সোনার হরিণ নেই – ১৯

উনিশ

বনমায়ার সেই দাঁতাল সঙ্গীকে মারার জন্য সরকারী ট্যাড়া পড়েছে।

প্রথম দিকে কিছুদিন ওই বুনো হাতিটা চা-বাগানের কাছাকাছি জঙ্গল থেকে তারস্বরে ডাকাডাকি করেছে। সন্ধ্যায় বা রাতে ওদিকে ঘেঁষার মতো বুকের পাটা কারো নেই। তারপর লছমন এক চাঁদনি রাতে স্বচক্ষে পাহাড়ের মতো ওই দাঁতাল হাতিটাকে সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। একবারও ডাকেনি বা এতটুকু শব্দ করেনি। বাপীকে বলেছে, ভয়ে ওর হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে গেছল। ওটা নেমে এলে ছনের ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে ওকে পিষে মারতে কতক্ষণ।

কিছুই করেনি। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি চলে গেছে। তার সঙ্গিনী আর এ-জগতে নেই তা ও ভালো করেই বুঝে গেছে। কিন্তু কিছুদিন না যেতে ওটার উপদ্রব শুরু হল। এক-এক রাতে গাছপালা মুড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গলের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাক-ঢোল টিন কানেস্তারা নিয়ে দল বেঁধে রাতে পাহারা দিতে হয়। পাঁচ-ছ’মাসের মধ্যে নানা জায়গায় সাত-সাতটা জঙ্গলের কুলি মজুরকে মেরে দলা পাকিয়ে রেখে গেছে। ওটা গুণ্ডা হয়ে গেছে। মারার পরোয়ানা বার করা ছাড়া আর উপায় নেই। বনবিভাগের তরফ থেকে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। বিষমাখানো ফলার কারবারী নেপালী তীরন্দাজরা ওটার খোঁজে দল বেঁধে জঙ্গল ছুঁড়েছে। কিন্তু এই গুণ্ডা হাতিও এখন তেমনি চতুর। উল্টে ওই তীরন্দাজদের দুজন আচমকা ওর হাতে পড়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে।

শেষে বাইরের দুজন রাইফেলধারী পাকা শিকারী আসরে নামতে ওটা কিছুটা নাকাল হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছে মনে হয়। মনে হয় কারণ, রাইফেলের গুলি ওটার কান বা ঘাড়ের কোথাও লেগে থাকবে বলে শিকারীদের বিশ্বাস। নইলে মুখ থুবড়ে পড়ে ওখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু জঙ্গল কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে ওটা পালিয়েছে। পরের ছ’মাসের মধ্যে জঙ্গলের এই এলাকায় আর তাকে দেখা যায়নি। অমন পাহাড়ের মতো দেহ নিয়ে কোথাও মরে পড়ে থাকলেও টের পাওয়া যেত। জঙ্গলের লোকেরাই নিঃশব্দে খোঁজাখুঁজি করেছে। ওটার দাঁতের প্রতি অনেকেরই লোভ। কোথাও মরে পড়ে থাকলে আর সকলের অগোচরে দাঁত দুটোর মালিক হয়ে বসতে পারলে এক ধাক্কায় বড়লোক। বাপী শুনেছে, ওই বুনো গুণ্ডার বিশাল দাঁত দুটো ধনুকের মতো বেঁকে শূন্যে ঠেলে ওপরের দিকে উঠেছে।

পাগল হয়ে গেছে যখন একদিন ওটা কারো হাতে মরবে জানা কথা। গুলির ক্ষত বিষিয়ে আপনিও মরতে পারে। বন্দুক ছুঁড়তে জানলে আর ওটা সামনে পড়লে বাপী নিজেও মারার চেষ্টাই করত। কিন্তু ভিতর থেকে হিংস্র হয়ে উঠতে পারত কি? উল্টে ছেলেমানুষের মতোই কাল্পনিক শত্রুনিকাশের আক্রোশ তার। বনমায়ার হাল যদি কোনো এক মেয়ের হত, ও নিজে কি করত? এমন কি কিছু না হলেও শুধু যদি সভ্য দুনিয়ার বিধি-নিষেধের অস্তিত্ব না থাকত? তাহলেও কি কলকাতার এক সোনালি-চশমা-রাঙা-মুখ এত দিনে যমের দরজা দেখত না?

আরো একটা বছর ঘুরে গেল। বাপী তরফদার সুখে নেই এ তার কোনো শত্রুও বলবে না। মর্যাদা বেড়েছে, প্রতিপত্তি বেড়েছে। মাইনে বা বাড়ি ভাড়ার টাকা এক পয়সাও খরচ হয় না। সব সোজা ব্যাঙ্কে চলে যায়। অলিখিত কমিশন হিসেবে গড়ে তার দ্বিগুণের বেশি কাঁচা টাকা হাতে আসে। তাই সামাল দিতে ভাবতে হয়। খাওয়া খরচ নেই, জলখাবারের খরচ পর্যন্ত না। শুধু লাঞ্চ ডিনার নয়, সকালে-বিকেলের জলখাবারের সময়ও এখন পাশের বাংলোয় ডাক পড়ে। আপিস তো ওখানেই, তাই সাতসকালে নাকে-মুখে গুঁজে ছোটার দরকার হয় না। দু-বেলাই গায়ত্রী রাই আর তার মেয়ের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতে হয়। তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও মহিলার নজর আছে বোঝা যায়। মাঝে মাঝে অনুযোগ করে, যে-মুখ করে খাও, কি পছন্দ আর কি অপছন্দ কিছুই বোঝা যায় না।

বাইরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। বিরক্ত হলে আগের মতোই কথা শোনায় বা ধমকে ওঠে মহিলা। তবু বাপী স্নেহের স্বাদ পায়। ওর প্রতি মনোযোগ বাড়ছে, নির্ভরতা বাড়ছে। পরোক্ষ প্রশ্রয়ও। বাপীর সঙ্গে ঊর্মিলার কথায় কথায় ঝগড়া। ঝগড়া অবশ্য এক-তরফা ঊর্মিলাই করে থাকে। দোষ বলতে গেলে বাপীরই। ফাঁক পেলেই সাদা মুখ করে এমন কিছু মন্তব্য করবে বা ফোড়ন কাটবে যে ও—মেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেই। যা মুখে আসে তাই বলে তখন। গায়ত্রী রাই দেখে। শোনে। বিরক্ত হয়ে কখনো বা মেয়েকেই শাসন করে।—সর্বদা তুই ওর সঙ্গে এমন লাগবি কেন—আর যা-তা বলবি কেন?

বেশি রাগিয়ে দিতে পারলে মেয়ে মায়ের ওপর চড়াও হয়।—আমি ওর সঙ্গে লাগি—আমি যা-তা বলি? ও কত বড় বজ্জাত জানো?

বাপীর এমন মুখ যে মালিক না বাঁচালে এই মেয়ের অত্যাচারে তার বাঁচা দায়।

গায়ত্রী রাই কখনো ইচ্ছে করেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। কখনো বা ঠোঁটের ফাঁকে চুলচেরা হাসির রেখা মিলিয়ে যায়। ঊর্মিলা জানে না, কিন্তু বাপী তাইতেই আরো বিপন্ন বোধ করে। মহিলা বলতে গেলে গোড়া থেকেই সদয় তার ওপর। অনেক ভাবে ওকে যাচাই করেছে, কিন্তু উত্তীর্ণ হোক সেটা নিজেও মনেপ্রাণে চেয়েছে। এই চাওয়াটা ভিন্ন স্বার্থের কারণে। তখন শুধু চালিহা লক্ষ্য। তেমন নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত কাউকে পেলে তাকে দূরে সরানোর সংকল্প। সেই লক্ষ্য আর সংকল্পের দিকে বাপীই তাকে এগিয়ে দিয়েছে। তার পুরস্কারও পাচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আরো কিছু পাচ্ছে যার ফলে আনন্দের থেকে ভয় বেশি। ভিতরে সেই অনাগত আশঙ্কার ছায়াটা ইদানীং আরো বেশি দুলছে। মহিলার স্নেহ শুধু কাম্য নয়, দুর্লভ ভাবে বাপী। এর সঙ্গে ওর ভিতরের একটা উপোসী আবেগের যোগ। কিন্তু এত স্নেহ আর প্রশ্রয়ের আড়ালে মহিলার প্রত্যাশাটুকু বাপীর কাছে দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভয় আর দুশ্চিন্তা সেই কারণে।

…মেয়ে ওর সঙ্গে যেখানে বা যত দূরে খুশি বেড়াতে গেলে গায়ত্রী রাইয়ের আপত্তি নেই। দুপুরে ব্যবসার কাজকর্ম একটু-আধটু বোঝার জন্য মেয়েকে বাংলোর আপিস ঘরে গিয়ে বসতে বলে। কিন্তু বাপীর বিশ্বাস মেয়ে এলে স্রেফ আড্ডা দেয় আর কাজ-কর্ম পণ্ড হয় জেনেও এই তাগিদ দেয়। বিশেষ কাজে কিছুদিন আগে একবেলার জন্য পাহাড়ে আসার দরকার হয়েছিল। গায়ত্রী রাই মেয়েকে হুকুম করেছে, তুইও যা, ঘরে বসে থেকে কি হবে, যেটুকু পারিস শিখেটিকে নে।

ঊর্মিলা তক্ষুনি রাজি। শিখতে দায় পড়েছে তার। বাপীর সঙ্গে বেড়ানোটুকুই লাভ। বাপীই বরং প্রস্তাব নাকচ করেছে। বলেছে, শেখার সময় ঢের পাওয়া যাবে, আপনাকে একলা রেখে দুজনের বেরুনো চলবে না।

মা সরে যেতে ঊর্মিলা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, না গেলাম তো বয়েই গেল, কিন্তু শেখার সময় ঢের পাওয়া যাবে বলার মানে কি? কাজ শেখার জন্য এখানে তোমার কাছে বসে থাকব?

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর গায়ত্রী রাই তার সময়মতো শুতে চলে যায়। মেয়ের আবার সেটাই ভালো আড্ডার সময়। প্রায়ই বাপীকে ধরে রাখে। যে-দিন বিলেতের চিঠি আসে সেদিন তো ওকে সমস্ত সমাচার জানানোর জন্য এই নিরিবিলির প্রতীক্ষায় ছট্‌ফট করে। কিন্তু এরকম আড্ডা দেওয়াটাও গায়ত্রী রাইয়ের চোখে দৃষ্টিকটু ঠেকে না।

সম্প্রতি বাপীর একটা মোটর গাড়ি হয়েছে। গাড়ির তখন কি-বা দাম। চা—বাগানের সায়েবসুবোরা চলে যাবার সময় ভালো গাড়িও জলের দামে বেচে দিয়ে যায়। বাপী ডাটাবাবুকে বলে রাখতে সে-ই একটা ভালো গাড়ির সন্ধান দিয়েছিল। কিন্তু গায়ত্রী রাই বাপীকে এখানকার ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাদা টাকা দিয়ে কিনতে দেয়নি। আর হিসেবের বাইরের উত্তর বাংলার দূর-দূরের ব্যাঙ্কে যে টাকা জমা আছে—তার থেকে তুলে গাড়ি কিনলে ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও আরো সতের রকমের জবাবদিহির ফ্যাসাদে পড়তে হবে। গায়ত্রী রাইয়ের হুকুমে সেই গাড়ি ফার্মের নামে কেনা হয়েছে। ফলে খরচ সব কোম্পানীর ট্যাক্সের খাতায় উঠছে গাড়ি বাপীর খাস দখলে।

মায়ের বদান্যতায় ঊর্মিলা অখুশি নয়। তবু বাপীকে ঠেস দিতে ছাড়েনি।— মা যে দেখি তোমার বেলায় মিসেস দাতাকর্ণ হয়ে বসল একেবারে, যা চাও তাই মঞ্জুর। চাইলে শেষে আমাকে সুদ্ধু না দিয়ে দেয়—

বলতে বলতে খিলখিল হাসি।

বাপী সন্তর্পণে প্রসঙ্গ এড়িয়েছে। বিজয় মেহেরা বিলেত থেকে ফেরার আগে মহিলা না চাইতেই দেবার জন্য ঝুঁকবে কিনা সেই আশঙ্কা বুকে চেপে বসেছে বাপীর। ঊর্মিলা মেয়েটা বোকা নয়। নিজেকে নিয়ে, বিভোর, তাই কোনরকম সন্দেহের আঁচড় পড়ছে না। উল্টে বাপী দলে আছে বলেই নিজের ব্যাপারে বাড়তি জোর পাচ্ছে। ও ধরে নিয়েছে, সততার সবগুলো সিঁড়ি টপকানো শুধু নয়, মায়ের সব থেকে ব্যথার জায়গাটি ছুঁয়ে যেতে পেরেছে বলেই এই ছেলের এখন এত খাতির কদর, তার প্রতি এত স্নেহ। তাছাড়া মায়ের অসুখটার জন্য বাপী যা করল তাও এই মেয়ে আর কোনদিন কাউকে করতে দেখেনি। একথা ঊর্মিলা নিজেই বাপীকে বলেছিল। ওর নিজের তো আগে ধারণা হয়েছিল মায়ের অসুখ—টসুখ সব বাজে। পরে এই জন্যেও মনে মনে লজ্জা পেয়েছে।

বাপীর এত সুখের তলায় কোন্ দুশ্চিন্তা থিতিয়ে আছে ঊর্মিলাকে তার আভাস দেওয়াও সম্ভব নয়। জানালে এই মেয়ে অবুঝের মতো ক্ষেপে যাবে। মা মেয়ের মধ্যে আবার একটা বড় রকমের অশান্তি ঘনাবে। শুধু মানসিক নয়, মহিলার তাতে স্বাস্থ্যেরও ক্ষতির সম্ভাবনা। তাছাড়া ঊর্মিলাকে বলবেই বা কি, ওর মা তো এখন পর্যন্ত সরাসরি প্রস্তাব কিছু দেয়নি। যেটুকু বোঝার বাপী আভাসে বুঝেছে, আচরণে বুঝেছে।

বাঁচোয়া শুধু এই মেয়ে শেষ পর্যন্ত যদি তার সংকল্প আঁকড়ে ধরে থাকে। যেরকম অবস্থা আর মতিগতি দেখছে, মনে হয় থাকবে। এক বছরেরও ওপরে দেরি, এখন থেকেই বিজয় মেহেরার ফেরার দিন গুনছে। প্রাণের দায়ে ইদানীং বাপী ঊর্মিলার কাছে ওই ছেলের গুণকীর্তন শুরু করেছে। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব আছে, পুরুষের গোঁ আছে, বড় হবার মতো ইচ্ছের জোর তো আছেই, গুণও আছে।

ঊর্মিলার কানে মধু। এক-এক সময় তাগিদ দেয়, মায়ের কাছে ওর সম্পর্কে তুমি একটু একটু বলতে শুরু করো না।

বাপীর তখন পিছু হটার পালা।—এখন বললে মাঝখান থেকে উত্তেজনা বাড়বে, শরীর খারাপ হবে। সময়ে তোমার জোরটাই আসল, এখন বলে কিছু লাভ হবে না।

সেদিন ঊর্মিলা এসে একটা জবর খবর দিল। বিকেলে চা-বাগান কোয়ার্টার্স—এর দিকে বেড়াতে গেছল। আংকল চালিহার সঙ্গে দেখা। ডাটাবাবুর ক্লাবে নিয়ে গিয়ে জোরজার করে অনেক কিছু খাওয়ালো। সেই ফাঁকে বিজয় মেহেরার দারুণ প্রশংসা। আংকল নিজের একটা মস্ত ভুল শুধরোবার সুযোগের অপেক্ষায় আছে বলল। মিরিকের চা-বাগানের ওপরওলার সঙ্গে দেখা করে বিজয় মেহেরার সম্পর্কে খোঁজখবরও নিয়েছে। কারণ ডলি নিজের মেয়ে বললেই হয়, তার তো একটা দায়িত্ব আছে। তা সেই ওপরওয়ালা মেহেরার খুব প্রশংসা করেছে। বলেছে, যেমন সৎ তেমনি পরিশ্রমী। আর ভালো স্কলার তো বটেই। ছেলেটা যে খুব উন্নতি করবে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। বিজয় লন্ডনে এখন কোথায় আছে, কি রকম আছে, কবে পর্যন্ত ফেরার সম্ভাবনা, চিঠিপত্র লেখে কিনা, সহৃদয় আপনার জনের মতো আংকল এসব খোঁজও নিয়েছে। চিঠির প্রসঙ্গে ঊর্মিলা চুপ করে ছিল। অন্য সব কথার জবাব ঠিক ঠিক দিয়েছে। তারও ধারণা, বিজয়কে মায়ের কাছে অমন ছোট করে ফেলে আংকল এখন পস্তাচ্ছে।

কিন্তু পস্তাবার কারণটা বাপীর থেকে ভালো বোধ হয় আর কেউ আঁচ করতে পারবে না। বাপীর সঙ্গেও রণজিৎ চালিহার ব্যবহার এখন আরোও আপনার জনের মতো। মাঝে মাঝে ওকে ডিনারেও ডাকে। গেলাসে চুমুক দিয়ে অন্তরঙ্গ খোশমেজাজে জিজ্ঞাসা করে, কতকাল আর ব্যাচিলার থাকবে হে, দেখেশুনে ঝুলে পড়ো কোথাও। নয় তো বলো আমিই ঘটকালিতে লেগে যাই। তারপর গলা খাটো করে জিগ্যেস করেছিল, কাউকে মনে-টনে ধরেনি তো?

নিরীহ মুখে শুধু হেসেই বাপী এসব কথার জবাব এড়াতে পারে। ঊর্মিলার সঙ্গে সহজ মেলামেশাটাই খুব সম্ভব ভদ্রলোকের বেশি দুশ্চিন্তার কারণ। আর গায়ত্রী রাই যেভাবে এখন ওকে আগলে রাখে, সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেখে, টাকা-পয়সা দেয়—তাই দেখেও এই অতি-চতুর লোকের সন্দেহের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। মেয়ের বিয়ের পাত্রর জন্য দু-দুটো বড় কাগজে অত ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়েও মহিলা একটা বছরের মধ্যে সে-সম্পর্কে একেবারে চুপ মেরে গেল দেখেও এই লোকের সন্দিগ্ধ হবার কথা।

অনুমান মিথ্যে নয় দিন কতকের মধ্যেই বোঝা গেল। রণজিৎ চালিহা মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলতে দেখুক। কিন্তু মুশকিল হল, সেই একই খাঁড়া যে বাপীর দিকে উঁচিয়ে আছে! মেয়েকে নিয়ে আজকাল বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে ভ্যানে চেপে হাওয়া খেতে বেরোয় গায়ত্রী রাই। ব্যবস্থা বাপীরই। তাকে না পেয়ে রণজিৎ চালিহা সেদিন বাপীর বাংলোয় হাজির।

ব্যবসার আলোচনার ফাঁকেই তার মনের সংকট আঁচ করা গেল। মধ্যপ্রদেশের অনেক জায়গায় ঘুরে এসেছে এর মধ্যে। ভালো ব্যবসাই হবে আশা করা যায়। কিন্তু চালিহা খোঁজখবর নিয়ে দেখেছে পশ্চিম বাংলার কলকাতার মতো এমন বাজার আর হয় না। শুধু শুকনো হার্বের চাহিদাই সেখানে বছরে পঁচিশ-তিরিশ লক্ষ টাকার মতো। আর নেশার জিনিসও ওখানেই সব থেকে বেশি চলতে পারে। চালিহার মতে এত বড় মার্কেট আর হাতছাড়া করে রাখার কোনো মানে হয় না। ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়নের জন্যেই বাপীকে প্রথমে নেওয়া হয়েছিল, এখন তার সেখানেই চলে যাওয়া উচিত। সেখানে একটা গোডাউন ঠিক করে এখান থেকে মাল চালানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তারপর দেখে-শুনে ঘাঁটি ঠিক করে অন্য পাঁচ রকমের মাল পাঠানো যেতে পারে।

প্রস্তাবের শুরুতেই বাপী তার মনের কথা বুঝে নিয়েছে। সাদাসিধে জবাব দিল। মিসেস রাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করুন, আমার আর অসুবিধে কি।

—বলেছিলাম। চালিহার মুখে চাপা বিরক্তি।—এই অসুখটার জন্যেই ভদ্রমহিলা মনের দিক থেকে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন মনে হয়। অত বড় একটা মার্কেট হাতছাড়া হওয়া উচিত নয় বলে যদি মনে করো তাহলে তুমিই জোর দিয়ে তাঁকে বলো। এদিকের জন্যে তো কিছু আটকে থাকবে না, মধ্যপ্রদেশের ফিল্ড হাতে নিয়েও এদিকটা আমি দেখাশুনা করতে পারব।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বাপী জিজ্ঞাসা করল, মিসেস রাই কি বলেন?

—কি বলেন তাই তো আমার মাথায় ভালো করে ঢুকছে না। তোমাকে নাকি এখন তাঁর খুব কাছে রাখা দরকার। ব্যবসায় ইন্টারেস্ট ছেড়েও তোমাকে খুব কাছে রাখা দরকার তাঁর…ব্যাপার কি বলো তো?

ব্যাপার কি তা যে এই লোক গায়ত্রী রাইয়ের ও-কথার পরে খুব ভালো করে টের পেয়ে গেছে বাপীর তাতে একটুও সন্দেহ নেই। মনে হল, অন্তরঙ্গ খোলসের আড়ালে একটা হিংস্র জানোয়ার ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওৎ পেতে আছে। চোখের গভীরেও একটা ধারালো ছুরি লুকনো আছে।

বাপী ভাবনায় তলিয়ে যাবার মতো করে জবাব দিল, অসুখটার জন্যেই হয়তো মন দুর্বল হয়ে আছে।

একটু আগে নিজেই এই কথা বলেছিল চালিহা। মুখে হঠাৎ আবার হাসির খোলস চড়ালো। বলল, তোমারও তো মন খুব সবল দেখছি না. যাক, আমার যা বলার ব্যবসার স্বার্থেই বললাম, যদি ভালো বোঝো তো মিসেস রাইয়ের সঙ্গে আলোচনা কোরো—আর কাছে থাকাটাই যদি বেশি দরকার ভাবো তা হলে আর কথা কি!

সে চলে যাবার পরেও বাপী স্থাণুর মতো বসে অনেকক্ষণ। সকলকে ছেড়ে গায়ত্রী রাই আগে এই লোকের কাছেই মনের ইচ্ছেটা প্রকারান্তরে ব্যক্ত করে ফেলল কেন মাথায় আসছে না। অসুখের জন্য বাপীর যেটুকু উদ্বেগ, মহিলার নিজের তার ছিটেফোঁটাও নেই। তার চরিত্রের এই ধাত বাপীর থেকে রণজিৎ চালিহা কম জানে না। অতএব ওকে কাছে রাখার একটাই অর্থ চালিহা বুঝেছে। আর, গায়ত্রী রাইও তাকে তা-ই বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু কেন? দূরে যাকে সরাতে চায় চালিহা, ভবিষ্যতে সে কত কাছের কোন জায়গা জুড়ে বসতে পারে সেটা বলে তাকে একটু সতর্ক করে দেবার জন্যে? বুঝিয়ে দেবার জন্যে যে আর তোমার ওই ছেলের পিছনে লেগে লাভ নেই—বরং নিজে তুমি সমঝে চলো?

কিন্তু বাপী কি করবে এরপর? মহিলার সংকল্প যে ভাবে দানা বেঁধে উঠছে, ও কোন্ পথ ধরে আত্মরক্ষা করবে?

জঙ্গলের কাজ যেমন বাড়ছে, আবুর দায়িত্ব বাড়ছে তেমনি। কোথায় কোন্ চাষের বেড হচ্ছে বা হবে বাপীর কাছে তার প্ল্যান ছকা। দায়-দায়িত্ব আবুর। তার হুকুমমতো তিরিশজন লোক সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে। এই গতর-খাটা লোকদের হিসেব মেটাবার জন্য আর পরামর্শ নেবার জন্য একদিন অন্তর আবুকে বাপীর কাছে আসতে হয়। হিসেব বুঝে পরচা লিখে সই করে দিলে অ্যাকাউনটেন্ট টাকা দিয়ে দেয়। মেমসায়েবের বাংলোর আপিসের দিকে ঘেঁষে না আবু। সন্ধ্যার দিকে বাপীর বাংলোয় আসে।

পর পর চার দিনের মধ্যে আবুর দেখা নেই। লোক মারফৎ অ্যাকাউন্টেন্টের কাছে হিসেব পাঠিয়েছে—সে এসে বাপীর কাছ থেকে সই করিয়ে নিয়ে গেছে। অ্যাকাউন্টেন্ট জানিয়েছে, রব্বানীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

বিকেলের দিকে বাপী সেদিন ওকে দেখার জন্যেই বেরিয়ে পড়ল। এদিক ওদিক পক্স-টক্স লেগেছে খবর পেয়েছে। শুধু-মুদু ঘরে বসে থাকার লোক নয় আবু রব্বানী।

দাওয়ার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মুখখানা বাংলার পাঁচের মতো হাঁড়ি করে হারমা বেরিয়ে আসছে। বাপীকে দেখল। অভ্যাসবশত একটা হাত কপালে উঠল বটে, কিন্তু মুখ তেমনি অপ্রসন্ন। গম্ভীর তো বরাবরই। একটি কথাও না বলে পাশ কাটিয়ে গেল।

ওর অসন্তোষের কারণ আঁচ করতে পারে বাপী। সাপ ধরার মৌসুম এটা। এর মধ্যে তিন দিন আগে রেশমাকে আবার পাহাড়ের বাংলোয় পাঠানো হয়েছে। এবারে গায়ত্রী রাইকে বলেই তাকে পাঠিয়েছে রণজিৎ চালিহা। বানারজুলি বা আশপাশের এলাকার মদ চালানোর ব্যাপারটা এখন বাপীর হাতে বটে। কিন্তু অন্যত্র চালিহার পার্টিও কম নয়। একটা বড় চালানের ব্যবস্থা করে মাল সংগ্রহের জন্য রেশমাকে আগে থাকতে সেখানে পাঠানো হয়েছে। বাপীর ধারণা দু-চার দিনের মধ্যে রণজিৎ চালিহাও পাহাড়ে যাবে। অবশ্য যাওয়াই স্বাভাবিক। হাজার টাকার মাল আসবে হয়তো, সে টাকা তো আর রেশমার হাতে দিয়ে দেওয়া যায় না। আগে গিয়ে সে শুধু সংগ্রহের ব্যবস্থা পাকা করে রাখবে।

চেষ্টা করেও ব্যাপারটা খুব সাদা চোখে দেখেনি বাপী। কিন্তু কর্ত্রীর সায় থাকলে সে আর বাধা দেয় কি করে। রেশমাকে আসামে চালান করতে চাওয়ার পিছনে চালিহার নিজস্ব মতলব কিছু আছে একথা তো গায়ত্রী রাইকে খোলাখুলিই বলে দিয়েছিল বাপী। হয়তো বা ভেবেছে, ঝগড়ু আছে সেখানে, মেয়েটা ঠিক থাকলে তার ওপর হামলার কোনো ভয় নেই। আবার এমনও হতে পারে ওই তুখোড় বুদ্ধিমতী মহিলার কাছে এও একটা টোপের মতো। আর সেই কারণেই প্রস্তাব আসামাত্র সায় দিয়েছে। হামলা যদি কিছু হয়ই, আর মেয়েটা যদি রুখে দাঁড়ায় বা ফুঁসে ওঠে, রণজিৎ চালিহার তাহলে মুখ পুড়বে। জঙ্গলের এইসব মেয়ে, বিশেষ করে রেশমা যে সহজ মেয়ে নয় গায়ত্রী রাই সেটা ভালই জানে। বড়দরের গণ্ডগোল কিছু পাকিয়ে উঠলে চালিহার সঙ্গে মহিলার কিছু ফয়সলার সুযোগ হয়তো আপনি এগিয়ে আসবে।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে বাপীর চাপা অস্বস্তি রেশমাকে নিয়েই। তার হাবভাব চাল-চলনের বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। জঙ্গলের কাজ তদারকে বেরুলে ওর সঙ্গে দেখা হয়। আবার বাংলোর দিকের রাস্তায় যখন ঊর্মিলার সঙ্গে বেড়ায়, তখনো দেখা হয়। রেশমা চোখের কোণে তাকায়, ঠোঁটে হাসি টিপ টিপ করে। সামনা-সামনি দেখা হয়ে গেলে দু-হাত কোমরে তুলে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাপী এগোলে বা থামলে দুটো কথা কইবার সাধ। কিন্তু বাপী এগোয়ও না দাঁড়ায়ও না। সোজা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাতেও মেয়েটার চোখেমুখে কৌতুক ঝরে লক্ষ্য করেছে।

বাপী তরফদার এখন ওর শুধু খোদ ওপরওলা নয়, এক কথায় দণ্ডমুণ্ডের মালিক। রেশমাও সেটা খুব ভালো জানে। দেখা হলে এই মেয়ে যদি সসম্ভ্রমে তাঁকে সেলাম ঠুকত বা পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াত—তাও অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু এর থেকে ওর সর্ব অঙ্গে ওপরওলার দাক্ষিণ্য যেটুকু আছে তার ওপরেই যেন নির্ভর বেশি। নিজের এই জোরের দিকটা সম্পর্কে সজাগ বলেই বেশি বেপরোয়া। এই মেয়ে যদি সসম্ভ্রমে সেলাম ঠোকে বা পথ ছেড়ে দাঁড়ায় সে—ও যেন কৌতুকের মতোই হবে। যাই হোক, বাপীর ধারণা মেয়েটার চাপা কৌতুক দিনকে দিন বাড়ছে।

…ক’দিন আগের এক বিকেলে ঊর্মিলা বাপীর বাংলোয় এসে হেসে অস্থির।—জঙ্গলে রেশমার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?

বাপী জবাব দেয়নি। নির্লিপ্ত গম্ভীর মুখে তাকিয়েই শুধু

—তোমাকে ক’বার করে ডেকেছিল আর তুমি সাড়া না দিয়ে আর একদিকে চলে গেছ?

…জঙ্গলের সেই সাপ ধরার পোশাকে রেশমাকে দেখেছিল ঠিকই। আঁট জামা পরা এই মেয়েকে দেখলে দুটো চোখ আপনা থেকে অবাধ্য হয় বলেই ডাক শুনেও বাপী সোজা প্রস্থান করেছিল। জিগ্যেস করতে আরো বেশি বিরক্ত হয়ে জবাব দিয়েছিল, রেশমাকে বলে দিও আমি ওর ইয়ার্কির পাত্র নই।

ছদ্ম বিস্ময়ে ঊর্মিলার দু’চোখ বড় বড়।—রেশমা তো তাহলে ঠিক বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি।

—কি বলেছে?

—ও একটা মস্ত শঙ্খচূড় ধরেছে আজ, সেই আনন্দে ওটা তোমাকে দেখাবার জন্যে ডেকেছিল। ও দুঃখ করছিল, এত বড় ওপরওলা হয়েও জ্যান্ত সাপের মতোই তুমি ওকে ভয় করো—এদিকে তোমার জন্যেই এখন ওর এত আয়-পয় যে ম্যানেজার চালিহা পর্যন্ত এখন ওকে খাতির করে, হেসে কথা কয়। তারপরেই চোখ পাকিয়েছে ঊর্মিলা, নিজের মনে পাপ না থাকলে ওর মতো এতদিনের একটা চেনা-জানা মেয়েকে তোমার এত ভয় কেন মশাই? ও-মেয়ে তো পারলে তোমাকে পুজো করে।

বিরক্ত হয়ে বাপী চায়ের তেষ্টার কথা বলে ওদের বাংলোয় চলে এসেছিল। মেয়েলী রাস্তা ধরে রেশমা যে শয়তানি করেই চালিহার খাতির করা বা হেসে কথা কওয়া ব্যাপারটা বাপীর কানে তুলতে চেয়েছে তাতেও কোনো সন্দেহ ছিল না।

আবু রব্বানী দাওয়ায় একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে। অদূরে দুলারি দাঁড়িয়ে। দুজনেই গম্ভীর। মুখ দেখে মনে হয় দুজনের কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। এইমাত্র হারমাকে চলে যেতে দেখেছে বাপী। কাছে আসতেই দুলারি জিগ্যেস করল, হারমাকে দেখলে?

—হ্যাঁ, কেন?

—কেন আবার কি, তোমার একটু মায়াদয়া নেই? রেশমা পাহাড়ে গেলে ওকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না? সেখানকার জঙ্গলে সাপখোপ নেই?

এমন মুখ আর এই অভিযোগ যে আবুকে আরো উত্তপ্ত করার জন্য বাপীর বুঝতে সময় লাগল না। ওর দিকে ফিরে হেসেই জিগ্যেস করল, জ্বরটর বাধিয়ে বসে আছ নাকি?

এবারে গম্ভীর চালে ঠেস দিয়ে দুলারিই আগেভাগে জবাব দিল, বসন্তের বাতাসে রাতদুপুরে ইঁদারায় ঠাণ্ডা জলে চান না করলে গা জুড়ায়? এখন গা গরম, তার থেকে মেজাজ আরো বেশি গরম। হারমার জন্য এত দরদ যে আমাকেই পাঁচ কথা শোনাচ্ছে।

বাপী দাওয়ায় বসল। কি ব্যাপার?

গোমড়া মুখ করে আবুই ব্যাপার বোঝালো তাকে। জান কয়লা করে ফেললেও রেশমার মতো মেয়ে হারমাকে পাত্তা দেবে না, দোষের মধ্যে ঠেস দিয়ে দুলারিকে এই কথা আবু বলেছিল। তাইতেই দুলারির রাগ, রেশমার নামে কেউ কিছু বললে ও আর বরদাস্ত করতে পারে না। কিন্তু হারমা যে নালিশ করে গেল, উল্টে ওই মেয়ের ওপর দুলারির রাগ হবার কথা।…ম্যানেজার চালিহার সঙ্গে রেশমার এখনকার একটু ভাবসাব আবুও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু দুলারি তা বিশ্বাসই করে না। রেশমার কানে লাগাতে ওই পাজী মেয়ে ফিরে তড়পেছে, নতুন বড় কর্তা তো সাত খুনের আসামীর মতো দেখে তাকে, পুরনো বড় কর্তা যদি হেসে-ডেকে দুটো কথা কয় তো দোষের কি, আনন্দই বা হবে না কেন? পাহাড়ে যাবার মওকা পেয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে চলে গেল, এদিকে হারমা বলল, এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় ওই চালিহা লোক পাঠিয়ে রেশমাকে তার বাংলোয় ডেকে নিয়ে গেছল। পাহাড়ে যেতে হবে বলার জন্যে সন্ধ্যার পর বাংলোয় ডেকে পাঠাবার দরকার কি, আপিসে ডেকে এনে বললেই হয়। অবশ্য হারমা তখন ওর সঙ্গে ছিল, আর আধ ঘণ্টা-টাক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিল। তারপর রেশমার পাহাড়ে যাবার আগের দিন বিকেলে ম্যানেজার চালিহা নিজে ওর জঙ্গলের ডেরায় এসেছে, রেশমা নাকি তাকে আদর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে। কম করে ঘণ্টাখানেক পরে কাজের কথা বলে তারপর চলে গেছে। হারমা ততক্ষণ সামনের উঠোনে বসে। নালিশ শুনে দুলারি নাকি উল্টে হারমাকে ধমকেছে, দু’দিনই তুই কাছে ছিলি আর ঘরের দরজাও বন্ধ ছিল না—তোর এভাবে এসে লাগান—ভাঙান দেবার কি হল, কাজের কথা থাকতে পারে না?

কাজ যা-ই থাক, এই ধূর্ত লোকের সঙ্গে মাখামাখি আবুর একটুও ভালো লাগেনি। হারমার পক্ষ নিয়ে সে-কথা বলতে দুলারি শুনিয়েছে, নিজের চরিত্রখানা কি ছিল তাই আগে ভালো করে দেখো, রেশমার মতো মেয়েকে বুঝতে তোমার ঢের দেরি। ফাঁদ যদি পাতেও, বুকে ছুরি বসানোর জন্যে পাতবে জেনে রেখো। সবটা শোনার পর নিরীহ মুখে বাপী জানান দিল, চালিহা সাহেবও দু’চার দিনের মধ্যে পাহাড়ে যাচ্ছেন…।

—যাচ্ছেন! রাগ আর উত্তেজনায় আবু সামনে ঝুঁকল।

—যেতে তো হবেই। রেশমা যে কাজের ভার নিয়ে গেছে তার টাকা পৌঁছে দিতে হবে না?

—শুনলে? শুনলে দোস্ত-এর কথা?

মুখ মচকে দুলারি জবাব দিল, দোস্তকেও তোমার মতো রোগে ধরাতে চাও তো এ-সব কথা বেশি করে শোনাও।

রেশমার বিরুদ্ধে কোনো কথাই দুলারির বরদাস্ত হবার নয়।

কিন্তু দুদিন না যেতে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাপারখানা অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। হাজার আড়াই টাকা নিয়ে কর্ত্রীর হুকুমে চালিহার বদলে বাপীকে ছুটতে হল পাহাড়ের বাংলোয়। জরুরী তার পেয়ে রণজিৎ চালিহা বিহারে চলে গেছে। ছ’সাত দিনের আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই।

এ-রকম হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু হাসিই পেয়েছে বাপীর। বেচারার বরাত বড় মন্দ চলেছে দেখা যাচ্ছে।

.

রেশমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বাংলোর ফটক দিয়ে বাপীর গাড়ি ঢুকতে দেখল। চালকের আসনে শুধু ওকেই দেখল। নিজের অগোচরে হাত দুটো কোমরে উঠল তার। একজনের বদলে অন্যজনকে দেখে অবাক কতটা ঠাওর করা গেল না। মুখে চাপা খুশির ছটা।

বাগানে মৌসুমী ফুল ছেয়ে আছে। আবার সেই বসন্তকাল। একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে রঙ-চঙা ঘাঘরা আর জামা-পরা ওই মেয়ে দাঁড়িয়ে। কোমরে দু-হাত তোলার ভঙ্গিটাও চোখ টানবেই। ভিতরে ভিতরে বাপীর আবার সেই পুরনো অস্বস্তি। ফলে ওপরওলার মুখ ভার। ঠাণ্ডা, গম্ভীর।

গাড়ি থেকে নামার ফাঁকে ঝগড়ু এসে দাঁড়ালো। ওকে দেখে একগাল হাসি। তড়বড় করে বলল, তুমি আসবে বাপীভাই, ভাবিনি—খুব ভালো হল।

বারান্দায় উঠে বাপী একটা চেয়ার টেনে বসল। রেশমা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে। ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শুধু। ঝগড়ুর দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখেই বাপী জানান দিল, মিস্টার চালিহা জরুরী তার পেয়ে বিহার চলে গেলেন, তাই আমি এলাম।

কালো মুখে আর এক প্রস্থ হাসি ছড়িয়ে ঘাড় মাথা নাড়তে নাড়তে ঝগড়ু চায়ের ব্যবস্থায় চলে গেল। ওই একজনের বদলে বাপীভাইকে দেখে সে-যে কত খুশি, মুখে আর সে-কথা বলল না।

সামান্য মাথা নেড়ে বাপী রেশমাকে কাছে ডাকল। কোমর থেকে হাত নামলো রেশমার। ঢিমেতালে এসে দাঁড়াল। বাপী তাকে বসতে বলল না। জিগ্যেস করল, কাজ-কর্মের কদ্দুর?

—হচ্ছে। কয়েকজন মাল মজুত করেছে, টাকা পেলেই দিয়ে দেবে। আর বাকিরা এখনো যোগাড় করছে, আরো পাঁচ-ছ’দিন লাগবে।

—এত সময় লাগবে কেন, তুমি তাড়া দাওনি?

—বেশি তাড়া দেবার কথা আমাকে বলা হয়নি। তোমার ফেরার তাড়া থাকলে তাড়া দিয়ে দেখতে পারি।

রেশমা সোজা চেয়ে আছে বলেই বাপীর দু-চোখ সামনের বাগানের দিকে। এবারে ওর দিকে না তাকিয়ে পারা গেল না। খুব সহজ কথাটার মধ্যেও যেন অহেতুক মজার ছোঁয়া লেগে আছে। চোখাচোখি হতেই বাপী ধাক্কা খেল একপ্রস্থ। এই হাসিমাখা চাউনি বাপীর অচেনা নয় খুব। কোথায় দেখেছিল …কোথায়? যে-চাউনি দেখলেই মনে হয় তার আড়ালে সর্বনাশ লুকিয়ে আছে কিছু। কমলা বনিক নয়, মণিদার বউ গৌরী বউদির চোখে এই রকম দেখেছিল কিছু। গৌরী বউদি সাত বছরের বড় ওর থেকে। রেশমা বছর দুইয়ের। কিন্তু দেখলে রেশমাকে বড় কেউ বলবে না। আরো তফাৎ কিছু আছে। গৌরী বউদি খুব অপ্রত্যাশিত পুরুষ দেখেছিল। রেশমার চাউনি আদৌ অপ্রত্যাশিত কাউকে দেখার মতো নয়। ও-যেন কাউকে নাগালের মধ্যে পেয়েই বসে আছে।

বাইরে বাপী আরো ঠাণ্ডা। আরো গম্ভীর। উঠল। ঘরে চলে গেল। নিজেই জানে কপাল ঘেমে উঠেছে। ওপরওলার ষড়যন্ত্রটা যে রণজিৎ চালিহাকে নিয়ে নয়—ওকে নিয়ে।

এবারে আর রেশমার সঙ্গে কোথাও বেরুলো না। ওর কাছ থেকে পার্টিদের ঠিকানা নিয়ে নিজেই বেরুলো। ওকে শুধু হুকুম করল, যোগাড়যন্ত্র তাড়াতাড়ি হয় কিনা দেখো—

একে একে চারদিন কেটে গেল। আজ পাঁচদিন। বাপী আশা করছে আজকের মধ্যে কাজ চুকিয়ে কাল সকালে বেরিয়ে পড়তে পারবে। একলাই যাবে। পরে ভ্যান এসে মালসহ রেশমাকে নিয়ে যাবে। ওর আচরণের ফলেই রেশমা ও এবারে অনেকটা সমঝে চলতে বাধ্য হয়েছে বলে বিশ্বাস। সমস্ত দিন বা রাতের মধ্যে একবারও দেখা হয়নি এমন দিনও গেছে। সকাল দুপুর বিকেল রাত্রি একলা বসে খেয়েছে। ঝগড়ুকে বলেছে খাবার ঘরে দিয়ে যেতে। বাপীভাইয়ের মেজাজ দেখে এবার ঝগড়ুও হয়তো অবাক একটু। দুদিন মাত্র রেশমাকে ডেকে কাজের কথা বলেছে বা নির্দেশ দিয়েছে। রেশমাও অনুগত বাধ্য মেয়ের মতো কথার জবাব দিয়েছে বা শুনেছে। কোনো অছিলায় কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করেনি। তবু বাপীর ভেতরটা অস্বস্তিতে বোঝাই একেবারে।

সেদিন আর দুপুরের পর বাপীর হাতে কাজ নেই কিছু। রেশমা সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তার কাজে বেরিয়েছে। বেলা থাকতে বাপী পায়ে হেঁটেই বাংলো ছেড়ে বেরুলো। আগের তুলনায় অনেক আত্মস্থ। পাহাড় থেকেই নেমে জঙ্গলে ঢুকল। তারপর পাহাড়ের ধার ধরে আপন মনে এগিয়ে চলল। পাহাড়-ঘেঁষা জঙ্গলের একান্ত নির্জন পথ ধরে মাইল দুই হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে একটা পাথরে বসল।

বিকেল চারটে তখন। এত নিরিবিলি বলেই ভালো লাগছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। এই নির্জনতার এক ধরনের ভাষা আছে যা কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে। আগের বছর যেমন দেখে গেছল তেমনি। বনের সর্বত্র সেই রূপের ঢেউ। সেই রসের ঢেউ। অশোক পলাশের সেই রঙের বাহার। শিমূল কৃষ্ণচূড়ার মাথা তেমনি লালে লাল। বাপী তন্ময় হয়ে দেখছে।

হঠাৎ বিষম চমক। কেউ ডাকেনি, কিন্তু নিজে থেকে কি করে টের পেল জানে না। ওর বাঁ পাথরটার ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে।

রেশমা। পরনে ঘাগরা। গায়ে রঙচঙা জামা। দু-হাত কোমরে। বাপীকে যেন দেখেইনি। তার মাথার ওপর দিয়ে সামনের প্রকৃতি দেখছে সেও

—তুমি এখানে কেন? হঠাৎ কঠিন কর্কশ গলার স্বর বাপীর।

রেশমার দুচোখ যেন দূরের থেকে কাছে এলো। তার মুখের ওপর স্থির হল। রাগত মুখ রাগত চাউনি তারও।আমার সঙ্গে আজকাল তুমি এরকম ব্যাভার করছ কেন?

—তুমি যাবে এখান থেকে?

—কেন যাব? জঙ্গল তোমার?

হঠাৎ বাপী অত্যন্ত শান্ত। সংযত। গলার স্বর তেমনি কঠিন।—দেখো রেশমা, তুমি যার কাজ করছ আমিও তার কাজ করছি। এর মধ্যে তুমি যদি আমাকে ওই চালিহার মতো একজন কেউ ভেবে থাকো তো খুব ভুল হবে

কৌতুক চাপার তাড়নায় রেশমা আরো গম্ভীর। সাদাসাপটা জবাব দিল, চালিহার মতো ভাবলে তোমার ধারে-কাছে কে ঘেঁষত?

এবারে বেশ জোরেই ধমকে উঠল বাপী।—তুমি যাবে এখান থেকে?

কোমর থেকে দু-হাত খসল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকালো একবার। সঙ্গে সঙ্গে গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ। কিছু বোঝার আগেই দু-হাত বাড়িয়ে আচমকা প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টানে বাপীকে একেবারে নিজের গায়ের ওপর টেনে আনল। তারপরেই বলে উঠল, বনমায়ার সেই গুণ্ডা হাতি!

পলকে সামনের দিকে চোখ পড়তে বাপী বিমূঢ় হঠাৎ। রেশমা এক হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে, হুঁশ নেই। দেড়শ গজ দূরে একটা বিরাট হাতি। দুটো বিশাল দাঁত ধনুকের মতো বেঁকে শূন্যে উঠে গেছে। ডান দিকের গলার কাছে প্রকাণ্ড লালচে ক্ষতর মতো। হাতিটাও বোধ হয় সেই মুহূর্তেই দেখেছে ওদের। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের মতো শরীরটাকে একটা ঝাঁকানি দিয়ে দ্রুত ধাওয়া করল এদিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *