমাকে টেনে নিতে পারি—তাতে আর কিছু না হোক, বাড়ি ছাড়তে হবে না বা রাস্তায়ও গিয়ে দাঁড়াতে হবে না। রাজি আছ?

অবিশ্বাস্য আগ্রহে কুমকুম উঠে দাঁড়ালো। চোখে মুখে বাঁচার আকুতি। মুখেও তাই বলল।—বাগডোগরার এয়ারপোর্টেও তুমি কাজ দেবার কথা বলেছিলে বাপীদা—এখনো যদি সে রাস্তা থাকে আমি তো বেঁচে যাই—আমি কোন্ মুখে আর তোমাকে সে-কথা বলব!

কৃত্রিমতা থাকলে বাপীর চোখে ধরা পড়ত। নেই। মেজাজ প্রসন্ন নয় তবু বলল, এ-ও জল-ভাত রাস্তা কিছু নয়, ঝুঁকি আছে বলেই এতেও কিছু বুদ্ধি—বিবেচনার দরকার আছে, সাহসের দরকার আছে।

আশায় উদ্‌গ্রীব মুখ কুমকুমের।—আমার বুদ্ধি-বিবেচনায় কুলোবে কিনা তুমিই ভালো জানো বাপীদা—আমার আর খোয়ানোর কিছু নেই, তাই ঝুঁকি নেবার মতো সাহসের অভাব অন্তত হবে না। তাছাড়া তুমি আছ, চোখ বোজার এক মাস আগেও বাবা কি বলে গেছে তুমি জান না বাপীদা—

কানে গরম কিছুর ছেঁকা লাগল। ওকে থামিয়ে বাপী চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। তেমনি নীরস গম্ভীর গলায় বলল, শোনো, যিনি চলে গেছেন, এরপর তাঁকে টানলে আমারও অসুবিধে, তোমারও। এখন থেকে তুমি শুধু তুমি—মনে থাকবে?

ধাক্কা সামলে নিয়ে কুমকুম মাথা নাড়ল। থাকবে।

—ঠিক আছে। আপাতত যেমন আছ—থাকো।

বাপী বেরিয়ে এলো। একটু বাদে গাড়ি দক্ষিণে ছুটল।…মেয়েটা দুঃখ পেল হয়তো, কিন্তু ও নিজে স্বস্তিবোধ করছে। মাস্টারমশাই মুছে গেছেন। যে আছে নতুন করে আর তার কিছু হারানোর নেই, খোয়ানোর নেই—এটুকুই সার কথা, সত্যি কথা। ও মেয়ে নিজেই এ-কথা বলেছে। বাপীও শুধু এই বাস্তবের ওপরেই নির্ভর করতে পারে। নইলে তার যেমন অসুবিধে, মেয়েটারও তেমন ক্ষতি।

এখন আর বিবেকের আঁচড় পাঁচড় কিছু নেই। হাল্কা লাগছে।

মাস্টারমশাই মারা যেতে কাজে একটু ঢিলে পড়েছিল। বাপী তাই আবার কটা দিন বেশ ব্যস্ত। একটু খুশি মেজাজেই সেদিন দক্ষিণদিক থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছিল। এক নামী ওষুধের কারখানার কর্তাব্যক্তির সঙ্গে একটা বড় কনট্রাক্টের কথাবার্তা পাকা। তাদের পারচেজ অফিসারের মারফৎ চাহিদার লিস্টও হাতে এসে গেছে। বছরে আপাতত দেড়-দু লাখ টাকার মাল তারা ওর কাছ থেকে নেবে আশা করা যায়।

আজ আর ঘোরাঘুরি না করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার ইচ্ছে। ঊর্মিলা এর মধ্যে আরো দুটো চিঠি লিখেছে। একটারও জবাব দেওয়া হয়নি। এরপর হয়তো রাগ করে টেলিগ্রাম করে বসবে। আর কিছু না হোক, মেয়ে তার মায়ের মেজাজখানা পেয়েছে। ঘরে ফিরে প্রথম কাজ ওকে চিঠি লেখা।

গাড়ি ভবানীপুরের রাস্তায় পড়তে ভিতরটা উসখুস করে উঠল।…

সামনের বাঁয়ের রাস্তায় গাড়িটা ঘুরিয়ে দিলে সেই পঁচিশ-ঘর বাসিন্দার টালি এলাকা পাঁচ মিনিটের পথ। আজ নতুন নয়, এ-পথে এলেই গাড়িটা ওদিকে ঘোরাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ব্রুকলিন রতন বণিক ওকে যতো টানে, নিজেরই অগোচরের নিষেধ ততো বড় হয়ে ওঠে।

পার্ক স্ট্রীটের মুখে পড়ার আগেই আজ আবার আর একজনের কথা মনে পড়ল। গৌরী বউদি।…সেদিন বাইরে একটা পরিবর্তন দেখে নি গৌরী বউদির, কিন্তু ভিতরে কিছু রকম-ফেরের আভাস পেয়েছিল। অথচ তফাতটা কি স্পষ্ট করে ধরতে পারে নি। ওকে বলেছিল, ইচ্ছে হলে যেও একদিন বাচ্চু এখনো তার বাপীকাকাকে ভোলে নি।

গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। ওখানে যেতে নিষেধ নেই আর।

দোরগোড়ায় গাড়ি থামিয়ে বিকেলের টান-ধরা আলোয় পাশাপাশি দুটো বাড়িই দেখে নিল একবার। দুটোই জীর্ণ, মলিন। চুন-বালি খসা। অনেকদিন সংস্কার হয়নি বোঝা যায়। বাড়ি দেখে বিচার করলে সন্তু চৌধুরীর রোজগারে কিছু ভাটা পড়েছে মনে হবে। গাড়িতে বসেই কয়েকবার হর্ন বাজালো। কিন্তু দোতলার বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়াল না। অগত্যা নেমে দোতলার কলিংবেল টিপল।

একটু বাদে যে এসে দরজা খুলল, সে বাচ্চু কোনো সন্দেহ নেই. বছর তের বয়েস। আগের থেকে অনেক লম্বা হয়েছে। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে ময়লা হাফশার্ট। শুকনো রোগাটে মূর্তি।

ঝকঝকে গাড়িটা দেখে আর ফিটফাট এক সাহেব মানুষ দেখে ছেলেটা ভেবাচাকা খেয়ে মুখের দিকে চেয়ে রইল। চেনা আদল অথচ ঠিক ধরতে পারছে না কে।

বাপী বলল, তোর বাপীকাকুকে চিনতেই পারলি না রে!

শুকনো মুখে আচমকা খুশির তরঙ্গ। বলা মাত্র চিনেছে। কিন্তু সেদিনের সেই বাপীকাকু আজ এমন গাড়ি-অলা মস্ত সাহেব হয়ে গেছে দেখে উচ্ছল হয়ে উঠতে পারছে না। তাড়াতাড়ি বলল, চিনেছি, মা বলেছিল তুমি কলকাতায় আছ, একদিন আসতেও পারো—

তার হাত ধরে বাপী হাসিমুখে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, অনেক বড় হয়ে গেছিস—কোন ক্লাস হল এখন?

—ক্লাস সেভেন।

—ফার্স্ট-টাস্ট হচ্ছিস তো?

দোতলায় উঠে হাত ছেড়ে দিতে ছেলেটা বিব্রত মুখে বলল, এবার ফেল করতে করতে পাশ করে গেছি—

—সে কি রে! কেন, দেখবার কেউ নেই বুঝি?

আসার সঙ্গে সঙ্গে বাপীকাকুকে এমন অপ্রিয় খবরটা দিতে হল বলে ছেলেটার বিমর্ষ মুখ। মাথা নাড়ল, নেই।

দোতলায় এখনো আগের মতো ডাইনিং টেবিল পাতা। কিন্তু যত্নের অভাবে টেবিল চেয়ার এমন কি ঘরের দেওয়াল পর্যন্ত শ্রীহীন। সামনের বসার ঘরের পর্দাও বিবর্ণ ছেঁড়াখোঁড়া।

বাচ্চু তাকে বসার ঘরে এনে বসালো। সোফা-সেটিগুলোরও কাল ঘনিয়েছে বোঝা যায়।

—তোর মা বাড়ি নেই?

ছেলেটা ভেবাচেকা খেয়ে গেল একটু। তারপর বলল, মা তো এ বাড়িতে থাকে না—মায়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, তুমি জানো না?

একটা বড় রকমের ধাক্কা সামলে বাপীর সহজ হবার চেষ্টা। কিন্তু ছেলেটার কথার জবাবে মাথাও নাড়তে পারল না। মা কবে থেকে এ বাড়িতে থাকে না তা-ও জিজ্ঞাসা করতে পারল না।

বাচ্চু এবারে নিজেই মাথা খাটিয়ে বলল, সন্তুকাকু অনেক দূরে বাড়ি করেছে তো—মা সেইখানে থাকে।…তোমাকে এখন কি সুন্দর লাগছে দেখতে বাপী কাকু—আগের থেকে ঢের ভালো। ছেলেটা কি বলবে বা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।—ভিখুদা আছে বাপীকাকু, তোমাকে এক পেয়ালা চা দিতে বলি?

বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। বাপী তাড়াতাড়ি সায় দিল, বল্‌–

ছুটে চলে গেল। ফিরেও এলো তক্ষুনি। অপ্রতিভ মুখ।—এই যাঃ! ভিখুদা ও তো বাড়ি নেই বাপীকাকু…আমি করে আনি?

বাপী তাড়াতাড়ি বাধা দিল, তোকে করতে হবে না, বোস—আমি চা খুব কম খাই।

ঘরটা অন্ধকার লাগছিল। বাচ্চু. সুইচটা টিপে দিয়ে মুখোমুখি বসল।

—তোর বাবার অফিস থেকে ফিরতে রাত হয় এখনো?

বাচ্চু আবার অবাক।—বাবার অফিস কি, কত বছর আগেই তো চাকরি চলে গেছে। বাবা এখন দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বেরোয় আর অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করে সন্ধের সময় আসে। খানিকক্ষণের মধ্যে এসে যাবে—

এবারের ধাক্কাটা ততো বড়ো না হলেও বড়ই। মণিদার চাকরি কেন চলে গেছে আঁচ করা কঠিন নয়। তার ওখানে বাপীর চাকরির প্রসঙ্গে গৌরী বউদি বাধা দিয়ে বলেছিল, তোমার ওখানে ঢুকে পরের ছেলে হাতকড়া পরুক শেষে। হাতকড়া না পরলেও মণিদা নিজের চাকরিই রাখতে পারল না। ছেলেটার এই স্বাস্থ্য বা এমন চেহারা কেন বাপী এখন বুঝতে পারছে।…ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গৌরী বউদি সেদিন বলেছিল, তার হুকুম করার দিন গেছে। সে-কথার অর্থও এখনও জলের মত স্পষ্ট।

সাগ্রহে বাচ্চু জিজ্ঞসা করল, আজ তুমি এখানে থাকবে বাপীকাকা? বলে ফেলেই অপ্রস্তুত একটু। প্রস্তাবটা কত অসম্ভব নিজেই বুঝছে যেন

ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে বাপীর শুধু মায়া হচ্ছে না। যন্ত্রণাও হচ্ছে। বাপীকাকু-অন্ত প্রাণ ছিল একদিন, একসঙ্গে খাওয়া-শোয়া পড়া হুটোপুটি করার সব স্মৃতিই হয়তো মনে আছে। বলল, থাকতে পারছি না, তবে তোর সঙ্গে এর পর থেকে মাঝে মাঝে দেখা হবে। আমি কলকাতায় আছি তোর মা বলল?

—হ্যাঁ।

—মায়ের সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল, এখানেই?

—হ্যাঁ, মা তো মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসে, আর মাসের প্রথমে আমার জন্য বাবার হাতে টাকা দিয়ে যায়…এবারে টাকা দিতে এসে বলেছিল। তার পরেই সন্ত্রস্ত।—বাবা এলে তাকে কিন্তু এসব কিছু বোলো না বাপীকাকু, শুনলেই আমাকে মারবে।

বুকের তলায় আরো একটা আঁচড়। হাত ধরে কাছে টেনে নিল।—বাবা তোকে আজকাল মারে নাকি?

—খুব। ভয়ে ভয়ে দরজার দিকটা দেখে নিল একবার। তারপর গোপন কিছু ফাঁস করার মতো করে বলল, মা যখনই আসে, বাবাকে যাচ্ছেতাই করে বকাবকি করে তো, বাবা তখন খুব রেগে থাকে—তারপর একটু কিছু হলেই আমাকে মারে। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয় বলেও মার খেতে হয়—তুমি আমাকে আবার আগের মতো পড়াবে বাপীকাকু?

ঘরে যেন বাতাস কম।—দেখি, কি ব্যবস্থা করা যায়। এই বাপের কাছেই শুধু ছেলেটা কিছু আদর-যত্ন আর প্রশ্রয় পেত। দুটো চারটা বছর বাদে এই ছেলে ওই বাপকে কি চোখে দেখবে বা কতটুকু ভয় পাবে?

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। বাচ্চু সচকিত তক্ষুনি। ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা আসছে। বাপীকাকুকে দেখে বাবা খুশি হবে কিনা সেই আশঙ্কা।

মণিদা ঘরে ঢুকল। রাস্তার আলোয় দোরগোড়ায় ঝকঝকে গাড়ি দেখেছে, তখনো তার ঘরে কেউ এসেছে ভাবেনি হয়তো। এই বেশে বাপীকে দেখে হকচকিয়ে গেল।

—বাপী যে…কখন এলি?

—এই তো কিছুক্ষণ। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, এবার যাব।

—বোস্ বোস্, চা-টা দিয়েছে?

বাচ্চু বলে উঠল, ভিখুও বাড়ি নেই বাবা, কে দেবে?

মণিদার শরীরের বাড়তি মেদ ঝরে গেছে। জামাকাপড়ের বিলাস সুখের দিনেও খুব ছিল না, কিন্তু এখন দুরবস্থা বোঝা যায়! গালে তিনদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

ঠাণ্ডা গলায় বাপী বলল, চায়ের দরকার নেই, বোসো।

মণিদা পরিশ্রান্ত বেশ। ঘামছে। বসে একটু সহজ হবার চেষ্টা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিড়ি বার করে ধরালো। আগে সর্বদা চুরুট মুখে থাকত। বলল, তুই কলকাতায় আছিস খবর পেয়েছি, অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছিস শুনলাম…নিচের ওই গাড়িটা তোর নাকি?

—হ্যাঁ।

—বেশ, বেশ। উৎসুক একটু।—কিসের ব্যবসা করছিস?

—অনেক রকমের। বাচ্চুকে বলল, সাতটা বাজল, তুই বই-টই নিয়ে বোসগে যা—আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি।

বাচ্চু তক্ষুনি চলে গেল। বাপী মণিদার দিকে ফিরল।—তোমার খবর তেমন ভালো নয় বোধ হয়?

—নাঃ। চাঁচাছোলা প্রশ্ন শুনে সহজ হবার চেষ্টা ছেড়ে মণিদা বলল, একটা গণ্ডগোলে পড়ে চাকরিটা চলে গেল, তোর বউদিও অবুঝের মতো বিগড়ে গেল…। হাতের বিড়িটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে এবার অসহায়ের মতো বলে ফেলল, কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করে দিতে পারিস?

—পারি। বাপীর গলার স্বর চড়া নয়, কিন্তু কঠিন।—তোমার চাকরি গেল বউদি বিগড়ে গেল তার শাস্তি ছেলেটা পাচ্ছে কেন? ওর এই হাল কেন? এই চেহারা কেন? ওর গায়ে হাত তুলতে তোমার লজ্জা করে না?

মণিদা আবার ভেবাচাকা খেয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।

গায়ে হাত তোলার কথাটা বলে ফেলার দরুনও ছেলেটার দুর্ভোগ হতে পারে মনে হতে বাপী আরো তেতে উঠল।—শোনো বাচ্চুর জন্য আমি ভালো মাস্টার ঠিক করে দেব, ওর লেখা-পড়া খাওয়া-দাওয়ার সব ভার আমি নিলাম। তোমার পোষালে আলাদা রোজগারের ব্যবস্থাও আমি করে দেব। কেবল, ওই ছেলেটার ওপর তোমাদের কারো শাসন আমি বরদাস্ত করব না, এটুকু মনে রাখতে হবে।

উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বার করে সামনে ধরল।—যদি রাজি থাকো তো কাল-পরশুর মধ্যে একদিন গিয়ে দেখা কোরো—আর বাচ্চুকে নিয়ে যেও।

মণিদা কার্ড হাতে নিল। এ সেই হাবা-মুখ ভাইটাই কিনা ভেবে পাচ্ছে না।

বাপী নেমে এলো।

খিঁচড়নো মেজাজ নিয়েই ফ্ল্যাটে ফিরল। বাইরে দরজা খোলা দেখে আরো বিরক্ত। এসেছে কেউ। শুধু জিত্ হলে দরজা খোলা থাকার কথা নয়।

ঘরে পা দিয়েই দু’ চোখ কপালে। খোশ মেজাজে বসে গল্প করছে তিনটি মানুষ।

জিত্ মালহোত্রা। তার পাশে অসিত চ্যাটার্জি।

ওদের দুজনের সামনের সোফায় আবু রব্বানী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *