সোনার হরিণ নেই – ২৯

উনত্রিশ

রাত দশটার কাছাকাছি। একটা লোভ টেলিফোনটার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সুদীপ নন্দী বা তার মা এখনো ঘুমিয়ে পড়েনি নিশ্চয়। অসময়ের ডাকে তারা সাড়াও দেবে, খুশিও হবে। অনিশ্চয়তার গহ্বরে সহজে কেউ ঝাঁপ দিতে চায় না। নাগালের মধ্যে নিশ্চিত কোনো আশ্বাস পেলে তবে জোর বাড়ে। রাতের এই টেলিফোন সেই আশ্বাসের মতো হতে পারে। আর কিছু না বলে শুধু অন্তরঙ্গ কুশল খবর নিলেও হাতের কাছে তারা নাগালের মানুষ দেখতে পাবে। লোভের হাতছানি বাপী জোর করেই বাতিল করে দিল। মত্ত অবস্থায় ঘরে ফিরে অসিত চ্যাটার্জি মুখ সেলাই করে বসে থাকবে না। এই রাতের ঘোরে অন্তত বাপীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেই। মিষ্টি কি ভাববে বা কি বুঝবে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সেখান থেকেই তার কলকাতায় অবস্থানের খবরটা মা আর দাদার কানে পৌঁছুবে আশা করা যায়। মিষ্টির মন তার মা বা দাদার মতো এখনো খুব অস্থির মনে হয় না। কিন্তু যত স্থিরই হোক, অসিত চ্যাটার্জি ঘরে ফিরলে তাতে ঢিল একটা পড়বেই। সেই বৃত্ত আপনা থেকে কতটা ছড়ায় দেখা যাক।

এর থেকেও বড় লোভ সংবরণ করতে হল পরদিন। এক পয়সার যুদ্ধের ফয়সলা এখনো হয়নি। ছোটখাটো গণ্ডগোল রোজই চলছে। তবু লোকে কাজকর্ম একেবারে সিকেয় তুলে বসে নেই। নিজের দখলে গাড়ি থাকায় বাপীরও নড়াচড়ার সুবিধে হয়েছে। বিপাকে পড়ে কোথাও আটকে যাবার ভয় নেই। সকালে জিত্ মালহোত্রাকে সঙ্গে নিয়ে উল্টোডাঙার গুদাম ঠিক করতে গেছিল। ফেরার সময় সেন্ট্রাল এভিনিউর পথ ধরল। রাস্তার ধারে এক জায়গায় ছোট একটা চকচকে বাড়ির দোতলায় পরিচিত নামের এয়ার অফিসের সাইনবোর্ড চোখে পড়া মাত্র বাপীর ডান পা আপনা থেকেই ব্রেকের ওপর। ঘড়িতে সাড়ে বারোটা।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা রাস্তাটা পার হলে উল্টোদিকে অফিসের দরজা। ঘাড় বেঁকিয়ে বাপী দেখছে। পাশ থেকে মালহোত্রা লক্ষ্য করছে সে-খেয়ালও নেই। ওখানে একতলা বা দোতলার কোনো একটা ঘরে বসে কাজ করছে জুনিয়র অফিসার মালবিকা চ্যাটার্জি! অসিত চ্যাটার্জির মতে যে অফিসারগুলো ছোঁকছোঁক করে ওকে ঘিরে থাকে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াই কাজের অর্ধেক। জানান না দিয়ে বাপী যদি সোজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, মুখখানা দেখতে কেমন হবে? মিষ্টির সঙ্গে তখন এই মালবিকা চ্যাটার্জির একটুও যুঝতে হবে কি হবে না? এক নজর তাকিয়েই বাপী সেটুকু বুঝতে পারবে।

—কোন টিকিট কাটার দরকার থাকলে আমাকে বলে দিন সার, আমি কেটে রাখব।

জিত্‌ মালহোত্রা। একটা অদম্য লোভের তাড়না দমন করে বাপী আবার, গাড়ি চালিয়ে দিল। জবাবে সামান্য মাথা নাড়ল কি নাড়ল না।

হোটেলের মুখে জিত্ নেমে গেল। আবার সে তিনটেয় আসবে। মনিবের সঙ্গে আজ বড়বাজারে বড় কয়েকটা পার্টির সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের প্রোগ্রাম।

স্নান সেরেই বেরিয়েছিল। হুকুমমতো হোটেলের বয় ঘরে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। খাওয়া সবে শুরু করেছিল, টেলিফোন বেজে উঠল। ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকালো বাপী। কে হতে পারে? নিশীথ?…অসিত চ্যাটার্জিও হতে পারে। পরেরজন হলে ততো অবাঞ্ছিত নয়। গতরাতের খবর বা আজকের সকালের খবর কিছু পাওয়া যেতে পারে। বোতলে যে অর্ধেক এখনো পড়ে আছে তার টানে আজও আসতে চাইবে হয়তো। ডাকবে না হেঁটে দেবে?

…হ্যালো?

—বাপী নাকি?

ও-ধারের গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হবার চেষ্টায় একটা উদ্‌গত অনুভূতির গলা টিপতে হল। ধৈর্যের ফল ধরেছে। সবুরে মেওয়া ফলেছে।

—হ্যাঁ, দীপুদার গলা মনে হচ্ছে?

—ঠিক ধরেছে। অন্তরঙ্গ হাসি। তারপর অন্তরঙ্গ অনুযোগ।—দেড় মাসের ওপর কলকাতায় আছ শুনলাম অথচ একটা খবর পর্যন্ত নাওনি।…শুনে মা-ও দুঃখ করছিলেন।

বাপীর গলা চিনি-গলা।—কাজের চাপে নাওয়া-খাওয়ার সময় পাচ্ছিলাম না দীপুদা, তার ওপর যে গণ্ডগোল তোমাদের রাজ্যে, সব গুটিয়ে আবার না ফিরেই যেতে হয়। যখন-তখন বেরুনোর জো আছে? মাসীমাকে বোলো দেখা হলেই আমি তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব। তুমি কোত্থেকে?

—কোর্ট থেকে। তোমার সঙ্গে একটু দেখা হওয়ার দরকার ছিল। বিকেলে হোটেলে থাকবে?

—বিকেলে কখন?

—এই ধরো সাড়ে চারটে পাঁচটা?

—পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা করো, আমার ওদিকেই একটু কাজ আছে, পাঁচটা দশ-পনেরর মধ্যে কোর্ট থেকে আমি ফেরার সময় তোমাকে তুলে নেব। বিকেলের জলযোগের ব্যবস্থা ভালই হবে কথা দিচ্ছি।

ওদিক থেকে সুদীপ নন্দীর জোরালো হাসি। পরে একটু সমঝে দেবারও চেষ্টা। তোমার গতকালের দরাজ জলযোগের ব্যবস্থার জন্য মিষ্টি কিন্তু রেগে আছে।

বাপীরও হাসির কামাই নেই।—সেই ছেলেবেলায় মিষ্টির রাগও আমার খুব মিষ্টি লাগত দীপুদা। কিন্তু গতকাল আমার সত্যি কোনো দোষ ছিল না…

কথার মাঝেই বাধা পড়ল।—ঠিক আছে ঠিক আছে, এই অপদার্থটাকে আর না চেনে কে, যা বোঝার মিষ্টিও ঠিকই বুঝেছে। পাঁচটা থেকেই আমি কোর্টের ইস্ট গেটে থাকব’খন, তুমি এসো।

ফোন রেখে বাপী আবার খেতে বসল। কি খাচ্ছে, সেদিকে আর চোখ মন কিছুই নেই। হাসছে নিঃশব্দে। মিষ্টি রেগে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। বাপীর ঘর থেকে তার ঘরের লোক মাতাল হয়ে ফিরেছে সেটা বরদাস্ত করা সহজ নয়। নেশার ঘোরে এই লোক বেফাঁস কি বলেছে না বলেছে ভেবেও তার রাগ হতে পারে। ঘরের মানুষ অমানুষ হলে মেয়েদের আসল পুঁজি ঝাঁঝরা। মিষ্টি সেটা বাপীর কাছেই সব থেকে বেশি গোপন করতে চাইবে। তার রাগ হবে না তো কি? কিন্তু তার মা আর দাদার ভিন্ন লক্ষ্য, ভিন্ন চিন্তা। গেলবারেও বাপীর লক্ষ্য বা চিন্তার আভাস পেয়েছিল। ওকে দেখামাত্র অসিত চ্যাটার্জির সন্দেহ বা তিরিক্ষি মেজাজ অহেতুক নয়। মিষ্টিকে সে এখনো অত ভয় করে বলে মনে হয় না। কিন্তু তার মা বা দাদা যে তাকে ছেঁটে দেবার মতলবে নির্ভরযোগ্য নাগালের মানুষ খুঁজছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মালহোত্রার সঙ্গে কথা বলে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী বাপী পার্টি বাছাই করে নিল। হাতে যেটুকু সময়, সকলের সঙ্গে আজ দেখা করা সম্ভব নয়। ঠিক পাঁচটা দশে কোর্টের পুব গেটে গাড়িটা এসে দাঁড়াল। দীপুদা অপেক্ষা করছিল। ক্রিম—রঙের ঝকঝকে গাড়ি দেখে তারও দু’চোখ অসিত চ্যাটার্জির মতোই গোল হল।

রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে আসছে।

বাপীর পাশের আসনে জিত্‌ মালহোত্রা। তাকে বলাই ছিল, বাপীর চোখের ইশারায় সে শশব্যস্ত দরজা খুলে নামল। মানী অতিথির উদ্দেশে বিনীত তৎপর অভিবাদন জানিয়ে তাকে নিজের আসন ছেড়ে দিল। সে মালিকের পাশে বসতে দরজা খুলে ও পিছনের সীটে বসল।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাপী হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ নাকি?

—না, মিনিট পাঁচেক। গাড়ির ভেতরটাতেও চোখ বুলিয়ে নিল। জিগ্যেস করল, এ গাড়ি এখানে কিনলে, না ওখান থেকে নিয়ে এসেছ?

—আনা নেওয়ার অনেক হাঙ্গামা। তাছাড়া বানারজুলিতে থাকলে সেখানে গাড়ি ছাড়া আরো অচল। যাতায়াত তো করতেই হবে, এখানেও কিনে নিলাম আর একটা।

গাড়ি আরো একটা আছে বুঝিয়ে দেওয়া গেল। জিপও একটা আছে ফাঁক পেলে তাও জানিয়ে দিত। ব্যারিস্টার সাহেবের যাতায়াত এখনো ট্রামে বা বাসে। স্কুলে পড়তে জঙ্গল সাহেবের ছেলে জঙ্গল-আপিসের জিপে আসত যেত। বাপী পিসিমার তৈরি আমসত্ব, পাকা কামরাঙা, বন-মোরগ ঘুষ দিয়ে সেই জিপে তার সঙ্গে যাতায়াতের আরজি পেশ করতে মনে লেগেছিল। প্রথমে ধমকে উঠে পরে সদয় হয়ে বলেছিল, বাড়ি থেকে এক মাইল রাস্তা হেঁটে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে আর স্কুলের আধ-মাইল আগে নেমে যেতে। কেরানীর ছেলের সঙ্গে এক জিপে কেউ তাকে দেখে ফেললে মান খোয়া যাবে। আর আসার সময় হেঁটেই আসতে হবে কারণ উঁচু ক্লাসের ছেলেদের সামনে তাকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয়। রাগে আর অপমানে বাপী এই জিপের দিকে আর ফিরেও তাকাতে চায়নি। বাপী ভোলেনি। কিন্তু দীপুদার কি মনে আছে?

সুদীপ নন্দী ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের স্মার্ট লোকটাকে দেখে নিল একবার।— ইনি?

—ইনি আমার সেক্রেটারি মিস্টার জিত্ মালহোত্রা।

মালহোত্রা আর একবার কপালে হাত তুলে সৌজন্য জানালো। দীপুদাও। বানারজুলির সেই কথায় কথায় গাঁট্টা-খাওয়া ছেলেটার আজ এই বরাত দেখে বুক একটুও চড়চড় না করে পারে কি? গাড়ি চালানোর ফাঁকে খোশ-মেজাজে বাপী আড়চোখে মুখখানা দেখার চেষ্টা করছে।

—কলকাতায় একটা বড় সেন্টার খুলে ফেললাম দীপুদা। জিত্, তুমি কি করলে না করলে দীপুদাকে একটু দেখাও না। আমাকে খুব কাজ দেখাচ্ছ, কিন্তু এঁর চোখ সহজে ফাঁকি দিতে পারবে না—নামজাদা ব্যারিস্টার।

দীপুদার বিব্রত মুখ! পিছন থেকে জিত্ সাগ্রহে আর্ট পেপারে ছাপা চকচকে প্যামফ্লেট তার হাতে দিল। সেটা ওলটাবার আগে ফার্মের একচ্ছত্র মালিকের নাম চোখে পড়বেই। ভারতের নানা জায়গায় শাখা-প্রশাখার বিস্তারও নজর এড়াবে না। জিত্ এরপর ফার্মের ক্যালেন্ডার আর ভেলভেট কভারে মোড়া ডায়েরিও তাকে উপহার দিয়ে ফেলল। ওতেও বর্তমান মালিকের নাম অনুপস্থিত নয়।

খুশিতে মুখখানা ভরাট করার চেষ্টা সুদীপ নন্দীর।—চমৎকার! আপাতত তুমি তাহলে কলকাতাতেই থাকছ?

—ইচ্ছে তাই, তবে ফাঁকে ফাঁকে বাইরে ছোটাছুটি তো আছেই। মাসে এক আধবার বানারজুলিও যেতে হবে। হাসল।—তুমি বিলেত-ফেরত সাহেব মানুষ এখন, বানারজুলির জঙ্গল বোধ হয় ভুলেই গেছ।

দীপুদা স্বীকার করল না। উল্টে রং চড়ালো।—বানারজুলির জঙ্গলের সেইসব দিনগুলি কি ভোলবার। তোমার সেই বনমোরগের স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।

বিনিময়ে বাপী কি পেয়েছে তাও মনে আছে কিনা জিগ্যেস করার লোভ সামলাতেই হল। হোটেলে পৌঁছনোর ফাঁকে ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার খবরটাও জানিয়ে দিল। শিগগীরই উঠে যাবে, মাসিমাকে এনে তখন একটু দেখেশুনে যাবার আবেদনও জানিয়ে রাখল। সুদীপ নন্দীও সানন্দে প্রতিশ্রুতি দিল।

জিত্‌ মালহোত্রাকে বিদায় করে বাপী গাড়িটা তমকা-পরা দারোয়ানের জিম্মায় ছেড়ে দিল। লোক ডেকে পিছনের গ্যারাজে গাড়ি তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা সে-ই করবে। দীপুদাকে নিয়ে নিজের সুইটে এলো। ফোনে দুজনের মতো খাবারের হুকুম দিয়ে সামনে এসে নিশ্চিন্ত হয়ে বসল।—এবারে বলো কি খবর।

—না, খবর তেমন কিছু না, তুমি কলকাতায় আছ আর এতদিনের মধ্যে দেখা হল না, মা তাই বার বার বলছিল। মিষ্টির সঙ্গেও তোমার দেখা হয়নি শুনলাম।

—না। কৈফিয়ৎ দাখিল করার মুখ বাপীর।—এয়ারপোর্টের ইনফরমেশন কাউন্টারে ওকে না দেখে ভাবলাম দিল্লির চাকরিটা হয়ে গেছে, ইন্টারভিউ দিতে গেছল জানতাম তো।

ব্যারিস্টার সুদীপ নন্দীর ক্ষোভপ্রকাশের ধরন আলাদা। মুখ মচকে বলল, সে—চাকরিও ও-ই পেয়েছিল, আর সেটা এর থেকে ঢের ভালো চাকরিই ছিল। নিতে পারল না। দ্যাট স্কাউনড্রেল ওয়ন্—আমি আর মা বার বার করে বলেছিলাম, কি করবে ও, চলে যা। গেল না, এখন পস্তাচ্ছে।

শুনে ভেতরটা চিনচিন করছে বাপীর। এখন পস্তাচ্ছে শুনেও তেমন খুশি হতে পারল না। বড় চাকরি পেয়েও নিতে না পারার একটাই অর্থ। আর একজনের জোর খেটেছে। নিছক অত্যাচারের জোর হলে মিষ্টি পরোয়া করত কি…?

একটু চুপ করে থেকে দীপুদা বলল, এত বড় ব্যবসার তুমি একলা মালিক এখন মা তাও জানে দেখলাম। ফোনে মিষ্টি হয়তো বলেছে। আচ্ছা, এর আসল মালিক তো একজন মহিলা শুনেছি, তাঁর কি হল?

—নেই। সাত-আট মাস হল মারা গেছেন

—তাঁর ছেলেপুলে নেই?

—একটি মেয়ে।

দীপুদা নড়েচড়ে বসল।…সমস্ত ব্যবসাটাই তুমি পেয়ে গেলে, তার কি হল? বাপী থমকালো একটু। ফোনে দীপুদা বলেছিল, তার সঙ্গে দেখা হওয়া একটু দরকার। দরকারটা কি তার আভাস একটু একটু পাচ্ছে মনে হয়। সত্যি যদি হয় বাপী নিজেই তাহলে নিজের মগজের তারিফ করবে না তো কি? হেসেই জবাব দিল, তার বিয়ে হয়ে গেল বলেই তো আমি সব পেলাম।

ব্যারিস্টার সাহেবের সপ্রতিভ ভাবটুকু কেউ বুঝি সুইচ টিপে নিভিয়ে দিল। ঢোঁক গিলে জিগ্যেস করল, ও…তোমার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে তাহলে?

—আমার সঙ্গে! ভিতরে উৎফুল্ল, বাইরে আকাশ থেকে পড়া মুখ।—কি যে বলো ঠিক নেই। তার বিয়ে হয়েছে এক বিলেত-ফেরত পাঞ্জাবী এনজিনিয়ারের সঙ্গে—এখন কলকাতায় আছে ওরা, এ-মাসের শেষেই আমেরিকা চলে যাবে।

ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ সুদীপ নন্দীর।—তাহলে তুমি সবটা পেলে কি করে? বাপী হাসছে। দীপুদা আর তার মাকে অন্তত নিশ্চিত করার তাগিদ এখন। বলল, সেই মহিলা আমাকে খুব ভালবাসতেন, নিজের ছেলেকেও কেউ এত ভালবাসে কিনা জানি না। ব্যবসা ছাড়াও তার অগাধ টাকা আর সোনা ছিল। ব্যবসার সঙ্গে সে-সবও আমাকে আর ঊর্মিলাকে সমান দু-ভাগ করে দিয়ে গেছেন। ওর বা স্বামীর আর ব্যবসায় ইনটারেস্ট নেই—তাই ওদের অংশ আমিই কিনে নিয়েছি! কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করেছি তোমাদের এ ধারণা হল কি করে দীপুদা?

বিব্রত দেখালেও মানুষটার ভিতর থেকে একটা গুরুভার নেমে গেছে। হেসেই জবাব দিল, আর বলো কেন, রাগ হলে মেয়েদের আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। অসিতকে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখেই ওর মেজাজ বিগড়ে গেছিল। তোমার কাছে ছিল আর তুমি এখন কত বড় হয়েছ তাও বোধ হয় তার মুখেই শুনেছ। আর, মা যা বলল, তোমার মালিকের মেয়ের গল্প গেলবারে তুমিই হয়তো মিষ্টির কাছে করেছিল। তাই গোটা ব্যবসাটা এখন তোমার শুনেই ও ধরে নিয়েছে মালিকের সেই মেয়েকে বিয়ে করেই সব পেয়েছ। আসলে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরে ওই অপদার্থটা আরো কি বলেছে না বলেছে ঠিক নেই। রাগের মাথায় রাত এগারোটায় মিষ্টি পাশের ওষুধের দোকান থেকে মাকে ফোন করেছে। ওর ধারণা, মালিকের সেই মেয়েকে বিয়ে করেই এখন মস্তলোক হয়েছ তুমি আর তার হ্যাজব্যান্ডকে দেদার মদ খাইয়ে মজা দেখেছ। বোনটার দোষ নেই বুঝলে, একেবারে তিক্তবিরক্ত হয়ে গেল।

শিরায় শিরায় বাপীরও উষ্ণ তাপ ছড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত কি আর হয়েছে, কতটুকু হয়েছে। তার আগে অনেক এগনোর ইচ্ছে, অনেক দেখার ইচ্ছে। ওই মেয়ে যেন সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছড়ি উঁচিয়েছে।

কিন্তু সুদীপ নন্দী নিশ্চিন্ত এখন, খুশিও। এই রাতের মধ্যে তার মা-ও নিশ্চিন্ত হবে। খুশি হবে। তাদের ভিন্ন স্বার্থ। ভিন্ন প্ল্যান। নিজের মুখ কৌতুকের মুখোশে ঢাকল বাপী। হাসতে লাগল।—তোমাদের কাছে আমিই কালপ্রিট তাহলে।

—কি যে বলো, আমরা তোমাকে চিনি না! মিষ্টিও যা বলেছে রাগের মাথায়ই বলেছে, নইলে তার চিজটিকেও সে খুব ভালোই জানে।

বয় খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। বাপী উঠে দেয়ালের দেরাজ থেকে হুইস্কির বোতল এনে টেবিলে রাখল। আধাআধি অবশিষ্ট আছে এখনো। কিন্তু ওটা দেখামাত্র খুশি হবার বদলে দীপুদা তেতেই উঠল একটু।—তুমি তো খাও না, ওই রাসকেল একলাই এতটা সাবড়ে দিয়ে গেছে নাকি?

বাপীই যেন অপরাধী—কি করব বলো, খেতে থাকলে তো আর কেড়ে রাখতে পারি না। তাও তো শেষ পর্যন্ত জোর করেই তুলে দিলাম।

—ও তোমার কাঁধে চাপল কি করে, তোমাকে পেল কোথায়?

—গাড়িতে আসছিলাম, রাস্তায় দেখা। কোন্ রাস্তা সেটা বলল না। দীপুদার মুখ চলছে। গেলাসও। প্রথম গেলাস একটু দ্রুতই শেষ। ফলে আরো একটু অন্তরঙ্গ। বাপী আবার গেলাস ভরে দিতে বলল, কিছু না মনে করো তো একটা কথা বলি, ওই ওকে তুমি অত আসকারা দিও না।

—অসিতবাবুকে? এলে তাড়িয়ে দেব?

—তা বলছি না, অন্তত বুঝিয়ে দেবে তুমি খুব সহজ লোক নও আর ওর কাছের লোক নও।

খেতে খেতে নির্লিপ্ত মুখে বাপী বলল, কিন্তু তার তো নিজের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা—রেজিস্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট— এখন বড় চাকরিও পেয়েছে…

—স-সবও গেয়ে গেল না? রাগত মুখে খাওয়া থামিয়ে গেলাসে বড় চুমুক দিল একটা। ন্যাপকিনে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কপালজোরে বড় চাকরি তো পেয়েছে, কিন্তু তার কটা পয়সা ঘরে আনে সে-কথা বলেছে? সব রেসে ঢেলে দিয়ে আসে, নয়তো জুয়ায়—বুঝলে? মিষ্টির টাকা চুরি করেও জুয়া খেলে এসেছে—উনি আবার বড় চাকরি করেন!

আলতো করে বাপী জানান দিল, কাল নিজেই সেকথা বলেছিল। তোমাদের সঙ্গে নাকি এ-নিয়ে এক হাত হয়েও গেছে।

না হয়ে উপায় কি বলো। আমরা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, রেস জুয়া মদ এসব না ছাড়লে আমাদের তাকে ছাড়তে হবে—মিষ্টিকেও।

যা জানানো হয়েছে মা আর দাদাটি তাই হবে আশা করছে বলেই যে আজ এত খাতির কদর বাপী তরফদারের তাও দিনের মতোই স্পষ্ট। অপ্রিয় প্রসঙ্গ বদলে বাপী আপনার জনের মতো মাসীমার স্বাস্থ্যের খবর নিল। মেয়ের ভাবনায় তার রাতের ঘুম গেছে শুনে বাপীর মুখেও উদ্বেগের ছায়া। বউদি অর্থাৎ দীপুদার স্ত্রী আর ছেলের খবরও নিতে ভুলল না। বউদিকে আগের বারে রোগাই দেখে গেছিল, এখন তেমনি আছে শুনল। স্বাস্থ্যটা তেমন ভালো যাচ্ছে না, অল্প-স্বল্প রোগ লেগেই আছে।

—ছেলে আর বউদিকে নিয়ে মাসখানেকের জন্য আমার বানারজুলির বাংলোয় থেকে এসো, স্বাস্থ্য চেহারা সব ফিরে যাবে। সেখানে সব ব্যবস্থা আছে, কুটোটি নাড়তে হবে না—খাবে—দাবে আর বেড়িয়ে বেড়াবে।

যাবে কি যাবে না সেটা স্বতন্ত্র কথা, এ-রকম আপ্যায়ন শুনলে সকলেই খুশি হয়। দীপুদা খুবই খুশি।

ততক্ষণে খাওয়া শেষ। দীপুদার দ্বিতীয় গেলাসও। বাপী আবার বোতল তুলে নিতে সে আধো-আধো বাধা দিল, আবার কেন…

…ওয়ান ফর দি রোড। হুইস্কি ঢেলে বাপী নিজেই সোডাও মিশিয়ে দিল। এই গেলাসও আধাআধি শেষ হতে বাপী আলতো করে আবার মোক্ষম জায়গাটিতে ঘা বসালো। বলল, অসিতবাবুরও তোমাদের ওপর বেজায় রাগ দেখলাম কাল—

ওই জিনিসটা পেটে পড়লে আর একটু জমে উঠলে গলতেও সময় লাগে না, জ্বলতেও না। দীপুদাও দপ করে ঝলসে উঠল। —হবে না! গুণের শেষ আছে ওর? যা-তা বলে গেছে বুঝি?

বলছিল, মাসিমাই তার মেয়ের কান বিষিয়ে দিচ্ছে, আর বাড়িটার লোভে তুমিও মাসিমাকে তাতিয়ে রাখছ।

—এসব কথাও বলেছে! বাড়িটা মানে আমাদের ওই বাড়িটা?

হ্যাঁ, তুমি নাকি বলেছ মেয়েকে ভাগ দিলে বাড়ি আর রক্ষা করা যাবে না, সে বেচে খাবে—এ-সব বলে মাসিমাকে বিগড়ে দিয়ে ওটা তুমি একলাই হাতড়াবার মতলবে আছ।

—স্কাউনড্রেল! মদ গিলেও মুখ এতক্ষণ এত লাল হয়নি দীপুদার।—একলা হাতাতে হলে মিষ্টিকে ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেঁটে দেওয়ার জন্য এত ঝোলাঝুলি করব কেন? ওই স্কাউনড্রেলের খপ্পরে গিয়ে পড়লে যা বলেছি তাই হবে না তো কি? জুয়ার নেশায় যে স্ত্রীর গহনা আর টাকা চুরি করতে পারে সে না পারে কি?

টাকা চুরির সঙ্গে এবারে গয়না চুরিটাও যোগ হল। কান পেতে শোনার মতোই। চার মাস আগে ভালো একটা হার খোয়া গেছে মিষ্টির। টাকা চুরি ধরা পড়ার পর মা আর তার অন্তত ধারণা ওই শয়তানই সেটা খেয়েছে। দিনে দিনে আরো অনেক গুণ ধরা পড়ছে ছেলের। মিষ্টিকে ইদানীং সন্দেহ করে। দিল্লিতে অমন ভালো চাকরিটা পাওয়ার পিছনে খারাপ কোনো খাতিরের হাত আছে ধরে নিয়ে এমন যাচ্ছেতাই ব্যাপার করল যে মিষ্টির যাওয়াই হল না শেষ পর্যন্ত। তার এই প্রমোশনটাও একই সন্দেহের চোখে দেখে। যখন তখন আপিসে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্প করতে দেখলে ঘরে এসে বিচ্ছিরি রকমের খোঁচা দিয়ে কথা বলে আর যাচ্ছেতাই রসিকতা করে।

জ্বলজ্বলে চাউনি দীপুদার। ঘরের কেচ্ছার কথা কত আর বলব তোমাকে? আর বেশি শোনার তাগিদ নেই বাপীর। গতকাল আর আজকের মধ্যে তুরুপের অনেকগুলো তাস হাতে পেয়ে গেছে। ধীরেসুস্থে কি ভাবে খেলবে এখন সেই বিবেচনা সেই হিসেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *