সোনার হরিণ নেই – ২০

কুড়ি

শক্ত মুঠোয় বাপীর জামাটা ধরে আবার একটা হ্যাঁচকা টান দিল রেশমা—ছোটো শিগীর।

কিন্তু বুনো হাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটা যে সম্ভব নয় সেই মুহূর্তে অন্তত বাপীর মাথায় এলো না। দিশেহারার মতো সামনের দিকে ছুটতেই জামায় আবার জোরে টান পড়ল। জামাটা ফ্যাস করে ছিঁড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রেশমা জামা ছেড়ে তার হাত ধরল। ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আঃ, পাহাড়ের দিকে ছোটো!

পঁচিশ-তিরিশ গজের মধ্যে পাহাড়। রেশমা বাপীর হাত ছাড়েনি। ওরা পাহাড়ের নাগাল পাবার ফাঁকে ওই যম পঞ্চাশ-ষাট গজের মধ্যে এসে গেছে। —ওঠো! শিগগীর ওঠো! ও-দিক দিয়ে নয়, এই ছোট পাহাড়গুলো টপকে ওঠো। রেশমা ওকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেও দু’হাতে আর দু’পায়ে তর তর করে উঠে যেতে লাগল। কিন্তু বাপী তাও পিছিয়ে পড়ছে দেখেই আবার দাঁড়িয়ে গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে পাথর টপকাতে সাহায্য করল। বুনো মরদ হাতি পাহাড়ের গায়ে এসে গেছে ততক্ষণে। ওদের পাহাড়ে উঠতে দেখেছে। বিশাল মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে ওটা পাহাড়ে ওঠার জায়গা খুঁজছে। একটা পাথরের আড়ালে বাপীকে এক হাতে জাপটে ধরে বসে ওটার মতি-গতি লক্ষ্য করল রেশমা। দেখছে বাপীও। কি বলতে যেতে রেশমা মুখে হাত চাপা দিল। তারপর এক-হাতে তেমনি ধরে রেখে হামাগুড়ি দিয়ে আবার অন্য উঁচু পাথরের দিকে এগিয়ে গেল। এইভাবে আরো খানিক এগিয়ে যেতে পারলে পর পর কতগুলো পাহাড়ী ঝোপের আড়াল পাবে।

আবার একটা পাথরের পিছনে এসে থামল ওরা। কানে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে রেশমা বলল, ‘খানিকটা ওঠার মতো প্লেন পাথর পেলে ও ঠিক শুঁড় দিয়ে ছোট পাথর ঠেলে ঠেলে এ দিকে উঠে আসবে। বোসো, দেখে নিই কি করছে—

সভয়ে দেখছে বাপীও। শুঁড় তুলে শিকার ঠিক কোন্ দিকে হদিস পেতে চেষ্টা করছে। দুটো অতিকায় দাঁত ধনুকের মতো বেঁকে আছে। হাঁ করে শুঁড় উঁচনোর দরুন লালা-ঝরা লাল মুখ-গহ্বর দেখেও গা শিরশির করছে। ঘাড় আর কাঁধ ঘেঁষা পেল্লায় দগদগে ক্ষতটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন।…বনমায়ার সেই বুনো মরদ হাতিটাই যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দু’পেয়ে মানুষ বনমায়ার জীবন কেড়েছে। তাই আজ মানুষই চরম শত্রু ওর।

ক্ষিপ্ত আক্রোশে হাতিটা শরীর ঝাঁকিয়ে সামনের দিকে এগোতে রেশমা আবার একটা হ্যাঁচকা টান দিল।—ওই ওপরের ঝোপের দিকে, শিগগীর।

ছোট বড় খণ্ড খণ্ড পাথর টপকে আরো ওপরের ঝোপের আড়ালে চলে এলো তারা। একটু বাদে বাপী সত্রাসে দেখলে, দূরে বারো চৌদ্দ গজের মতো পাহাড় বেয়ে উঠে শুঁড় দিয়ে পাথর ঠেলে ঠেলে হাতিটা এ-দিকে এগিয়ে আসছে। ওরা যেখানে আছে শুঁড় দিয়েও নাগাল পাবে না হয়তো, কিন্তু অতটা যখন উঠেছে আরো উঠতে পারবে কিনা কে জানে। ওটাকে আসতে দেখেই বাপীর গায়ের রক্ত হিম।

বড় পাথরের দিকে ঘেঁষল না রেশমা, আবার ওকে টেনে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খণ্ড খণ্ড পাথরের আড়ালে আড়ালে আরো উঁচু উঁচু ঝোপের পিছনে চলে আসতে লাগল। এক হাতে পিঠ বেড়িয়ে বাপীকে জাপটে ধরে আছে। মহামূল্যবান একটি প্রাণ যেন ওরই হাতের মুঠোয়। ঝোপের আড়ালে বসে আবার কানের কাছে মুখ এনে ফিস-ফিস করে বলল, উল্টো দিকের হাওয়ায় ও আমাদের গায়ের গন্ধ পাচ্ছে…ওর পিছনে চলে না যাওয়া পর্যন্ত ওটা নড়বে না, হয়তো বিকেল ছেড়ে সমস্ত রাত আমাদের আগলে রাখবে।

হাতিটা এখন বেশ নিচে অবশ্য। ওটার দিকে চোখ রেখে ঝোপ আর পাথরের আড়ালে আড়ালে ফাঁক বুঝে বুঝে তারা ওটার পিছনের দিকে এগোতে লাগল। এই করে অনেকটা পিছনে এসে কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু ওটা না গেলে তো আর পাহাড় থেকে নামা যাবে না।

হাতিটা যে রাস্তা ধরে ওপরে উঠেছিল সেদিকে ফিরে চলল এক সময়। ফলে ওদেরও সন্তর্পণে এগোতে হচ্ছে। নইলে গায়ের গন্ধ পাবে।

নামার আগে ওই বুনো হাতি হঠাৎ থেমে গিয়ে শরীরের সমস্ত রাগ গলা দিয়ে বার করতে লাগল। তার ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে পাহাড়টা সুদ্ধু কাঁপছে। উঁচু ঝোপের আড়ালে রেশমা বাপীকে এক হাতে বুকের আর নিজের পাঁজরের সঙ্গে জাপটে ধরে বসে আছে। কিন্তু তখন পর্যন্ত বাপীর কোনো দিকে হুঁশ নেই। সব ক’টা স্নায়ু টান টান, লক্ষ্য নিচের ওই দানবটার দিকে।

হুঙ্কার থামিয়ে বুনো হাতিটা সমতল পাহাড় ধরে নামতে লাগল। নামার পর আরো খানিক দাপাদাপি করে জঙ্গলের যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলল।

একটা দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটতে লাগল বাপীর। মুখ ফেরাতেই রেশমার গালের সঙ্গে গাল ঠেকল। রেশমা তেমনি এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। নিঃশব্দে হাসছে। ঠোঁটের ফাঁকে ঝকঝকে দাঁতের সারি চিক চিক করছে। চোখের পলকে সর্বাঙ্গে যেন আগুনের ছেঁকা লাগল বাপীর। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কোন রকম বাধা না দিয়ে রেশমাও এবারে ছেড়ে দিল। কিন্তু চাপা হাসির তরঙ্গ নিঃশব্দে ওর দেহ-তট ভেঙে উপচে উঠছে। বাপী আর তাকাতেও পারছে না। শুধু নিজের জামা নয়, রেশমারও জামার জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে-খুঁড়ে একাকার।

মাথাটা প্রচণ্ড ঝিম ঝিম করছে বাপীর। তবু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে চাপা ধমকের সুরে রেশমা বলল, এখুনি নামতে যাচ্ছ নাকি? পাগলা হাতির থেকে এখন আমাকে বেশি ভয় তোমার?

বাপী দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুর মতো। শরীরের রক্তকণাগুলো জ্বলছে। চারদিক তাকিয়ে দেখল। বিচার-বিবেচনা যতো বাড়ছে এখন, ভিতরে ততো অস্বস্তি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার বেশ খানিকটা নিচে পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড ছোট পাথর। তুখোড় বুদ্ধিমতীর মতোই এই ছোট পাথরগুলোর এ-ধারে ওকে নিয়ে এসেছে রেশমা। কোনো হাতির পক্ষে এই ছোট পাথরের জঙ্গল ঠেলে উঠে আসা সম্ভবই নয়, বাপীর এতক্ষণ সেটা মনে হয়নি। কিন্তু তার পরেও রেশমা ওকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমনি জাপটে ধরে বসেছিল। সবটাই মনে পড়ছে বাপীর। নিজের প্রাণ তুচ্ছ, গোড়া থেকে ওকে বাঁচানোর আকৃতিটুকুই সব রেশমার।

বাঁচাতে পেরেছে। পাথুরে মাটি ছেড়ে রেশমাও উঠে দাঁড়াল। চোখেমুখে হাসি চিক চিক করছে তখনো। কিন্তু বাপী কি এত দুর্বল, এত অসহায়। ওর দিকে চোখ পড়তে এ কি সর্বনাশের ছায়া দেখছে। স্নায়ুগুলো এত কাঁপছে কেন ঠক ঠক করে?

রেশমা বলল, কিছুটা নেমে পাহাড় ধরেই যতটা সম্ভব এগনো যাক, একেবারে নিচে নামা ঠিক হবে না।

অর্ধেকটা নেমে পাহাড়ের পাথর ভেঙে ভেঙে পাশাপাশি চলল তারা। কিন্তু এভাবে চলা কষ্টকর। রেশমা থমকে দাঁড়াল এক জায়গায়। — হাত ধরব?

—দরকার নেই। রেশমার এই দুটো কথাও কানে গরম তাপ ছড়াচ্ছে।

—প্রাণে বাঁচালাম, এখন তো আমাকে দূরে ঠেলবেই। না তাকিয়েও বাপী বুঝতে পারছে ওর চোখেমুখে সেই সর্বনাশা হাসি ঠিকরে পড়ছে।

.

…অথচ রেশমা না থাকলে প্রাণে বাঁচা যে সম্ভব ছিল না এ এক নির্মম সত্য। বুনো পাগল হাতিটা এত নিঃশব্দে আসছিল যে বাপীর চোখেই পড়ে নি। আর এক মিনিট দেরি হলেও রক্ষা পেত না। তাছাড়া ওটাকে দেখার পরেও দিশেহারার মতো জঙ্গল ধরেই ছুটতে যাচ্ছিল। রেশমা ওকে পাহাড়ে টেনে না তুললে এই জীবনের খেলা শেষ হয়ে যেত। জঙ্গলের মধ্যে ছুটে হাতির সঙ্গে পাল্লা দেবার চেষ্টা যে হাস্যকর এ বাপীও জানে। অথচ সংকটের সময় এটুকুও মাথায় আসেনি।

দিনের আলোয় টান ধরেছে। দেখতে দেখতে এখন অন্ধকার ধেয়ে আসবে। নিচে নেমেও তারা পাহাড় ঘেঁষেই দ্রুত চলতে লাগল। আরো মিনিট বিশ-পঁচিশ বাদে সব অন্ধকার। দু’জনে পাশাপাশি চলেছে। এখন রেশমার মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। তাইতেই স্বস্তি একটু।

এতটা পথ দু’জনেরই মুখ সেলাই। পাহাড়ের বাংলোয় উঠে আসতে রাত। বাইরের বারান্দায় বড় হ্যাসাক জ্বলছে। বাপীর মনে হল ওটা না থাকলে ভালো হত। দূর থেকে দেখল ঝগড়ু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাত হতে দেখে ওদের অপেক্ষাতেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো

বারান্দায় উঠে আসতে দু’জনের মূর্তি দেখে ঝগড়ুর চোখ কপালে। এত আলোয় রেশমার সমস্ত মুখ লালচে দেখাচ্ছে। চাপা হাসি ঠিকরোচ্ছে। কিন্তু ঝগড়ুর কিছু তলিয়ে ভাবার ফুরসৎ নেই!—কি হয়েছে বাপীভাই? কোনো বিপদ—টিপদ নাকি?

—ওর কাছে শোনো। আমি খুব ক্লান্ত। এক পেয়ালা স্ট্রং কফি নিয়ে এসো চট করে।

দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলো। বুকের তলায় একটা ঠক ঠক শব্দ হয়েই চলেছে। মুখ হাত ধোবার ধৈর্যও নেই। গায়ের ছেঁড়া জামাটা খুলে গেঞ্জি গায়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। একটা চেনা যন্ত্রণার আগুন ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে।

একটু বাদে ঝগড়ু কফি রেখে গেল। ভয়ার্ত বিহ্বল মুখ তারও। বিপদের কথা শুনতে শুনতেই কফি নিয়ে চলে এসেছে বোধ হয়। পেয়ালা রেখেই আবার ছুটল।

রাত নটা নাগাদ চুপচাপ একলাই খেয়ে নিল বাপী। ভিতরে ঝগড়ুর ঘরে রেশমার খুশি-ঝরা গলা শোনা যাচ্ছে। তার ঘরের সামনেটা অন্ধকার। বাপী একটু এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে না দেখে পারল না। ঝগড়ু একটা নতুন দামী বোতল নিয়ে বসেছে। বাপী দেয়নি যখন ওটা নিশ্চয় রেশমাই দিয়েছে তাকে। পরনে তার একটা চকচকে ঘাগরা। গায়ে অন্য জামা। চান সেরে পিঠে ভিজে চুল ছড়িয়ে ঝগড়ুর মুখোমুখি মেঝেতে বসে আছে। হাঁটুর একটু ওপর থেকে ধপধপে পা দুটো দেখা যাচ্ছে। ঝগড়ুকে বিপদের গল্প বিস্তার করে শোনাচ্ছে।

বাপী সরে এলো বটে, কিন্তু স্নায়ুতে স্নায়ুতে একটা অবাধ্য অবুঝ দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। সেই এক রাতের কথা মনে পড়তে বুকের ওপর আসা মুগুরের ঘা পড়েছে।…যে রাতে কমলা বনিক নিজের শোবার ঘরে বসে আধা-বুড়ো রতন বনিককে তার খুশিমত মদ খেতে দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল বাপী সেই সন্ধ্যায় সেটা তক্ষুনি আঁচ করছিল।

আজ সামনে বসে ঝগড়ুকে দামী মদ খাওয়াচ্ছে রেশমা।

নিজের ঘরে এসে বাপী দরজা দুটো বন্ধ করে দিল। তারপর ছিটকিনিও লাগিয়ে দিল। শরীরটা কাঁপছে। আলো নিভিয়ে সটান বিছানায়। কিন্তু তার পরেও একটা অমোঘ সর্বনাশ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল…কলকাতায় যেমন হয়েছিল। সমস্ত দিন নিদারুণ আক্রোশে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করার পরেও রাতে একটা তিমির তৃষ্ণা ভিতর থেকে ঠেলে উঠেছে আর তারপর একটু একটু করে ওর ওপর দখল নিয়েছে—এই রাতের অনুভূতিটাও সেই রকম। অবাধ্য তাড়নায় এখনই কেউ যেন বাপীকে ওই বদ্ধ দরজার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দরজা খুলে লোলুপ প্রতীক্ষায় বসে থাকতে বলছে। ও নড়ছে না বলেই ওই চেনা যন্ত্রণাটা ওর হাড়-পাঁজর দুমড়ে মুচড়ে ভাঙছে।

রাত বাড়ছে। যন্ত্রণাটাও।

বাপী বিছানা ছেড়ে নামল। ওই দরজা খুললে কেউ আসুক না-আসুক ওকেই যে সামনের অন্ধকার হলঘরের ভিতর দিয়ে একজনের দরজার দিকে এগোতে হবে এটা তার থেকে ভালো কেউ জানে না। কলকাতার টালি এলাকার সেই এক খুপরি ঘরে বাপী তরফদার দেউলে হয়েছিল, সর্বস্বান্ত হয়েছিল। কিন্তু তখন বাপীর কোনো হাত ছিল না।

কিন্তু আজ? এখন?

বাপী মেঝেতে বসে পড়ল। কাঠের মেঝেতে খসখসে গালচে পাতা। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আর সে দেউলে হবে না। জীবনে শুধু একটি মেয়েই তার লক্ষ্য। আর কেউ না—কেউ না! আবার দেউলে হলে আর কোনদিন তার মুখোমুখি হওয়া যাবে না। তাই এই যন্ত্রণার শেষ না করলেই না। এই লোভের চুঁটি টিপে না ধরলেই না।

খসখসে গালচেয় নাক মুখ কপাল ঘষে ঘষে ছাল তুলে ফেলার উপক্রম করল। চামড়া যত জ্বলছে, যন্ত্রণা তত কমছে। মুঠো করা দুটো হাতই একে একে দাঁতে তুলে চামড়া কেটে ফেলল।

…হ্যাঁ, এইবার যন্ত্রণা আরো কমছে।

গালচের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল খানিক। তার পরেই স্নায়ুগুলো সব ধনুকের ছিলে ছেঁড়ার মতো একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল। বন্ধ দরজার ও-ধারে মৃদু ঘা পড়ল। কেউ দরজা ঠেলছে। খুলতে না পেরে ওই শব্দ করছে।

অন্ধকারে বাপী নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে। নিঃশ্বাসেও। উঠল। দরজার দিকে এগলো। ছিটকিনি নামালো। দরজা খুলল।

বারান্দার হ্যাসাক অনেক আগেই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরে চাঁদের আলোর ছড়াছড়ি। আড় হয়ে একপশলা জ্যোৎস্না রেশমার মুখের ওপর পড়েছে। কোমরে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

দরজা খুলতেই ঘরে এলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত দুটো পিছনে নিয়ে নিজেই দরজা দুটো বন্ধ করল। ঘর অন্ধকার আবার।

বাপী নিঃশব্দে সুইচের দিকে এগিয়েছে। তারপরেই জোরালো আলোর ধাক্কা।

রেশমার ঠোঁটে হাসি। মুখে হাসি। চোখে হাসি। কিন্তু তার পরেই সত্যিকারের বিস্ময়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, এ কি। নাক মুখ কপালের এ-রকম হাল হল কখন? পাহাড়ে? আগে তো লক্ষ্য করিনি…ওষুধ-টষুধ লাগিয়েছ কিছু?

বাপী চেয়ে আছে। এই রাতটা যেন এই মেয়ের দখলে। মৃত্যুর থাবা থেকে যে পুরুষকে ছিনিয়ে এনেছে, এই রাতে তার ওপর দখল বরবাদ করার হিম্মতও যেন কারো নেই।…নাক মুখ কপালের এই হাল বেশ রেশমা কি তা বুঝতে পেরেছে? ঠোঁটে মুখে চোখে আবার সেই হাসি। দেখছে সে-ও।

—ও কি! অত চোখ লাল করছ কেন?

—এত রাতে তুমি এই ঘরে কেন?

জবাবে রেশমা কাছে এগিয়ে এলো। ঘরের চারদিকে চেয়ে দেখল একবার। তারপর চোখের আর ঠোঁটের নিঃশব্দ হাসির জালে ওর মুখটা ভালো করে আটকে নিল।—অত ধকলের পর এত রাত পর্যন্ত তুমিই বা জেগে বসে আছ কেন?

সঙ্গে সঙ্গে আরো এগিয়ে এলো। একেবারে আধ-হাতের মধ্যে। বাপীর চোখে-মুখে একঝলক তপ্ত নিঃশ্বাস এসে লাগল। হাত দুটো আবার কোমরে উঠে এলো রেশমার। গলার স্বরেও হাসি ঠিকরলো এবার।—এলাম তো এলাম, তোমার অত ঘাবড়ানোর কি আছে? তুমি কি ভেবেছ মওকা বুঝে এরপর আমি তোমার ঘর করতে চাইব?

—তুমি যাবে এখন এখান থেকে?

—যাব বলে এসেছি?

রেশমা বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে এবার। কোমরের দু’হাত ওর কাঁধের ওপর দিয়ে গলার দিকে এগোচ্ছে। বাপী জানে আর এক মুহূর্ত দেরি হলে ওই দুটো হাত এবার অব্যর্থ রসাতলের গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে তাকে।

একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে চার হাত দূরে কাঠের গালচের ওপর ছিটকে পড়ল রেশমা। পুরু গালচের ওপর দিয়েই মাথার পিছনটা জোরে ঠোক্কর খেল। প্রচণ্ড ধাক্কায় চিৎপাত হয়ে যে-ভাবে পড়ল তার আঘাতও কম নয়। কিন্তু বাপীর মাথায় খুন চেপেছে। ওর পাশ কাটিয়ে চোখের পলকে ভেজানো দরজা দুটো খুলে ফেলল। তারপর সেই অবস্থাতেই দু’হাত ধরে হিঁচড়ে টেনে নারীদেহ দরজার বাইরে এনে ফেলল। আবার ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল।

হাঁপাচ্ছে। বুকের তলায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। কাঁচের জাগ থেকে এক গেলাস জল গড়িয়ে খেল। আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে বসল।

.

পরদিন সকাল সাড়ে আটটার পর ঝগড়ু কড়া নাড়তে বাপী দরজা খুলল। ঋগড়ু বলল, তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছ দেখে এতক্ষণ ডাকিনি। কিন্তু কি ব্যাপার বলো তো বাপীভাই, রেশমাকে কি তুমি খুব সক্কালে উঠে হেঁটেই বানারজুলিতে চলে যেতে বলেছ নাকি?

বাপী থমকালো।— কেন?

—আমি তো বেশ ভোরে উঠেছি, কিন্তু ওকে কোথাও দেখছি না। তারপর ওর ঘরে গিয়ে দেখি জামা-টামা বা তোরঙ্গটাও নেই। সকালে যাবে কাল রাতে ও তো আমাকে বলেনি!

বিড়বিড় করে বাপী বলল, না, আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।

স্নেহ-মেশানো বিরক্তি ঝগড়ুর।—দেখো তো, বলা নেই কওয়া নেই এ-ভাবে কেউ চলে যায়! যেমন বুদ্ধি তেমন সাহস মেয়েটার, কাল তুমি ওর জন্যেই বড় বাঁচা বেঁচে গেছ বাপীভাই—ভাঙা পাথর বেয়ে পাহাড়ে উঠে না গেলে আর রক্ষা ছিল না—কিন্তু এ-দিকে মর্জি দেখো মেয়ের, সকালে উঠেই হাওয়া!

…না, বাপী কিচ্ছু ভাববে না। কিচ্ছু চিন্তা করবে না। যা হবার তাই হয়েছে। এর ওপর বাপীর কোনো হাত ছিল না।

সকালে উঠে নিজেই বানারজুলি চলে যাবে ঠিক করেছিল। কিন্তু রেশমা চলে গেছে শুনে তার আর যাবার তাড়া নেই। ভালোই হয়েছে। একটু সময় দরকার। সহজ হবার মতো একটু অবকাশ দরকার। সকাল দুপুর বিকেল এক-রকম শুয়ে বসেই কাটিয়ে দিল। আয়নায় মুখ দেখে মাঝে মাঝে। নাক মুখ কপালে এখনো ছাল ওঠা লালচে দাগ। ঊর্মিলার প্রসাধনসামগ্রী এখানেও তার ঘরে মজুত। ঝগড়ুর অলক্ষ্যে ক্রিমের কৌটোটা এনে সকাল থেকে অনেকবার ঘষেছে।

….অমোঘ রসাতলের গহ্বর থেকে বাপী নিজেকে টেনে তুলেছে। সর্বক্ষণ তবু নিরানন্দে ভেতর ছেয়ে আছে। লোভের জাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে নিজেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পৌরুষের অস্তিত্ব নেই কোথাও।…এর পরেও ওই মেয়ের কোন রকম ক্ষতি করবে না বাপী। ক্ষতি করার শক্তিও নেই। কিন্তু রেশমা এরপর কি করবে? না, রাপী ভাববে না। তার ভাবনা ধরে দুনিয়ায় কিছুই ঘটছে না।

গাড়িতে সব মাল তুলে পরদিন সকালে আটটার মধ্যে বানারজুলি ফিরল। এই চালানের সবটাই রণজিৎ চালিহার অর্ডারের মাল। এগুলো কোথায় যাবে বাপী জানে না। চালিহা বাইরে থেকে ফিরেছে কিনা তাও জানা নেই। গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা তার বাংলোতেই এলো।

গাড়ি থেকে নামার আগেই বাপীর চিন্তার জগৎ ওলট-পালট আবার।

চালিহার বাংলোর বারান্দার একটা চেয়ারে বসে আছে রেশমা। একা। উস্কোখুস্কো লালচে চুল। ঢিলেঢালা বেশবাস

বাপীকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। হাত দুটো আপনা থেকেই কোমরে উঠে এলো। বাপী থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। রেশমা চেয়ে আছে। সাপ ধরা মেয়ের দুটো চোখ সাপের মতোই জ্বলছে ধক—ধক করে।

একটু বাদে ঘুরে শ্লথ পায়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রণজিৎ চালিহা বেরিয়ে এলো। চকচকে লুঙ্গির ওপর গায়ে সিল্কের হাওয়াই শার্ট। ফোলা ফোলা লালচে মুখে জলের দাগ। এইমাত্র চোখেমুখে জল দিয়ে মুছে এসেছে বোঝা যায়। রাতে মদের মাত্রা ঠিক ছিল না বলে হয়তো বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিল।

কিন্তু ঠেলে তুলল কে? অনায়াসে অন্দরে ঢুকে রেশমা চাকরটাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে? বাপী জানে না। কিন্তু বুকের ভিতরে অস্বস্তি জমা হচ্ছে আবার।

—হ্যালো—হ্যালো! গুড মর্নিং। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, উঠে এসো।

বাপী পায়ে পায়ে বাংলোয় উঠল। অন্তরঙ্গ সম্ভাষণের কোনো জবাব না দিয়ে জিগ্যেস করল, গাড়ির মাল আপনার এখানেই তোলা হবে তো?

—হ্যাঁ, বোসো। অর্জুন!

ভিতর থেকে তার অসমীয়া কমবাইন্ড হ্যান্ড বেরিয়ে আসতে তাকে গাড়ির মালের বাক্স কটা ভিতরে তুলতে হুকুম করল। তারপর হৃষ্টবদনে বাপীর দিকে ফিরল।…চা খাবে?

—না, থ্যাংকস; আমি এক্ষুনি ফিরব।

বাপীর অবাক লাগছে, রেশমা ওর সামনে বাইরে আসতে পারছে না বলে এই লোকের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে আছে?

চালিহার মুখে হাসি ছুঁয়ে পড়ছে, চাউনিও ছুরির ফলার মতো হাসিমাখা বলল, তোমার জিম্মায় মাল ফেলে চলে এলো দেখে রেশমাকে বকছিলাম— তা ব্যাপারখানা কি হে, সব ফেলে-টেলে এত পথ হেঁটেই চলে এলো—আর ওর হাবভাবও অন্যরকম দেখছি—কি হল হঠাৎ?

বাপী ঠাণ্ডা জবাব দিল, কি হয়েছে জানি না, তবে ওকে বলে দেবেন দায়িত্ব ফেলে এভাবে চলে এলে ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হবে।

রণজিৎ চালিহা হাসছে। মাথা নেড়ে সায় দিল।—ও ভিতরেই আছে, ডাকব? পাল্টা প্রশ্ন ঠোঁটের ডগায় প্রায় এসে গেছল বাপীর। বলতে যাচ্ছিল, রেশমা এই বাংলোর ভিতরে কেন? বলল না। জবাব দিল, দরকার নেই।

মালের বাক্স কটা নামানো হয়েছে। বাপী উঠে দাঁড়াল, চলি—

গাড়িতে স্টার্ট দেবার ফাঁকে চালিহার চোখে চোখ পড়ল একবার। অন্তরঙ্গ হাসি-মুখে চালিহা হাত নেড়ে বিদায় নিল। কিন্তু এই চাউনি আর ওই হাসি দেখে বাপীর কেবল মনে হল, লোকটার যেন কোনো ক্রূর অভিলাষ সফল হয়েছে বা হতে চলেছে।

গাড়ি নিয়ে বেরুনোর পনের সেকেন্ডের মধ্যে বাপীর দু চোখ আবার হোঁচট খেল। রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রেশমার সাপ ধরার সঙ্গী হারমা। ওই বাংলোর দিকে চোখ। বাপীকেও দেখল। কলের মতো একটা হাত কপালে উঠল, বাপীর গাড়ি বেরিয়ে গেল। মুখ দেখে মনে হল, রেশমা ওই বাংলোয় সেটা ও জানে।

যার কথা ভাবছিল বাড়ির কাছাকাছি আসতে তার সঙ্গেই দেখা। আবু রব্বানী। ভেতর-জোড়া অস্বস্তি বাপীর। তাই থেকে থেকে আবুর কথা মনে হয়েছে, রেশমা ফিরে এসে ওদের কিছু বলেছে কিনা বা কতটা বলেছে জানার তাগিদ। রেশমাকে চালিহার বাংলোয় দেখার পর তাগিদটা আরো বেশি বলেই জোর করে ঘরমুখো হয়েছিল। রেশমা যদি ওদের কিছু না বলে থাকে তো বাপী কি বলবে?

উল্টো দিক থেকে আবু হনহন করে হেঁটে আসছিল। আর এত বিমনা ছিল যে বাপী মুখোমুখি ব্রেক কষতে তবে হুঁশ হল। হাসতে চেষ্টা করে বাপী বলল, ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়বে যে।… কোথায়?

—তোমার ওখানেই গেছলাম, না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম।…তুমি এই ফিরলে?

শুকনো গম্ভীর মুখ দেখে বাপীর খটকা লাগল একটু। সাত দিন বাদে দেখা, কিন্তু এই মুখে হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। বাপী জবাব দিল, একটু আগে ফিরেছি, কিছু মাল ছিল, চালিহার বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে এলাম।

সঙ্গে সঙ্গে আবু উদ্‌গ্রীব।—সেখানে রেশমাকে দেখলে?

গাড়িটা রাস্তার ধারে নিয়ে গিয়ে বাপী স্টার্ট বন্ধ করে নেমে এলো। কিছু ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কি ঘটেছে না জানা পর্যন্ত স্বস্তিও নেই। আবু কাছে এসে দাঁড়াতে বলল, দেখলাম।…রেশমা ওখানে কেন?

আরো মুখ কালো করে আবু জবাব দিল, ও কাল সন্ধ্যা থেকেই ওখানে— রাতেও ওখানেই ছিল।

শোনামাত্র বাপীর স্নায়ুগুলো সজাগ, তীক্ষ্ণ। মুখে কথা নেই।

—হঠাৎ কি হল বলো দেখি বাপীভাই, কিছু ভেবে না পেয়ে আমি তোমার কাছে ছুটেছিলাম।

—তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি?

—না। এতদিন বাদে পাহাড় থেকে ফিরে দুলারির কাছে এলো না। এমন তো কখনো হয় না। আজ সকালে হারমা এসে খবর দিল, রেশমা কাল সকালে হেঁটে পাহাড় থেকে ফিরেছে। সে নাকি ভয়ঙ্কর মূর্তি। খানিক বাদে ম্যানেজারের বাংলোয় চলে গেছে। অনেক দূর থেকে হারমা নিজের চোখে ওকে ওখানে যেতে দেখেছে। আবার সন্ধ্যার পর সেজেগুজে হারমা ওকে সেই বাংলোতেই যেতে দেখেছে। রাতে আর ঘরে ফেরেইনি।

নির্লিপ্ত মুখে বাপী জানান দিল, হারমা এখনো বাংলোর কাছাকাছি একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে।

শুনে আরো দুর্ভাবনা আবুর। বাপী শুনল, ধামন ওঝার ছেলে ও, জাতব্যবসা ছেড়ে জোয়ান ছেলে এই একটা মেয়েতে মজে আছে বলে বাপ ওকে ভিটে থেকে তাড়িয়েছে। ভাবগতিক যেমন দেখছে, এরপর ওই হারমাই না মেরে দেয় মেয়েটাকে। রাগের থেকে আবুর দুর্ভাবনা বেশি।—রেশমা হঠাৎ এরকম করছে কেন বাপীভাই?

—জানি না। দেখা হলে জিগ্যেস কোরো।…আর বোলো, আমার কোনো রাগ নেই ওর ওপর। এই জীবনটার জন্য বরাবর আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

আবু আরো হতভম্ব।—কেন বাপীভাই? কি হয়েছে?

বাপী ঠাণ্ডামুখে জানালো কি হয়েছে। বনমায়ার সেই বুনো হাতির খপ্পর থেকে রেশমা ওকে বাঁচিয়েছে।

শুনতে শুনতে আবু বার বার শিউরে উঠেছে। তারপর সোৎসাহে বলে উঠেছে, রেশমা এইরকমই বাপীভাই—ঠিক এইরকম। ঠিক অমনি করে ও দুলারির জন্যেও প্রাণ দিতে পারে। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ ও এ-রকম হয়ে গেল কেন? সব জানলে মেমসায়েব তো উল্টে ওকে আরো অনেক ইনাম দেবে।

জবাব না দিয়ে বাপী গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। বলল, পারো তো কাল সকালের দিকে একবার এসো।

আবু বিমূঢ় মুখে চেয়ে রইল তার দিকে। দেখতে দেখতে বাপীর গাড়ি অনেক দূরে।

বাংলোয় আসতে ঊর্মিলা জানালো, মায়ের শরীর আবার একটু খারাপ হয়েছে। ডাক্তার আবার দিন-কতক তাকে বিশ্রামে থাকতে বলেছে। গায়ত্রী রাই বলেছে, ও কিছুই না, ডাক্তাররা অমন বাড়িয়ে বলে। মাল চালিহার বাংলোয় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আর রেশমাও ফিরে এসেছে শুনে মহিলা নিশ্চিন্ত। মাল বা রেশমাকে আনার জন্য আর ভ্যান পাঠানোর দরকার নেই। গায়ত্রী রাইয়ের অসুস্থতার ফলে বাপী যেন একটু আড়াল পেল। দুজনেই জানে তার শরীর খারাপ শুনলে বাপী একটু বেশি উতলা আর গম্ভীর হয়ে যায়।

পরদিন সকাল সাতটার আগেই আবু এলো। ওর চকিত চাউনি দেখেই বাপীর মনে হল রেশমার এমন অদ্ভুত আচরণের কিছু হেতু ও আঁচ করতে পেরেছে। খবর জিগ্যেস করতে আবু বলল, গতকালও সমস্ত রাত রেশমা চালিহার বাংলোয় ছিল। সমস্ত দিনও ওই বাংলোতেই ছিল। চালিহা আপিসে চলে যেতে হারমা ওকে ডেকে দেখা করেছিল। বলেছিল, দুলারি ডেকেছে। ঝাঁঝ দেখিয়ে রেশমা তাকে বলে দিয়েছে, তার এখন কারো সঙ্গে দেখা করার সময় নেই।

বাপী চুপ। তার ওপর আক্রোশেই এই কাণ্ড করছে জানা কথা। আবুর পাথরের মতো মুখ। একটু থেমে মনের কথা ব্যক্ত করল।—দুলারি বলছিল রেশমা মনে মনে তোমাকে পুজো করে…বুনো হাতির কবল থেকে তোমাকে বাঁচাতে পেরে ওর বোধ হয় মাথা খারাপ হয়েছিল।…সত্যি?

বাপী ঈষৎ তপ্ত জবাব দিল, ওর মাথার খবর ও-ই জানে। দুলারিকে বলে দিও আমার মাথা ঠিক ছিল। আমি ওর কোনো ক্ষতি করিনি বা কোনদিন করব না।

আবু চলে যাবার পরেও সারাক্ষণ ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে থাকল বাপীর। লাঞ্চের পর আপিস ঘরে আবার কাজে বসল এসে। কিন্তু মন নেই। কিছু ভালো লাগে না। বেলা তিনটে নাগাদ সেজেগুজে ঊর্মিলা ঘরে ঢুকে ঝাঁঝালো অনুযোগ করল, কাল ফিরে এসে-তক হাঁড়ি মুখ করে কেবল কাজই দেখাচ্ছো—চলো না ঘুরে আসি একটু।

—কোথায়?

—প্রথমে রেশমার ওখানে। হতচ্ছাড়ি এসে অবধি আমার সঙ্গে একবার দেখা পর্যন্ত করল না। ফিক করে একটু হাসল ঊর্মিলা, তারপর ক্লাবে ডাটাবাবু কেমন আছে একটু খবর নেব।

বাপী বলতে যাচ্ছিল, রেশমাকে পেতে হলে তোমার আংকল চালিহার বাংলোয় যাও—দু দিন দু রাত সে তার ওখানেই আছে। কিন্তু বলল না, সামলে নিল। শুনলে মেয়েটা অবাক হবে, তারপর কৌতূহলে ওরই ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। গম্ভীর মুখে বাপী ফাইলে চোখ নামাল। যাবে কি যাবে না, ওটাই জবাব। ঊর্মিলা রাগ করে বেরিয়ে গেল।

বিকেল সাড়ে চারটে তখন। বিরক্ত হয়ে ফাইলগুলো ঠেলে সরাল। দশ মিনিটের জন্যেও কাজে মন বসেনি। উঠে পড়বে ভাবছে।

—বাপীভাই! বাপীভাই! উদ্‌ভ্রান্ত দিশেহারা মুখে ঘরে ঢুকল আবু রব্বানী। — বাপীভাই! শিগগির ওঠো—কি সর্বনাশ করল রেশমা দেখে যাও। কি প্রায়শ্চিত্তি করল নিজের চোখে এসে দেখো বাপীভাই।

বাপী চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু আবু ততক্ষণে বাইরে আবার। চেঁচামেচি শুনে গায়ত্রী রাই বারান্দায় এসেছে। সে-ও গেটের ওধারে আবুর উদ্‌ভ্রান্ত মূর্তি দেখেছে। বাপীকে জিগ্যেস করল, কি হয়েছে?

—রেশমার কি হয়েছে বলছে, দেখছি।

দাঁড়াবার সময় নেই, সে-ও বেরিয়ে এলো। বুকের তলায় কাঁপুনি শুরু হয়েছে। কি হতে পারে? রেশমা কি করে বসল?

বাংলোর পিছনের পথ ধরে আবু আগে আগে হনহন করে চলছে। ওর নাগাল পেতে হলে বাপীকে ছুটতে হবে। পিছন থেকে বার দুই ডেকেও ওকে থামানো গেল না।

জঙ্গলের পথ ধরল। পিছনে বাপী।…কিন্তু আবু এ-রকম করছে কেন? দাঁড়াচ্ছে না কেন? ও কি কাঁদছে? নইলে থেকে থেকে চোখে হাত উঠছে কেন?

দুলারির সেই আগের ঘরের কাছাকাছি আসতেই বাপীর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। পর পর দুটো ঘরেই এখন সাপ মজুত করা হয়। …কিন্তু এখানে এত লোক জড় হয়েছে কেন? কি করছে ওরা? সামনের ঘরের ওই বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে কি দেখছে? বাঁশের বেড়ার ওধারে দুলারি দাঁড়িয়ে। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। কিন্তু দু চোখে আগুনের হল্কা ঠিকরোচ্ছে। তার পিছনে হারমা। ওই মুখেই কোন ভাব-বিকার নেই। আর সব কারা বাপী জানে না। জঙ্গলের সাপ ধরার লোক বা মজুর-টজুর হবে, সকলেই বিমূঢ়, হতভম্ব।

বেড়া ঠেলে ভিতরে ঢুকতে আবু ওর একটা হাত ধরল। তার আগে মাটি থেকে একটা পাকা বাঁশের লাঠি কুড়িয়ে নিয়েছে। ওর দু চোখ টকটকে লাল। জলে ঝাপসা। আবু কাঁদছে।

মুখে একটিও কথা না বলে বাপীকে বন্ধ দরজার সামনে টেনে নিলে গেল। যারা সেখানে ছিল তারা সরে গেল। কেউ বা পিছু হটল। কাছাকাছি এসে বাঁশের লাঠি দিয়ে আবু বন্ধ দরজার এক পাট ঠেলে খুলল।

সঙ্গে সঙ্গে কোমর সমান ফণা উঁচিয়ে ফোঁস করে উঠল একটা বিশাল শঙ্খচুড় সাপ। বাপী সভয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। আর তার পরেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তার গায়ের রক্ত জল। রেশমা মেঝের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে। সর্বাঙ্গ নীল। ওই বিশাল সাপ তার সর্ব অঙ্গ পাকেপাকে জড়িয়ে বুকের কাছে কুলোর মত ফণা উঁচিয়ে আছে।

দরজা দুটো বন্ধ করে আবু একজনকে ঘরের পিছনে গিয়ে ঘুলঘুলিটা টেনে খুলে দিতে বলল। বন্ধ দরজার এদিকে লাঠি-সোঁটার ঘা পড়লে সাপটা ঘুলঘুলি দিয়ে পালাবার পথ পাবে। হারমা হঠাৎ আবুর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিতে গেল। সাপটাকে পালাতে দেবে না। ঘুলঘুলির দিকে গিয়ে ওটাকে মারবে। আবু বাধা দিয়েছে।——মারবি কেন, ওটার কি দোষ, রেশমা যা চেয়েছে তাই হয়েছে। তাছাড়া কি হয়েছে মেয়েটার দেখতে হবে তো, তোর বাপ যদি কিছু করতে পারে।

যে-সাপ কাটে তাকে চট করে মারতে নেই এ-রকম একটা সংস্কার আছে। সে-রকম ওঝা নাকি ঝাড়ফুঁক করে বিষ তোলার জন্য সেই সাপকে আবার টেনে আনতে পারে। কিন্তু এ আশ্বাস যে শুধু হারমাকে আটকানোর জন্য তাও বোধ হয় সকলেই জানে।

ঘোলাটে চোখে বাপীর দিকে ফিরল আবু। বলল, ওপর-অলার খেলা দেখ বাপীভাই, পাহাড়ে যাবার দিন-কয়েক আগে এই বিরাট শঙ্খচূড়টাকে রেশমাই ধরেছিল, তারপর খুশি মুখে আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল, এটার ডবল টাকা দিতে হবে তোমার বাপীভাইকে বলে দিও।

বাপী ভোলেনি। সেদিন সে-ও জঙ্গলে ছিল। ওই সাপ দেখার জন্য রেশমা তাকে ডাকাডাকি করেছিল। বাপী শুনেও শোনেনি। চলে গেছল। রেশমা তারপর ঊর্মিলাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, এত বড় ওপরঅলা হয়েও বাপীভাই ওকে জ্যান্ত সাপের মতই ভয় করে।

দুটো নরম হাত একটা বাহু আঁকড়ে ধরতে বাপী ঘুরে তাকালো। ঊর্মিলা। ভয়ার্ত লালচে মুখ। খবর শুনে ছুটেই এসেছে। হাঁপাচ্ছে। সাহস করে কিছু জিগ্যেস করতে পারছে না, শুধু জানতে চায় সত্যি সব শেষ কি না। কি হল! কেন হল!

ওর হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে বাপী টের পাচ্ছে। কিন্তু বাপী কি বলবে? কি সান্ত্বনা দেবে? পাহাড়ের সেই পাগলা বুনো হাতি নাগালের মধ্যে পেলে এই দেহ ওটার পায়ের তলায় পড়ে ভেঙে-দুমড়ে তালগোল পাকিয়ে যেত। কিন্তু সে যন্ত্রণা কি এর থেকে বেশি?

বন্ধ দরজার এদিকে বিশ-পঁচিশ মিনিট লাঠি ঠোকাঠুকির পর আবার দরজা ফাঁক করে দেখা হল। সাপটা পালিয়ে গেছে।

রেশমা মাটিতে শুয়ে।

চারদিক দেখে প্রথমে ঘরে ঢুকল আবু রব্বানী। তার পিছনে ঊর্মিলার সঙ্গে বাপী। ঊর্মিলা তার বাহু দু হাতে আরও শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ওদের পিছনে আরও অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

রেশমার বিবর্ণ দেহ নিষ্প্রাণ। নিস্পন্দ।

তার বুকে মুখে কপালে মাথায় কতকগুলো ছোবল মেরেছে কে গুনবে? এর যে-কোন একটাতে মৃত্যু অবধারিত। তবু ওই কাল সাপ বোধ হয় এই নারীদেহে তার সমস্ত বিষ ঢেলে আক্রোশ মিটিয়েছে।

ঊর্মিলা দু’হাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বাপীর পায়ের নিচে মাটি ভয়ানক দুলছে। সে-ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ঊর্মিলাকে ধরে নিয়ে বাইরে এলো। বাইরে এখনও বেশ আলো। মাথার ওপর বসন্তের নীল আকাশ। কিন্তু বাপী চোখে সব-কিছু ঝাপসা দেখছে। মানুষগুলোর মুখও

কেন এমন হল? কেন কেন কেন? বাপীর জন্য? বাপীর দোষে? তাই যদি হয় তো ওই নীল আকাশ বজ্র হয়ে ওর মাথায় নেমে আসতে পারে না?

বাঁশের বেড়ার সামনে দুলারি তেমনি তামাটে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। হারমা নেই। সে বোধ হয় তার বাপ ধামন ওঝাকে ধরে আনার জন্য ছুটেছে। সব যে শেষ এ বোধ হয় এখনও শুধু ও-ই বিশ্বাস করছে না। আবু রব্বানী তাকে আশার কথা শুনিয়েছে।

ঊর্মিলাকে ধরে বাপী বেরিয়ে আসছিল। এই মুহূর্তে কোনো নিঃসীম অন্ধকার গহ্বরে সে হারিয়ে যেতে চায়। মুছে যেতে চায়। কিন্তু ধমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। দুলারির ধকধকে দুই চোখ ওর মুখের ওপর

বলল, যেও না। কথা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *