সোনার হরিণ নেই – ৩৬

ছত্রিশ

এরোপ্লেন আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাপীকে ছেলেবেলার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল। চোখে মুখে ঠোঁটে সেই রকম দুষ্টুমি। ছলে কৌশলে সেই রকম হাত—পা গা ছোঁয়ার লোভ। মিষ্টি টের পাচ্ছে। কিন্তু সহজে তার দিকে ফিরছে না বা সোজা হয়ে বসছে না। সে জানলার দিকে। বাইরের আকাশ দেখার সুবিধে, নিরাপদও।

এয়ারপোর্টে মিষ্টির মা বাবা দাদার সামনে বাপী এতক্ষণ মানানসই রকমের গম্ভীর ছিল। তার আগেও অসহ্য রকমের কতগুলো দিন গাম্ভীর্যের খোলসের মধ্যে ঢুকে থাকতে হয়েছে। মিষ্টিকে বাপী তিন দিনের সময় দিয়েছিল। সেই তিনটে দিন এই মেয়ে ওকে কম যন্ত্রণা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখেনি। মনে পড়তে বাপীর হাত দুটো সেই ছেলেবেলার মতো নিশপিশ করে উঠল।

….সেই তিন দিনের বিকেল পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। তার পরেও মিষ্টি নিজে আসেনি। টেলিফোনে তার গলা ভেসে এসেছে।…ফোনে ডাকলে হবে? মুহূর্তের মধ্যে কি যে ঘটে গেল বাপীই শুধু জানে। কতকালের সত্তা—দুমড়োনো একটা জগদ্দল পাথর টুপ করে খসে পড়ে গেল। শূন্যে উঠে বাপীর মাথাটা তখন ঘরের ছাদে ঠোক্কর খেলেও অসম্ভব কিছু মনে হত না। স্নায়ুগুলোর ঝাঁপাঝাঁপি বন্ধ করতে সময় লেগেছিল। তারপর জবাব দিয়েছে, হবে। কিন্তু তোমার আসতে অসুবিধে কি?

—অসুবিধে বুঝে নাও।

—বুঝলাম তুমি না এলেও আমার যাওয়া আর ঠেকাচ্ছে কে?

জবাবে মিষ্টি টুক করে ফোনটা নামিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু সেখানে মিষ্টির মা বাবা আর দাদার সমাদরের বেড়া টপকে কতটুকু আর নিরিবিলিতে পাওয়া সম্ভব। ফলে সেখানেও বিরাট মানুষ হব, জামাইয়ের মানানসই গাম্ভীর্যের মুখোশ ধরে রাখতে হয়েছে। মুখখানা আরো গুরুগম্ভীর করে তুলতে হয়েছিল শাশুড়ীর প্রস্তাব শুনে। কাগজ কলমের বিয়েতে আর তাঁর আস্থা নেই। বিয়ে হবে হিন্দুমতে অগ্নিসাক্ষী করে। বাপীর তাতে আপত্তির কারণ ছিল না। কিন্তু সেটা ফাল্গুনের তৃতীয় সপ্তাহ। সে-মাসে আর বিয়ের তারিখ নেই। তারপর টানা চৈত্র মাসে হিন্দু বিয়ের কথাই ওঠে না। বিয়ের তারিখ আছে বৈশাখের মাঝামাঝি

বাপীর তখন মনে হয়েছিল অত দূরের বৈশাখ আর আসবে কিনা সন্দেহ। ফলে ভাবী শাশুড়ীকে ঘাবড়ে দেবার মতো ঠাণ্ডা মুখ করে আপত্তি জানাতে হয়েছে।…সব বিয়েই বিয়ে। ও সময়ে তাকে ভারতবর্ষের বাইরেও চলে যেতে হতে পারে।

মনোরমা নন্দী তার পরেও মেয়ের মারফৎ বৈশাখ পর্যন্ত বিয়েটা স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন। মিষ্টি বলেছিল, মা যখন চাইছে ক’টা দিন সবুর করোই না। বাপী আরো গম্ভীর।—ঠিক আছে। তুমি কাল পরশুর মধ্যে আমার সঙ্গে বানারজুলি চলো—বিয়ে না হয় পরেই হবে।

মিষ্টি প্রথমে থমকে তাকিয়েছিল। তারপর দ্রুত প্রস্থান। মা-কে কি বলেছে বাপী জানতেও চায়নি। মোট কথা সেই থেকে ভদ্রোচিত গাম্ভীর্যের মুখোশ সরানোর তেমন ফুরসৎ মেলেনি। টাকার জোরে রেজিস্ট্রি আপিসে পিছনের তারিখ বসিয়ে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। আজই সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে বিয়ে শেষ। দুপুরে অতিথি-অভ্যাগতদের নিয়ে নামী হোটেলে লাঞ্চ পার্টির পর শ্বশুরবাড়ি থেকে সোজা দমদম এয়ারপোর্ট। এতেও শাশুড়ীর খুব আপত্তি ছিল। এ জামাই অসিত চ্যাটার্জি নয় বুঝেই হাল ছেড়েছেন। রেজিস্ট্রি বিয়ের দোষ ঢাকার জন্য মেয়ের কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ পরিয়েছেন, মোটা করে সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ কেটে দিয়েছেন।

জীবনে মিষ্টি এসেছে। তাই সবার আগে বানারজুলি ডেকেছে। সেখানকার আকাশ বাতাস জঙ্গল পাহাড় তারা আসবে বলে উন্মুখ হয়ে আছে। জীবনে মিষ্টি এলো এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের মত বাস্তব। এমন বাস্তবের বাসর বানারজুলি ছাড়া আর কোথায় হতে পারে। আবু রব্বানীকে খবর দিয়ে রাখা হয়েছে বিয়ের পরেই তারা যাচ্ছে। সে বোধ হয় এতক্ষণে বাগডোগরা এসে বসে আছে।

কিছুক্ষণ ধরে নিঃশব্দে খুনসুটি করার পরেও মিষ্টি সোজা হয়ে বসল না বা জানলা থেকে মুখ ফেরালো না। বাইরের দিকেই চেয়ে আছে আর হাসি চেপে আছে। সেই ছেলেবেলার দুষ্টুমি টের পাচ্ছে। বাপীও হার মানবে না। তার ঘুম পেল। মাথাটা বার বার মিষ্টির কাঁধে ঠোক্কর খেতে লাগল। শেষে ওই কাঁধের আশ্রয়ে ঘুমিয়েই পড়ল। কিন্তু হাত সজাগ। সেটা মিষ্টির বাহুর ওপর দিয়ে তার কোলের ওপর নেমে এসে বিশ্রামের জায়গা খুঁজছে।

এবারে মিষ্টি ধড়ফড় করে তাকে ঠেলে সরালো। এরোপ্লেন যাত্রী খুব বেশি না হলেও একেবারে কম নয়। চাপা তর্জনের সুরে বলল, এই! হচ্ছে কি?

—কি হচ্ছে?

গলা আরো নামিয়ে মিষ্টি বলল, শ্লীলতাহানির চেষ্টা।

মিষ্টি এবারে সোজা হয়ে বসল। গম্ভীর। কিন্তু ঠোঁটে হাসি ছুঁয়ে আছে। সিঁথি আর কপালের জ্বলজ্বল সিঁদুরের আভা গাল আর মুখের দিকে নেমে আসছে।

দুর্বার লোভের এমন স্বাদও বাপীর আগে জানা ছিল না। একটু বাদে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। গলা খাটো করে বলল, আমি একটা গাধা। গোটা এরোপ্লেনটা রিজার্ভ করে আনা উচিত ছিল।

মিষ্টি সামান্য ঘাড় ফিরিয়ে পলকে দেখে নিল। ঠোঁটের হাসিটুকুকেও আর প্রশ্রয় দেওয়া নিরাপদ ভাবছে না। নির্লিপ্ত চোখ আবার সামনের দিকে।

বাপীর আরো মজা লাগছে। এয়ার অফিসের জুনিয়র অফিসারের ব্যক্তিত্বের ফাঁক দিয়ে বানারজুলির মিষ্টি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

বাগডোগরা।

আবু দুটো গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে হাজির। ওর নিজের গাড়ি একটা। অন্যটা বাপীর গাড়ি। বাদশা চালিয়ে এসেছে। সেই গাড়ি আবার ফুল আর লতাপাতা দিয়ে সাজানো। কলকাতা থেকে আরো অতিথি অভ্যাগত আসতে পারে ভেবে দুটো গাড়ি আনা। শুধু দুজনকে দেখার পরে মনে হল, এ-সময় ঝামেলা বাড়াবে দোস্ত এত বোকা নয়।

দু’হাতে বাপীকে জাপটে ধরল প্রথম। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, তুমি মরদ বটে একখানা দোস্ত।

নিরীহ মুখে বাপীও খাটো গলায় জবাব দিল, চৌদ্দ বছর বয়সে বাবার সেই মারের পর তুমিই তো তাতিয়ে দিয়ে বলেছিলে মরদ হলে বদলা নিতে।

তাকে ছেড়ে আবু সভয়ে দেখে নিল বহিনজি শুনল কি না। তারপর মিষ্টিকে শুনিয়েই বলল, ভেরি ডেনজারাস আদমি ইউ! মালিক হও আর যাই হও, এখন থেকে আমি সব সময় মালকান বহিনজির দিকে।

ঘুরে মিষ্টির উদ্দেশে আধখানা নুয়ে বশম্বদ কুর্নিশ করে উঠল। অপ্রস্তুত মিষ্টি বলে উঠল, ও-কি!

—সেরে রাখলাম। আবুর ডগমগ মুখ।—এরপর সব গোস্তাফি মাফ হয়। আমি কিন্তু আর তোমাকে আপনি-টাপনি বলতে পারব না বহিনজি—দোস্ত আস্কারা দিয়ে জংলি মানুষকে কাঁধে তুললে আমার কি দোষ!

মিষ্টি হেসে জবাব দিল, কিছু দোষ নেই, বলতে হবে না।

বানারজুলি পৌঁছুতে সন্ধ্যা।

আবুর কাণ্ড দেখে বাপী হাসবে না রাগ করবে। আবুকে বেশি ঘটা করতে নিষেধ করে দিয়েছিল। পাশাপাশি দুটো বাংলোই রকমারি রঙিন আলোয় ঝলমল করছে। দুই বাংলোর মাঝের মেহেদি গাছের পার্টিশনের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য আলোর ফুল। দুই বাংলোর উঠোনে আর বারান্দায় লোক গিসগিস করছে। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত উত্তর বাংলার কেউ বাকি নেই বোধ হয়। চা-বাগানের অনেক পদস্থজনেরাও আমন্ত্রিত হয়ে এসেছে। বাপী তরফদার আবু রব্বানীও আর উপেক্ষার পাত্র নয়। ডাটাবাবুও তার রেজিমেন্ট নিয়ে হাজির। বুফে ডিনারের সব ভার তার ওপর। বাইরের যে-সব অভ্যাগতরা স্বস্থানে ফিরতে পারবে না, রাতে তাদের ক্লাব হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আবুর আয়োজনে ত্রুটি নেই।

উপহার আর অভিনন্দন পর্বের পরে মিষ্টিকে নিয়ে বাপীর বাংলোর ঘরে উঠে আসতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। এরপর সাড়ে আটটায় ডিনার। আত্মজনেরা কেউ ভিড়ে মিশে যেতে রাজি নয়, তারা বাংলোর ভিতরে অপেক্ষা করছিল। বাপী প্রথমে দুলারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মিষ্টিকে বলল, আবুর বউ, আমার এখানকার গার্জেন।

বউ দেখে খুশিতে দুলারির চোখে পলক পড়ে না। তারপর স্বভাব-গম্ভীর গলায় বাপীর দিকে ফিরে বলল, তোমার বউ না গার্জেন দেখে ভিরমি খায় বাপীভাই—তা আমি এখন গড় করি না কি করি?

বাপী গম্ভীর একটু।—ছোট বোনকে গড় করবে কি, আশীর্বাদ করো।

এদের শিক্ষা-দীক্ষা যেমনই হোক হেলা-ফেলার যে নয় পরোক্ষে মিষ্টিকেই সেটুকু বুঝিয়ে দিল। এরপর কোয়েলা এগিয়ে এলো। সেও তার রুচিমতো সাজসজ্জা করেছে। খাটুনি নেই, খেয়ে ঘুমিয়ে বেচারী আরো খানিকটা বিপুলা হয়েছে। অতি কষ্টে উপুড় হয়ে দু’হাত মাটিতে ঠেকালো। গড়ের মধ্যে এই ওদের সেরা গড়। মিষ্টি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে সোজা হতে সাহায্য করল, এটুকুতেই কালো মুখ খুশিতে আটখানা।

খবর পেয়ে ঝগড়ুও হাজির। সকালেই পাহাড়ের বাংলো থেকে নেমে এসেছে। বয়েস এখন সাতাত্তর। মোটামুটি মজবুত এখনও। বউয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বাপী তাকেও মর্যাদা দিতে ভুলল না। বাদশা ড্রাইভারের সঙ্গে পথেই পরিচয় করানো হয়েছে।

একটু বাদে ঘর্মাক্ত কলেবরে আবু এলো। সকলকে সরিয়ে দুলারি মিষ্টিকে একটু বিশ্রাম নিতে বলছিল। আবু বাধা দিল, বিশ্রাম সেই রাত্তিরে হবে—এখন মুখ-হাত ধুয়ে সাজ-টাজ যদি কিছু করার থাকে জলদি করে নিতে হবে। আরো লোক এসে গেছে, আবার ডিনারের সময় হচ্ছে।

বাপী সত্যিকারের গম্ভীর।—আরো লোক এসে গেছে?

—বা রে, আসবে না!

—তোমাকে নিষেধ করলাম, আর তুমি এত বড় এক ব্যাপার করে বসে আছ?

আজ অন্তত আবু কারো ভ্রুকুটির তোয়াক্কা রাখে না। জবাব দিল, ছাড়ো তো! এ কি আমার বিয়ে যে তিন দিন আগেও হবু বিবি চেলা কাঠ নিয়ে তাড়া করেছে।

বিড়ম্বনা সামলে দুলারি সকোপে তাকালো তার দিকে। মিষ্টি হেসে ফেলল। বাপী বলে উঠল, আমারও তো সেই বরাত! তাহলে তুমি এত ঘটা করতে গেলে কেন?

আবু হাসছে।—বহিনজির চেলা কাঠ তো চন্দন কাঠ, কার সঙ্গে কার তুলনা। দু’হাত কোমরে তুলে সদর্পে দুলারির মুখোমুখি।—কি বলেছিলাম?

একটু কাঁচুমাচু মুখ করে দুলারি মিষ্টির দিকে তাকালো।—বলেছিলে, এই সুরৎ নিয়ে আর বহিনজির কাছে গিয়ে কাজ নেই।

আবুর উদ্দেশে মিষ্টির চোখে অনুযোগ করার আগেই আবু চেঁচিয়ে উঠল, নো নো টু বহিনজি! আমি কক্ষনো একথা বলিনি।

ইংরেজির ধাক্কায় মিষ্টি হেসে ফেলল। বাপী হাসি চেপে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে কি বলেছিলে?

এবারও দুলারিই জবাব দিল, বলেছিল, দোস্ত-এর বউয়ের নাম মিষ্টি, কত মিষ্টি দেখো’খন—এক কথাই হল না?

মিষ্টি লজ্জা পাচ্ছে। ভালোও লাগছে। এই মানুষগুলো লেখা-পড়া জানে না, শহরের আদব কায়দা জানে না এ একবারও মনে আসছে না।

সব শেষে আবু আর দুলারিকে বিদায় দিয়ে বাপী ঘরে এলো। রাত সাড়ে দশটার ও-ধারে। বাংলো নিঝুম এতক্ষণে। ঝলমলে সাজ-পোশাক বদলে মিষ্টি চওড়া লালপাড় হালকা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। সেই রঙেরই ব্লাউস। খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে বসে আছে।

বাপী দু’চোখ ভরে দেখল খানিক। ঠোটের হাসি চেপে মিষ্টিও চেয়ে রইল। গায়ের জামাটা খুলে বাপী একদিকে ছুঁড়ে দিল। দরজা দুটো বন্ধ করে কাছে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টির ঠোটে হাসি টিপটিপ করছে।

—কেমন লাগছে?

মিষ্টির চোখে মিষ্টি কৌতুক। জবাব দিল, এখনও বানারজুলির মতো লাগছে না।

বাপী থমকালো একটু। জানালার পর্দার ওপরের ফাকটুকু দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। বলল, এক্ষুনি লাগবে, দেখো।

ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিল। তারপর জানালা দুটোর পর্দা সরিয়ে দিতেই দু’দিক থেকে বাইরের জ্যোৎস্না এসে ঘরে আর বিছানায় লুটোপুটি খেল।

বাপী বলল, শুয়ে পড়ো। চোখ বুজে শোনো।

মিষ্টি তাই করল। বাপী নিঃশব্দে একটা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। দেখতে দেখতে চারদিকের নীরবতা আরো নিঝুম। না, নিঝুম বলা একেবারে ভুল। রাশি রাশি ঝিঁঝি একসঙ্গে গলা মিলিয়েছে। সামনে জঙ্গলের গাছপালার সঙ্গে চৈত্রের বসন্ত বাতাসের মিতালির সড়সড় শব্দ থেকে পুষ্ট হচ্ছে। মিষ্টি কান পেতে শুনছে।

প্রায় মিনিট দশেক বাদে সুইচ টিপে সবুজ আলোটা জ্বালল। কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বানারজুলি?

মিষ্টির চোখে হাসি দুলছে। মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল, বেশ তো ছিল, আলো জ্বাললে কেন?

—হুঁ? বাপীর পলকা ভ্রুকুটি।—কেন জ্বাললাম?

তার গা ঘেঁষে বসল। চেয়ে আছে। মিষ্টিও। বাপী হাসছে অল্প অল্প। মিষ্টিও। বাপীর দু’চোখ লোভে টইটম্বুর। বাসনার দাপাদাপি টের পাচ্ছে তবু হাত বাড়াচ্ছে না। এই রাত কৃপণের মতো খরচ করার রাত।

হাসি-টুপটুপ ঠোটের কোণ দাঁতে কেটে মিষ্টি বলল, কি?

বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি?

মিষ্টি বলল, এক গেলাস জল দেব?

বাপী বুঝে উঠল না। জিজ্ঞাসা করল, জল কেন?

মিষ্টি বলল, সেই কতকাল ধরে জল দিয়ে গিলে খাবার সাধ

তার পরেই প্রমাদ গুনল। লুঠতরাজের দস্যুকে সেধে অন্তঃপুরের দরজা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরে সবুজ আলো। জানালার পর্দা সরানো। মিষ্টি চেষ্টা করল বাধা দিতে। পারা গেল না। দেড় যুগের বুভুক্ষু দস্যু সব বাধা ছিঁড়েখুঁড়ে তাকে বিপুল বিস্মৃতির মাঝদরিয়ায় টেনে নিয়ে চলল।

পৃথিবী কি থেমে ছিল কিছুক্ষণ…বা অনেকক্ষণ! কোনো নিঃসীম নীরবতার গভীরে ডুবে গেছল। নাকি বাপী ঘুমিয়ে পড়েছিল? আস্তে মুখ তুলে তাকালো। দেখছে। কোন্ অপরিসীম শান্তির জগৎ ঘুরে এখান থেকে এখানেই ফিরে এলো।

মিষ্টিও চেয়ে আছে। তাকেই দেখছে।

.

কটা দিন প্রায় হাল ছেড়ে ভোগের এক অবুঝ দুরন্ত রূপ দেখল মিষ্টি। যৌবনের অনুবাস্তবে এই লোক প্রথম নয়। কিন্তু পুরুষ যেন এই প্রথম আগেও ভোগ দেখেছে। নিজেকে সেই ভোগের এমন একাত্ম দোসর ভাবতে পারেনি। দেহ-পথে সমস্ত সত্তার ওপর এমন দুর্বার দখল বিস্তার দেখেনি। আবার স্বার্থপরের দখলও নয়। দু’দিকেরই সমর্পণ শর্ত, সমর্পণ লক্ষ্য।

নিজের ছাব্বিশের এই মেদশূন্য সুঠাম দেহ সম্পর্কে মিষ্টি কম সচেতন নয়। সক্রিয় চেষ্টায় বয়েসটাকে বাইশের পাকাপোক্ত গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু কটা দিনের মধ্যেই অনুভব করেছে, যা আছে খুব বাড়তি কিছু নয়। এটুকু না থাকলে ওই দামাল পুরুষের দোসর হওয়া খুব সহজ হত না। মিষ্টির অবাক লাগে, এত ক্ষুধা এত তৃষ্ণা আর এমন দুর্জয় আবেগ নিয়ে এই মানুষ এতকাল বসে ছিল কি করে।

মিষ্টি সেদিন না বলে পারল না, যে কাণ্ড করছ, দুদিনে ফুরিয়ে গেলাম বলে। বাপী নিরীহ মুখে ঘটা না করে দেখতে লাগল তাকে। এ-রকম দেখাটাই হঠাৎ জুলুমের সূচনা মিষ্টি এ ক’দিনে সেটা বুঝে নিয়েছে। চকিতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অর্থাৎ হামলার মতলব দেখলেই সে ঘর থেকে পালাবে। অগত্যা গম্ভীর আশ্বাসের সুরে বাপী বলল, যতই করিবে দান, ততো যাবে বেড়ে।

বারান্দায় আবুর হাঁক শোনা গেল, বাপী ভাই আছ?

মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় এলো। তাকে বসতে দিয়ে বলল, দিদি এলো না?

দিদি শুনে আবু গলে গেল।—তুমি ডাকছ শুনলে ছুটে আসবে—

বাপীও বারান্দায় এসে চেয়ার টেনে বসল। হাতে আগের দিনের খবরের কাগজ। ভাবখানা, এতক্ষণ এটা নিয়েই সময় কাটাচ্ছিল। এখনো ওতেই চোখ। এক-পলক দেখে নিয়ে আবু জিজ্ঞাসা করল, দোস্ত-এর তবিয়ৎ ভালো তো?

—খুব ভালো। কেন?

—চার-চারটে দিন কেটে গেল, রোজই আশা করছি বহিনজিকে নিয়ে একবার গরিব ঘরে যাবে।

ছোট হাই তুলে বাপী জবাব দিল, কি করে যাই, নিজেও যাবে না, আমাকেও ছাড়বে না। সারাক্ষণ চোখে আগলে রেখেছে, দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী, বুঝতেই পারো…

মিষ্টির মুখ লাল। চারদিনের মধ্যে দুদিন জঙ্গল দেখতে বেরোনোর কথা সে-ই বলেছে। টেনে বার করা যায় নি। রাগ করে ভিতরের দরজার দিকে পা বাড়ালো।

বাপী শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। আ-হা, সত্যি কথা বললাম বলে আবুর সামনে অত লজ্জা কিসের। বিয়ের পর বউ ওকে একমাস পর্যন্ত ঘর ছেড়ে বেরুতে দেয়নি—তারও দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী—বেরুতে চাইলে দুলারি নাকি চেলা-কাঠ নিয়ে তাড়া করত। তুমি তো অতটা করো না।

আবু গলা ছেড়ে হেসে উঠল। বলল, তুমি খামোখা লজ্জা পাচ্ছ বহিনজী—সেই বাচ্চা বয়েসে তোমার জন্য বাপীভাই যে পাহাড় থেকে ঝাঁপ খায়নি আমার বাপঠাকুদ্দার ভাগ্য। এখন উল্টো বলতে না পারলে ভাত হজম হবে?

আবু উঠে পড়ল। তার কাজের অন্ত নেই। একবার খবর নিতে এসেছিল। বাপীকে বলল, ঠিক আছে, দুলারিকে বলব’খন দোস্ত এখন বেজায় ব্যস্ত—ফুরসৎ মিললে বহিনজিকে নিয়ে আসবে।

সেই দিনই দুপুরের আকাশ অন্য রকম। বাতাস অন্য রকম। চৈত্রের মেঘ কালো আস্তরণ বিছিয়ে সূর্য ঢেকেছে। পাহাড়ী এলাকায় অসময়ের মেঘ নতুন কিছু নয়। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস দিয়েছে। গাছপালার সরসর শব্দ কানে আসতে ক’দিনের মধ্যে বাপীর মনে হল, বানারজুলির জঙ্গল আজ ওদের ডাকছে।

যেমন ছিল দুজনে তেমনি বেরিয়ে পড়ল। বাপীর পরনে পাজামা, গায়ে গেঞ্জির ওপর শার্ট। ও এ-ভাবে বেরুলো দেখে মিষ্টিরও সাজ বদলের কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। আটপৌরে ভাবে পরা দামী শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরে নিল। গায়ে ফিকে লাল ব্লাউস। পিঠের ওপর খোলা চুল। যাচ্ছে জঙ্গলে। সেখানে যা সহজ তাই সুন্দর।

কিন্তু বাইরে এত ছোলাছুলি বাতাস আগে বুঝতে পারেনি। পাশাপাশি পাকা রাস্তা ধরে চলেছে। একটু বাদে মিষ্টি ফাঁপরে পড়ল। চুল সামলাতে গেলে শাড়ি যে বেসামাল হয়, আবার শাড়ির নিচের দিক ঠিক রাখতে গেলে আঁচল ওড়ে। বার কয়েক দেখে নিস্পৃহ গলায় বাপী বলল, যে যেদিকে চায় যেতে দাও না, অত ধকল পোহানোর কি দরকার।

ধমকের সুরে মিষ্টি বলল, খুব শখ যে, জঙ্গলে না নেমে হাঁটিয়ে মারছ কেন? বাপী জবাব দিল না। মুচকি হেসে এগিয়েই চলল। দুপুরের রাস্তা একেবারে নির্জন বলেই মিষ্টিও খুব একটা অস্বস্তি বোধ করছে না। চলতে চলতে মাথার চুল আঁট-খোঁপা করে নিল। আর শাড়ির আঁচলটা কাঁধের ওপর দিয়ে এনে ভালো করে কোমরে জড়িয়ে নিল। সামনে কেউ পড়লে আঁচলটা চট করে খুলে মাথায় টেনে দেওয়া যাবে।

বাপী মন্তব্য করল, এয়ার অফিসের জুনিয়র অফিসার মালবিকা এইবার ঠিক—ঠিক খসল—বানারজুলির মিষ্টির খোঁজ পাচ্ছি।

খুব মিথ্যে বলেনি। মিষ্টির নিজেরই ফেলে আসা এক দূরের অতীতের দিকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। একটু আগে যে বাংলোটার সামনে এসে দাঁড়াল, দেখা মাত্র সেই অতীত আরো কাছে এগিয়ে এলো। তাদের সেই বাংলো। সামনের কাঠের বারান্দাটা ঠিক তেমনি আছে।

পাশের লোকের দিকে চেয়ে সভয়ে বলল, কি মতলব, ভেতরে যাবে নাকি?

বাপী মাথা নাড়ল। যাবে না। বলল, ওই বারান্দাটার দিকে চেয়ে একটা দৃশ্য দেখছি। …এমনি দুপুরে চোরের মতো এসে আমি একজনের অঙ্ক বলে দিচ্ছি। সে যখন টুকছে আমি তখন চোরের মতোই গায়ের সঙ্গে লেগে দাঁড়িয়ে তার গায়ের আর মাথার ঝাঁকড়া চুলের গন্ধ নাকে টানছি। অঙ্ক টোকায় ব্যস্ত সে আমাকে কাঁধ আর কোমর দিয়ে ঠেলে দিয়ে বলছে, আঃ, সরো না।

—অসভ্য কোথাকারের। দু’গালে লালের ছোপ পড়ল।

সেখান দিয়ে জঙ্গলে নামার মুখে কি মনে পড়তে মিষ্টি বলল, যাঃ সেই গাছটা কেটে ফেলেছে।

বাংলোর সামনে রাস্তার ধারের সেই গাছটা হালে কাটা হয়েছে মনে হয়। মাস কয়েক আগেও বাপী ওটা ওখানে দেখেছে। সেই গাছের ডালে বসে বাপী নানা কৌশলে মিষ্টিকে বাংলো থেকে টেনে আনত।

জঙ্গলে ঢুকেই মিষ্টির একখানা হাত বাপীর দখলে। এই উপদ্রব মিষ্টির ভোলার কথা নয়। ভোলেনি মুখ দেখেই বোঝা গেল। ভ্রুকুটি করে বলল, ধেৎ কেউ দেখে ফেলবে—

হাতের দখল আরো ঘন করে বাপী বলল, এই জঙ্গলে শুধু নিজের জন ছাড়া আর কেউ কাউকে দেখে না।

মিষ্টি বাধা দিল না। তার অদ্ভুত ভালো লাগছে। অনেক পিছনে ফেলে আসা অতীত এমন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে কে জানত! ছোট বড় গাছগুলো বাতাসে দুলে দুলে সেই আগের মতোই ডাকছে ওদের। সেই রঙিন প্রজাপতির দল জোড় বেঁধে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে। জোড়ায় জোড়ায় কাঠবেড়ালি গাছের ডালে লুকোচুরি খেলছে। খরগোশের জুটি একটা আর একটাকে ধাওয়া করছে। পেখম—মেলা ময়ূর তার ময়ূরির মন ভোলাচ্ছে। জঙ্গলের এ যৌবনে জরা নেই।

খুশি মনে মিষ্টি তন্ময় হয়ে দেখছে। সব ছেড়ে হাত ধরা মানুষটা যে অপলক চোখে ওকেই দেখছে খেয়াল নেই।

একটা গাছের মোটা সোটা ডালের ওপর হাত রেখে বাপী বলে উঠল, বাঃ ঠিক সেই রকমই আছে—উঠে পড়া যাক, তারপর তুমি আমার পা বেয়ে উঠে পাশে বোসো।

মিষ্টি তক্ষুনি বুঝেছে। সমস্ত মুখ টকটকে লাল। এইভাবে ওকে তুলে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে পাশে বসানো হত। পড়ে যেতে পারে বলে ধমকেই এক হাতে নিজের গায়ের সঙ্গে ওকে জড়িয়ে ধরে থাকত। বাঁদরের ভয় দেখিয়ে আরো কত রকমের দুষ্টুমি করত। নামানোর সময় আগে নিজের বুকের ওপর টেনে নামাতো। তারপরেও সহজে ছাড়তে চাইত না। পিপড়ের ডাঁইয়ের ভয় দেখিয়ে ওই রকম করে দশ-বিশ গজ এগিয়ে যেত।

—তুমি একটা অসভ্যের ধাড়ী—চলো।

আবার খানিক চলার পর বাপী আচমকা থমকে দাঁড়াল। গলা দিয়ে স্স করে ত্রাসের শব্দ বার করল একটা, সঙ্গে সঙ্গে এক হাতে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতের আঙুল একটা শিশু গাছের গুঁড়ির দিকে তুলে বলে উঠল, সাপ!

বিষম চমকে মিষ্টি একেবারে তার বুক ঘেঁষে দাঁড়াল।—কোথায়?

আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাপী শিশুগাছের মোটা গুঁড়িটা দেখালো।— ওই যে!…এই যাঃ, ওখানেই তো ছিল।…একটু আগে দেখলাম, ওই গাছের গুঁড়িতে জড়ানো সাদা-কালোর ছোপ মারা একটা বিশাল ময়াল লম্বা চ্যাপ্টা মুখটা সামনের দিকে টান করে এগিয়ে দিয়ে একটা ছোট মেয়েকে চোখে আটকে ফেলেছে, আর তাকে ধরার জন্য গাছের গুঁড়ি থেকে শরীরের প্যাঁচ খুলছে— সেদিকে চেয়ে অবশ মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে—কোথা থেকে একটা ছেলে এসে এক ধাক্কায় মেয়েটাকে পাঁচহাত দূরে ছিটকে ফেলে দিল, তারপর তাকে তুলে নিয়ে ছুটে পালালো।

জোর করেই দু’হাতে বাপী ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে, তেমনি শক্ত করে আগলে রেখে বলল, তারপর সেই মেয়ের মায়ের হাতে ওই ছেলের কানমলা পুরস্কার জুটল।

রক্তে দোলা লাগছে, মাথাটাও ঝিমঝিম করছে মিষ্টির।—ছাড়ো, কে কোন্ দিক থেকে এসে যাবে।

বাপী হাসছে।—বললাম না জঙ্গলের জগৎ আলাদা, এসে গেলেও কেউ কাউকে দেখে না। সেদিনের জন্য আমার কি পুরস্কার পাওনা ছিল?

জবাবে এদিক-ওদিক চেয়ে মিষ্টি নিজের ঠোঁটে তার ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিয়েই ধাক্কা মেরে সরালো তাকে।

বাপী হাসতে লাগল।

মিষ্টি বলল, আর বেড়িয়ে কাজ নেই, ফেরো!

বাপী বলল, আমার কি দোষ, একে একে সব মনে করিয়ে দিচ্ছি।

মিষ্টির ঠোঁটে চাপা হাসি। টিপ্পনীর সুরে বলল, জীবনে প্রথম পুরুষ চিনিয়েছ, সব মনে আছে, বেশি মনে করিয়ে দিতে হবে না!

বলল বটে, এক্ষুনি ফিরতে মোটেই চায় না। ছেলেবেলায় জঙ্গলে ঢুকলে রক্তে নেশা ধরত। এখনো তাই। তার থেকেও বেশি। সঙ্গের লোক হঠাৎ বেশ সভ্য—ভব্য হয়ে গেল লক্ষ্য করছে। জঙ্গলের গাছ চেনালো। ব্যবসার কাজে লাগে এমন কিছু গাছ দেখালো। সাপ ধরার গল্প করল। প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে ঘুরতে ঘুরতে আর এক জায়গায় দাঁড়ালো।

গাছ-গাছড়ার মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা। বাপী ভাবুকের মতো চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। তারপর আলতো করে জিগ্যেস করল, এ জায়গাটা মনে আছে?

চারদিক চেয়ে মিষ্টি ঠিক ঠাওর করতে পারল না। মাঝের আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে যাওয়ার ফলে সজাগও ছিল না তেমন। জিগ্যেস করল, এখানে কি? জবাবে বাপী হঠাৎ গায়ের শার্টটা খুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল। তারপর মিষ্টির বিমূঢ় চোখের সামনে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো। বলল, এখানে কিছু বেপরোয়া ব্যাপার ঘটেছিল বলে পিঠে এই দাগগুলো পড়েছিল। বাংলোয় দাঁড়িয়ে তুমি নিজের চোখে দেখেছিলে—

ওই হাসি-হাসি মুখ আর চোখের দিকে তাকিয়েই ভিতরে ভিতরে বিষম অস্বস্তি মিষ্টির। মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলের কোনো আদিম ইশারা আষ্টেপৃষ্ঠে হেঁকে ধরতে চাইছে তাকে। শরীর ঝিমঝিম করছে। ছোট ছেলেকে আশ্বস্ত করার মতো করে তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক আছে, ওখানেও হাত বুলিয়ে আদর করে দেব’খন, জামা পরে নাও।

বাপী বাধ্য ছেলের মতো নিচু হয়ে জামা কুড়োতে গেল। তারপর মিষ্টি কিছু বোঝার আগে চোখের পলকে ছোঁ মেরে তাকে মাটি থেকে শূন্যে তুলে ফেলল। এক হাতে ঘাড়ের নিচে, অন্য হাত দুই হাঁটুর পিছনে। একেবারে বুকের ওপর তুলে এনেছে।

মিষ্টির গলা দিয়ে একটু গোঁ গোঁ শব্দ বেরুলো শুধু। দুই ঠোঁট আর মুখও ততক্ষণে এই অকরুণ দস্যুর দখলে। বাধা দেবার সর্ব শক্তি নিঃশেষে টেনে নিচ্ছে। আর বুঝি থামবেই না।

থামল। মুখ তুলল। দু’চোখে অমোঘ অভিলাষের তরল বন্যা। চাপা ভারী গলায় বলল, পিঠের এ-দাগ ঘরের আদরে ভোলানো যাবে না।

দু’চোখ বড় করে মিষ্টি তাকালো একবার। জঙ্গলের সেই আদিম ইশারা এখন দামামা বাজিয়ে ধেয়ে আসছে। সর্বাঙ্গ অবশ। অবশ অঙ্গের আধখানা মাটিতে আর আধখানা মাটির জামাটার ওপর নেমে এলো টের পেল। তারপর পৃথিবী আবার থেমে গেল। জঙ্গলের কানাকানি স্তব্ধতার গভীরে ডুবে গেল। আজ বাপী নয়, মিষ্টি তরফদার প্রায় অচেনা এক জগৎ ঘুরে এখান থেকে এখানেই ফিরে এলে।

জঙ্গল ভেঙে মিষ্টি আগে আগে চলেছে। ছেলেবেলায় জঙ্গলের সোজা পথে ও-বাড়ি গেছে। এতকাল বাদে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। ভুল হয় হবে, তবু পিছন ফিরে তাকাবে না।

বাপী তার হাত দশেক পিছনে। রাগের মর্যাদা দিচ্ছে আর হাসছে অল্প অল্প। খানিক বাদে ভুল রাস্তায় পা বাড়াতে দেখে পিছন থেকে বলল, ওদিকে গেলে এক-আধটা-বাঘ-ভালুকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।

মিষ্টির পা থেমে গেল। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। গনগনে মুখ। কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তপ্ত জবাবটা আপনা থেকে এসে গেল।—বাঘ-ভালুক ও তোমার থেকে ঢের বেশি নিরাপদ বুঝলে?

অপরাধী মুখ করে বাপী তক্ষুনি মাথা নেড়ে স্বীকার করল। তারপর কোন দিকে যেতে হবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

মিষ্টি আবার আগে আগে চলল। এত দুঃসাহস কারো হতে পারে, তার শরীরটাকে নিয়ে কেউ এমন কাণ্ড করতে পারে ভাবা যায় না। প্রচণ্ড রাগই হচ্ছে মিষ্টির। কিন্তু রাগটা পিছনের লোকের ওপর যত না, তার থেকে ঢের বেশি নিজের ওপর। কারণ ওই লোকের ওপর যত রাগ হবার কথা, চেষ্টা সত্ত্বেও ঠিক ততো রাগ হচ্ছে না।

পাছে এও টের পেয়ে যায় সেই রাগে আগে আগে চলেছে। সেই ভয়েও। জঙ্গল ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠলো। মিনিট তিনেকের পথ। বাংলো দেখা যাচ্ছে। আগে আগে পা বাড়িয়েও মিষ্টি থমকে দাঁড়াল। গেটের সামনে বিচ্ছিরি দেখতে একটা লোক দাঁড়িয়ে। খালি গা। মিশকালো। একরাশ চুলদাড়ি। নিজের মনে বিড়বিড় করছিল। মিষ্টিকে দেখে ঘোলাটে চোখে তার দিকে চেয়ে রইল।

মিষ্টি ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকালো। বাপী হাত পনের দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে হাসি ছুঁয়ে আছে। এগিয়ে এসে বলল, কি হল, যাও?

—ওই লোকটা কে?

—ওর নাম হারমা। মাথার ঠিক নেই।

—আমাকে এভাবে দেখছে কেন?

—মনের মানুষের অভাবে ওর এই হাল। তুমি যে-মুখ করে ফিরছিলে সগোত্র ভেবে ওর বোধ হয় পছন্দ হয়েছে। চলো—

মিষ্টির হাত ধরে বাপী গেটের দিকে এগলো। এবারে মিষ্টি আর বাধা দিল না। লোকটার চাউনি দেখে অস্বস্তি লাগছে। দাঁড়িয়েই আছে। চেয়েই আছে।

—কি চাই?

বাপীর ঠাণ্ডা প্রশ্নে লোকটার সম্বিৎ ফিরল একটু। হাত তিন-চার দূরে সরে দাঁড়াল। পুরনো অভ্যেস একটা হাত তুলে কপালে ঠেকালো। কিন্তু চাউনি সদয় নয় এখনো। ঘুরে হনহন করে জঙ্গলে নেমে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *