সোনার হরিণ নেই – ৪০

চল্লিশ

‘আগে বাঢ়। মিল যায়গা।’

ভুটান জঙ্গলের উদোম ফকিরের গমগমে গলার স্বর আর কথাগুলো বাপীর প্রায়ই মনে পড়ে। সেদিনের মানসিকতায় শব্দ চারটে রোমাঞ্চকর কাণ্ড ঘটিয়েছিল। বুকের তলায় ঝংকার তুলেছিল। বিঘ্ন ঠেলে সামনে এগনোর সাদা মন্ত্র কেউ কানে জপে দিয়ে গেছল। কিন্তু এখন কি? জপের মতো কথাগুলো এখনো কানে বাজে কেন? স্নায়ুতে স্নায়ুতে সাড়া জাগে কেন?

বাপীর তন্ময় হতে সময় লাগে না। প্রকাণ্ড দেবদারু গাছের নিচে ভস্মমাখা সেই উলঙ্গ ফকির বসে। ওর দিকেই চেয়ে আছে। তার দু’চোখে হাসি ঠিকরোচ্ছে কি আলো, বাপী জানে না।

‘আগে বাঢ়। মিল যায়গা। ‘

ত্রিশূল হাতে উঠে দাঁড়াল। পলকে গভীর জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেল।

কিন্তু কোথায় গেল? সামনে এগলো? কিছু পাওয়ার আশা না থাকলে ফকিরই বা এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? দুর্নিরীক্ষ মহাশূন্যে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে এমন কোনো মহাশক্তিধরের কাছে পৌঁছনোর আশা? খুব ছেলেবেলায় বাপী ভাবত আকাশের ওপারে ঈশ্বরের রাজ্য। ও রকম কোনো অলৌকিক অস্তিত্বে বিশ্বাস এখন নিজের কাছেই হাস্যকর।

‘চলা পৃথ্বী—স্থিরভূমি’। দেড় হাজার বছর আগে ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্যভট্টের ঘোষণা বাপী বইয়ে পড়েছে। সে বলে গেছে, সূর্য নয়, স্থিরভূমি এই পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে পাক খাচ্ছে। এই জ্ঞান কোনো ঈশ্বর মহাশূন্য থেকে তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল? গত দেড় বছর যাবৎ মানুষের তৈরি উপগ্রহ মহাকাশের রহস্যের আবরণ সরিয়ে চলেছে। স্পুৎনিক আর একসপ্লোরারের জয়-জয়কার। মানুষ খুব শিগগীরই ওই মহাকাশের গ্রহ-উপগ্রহ জয় করবে এমন বিশ্বাস বাপীরও আছে। কিন্তু সব-কিছুর আড়ালে বসে বিচ্ছিন্ন কোনো অলৌকিক পুরুষ এই শক্তির যোগানদারি করছে, বাপী ভাবে না।

অথচ শক্তিটুকু অস্বীকার করার উপায় নেই। একটা শক্তির উৎস কোথাও আছেই। সেটা কোথায়, কত বড়, তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বই বা কেমন? উলঙ্গ ফকির সম্পর্কেও বাপীর সেই গোছেরই বিস্ময়। হাড়গুড়নো রক্তজমানো সেই প্রচণ্ড শীতে লোকটার গায়ে একটা সুতো নেই। শীততাপের অমোঘ প্রাকৃতিক বিধান থেকে নিজেকে সে এমন অনায়াসে তফাতে সরিয়ে রাখতে পারে কোন শক্তির জোরে? লজ্জা-ভয়ই বা তার কাছে ঘেঁষে না কেন?

নিজের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে এক এক সময় দম বন্ধ হয়ে আসে বাপীর। ধড়ফড় করে ওঠে। নিজেকে টেনে তোলে। ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাস্তব ভূমির ওপর পা ফেলে চলতে চেষ্টা করে। কাজকর্মে মন দেয় কিন্তু সেই মন আর সেই উৎসাহে ভাটা পড়ছে তাও অনুভব করে।

তা হলেও ব্যবসা সেখানে দাঁড়িয়ে, টাকা আপনি আসছে। আসছেই। অনেকটা খেয়ালের বশেই বাপী, নিঃশব্দে মাঝে মাঝে এই বোঝা কিছু কিছু হালকা করে ফেলে। দেশের প্রায় সর্বত্র খরা বন্যা দুর্ভিক্ষ লেগেই আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বছর বছর পোকামাকড়ের মতো মরে যায়। তাছাড়া অন্ধ আতুর বা আর্তের সেবা প্রতিষ্ঠানই বা এ-দেশের মতো এত আর কোথায় আছে। গোটা দেশটাই যেন দাও-দাও রব তুলে হাত পেতে বসে আছে।

বাপীর নিঃশব্দে দিয়ে যাওয়ার অঙ্কটা ক্রমশ বড় হচ্ছে সেটা একমাত্র মিষ্টি লক্ষ্য করেছে। বাপী ওকেও বলে না। কিন্তু সমস্তই চেকবই পাশবই আর কাঁচা টাকা বোঝাই সিন্দুকের চাবি তার হেপাজতে। লক্ষ্য বা চোখ রাখলে তার না জানার কারণ নেই। এমন সংগোপন দানের বহর দেখেও মিষ্টি অস্বস্তি বোধ করে। ঐশ্বর্যের সবটা সাদা রাস্তায় আসছে না বলেই এভাবে বিবেক পরিষ্কার রাখার চেষ্টা কিনা বোঝে না।

ঠাট্টার সুরেই একদিন বলে ফেলল, দান করলেও লোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু প্রচার চায়—তুমি যেন খুব চুপি চুপি মস্ত মস্ত এক-একটা দানের পর্ব সেরে ফেলছ?

তার মুখের দিকে চেয়ে বাপী বেশ একটু কৌতুকের খোরাক পেল। ঠোঁটে হাসি। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তুমি দক্ষিণেশ্বর গেছ কখনো?

প্রশ্ন শুনে মিষ্টি অবাক।——মায়ের সঙ্গে দুই-একবার গেছি। কেন? —আমি একবারও যাইনি। তোমার কথা শুনে সেখানকার জ্যান্ত ঠাকুরটির একটা কথা মনে পড়ল। বলেছিল, সেবা করতে পারিস, দান করার কে রে শালা তুই?

মিষ্টির ভালো লাগল। হেসে বলল, তুমি তাহলে সেবা করছ?

—আমি কিছুই করছি না। নিজেকে যাচাই করছি।

না বুঝে মিষ্টি চেয়ে রইল।

বাপী বলল, দিতে ইচ্ছে করে না। তখন আরো বেশি করে দিয়ে ফেলে দেখি কেমন লাগে। মানে, দেখি কতটা টাকার গোলাম হয়ে বসে আছি। ছাড়তে না পারার গোলামি বরদাস্ত করতে না চাইলেও ওটা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।

মিষ্টির দু-চোখ বড় বড়।—শেষে কি আমার ওপর দিয়েও এরকম এপেরিমেন্ট চলবে নাকি!

বাপী হাসছে।—ঘুরে ফিরে একই ব্যাপার কিন্তু।…সেই আঁকড়ে ধরে থাকার গোলামি।

মিষ্টি আর কিছু বলল না। এই জবাব আশাও করেনি, ভালও লাগেনি।

দিন গড়াতে গড়াতে ঊনষাট সালের আগস্ট পেরিয়ে সেপ্টেম্বরে পা ফেলল। মাসের প্রথম দিনে বাপীর জীবনের এই গতিও আচমকা বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াল।

গত জুন মাস থেকে পশ্চিম বাংলার খাদ্য পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। চালের দর হু হু করে বাড়ছে। বাজারের চাল উধাও হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম—গ্রামান্তর থেকে প্রতি দিন তিন-চার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ কলকাতায় আসছে খাবার খুঁজতে। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় খাদ্যনীতির ব্যর্থতার দায় খাদ্যমন্ত্রীর ওপর না চাপিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপের দিকেই গড়াতে থাকল।

এই ব্যর্থতা সামনে রেখে প্রবল আক্রমণে নেমে গেছে বিরোধী দল। সরকারকে উল্টে দেবার হুমকি দিয়ে আসরে নেমেছে তারা। তাদের অসন্তোষ মুখ্যমন্ত্রীর ওপর যত না, তার থেকে ঢের বেশি খাদ্যমন্ত্রীর ওপর। পরের দু-তিন মাসে চালের দর মণ পিছু আরো পাঁচ টাকার ওপর বেড়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধি আর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি কোমর বেঁধে গণ-আন্দোলনে নেমেছে। তারা চালের মজুতদারির বিরুদ্ধে যুঝবে, আইন অমান্য করবে, অবস্থান ধর্মঘট করবে, পিকেটিং করবে। অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠতে লাগল, কারণ খিদের জ্বালায় সাধারণ মানুষও ক্ষিপ্ত। জঠরে আগুন জ্বললে লোকে কান শুনতে ধান শোনে। রাজনীতি বুঝুক না বুঝুক, দুর্দিন ঘোচানোর যুদ্ধে তারাও ছুটে আসবে, হাত মেলাবে।

ধর-পাকড় শুরু হয়ে গেল। শাসনযন্ত্র গণবিক্ষোভের ষাট-পঁয়ষট্টি জন নেতাকে ছেঁকে তুলে আগে-ভাগে গ্রেপ্তার করল। কেউ কেউ আবার ধরা—ছোঁয়ার বাইরে গা ঢাকা দিল। কিন্তু বিদ্রোহের আগুন তখন অনেক ছড়িয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রাণ নেবার হুমকি পর্যন্ত শোনা গেল। আগস্ট-এর শেষ দিনে গতকাল সেই রক্তাক্ত গণ-বিক্ষোভের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। দুই তরফই প্রস্তুত ছিল শহরের মানুষ গ্রামের মানুষ স্ত্রীলোক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সহ পঁচিশ হাজারের এক মিছিল ময়দানের সভার পর এগিয়ে এলো রাজভবনের দিকে।

পথ আগলে সশস্ত্র পুলিশও প্রস্তুত। রাত সাড়ে সাতটায় সেখানে পুলিশ আর জনতার খণ্ডযুদ্ধ। লাঠি-চার্জ টিয়ার গ্যাস। সেখান থেকে অশান্তির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শহরে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। স্টেট বাস আর দুধের বুথ পোড়ানোর হিড়িক পড়ে গেল।

এক দিনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা তিনশ’র ওপর। আহতদের ভিড়ে হাসপাতাল বোঝাই।

বাইরে বাপী এই মানুষগুলোর থেকে অনেক দূরে অনেক বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বিপুল ঐশ্বর্য সত্ত্বেও ভিতরের মনটা আজও এদেরই দিকে। ব্যক্তিবিশেষে বিধান রায় বাপীর চোখে শুধু পুরুষ নয়, পুরুষসিংহ। চিকিৎসায় ধন্বন্তরী নাম। শক্ত দুই হাতে এই বাংলার শিল্প বাণিজ্য শিক্ষা সংস্কৃতি পথ পরিবহন স্বাস্থ্য—সব কিছুর শ্রী ফেরানোর হাল ধরে বসে আছেন। বাপীর মানসিক বিরোধ তাঁর সঙ্গে নয়। স্বাধীনতার বারো বছরের মধ্যেও যে-শাসনযন্ত্র ক্ষুধার মুখে অন্ন যোগাতে পারল না, বিরোধ তার সঙ্গে। আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত রাজনীতির খেলাই। অজ্ঞ ক্ষুধার্ত জনেরাই বেশির ভাগ এই রাজনীতির প্রথম সারির বলি।

পরদিন অর্থাৎ আজ। পয়লা সেপ্টেম্বর। সকাল থেকে অশান্তির খবর কানে আসছে। আন্দোলনের অনেকখানি দখল চলে গেছে সমাজবিরোধীদের হাতে। বিকেলের মধ্যে পাঁচটা থানা আক্রমণ করে লুটপাট করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির এলাকায় তুমুল হামলা। বড় বড় রাস্তাগুলো ব্যারিকেড করে দেবার ফলে পুলিশ পেট্রল ব্যাহত। টিয়ার গ্যাস বা লাঠিচার্জে কুলোলো না আর। গুলি চলল। সরকারী হিসেবে পঁয়ষট্টি জন গুলিতে আহত আর চার জন নিহত। এ হিসেব কতটা সত্যি সকলেই জানে।

মিষ্টির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খবর পেয়েছিল। গতকাল বিকেলে দুজনে তাঁকে দেখতে যাবে ঠিক করেছিল। গণ্ডগোলের দরুন আর বাড়ি থেকে বেরোয় নি। আজও বিকেল পর্যন্ত বাড়ি বসে থেকে বাপীর একটুও ভালো লাগছিল না। গণ্ডগোল বেশি ঘোঁট পাকিয়েছে উত্তর কলকাতার দিকে। দক্ষিণ দিকের তেমন বড় কিছু ঘটনা বা দুর্ঘটনার খবর কানে আসেনি। বাপী মিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। বা গণ্ডগোল দেখলে এগোবেই না।

চলেছে। বাপীর গাড়িও ইদানীং ড্রাইভার চালায়। নিজে ড্রাইভ করা ছেড়েছে। রাস্তায় ট্রাম বাস ট্যাক্সি এমন কি আর প্রাইভেট গাড়িও চোখে পড়ছে না। এলগিন রোডের কাছাকাছি আসতে বোঝা গেল ব্যাপার এদিকেও সুবিধের নয়। রাস্তা জুড়ে ভাঙা কাচ ডাবের খোলা ইট পাথর জুতো আর ভাঙা কাঠের তক্তার ছড়াছড়ি। ছোট বড় গলির মুখে এক-একটা জটলা। বন্দুক উঁচনো পুলিশের পেট্রল গাড়ি দেখলেই তারা ছুটছাট হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি আর একটু ভালো করে বোঝার জন্যে বাপী গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করাতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে পাঁচ-সাত জন মারমুখী ছেলে ছুটে এসে গাড়িটা ঘিরে ফেলল।—এই দিনে আপনারা গাড়ি চেপে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন?

কেন বেরিয়েছে বাপী তাদের বোঝাতে চেষ্টা করল, কিন্তু সেই ফাঁকে একজন পিছনের একটা টায়ারের ভাল্ব খুলে দিয়েছে। সশব্দে বাতাস বেরিয়ে টায়ারটা চুপসে গেল। এই দিনে বাইরে বেরুনোর কারণ শুনে হোক বা মিষ্টিকে দেখে হোক, তাদের মাতব্বর টায়ারটা যে ফাঁসিয়েছে তাকে ধমকে উঠল। তারপর বাপীকে বলল, বাড়তি টায়ার থাকে তো এক্ষুনি লাগিয়ে ফিরে যান—সামনে এগোতে পারবেন না—আরো বিপদে পড়বেন।

দূরে পুলিশের পেট্রল গাড়ি চোখে পড়া মাত্র দলটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

মিষ্টিও গাড়ি থেকে নেমে এলো। পেট্রলগাড়িটা ঝড়ের বেগে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভার পিছনের ক্যারিয়ার থেকে সাজসরঞ্জাম বার করে স্টেপনি লাগানোর কাজে লেগে গেল। মিষ্টি আর বাপী নির্বাক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।

—তুই আমার হাড়মাস সব খাক করে দিলি। তোকে আমি এবার থেকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রেখে দেব—তুই কত বড় হারামজাদা আমি এবার দেখে নেব!

তারস্বরের ক্ষিপ্ত কথাগুলো কানে আসতে বাপী ফিরে তাকালো। আর সেই মুহূর্তে মাথার ঠিক মধ্যিখানে কেউ বুঝি প্রচণ্ড মুগুরের ঘা বসিয়ে দিল একটা।

কথাগুলো কানে আসতে মিষ্টিও ফিরে তাকিয়েছিল।

…আধ হাত পাকা দাড়ি বোঝাই একটা লোক বছর এগারোর হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরা ঢ্যাঙা এক ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে রাগে ফোঁস করে এই কথা বলছে। লোকটার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে মেটে সিঁদুরের চওড়া তিলক।

মিষ্টিকে নয়, বাপীকে দেখেই লোকটা থমকে দাঁড়ালো একটু। আবার এগোতে গিয়েও পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকেই গেল বুঝি। দুই চোখ বিস্ফারিত। সামনে যাকে দেখছে, ঠিক দেখছে কিনা ভেবে পাচ্ছে না।

—বিপুলবাবু আপনি! আপনি আমাদের সেই বিপুলবাবু না?

বাপী নিস্পন্দ নির্বাক।

—আপনি আমাকে চিনতেও পারছেন না বিপুলবাবু! আমি রতন। রতন বণিক! আমাকে…আমার বউ কমলাকে মনেও পড়ছে না আপনার?

মাথার মধ্যে ঝড়। যেভাবে হোক এই ঝড় না থামালে কোথায় ভেসে যাবে বাপী জানে না। প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে টেনে তুলল। ওর শক্ত হাতে ধরা ছেলেটার দিকে না তাকাতে চেষ্টা করছে।

—চিনেছি। চিনে তোমার মতোই অবাক হয়ে গেছলাম।

রতন বণিক খুশিতে আটখানা।—আপনি না চিনে পারেন! এমন সুন্দর চেহারা হয়েছে এখন আপনার! এ আপনার গাড়ি? ইনি আপনার পরিবার? ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে বিগলিত মুখে মিষ্টির সামনে মাথা নোয়ালো।—পেন্নাম হই গো মালক্ষ্মী—এই বিপুলবাবু আমাদের কতখানি ছিলেন আপনি জানেন না। উনি আমার বস্তির খুপরি ঘরে থাকতে আমি বলে দিয়েছিলাম, এই দিন থাকবে না—উনি রাজা হবেন! হ্যাঁ বিপুলবাবু, আপনি কলকাতায়–আর আমি জানিও না!

মাথার ভিতরে যা হচ্ছে—হচ্ছে। পিঠেও চাবুক পড়ল একটা। মিষ্টি ভাবছে, একটু আগের বিভ্রাটের দরুণ মানুষটা এই লোকের আনন্দ বা কথায় তেমন সাড়া দিতে পারছে না।

রতন বণিক হঠাৎ ছেলেটার কাঁধ ধরে বাপীর দিকে ঠেলে দিল।—এই ছোঁড়া, পেন্নাম কর শিগগীর। কাকে দেখছিস জানিসও না। আজ ঘরে ফিরে তোর হাড় গুঁড়ো করে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তোর জন্যেই বিপুলবাবুর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে গেল—তাই বেঁচে গেলি।

ছেলেটা দুজনকেই প্রণাম সেরে উঠতে রতনের একমুখ হাসি। আমার ছেলে বিপুলবাবু, ওর নাম মদন। তক্ষুনি আবার রাগের মুখ।—এত বড় পাজী ছেলে আর হয় না—বুঝলেন। খেয়েদেয়ে বেলা বারোটায় আমার চোখে ধুলো দিয়ে মারামারি গোলাগুলির মধ্যে বেরিয়েছে—আমি পাঁচ ঘণ্টা ধরে পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে এইখানে এসে ওকে ধরেছি—এইটুকু বিচ্ছু আমাকে একেবারে শেষ করে ছাড়ল।

বাপীর চোখ দুটো এবারে কেউ যেন টেনে ছেলেটার মুখের ওপর বসিয়ে দিল।

দেখছে মিষ্টিও। লম্বা গড়ন। রোগা। কালোও নয় ফর্সাও নয়। বাপ যত দুষ্টু বলছে মুখ দেখলে ততো দুষ্টু মনে হয় না। চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় দুষ্টুমিতে ছাওয়া। কিন্তু সব মিলিয়ে ছেলেটা দেখতে বেশ। এত বুড়োর এই ছেলে কেউ ভাববে না, নাতি-টাতি ভাববে।

সহজ ভাবেই মিষ্টি বলল, মায়ের কথা শোনে না বুঝি….

বলে অপ্রস্তুত। রতন বণিক ফোঁস করে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা। বিড়বিড় করে বলল, মা তো নয়, শত্তুর।…ছেলে ছেলে করে পাগল হয়েছিল। আমি বলেছিলাম ছেলে হবে—হল। আর দুটো বছর না যেতে সেই ছেলে রেখে আমাকে একেবারে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল!

বাপী কাঠ। রতনের ছল-ছল দু’চোখ তার মুখের ওপর।—আপনি তো এ খবরও জানেন না বিপুলবাবু। এমন বউকে শত্রুর ছাড়া আর কি বলব? ভরা শীতেও দুবার করে চান করা চাই—কার নিষেধ কে শোনে। বুকে সর্দি বসিয়ে সাতদিনের জ্বরে সব শেষ। যাবার দিন সকালে আপনাকে মনে পড়েছিল… কিছু বলেও গেছল…

গাড়ি রেডি। বাপীর হঠাৎ ফেরার তাড়া। রতনকে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলে মিষ্টিকে তাড়া দিয়ে গাড়িতে উঠল। রতনকে বলল, গণ্ডগোলের মধ্যে আর বাইরে থেকো না—ঘরে চলে যাও।

বিকেলের আলো আর নেই-ই প্রায়। গাড়ির ভিতরটা আবছা। বাপী পিছনে মাথা রেখে নিশ্চল বসে আছে। দু চোখ বোজা।

মিষ্টির মনে পড়ছে কিছু। ফিরে তাকালো।—কলকাতায় সেই প্ৰথম দেখা হতে তুমি বলেছিলে, অফিসের চাকরি যাবার পর সেখানকার কোন্ পিওন আর তার বউ আদর করে তাদের বস্তিঘরে তোমাকে রেখেছিল…এ সেই পিওন নাকি?

জবাব না দিয়ে বাপী শুধু মাথা নাড়ল। সে-ই!

—ওদের কাছে কত দিন ছিলে?

—দুমাস।

এবারে মিষ্টিও অবাক একটু। — সামান্য লোক হলেও তোমার জন্য এত করেছে, আর এত বছরের মধ্যে তুমি তাদের একটা খবরও নাওনি?

বাপী জবাব দিল না। মাথা পিছনে তেমনি ঠেস দেওয়া। দুচোখ বোজা। মিষ্টি এবারে ভালো করে লক্ষ্য করল। উতলা একটু। শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

এবারেও বাপী সামান্য মাথা নাড়াল কি নাড়াল না।

মিষ্টি ভাবল ছেলেগুলো হঠাৎ ওভাবে হামলা করার দরুন স্নায়ুর ওপর দিয়ে ধকল গেছে। এর থেকে বেশি বিপত্তিও হতে পারত।

রাত্রি। দেড় হাত ফারাকে মিষ্টি ঘুমোচ্ছে। বাপী নিঃশব্দে উঠে বসল। শরীরের রোমে রোমে আগুনের কণা। নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে লাগছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বাপী জানে এই দুঃসহ যন্ত্রণার শেষ এই মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে। যদি সে মিষ্টিকে ডেকে তুলতে পারে, তুলে যদি ওকে বলতে পারে, কথা ছিল তোমার আমার মধ্যে গোপন কিছু থাকবে না—তাই এবারে শেষ কিছু শোনো— শুনে আমাকে দেখো, চেনো।

বাপীর গলায় কুলুপ আঁটা। ডাকা যাবে না। বলা যাবে না। শরীর জ্বলছে। যন্ত্রণা বাড়ছে। শব্দ না করে খাট থেকে নামল। পা দুটো পাথরের মত ভারী। ঝিনঝিন করছে। অন্ধকার ঘর-সংলগ্ন বাথরুমে এলো। কানে মাথায় জলের ঝাপটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কি-যে হতে লাগল বুঝছে না। পায়ের নিচে ভূমিকম্প। সব কিছু বিষম দুলছে, উল্টে যাচ্ছে। প্রাণপণে বেসিনটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল একটু। দেয়াল হাতড়ে ঘরে এলো। বিছানাটা কদ্দুর। বাপী কি আর নাগাল পাবে?

পেল। তারপর আর মনে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *