সোনার হরিণ নেই – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

পরের টানা প্রায় দেড় বছরের নাটকে বাপী তরফদারের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। সে নেপথ্যে দাঁড়িয়ে। শান্ত, নিরাসক্ত। কাজের সময় কাজে ডুবে থাকে। অবসর সময় বই পড়ে। পড়ার অভ্যেস আগেও ছিল। এই দেড় বছরে সেটা অনেক বেড়ে গেছে। যাওয়া-আসার পথে এক-এক সময় গাড়ি থামিয়ে স্টল থেকে গাদা গাদা ইংরেজি-বাংলা বই কিনে ফেলে। এই কেনার ব্যাপারেও বাছ-বিচার নেই খুব। গল্প-উপন্যাস আর ভালো লাগে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার মতো যে-সব বইয়ে জীবনের হাজারো অদৃশ্য খুঁটিনাটির সন্ধান মেলে সে-সব বেশি পছন্দ। ভালো লাগলে পাতা উল্টে যায়, না লাগলে ফেলে দেয়।

কমলার প্রসাদ অঝোরেই ঝরছে। এক বছরের ওপর হয়ে গেল কাছাকাছির অভিজাত এলাকাতে বাড়ি কেনা হয়েছে। টাকা কোনো সমস্যা না হলে যেমন বাড়ি কেনা যায় সেই রকমই। এক তলায় অফিস, দোতলায় বাস। মণিদাকে বাপী অফিসে এনে বসায়নি। সে উল্টোডাঙার গোডাউনের অফিসেই বসছে। বাচ্চুকে নরেন্দ্রপুরে ভর্তি করে দিয়ে পার্ক স্ট্রীটের বাড়ি ছেড়ে মণিদা গোড়াউনের পাশে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। ছেলে সরানোর ব্যাপারটা মণিদার মনেই ছিল। আগে বাচ্চুর কাছেও ফাঁস করেনি। কারণ, সন্তু চৌধুরী তখন পাঁচ ছ’মাসের জন্য গৌরী বউদিকে নিয়ে ইংল্যান্ড সফরের তোড়জোড় করছে। রওনা হবার আগের ক’দিন তারা বাচ্চুকে দেখতে ঘন ঘন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছিল। বাচ্চুর মাসের বরাদ্দ টাকা সন্তু চৌধুরীর কোনো বিশ্বস্ত জন প্রতি মাসের গোড়ায় মণিদাকে দিয়ে যাবার কথা। মণিদা সে টাকা সই করে রাখবে। ভরসা করে তারা একেবারে সব টাকা তার হাতে তুলে দিতে পারেনি। মণিদা ব্যবস্থার কথা শুনেছে। কোনো মন্তব্য করেনি।

পাঁচ ছ’মাস বাদে ফিরে এসে থাকলেও তারা বাচ্চু বা মণিদার হদিস পায়নি। পার্কস্ট্রীটের বাড়িতে অন্য অপরিচিত ভাড়াটে দেখেছে। আর সন্তু চৌধুরীর টাকাও মণিদা ছোঁয়নি দেখে হয়তো ধরে নিয়েছে, তাদের আক্কেল দেবার জন্যেই লোকটা বাড়ি ঘর ছেড়ে আর সব বেচে দিয়ে ছেলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। বাপীর বাড়ি কেনার খবরও তাদের জানার কারণ নেই। বাচ্চুর দু-তিন মাস অন্তর ছুটিছাটায় আসে এখানে। বাপীকাকুর কাছে থাকে। সে ক’টা দিন খুব আনন্দ ছেলেটার। বাবার কাছেও গিয়ে থাকতে চায় না। ছেলেকে দেখার জন্য মণিদাকেই আসতে হয়। বাপী আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। এখানে এসে ছেলেটা মায়ের নামও মুখে আনে না। এটা বাপের নিষেধ কিনা জানে না। হস্টেলে ফিরে যাবার সময় হলে ওর মন খারাপ হয় বুঝতে পারে। কিন্তু যেতে আপত্তি করে না। আবার কবে ছুটি ক্যালেন্ডারে দেখে রাখে। যাবার আগে জিগ্যেস করে, জিত্ কাকুকে পাঠিয়ে তখন আবার আমাকে নিয়ে আসবে তো?

ছেলেটাকে অনায়াসে নিজের কাছেই এনে রাখা যেত। কিন্তু বাপী নিজেই এখন মাসের মধ্যে টানা পনের দিন কলকাতায় থাকে না। কলকাতার ব্যবসা মোটামুটি বাঁধা ছকের দিকে গড়াতে সে আবার বাইরের ঘাঁটিগুলো তদারকে মন দিয়েছে। আবু উত্তর বাংলা নিয়ে পড়ে আছে। বিহার আর মধ্যপ্রদেশের রিজিয়ন্যাল ম্যানেজারদের কাজকর্ম এখন আবার বাপী নিজে দেখছে। মাসে দেড় মাসে একবার করে বানারজুলিতেও যেতে হচ্ছে। কিন্তু দেড় বছরের এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোন রকম উত্তেজনা বা উদ্দীপনার ব্যাপার নেই। প্রাচুর্য থেকে কোনো কৃত্রিম আনন্দ ছেঁকে তোলার আগ্রহ নেই। চারদিকে খাল বিল নদী-নালা সমুদ্র, তৃষ্ণায় ছাতি-ফাটা চাতক তবু স্বাতী নক্ষত্রের ফটিক জল ছাড়া অন্য জল স্পর্শ করে না। সামাজিক যোগাযোগও কমে আসছে বাপীর। বাড়ি কেনার পর মিষ্টিকে আর অসিত চ্যাটার্জিকে একবার মাত্র নেমন্তন্ন করে আনা হয়েছিল। তাদের ঘরের শান্তিতে আবার চিড় খেয়েছে তখনই বোঝা গেছল। সেই কারণে দীপুদার যাতায়াত আগের থেকে বেড়েছে। তার মায়ের টেলিফোন আসাও। কিন্তু আগ্রহ সত্ত্বেও বাপীকে তারা তেমন নাগালের মধ্যে পায় না। তার ঘন ঘন টুর প্রোগ্রাম। ফিরলে কাজের ডবল চাপ।

অসিত চ্যাটার্জির সামনে কিছু বাড়তি রোজগারের টোপ ফেলার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বাপী জিকে বলে দিয়েছিল হিসেব-পত্রের ব্যাপারে ওই লোকের কাছ থেকে কোনরকম সাহায্য নেবার বা কোম্পানীর ভাউচারে এক পয়সা দেবার দরকার নেই। ফলে জিত গা করছে না দেখে অসিত চ্যাটার্জি নিজেই কাজের কথা তুলেছিল। বাপীর জবাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। বলেছে, তার ধারণা এটা মিলু বা তার মা-দাদা কেউ পছন্দ করবে না।

অপছন্দের ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে তার মা-দাদাকে জুড়ে দেবার ফলে ফর্সা মুখ রক্তবর্ণ।—আমি কাজ করে বাড়তি উপার্জন করব তাতে কার কি বলার আছে? আর মিলুই বা আপত্তি করবে কেন?

—জিগ্যেস করে দেখো। তার আপত্তি না হলেও আর কথা কি…কাজ করে কত লোকই তো কত টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

জিজ্ঞাসার ফল কি হয়েছে বাপী আঁচ করতে পারে। অসিত চ্যাটার্জি মেয়ে জাতটার ওপরেই বীতশ্রদ্ধ। বলেছিল, যত লেখা-পড়াই শিখুক মেয়েরা মোস্ট্ আপ্রাকটিক্যাল। সেন্টিমেন্টাল ফুল্স্ যত সব

ব্যবসার বাইরে জিত্ মালহোত্রার সঙ্গেও বাপীর অন্য কোনো কথা হয় না। এমন কি প্রত্যক্ষ যোগ নেই বলে এখানকার মদের ব্যবসা কেমন চলছে, সে খবরও নেয় না। কিন্তু জল কোন দিকে গড়াচ্ছে চোখ বুজে অনুমান করতে পারে। এই দেড় বছরের মধ্যে আবু রব্বানী পাঁচ-ছ’বার কলকাতায় এসেছে। ওদের লাল জলের ব্যবসা চালু হবার পরেই আবুকে বাপী এখানকার জন্য একটা লিকার শপের লাইসেন্স বের করার পরামর্শ দিয়েছিল। নিজেদের দোকান থাকলে শুধু সুবিধে নয়, নিরাপদও। টাকা খসালে বোবার মুখে কথা সরে। লাইসেন্স বার করতে জিতের বেশি সময় লাগেনি। লাইসেন্স কুমকুমের নামে। আবু আর জিত্ তার অংশীদার। লাভের চার আনা শুধু বাপীর নামে জমা হবে—কিন্তু কাগজে—কলমে সে কেউ নয়। এরপর মধ্যকলকাতায় যে দোকান গজিয়ে উঠেছে তাতে খুব একটা জাঁকজমকের চিহ্ন নেই। যে দুজন কর্মচারীকে বহাল করা হয়েছে তারাও বানারজুলির লোক এবং আবুর লোক।

জিত্ মালহোত্রা সময়মতো অফিসে আসে, দরকার মতো পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার পর সে নিপাত্তা। শনিবারও বেলা একটার পর তার টিকির দেখা মেলে না। এই ব্যস্ততা যে শুধু ওদের জলীয় ব্যবসার কারণে নয়, তাও বোঝা গেছে। বাড়তি রোজগারের আশায় ছাই পড়লেও অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে জিতের যে গলায় গলায় ভাব এখন তার প্রমাণ দীপুদার নালিশ। তার অবুঝ বোন আবার অশান্তির মধ্যে পড়েছে। অমানুষ ভগ্নীপতি প্রায় রাতেই বদ্ধ মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফেরে। শনিবার রেসের মাঠে যায়। দীপুদার চেনাজানা অনেকেই তাকে দেখেছে। শনিবার অন্য দিনের থেকে নেশার মাত্রা বেশি হয়, তাই মিষ্টিরও রেসের ব্যাপারটা জানতে বুঝতে বাকি নেই। ঝগড়ার মুখে ওই অপদার্থই বুক ঠুকে বলে, সে রেসে যায় নেশা করে—তাতে কার বাপের কি। রোজ মদ খাওয়া আর ফি হপ্তায় রেস খেলার অত টাকা কোথা থেকে পায় দীপুদারা ভেবে পায় না।

বাপী নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত। মিষ্টির মত নেই বলে ওই লোকের তার এখান থেকে কিছু বাড়তি রোজগারের প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে, সে-খবর দীপুদা বা তার মাকে অনেক আগেই জানানো হয়ে গেছে।

কুমকুমের সঙ্গে বাপী এখন আর দেখা পর্যন্ত করে না। কিন্তু তার সমাচারও নখদর্পণে। জীবনের এই বৃত্তে সে শক্ত দুটো পা ফেলে দাঁড়িয়েছে। এখন সে নিজের সহজ মাধুর্যে আত্মস্থ। দ্বিধাদ্বন্দ্বশূন্য। কুমকুম বহিনের প্রসঙ্গে আবু রব্বানী প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বুদ্ধি ধরে, কথা শোনে, একটুও হড়বড় করে না। বৃত্ত বদলের শুরুতেই কুমুর জন্য বেশি ভাড়ার ফ্ল্যাট ঠিক করা হয়েছে। মাথার ওপর বাড়িঅলা বসে থাকলে কাজের অসুবিধে। তার দেখাশুনার জন্য একজন আয়া আর একজন বুড়ো চাকর আছে। সেই তখন আবুর সঙ্গে বাপী একবার কুমুকে দেখতে গেছল। মনে মনে বাপী নিজেও তখন ওর বিবেচনার তারিফ করেছিল। বেশবাস আর প্রসাধনে রুচির শাসনও জানে মেয়েটা। আলগা চটক কিছু নেই। বাড়তির মধ্যে আগের সেই ঝকঝকে সাদা পাথরের ফুলটা আবার নাকে উঠে এসেছে। ওটার জেল্লা চোখে ঠিকরোবার জন্যেই।

এর মাস তিনেক বাদে আবু তৃতীয় দফা যখন কলকাতায় এসেছে, তার সঙ্গে বানারজুলির বাদশা ড্রাইভার। এখন বুড়োই বলা চলে। কলকাতায় মালিকের কাছে এসেছে। ভারী খুশি।

বাপী আবুকেই জিজ্ঞাসা করেছে, কি ব্যাপার?

আবু মাথা চুলকে জবাব দিয়েছে, ও কিছুদিন এখন কুমকুম বহিনের কাছে থাকবে।

বাপী আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আবু কোন্ চটকের ওপর নির্ভর করতে চায় তক্ষুনি বুঝে নিয়েছে। ওরও এখন মাথা হয়েছে বটে একখানা। দিন কয়েকের মধ্যে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড চকচকে গাড়ি কেনা হয়েছে। কিছুদিন বলতে বাদশা ড্রাইভার কুমকুমের কাছে টানা চার মাস ছিল। ও বানারজুলি ফিরে যাবার আগে মালিককে জানিয়ে গেছে, দিদিজির গাড়ি চালানোর হাত এখন খুব পাকা আর খুব সাফ। ভারী ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি চালায় দিদিজি—মালিকের চিন্তার কোন কারণ নেই।

পাকা হাত দেখাবার লোভে কুমকুম কোনো দিন গাড়ি চালিয়ে বাপীর কাছে আসেনি। জিত্ অনেক করে বলা সত্ত্বেও আসেনি। শুনেই মিস ভড়ের নাকি দারুণ লজ্জা। জিত্ আশা করেছিল এ-কথা শোনার পর মালিকই একদিন তাকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলবে।

বাপী বলেনি। কিন্তু কুমকুমের গাড়ি চালানো নিজের চোখেই দেখেছে একদিন। পার্ক স্ট্রীট ধরে আসার পথে বাপীর গাড়ি ট্রাফিক লাইটে আটকে গেছল। সামনের সোজা রাস্তা ধরে সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে আসছে। সেই চলন্ত সারিতে কুমুর গাড়ি। গাড়ি চালিয়ে কুমু দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাচ্ছে। ডান হাতের কনুই পাশের খোলা জানলায় রেখে স্টিয়ারিং ধরে বসায় শিথিল ভঙ্গিটুকু চোখে পড়ার মতোই। কুমকুমের ওকে দেখার কথা নয়। দেখেওনি। বাপী এর পর নিজের মনেই হেসেছে অনেকক্ষণ ধরে। রাতের আবছা আলোর নিচে এই মেয়েকে শিকারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত কে বলবে।

এর পর যা, বাপীর সামনে তার সবটাই ছকে বাঁধা ছবির মতো স্পষ্ট।

…ব্যস্ততার অজুহাতে অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে জিতের মাখামাখির ভূমিকা কমে আসছে। সে পিছনে সরছে। সামনে মিস ভড়। কুমকুম ভড়। অসিত চ্যাটার্জি তার অন্তরঙ্গ সাহচর্যের দাক্ষিণ্যে ভাসছে। রমণীর যে রূপ গুণ বুদ্ধি পুরুষের আবিষ্কারের বস্তু, অসিত চ্যাটার্জির চোখে কুমকুমের সেই রূপ সেই গুণ আর সেই বাস্তব বুদ্ধি। পয়সা আছে, তবু আর পাঁচটা মেয়ের মতো ড্রাইভারের মুখাপেক্ষী নয়। নিজের গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে। নিজের তত্ত্বাবধানে মদের দোকান চালায় এমন মেয়ে এই কলকাতা শহরেও আর আছে কিনা জানে না। সে জানে মিস ভড়ের বাবার দোকান ওটা। অসময়ে বাবা মরে যেতে লাইসেন্স নিজের নামে করে নিয়ে অনায়াসে সেই দোকান চালাচ্ছে। সামনে এসে বেচাকেনা করে না অবশ্য, পর্দার আড়ালে পিছনের চিলতে ঘরে বসে দু’তিন ঘণ্টা দেখাশোনা করে। কেউ টেরও পায় না এটা কোনো মেয়ের দোকান। আর যে—কোনো মেয়ে হলে বাপ চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে দোকান বেচে দিয়ে টাকার বাণ্ডিল বুকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকত। নিজে মদ ছোঁয় না, কিন্তু পুরুষের এই নেশাটাকে সংস্কারে অন্ধ মেয়েদের মতো অশ্রদ্ধার চোখেও দেখে না। মান্যগণ্য অতিথিদের জন্য রকমারি জিনিস ঘরে মজুত। চাইতে হয় না। একটু উসখুস করলেই তেষ্টা বোঝে। উদার হাতে বার করে দেয়। আবার বেশি খেতে দেখলে আপত্তি করে। বলে, অত ভালো নয়, আনন্দের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই ভালো। কুমকুমের চিন্তা হবে না তো কি। এত রূপ আর এত বিদ্যা যে মানুষের, তার ভালো মন্দের দিকে চোখ না রেখে কোনো মেয়ে পারে?

এ-সব খুঁটিনাটি খবর বাপী বানারজুলিতে বসে শুনেছে। আবু হেসে হেসে বলেছে, আর খুব বেশি দেরি নেই দোস্ত, জামাইসাহেব ঘায়েল হল বলে।

বাপী সচকিত।—দুলারি কিছু জানে না তো?

—ক্ষেপেছো! গেল মাসেও কুমকুম বহিন এসে তিন রাত তোমার বাংলোয় থেকে গেছে—দুলারির সঙ্গে এখন খুব ভাব তার। ও বলে, মেয়েটা কত ভালো, বাপীভাই একেই বিয়ে করছে না কেন। এ-সব শুনলে আর খাতির করবে!

ফুর্তির মুখে আবু বলেছিল, কুমকুম বহিন এবারে এসে খুব মজার কথা শুনিয়ে গেছে বাপীভাই। ওই লোকটার জন্যে তার নাকি মায়া হয়। কি রকম মায়া জানো? খারাপ সময়ে একবার ও কালীঘাটের মন্দিরে গেছল—মা কালীর কাছে প্রার্থনা করতে যদি একটু দিন ফেরে। সেখানে গিয়ে দেখে এক ভদ্রমহিলার মানতের পাঁঠা বলি হচ্ছে। জীবটার জন্য মহিলার এমন মায়া যে বলির আগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকল। কুমকুমেরও ওমনি মায়া, কিন্তু পুজোর বলি না দিয়ে পারে কি করে।

আবুর হা হা হাসি। কিন্তু বাপী তেমন খুশি হতে পারেনি। এ-রকম শুনলে বিবেকের ওপর আঁচড় পড়ে! এই বাস্তবে নেমে বাপী সেটা চায় না।

ঘটনার ঢল এবারে পরিণতির মোহনার দিকে। সেদিন শনিবার। সন্ধ্যার ঠিক পরেই দীপুদা এলো। থমথমে মুখ। সাধারণত টেলিফোন করে বাপী আছে কি নেই জেনে নিয়ে আসে। কিছু একটা তাড়ায় এই দিনে খবর না নিয়ে বা না দিয়ে এসে গেছে। এই মুখ দেখা মাত্র বাপীর মনে হয়েছে তার প্রতীক্ষায় গাছে কিছু ফল ধরেছে।

—এসো। হঠাৎ যে?

—তোমার সঙ্গে সীরিয়াস কথা আছে…।

—বোসো। কি ব্যাপার?

হল-এর অন্য মাথায় দাঁড়িয়ে বলাই কিছু একটা করছে। সেদিকে চেয়ে দীপুদা বলল, তোমার ভিতরের ঘরে গিয়ে বসি চলো।

শোবার ঘরে এসেই চাপা রাগে বলে উঠল, রাসকেলটার এত অধঃপতন হয়েছে আমি শুনেও বিশ্বাস করিনি।

তিন হাতের মধ্যে মুখোমুখি বসে বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল। অর্থাৎ ব্যাপার খানা কি কিছু বুঝছে না।

বোঝানোর জন্যেই দীপুদার আসা। তপ্ত গলায় দীপুদা যা শোনালো তাতে বাপীর মনে হল, প্রতীক্ষার গাছে ফল শুধু ধরেনি, অনেকটা পেকেও গেছে।

—মেয়েছেলে নিয়ে গোলমেলে ব্যাপার বেশিদিন ধামা-চাপা থাকে না। অসিত চ্যাটার্জির আপিসের এক বন্ধু আগে ওর বাড়িতে আসত, আড্ডা দিত। মিষ্টির সঙ্গেও বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছল। ওই স্কাউনড্রেলের সেটা পছন্দ নয় বুঝেই ভদ্রলোক বছরখানেকের মধ্যে বাড়িতে আর আসেটাসে না। সপ্তাহ তিনেক আগে সে এয়ার-অফিসে এসে মিষ্টির সঙ্গে দেখা করে গেছে। কর্তব্যজ্ঞান আছে বলেই না এসে পারেনি। বলেছে, একটি সুশ্রী মেয়ে নিজে ড্রাইভ করে সপ্তাহের মধ্যে কম করে চার দিন তাদের অফিসে আসে। অফিসে ঢোকে না। ছুটির আগে আসে, গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করে। অসিত চ্যাটার্জি নেমে এলে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। প্রত্যেক শনিবার দিন একটা বাজার দু’পাঁচ মিনিট আগে তার গাড়ি আসে, হাজার কাজ থাকলেও তখন অসিত চ্যাটার্জিকে অফিসে ধরে রাখা যায় না। ঠিক নেশা না থাকলেও আগে ওই বন্ধুটি মাঝেসাঝে অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে রেসের মাঠে যেত। শনিবারে ঘড়ি ধরে এই অফিস পালানোর তাড়া দেখেও তার সন্দেহ হয়। কয়েকটা শনিবার তাই সে-ও রেসের মাঠে গেছে। সব কদিনই সেই মেয়ের সঙ্গে অসিত চ্যাটার্জিকে দেখেছে। তারা গ্র্যান্ডে বসে খেলে। ছ’সাত মাস হয়ে গেল এই এক ব্যাপার চলছে। জিগ্যেস করলে অসিত চ্যাটার্জি বলে, মেয়েটির বাবা তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন ছিলেন। উনি মারা যেতে তাঁর এই মেয়ে এখন ফার্ম দেখাশুনা করে। বিনে পয়সায় অসিত চ্যাটার্জি ফার্মের খাতাপত্র ঠিক করে দেয় বলেই এত খাতির কদর। সত্যি যদি হয় তাহলে বলার কিছু নেই। শুধু বন্ধুটির নয়, অফিসের অনেকেরই খটকা লেগেছে বলে শুভানুধ্যায়ী হিসেবে সে মিষ্টিকে খোলাখুলি জানাবার দরকার মনে করেছে।

মিষ্টি জানে, একটা বড় ফার্মে বিকেলে পার্ট টাইম কাজ জুটেছে বলে ফিরতে রাত হয় লোকটার। অনেক টাকা দেয় তারা। সেই টাকায় মদ গিলে ঘরে আসে। কিন্তু মতিগতি বদলাচ্ছে, তাও লক্ষ্য করছে। মদ খাওয়া বা রেস খেলা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হলে বেপরোয়ার মতো কথা বলে। শাসায়। তা বলে এরকম ব্যাপার কল্পনাও করা যায় না। তাই শোনামাত্র সব যে বিশ্বাস করেছে তাও নয়। যে সেধে এসে এমন খবর দিয়ে গেল তার রাগ বা আক্রোশ থাকা অস্বাভাবিক নয়। আজকাল বাড়িতে আসে না তার কারণ আসতে হয়তো নিষেধই করা হয়েছে।

দীপুদা জানিয়েছে, বোকা মেয়ে তার পরেও তাকে বা মাকে একটি কথাও বলেনি। ওই পাষণ্ডের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছে। সেই রাতে নেশার মুখে কিছু বলেনি। পরদিন সকালে ধরেছে। বলেছে, তুমি রোজই প্রায় অফিস থেকে একটি মেয়ের সঙ্গে বেরিয়ে যাও শুনলাম—সে নিজে ড্রাইভ করে, তুমি পাশে বসে থাকো। কি ব্যাপার?

অন্ধকারে জানোয়ারের মুখে হঠাৎ জোরালো আলোর ঘা পড়লে যেমন ধড়ফড় করে ওঠে, কয়েক পলকের জন্য সেই মুখ নাকি অসিত চ্যাটার্জির। মিষ্টি যা বোঝার সেই কটা মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে নিয়েছে। তারপর জানোয়ারের মতোই তর্জন-গর্জন লোকটার।—কোন্ সোয়াইন বলেছে? আমি কখন কোন কাজে কার গাড়িতে বেরোই তা না জেনে তোমাকে এ সব বলে কোন্ সাহসে? তোমার সেই চরিত্রবানেরা কারা আমি জানতে চাই? অফিসে তোমার চারদিকে যারা ছোঁকছোঁক করে বেড়ায়—তারা? কোন মতলবে তোমাকে তারা এ-সব বলে তুমি জানো না? না কি জেনেও ন্যাকামো করছ?

দীপুদার বোন তারপরেও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। সে জানতে চেয়েছে, আপিসের পর সে কোন বড় ফার্মে পার্টটাইম কাজ করে, ফার্মের নাম কি, টেলিফোন নম্বর কি।

এরপর শয়তানের মুখোশ আরো খুলেছে। চিৎকার করে বলেছে, যে স্ত্রীর এত অবিশ্বাস তার কোন কথার জবাব সে দেবে না। তাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে কারো ঘাড়ে মাথা থাকবে না বলে শাসিয়েছে।

মিষ্টি এরপর টেলিফোন করে দাদাকে শনিবারের রেসের মাঠে যেতে বলেছে। শুনে দীপুদা প্রথমে আকাশ থেকে পড়েছিল। মিষ্টি শুধু বলেছে, কিছু গণ্ডগোলের ব্যাপার চোখে পড়তে পারে, কিছু বলবে না, শুধু দেখে এসো, পরে কথা হবে।

দুর্বোধ্য হলেও কাকে নিয়ে বোনের অশান্তি, জানা কথাই। দীপুদা গত শনিবারে রেসের মাঠে গেছল, এই শনিবারেও মাঠ থেকে ফিরে সোজা আগে মিষ্টির ওখানে গেছল। মাঠে যা দেখার দেখেছে। তারপর মিষ্টির মুখে সব শুনেছে। তাদের মা এখনো কিছু জানে না। সব শোনার পর মায়ের মাথাই না খারাপ হয়ে যায় দীপুদার এই চিন্তা

বাপীর মুখের রেখা নিজের প্রতি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। চুপচাপ শুনছে। চেয়ে আছে। মিষ্টির ওখান থেকে দীপুদা সরাসরি এখানে কেন, বোঝার চেষ্টা।

দুর্ভাবনায় মুখ ছাওয়া দীপুদার, একটু চুপ করে থেকে বলল, মেয়েটি সুশ্রী আর অবস্থাপন্ন তো বটেই, বেশ কালচারও মনে হল। এমন এক মেয়ের সঙ্গে স্কাউনড্রেলটা কি ভাঁওতা দিয়ে ভিড়েছে তার ঠিক কি! এরকম একটা থার্ড রেট লোক ওখানে পাত্তা পেল কি করে?

এ আলোচনা যেন অবান্তর। বাপী বলল, ওই থার্ড রেট লোক তোমার বোনের কাছেও পাত্তা পেয়েছিল…এ কথা ভেবে আর কি হবে। এখন সমস্যাটাই বড়।

দীপুদা কথাটা মেনে নিয়েই বলল, মিষ্টি তখন ছেলেমানুষ, কি আর কাণ্ডজ্ঞান। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে। উৎসুক একটু। আচ্ছা বছর সাতাশ-আটাশ বয়েস, ব্যবসা আছে, নিজে ড্রাইভ করে—এ-রকম কোনো মেয়েকে তুমি চেনো বা দেখেছ?

বাপী ভিতরে সচকিত। প্রশ্নটা ব্যারিস্টার সুদীপ নন্দীর নিছক কাঁচা কৌতূহল মনে হল না। প্রশ্নটা তার না হয়ে তার বোনের হতে পারে। মাকে কিছু না বলে বা তার সঙ্গে শলাপরামর্শ না করে হন্তদন্ত হয়ে আগে এখানে এসেছে কেন? বাপীর ঠাণ্ডা দু’চোখ দীপুদার মুখের ওপর স্থির একটু। তারপর উঠে বলাইকে টেলিফোন এ-ঘরে দিয়ে যেতে হুকুম করল।

নম্বর ডায়েল করল। জিতের নম্বর। কাছাকাছির মধ্যে এখন তারও আলাদা ফ্ল্যাট হয়েছে। বউ ছেলে নিয়ে এসেছে। জিত্‌ সাড়া দিতে বাপী শুধু বলল, একবার এসো——

ঘনিষ্ঠ আলাপ না থাকলেও জিত্ মালহোত্রাকে সুদীপ নন্দীও চেনে। আরো উৎসুক। —তাকে ডাকলে কেন…এ ব্যাপারে সে কিছু জানে?

জবাবে ঠাণ্ডা মুখে বাপী তার কৌতূহল আরো চড়িয়ে দিল।—অপেক্ষা করো। এক্ষুনি এসে পড়বে।

ট্যাক্সি হাঁকিয়ে জিত্ দশ মিনিটের মধ্যে হাজির। বলাই খবর দিতে তাকেও শোবার ঘরেই ডাকা হল। সুদীপ নন্দীকে দেখে সদাসপ্রতিভ জিত্ দুহাত জুড়ে কপালে ঠেকালো। বাপী বলল, পাঁচ-ছ’মাস আগে তুমি এঁর ভগ্নীপতি অসিত চ্যাটার্জি আর তোমার চেনাজানা কোন্ ওয়াইন শপের মেয়ে মালিকের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে চেষ্টা করেছিলে…যা জানো দীপুদাকে বলো। নিজের দোষ ঢাকার জন্য কিছু গোপন করার দরকার নেই।

বাপী উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। জিকে ওটুকু না বললে চলত। ওর নিজের বুদ্ধিই যথেষ্ট। তার ওপর আবু রব্বানী অনেক রকমের তালিম দিয়েই রেখেছে। কলেপড়া মুখ করে ও কি বলবে বাপী জানে। বলবে, চ্যাটার্জি সাহেবের সঙ্গে আগে তারই গলায় গলায় ভাব হয়ে গেছল।…চ্যাটার্জি সাহেবের মতো অত না হলেও অল্পস্বল্প নেশার অভ্যেস তারও আছে। লিকারশপের সেই মেয়ে মালিকের কাছ থেকে জিনিস কিনত। সেই মেয়ে তাকে খুব খাতির করত আর সস্তায় জিনিস দিত। কারণ, ইনকাম ট্যাক্সের অনেকের সঙ্গে তার দহরম—মহরম। তার গত দু’তিন বছরের ইনকাম ট্যাক্সের জট জিত্ সাফ করে দিয়েছে, অনেক টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে। চ্যাটার্জি সাহেব ড্রিংক-এর এত বড় সমজদার, তাই জিত্‌ই সেই মেয়ে মালিকের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। সস্তায় ভালো জিনিস পাওয়া ছাড়া এর থেকে আর কোনো বিভ্রাট হতে পারে ভাবেনি। বেগতিক দেখে মাস পাঁচ ছয় আগে জিত্‌ ভয়ে ভয়ে ব্যাপারটা মালিককে জানাতে চেষ্টা করেছিল!…আর শেষে বলবে, মালিকের শোনার সময় বা আগ্রহ হয়নি দেখে সে-ও চুপ মেরে গেছে।

.

তাসের ঘর ধসে গেছে। মিষ্টি মেয়েদের কোনো হস্টেলে যাওয়ার মতলবে ছিল। তার বাবার জন্য পারেনি। বাবা রিটায়ার করে কলকাতায় চলে এসেছে। সকলে মিলে একরকম জোর করেই তাকে বাড়িতে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন ঝড়ের পরের স্তব্ধতা থিতিয়ে আছে।

মনোরমা নন্দীর ঘন ঘন টেলিফোন আসছে। গলার চাপা স্বর শুনেই বাপী বুঝতে পারে টেলিফোনের তাগিদটা মেয়ের অগোচরে। সব থেকে বেশি এখন তাকেই দরকার, আভাসে ইঙ্গিতে তাও বলতে কসুর করেননি। দুচারবার বাপী এটা-সেটা বলে এড়িয়েছে। তারপর স্পষ্ট আশ্বাস দিয়ে বলেছে, আপনি ব্যস্ত হবেন না মাসিমা, যখন সময় হবে আমি নিজেই যাব, আপনাকে বলতে হবে না।

সুদীপ নন্দীও কোর্ট ফেরত বাড়িতে হানা দিচ্ছে প্রায়ই। মায়ের বাড়িটা এরপর সম্পূর্ণ তার একার হবে এই আশাতেই হয়তো দ্রুত ফয়সলার দিকে এগনোর তাড়া তার। টাকার যার গাছপাথর নেই, আর মন যার অত দরাজ—সম্পর্ক পাকা হবার পর সে ওই বাড়ির ওপর থাবা বসাতে আসবে না এ বিশ্বাস আছে। তিক্তবিরক্ত সে আসলে নিজের বোনের ওপর। তার মাথায় কি-যে আছে ভেবে পাচ্ছে না। কারো সঙ্গে কথা নেই। চুপচাপ আপিসে যায় আসে। এত বড় এক ব্যাপারের পরেও ডিভোর্সের কথায় হাঁ না কিছুই বলে না। দীপুদার বাপীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

বাপীর একই জবাব।——আমার পরামর্শ যদি শোনো তো ব্যস্ত হয়ো না। এত বড় ব্যাপার হয়ে গেল বলেই ধৈর্য ধরে কিছুদিন সবুর করো। মাসিমাকেও তাড়াহুড়ো করতে বারণ করো।

দেড় মাসের মধ্যে অসিত চ্যাটার্জির ভরাডুবি ঘনিয়ে এলো আর এক দিক থেকে। এর পিছনে সবটাই কুমকুমের হাতযশ। বড় তেল কোম্পানীর চিফ অ্যাকাউনটেন্ট, জমা খরচের হাজার হাজার কাঁচা টাকা অসিত চ্যাটার্জির হেপাজতে। আজকের জমার টাকা কাল বা পরশু পিছনের তারিখ দিয়ে খাতায় দেখালে কে আর ওটুকু কারচুপি ধরছে। ক্যাশ ব্যালান্স ঠিক রাখাও তো তারই দায়। তারিখ অনুযায়ী সেটা ঠিক থাকলেই হল। শনিবারে রেসের মাঠের জন্য পাঁচ-সাতশ বা হাজার টাকা সরিয়ে সোমবারে আবার সে টাকাটা পুরিয়ে রাখলেই হল। দুচারবার এ-রকম করেছে। শনিবারে তাড়াতাড়ি ব্যাংক বন্ধ, কুমকুম হয়তো সময় করে টাকা তুলে রাখতে পারেনি। অসিত চ্যাটার্জিকে ফোনে জানিয়ে রেখেছে, কিছু টাকার ব্যবস্থা রেখো, সোমবার পেয়ে যাবে।

রেসে জিতলে তো কথাই নেই, ঘাটতির টাকা তক্ষুনি পকেটে এসে গেছে। না জিতলেও সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। রবিবারের সান্ধ্য বৈঠকে কুমকুম দোকান থেকেই সে-টাকা এনে তার হাতে তুলে দিয়েছে। তাই আপিসের টাকায় হাত দিতে অসিত চ্যাটার্জির তখন আর ভয়-ডর নেই।

কুমুর টেলিফোন পেয়ে শেষবারে চার হাজার টাকা সরিয়েছে। হাতে খুব ভালো ভালো টিপ আছে। কি কি উৎসব উপলক্ষে বড়দরের খেলা। কপালদোষে সেদিন সবটাই হার হয়ে গেল, রবিবারের সন্ধ্যায় এসে অসিত চ্যাটার্জি আয়ার মুখে শুনল হঠাৎ কোনো জরুরী কাজে কুমকুম বাইরে গেছে, পরদিন সকালের মধ্যেই ফিরবে বলে গেছে। অসিত চ্যাটার্জি তখনো নিশ্চিন্ত। পরস্পরের প্রতি এমনি মুগ্ধ তারা যে বাজে ভাবনাচিন্তার ঠাঁই নেই।

কিন্তু পরদিন অফিসে যাবার আগে টাকা নিতে এসে দেখে কুমকুম ফেরেনি। এবারে অসিত চ্যাটার্জির চিন্তা হয়েছে একটু। কুমকুমের জরুরি কাজে হঠাৎ যাওয়া বা দিনকতকের জন্য আটকে পড়া নতুন নয়। আগেও এরকম হয়েছে। সেরকম কোনো জরুরী কাজের জন্য যদি চলে গিয়ে থাকে, চার হাজার টাকার ব্যাপারটা হয়তো ভুলেই বসে আছে।

ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে, একদিন ছেড়ে চার-পাঁচ দিনও এই ঘাটতি ধামা-চাপা দিয়ে রাখা সহজ ব্যাপার। কিন্তু লোকটার বরাত নিতান্তই খারাপ এবার। ভিতরের কারো শত্রুতার ফল কিনা জানে না। সেই বিকেলের মধ্যেই ধরা পড়ে গেল। বড় সাহেব স্বয়ং অ্যাকাউন্টস চেক করতে বসল।

অসিত চ্যাটার্জির মাথায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। চাকরি খতম তো বটেই ‘ এখন জেল বাঁচে কি করে। কাকুতি মিনতি করে আর হাতে পায়ে ধরে দুটো দিনের সময় নিল। কুমকুমের প্রতীক্ষায় পাগলের মতো সন্ধে পর্যন্ত কাটল। আর কোনো পথ না দেখে শশুরবাড়িতে ছুটল মিষ্টির সঙ্গে দেখা করতে। অনেক করে বলে পাঠালো, ভয়ানক বিপদ—একবারটি দেখা না হলেই না। মিষ্টি নিচে নামেনি। দেখা করেনি।

পরদিন সকাল নটা নাগাদ বাপীর কাছে এসে ধর্ণা দিল। উদ্ভ্রান্ত মূর্তি। এক্ষুনি চার হাজার টাকা না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

বাপী খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করল। খুঁটিয়ে শুনল সব। টাকার জন্য তার স্ত্রীর কাছে গেছল কিনা তাও জেনে নিল। তারপর উঠে নিজের ঘরে এসে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল। নম্বর ডায়েল করল।

ওদিক থেকে দীপুদা সাড়া দিল। বাপী মিষ্টিকে ডেকে দিতে বলল।

কয়েক মুহূর্তের অধীর প্রতীক্ষা। ফোন ধরবে কি ধরবে না সেই সংশয়।

—বলো।

একটা বড় নিঃশ্বাস সংগোপনে মুক্তি পেয়ে বাঁচল।—ও-ঘরে অসিত চ্যাটার্জি বসে আছে। তার এক্ষুনি চার হাজার টাকা চাই। না পেলে জেল হবে। অফিসের ক্যাশ ডিভালকেশন…। তার খুব পরিচিত কে একজন মহিলা হঠাৎ দু’তিন দিনের জন্য বাইরে চলে গেছে, সে ফিরে এলেই টাকাটা দিয়ে দেবে বলছে…

একটু বাদে ওদিকের ঠাণ্ডা গলা ভেসে এলো।—আমাকে ফোন কেন?

—দেব?

—যাকে দেবে আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকলে চার হাজার টাকা আমিই দিতে পারতাম। তোমার টাকা বেশি হলে বা দয়া করার ইচ্ছে হলে দিতে পারো।

ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ। বাপীও রিসিভার নামিয়ে বেরিয়ে এলো। ঠাণ্ডা মুখে অসিত চ্যটার্জীকে বলল, মিষ্টিকে ফোন করেছিলাম, টাকা দিতে পারছি না। অসিত চ্যাটার্জি আর্তনাদ করে উঠল, চার হাজার টাকার জন্য আমার জেল হয়ে যাবে বাপী? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, মিস ভড় আজ ফিরলে আজকের মধ্যেই টাকাটা তোমাকে দিয়ে যাব!

পিছনে জিত্ এসে দাঁড়িয়েছে, অসিত চ্যাটার্জি লক্ষ্য করে নি। বাপী ওর দিকে তাকাতে সে-ও দেখল। জিতের মুখে ভাব-বিকার নেই। অসিত চ্যাটার্জির কথা কানে গেছে বলেই তাকে বলল, মিস ভড় খানিক আগে ফিরেছে, একটু আগে তার ফোন পেয়েছি।

ডুবন্ত লোকটা বাঁচার হদিস পেল। এক রকম ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

.

দু’মাসের আগেই রায় বেরিয়েছে। ডিভোর্স মঞ্জুর। বিচ্ছেদের মামলা রুজু করেছিল অসিত চ্যাটার্জি। অভিযোগ, স্ত্রী দীর্ঘদিন যাবৎ তার সঙ্গে ঘর করে না। অন্য তরফ থেকে কেউ প্রতিবাদ করে নি। ফয়সলা যাতে তাড়াতাড়ি হয়ে যায় ব্যারিস্টার সুদীপ নন্দী বরং সেই চেষ্টা করেছে। তাদের তরফ থেকে কেউ হাজিরাও দেয় নি, অসিত চ্যাটার্জির অনুকূলে এক তরফা ডিক্রি জারি হয়েছে।

সেই দিনই বিকেলে কুমকুম এলো। বাড়ীতে এসে বাপীর সামনে দাঁড়ালো এই প্রথম। খানিক আগে দীপুদা ফোনে বাপীকে রায়ের খবর জানিয়েছে।

বাপী অনেকদিন কুমুকে দেখে নি। আগের থেকেও কমনীয় লাগছে। বিনম্র, হাসিছোঁয়া মুখ। বাপীর মনে হল, কাজ হাসিল করতে পারার কৃতিত্বে আজ অনায়াসে সোজা তার সামনে এসে হাজির হতে পেরেছে। ভিতরে ভিতরে বিরক্ত তক্ষুনি। প্রশংসা বা পুরস্কার কুড়নোর জন্য বানারজুলিতে আবু রব্বানীর কাছে চলে গেলে আপত্তির কিছু ছিল না।

—কি ব্যাপার? হঠাৎ যে?

একটুও ভণিতা না করে কুমকুম বলল, আমার কিছু টাকা দরকার বাপীদা…।

পুরস্কার নিতেই এসেছে তাহলে। বাপীর মুখের রেখা কঠিন। গলার স্বরও সদয় নয়।কত টাকা?

দ্বিধা কাটিয়ে কুমকুম বলল, বেশি টাকাই দরকার…আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি, জলপাইগুড়ির সেই ভাঙা ঘরদোর ঠিক করে নেব ভাবছি… কিছুদিন চলার মতো আরো নতুন করে দুজনারই কিছু শুরু করার মতো কত হলে চলে তুমিই ভালো বুঝবে।

বাপী বিমূঢ়ের মতো চেয়ে রইল খানিক। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, চলে যাচ্ছ! আমরা মানে আর কে? অসিত চ্যাটার্জি?

লজ্জা পেলেও সপ্রতিভ মুখেই মাথা নাড়ল কুমকুম। বলল, ওই লোকের ভালো কিছু নেই সত্যি কথাই বাপীদা, কোনো ভালো মেয়ের তাকে বরদাস্ত করতে পারার কথাও নয়। তবু যেখান থেকে যেখানে টেনে এনেছি…দেখা যাক না কিছুটা ফেরাতে পারি কিনা। না পারলেও আমার তো হারাবার কিছু নেই বাপীদা।

বাপী হতভম্বের মতো চেয়েই আছে। এক ঝটকায় ঘরে চলে গেল। তক্ষুনি চেকবই আর কলম নিয়ে ফিরল। খসখস করে চেকে কুমকুমের নাম লিখল। একটু থমকে বড়সড় একটা টাকার অঙ্ক বসালো। পছন্দ হল না। পাতাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিল। এবারে যে টাকার অঙ্কটা বসালো সেটা আরো বড়।

চেক হাতে নিয়ে টাকার পরিমাণ দেখে কুমকুমের দু’চোখ বিস্ফারিত।—এত টাকা কি হবে বাপীদা। না না, এত দরকার নেই—আমরা তো ভাল ভাবে কিছু রোজগার করতে চেষ্টা করব।

অন্য দিকে চেয়ে বাপী বিড়বিড় করে বলল, কিছু বেশি না, নিয়ে যাও …।

কুমকুম চুপচাপ চেয়ে রইল। আহত গলায় বলল, এর পর আমাকে তুমি আরো বেশী ঘৃণা করবে তো বাপীদা?

বাপী আস্তে আস্তে ফিরল তার দিকে। চোখের কোণ দুটো শিরশির করছে। একটা উদ্‌গত অনুভূতি জোর করেই গলা ঠেলে বেরিয়ে এলো। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ওরে না না—এর পর আমাকে তুই কত ঘেন্না করবি তাই বরং বলে যা!

হতচকিত কুমকুম ত্রস্তে কাছে এগিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। ধরা গলায় বলল, তার আগে আমার যেন সত্যি মরণ হয় বাপীদা। বাবা আজ আমাকে আশীর্বাদ করছেন—তুমিও করো।

.

রাত প্রায় আটটা। বাপী উঠল। ঘরে এসে জামা-কাপড় বদলালো। তারপর বেরিয়ে পড়ল।

সাতাশি নম্বরের সেই বাড়ি। বাপী নিঃশব্দে গাড়ি থামালো। নিচের বৈঠকখানায় দীপুদা আর তার মা। আজকের কোর্টের ফয়সালার প্রসঙ্গেই তাদের আলোচনা হচ্ছিল মনে হয়। বাপীকে দেখে দু’জনেই খুশি, কিন্তু গলার স্বর চড়িয়ে কেউ অভ্যর্থনা জানাল না। দীপুদা বলল, এসো, মা তোমার কথাই বলছিল।

—মিষ্টি কোথায়?

—ওপরে তার ঘরে। খবর দেব? এবারের আগ্রহ মনোরমা নন্দীর

—আমি গেলে অসুবিধে হবে?

—না না অসুবিধে কিসের! মহিলার ব্যস্ত মুখ।—দীপু, বাপীকে নিয়ে যা দায়টা ছেলের ঘাড়ে চাপালেন মনোরমা নন্দী। ছেলেও খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না হয়তো। কিন্তু প্রকাশ করে বলে না।—এসো, এসো।

দোতলায় উঠে ছোট ঢাকা বারান্দা ধরে দীপুদা তাকে কোণের ঘরের সামনে নিয়ে এলো। পর্দা ঝুলছে। ভিতরে আলো জ্বলছে। পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে দীপুদা বলল, মিষ্টি কি কচ্ছিস রে…বাপী এসেছে।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেয়াল-ঘেঁষা ড্রেসিং টেবিলটা চোখে পড়ল বাপীর। তার আয়নায় দেখা গেল একটা বই হাতে মিষ্টি শোয়া থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। আয়নায় তারও দরজার দিকে চোখ। বাপীকে দেখছে।

দীপুদা তাকে ভিতরে পৌঁছে দিয়ে সরে গেল। বাপীর দু’ চোখ মিষ্টির মুখের ওপর। শাড়ির আঁচলটা আরো ভালো করে টেনে দিতে দিতে সেও সোজা চেয়ে রইল। শান্ত, গম্ভীর। শোবার ঘরে এসে উপস্থিত হওয়া বরদাস্ত করতে আপত্তি, সেটা পলকে বুঝিয়ে দিল।

তক্ষুনি সেই ছেলেবেলার মতোই একটা অসহিষ্ণু তপ্ত বাসনা বাপীর শিরায় শিরায় দাপাদাপি করে গেল। তার পরেই সংযত আবার। বলল, ওঁরা নিচেই বসতে বলেছিলেন, আমি উঠে এলাম।

মিষ্টির চোখে পলক পড়ল না। বলল, দেখতে পাচ্ছি।

আবারও নিজের সঙ্গে যুঝতে হল একটু। বসতেও বলে নি। ড্রেসিং টেবিলের সামনের থেকে কুশনটা টেনে নিয়ে বাপী নিজেই বসল। স্নায়ু বশে রাখার চেষ্টা— আমার আসাটা এখনো তেমন পছন্দ হচ্ছে না মনে হচ্ছে।

অনড় দৃষ্টি তেমনি আটকে আছে।—কেন এসেছো? সব কিছুর ফয়সালা হয়ে গেল ভেবেছ?

বাপী একটু থেমে জবাব দিল, তোমার আমার দুজনেরই তাই ভাবার কথা।…যা হয়ে গেল তার ধাক্কাটা বড় করে দেখছ বলেই বোধ হয় তুমি এক্ষুনি সেটা ভাবতে পারছ না।

এবারের চাউনি তীক্ষ্ণ। মিষ্টির গলার স্বর চড়ল না। কিন্তু আরো কঠিন। যা হয়ে গেল তার পিছনে তোমার কতটা হাত ছিল?

বাপীর দু’চোখ ওই মুখের ওপরেই হোঁচট খেল একপ্রস্থ। তারপর স্থির হল, খুব ধীরে বুকের দিকে নেমে এলো একটু। আবার চোখ উঠে এলো। আশার আলো নিভলে যে জানোয়ার অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বাপী আগে তার টুটি টিপে ধরল। তার পরেও আকাশ থেকে পড়ল না। মিথ্যে বলল না। জবাব দিল, হ্যাঁ, সবটাই।

মিষ্টির মুখের তাপ চোখে জমা হচ্ছে—এর পরেও তাহলে তুমি কি আশা করো?

—আশা করেছিলাম অসিত চ্যাটার্জির জোরের পুঁজিটা তোমাকে খুব ভালো করে দেখিয়ে দিতে পেরেছি। বাপীর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝলসালো, চোখের তারায় বিদ্রূপ ঠিকরলো।—তুমি বড়াই করে বলেছিলে না এই পুঁজিতে ভেজাল নেই বলে, তার জুয়া আর নেশার রোগ বরদাস্ত করতেও তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে না…তা না হলে নিজেই তাকে ছেঁটে দিতে? এখন সবটাই মিথ্যে সবটাই ভেজাল দেখিয়ে দেবার পরেও আমি কি আশা করি তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? আমাকে তোমার দয়ার পাত্র ভেবেছ?

প্রতিটি কথা নির্দয় আঘাতের মতো কানে বিধল। কিন্তু এমনি নির্মম সত্য যে কোনো জবাব মুখে এলো না। অসহিষ্ণু আরক্ত চোখে মিষ্টি চেয়ে রইল শুধু।

কুশন ছেড়ে বাপী উঠে দাঁড়ালো। সামনে এগিয়ে এলো একটু। পুরুষের উঁচু মাথা।—শোনো, আঠারো বছর ধরে আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি, তোমার কথা ভেবেছি। এতে কোনো ভেজাল নেই—মিথ্যে নেই। বারো থেকে আজ এই তিরিশ বছর বয়েস পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি—এর পর হাতে গুণে আর তিন দিন অপেক্ষা করব। আমার কি প্রাপ্য যদি স্বীকার করে নিতে পারো, এই তিন দিনের মধ্যে তুমি আসবে, নিজে এসে আমাকে ডেকে নেবে। তা যদি না পারো এখানকার পাট গুটিয়ে আমি চলে যাব—আর তোমাকে বিরক্ত করতে আসব না।

লম্বা পা ফেলে হাতের ধাক্কায় পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *