পাঁচ
দুপুরেও আকাশ সেদিন মেঘলা ছিল। পিছনের দিকে তাকালে বুক পর্যন্ত কালচে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের সারির মাথাগুলো শুধু দেখা যাচ্ছিল।
বাপী বৃষ্টি ভালবাসে না। কিন্তু মেঘলা আকাশ ভারী পছন্দ। আর ওই মেঘে পেট-ঠাসা হিমালয়ও। ঝমঝম বৃষ্টি এসব জায়গায় লেগেই আছে। তখন ঘরে থাকলে বেরুনো দায়। পিসী চোখে আগলায়। কাঠের ঘরে বসে তখন জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখলেও পিসী থেকে থেকে এসে শাসিয়ে যায়, জল মাথায় করে কেউ এখন বাইরে বেরুলে আর রক্ষা নেই—বাবাকে বলে ঠ্যাং ভাঙার ব্যবস্থা না করে ছাড়বে না।
বাপী পিসীর তম্বির পরোয়া করে না। বারো বছর বয়সে এটুকু অন্তত বুঝেছে পিসী আর যা-ই করুক, বাবার কাছে ওর নামে নালিশ করবে না। আসলে জলে বেরুতে বাপীর নিজেরই ভালো লাগে না। জংলা রাস্তাগুলো সব পিছল আর প্যাচপ্যাচে হয়ে যায়। গাছে পাখি কলকল করে না। বাঁদরগুলো সব মৌনী হয়ে বসে থাকে। খরগোশ আর বনমোরগগুলোর টিকির দেখা মেলে না। যদি বা দুই একটা চোখে পড়ে, পিছল রাস্তায় তাড়া করা যায় না।
তার থেকে মেঘলা আকাশ ভালো। বানারজুলির পেল্লায় জঙ্গলখানার তখন আর এক চেহারা। শাল শিশু অর্জুন জারুল দেবদারু ইউক্যালিপটাস—এই-সব বড় বড় গাছগুলো তখন বেজায় গম্ভীর। আর তাই দেখে ছোট গাছগুলোও যেন ঘাবড়ে গিয়ে চুপ মেরে থাকে। আকাশে সূয্যি ঠাকুর যতই জ্বলুক, এমনিতেই জঙ্গলের মধ্যে ছায়া-ছায়া ভাব। উনি মেঘে ঢাকা পড়লেই সেই ছায়া-ভাবটা ঘন থমথমে হয়ে ওঠে। আর তখনই জঙ্গলটাকে বাপীর সব থেকে ভালো লাগে। ওটা তখন অদৃশ্য একটা হাত বাড়িয়ে ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসতে চায়। এমন কি পাঁচ মাইল দূরের স্কুলের ক্লাসে বসেও বাইরে মেঘলা আকাশ দেখলে ভিতরটা পাখা মেলে বানারজুলির ওই জঙ্গলে এসে সেঁধোয়, তারপর ইচ্ছাসুখে হুটোপুটি করতে থাকে। এক-একদিন তো এমন হয়, স্থান-কাল মনে থাকে না। মাস্টারমশাই উঠে এসে কান টেনে ধরে। অন্য ছেলেরা হাসাহাসি করে।
আর, তখন ঘরে থাকলে তো কথাই নেই। ছুটির দিনের দুপুর হলে সোনায় সোহাগা। পিসীর চোখে ধুলো দিয়ে ছোট্ট মজবুত লাঠিখানা হাতে করে ছুটে বেরুবেই। ওই ছোট্ট জুতসই লাঠিটা ওকে দিয়েছিল আবু রব্বানী। তেল খাইয়ে—খাইয়ে ওই লাঠি বাপী এখন প্রাণের জিনিস করে তুলেছে। জঙ্গলে ঢোকার আগে আরো কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে নিতে হয়। শার্টের দু পকেট আর প্যান্টের দু-পকেট বাছাই নুড়ি-পাথরে বোঝাই করে নেয়। ফুরোলে ওই অস্ত্র জঙ্গলেও মেলে। জল পড়লে ওপরের মাটি কাদা হয় বটে, কিন্তু আসলে তো পাথুরে জঙ্গল।
পাথর হাতে নিলেই বাপীর আবুকে মনে পড়ে। টিপ বটে হাতের। টিপের কমপিটিশন বা প্রাইজ থাকলে আবুকে দুনিয়ার কেউ হারাতে পারত না বোধ হয়। ওর মতো টিপ করার জন্য বাপীরও চেষ্টা বা নিষ্ঠায় ফাঁক নেই। ফারাক ঠিক করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গাছের মোটা-সরু ডাল লক্ষ্য করে প্রায়ই টিপের মহড়া দিতে হয়। এই করে করে তারও হাতের টিপ মন্দ নয় এখন। কিন্তু আবু রব্বানীর ধারে কাছে নয় তা বলে।
বাপী কোনো সময়ই বৃষ্টি পছন্দ করে না এমন নয়। লোকে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলে তারপর দুটো কাঁটাই ফেলে দেয়। বাপীরও তেমনি স্কুলে রওনা হবার আগেভাগে বৃষ্টি এলে স্কুল কামাই করার তাড়না। তারপর বৃষ্টি আর স্কুল দুইই চুলোয় যাক। যেমন আজকের এই দিনটায় এই রকমই হবে আশা করেছিল। পড়ার বই সামনে রেখে সকাল থেকে নটা পর্যন্ত জানলা দিয়ে ঘন ঘন আকাশ দেখেছে। সকাল ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত ওই আকাশ মেঘে কালি। কালো কালো মেঘের চাঙড়ে হিমালয়ের পেট-বুক ঢাকা। গলা উঁচিয়ে না পড়লে বাবা আর পিসী ভাবে পড়ায় ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। মেঘের সাজ দেখে আনন্দে বাপীর গলা আপনি চড়ছিল। ওই মেঘ হুড়মুড় করে আজ গোটা বানারজুলির ওপর ভেঙে পড়বেই।
কিন্তু বেলা সাড়ে নটার আগে ভাঙুক এটা চায় না। চান-খাওয়া সেরে ঘড়ি ধরে রোজ পৌনে দশটায় একগাদা বই-খাতার ঝোলা কাঁধে ফেলে স্কুলে রওনা দিতে হয়। স্কুল বসে বেলা এগারোটায়। পাঁচ মাইল দূরে সেই বানারহাটে স্কুল। অত পথ হাঁটার ধকল কিছু নয়, রাস্তায় একে একে আরো অনেক ছেলে জোটে। হৈ-হৈ করে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আসলে স্কুলটুল ভালো লাগে না। ক্লাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার চিন্তাতে গায়ে জ্বর আসে। সকালে ঘুম ভাঙলেই স্কুলে না যাওয়ার নানা ফন্দি মাথায় জট পাকাতে থাকে। সকালের জলখাবার খেতে খেতে পিসীকে প্রায়ই শুনিয়ে রাখে, এই এই কারণে আজ স্কুলে যাবে কি যাবে না ঠিক নেই। কিন্তু হাসতে মানা বাবাটি সামনে এসে দাঁড়ালেই সব ফন্দি—ফিকির মাথা থেকে উধাও হয়ে যায়।
কিন্তু আজকের আকাশ আর পাহাড় দেখে স্কুল ফাঁকির চিন্তা থেকে মাথাটাকে বিশ্রাম দেওয়া গেছে। আজকের দিনের ব্যবস্থা যা হবার ওখান থেকেই হচ্ছে। অল্প বৃষ্টিতে বাবা যদি ছাতা নিয়ে স্কুলে যেতে বলে, পিসী সে হুকুমও বরবাদ করে দেয়। বৃষ্টিকে বড় ভয় পিসীর। এখানকার ভাষায় ‘মালোরি’ জ্বর ঘরে ঘরে লেগে আছে। তার ওপর ব্ল্যাকওয়াটার ফিভার না কি এক ঘোড়ার ডিমের ব্যামোয় জঙ্গলের আর আশপাশের চা-বাগানের কতগুলি লোক ধপাধপ মরল। পিসীর ধারণা জলে ভেজার থেকেই যত রাজ্যের ব্যামোর উৎপাত।
কিন্তু ঘড়িতে যখন নটা, বারো বছরের বাপীর মেজাজের তখন বারোটা। ওই আকাশ তার সঙ্গে একটা বড় রকমের বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মেঘ এখনো গোটা আকাশ জুড়ে আছে বটে, কিন্তু এখন আর তেমন ঘন গভীর নয়। পাহাড়ের বড় গাছগুলোও একটু একটু দেখা যাচ্ছে। মেঘ-বিশারদ না হলেও অনেক লক্ষ্য করার ফলে বাপী মোটামুটি ওদের হালচাল জানে। হলপ করে বলতে পারে ঘণ্টাকতকের মধ্যে এই মেঘ আর বর্ষাবে না।
মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল। হাতের বই চটাস করে টেবিলে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর ঝাঁজে বসার বেতের চেয়ারটা পিছনে ওলটালো। ওটার ওপর আর একটা লাথি ঝেড়ে গটগট করে সোজা হেঁসেলে পিসীর কাছে।—আমি আজ স্কুলে যাচ্ছি না—কক্ষনো যাচ্ছি না।
এরকম শুনে পিসীর দু কান অভ্যস্ত। মুখ না ফিরিয়ে বললেন, আজ আবার কি হল, আজ তো আরো কষ্ট কম হবে, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় চলে যাবি
রাগের চোটে ভেংচে উঠল বাপী। —ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় চলে যাবি—ঠাণ্ডার জন্যে পাঁচ মাইল রাস্তা কমে দু মাইল হয়ে যাবে? হাঁটতে হাঁটতে পায়ের সুতো ছিঁড়ে যায়, ফেরার সময় জিভ বেরিয়ে পড়ে—তবু একটা সাইকেল কিনে দেবে না—আর ছ’ মাস ধরে ভোলানো হচ্ছে সাইকেল হবে! আজ আমি যাব না, যাবই না! বাবাকে বলে দাও আমার পা দুটো আজ সকাল থেকে টনটন করছে।
এতটুকু ছেলের পাঁচ-পাঁচ দশ মাইল হেঁটে যাওয়া আসা পিসীর চোখেও অত্যাচারের সামিল। চা-বাগানের অনেক বাবুর বাড়িতেই সাইকেল আছে। তাদের ছেলেরা বেশির ভাগ সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে। আবার অনেক সমবয়সী তাদের ক্যারিয়ারে বসে যায়। বাপী ছোট বলে তাদের কাছে খুব একটা পাত্তা পায় না। তাছাড়া ওর নিজেরও দয়া চাইতে ইচ্ছে করে না। সাইকেল চড়া শেখার আন্তরিক অভিলাষ একমাত্র আবুর কাছে ব্যক্ত করেছিল। আবু বলেছিল, শিখে কি হবে, তোর বাবা কিনে দেবে?
বাপী বলেছে, পিসীর পিছনে লেগে থাকব, তার তাগিদে বাবা একদিন না একদিন কিনে দেবেই।
এরপর আবু চা-বাগানের কোন্ এক পিওনের কাছ থেকে একটা ঝর্ঝরে সাইকেল জোগাড় করে এনেছিল। চালাতে শেখা এক দিনেই হয়ে গেছল। তারপর কিছু দিন ওই নেশায় পেয়ে বসেছিল তাকে। ছুটির দিনে ঘণ্টা কতকের জন্য একটা সাইকেল তার চাই-ই। পিসীর কাছ থেকে চার আনা আট আনা আদায় করে আবুর হাতে দিত। আবু কখনো পিওন কখনো আরদালিকে ঘুষ দিয়ে সাইকেল যোগাড় করত। কারো কাছে ভালো সাইকেল দেখলে লোভে দু চোখ চকচক করে ওঠে বাপীর। চুরি করে পার পেলে আপত্তি হত না বোধ হয়। বড় সাধ, ওরও একদিন ঝকঝকে একটা সাইকেল হবে।
কিন্তু এক বছরে আশা অনেক ফিকে হয়ে এসেছে। পিসীর কথা বাবা কানে তোলে না। পিসীর দরদ আছে। দুধের ছেলের অত পথ হাঁটাটা তার বুকে লাগে। নিজের উদ্যোগে ভাইপোর সাইকেল চড়াটা শেখা হয়ে গেছে যখন, সাইকেল একটা ওকে কিনে দেওয়াই উচিত। এই উচিত কথাটা বাবাকে অনেকবার শুনিয়েছে পিসী। গোড়ায় গোড়ায় বাবা কোনো জবাবই দেয়নি। আড়াল থেকে বাপী কখনো তাকে ভুরু কোঁচকাতে দেখেছে, কখনো না শোনার মতো করে পাশ কাটাতে দেখেছে। কিন্তু পিসীর তাগিদে কামাই নেই। কারণ পিসীর ওপর বাপীর না-ছোড় জুলুম। শেষে বাবা একদিন মহা বিরক্ত। তেতে উঠে পিসীকে বলল, প্রথম যেদিন বলেছ সেদিনই তোমার কথা আমার কানে গেছে। আমার কি মাটির তলায় টাকা পোঁতা আছে যে ভাবছ ইচ্ছে করে দিচ্ছি না? শুনে রেখেছি সুযোগ—সুবিধে যদি হয় কখনো— দেব। রোজ তোমার এই এক বায়না নিয়ে আসার দরকার নেই।
বাস, সেই থেকে পিসীরও আর তাগিদ দেওয়ার সাহস নেই।
ডালের কড়া নামিয়ে সুধারাণী ভাইপোর মুখখানা দেখলেন একবার।—সকাল থেকেই বুঝি স্কুলে না যাবার ফন্দি আঁটছিস—তোর বাবা সাইকেল কিনে না দিলে আমি কি করব—আমার টাকা আছে?
বাপীর চোখে পিসীর টাকা না থাকাটাও অপরাধ।—টাকা নেই তো স্কুলে পাঠানোর এত গরজ কেন? আমার কষ্ট হয় না? আজ আমি স্কুলে যাব না—যাবই না।
পিছনে বাবার চটির আওয়াজ কানে আসতে সচকিত। তাঁরও চানে যাবার সময় এটা। খেয়েদেয়ে দশটার মধ্যে হরিনারায়ায়ণবাবু দপ্তরে গিয়ে বসেন। অধস্তনদের কাছে তিনি কেরানীবাবু। অন্যদের কাছে শুধু হরিবাবু। সকালের কাজ সেরে দিদিকে কাঠের আলমারির চাবি দিতে এসেছেন। ওই আলমারিতে দরকারী কাগজপত্র থাকে।
ছেলের কথা কানে যায়নি, চড়া গলা শুনেছেন। মুখ দেখেই কিছু একটা বকাবকির আঁচ পেলেন।—কি হয়েছে?
বাপী পালাবার পথ খুঁজছে। কিন্তু বাবা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সুধারাণী সামাল দিতে চেষ্টা করলেন, ওর আজ পা কনকন করছে, অত পথ হেঁটে স্কুলে যেতে চাইছে না—
বাপীর মনে হল চোখ দুটো দিয়েই বাবা ওর কান টেনে ধরল। কথাগুলো ঠাস ঠাস করে দু-গালে দুটো চড় পড়ার মতো।—দশ মিনিটের মধ্যে চান সেরে খেতে বোস্—
বাপী পাশ কাটালো। বাবার ওপরেই সব থেকে বীতশ্রদ্ধ। আড়াল থেকে পিসীর গলা কানে আসতে সাগ্রহে কান পাতল।
—তোর সবেতে বেশি বেশি, ওইটুকু ছেলের রোজ অত পথ হাঁটতে কষ্ট তো হয়ই—একটা সাইকেল কিনে দিবি-দিবি করেও তো দিলি না।
বাবার চাঁছাছোলা জবাব।—ওর থেকে ঢের বেশি কষ্ট আমরা করেছি—এখনো করছি। অত বেশি আসকারা দিও না, গরিবের ছেলে গরিবের মতো বাড়তে দাও। একটা সাইকেল কিনতে অনেক টাকা লাগে, বুঝলে?
ঠক করে কাঠের মেজেতে চাবি ছুঁড়ে দেওয়ার শব্দ। তা সত্ত্বেও পিসীর গলা কানে এলো আবার, তুই তো কেবল আসকারা দিতেই দেখিস—কবে পাঁচ-পাঁচ দশ মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে স্কুলে গেছিস এসেছিস—বাড়ির দোরগাড়ায় স্কুল ছিল। নতুন না পারিস, দেখে-শুনে একটা পুরনো কিনে দে না—
আড়ালে বাপীর উৎফুল্ল মুখ। পিসীর সাহস আছে বলতে হবে। বাবার ফটফট চটির আওয়াজেই মেজাজ বোঝা যায়। বাপী আড়াল থেকে হাওয়া।
.
খেয়েদেয়ে সময়মতো কাঁধে বইয়ের থলে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। এই মেঘলা দিনে স্কুলে যেতে হচ্ছে। মুখ ভার। কিন্তু পিসীর ওপর আর রাগ করা সাজে না। বাইরে বেরিয়ে সরোষে আকাশের দিকে তাকাতে মেজাজ আরো বিগড়লো। নীল আকাশের বুক-জোড়া মস্ত একখানা কালচে অথচ হালকা মেঘের চাদর বিছানো। গা-পোড়ানো রোদের ছিটে-ফোঁটা নেই। ঠাণ্ডা, মিষ্টি বাতাস। বাঁধানো রাস্তার পাশ ঘেঁষে জঙ্গল। অদূরের লম্বা-লম্বা গাছগুলো এখন থেকেই গম্ভীর। বাপীকে স্কুলে যেতে হচ্ছে বলে ওরাও যেন মনমরা। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল বাবা বলে কোনো মানুষ যদি দুনিয়ায় না থাকত।
—কি রে, স্কুল চললি? পিছন থেকে কাঁধের কাছে মাঝারি জোরের চাপড় একখানা। আবু রব্বানী। ওর হাতে নিজের মাথার থেকেও এক হাত লম্বা সেই পাকা পোক্ত লাঠি—যেটা দেখলে বাপীর দু চোখ জুড়িয়ে যায়। আবুরও সব থেকে পিয়ারের জিনিস ওইটি। লাঠির এক-দিকে রূপোর মতো ঝকঝকে বড়—সড় একটা ইস্পাতের ফালা গোঁজা। ওটা দিয়ে সাপ-খোপ ছেড়ে মাঝারি সাইজের জন্তু-জানোয়ারকে অনায়াসে ঘায়েল করা যায়। ঘায়েল করার দৃশ্য বাপী নিজের চোখেই কম দেখেনি। কিন্তু বাইরে থেকে ইস্পাতের ধারালো ফালা দেখা যায় না। লোহার প্যাচঅলা ক্যাপে ঢাকা। যেন একদিকে লোহা বাঁধানো পাকাপোক্ত লাঠিই একটা। আবুর হাতে ওই লাঠি দেখেই বাপী বুঝে নিল ও এখন জঙ্গল ছুঁড়তে যাচ্ছে।
—পড় পড়, ভালো করে লেখা-পড়া না শিখলে মানুষ হবি কি করে? লেখা—পড়া শিখে বাবু হবি, এই আবুই তখন আবার তোকেও সেলাম ঠুকবে—
পর পর অনেক বার ফেল করে আবু এ বছরই স্কুল ছেড়েছে। নইলে এবারে বাপীর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তে হত। মুখে বিকার নেই, কথাগুলোও গম্ভীর। বাপীর তবু মনে হল ঠাট্টাই করছে। এই দিনেও স্কুলে যেতে হচ্ছে ঠাট্টা করবে না তো কি। লাঠি হাতে আবুকে দেখেই স্কুলের বিতৃষ্ণা আরো বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছে। জিজ্ঞাসা করল, তুমি জঙ্গলে যাচ্ছ বুঝি?
—তা ছাড়া কোন চুলোয় আর যাব। বাপের হুকুম সকাল-বিকেল এখন জাঙল ঠেঙাতে হবে। মতলবখানা বুঝলি না, এরপর তোর বাপকে ধরা-করা করে বীটম্যানের খাতায় আমার নামটা ঢোকাতে চেষ্টা করবে।
বাপীর বিবেচনায় সেটা মস্ত ভাগ্যের কথা। বাবার মতো কেরানীবাবু হওয়ার থেকে বীটম্যান হওয়া ঢের ভালো। একটা বড় নিঃশ্বাস ঠেলে বার করে সখেদে বলল, আমার আজ একটুও স্কুলে যেতে ইচ্ছে কচ্ছিল না—বাবার গুঁতোয় যাচ্ছি।
আবুর সঙ্গে আবুর মতো করেই কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করে বাপী। ঢিমেতালে চলতে চলতে তাচ্ছিল্যভরে আবু জবাব দিল, ইচ্ছে না করলে কোন বাপ আবার ঠেলে পাঠাতে পারে—মন না চায় যাবি না।
লোভ বাড়ছে। আবার ভয়ও।—–বাবা টের পেয়ে গেলে?
—ভোঁতা মাথা হলে টের পাবে আর গায়ের ছাল ছাড়াবে। সময়ে স্কুলে রওনা হয়েছিস, আবার সময়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘরে ফিরবি—টের পাবে কেমন করে?
চাপা উত্তেজনায় বাপীর বুক দুরুদুরু। তার পরেই আবার হতাশা।—অ্যাবসেন্ট হলে কাল যে আবার দরখাস্ত দিতে হবে স্কুলে, তখন টের পাবেই।
দাঁড়িয়ে গিয়ে আবু ঘাড় বেঁকিয়ে ওর বুদ্ধির বহর দেখে নিল। তারপর হাল—ছাড়া গলায় বলল, তুই বরং স্কুলেই চলে যা। কি করে যে পাসটাসগুলো করিস বুঝি না—এক বাবা ছাড়া পিরথীবিতে আর গার্জেন নেই? পাঁচ দিন সাত দিনের জন্য বাপ অন্য জঙ্গলের কাজে গেছে বললে মাস্টাররা কি যাচাই করে দেখতে আসবে নাকি? বাপ না থাকলে তখন পিসী সই করলে চলবে না? পিসীর সই করা মানে বাঁকা-চোরা করে তোর সই করা—
বুকের ভিতরে আবার দুরু দুরু বাপীর।
—শোন্, তোকে ধরার তালেই ইদিক দিয়ে এলাম। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ছি—ইচ্ছে থাকে তো তুইও ফাঁক বুঝে ঢুকে পড়। মেঘলা দিনে আবার জন্তু-জানোয়ারগুলোর প্রেম বেশি চনমন করে ওঠে—
লোভের শেষ আস্ত রাজভোগখানা ছুঁড়ে দিয়ে আবু হনহন করে খানিক পথ ভেঙে জঙ্গলে ঢুকে গেল। বাপী সেখানে মিনিট খানেক ঠায় দাঁড়িয়ে। এই লোভ সামলানোর সাধ্যি আর নেই। পিছনের জঙ্গলের মধ্যেই আবুদের মেটে-ঘর। ওকে ধরার জন্যেই এই পথ ধরে এসেছে। ওইটুকু সব বাধা আর সব নিষেধ তুচ্ছ করার মতো যথেষ্ট। তার ওপর মেঘলা দিনে জন্তু-জানোয়ারগুলোর প্রেম চনমন করে ওঠার কথা।
পিছনে ঘুরে দেখে নিল। কেউ আসছে না। চোখের পলকে সে-ও ওখান থেকেই জঙ্গলের আড়ালে।
প্রেম বলতে বাপী এতকাল পিসীর মুখে রাজপুত্র রাজকন্যার প্রেমের কথাই শুনে এসেছে। রূপকথার রাজপুত্র মেঘ-বরণ চুল রাজকন্যার খোঁজে পক্ষীরাজ ঘোড়ার চেপে জঙ্গল পাহাড় টপকে সাগর পেরিয়ে রাক্ষসের দেশ থেকে ঘুমন্ত রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছে। পাশা খেলে ডাইনী পাশাবতীর দফা রফা করে, নয়তো একডুবে কাজলদীঘির তলা থেকে সোনার কৌটা তুলে তলোয়ারের ঘায়ে ভোমরা-ভোমরি দুখানা করে এক-একটি রাজপুত্র এক-একটি সোনার বরণ রাজকন্যাকে ঘরে এনে ধুমধাম করে বিয়ে করেছে। পিসীর মুখে ওইসব গল্প শুনেও বুকের রক্ত টগবগ করে ফোটে, উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়। খানিকক্ষণের মধ্যে বাপী নিজেই সেই সব রাজপুত্র বনে যায়।
কিন্তু জঙ্গলের জীবগুলোর প্রেম একেবারে অন্য ব্যাপার। কোটা ওদের ভালবাসা-বাসি আর কোন্টা মারামারি খেয়োখেয়ি এখনো ভালো বুঝতে পারে না। এই ব্যাপারে আবু ইদানীং ওকে একটু-আধটু পাঠ দিচ্ছে। একটু একটু করে ভারী মজাদার নিষেধের জগতের পর্দা সরাচ্ছে। নইলে আগে চোখে দেখতে পেলেও বাপী কি কিছু বুঝতে পারত! এখনো পারে না, আবু বলে দিলে ঠকে শেখে। ভালবাসা-বাসি করতে হলে জীবগুলোরও একটা মেয়ে, আর একটা পুরুষ দরকার হয়, তা-ই জানত না।
এই পাঠ শুরু মাস দুই আগে। দূরে একটা বন-মোরগকে ছুটে আর একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে বাপী হাতের পাথর তুলেছিল। দুটোকেই একসঙ্গে শেষ করবে। আবু থামালে।—দাঁড়া, প্রেম করছে দেখছিস না, এ সময় মারতে হয়!
বাপী হাঁ। —মারামারি করছে না?
আবু হেসে সারা। তারপর এযাবৎ আশপাশের অনেক জানোয়ারেরই প্রেম করাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ওকে। এমন কি খরগোশ বা কাঠবেড়ালীর প্রেমও বাপী এখন একটু-আধটু আঁচ করতে পারে। তবু গেল রোববারেই তো এক তাজ্জব ব্যাপার দেখে ঠকেছে।
সেদিন জঙ্গলে পাশাপাশি চলতে চলতে আবু কি দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছল। তারপরেই সেই অদ্ভুত দৃশ্যটা বাপীও দেখেছে। দুটো সাপ একটা আর একটাকে জড়িয়ে পাকিয়ে লেজে ভর করে একেবারে ছুঁয়ে পোঁতা লাঠির মতো দাঁড়িয়ে . আছে। দুটোর ফণাও মুখোমুখি, লাগালাগি।
আবুর সঙ্গে আড়ালে সরে গিয়ে তাজ্জব দৃশ্যটা অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে। আবু ফিস্ ফিস্ করে বলেছে, প্রেমে বাগড়া দিলে ক্ষেপে গিয়ে দুটোই একসঙ্গে তাড়া করবে। সাবধান, জোরে নিঃশ্বাসও ফেলবি না!
হাঁ করে বাপী দেখেছে আর বুঝেছে, এ-ও প্রেম। সেই দিনই পরে আবুর মুখে বাঘের প্রেমের গল্প শুনে বাপীর গায়ে কাঁটা! প্রেম করার সময় হলে বাঘিনী নাকি ডেকে ডেকে কাছাকাছির বা দূরের বাঘকে জানান দেয়। সেই প্রেমের ডাক আবু নিজের কানে শুনেছে। ওই ডাক শুনে কখনো আবার একটার বেশি পুরুষ বাঘ এসে হাজির হয়। বাঘিনীকে পাবার জন্য দুই বাঘের মধ্যে তখন যাকে বলে একেবারে খতমের লড়াই। যে জিতবে বাঘিনী তার। আর, বাঘিনীর প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে যদি একটাই বাঘ আসে তো সে ব্যাটাও নিজের বীরত্ব দেখিয়ে বাঘিনীর মন পাবার জন্য একগাদা পশু মারবে—যা খাবে না তার থেকেও ঢের বেশি।
কদিন ওই প্রেমের পাঠ শুনে আর নিজের চোখেও অনেক দেখার পর বারো বছরের বাপীর ধারণা, জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারের ভালোবাসা-বাসিটা রূপকথার রাজপুত্র রাজকন্যার মতো। ঝাঁপাঝাঁপি ঝকাঝকি জড়াজড়ির ব্যাপার। তার চোখে দেখা বানারজুলির মানুষ বা মেয়েমানুষেরা রূপকথার ছেলে—মেয়ের মতো নয়। আবার জঙ্গলের জীবজন্তুর মতোও নয়। অথচ আবু বলে, মেয়ে-পুরুষের ভালো-বাসা-বাসি না হলে কেউ জন্মাতোই না—বাপী না, আবু না, পৃথিবীর কেউ না। অবাক কথা। বাপী যেটুকু বোঝে তার থেকে বেশি অস্পষ্ট থাকে। কেউ বলে দেয়নি, নিজের ভিতর থেকেই কেমন করে জেনেছে এসব দেখাশোনা বা বোঝাটা ভয়ানক গোপনীয় ব্যাপার। আবার এত গোপনীয় বলেই জানার ভীষণ লোভ।
আজকের মতো এমন দিন হয় না। বাবার ভয়-ডর উবে গেছে। এমন ছুটির স্বাদ আলাদা। কেবল একটু আফসোস হাতে নিজের লাঠিটা নেই। জঙ্গল থেকে সরু একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে মনের আনন্দে ছোট গাছ আর ঝোপঝাড় পেটাতে পেটাতে আবুর পাশাপাশি চলেছে। কাঁধের বই-খাতার থলের বোঝাটা একজন বীটম্যানের কুঁড়েতে জিম্মা রেখে নিশ্চিন্ত। ঘরে ফেরার সময় তুলে নিয়ে যাবে।
মেঘলা আকাশের ঠাণ্ডা অথচ ঝিমুনো ছোঁয়াটা জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। এ রকম হয় বলেই বাপীর ভালো লাগে। আজ অনেক দূরে চলে যাবার ইচ্ছে। একেবারে পাহাড়-ঘেঁষা বাঘ বা চিতার ডেরার দিকে না হোক, এক-আধটা ভালুক-টালুকের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে। বিপাকে না পড়লে এখানকার ভালুক মানুষ তাড়া করে না, উল্টে পালায়। আবু অনেক দেখেছে। ও নাকি ভালুকের ভালোবাসা-বাসিও দেখেছে।
কিন্তু কিছুটা যেতে যে জিনিসটা চোখে পড়ল সে অন্য ব্যাপারে। খুব সুন্দরও একটা বড় ময়ূর রং-বেরঙের বিশাল পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘুরেফিরে এক-একবার ঢং করে নাচছে। ওটার সামনে আর একটা পেখমছাড়া ময়ূর পোকামাকড় খুঁটে খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে পেখমমেলা বড় ময়ূরটাকে দেখছে।
আবু মন্তব্য করল, কেমন প্রেম করছে দ্যাখ—
বাপী দাঁড়িয়ে গেল। মেঘলা দিনে পেখম ছড়ানো ময়ূর অনেক দেখেছে। নাচতেও দেখেছে। কিন্তু প্রেমের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি।
—সামনের ওই কুচ্ছিতটা মেয়ে ময়ূর?
—না তো কি। নেচে নেচে রূপের বাহার দেখিয়ে ওকে ভোলাচ্ছে।
বাপীর আরো খানিক দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আবু তাড়া দিল, এসব তো দুধের খোকারা দেখবে—আয়।
ঘণ্টা দুই আড়াই জঙ্গলখানা মন্দ চষা হল না। এরকম তো কতদিন কতবার করেছে, কিন্তু আনন্দটা সব সময় আনকোরা নতুন। বাপীর একটু খেদ বড় জানোয়ার একটাও চোখে পড়েনি। বাপী আর এক দিকের গভীরে খানিক এগোতে চেয়েছিল। আবু বাধা দিয়েছে, ওদিকে নয়, বুনো শুয়োর বেরোতে পারে।
দাঁতাল বুনো শুয়োর কি ভয়ংকর জীব বাপীর শোনা আছে। ভালুকের মতো নয়, দেখলে সোজা তেড়ে আসে। এ জায়গাও নিরাপদ খুব নয়, এসে হাজির হলেই হল। তখন চটপট কোনো গাছে উঠে পড়লে বাঁচোয়া। এদিকে সেরকম গাছের অভাব নেই।
আবু আর ঘুরতে রাজি নয়। তার খিদে পেয়েছে, ঘরে যাবে। বাপীকেও আসতে বলল। যা আছে ভাগ করে খাওয়া যাবে। তারপর ফের জঙ্গলে এসে আড্ডা দাও বা যত খুশি ঘোরো।
কিন্তু দু কদম না এগোতেই ঝমঝম চেনা শব্দ। তারপর যে কাণ্ড দুজনারই খিদে-টিদে সিকেয়। দিব্বি বড়সড় সজারু একটা। ওদের দেখেই পালাচ্ছে। ওটাকে দেখামাত্র চাপা উত্তেজনায় আবুর অন্য মুখ। ফলে বাপীরও। চোখের পলকে ছিটকে গিয়ে আবু ওটার পিঠে ডান্ডার গোটাকতক পেল্লায় ঘা বসিয়ে দিল লোহামোড়া দিকটা দিয়ে। সারা গায়ের এক বিঘৎ মোটা মোটা কাঁটাগুলো মেলে দিয়ে সজারুটা দাঁড়িয়ে লড়ছে, আবার গর্তের দিকে ছুটছে। ওর গর্ত সামনের ওই চারা গাছগুলোর বেড-এর দিকে।
আবু ছুটে গিয়ে সেই গর্তটা বার করে তার মুখ আগলালো। ওকে চেঁচিয়ে হুকুম করল, হাতে পাথর তুলে নে, ওদিকে দিয়ে না পালায় তুই দ্যাখ—একটা সজারু মারার সাধ অনেক দিনের—এ শালাকে আজ মারবই। বলতে বলতে লাঠি থেকে লোহার খাপ খুলে ইস্পাতের ঝকঝকে ধারালো ফলাটা বার করে লাঠি বাগিয়ে ধরল।
কিন্তু অত বড় সজারু মারা সহজ নয়। ওই বড় বড় কাঁটার আড়ালে আসল জীবটিকে পাওয়া ভার। না চলে লাঠি, না পাথর। ওটার যেমন প্রাণপণ বাঁচার লড়াই এদের তেমনি মারার। ইস্পাতের ফলার খোঁচায় কাঁটাগুলো রক্তাক্ত। লাঠি আর পাথরের ঘায়ে ভেঙেছেও অনেকগুলো। শেষে ওটা ঝিমিয়ে পড়তে আবু অনেক কাছে গিয়ে ধারালো ফলার দিকটা মোক্ষমভাবে বসাতে পারল। ওরকম বার কয়েকের চেষ্টায় ওটার ভবলীলা সাঙ্গ।
এই উত্তেজনায় ফাঁকে কম করে ঘণ্টা-সোয়াঘণ্টা পার। বাপীর হাঁপ ধরে গেছে। ধুলোমাখা রক্তাক্ত জীবটাকে দেখে গাও ঘুলোচ্ছে। কিন্তু আবু ফুর্তিতে টইটম্বুর। পকেটে ধারালো ছোরা একটা থাকেই। গাছ থেকে দড়ির মতো একটা লম্বা ঝুরি কেটে এনে তার এক মাথা দিয়ে ওটার গলার দিকটা শক্ত করে বাঁধল। তারপর টেনে নিয়ে চলল। আবুর কথা শুনে বাপীরও গা-ঘুলনো ভাবটা গেছে। অত বড় সজারুটা মারার জন্য আবু নাকি জঙ্গল আপিস থেকে এক টাকা বা দু টাকা প্রাইজ পাবে। সজারু চারাগাছের বেড-এর নরম মাটির তলা দিয়ে লম্বা গর্ত করে চারাগাছের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই সজারু মারলে পুরস্কার। তাছাড়া সজারুর মাংস খেতে চমৎকার। কম করে সাত-আট সের মাংস হবে ওটার। আবুর বাড়িতে আজ ভোজ লাগবে। বাপীর নেমন্তন্ন তো বটেই। আর বড় সজারুর কাঁটাও ফেলনা নয়। ড্রইং করার কলম হয় ওই দিয়ে। আবু হেসে উঠল।—আচ্ছা ওরা প্রেম করে কি করে বল তো, নড়লে চড়লেই তো বড় বড় কাঁটা!
মাথা ঘামিয়ে বাপীও ভেবে পেল না।
আধ ঘণ্টা ধরে পালা করে ওটাকে হিঁচড়ে টেনে জঙ্গলের বাইরে পাকা রাস্তার এনে ফেলল। টানতে সুবিধে, কেরামতিটাও লোক দেখবে। আনন্দে বাপী স্কুল পালানোর বিপদও ভুলেছে। কারণ এত বড় একটা বাহাদুরির পিছনে সেও আছে। রাস্তার লোকেরা জীবটাকে দেখছে আর ওদেরও দেখছে। কেউ কেউ আবার দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করছে—কোথায় পেল, বা কি করে মারল।
লম্বা রাস্তাটা বাঁক নিতে সামনের দিকে চেয়ে দুজনেই অবাক। খোদ বড় সাহেবের ছবির মতো সুন্দর বাংলোর সামনে মালবোঝাই ট্রাক একটা। তার পিছনে জিপ।
সেখানে ছোট সাহেব অর্থাৎ ফরেস্টার, ফরেস্ট গার্ড, কেরানীবাবু অর্থাৎ বাপীর বাবা, আবুর বাবা হেড বীটম্যান কালু, তার সঙ্গে আরো কয়েকজন বীটম্যান পিওন—সকলেই ব্যস্তসমস্ত। নীচের কর্মচারীরা ট্রাকের দড়ি খুলে মাল নামানোর তোড়জোড় করছে।
বানারজুলি জঙ্গলের সর্বময় কর্তা রেঞ্জ অফিসারের বাংলো ওটা। বড় সাহেবের বাংলো। অবাঙালী বড়সাহেব বদলি হবার ফলে প্রায় তিন সপ্তাহ বাংলোটা খালি পড়ে ছিল।
আবু বলল, নতুন বড়সাহেব এলো বোধ হয়। শিগগীর আয়—
বাঁধা সজারুটাকে টানতে টানতে প্রায় ছুট লাগালো আবু। সেখানে আব্বা আছে, কেরানীবাবু আছে, ছোটসাহেব আর বীটম্যানরা আছে—সকলের সামনে খোদ বড়সাহেবকে কেরামতিটা দেখাবার এমন মওকা আর পাবে কোথায়?
পায়ে পায়ে বাপীও এগিয়ে এসেছে। স্কুল পালানোটা আর মনেই নেই। জিপটার দিকে চোখ। ফরেস্টার সাহেব আর বাবা যাকে তোয়াজ করছে ওই ছিপছিপে সুন্দরপানা সাহেবটিই নিশ্চয় নতুন রেঞ্জ অফিসার। তার দু হাত দূরে ঝকমকে শাড়ি পরা মেমসাহেব। বেশ সুন্দর দেখতে। মেমসাহেবের সামনেই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটা বড়। পরনে ধপধপে সাদা হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট। আর চকচকে রঙিন ফ্রক পরা মেয়েটার ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, ফুটফুটে ফর্সা রং ফোলা ফোলা লালচে গাল…পুতুল পুতুল মুখ।
বাপী হাঁ করে মেয়েটাকেই দেখছে।
আবুর বরাত খারাপ। লতার দড়ি-বাঁধা ওই পেল্লায় মরা সজারু এনে ফেলতে সকলে যখন সচকিত, খোদ বড়সাহেবের বিরক্ত মুখ। মেমসাহেব আঁতকে ওঠার দরুন হতে পারে। আরদালি পিওন ফরেস্ট গার্ড বীটম্যানরা দুচার মিনিটের জন্য অমনোযোগী হল বলেও হতে পারে। এতে হয়ত দণ্ডমুণ্ডের মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার গুরুত্বে ঘা পড়ল। তার ওপর মেমসাহেবের নাক-মুখ কোঁচকানো বিরক্তি।—মাগো, কি বিচ্ছিরি—সরিয়ে নিতে বলো!
আবুর ভেবাচাকা মুখ। ছেলের কেরামতি দেখে ওর বাবা কালুর দু চোখ আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। বড়সাহেবের বাহবা আশা করেছিল। মেমসাহেবের কথা শুনে আর বড়সাহেবের মুখ দেখে রক্ত জল। আগুন চোখে ছেলের দিকে ফিরে তাকানোর আগেই ত্রস্ত আবু তার সজারু সমেত রাস্তার ওধারে জঙ্গলে নেমে গেল। সব থেকে বেশি ঘাবড়েছে ও-ই
ফুটফুটে মেয়েটা সভয়ে মায়ের তিন পা পিছনে চলে গেছল। দেখার জন্য এবারে রাস্তার এধারে এগিয়ে এলো। তার দাদাকে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের দিকে খানিকটা নেমে দাঁড়াতে দেখে এগিয়েছে। তবু সাহস দেখে বাপীর হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা বলছে, এই দাদা, আর নামিস না—
জঙ্গল থেকে রাস্তা অনেকটা উঁচু। মরা সজারুটাকে টেনেহিঁচড়ে আবু ততক্ষণে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। বাপীর বরাত ভাল, তার ব্যস্তসমস্ত বাবা তখন মাল রাখার তদারকির কাছে বাংলোর ভিতরে। এই অপ্রিয় ব্যাপারটা দেখলে বা জানলে দুর্ভোগ হত। ঘর্মাক্ত কলেবরে এবারে বাইরে আসতে ছেলের দিকে চোখ গেল। বাপী জঙ্গলের দিকে মুখ করে সাহেবের মেয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে।
কাঁধের নীচে বাবার হাতের হ্যাঁচকা টান পড়তে মুহূর্তের জন্য মুখ আমসি। পরের মুহূর্তে অবাক। ঘাম-ঝরা হাসিমাখা মুখ বাবার। স্কুল-ফুল ভুলে গেছে। ওকে বড়সাহেবের সামনে টেনে বলল, প্রণাম কর্—
সাহেবের ধুলোমাখা বুটে প্রণাম ঠুকে ওঠার ফাঁকে আবার বাবার চিনিগলা কথাই কানে এলো।—মা-মরা এই একটাই ছেলে আমার স্যার, আশীর্বাদ করুন—
বড়সাহেব সামান্য মাথা নাড়লেন। বাবার হুকুমে মেমসাহেবকেও স্যান্ডালপরা পা ছুঁয়ে প্রণাম সারতে হল। তাদের মেয়ে এদিকে ঘাড় বেঁকিয়ে ওকে দেখছে। বাবার ভাবনা গেছে। হাল্কা পায়ে বাপী আবার মেয়েটার কাছে এসে দাঁড়াল। আগের আধ-বুড়ো খোট্টা বড়সাহেবের ছেলেমেয়ে ছিল না। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার লোভ খুব। চেষ্টার দরকার হল না, ও-ই কথা বলল।
—ওটা কি মেরে এনেছিলে?
—সজারু।
—লাঠি পাথর আর লাঠির মধ্যে ইস্পাতের ফলা খোঁজা আছে—তাই দিয়ে।
—তুমি মারতে দেখেছ? শুনেই গা শিরশির করছে যেন মেয়েটার।
—আমি আর আব্বুই ত মারলাম ওটা।
এবারে বড় বড় চোখ করে ওকে ভালো করে দেখার দরকার হল যেন।—ভয় করল না?
—নাঃ।
—ওটা তাড়া করল না?
—তাড়া করবে কি, ভয়ের চোটে গর্তে ঢুকতে চাইছিল। আবু গর্তের মুখ আগলে ছিল।
মেয়েটার চোখেমুখে অবিশ্বাস। আর একবার ওকে ভালো করে দেখে নিল।—তুমি এইটুকু ছেলে, তুমি মেরেছ না আরো কিছু—
ওকে বিশ্বাস করানো যেন বাপীর দায়।—আবুকে জিগ্যেস করে দেখো, ও তো আর মিথ্যে কথা বলবে না।
বিশ্বাস করা তবু সহজ নয়।—তোমার নাম কি?
—বাপী।
হেসে উঠল। সার বাঁধা ছোট দাঁতের সারির ঝিলিক।—বাপি তো বাবাকে বলে—ওই তো বাপি। .
হাত তুলে বাবাকে দেখালো।
মজার কথায় বাপীরও মজা লাগল একটু। জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?
—মিষ্টি।
এবারে বাপী হাসল।—মিষ্টি তো লোকে খায়—
মেয়েটা প্রতিবাদ করল, যেমন বুদ্ধি তোমার, আমি মিষ্টি দেখতে বলে দাদু নাম রেখেছিল মিষ্টি—আমার ভালো নাম মালবিকা নন্দী—তোমার ভালো নাম নেই?
মনে মনে বাপী বলল, মেয়ের অহংকার দেখো, নিজেই বললে মিষ্টি দেখতে। কিন্তু মিষ্টি যে সত্যি ভারী মিষ্টি দেখতে অস্বীকার করার উপায় নেই।
—বিপুলনারায়ণ তরফদার
—মা-গো, কি বিচ্ছিরি নাম—তোমাদের জংলা দেশে বুঝি এ-রকম সব বড় বড় নাম হয়?
নাম নিয়ে বাপী কখনো মাথা ঘামায় না। শুনে রাগ হলেও প্রকাশ করার উপায় নেই।—এর আগে তোমরা জঙ্গলে ছিলে না?
—ছিলাম তো, ময়নাগুড়ির জঙ্গলে ছিলাম। সেখান থেকে এখানে বদলি হয়ে এলাম।
বাপীর হাসিই পাচ্ছে, যেন ও-ই রেঞ্জ অফিসার, এক জঙ্গল থেকে আর এক জঙ্গলে বদলি হয়ে এলো। বলল, তাহলে তুমিও তো জংলা দেশের মেয়ে।
তক্ষুণি মুখ-মচকানো জবাব—এঃ, আমার কলকাতায় জন্ম—বুঝলে? সেখানে মায়ের বাবা থাকে, দাদুর কাছে ছ বছর ছিলাম আমরা—তুমি কলকাতা দেখেছ?
দেখেনি যখন বাপীর মাথা নাড়া ছাড়া উপায় কি। মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিল, বাবা-মা বাংলোর ভিতরে চলে গেছে, দাদাও রাস্তায় নেই।
—কলকাতা দেখনি আবার ফটফট করছ—তুমি জংলি ভূত একটা—
খিল খিল করে হাসতে হাসতে বাংলোর দিকে ছুট।
বাপীর রাগ হবার কথা। কিন্তু একটুও রাগ হচ্ছে না। অবাক চোখে বাংলোটাকেই দেখছে। ওই আঙিনায় ঢোকার তাগিদ কখনো বোধ করে নি। আজ করছে। ঢুকলে সাহেব মেমসাহেবের কথা জানে না, বাবা যে তেড়ে আসবে এটুকু বোধ আছে।
রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে নামল। আবুর টিকির দেখা নেই। এতক্ষণে তার ঘরের কাছাকাছি চলে গেছে হয়তো। বেচারা আবুর এমন একখানা সজারু মারার কদর হল না। ওই মেমসাহেবের জন্যেই হল না। একেবারে ননীর শরীর, দেখেই মূর্ছা গেলেন। না, দেখতে ভালো হলেও মেমসাহেবকে ওর একটুও ভালো লাগে নি ওদের ছেলেটারও দেমাক খুব, একটা কথাও বলল না। কিন্তু মিষ্টি মেয়েটা কি মিষ্টি কি মিষ্টি! হাসলে সুন্দর, মুখ মচকালে সুন্দর, আবার সজারু দেখে ভয়—পাওয়া মুখখানাও সুন্দর। কথা শুনে এক-একবার রাগ হচ্ছিল বাপীর। কিন্তু তাও বেশ লাগছিল। চা-বাগানের বাবুদের ছোট-বড় আরো অনেক মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখেছে, কিন্তু মিষ্টির মতো কেউ না। আর তাদের এত দেমাক যে কেরানীবাবুর ছেলের সঙ্গে কথাই বলে না। বড়সাহেবের মেয়ে মিষ্টি সেধে কথা বলেছে। কত কথা আর মিষ্টি মিষ্টি কথা।
জঙ্গলের পথ ছেড়ে আবার রাস্তা ধরল। বাড়ি। বই খাতা সেই বীটম্যানের ঘরেই পড়ে থাকল তাও মনে নেই। ঘরে ঢোকার মুখে মনে পড়ল। পিসী সামনে নেই, জেরায় পড়তে হল না।
—পিসী! মিষ্টি এসে গেছে—!
ভিতরের দাওয়ায় বসে ওর জন্যেই জলখাবারের রুটি বেলছিলেন সুধারাণী। অবাক হবারই কথা, বাইরে থেকে মিষ্টি কখনো কেউ আনে না। কখনো-সখনো তিনিই ঘরে তৈরি করে দেন।
—কোত্থেকে এলো, কে আনল?
বাপীর মুখে দুষ্টু-দুষ্টু হাসি—জঙ্গলের বড়সাহেব এলো আজ, আর তার সঙ্গে মেমসাহেব এলো—তাদের সঙ্গে মিষ্টি এলো।
ভালোমানুষ পিসী প্যাচ বুঝবে কেমন করে।—তোদের জন্যেও দিল বুঝি? কি মিষ্টি?
—বড়সাহেব আর মেমসাহেবের মেয়ে মিষ্টি। পিসীকে ঠকাতে পেরে বাপী হেসে উঠল।—নাম মিষ্টি দেখতে মিষ্টি কথাও মিষ্টি—আমার খেয়েই নিতে ইচ্ছে করছিল গো!
সুধারাণী বুঝলেন এবং ভাইপোর বজ্জাতির কথা শুনে না হেসেও পারলেন না।—শুনলে তোর নোলা ছিঁড়ে দেবে একেবারে—কি পাজী হয়েছিস তুই। যা মুখ হাত ধুয়ে আয়, আমি রুটি কখানা করে দিই চট করে—
পেটের আগুনও জ্বলছে এতক্ষণে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ঘুরে এসে পিসীর সামনে দাওয়ার ওপরেই বসে পড়ল। থালায় খাবার দেখে আর পিঁড়ি পাতার তর সইল না।
জঙ্গলের নতুন মনিবের খবর নেবার কৌতূহল সুধারাণীর। মনিব ভালো মানুষ হলে ভাইয়ের ভাগ্য। নইলে অনেক হেনস্থা। যখন-তখন ডাক পড়ে, কথায়-কথায় শাসায়। কেরানীবাবু-টাবুরা ঘরের কেনা গোলাম।— সাহেব মেমসাহেবকে কেমন দেখলি?
রুটি তল করতে করতে বাপী জবাব দিল, সাহেবের হুমো গম্ভীর মুখ, মেমসাহেব আর তার মেয়ে মরা সজারু দেখে ভিরমি খায়। দৃশ্য মনে পড়তেই হাসি। সোৎসাহে সজারু মারা, আর আবুর সেটা সাহেব মেমসাহেবকে দেখাতে আনার ফলখানা বলে ফেলল।
গালে হাত দিয়ে শুনছিলেন সুধারাণী। শোনার পরে খটকা।—তুই স্কুলে ছিলি তো সজারু মারলি কি করে?
রুটি গলায় ঠেকার দাখিল। ফলে স্বর চড়া এবং বিরক্তি ভরা। —মাঝে মধ্যে স্কুল হাফ-হলিডে হয়ে যেতে নেই–বারো মাসই পুরো স্কুল হয়?
আর কাছে বসে থাকা নিরাপদ নয় বাপীর সে-জ্ঞান টনটনে। পিসীর চোখে ধুলো দিয়ে বই-খাতার ঝোলাটা নিয়ে আসতে হবে। শেষ আস্ত রুটি আর তরকারিটুকু একেবারে মুখে পুরে উঠে পড়ল।
পরের দশটা দিনের মধ্যে দুটো রবিবার, দুটো শনিবারের হাফ-ডে, আর কি এক পরব উপলক্ষে এক দিন ছুটি গেছে। সেই পাঁচটা দিনের বেশির ভাগ সময় বাপীর রেঞ্জ অফিসারের বাংলোয় সামনে আর আশপাশে ঘুর ঘুর করে কেটেছে। স্কুলের দিনেও বিকেলে একবার করে পা দুটো ওকে এ-দিকে টেনে এনেছে। বাংলোর ভিতরের চত্বরে আর সামনের ওই চেয়ার-টেবিল সাজানো কাঠের বারান্দায়ও পা দিয়েছে। পরবের ছুটির দিনের সমস্ত দুপুরটা মিষ্টির সঙ্গে গল্প করে কেটেছে। ওর বাবা ভিতরে ঘুমুচ্ছিল। দীপুদা চা-বাগানের কোন্ নতুন বন্ধুর বাড়ি টহল দিতে বেরিয়েছে। বাইরের টেবিলে মিষ্টির একটা পাতলা বই, খাতা আর পেনসিল।
দুপুরেও মেয়ের পড়ায় কি মন—রাস্তার ঠিক পরেই ওদের গেটের মুখোমুখি ছোট গাছটার একটা ডালে গ্যাঁট হয়ে বসে বাপী মজা দেখছিল।… মিষ্টি পড়ার টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে কাঠের মেঝেতে বার কয়েক ঝাঁপ খেল। প্রতিটি ঝাঁপের পরে ঘাড় বেঁকিয়ে ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। অর্থাৎ মা-বাবা ভিতর থেকে টের পেল কিনা। শব্দ না করে ঝাঁপ খাওয়ার কেরামতিটাই রপ্ত করছে মনে হল বাপীর। সে-খেলা শেষ হতে হাতের রাবার মেঝেতে ফেলে ফেলে এক পা তুলে টেবিল-চেয়ারের চারদিকে ঘুরে এক্কা-দোক্কা খেলা চলল খানিক। তারপর লালচে মুখে খানিক এগিয়ে এসে গেট বরাবর মুখ করে দাঁড়িয়ে একটু একটু হাঁপাতে লাগল।
বাপী এই মওকায় কোকিলের ডাক ডেকে উঠল একটা। তারপর আরো একটা। কানা মেয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। গাছটাও দেখল। কিন্তু পা ঝুলিয়ে বসে থাকা সত্ত্বেও ওর দিকে চোখ গেল না।
বাপী অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল। অবাধ্য পা দুটো এর পর ওই গেট পেরুতোই, কিন্তু মনের তলায় মেমসাহেবের ভয়। মুখে কিছু না বললেও ওর আসাটা যে পছন্দ নয় সেটুকু বাপী গেল দিনই আঁচ করতে পেরেছিল। বিকেলে মিষ্টির ডাকেই ভিতরে ঢুকেছিল, তারপর সামনের আর পিছনের বাগানে মিষ্টির সঙ্গে ছোটাছুটি করে খেলা করছিল। এই মেয়ে ওর সঙ্গে ছুটে পারবে কেন। দশ গজ এগিয়ে দিয়েও ওকে হারিয়ে আগে গিয়ে বুড়ী ছুঁয়েছে। বারান্দার চেয়ারে বসে আগেও মেমসাহেব ওদের ছোটাছুটি লক্ষ্য করেছে। তার মুখখানা বাপীর অপ্রসন্ন মনে হয়েছে। গেল দিনে সব থেকে বেশি মনে হয়েছে। বার বার হেরে আদুরে মেয়ের মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। এবারে তার অর্ধেকের বেশি এগিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে হারানোর গোঁ। কিন্তু বাপী এমন অন্যায় হারা হারতে রাজি নয়।
এই থেকে কথা কাটাকাটি। মেমসাহেব তখন বারান্দার এ-মাথায় এসে কড়া গলায় মেয়েকে চলে আসতে হুকুম করল। আর ওর দিকে এমন করে তাকালে যে বাপীর পা দুটো আপনা থেকেই গেটের দিকে। ফলে ভিতরের তাড়না সত্ত্বেও এ-দিনের দুপুরে ওই ছোট গেট পেরুনো নিরাপদ হবে কিনা ভাবছিল।
কোকিলের ডাকে কাজ হল না দেখে বাপী একটু জোরেই বার-দুই হাততালি দিল। গাছের ডালে এবারে ওকে আবিষ্কার করতে পেরে মেয়েটা পলকের জন্য হাঁ। তারপর একমুখ হাসি। এমন মজার ব্যাপার আর যেন হয় না। তরতর করে কাঠের সিঁড়ি টপকে ছুটে গেটের কাছে এলো। .
বাপী হাতের ইশারায় ওকে কাছে আসতে বলল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি একবার ওদের ঝিমুনো বাংলোটা দেখে নিল। তারপর আস্তে আস্তে গেটের আটা সরিয়ে তিন-চার লাফে রাস্তার এধারে।
সামান্য গলা চড়িয়ে বাপী বলল, এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি, টেবিল থেকে লাফালি, ধেই ধেই করে নাচলি, আর এদিকে একবার তাকালি না।
এর মধ্যে বাপী অনায়াসে তুমি থেকে তুই-এ চলে এসেছে। মিষ্টির কানে সেটা একটুও লাগে নি। হি-হি করে হেসে উঠল।—গাছের ওপর তোমাকে ঠিক হনুমানের মতো লাগছে।
রাগ হতে পারত, কিন্তু মিষ্টির হাসি দেখতে বেশি মজা। কাঠবেড়ালের মতো তরতর করে গাছ থেকে নেমে এলো। — জঙ্গলের ভেতরে যাবি? চল, খুব ভাল লাগবে—
ভয়ে ভয়ে মিষ্টি জঙ্গলের ভিতর দিকে চোখ চালাল একবার। লোভ একটু হচ্ছে। বাবার লোকজনের সঙ্গে ময়নাগুড়ির জঙ্গলে গেছে। মজা লাগে আবার গা ছমছমও করে।—তুমি একলাই জঙ্গলের ভিতরে চলে যাও?
—হরদম যাই। তোর ভয় করছে?
—ভয় করবে কেন, মা জানতে পারলে বকবে না? তাছাড়া বারোখানা অঙ্ক করে রাখতে বলেছে, না হলে দেবে একেবারে
—কি অঙ্ক?
—কঠিন কঠিন অঙ্ক, দেখবে এসো না?
—তোর মা রাগ করবে না?
—রাগ করবে কেন, আমাকে বাইরে দেখলে বরং রাগ করতে পারে। তাছাড়া মা তো এখন ঘুমুচ্ছে —
অগত্যা বাপী ওর সঙ্গে কাঠের বারান্দায় চলে এলো। মিষ্টির কঠিন কঠিন অঙ্ক দেখে হাসিই পেয়ে গেল। পুচকে পুচকে যোগ-বিয়োগ-গুণ ভাগ।—এই অঙ্ক তোর! বারো মিনিটও লাগবে না, আমি উত্তর বলছি তুই লেখ—
এই প্রস্তাব পছন্দ। চটপট কাজটা সারা হয়ে গেলে গল্প করার সুবিধে। কিন্তু বই থেকে অঙ্কগুলো ঠিক-ঠিক খাতায় তোলার ঝামেলা আছে। চেয়ারে বসলে টেবিল বেশি উঁচু। মিষ্টি দাঁড়িয়েই কাজে মন দিল। বাপীও ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা হাত মিষ্টির ঝুঁকে পড়া পিঠের ওপর দিয়ে টেবিলের ওদিকে। মেয়েটা জানতেও পারছে না ওই হাতটা ওকে আরো কাছে আগলে রাখতে চাইছে। এত কাছাকাছি লাগালাগি হয়ে থাকতে এত ভাল লাগে দু মিনিট আগে বাপীও কি জানত! মিষ্টির গায়ে আর ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুলে ভারী একটা মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ। গন্ধটা আরো ভাল করে নিতে গিয়ে নিজের গালের সঙ্গে ওর মাথাটা ঠেকেই গেল একবার।
—আঃ, সরো না! কাঁধ আর কোমর দিয়ে মিষ্টি ওকে ঠেলে দিল একটু। মন দিয়ে সব কটা অঙ্ক আগে খাতায় তুলে ফেলেছে।
সরতে একটু হল বটে কিন্তু বাপীর অবুঝ একটা ইচ্ছে আরও বেড়ে গেল। ইচ্ছেটা ঠিক যে কি নিজেও জানে না।
অঙ্কগুলো এরপর টকাটক হয়ে গেল বটে। এত তাড়াতাড়ি যে মিষ্টি ভারী অবাক। বাপী চোখ দিয়ে দেখে, আর ওকে লিখতে বলে। মিষ্টির মনে হল বাপীর মত এমন অঙ্ক-বিশারদ আর হয় না। অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করল, সব রাইট?
—রাইটের বাবা।
মিষ্টি খুব খুশি। চুপি চুপি এও এক মজার খেলা সাঙ্গ হল যেন।—তুমি বলে দিয়েছ মা যেন কক্ষনো জানতে না পায়, তাহলে দুজনকেই ধরে দেবে—
মুখোমুখি চেয়ার পেতে গল্প করতে বসল দুজনে। বাপীর গল্প মানে জঙ্গলের গল্প। জঙ্গলে ঘুরতে কেমন লাগে। কাছাকাছির মধ্যে হামেশা কোন্ কোন্ জীবের দেখা মেলে। তাড়া করলে ওরা কিভাবে পালায়। কোনগুলোকে অনায়াসে পাথর ছুঁড়ে মারা যায়। ও কত মেরেছে। মিষ্টি ওর সঙ্গে জঙ্গলে গেলেই দুই-একটা মেরে দেখাবে।
ফাঁক পেলে এর পর মিষ্টিকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাবার মতলব। এই জন্যেই লোভ দেখানো।
—আর ওরা কেমন জোড় বেঁধে খেলা করে জানিস? কক্ষনো দুটো পুরুষ আর দুটো মেয়েতে খেলা করে না। একটা পুরুষ আর একটা মেয়ে—
মিষ্টি হাঁ করে ওর কথা শুনছে।
—বুঝলি না বোকা মেয়ে! যেমন ধর একটা পুরুষ খরগোশ আর একটা মেয়ে খরগোশ, একটা পুরুষ ময়ূর আর একটা মেয়ে ময়ূর, একটা পুরুষ সাপ আর একটা মেয়ে সাপ—
সাপ শুনেই মিষ্টির গায়ে কাঁটা দিল।—সাপেরাও খেলা করে? তুমি দেখেছ?
—দেখিনি আবার! এই সেদিনই তো দেখলাম দুটো পেল্লায় সাপ একটা আর একটাকে পেঁচিয়ে লেজে ভর করে লাঠির মত দাঁড়িয়ে আছে।…এটা অবশ্য ঠিক খেলা নয়, তুই বুঝবি না…
মিষ্টির দু চোখ বড় বড়।—মারামারি?
—দূর বোকা। না, আমার বলতে লজ্জা করছে…
সাপের কথা বলতে লজ্জা করবে কেন মিষ্টি ভেবে পেল না। লজ্জার কথা শুনে আরও কৌতূহল।—মারামারি না হলে কি বলো না?
—ভালবাসা-বাসি।
শুনেই মিষ্টি হেসে সারা। হাসির চোটে একঝাঁক চুল মুখের ওপর এসে গেল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেগুলো সরাতে সরাতে তেমনি হাসি আর অবিশ্বাসে ভেঙে পড়ে বলল, সাপ আবার ভালবাসে নাকি?
চুল সরানো মুখখানা রসে টইটম্বুর ফলের মত টুপটুপ করছে। গাল দুটো ধরে টিপে দিতে ইচ্ছে করছে বাপীর।
একটুও যদি বুদ্ধি থাকত তোর, পুরুষ সাপ মেয়ে সাপকে ভালবাসবে না কেন—এ কি মানুষ নাকি যে দেখলেই ছুবলে দেবে! আমার সঙ্গে জঙ্গলে এলে কত কি দেখতে পাবি।
—না বাবা, মিষ্টি মাথা দোলাল, আমার সাপ শুনেই ভয় করছে।
—আচ্ছা ভীতু মেয়ে তো, ও-সব সাপ-টাপ বা পাজী জানোয়ার সব বেশি জঙ্গলে থাকে, বুঝলি? তাছাড়া আমি সঙ্গে থাকলে আর ভয় কি!
বাপীর বিশ্বাস ভুলিয়ে-ভালিয়ে দুই একবার জঙ্গলে নিয়ে ঢোকাতে পারলে মিষ্টিও ওই জঙ্গলটাকে ওরমতই ভালবেসে ফেলবে। বানারজুলির জঙ্গল কেউ ভাল না বেসে পারে না।
কিন্তু সব উৎসাহের মুখে বড় রকমের হোঁচট খেতে হল। বেলা যে চারটে গড়াতে চলল, বাপী বা মিষ্টি কারোই খেয়াল ছিল না। দুপুরের ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা মুখে মেমসাহেব ঘর থেকে বেরুল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে কাঁটা বিঁধল। দুটো চেয়ার মুখোমুখি লাগানো। আর তাতে মুখোমুখি আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে দুজনে।
মেমসাহেবের ভ্রুকুটি দেখেই চোরের দায়ে ধরা পড়ল বাপী। নড়-চড়া ভুলে শুকনো মুখে একটা শাস্তির অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
ঝাঁঝালো গলায় মেমসাহেব প্রথমে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, অঙ্ক হয়েছে? মেয়েও ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। হয়েছে। তার ভয়, কি করে হয়েছে মা না সেটা বুঝে ফেলে।
এবারে বাপীর পালা। মেমসাহেবের ভুরুর ভাঁজ সোজা হয় নি তখনো।— তোর বাড়ি কোথায়?
একটা হাত তুলে বাপী শুধু রাস্তার দিকটাই দেখিয়ে দিল।
আরও ঝাঁঝালো গলায় মেমসাহেব বলে উঠল, মেয়েদের সঙ্গে তোর এত কি খেলা আর গল্প—যা বাড়ি যা—আর কক্ষনো যেন এভাবে না দেখি!
গেটের বাইরে পা দিয়ে বাপী হাঁপ ফেলে বাঁচল বটে, কিন্তু তার পরেই যত রাগ ততো দুঃখ। একটু আড়াল নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলোটাকেই দেখল খানিক। মিষ্টি তার মায়ের সঙ্গে ঘরে চলে গেছে। নিজের দোষেই এমনটা হল। খেয়াল করে ওই মহারাণীর ঘুম ভাঙার আগে সটকান দিলে এই গণ্ডগোল হত না।
পরের দুটো দিন সকালে আর স্কুল-ফেরত বাড়িতে না ঢুকে বাংলোটার সামনের রাস্তায় কতবার ঘোরাঘুরি করেছে, হিসেব নেই। বাইরের ওই কাঠের বারান্দায় সাহেব বা মেমসাহেবকে দেখলে সরে যায়। মিষ্টি ঠাণ্ডা মেয়ে নয় একটুও, যে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকবে। ওর দেখাও অনেক বার করে মেলে। আর বাপীর পা দুটো তখন ওই গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকতে চায়। মেমসাহেব না থাকলে গেটের কাছাকাছি এগিয়েও আসে। মিষ্টি তখন ওকে ঠিক দেখতে পায়। ওর সঙ্গে খেলা করতে বা গল্প করতে যে ভাল লাগে মিষ্টির, বাপী সেটা মুখ দেখলেই বুঝতে পারে। ফাঁক বুঝে হাতের ইশারায় বাপী ওকে গেটের বাইরে চলে আসতে বলেছিল। জবাবে মেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতের ছোট্ট বুড়ো আঙুল নেড়ে যা বোঝাবার বুঝিয়েও দিয়েছে। অর্থাৎ ওর আসাটা বা বাপীর সঙ্গে খেলা করাটা মা বরদাস্ত করবে না। ফিক ফিক করে হেসেওছে আবার। বাপী জ্বলতে জ্বলতে ফিরে গেছে।
একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বড়সাহেব আর মেমসাহেবের ডাঁটের ছেলে দীপুদার মন পেলে আবার ও-বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকা সহজ হতে পারে। সুদীপ নন্দী। বাবা-মায়ের আদরের নাম দীপু। একই স্কুলে ওর থেকে তিন ক্লাস ওপরে অর্থাৎ ক্লাস নাইনে পড়ে দীপুদা। বছরের চার মাস কেটে গেলেও স্কুলে ভর্তি হতে অসুবিধে হয় নি। বাপীর ধারণা বড়লোকের ছেলে বলেই হয় নি। জঙ্গলের জিপে চড়ে স্কুলে যায় জিপে চড়ে ফেরে। মিষ্টি তো কাছের চা-বাগানের মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাপী ভাবে খুব মজা ওর। সকাল আটটায় স্কুল, বারোটায় ছুটি। সমস্তটা দুপুর হাতের মুঠোয়। দীপুকে জিপে চেপে স্কুলে যেতে দেখে বাপীরও জিপে ওঠার লোভ খুব। কিন্তু এত দিন সাহস করে বলতে পারে নি।
তোয়াজ কি করে করতে হয় বাপীর একটু-আধটু জানাই আছে। বাবাকে দেখেছে, আবুর বাবা কালুকে দেখেছে, চা-বাগানের অনেক বাবুদেরও সাহেবকে তোয়াজ তোষামোদ করতে দেখে আসছে।
সেদিন স্কুল-গেটে জিপটা থামতেই বাপী ছুটে গেল। জিজ্ঞেস করল, তোমার বইখাতাগুলো আমি ক্লাসে দিয়ে আসব দীপুদা?
কেরানীবাবুর ছেলেকে দীপু বেশ চেনে। বাড়িতে বোনের সঙ্গে খেলা করতেও দেখেছে।
—কেন?
—তোমার কষ্ট হবে। তাই…।
তোয়াজটুকু মন্দ লাগল না। কিন্তু ধমকের সুরে মুখে বলল, ভাগ—।
মুখ কাঁচুমাচু করে টিফিনের সময় ফাঁক বুঝে আবার দীপুদার সামনে। —পিসী চমৎকার আমসত্ত্ব বানায় দীপুদা, আজ তোমার কথা বলতে অনেকটা দিয়ে দিয়েছে—আর পাকা কামরাঙাও আছে, খুব মিষ্টি—খাবে?
তার এক হাতে মস্ত একটা লোভনীয় কামরাঙা আর অন্য হাতে সোনা-রঙ আমসত্ত্ব খানিকটা।
ও-দুটো নিয়ে দীপু ওকে কৃতার্থ করল। খেতে খেতে মন্তব্য করল, বেশ তো…। কাল আবার আনিস—
পরদিনও ওই একই ঘুষ। সঙ্গে একটা বাড়তি টোপ।—আমাতে আবুতে জঙ্গল থেকে বন-মোরগ বা খরগোশ মেরে বাড়িতে দিয়ে আসব দীপুদা?
আবুকেও দীপুদার চেনা হয়ে গেছে।—দিস। মাকে বলব’খন আবুকে বখশিশ দেবে। দুই-ই খুব ভালো খেতে…
বাপীর বলার ইচ্ছে, আবু বখশিশ-টখশিশ নেয় না। বলা গেল না।
—তোর কোন্ ক্লাস রে?
—ক্লাস সিকস…!
এই মওকাতেই বুকের দম আটকে বাপী বলে ফেলে, রোজ পাঁচ মাইল করে হেঁটে আসতে-যেতে আমার খুব কষ্ট হয় দীপুদা, তোমাদের জিপে করে যদি আমাকে একটু
কথাটা আর শেষ করে উঠতে পারল না। তার আগেই দীপুদা কট কট করে বলে উঠল, ও…এই মতলবে আমার মন ভেজানো হচ্ছে। সাহস তো কম নয়, তোর সঙ্গে আমি এক জিপে আসব যাব?
বাপী চুপসে গেল। কিন্তু আমসত্ত্ব কামরাঙার লোভে হোক বা বন-মোরগ খরগোশ ভেটের আশায় হোক, দীপুদা একেবারে অনুদার হতে পারল না, বলল, আচ্ছা, এক কাজ করিস, আসার সময় মাইলটাক হেঁটে এসে রাস্তার এক জায়গা দাঁড়িয়ে থাকিস, আমি তুলে নেব—আবার স্কুলের আধ-মাইলটাক আগে নেমে যাবি। ফেরার সময় হেঁটেই যেতে হবে, উঁচু ক্লাসের এত ছেলের সামনে তোকে সঙ্গে নিতে পারব না।
বাপীর পিত্তি জ্বলে গেল। ও যেন চার পয়সা ভিক্ষে চেয়েছে আর বড়লোকের ছেলে দয়া করে একটা পয়সা দিলে। ওই জিপের দিকে বাপী যদি জীবনে আর ফিরেও তাকায়।
সাহেব বাংলোর দিকে মনটা পড়ে থাকার ফলে আবুর সঙ্গে কদিনের মধ্যে দেখাও হয় নি। সেই সজারু-ভোজের সন্ধ্যায় পর থেকে। ওকে দেখেই আবু ঠেস দিয়ে বলল, কি রে, সাহেবের মেয়ের সঙ্গে এত ভাব-সাব যে ইদিক মাড়াতেও ভুলে গেলি?
দোষটা প্রায় স্বীকার করে নিয়েই বাপী জিজ্ঞাসা করল, তুমি জানলে কি করে? —সেদিন ও-দিক দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম বাগানে মেয়েটার সঙ্গে খুব হুটোপুটি করছিস।
বিমর্ষ মুখে বাপী বলল, আর যাই না, বারণ করে দিয়েছে—
মুখ দেখে আর কথা শুনে আবুরও কৌতূহল।—কে বারণ করল?
—মেমসাহেব মহারাণী—আবার কে!
আবু হাসতে লাগল।—তুই হলি গিয়ে ওদের চোখে একটা কাক— পেখম লাগিয়ে দহরম-মহরম করতে যা আরো!
কাকের ময়ূরপুচ্ছ পরার গল্পটা বাপীও জানে। তবু আবুর কথায় মন খারাপ
হয়ে গেল। বলল, আমার ভাল লাগে যে—
—কি ভাল লাগে?
এবারে লজ্জা-লজ্জা মুখ বাপীর।—তুমি কাউকে বলবে না?
আবু মাথা নাড়ল। বলবে না।
আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
—আবুর হাঁ হবার পালা এবার।—কাকে রে?
—ওই মিষ্টিকে
—বলিস কি রে। ওই পুঁচকে মেয়ের যে চোখই ফোটে নি এখনো!
শুনে শুনে আবুর ঠাট্টা এখন বুঝতে পারে বাপী। আর আবুর কাছে লজ্জাশরমেরও ধার ধারে না। বলল, হলই বা ছোট বড় হবে তো?…ওর গায়ে আর চুলে কি মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ, আর হাতটাতগুলো যা নরম না!
—বা বা বা বা! এরই মধ্যে এতটা এগিয়েছিস! হাসতে হাসতে আবু বেশ জোরেই পিট চাপড়ে দিল।—লেগে থাক, লেগে থাক— ও মেয়ে বড় হলে খাসা দেখতে হবে ঠিকই, আর পছন্দ হলে তখন তোকে একটা বেয়ারা-টেয়ারা করে নেবে।
আবুর এই ঠাট্টায় বাপীর যথার্থ রাগ হয়ে গেল। ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে হন—হন করে চলে এলো।
বাংলোর সামনের রাস্তায় পা ফেলতে গিয়েও পিছু হটে সেই গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।…বারান্দায় সাহেব মেমসাহেব আর মিষ্টি। সাহেব মেমসাহেব কথা কইছে। মিষ্টি এক পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে হাত দুটো দু পাশে পাখির ডানার মত ছড়িয়ে বন-বন করে দফায় দফায় পাক খাচ্ছে। আর থেকে থেকে নিজের মনেই হাসছে।
বাপী দেখছে।
…বাংলোটা ওর চোখে রূপকথার দেশের কোন নিষেধের বাড়ির মতো কদিন ধরে সেই রকমই মনে হচ্ছে। মিষ্টিকে কিন্তু কোন রূপকথার রাজকন্যা ভাবা মুশকিল। রূপকথার মেয়েরা কখনো ফ্রক পরেছে শোনে নি, তাই মেলে না। না মিললেও ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। আর সাহেব-মেমসাহেবকে রাক্ষস-রাক্ষসীর মত কেটে কুচি কুচি করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
…রাক্ষস-রাক্ষসী কেটে ফেললে রূপকথার মেয়েরা খুশি হয়। হাসে কিন্তু বাবা-মাকে কাটলে মিষ্টি বোকা মেয়ের মতো ভ্যা-ভ্যা করে কাঁদবে।
সেই অবুঝপনার জন্যেই গাছের আড়ালে বাপীর দু চোখ রাগে বোঝাই।
.
হাতির নাম বনমায়া। বানারজুলি জঙ্গলের পোষা হাতি। কাঠ টানে। আর জিপ চলে না এমন জায়গায় যেতে হলে জঙ্গলের বাবুরা ওর পিঠে চাপে। পিঠে তখন হাওদা লাগানো হয়। বনমায়াকে বাপী জন্ম থেকে দেখে আসছে। ওর পিঠে চেপেওছে কত। বনমায়া নামটাও খুব মিষ্টি লাগে। চা-বাগানের সাহেব বাংলোয় একটা নেপালী মেয়ে কাজ করত। তার ওই নাম ছিল। বছর তিনেক অগে ওই মেয়েটাকে নিয়ে কি একটা হুজ্জত হয়েছিল খুব। এখানকার অনেক লোক সাহেবদের ওপর ক্ষেপে গেছল। আর তারপর থেকে সেই মেয়েটা একেবারে হাওয়া। বাপী তখন আরো কত ছোট। ভালো করে কিছু বুঝতেই পারে নি।
কিন্তু বাপীর মাথা এখন আর তত কাঁচা নয়। বনমায়া নাম থেকে নিজেই বুঝে নিয়েছে এটা মেয়ে হাতি। আবু হেসে বলে, বনমায়ার রূপ খুব। ওকে দেখলে চা-বাগানের আর জঙ্গলের কন্ট্রাক্টরদের মর্দা হাতি দুটো নাকি ছোঁক ছোঁক করে কাছে আসতে চায়। কিন্তু বনমায়ার রূপ যেমন দেমাক তেমন। কাউকে পাত্তাও দেয় না। রূপের কথা বনমায়ার মাহুত ভীম বাহাদুরও বলে। ভীম বাহাদুরের সঙ্গেও বাপীর মন্দ খাতির নয়। মাস গেলে মাইনেটা তো বাপীর বাবার হাত থেকেই নিতে হয়। তা বনমায়ার রূপ নিয়ে ভীম বাহাদুরেরও খুব গর্ব। এদিককার সব নেপালী আর অবাঙালী মেয়ে-পুরুষই মোটামুটি পরিষ্কার বাংলা বলে। ভীম বাহাদুরের জন্ম-কৰ্ম্ম সব এখানেই। বনমায়ার মাথা চাপড়ে ভীম বাহাদুরকে বাপী নিজের কানে বলতে শুনেছে, তোর মরদ খুঁজে বার করতে হলে আমাকে আফ্রিকার জঙ্গল ছুঁড়ে আসতে হবে।
আবুও শুনেছিল। সে হেসে সারা। কিন্তু বাপীর মাথায় কিছুই ঢোকে নি। পরে আবু খোলসা করে বলতে কিছু কিছু বুঝেছে।…বনমায়ার বয়েস নাকি মাত্র কুড়ি। আশী-নব্বুই একশ দেড়শ বছর পর্যন্তও বাঁচে হাতিরা। তা এই বয়সেই বনমায়ার সর্ব অঙ্গে রূপ ছুঁয়ে পড়েছে। আর স্বাস্থ্যখানাও তেমনি হয়েছে। প্রায় দশ ফুট উঁচু পাঁচ ফুটের মতো শুঁড়। ওর যুগ্যি বর সে-রকম জাঁদরেল মরদ হাতি এখানে কোথায় জুটবে? বরের খোঁজে তাই আফ্রিকায় যাবার কথা বলছিল ভীম বাহাদুর। এখানকার কোনো পোষা মরদ হাতির হাতে ও নাকি কখনো ওকে ছেড়ে দেবে না।
হাতির বর শুনে বাপীর হাসি পেয়ে গেছল। হাতির রূপ কাকে বলে অতশত বোঝে না। একটা হাতির সঙ্গে আর একটা হাতির তফাতও ভালো করে আঁচ করতে পারে না। তবে অনেক দেখার ফলে ছাড়া অবস্থায় একলা চড়ে বেড়ালেও বনমায়াকে ঠিক চিনতে পারে। আর বনমায়া তো ওকে চেনেই। দেখলেই শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম ঠোকে। কেরানীবাবুর ছেলেকে সেলাম করাটা ভীম বাহাদুর শিখিয়েছে।
রূপ না চিনলেও বনমায়ার মতো সভ্যভব্য ঠাণ্ডা জীব বাপী আর দেখে নি। হাজার দৌরাত্ম্যেও ওর মেজাজ গরম হয় না। শুঁড় ধরে ঝুলে পড়লেও ও মজা পায় আর দোলা দেয়। কলা বেল আখ শুঁড়ের কাছে ধরে বার বার সরিয়ে নিলে পিটপিট করে তাকায়, তারপর ঝাঁ করে ঠিক সময় কেড়ে নেয়। বাপী তখন রাগ দেখিয়ে চড়চাপড় ঘুষি বসিয়ে দেয়। কিন্তু বনমায়া তখন সাত চড়ে রা নেই এমন ঠাণ্ডা।
দেড় মাস আগে, আবুর কথায় যাকে বলে এই বনমায়ার নামেও কলঙ্কের ঢি ঢি পড়ে গেছল একেবারে। সেই বিষম ঘটনার আগের রাতে জঙ্গলের এ-ধারের আর আশপাশের অনেকেই একটা বুনো হাতির ডাক শুনেছিল। সে নাকি সাংঘাতিক ডাক। দল ছাড়া ক্ষ্যাপা বুনো হাতি ভয়ঙ্কর জীব। কাছে ঘেঁষবে কে?
দূরের জঙ্গলে বা পাহাড়ী এলাকায় দল-বাঁধা বুনো হাতির উপদ্রব নতুন কিছু নয়। ছোট পাহাড়ী নদীগুলোর নাম খোল। সেই খোলে ওরা জল খেতে আসে। একসঙ্গে অনেকগুলো পাহাড়ের দিক থেকে নেমে এসে এক-এক সময় জঙ্গল তছনছ করে, চাষের খেত মুড়িয়ে দেয়। ওদিকের লোকেরা তখন দল বেঁধে মশাল জ্বেলে ঢাক ঢোল কানেস্তারা বাজিয়ে হাতি তাড়ায়। ওদিকের ফরেস্ট গার্ডকেও তখন বন্দুক নিয়ে ছুটতে হয়। কিন্তু হাতির দঙ্গল এদিকের জঙ্গলে বা লোকালয়ে আসে না। আবু বলে, বুনো হলেও ওরা বুদ্ধি ধরে। চা-বাগান আর জঙ্গলের সব বাংলোগুলোতেই বন্দুক আছে। এদিকে এলে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে সে ওরা বেশ জানে। ক্ষ্যাপা হাতির কথা আলাদা। ক্ষেপে গেলে কারই বা কাণ্ডজ্ঞান থাকে। সেদিন ওটার হাঁকডাক শুনে জঙ্গলের কুঁড়েতে যারা থাকে তাদের রক্ত জল। ওটা হানা দিয়েছিল চা-বাগানের দিকে। ওটাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য বাগানের সাহেবরা তখন এক ধার থেকে জঙ্গলের দিকে রাইফেল ছুঁড়েছে। হৈ-হৈ কাণ্ড যাকে বলে। দূরে হলেও থমথমে বেশি রাতের সেই গুলির শব্দ আর হাতির ডাক বাপীরও শোনার কথা। কিন্তু বাপী বিছানায় গা দিল কি ঘুমে কাদা।
পরদিন সকালে সকলের চক্ষু ছানাবড়া। বনমায়ার পায়ের শেকল ছেঁড়া। বনমায়া হাওয়া। ভীম বাহাদুরের মাথা খারাপ হওয়ার দাখিল। পাগলের মতো বনমায়ার খোঁজে তামাম জঙ্গল চষে বেড়াল। সব দোষ এসে চাপল ওরই ঘাড়ে। বুনো হাতির ডাক শুনে ও কেন আগে থাকতে বন্দুক-অলা ফরেস্ট গার্ড এনে বনমায়াকে পাহারা দিল না। ভীম বাহাদুর যত বলে, বুনো হাতি এসে বনমায়ার শেকল ছেঁড়ে নি—তাহলে বনমায়াও চেঁচিয়ে একাকার করত, আসলে বনমায়াই নিজে শেকল ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে—আগের বড়সাহেব ততো রেগে যায়। চাকরি তো গেলই তার ওপর ওর বিচার হবে। একটা হাতি খোয়ানো কম ব্যাপার নয়। আবু চোখ টিপে হেসে হেসে বলেছিল, ভীম বাহাদুরের কথাই ঠিক। ওটা ছিল বুনো মস্তির প্রেমের ডাক। বনমায়া সাড়া না দিয়ে পারে নি।
তার আগেই ওর কাছ থেকে বাপীর বুনো জীব-জন্তুর প্রেমের পাঠ নেওয়া শুরু হয়ে গেছল। তখন পর্যন্ত মস্তি কথাটা শোনে নি। মস্তি কি?
আবু বলেছে, মরদ হাতির মাথায় প্রেম জাগলে বিষম ব্যাপার। তখন সঙ্গিনী না পেলে ক্ষেপে যায়। সেই সময় ওদের মাথায় আপনা থেকেই এক রকমের রস গড়ায়। ওই দশার সময় ওদের মস্তি বলে। কিন্তু দলছুট মস্তি সঙ্গিনী পাবে কোথায়? তখন আরো ক্ষ্যাপা দশা। পোষা হাতী দেখলে শিকল ছিঁড়ে দাঁতের ঘা মেরে মেরে ওটাকে টেনে নিয়ে যাবেই। না গেলে মেরে ফেলবে। আবুর মতে বনমায়ার দুর্জয় সাহস। নিজে থেকে নিঃশব্দে শেকল ছিঁড়ে ওই বুনো মস্তির সঙ্গে পালিয়েছে। পোষমানা মেয়ে হাতিরা তো বুনো মস্তিকে সাংঘাতিক ভয় করে।
সব জানা আর শোনার পর বাপীর বনমায়ার জন্য খুব চিন্তা হয়েছিল। বুনো মস্তি শেষ পর্যন্ত ওটাকে মেরেই ফেলে কিনা কে জানে। আর ভীম বাহাদুরের জন্য বেজায় দুঃখ হয়েছিল। পাগলার মতো ও তখনো বনমায়াকে খুঁজেই চলেছে।
তিন সপ্তাহ বাদে আবার এক দারুণ ব্যাপার। আর সেই ব্যাপারের নায়ক কিনা বাপী নিজেই। বনের পশু-পাখির কিছু ভালবাসাবাসি দেখার তাড়নায় ছুটির সেই নির্জন দুপুরে একলাই জঙ্গলে ঢুকেছিল। হঠাৎ দেখে দশ গজের মধ্যেই একটা হাতি! ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ভালো করে দেখবে কি, ভয়ে গায়ের রক্ত জল।
তার পরেই কি কাণ্ড। ও যে বনমায়া! ওই তো শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম করল ওকে! বাপী বিশ্বাস করবে না স্বপ্ন দেখছে?
আনন্দে আর উল্লাসে পাগলের মতো নাচই শুরু করে দিয়েছিল বাপী। আর ওর শুঁড় ধরে টানাটানি করে বলেছিল, চল শিগগীর চল, তোর জন্য এদিকে কত কাণ্ড!
কিন্তু বনমায়া কম বজ্জাত নয়। পাছে একলা গেলে মারধর খেতে হয়, বাপীর ধারণা সেই জন্যেই শুঁড়ে পেঁচিয়ে ওকে মাথায় তুলে বসিয়ে নিয়ে তারপর চলল।
কি মজাই না হল তারপর। যে দেখে সে হাঁ। বনমায়ার মাথায় চড়ে বাপী আসছে! কাতারে কাতারে লোক ছুটে আসতে লাগল। আর ভীম বাহাদুর তো বনমায়াকে দেখে কেঁদেই ফেলল। প্রথমেই রাগের চোটে ওর শুঁড়ে দুমদাম কটা ঘুষি। তারপর কান্না! শেষে সকলের সামনে বাপীকে জড়িয়ে ধরে কি আদর কি আদর!
শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে সেই বনমায়া আসছে জঙ্গল ধরে। ওর পিঠে হাওদা, তাতে মিষ্টি বসে, দীপুদা বসে আর বন্দুক হাতে ফরেস্ট গার্ড দেবকী দাস বসে। মাথার ওপরে ঘাড়ের দিকে ভীম বাহাদুর।
পরের রবিবারে সকালে জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে বড়সাহেবের বাংলোর দিকেই আসছিল বাপী। এই দৃশ্য দেখে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল।
বনমায়া গলা দিয়ে ঘোঁৎ করে একটু আনন্দ জানিয়ে শুঁড় উঁচিয়ে বাপীকে সেলাম ঠুকলে। তাই দেখে মিষ্টি আর দীপুদা অবাক। আনন্দে হাততালি দিয়ে মিষ্টি বলে উঠল, কি মজা দাদা, বাপীকে তুলে নে না, ও জঙ্গলের কত কি জানে—ও লোভ দেখিয়েছিল বলেই তো বাবা-মাকে ধরে আজ জঙ্গলে আসা হল—
দাদার হুকুমের পরোয়া না করেই ভীম বাহাদুর সানন্দে ডাকল, জলদি উঠে এসো বাপী ভাই, আজ বহুত মজা হবে।
রক্ত নেচে উঠলেও বাপী নড়ছে না। জিপে করে স্কুলে যেতে চাওয়ার অপমান ভোলে নি। দীপুদার মুখ দেখে মন বোঝার চেষ্টা।
জঙ্গলে ঢুকতে যাচ্ছে বলেই দীপুদার আজ উদার হতে বাধল না। একজন বাড়লে জোরও একটু বাড়ে। বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, উঠে আয়—
না, ওর ওঠার জন্য বনমায়াকে ওয়েট করানোর দরকার নেই। বাপী ওর শুঁড় বেয়ে তরতর করে উঠে এলো। ভীম বাহাদুরকে পেরিয়ে হাওদায় মিষ্টির গা ঘেঁষে বসে পড়ল। ওর বরাত বটে একখানা আজ। আনন্দের চোটে গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, দুর্গা দুর্গা—
মিষ্টির আবার খিল খিল হাসি।—দুর্গা দুর্গা কেন, আমরা কি শিকারে চলেছি?
বাপীর মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল তক্ষুনি। বলল, তা না, নাম নিলে যাত্রা ভালো হয়, গাছ থেকে তো অনেক সময় সাপ-টাপও লাফিয়ে পড়তে পারে—
—অ্যাঁ? শিউরে উঠে বাপীর সঙ্গে একেবারে লাগালাগি হয়ে বসল মিষ্টি। দীপু
এদিকের জঙ্গল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় তেমন। অস্বস্তি তারও, চোখ পাকালো—তুই ওকে ভয় দেখাচ্ছিস?
বাপীর মুখ আমসি। এক্ষুনি না ওকে আবার নেমে যেতে বলা হয়। সামাল দিল দেবকীনন্দন, কিছু ডর নাই ছোট হুজুর, তার আগেই আমি গুলি করে খতম করে দেব।
ফাঁড়া কাটল। বনমায়া হেলে দুলে চলেছে। আর তাইতে মিষ্টির ছোট্ট শরীর ওর গায়ে কেবলই ঠোক্কর খাচ্ছে। তাছাড়া লেগেই বসে আছে ওর সঙ্গে। মেয়েটার শরীরের হাড়গোড়সুদ্ধ নরম। চুরি করে বেশ বড় বড় নিঃশ্বাস টানছে বাপী। মিষ্টির গায়ের গন্ধ, আর চুলের গন্ধ।
দেবকীনন্দন কত রকমের জানোয়ার আছে এই জঙ্গলে দীপুদাকে শোনাচ্ছে। নটখট জানোয়ারের মধ্যে চিতাবাঘ, ভালুক, বুনো শুয়োর, বুনো হাতি, বনবেড়াল—ঢাউস সাপ—এই সব।
চকিতে বাপীর মাথায় আবার এক মতলব খেলে গেল—দীপুদা, আবুকে তুলে নিই চলো। তাহলে দারুণ হবে—ভালুক-টালুক এসে গেলে ও কেমন নেমে গিয়ে তাড়া করে দেখবে—কোথায় কোন্ রকমের জানোয়ার থাকে ও সব জানে। সঙ্গে সঙ্গে আরো লোভের টোপ ফেলল, তাহলে আজই খরগোশ বা বন—মোরগও ঠিক পেয়ে যাবে—
আবু ছেলেটা যে ডাকসাইটে দীপুর জানা হয়ে গেছে। এখানকার নতুন বন্ধুদের মুখে শুনেছে। প্রথম দিনের সেই সজারু মেরে আনাটাও ভোলে নি। তাছাড়া ওর বাবা কালু তো ওকে তার বড়সাহেবের কাছে বাংলাতে এনে হাজির করেছিল। সাহেবকে ছেড়ে আবু দীপুকেও বুকে মাথা ঠেকিয়ে . আদাব জানিয়েছিল। একটা দুটো বনমোরগ নিয়ে বাংলোয় ফিরলে বাবা-মাও খুশী হবে। এদিকে বন-মোরগ মারার মজাটাও মন্দ হবে না। তাছাড়া অচেনা জঙ্গলে তার মতো একটা ছেলে থাকলে আরো নিশ্চিন্দি।
তবু ইতস্তত ভাব একটু—তুলে এনে বসাবি কোথায়, এই হাওদার মধ্যে গ্যাজা-গেঁজি হয়ে বসতে পারব না।
বাপী বুঝল আসলে বাবুর মানে লাগছে। ব্যস্ত হয়ে বলল, সে তুমি কিচ্ছু ভেব না দীপুদা, আবু ঠিক ভীম বাহাদুরের পাশে জায়গা করে নেবে।
আবুকে তুলে নেওয়ার কথায় ভীম বাহাদুরও তক্ষুনি সায় দিল। বলল, হাঁ, ঠিক হোয়ে যাবে ছোট সাব, বনমায়া কি ছোট মেয়ে।
নিজের নাম শুনেই হাতিটা কান খাড়া করল। আর ছোট মেয়ে শুনে মিষ্টির খিল-খিল হাসি। হাসলেই ওর ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা বাপীর বুকে ঠেকছে।
দীপুই কর্তাব্যক্তি এখানে। আবেদন মঞ্জুর করল, ডেকে নে তা হলে, কতদূর?
হাতিতে চেপে গেলে কি আর দূর, ভীম বাহাদুর চলো। সোনায় সোহাগা গোছের আনন্দ বাপীর।
আবু কতটা খুশী দেখে বোঝা ভার। সাহেবের ছেলে সঙ্গে আসতে বলেছে শুনে তেরছা চোখে বাপীর দিকে তাকালো। মিষ্টির দিকেও। উল্লাস মাখা চোখ দুটো দিয়েই বাপীর ওকে আনার তাগিদ। ঘর থেকে নিজের লাঠিখানা নিয়ে আবু এসে হাতির শুঁড়ে চেপে বসল। সকলের আনন্দ ষোল কলায় পূর্ণ।
আনন্দের হুল্লোড়ের মধ্যে তিনটে ঘণ্টা কোথায় দিয়ে কেটে গেল। আবুকে নিয়ে বাপীর গর্ব সার্থক। দীপুদা আর মিষ্টি দুজনই ওর তারিফ করেছে। আবুর কথামতো হাতি নিয়ে এক এক দিকে হানা দেবার ফলে ওরা দু’দুটো ভালুক পালাতে দেখেছে। একটা বুনো শুয়োর দেখেছে। বুনো শূয়োরটার-বেজায় রাগ, আবুর দিকে তেড়ে এসেও শেষে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে জঙ্গলে ঢুকে গেল। আবু তখন হাতির শুঁড় ঘেঁষে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। একলা পেলে ওই বুনো শূয়োর ওকে আস্ত রাখত না। হাওদায় বসে থাকলেও মিষ্টির গা ছমছম করছিল, ভালুক আর ওই শূয়োর দেখে এক হাতে বাপীকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছিল। বরাত-জোরে একটা বাঘ-টাঘ যদি বেরিয়ে পড়ত, নিদেনপক্ষে কাছাকাছির মধ্যে কোথাও বাঘের গর্জন-টর্জনও যদি শোনা যেত, মিষ্টি তাহলে দু’হাতেই ওকে জাপটেমাপটে ধরত বোধ হয়। লাগালাগি হয়ে তো বসেই আছে, তাছাড়া আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টির অজান্তে কতবার যে ওর পায়ে পিঠে কোমরে হাত দিয়েছে বাপী, সে শুধু ও নিজেই জানে।
বুনো শুয়োর দেখার পর দেবকীনন্দন আর ঘন জঙ্গলের দিকে যেতে রাজি হয় নি। বড়সাহেবের বকুনির ভয় আছে। ফেরার সময় আবুর সঙ্গে বাপীও কিছু কেরামতি দেখাতে পেরেছে। তিন-তিনটে বন-মোরগ মারা হয়েছে, তার মধ্যে হাতির পিঠ থেকে নেমে একটা ও মেরেছে। বাকি দুটো আবু। খরগোস মারা গেল না। দীপুর একটা হরিণ মারার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাহেবের হুকুম ভিন্ন দেবকীনন্দন রাজি হল না। শিকারের ব্যাপারে রিজার্ভ ফরেস্টের আইন-কানুন সে-সময়েও ছিল। কিন্তু শিকারীরা সে-সময় আইনের পরোয়া বড় একটা করত না। কিছু টাকা খসালেই ফরেস্ট গার্ডের মুখ সেলাই। কিন্তু খোদ বড়সাহেবের ছেলের সঙ্গে এসে দেবকীনন্দন আইন অমান্য করে কি করে।
সকলের সঙ্গে এইদিন বাপীও নির্ভয়ে বড়সাহেবের বাংলোয় ঢুকতে পেরেছে। বন-মোরগ নিয়ে দীপুদা যেন দিগ্বিজয় করে ঘরে ফিরেছে। তিন-তিনটে বন-মোরগ দেখে মেমসাহেবও খুশি। তার মধ্যে একটা বাপী মেরেছে মিষ্টি সে-খবরও তার মাকে জানিয়ে দিল। বাপী আশা করেছিল, মেমসাহেব একটা মোরগ অন্তত ওকে আর আবুকে দিয়ে দেবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
বাপীর তা বলে আফসোস নেই খুব। বাধা নিষেধ ঘুচল ভেবে আনন্দে আটখানা। মিষ্টিকে এক ফাঁকে জানিয়ে দিল, দুপুরে খেয়ে-দেয়ে আবার সে আসছে। বলেই ছুট। আবু আগেই বেরিয়ে এসেছিল। তাকে ধরল।
আবু ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো ওর দিকে। গম্ভীর। কিন্তু ভিতরে হাসছে বোঝা যায়। একটা চোখ ছোট করে বলল, কি করে, খুব মজা লুটলি বুঝি আজ— মেয়েটাকে তো কোলে সাপটে নিয়ে বসেছিলি দেখলাম—
বারো বছরের জীবনে বাপী এত আনন্দ আর পেয়েছে কিনা জানে না। অচেনা গোছের ভারী অদ্ভুত স্বাদ এ আনন্দের। শরীরটার ভেতর পর্যন্ত নরম-নরম একটা স্পর্শ এখনো ছড়িয়ে আছে। আবুর কথা শুনে লজ্জা পেল। এক ও ছাড়া আর সকলের চোখে ধুলো দিতে পেরেছিল। এমন কি ওই বোকা মেয়েটার চোখেও।
আবু এবারে নিজে থেকেই মন্তব্য করল, তোর স্বভাবচরিত্তি আমার থেকে ভালো বলতে হবে—
আবুর কোনো কথাই বাপীর কাছে হেলা-ফেলার নয়। ঠাট্টা হলেও না। মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা।—কেন?
—একটা দুধের মেয়েকে নিয়ে দিব্বি মেতেছিস। তোর মতো বয়সে আমার ষোল-আঠারো বছরের মেয়েগুলোকে ভালো লাগত।
বাপী বিমূঢ় একটু। আবু এখন বড় জোর সতের পেরিয়েছে। বাপীর বয়েসে মানে বারো বছর বয়সে ষোল-আঠারোর মেয়েদের ভালো লাগত! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে এখন?
—এখন কি?
——এখন কোন্ বয়সের মেয়েদের ভালো লাগে?
ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আবু।—আর বলিস না, আমার বারোটা বেজে গেছে। বয়েস-টয়েসের ধার ধারি না, ভালো এখন শুধু একটা মেয়েকেই লাগে—কিন্তু ভীম বাহাদুর টের পেলে আমার মুখ থেঁতো করে দেবে—
শুনে বাপী হাঁ একেবারে।—কেন? কোন্ মেয়েকে ভালো লাগে তোমার?
—বনমায়াকে। মানুষের মেয়ে-টেয়ে আর ভালো লাগে না। অমন ডাকাবুকো প্রেম ওই বজ্জাতের মতো আর কোনো মেয়ে জানে না। ডর-ভয়ের মাথা খেয়ে একুশ দিনের মধ্যে একটা বুনো মস্তিকে ঠাণ্ডা করে ঘরের মেয়ে আবার ঘরে ফিরে এলো—চাট্টিখানি কথা!
বাপী এরপর হেসে বাঁচে না। ঘরে ফিরেও আবুর হাতি-মেয়ে প্রেমে পড়ার কথা যতবার মনে এসেছে, কেবল হেসেছে।
কিন্তু আবুর ঠেসের কথায় বাপী একটুও হতাশ হয় নি। মিষ্টিটা ছোটই বটে। কিন্তু যে মিষ্টিকে ওর খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে সে যেন ঠিক অত ছোট নয়। বাপী নিজেও তো সকলের চোখে কত ছোট, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও কি আর তেমন ছোট? মিষ্টিরও দেখতে দেখতে আর একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হবে। আর, আবু তো নিজেই বলেছে বড় হলে ওই মেয়ে খাসা দেখতে হবে।
পিসীর চোখে ধুলো দিয়ে সময় হিসেব করে বাপী দুপুরে আবার মিষ্টিদের বাংলোর সামনে হাজির। কিন্তু সামনের বারান্দা ফাঁকা। এই হিসেবে গরমিল দেখেই বাপীর মেজাজ গরম। দুটো বেজে গেছে, চারটের মধ্যেই তো ওর মা মহারানী দিনের ঘুম সাঙ্গ করে হেলে দুলে ওই বারান্দায় এসে দাঁড়াবেন। গেটটা ধরে বাপী শূন্য কাঠের বারান্দার দিকে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু ঘরের জানলা দিয়ে মিষ্টি ওকে ঠিকই দেখেছে। বাবা নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ওদিকে মায়েরও পাকা ঘুমের ঘন নিঃশ্বাস। মিষ্টির ওপরেও মায়ের আজ একটু ঘুমোনোর হুকুম ছিল। দাদা যে ছুটির দিনে আড্ডা দিতে বেরোয় সেটা কিছু নয়। ঘুম-টুম ধারে কাছে নেই মিষ্টির। উপুড় হয়ে শুয়ে মুখ তুলে জানলা দিয়ে গেটের দিকে দেখছিল।
পা টিপে বিছানা থেকে নেমে এলো। তারপর বারান্দায় এসেই ফিক করে হাসি। এই লুকোচুরির দেখাশুনার মধ্যে বেশ মজা আছে।
মজার ছোঁয়া বাপীর মুখেও। হাত তুলে মিষ্টিকে কাছে আসতে ইশারা করল। মিষ্টি দ্বিধায় পড়ল একটু। ওর ইচ্ছে বাপী আসুক। কিন্তু গেল সপ্তাহে ওকে এখানে এনে বসানোর ফলটা ভালো হয় নি মনে আছে। দেড় দু’-ঘণ্টা এখন আনন্দে কাটানোর ইচ্ছে ওরও।
গেটের কাছে আসতে এ-ধার থেকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি কচ্ছিলি?
—মায়ের কাছে শুয়ে ছিলাম, আর তুমি আস কিনা জানলা দিয়ে দেখছিলাম—
—মা কি কচ্ছে?
—মা-বাবা দু’জনেই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে—ভারী খাওয়া হয়েছে তো।
—খুব মুরগির মাংস সাঁটালি বুঝি?
মিষ্টির মুখে এখনো জল গড়ানোর দাখিল। কি সুন্দর খেতে, মা নিজে রান্না করল। দাদা তো নিজে পেট ঠেসে খেয়ে টিফিন বাক্সয় করে তার বন্ধুর জন্যেও নিয়ে গেল—
বাপী এবারে ঠেস দিতে ছাড়ল না। বলে উঠল, আমরা মেরে এনে দিলাম আর নিজেরাই স্বার্থপরের মতো খেলি—আমাদের কথা একবার মনেও পড়ল না?
মিষ্টি বিপাকে পড়ল। বাপী বলার পরে মনে হল ওদেরও দেওয়া উচিত ছিল। বলল, মা না দিলে আমি কি করব…এখনো আছে বোধ হয়, মা ঘুম থেকে উঠলে তোমাকে দিতে বলব?
—আমার খেতে বয়ে গেছে, আমি কি ভিখিরি? শব্দ না করে শেকল সরিয়ে আস্তে আস্তে গেটটা খুলল।—নে, বেরিয়ে আয় চট করে, জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে খেলা করিগে চল্।
কিন্তু মিষ্টির অত সাহস নেই।—মা জানতে পারলে রক্ষে রাখবে না।
—তুই আচ্ছা ভীতু। মা জানছে কি করে, তার ঘুম ভাঙার ঢের আগেই তুই চলে আসবি। তোকে নিয়ে কি আমি দূরে যাব নাকি, কাছেই খেলা করব— জঙ্গলের মতো মজা আর কোথাও আছে নাকি, নিজেই তো দেখলি!
মিষ্টি তবু ভয় পাচ্ছে দেখে এবারে রেগেই গেল।—মায়ের পাশে শুয়ে তুইও তাহলে ঢেপসির মতো ঘুমোগে যা—মুরগির মাংস খুব ভালো হজম হবে’খন— স্বার্থপর মেয়ে কোথাকারের, আর কক্ষনো যদি আসি।
গেট ছেড়ে বাপী রাস্তাটার ওপারে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ভাবখানা এক্ষুনি ও একলাই জঙ্গলে নেমে যাবে।
বাপীকে অন্তত না দিয়ে নিজেদের মুরগির মাংস খাওয়াটা যে স্বার্থপরের কাজ হয়েছে মিষ্টি এখন আর সেটা অস্বীকার করে কি করে। তাছাড়া সকালে ওই ছেলের সঙ্গে জঙ্গলে ঘোরার মজাটাও কম হয় নি। ও চলে গেলে সত্যি খারাপ লাগবে। রাগ করে যদি আর না আসে তাহলে আরো খারাপ লাগবে।
একটা হাত তুলে বাপীকে দাঁড়াতে বলল। তারপর হালকা পায়ে ছুটে বাংলোয় উঠে গেল। বাবা মা কেমন ঘুমোচ্ছে উঁকি দিয়ে দেখে নিল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ছুটে চলে এলো। সন্তর্পণে গেটের শিকলটা তুলে দিয়ে সেও রাস্তার এ—ধারে। উত্তেজনায় বুকের ভিতরে টিপটিপ
মিষ্টির একটা হাত বাপীর দখলে। তরতর করে রাস্তার ঢল বেয়ে নেমে চোখের পলকে দু’জনে জঙ্গলের আড়ালে। মিষ্টির গা ছমছম করছে। এখন তো আর বড় কেউ সঙ্গে নেই। ভিতরে পা দিয়েই মনে হল জঙ্গলটা ভীষণ নিরিবিলি এখন।
বাপীর বুঝতে দেরি হল না। হাতির পিঠে বসেই ভালুক আর বুনো শুয়োর দেখে ওই মেয়ে ওকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছিল। ওর যেন সুবিধেই হল।
—ভয় করছে বুঝি?
মিষ্টির স্বীকার করতে আপত্তি, আবার একেবারে অস্বীকারও করতে পারছে না।
—দূর বোকা মেয়ে, আমি তো সঙ্গে আছি। হাত ছেড়ে বাপী এবারে ওর কাঁধ ধরে নিজের গায়ের সঙ্গে আগলে নিয়ে পা বাড়ালো।
ভয়-ডর কিছুক্ষণের মধ্যেই মিষ্টিরও উবে গেল। দুটো রঙচঙা প্রজাপতির পিছনে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। পাথর হাতে করে গাছের ডোরা-কাটা কাঠ—বিড়ালিও তাড়া করল দু’জনে। একটা খরগোস ও-দিক ফিরে গাছের কচি পাতা খাচ্ছিল, একেবারে একটুর জন্যে বাপীর ঢিলে থেঁতো হবার হাত থেকে বেঁচে গেল।
এ এক ভিন্ন রোমাঞ্চ। ছোটাছুটির ফলে মিষ্টি অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। বাপীর চোখে তাও মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। ফোলা ফোলা গাল দুটোতে এখন যেন আলগা রং লেগেছে। চুলের গোছা মাঝে মাঝেই মুখে এসে পড়ছে। বাপী লক্ষ্য রাখছে, ফাঁকে পেলে ওর আগে নিজে হাত বাড়িয়ে সেগুলো পিছনে সরিয়ে দিচ্ছে।
এরপর একটা গাছের বুক-সমান নীচু মোটাসোটা ডাল বেছে নিয়ে বাপী দু’হাতে ভর দিয়ে সেটার ওপর লাফিয়ে উঠে বসল। তারপর ঝোলানো পা দুটোকে শক্ত করে একটু ঝুঁকে মিষ্টির হাত দুটো ধরে হুকুম করল, নে, পায়ের ওপর পা দিয়ে উঠে চলে আয়।
মিষ্টির এখন সবেতে আনন্দ। গাছের ডালে কখনো চড়ে নি বা বসে নি। বাপীর হাত ধরে ওর পা বেয়ে উঠতে চেষ্টা। খিল খিল হাসি। ওঠা হল, এখন হাত ছেড়ে বাপীর পাশে গাছের ডালে বসে কি করে?
কি করে বসবে রাপী সেটা ভালোই জানে। একটা হাত ছেড়ে কোমরের কাছটা জড়িয়ে ধরে নিজের কোলের ওপর টেনে নিয়ে এলো ওকে। মুখে মুখে ঠেকল, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি। তারপর দু’হাতে একরকম জাপটে ধরেই পাশে ডালের ওপর বসিয়ে দিল।
মিষ্টি আনন্দে আত্মহারা। আর আনন্দের সঙ্গে বাপীর হাড় মাংসের মধ্যে আরো অচেনা কিছুর ঝিলিক। গাছে বসার পরেও এক হাতে নিজের গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে।
কিন্তু মিষ্টির এখন সাহস খুব।—আঃ, সাপটে ধরে আছ কেন, ছাড়ো না! জবাবে একটু ধমকের সুরে বাপী বলল, হ্যাঁঃ, পড়ে গেলে তখন? তোর কি অভ্যেস আছে? পড়ে গিয়ে ওই ননীর শরীর একটু ছড়ে গেলে তোর মা আস্ত রাখবে আমাকে? গাছে একটা বাঁদর-টাদর এসে বসলেই তো তুই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবি।
মিষ্টি সভয়ে গাছের ওপরটা দেখে নিল একবার।—বাঁদর এসে বসবে নাকি?
বাপী যথাসম্ভব গম্ভীর।— আমি থাকলে ভয় নেই, এখানকার বাঁদরেরা আমাকে ওদের হেডমাস্টার ভাবে।…বাড়ির থেকে এখানে তোর ভালো লাগছে কিনা বল—
সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টির অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস।—খু-উ-ব ভালো লাগছে। সকালেও ভালো লেগেছিল। বাড়িতে কিচ্ছু মজা নেই।
সোৎসাহে বাপী বলল, তাও তো এখন পর্যন্ত কিছুই দেখিস নি তুই। জঙ্গলে জীব-জন্তুরা যে কি-কাণ্ড করে না!
ওদের ভাল-বাসাবাসির ব্যাপারটা বলতে গিয়েও বলল না। হাঁদা মেয়ে বাড়ি গিয়ে, যদি আবার কাউকে বলে দেয় তাহলে চিত্তির। জোরে শ্বাস টানল বার কয়েক। মিষ্টির চুলের গন্ধ আর গায়ের গন্ধ। সকালে আবু ঠাট্টা করে বলছিল, হাওদার ওপর ও নাকি মিষ্টিকে কোলে সাপটে নিয়ে বসেছিল। না অতটা পারে নি। ওকে গাছে টেনে তোলার সময় বরং ঢের বেশি চালাকি করা গেছে। সেই চালাকির ঝোঁকটাই মাথায় চেপে বসছে আবার।
—তোর চুলে আর গায়ে সুন্দর গন্ধ…কি করে হল রে? কি মাখিস?
মিষ্টি বলল, চুলে মা গন্ধ তেল মাখিয়ে দেয়, চানের সময় গায়ে সাবান ছাড়া আর তো কিছু মাখি না—
বাপী ওর গলার নীচে নাক ঠেকিয়ে জোরে দু’বার শ্বাস নিল। তারপর মন্তব্য করল, তোর গায়েও সুন্দর গন্ধ।
নিজের বুকে চিবুক ঠেকিয়ে মিষ্টি বুঝতে চেষ্টা করল কি-রকম সুন্দর গন্ধ! তারপর বলল, আমি তো পাচ্ছি না!
বাপী বলল, নিজেরটা নিজে পাওয়া যায় না বোধ হয়, আমার পাস কিনা দেখ্ তো।
মিষ্টি ওর বুকে নাক ঠেকিয়ে জোরে শ্বাস টেনেই মুখটা বিকৃত করে ফেলল।—
এঃ, বিচ্ছিরি ঘামের গন্ধ!
রাগ না করে বাপী হাসতে লাগল। বলল, আমি তো ছেলে, বুঝলি না— ছেলেদের গায়ে কি মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ মানায়!
আনন্দে যত বিভোর হোক, আজ সময়-জ্ঞান ভোলেনি বাপী। ধরা পড়লে আজকের আনন্দ তো মাঠে মারা যাবেই, পরেও আর কোনো আশাই থাকবে না। লাফিয়ে ডাল থেকে মাটিতে নেমে পড়ল। তারপর দু’হাত বাড়িয়ে মিষ্টিকে ডাকল, আয়।
ওর মতো লাফিয়ে নামতে পারে কিনা মিষ্টি একবার দেখে নিল। লোভ হচ্ছে, কিন্তু খুব ভরসা পাচ্ছে না। সেটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর গলায় শাসনের সুর।—হাতে পায়ে লেগে গেলে জঙ্গলে ঘোরার মজা একদিনেই শেষ—চলে আয়।
দু’দিকের পাঁজর ধরে বাপী নিজের বুকের ওপর টেনে নামালে ওকে। তারপর তক্ষুনি মাটিতে না নামিয়ে সেই ভাবেই দশ বারো পা এগিয়ে গেল। বুক ছেড়ে মুখের সঙ্গেও মুখ ঠেকে আছে। এবারে মিষ্টির অস্বস্তি।—মাটিতে নামাচ্ছ না কেন!
—দাঁড়া, পিঁপড়ের ডাঁই-ফাই দেখেছিলাম ও-দিকটায়। দাঁড়িয়ে গেল। মুখে হাসি।—আমার গায়ে কত জোর জানিস, তোকে আমি এমনি করে ওই রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি—যাব?
—না—না। মিষ্টি এবারে হিঁচড়ে নেমে এলো।—আমি কি ছোট, কেউ দেখে ফেললে?
মাটিতে নেমে গেলেও বাপী ওর হাতের ওপর দখল নিতে ছাড়ল না। রাস্তার কাছাকাছি এসে হাতও ছাড়ল।—শোন, বাড়িতে কাউকে কিছু বলবি না কিন্তু খবদ্দার!
ঠোঁট উল্টে মিষ্টি জবাব দিল, কি বুদ্ধি তোমার, বললে তো মা আমাকেই আগে ঠেসে বকুনি লাগাবে।
ছুটে রাস্তায় উঠে গেল। বাপীও এগিয়ে এসে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে। সন্তর্পণে গেট খুলে আবার শেকল লাগিয়ে দিয়ে মিষ্টি চোরের মতোই বাংলোয় উঠে গেল। ঘরের মধ্যে একবার উঁকি দিয়ে একমুখ হেসে আবার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। গাছের আড়াল থেকে বাপীও গলা বাড়িয়েছে। হাত নেড়ে মিষ্টি বুঝিয়ে দিল, বাবা-মা এখনো ঘুমোচ্ছে।
বাপী হাওয়ায় ভেসে বাড়ি চলল। আবুটা শুনলে কি বলবে ভাবছে আর হাসছে। সেই সঙ্গে একটা অবুঝ আনন্দ ভিতর থেকে উপচে পড়তে চাইছে। এটা কি রকমের আনন্দ বা এ-রকম কেন হয় বাপীর কাছে এখনো খুব স্পষ্ট নয়।
…তবে আবুর একটা কথা ঠিক, মিষ্টিটা এখনো বড্ড ছোট। আজ এত কাণ্ড হয়ে গেল, ও কিছু বুঝতেই পারল না। তাই ওর এই আনন্দের এক ফোঁটাও ভাগ পেল না।
…বাপীর যদি সে-রকম মন্ত্র-টন্ত্র কিছু জানা থাকত, মিষ্টিটাকে তাহলে রাতা—রাতি আর একটু বড় করে ফেলত।
.
ঠিক এক বছরের মাথায় বনমায়াকে নিয়ে আবার একপ্রস্থ হৈ-চৈ। আর তার এক মাসের মধ্যে ওর মাহুত মন-মরা ভীম বাহাদুরের আশা আর ভবিষ্যদ্বাণী দুই-ই তাক লেগে যাওয়ার মতো সফল।
বনমায়া আবার পালিয়েছে। এক মাস না যেতে ঠিক আগের বারের মতো একা নিজেই আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর এবারের পালানোটা একেবারে অন্যরকম। এবারে আর জঙ্গলের কেউ বা আশপাশের বন্দুক-অলা সাহেবদের কেউ দ্বিতীয় কোনো বুনো হাতির হাঁকডাক শোনে নি। এদিকে প্রথমবার পালানোর ফলে বনমায়ার পায়ের শেকল বদলে ঢের শক্ত-পোক্ত শেকল আনা হয়েছিল। পেল্লায় শাল-গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা সেই শেকল ছেঁড়া একলা বনমায়ার কর্ম নয়। একলা যে ছেঁড়ে নি তারও প্রমাণ মিলেছে। আগের রাতে অল্প অল্প বৃষ্টি হয়েছিল। সেখানকার মাটিতে বনমায়া ছাড়া আরো একটা হাতির পায়ের ছাপ দেখা গেছে। আর জঙ্গল থেকে দূরের পাহাড়ের দিকে পাশাপাশি দুটো হাতি চলে যাওয়ার হদিসও মিলেছে।
মোট কথা, এটা স্পষ্ট বোঝা গেছে, বুনো মরদ হাতিটা এবার নিঃশব্দে এসেছে। দুজনে মিলে শিকল ছিঁড়ে তেমনি নিঃশব্দে একসঙ্গে পালিয়েছে। এই পাহাড়ী জঙ্গল এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই দিব্বি ঠাণ্ডা পড়ে। সাহেব-সুবোরা বিলিতি আর জঙ্গল বা চা-বাগানের নিচের ধাপের জোয়ান-বুড়োরা দিশী মদ টেনে পাকা ঘুম লাগায়। বড় রকমের হাঁক-ডাক না হলে এমনিতে তাদের অসময়ে ঘুম ভাঙার আশা কম।
বড়সাহেব সন্দীপ নন্দী গেল বছরের হাতি পালানোর ফিরিস্তি শুনেছেন। এবারে এমন নিঃশব্দে পালানোয় ব্যাপারটা নিজে চাক্ষুস তদারক করে ভীম বাহাদুরের খুব একটা দোষ খুঁজে পেলেন না। কিন্তু মরা হাতির দাম যেখানে লাখ টাকা, সেখানে পোষা জ্যান্ত হাতি পালালে সরকারী কৈফিয়তে দোষ-ত্রুটি তো কিছু বার করতেই হবে। হাতি তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে অতএব কারো দোষ নেই এ-কথা লিখতে পারেন না। ও-দিকে চোখের জল ফেলে আর দু-হাত জোড় করে ভীম বাহাদুর যা বলছে তাতে তড়িঘড়ি শাস্তি দেওয়া দূরের কথা, গম্ভীর থাকা দায়। তার আর্জির সার কথা, সাহেব যেন নারাজ না হন, সে নিরপরাধ হলেও দোষ মেনে নেবে যদি না বনমায়া ফিরে আসে। গা জুড়োলেই বনমায়া ফিরে আসবে। আসবেই।
ওর সমব্যথী ফরেস্ট গার্ড আর বীটম্যানদেরও সেই বিশ্বাস। অতএব বড়সাহেব তদন্তসাপেক্ষ রিপোর্ট দিয়ে বিচার স্থগিত রেখেছেন। আর মুখে ভীম বাহাদুরকে বলেছেন, ভালো করে তল্লাসি চালিয়ে যেতে, না পেলে মুশকিল হবে।
ভীম বাহাদুরের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ করে গেলবারের মতোই, এক মাসেরও আগে বনমায়া যেমন নিঃশব্দে গেছিল তেমনি নিঃশব্দে আবার ফিরে এসেছে। আর রাগের চোটে ভীম বাহাদুর পাগলের মতো কাণ্ড করেছে। ঘর থেকে ডাঙশটা এনে ওর মাথায় চেপে বসে এলোপাথারি মার শুরু করেছিল। বনমায়াও তেমনি গাঁ-গাঁ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। ভীম বাহাদুরের একটা পা ধরে টেনে আবু ওকে হিঁচড়ে নামিয়েছে। তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছে, কি বুদ্ধি তোমার, প্রেম মাথায় চড়লে ও পালাবেই, কিন্তু এরকম মার খেলে আর ফিরে আসবে?
ওর যুক্তির কথা শুনে বনমায়াকে ভীম বাহাদুরের এরপর সে কি আদরের ঘটা।
কত কি আছে যা ভাগ না করলে ভোগের আনন্দ বাড়ে না। বাপীরও সেই গোছের খেদ। খেদ কেন, রাগই বলা যেতে পারে। রাগ মিষ্টির ওপর, মিষ্টির মায়ের ওপর, এমনকি কলকাতায় কারা সব ঘোড়ার ডিমের আত্মীয় আছে ওদের, তাদের ওপরেও। এক মাসের ওপর হয়ে গেল ছেলেমেয়ে নিয়ে মিষ্টির মা কলকাতায় গেছে কোন্ আত্মীয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে। মহারাণীর এখনো ফেরার নাম নেই। আসলে ছেলেমেয়ের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, পরীক্ষার ফল বেরুলেও নতুন ক্লাস এখনো শুরু হয় নি, তাই ফেরার তাড়াও কম। কিন্তু বনমায়াকে নিয়ে এ-দিকে এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেল আবার, মিষ্টি জানতেও পারল না।
এই একটা বছরে বাপীর বুদ্ধিসুদ্ধি আরো পেকেছে। ওর জন্যেই জঙ্গলে বেড়ানোর নামে মিষ্টির এখন জিভে জল গড়ায়। আগের থেকে ওর সাহসও অনেক বেড়েছে। ছুটির দিনের দুপুরে ও-ই বরং বাপীর অপেক্ষায় ঘর বার করে এখন। খরগোস কাঠবেড়ালি বা বন-মোরগ তাড়া করার ঝোঁকে বাপী যে এক—একদিন ওকে নিয়ে কতটা দূরে চলে যায় মিষ্টি ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না। আবু সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই। মিষ্টি তখন নিজের খুশিতেই একটু দূরে পা বাড়াতে চায়। বাপীর বোল-চালের ফলে হোক বা আবুর হাবভাব দেখেই হোক, মিষ্টির এখন বিশ্বাস বাঘ-ভালুক সামনে পড়ে গেলেও আবু ওদের কলজে ফুটো করে দেবে। আবু নিজেই বলে, তোমাদের যেমন দেবতা আছে, জঙ্গলের তেমনি অপ-দেবতা আছে। আমি হলাম গিয়ে সেই অপ-দেবতা, আমি সঙ্গে থাকলে তোমার কোনো ভয় নেই খুকুমণি।
কিন্তু বাপীর নিজের দোষেই মিষ্টি একটা জিনিস ইদানীং বুঝে ফেলেছে। ফাঁক পেলেই ওর এই সুন্দর শরীরটার ওপর ও হামলা করে। চালাকি করে গায়ে পিঠে হাত দেয়, মিথ্যে ভয় দেখিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। নিজে এখন অনায়াসে উঠতে পারলেও বুকের সঙ্গে সাপটে ধরে গাছের ডালে বসায় নয়তো ডাল থেকে নামায়। একদিন তো ডাল থেকে নামার সময় ইচ্ছে করেই ওকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেল। এমনি করল যেন টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে। মিষ্টির অবশ্য লাগে নি, লেগে থাকে তো ওরই একটু-আধটু লেগেছে। কারণ মিষ্টি ওপরে আর ও নীচে। কিছু বুঝুক না বুঝুক, মিষ্টির এরকম হামলা করতে দিতে আপত্তি। আগেও বলেছে—দাদা মারলে মা দাদাকেই বকে, মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে হয় না, বুঝলে? আর তুমি কেবল আমাকে পেলেই ধরে টানাটানি করো। এরকম করলে মাকে আমি বলে দেব।
বাপীর রাগ যেমন ভয়ও তেমনি। হেসেই ওকে ভোলাতে চেষ্টা করেছে, তুই যেমন বোকা, মেয়েদের মারতে নেই বলে গায়ে হাত তুলতে নেই—আমি কি তোকে মারার জন্যে গায়ে হাত দিই?
—তবে কেন দাও?
বাপী ভয়ে ভয়ে খুব মোলায়েম করে বলেছে, আমার ভালো লাগে।
—আমার বিচ্ছিরি লাগে। তুমি ও-রকম করলে আমি আর আসবই না। বাপী কথা দিয়েছিল ও-রকম আর করবে না। কিন্তু তার পরের ছুটির দিনেই ইচ্ছে করে গাছের ডাল থেকে নামানোর সময় ওকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে। মিষ্টি আর কিছু না বুঝুক, এটুকু বুঝেছে ওর শরীরের ওপর হামলা করতে ওই পাজী খুব মজা পায়।
এরপর কলকাতায় যাবার আগে মাত্র দুটো ছুটির দিনে জঙ্গলে এসেছিল। দুদিনই মিষ্টি বেঁকে বসেছিল, আসবে না। দাদার বন্ধু দাদাকে বলেছে, চা-বাগানের এক দুষ্টু লোক একটা মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল, সেই জন্য রেগে গিয়ে অন্য লোকেরা ওই লোকটাকে মেরেছে। মিষ্টির মা বলেছে, বেশ করেছে মেরেছে, ও—রকম অসভ্য লোককে মারাই উচিত।—জঙ্গলে গেলে তুমিও অসভ্যের মতো করো, তোমার সঙ্গে যাব না!
নিরুপায় বাপী তখন নিজের কান মলেছে। বলেছে, ও-রকম করাটা যে অসভ্যতা ও ঠিক জানত না—আর কক্ষনো ও-রকম করবে না।
এরপর মিষ্টি এসেছে। বাপী ওর হাত ধরেছে তাতে খুব আপত্তি হয় নি। হাত ধরাটা তো আর গায়ে হাত দেওয়া নয়। পরের বারেও মিষ্টি আগে থাকতে গায়ে হাত না দেবার কড়ার করে তবে জঙ্গলে ঢুকেছে। বাপীর তাতেই প্রচণ্ড রাগ হয়েছে, হাত দুটো আরো বেশি নিশপিশ করেছে। আর অতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলার জন্য মনে মনে নিজেকেই গালাগাল করেছে।
রাগ বাপীর ওই বড়সাহেবের বাংলোর সকলের ওপরেই। মিষ্টির বাবা-মা, দীপুদা সক্কলের ওপর। ও-বাড়িতে ঢুকতে হলে আবুর সঙ্গে খরগোস বা বন—মোরগ নিয়ে, আম-জাম-জামরুল-পেয়ারা-খেজুর নিয়ে, ঝুড়ি ভরতি শাল-পলাশ নিয়ে, বা চাক-ভাঙা মধু নিয়ে যেতে হয়। আবুর আশা মেমসাহেবের নেকনজরে পড়লে সে বীটম্যান হবে। আর বাপীর আশা, মেমসাহেব বা দীপুদার কাছে ওর একটু আদর হবে, যার ফলে যখন-তখন ওই বাংলোয় আসাটাও সহজ হবে। কিন্তু একটা বছরে এটুকু ভালোই বুঝে নিয়েছে, আদরের আশা দূরে থাক, এই বাংলোর মানুষেরা ওদের মানুষই ভাবে না। জিনিস-টিনিস পেলে এমন ভাব দেখায় যেন এসব তাদের পাওনা। এমনিতে মিষ্টির সঙ্গে একটু গল্প করার লোভে বাংলোয় পা দিলেই মেমসাহেবের দুই ভুরুর মধ্যে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। সকালে জিনিস দেবার পর বিকেলে এলেও এমনিই অখুশি মুখ দেখে মেমসাহেবের। আর একদিন আবুর সঙ্গে এক ভাঁড় চাকভাঙা মধু নিয়ে এসে মেমসাহেবের মুখ হাসি দেখে সাহসে ভর করে তার সামনেই মিষ্টিকে ডেকে বলেছিল, মিষ্টি, একটা কথা শুনে যা—
সঙ্গে সঙ্গে মেমসাহেবের ফোঁস-মূর্তি।—এই ছেলে, অসভ্যের মতো তুই—তুকারি করিস কেন? ফের শুনি তো কান ছিঁড়ে দেব—
অপমানে বাপীর মুখ কালি একেবারে। বাইরে এসে আবু আবার তার ওপর হেসে হেসে নুন ছড়িয়েছে।—কি রে, ওই মেয়ের সঙ্গে আর প্রেম করবি না কি এরপর ওর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম ঠুকবি?
রাগের চোখে বাপী জ্বলে উঠেছিল, ওই মিষ্টিকে একদিন আমি একেবারে গিলে খাব দেখে নিও।
পিঠ চাপড়ে দিয়ে আবু বলেছিল, এই তো মরদের মতো কথা।
মেমসাহেব তো তবু মুখে বলেছে কান ছিঁড়ে দেবে। দীপুদা যখন তখন কান টেনেই ধরে, আর মাথায় খট-খট করে গাঁট্টা বসিয়ে দেয়। সব ছুটির দিনেই একলা মিষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার সুযোগ হয় না। কোনো কোনো ছুটির দিনে ওদের বাংলোয় অতিথি আসে, কোনোদিন বা দীপুদা এমনিই বেরোয় না। তখন একলা মিষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার আশায় ছাই। বাপী তখন ছুটে গিয়ে আবুকে ধরে নিয়ে আসে। আবুকে দেখলে দীপুদা জঙ্গলে বেড়াতে আপত্তি নেই। বাড়িতে লোকজন দেখে বেরুবার আশায় এই লোভটা মিষ্টিই একদিন দাদাকে দেখিয়েছিল, আর বাপীকে বলেছিল আবুকে ডেকে আনতে। তারপর থেকে ঘরে থাকলে আবুও জঙ্গলে ঘোরার রস কিছু পেয়েছে। এক-একদিন নিজেই ওকে ডেকে বলে দেয়, আবুকে ডেকে নিয়ে আসিস—
এক জায়গায় বেশি দিন থাকলে ভয়-ডর আপনা থেকেই কমে আসে। মিষ্টি এখন সামনের রাস্তা পেরিয়ে একলা জঙ্গলে নামলে আর খুব কাছাকাছির মধ্যে ঘোরাঘুরি করলেও ওর মা বকা-ঝকা করে না। কেবল বলে দেয়, খবরদার দূরে যাবি না, এখান থেকে ডাকলে যেন শুনতে পাস—
ছেলে আর আবু সঙ্গে থাকলে কিছুই বলে না। তার ধারণা কাছাকাছির মধ্যেই থাকে ওরা। সে-সময় দীপুদার মাতব্বরী আর শাসন দেখে বাপীর গা জ্বলে যায়। জঙ্গলটা যেন ওদের সম্পত্তি। ইচ্ছে মতো বাপী এদিক ওদিক ছুট লাগালে চোখ পাকাবে। পশু-পাখি টিপ করে পাথর ছুঁড়লেও এক-এক সময় আচমকা গাঁট্টা। কি, না আমি মারতে যাচ্ছিলাম, তুই আগে মেরে বসলি কেন? ওর সঙ্গে ছুটতে গিয়ে মিষ্টি হোঁচট খেয়ে ব্যথা পেল কি পেল না, দীপুদার চড়-চাপড়টা এসে পড়ল ওর ওপর। বাপীর সব থেকে বেশি অপমান হয় এসব যখন আবু দেখে আর তেরছা চোখে ওর দিকে তাকায়। যেন বলতে চায়, ভালবাসার আর কি দাম দিবি, এরপর কি জুতোপেটা শুরু হলে আক্কেল হবে?
সেই এক বছর আগে মিষ্টিকে ভালবাসতে ইচ্ছে করার কথাটা বোকার মতো আবুকে যদি না বলে ফেলত, তাহলে এতটা খারাপ লাগত না। মিষ্টির মা বা দীপুদা শাসন করলেও আবু এভাবে তাকিয়ে মজা পেত না, বা ঠাট্টা-ঠিসারা করত না। ওই বাংলোর মহারাণী আর তার ছেলের ওপর কত যে রাগ বাপীর সে শুধু ওই জানে। রাগ বড়সাহেবের ওপরেও। বাপীর বাবার থেকে এত ওপরের একজন না হলে ওকে এত হেলা-ফেলা কেউ করত না। আর রাগ সময় সময় তাদের আদুরে মেয়ের ওপরেও। ওই মিষ্টির থেকে বনমায়া ঢের ভাল। পায়ে শেকল বাঁধো আর যা-ই করো, ভালবাসার পুরুষ হাতি এলে সব ভয়-ডর বিসর্জন দিয়ে ও তার সঙ্গে চলে যাবেই। মিষ্টি যদি বনমায়ার মতো হত।
বনমায়াকে নিয়ে আবুর সঙ্গে অনেক রসের কথা হয়েছে বাপীর। সে-সব কথা মিষ্টিটাকে বলাও যাবে না। এক বছরেই বাপী ভিতরে ভিতরে যেমন ধাঁধাঁ করে বড় হয়ে গেছে, ও তো আর অতটা হয় নি। আর আবুর তো কথাই নেই, আঠেরো বছর পার—জঙ্গলের যাকে বলে বুক-চিতানো মরদ একখানা। ওকে দেখলেও বাপীর চোখ জুড়োয়।
কিন্তু মিষ্টিরা নতুন বছরের ছুটির মধ্যে এখানে না থাকাতে জন্ম থেকে দেখা এই বানারজুলির জঙ্গলটাকেই আরো চেনা আরো জানার সুযোগ হয়েছে বাপীর। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ, ছুটির আগে রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে। নতুন ক্লাসের বই—পত্রই কেনা হয় নি এখন পর্যন্ত—বই নিয়ে বসার তাড়াই বা দেয় কে? তার ওপর স্কুল ছুটি।
সকাল দুপুর বাপীর আবুর সঙ্গেই কাটছে। আঠারো পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবুর বীটম্যান হওয়ার দাবী। এতদিন স্কুল ছাড়া সার্টিফিকেটে ওর বয়েসটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চাকরির জন্য আবু এখন কোমর বেঁধে তৈরি। ওর বাবা কালুকে নিয়ে বাপীর বাবার সঙ্গে দেখা করে দরখাস্ত পেশ করেছে। বাবা দরখাস্ত রেখেছে, আশাও দিয়েছে। চাকরি দেওয়া না দেওয়ার মালিক বড় সাহেব— মিষ্টির বাবা। সেটা সকলেই জানে। কিন্তু তার কাছে সুপারিশ তো কাউকে করতে হবে। বাপীর বাবা সেই সুপারিশের আশ্বাস দিয়েছে।
আবুকে মুখে কিছু না বললেও এখানেই বাপীর যা একটু সংশয়। বড় সাহেবকে দশ গজের মধ্যে দেখলেই বাবার চোখ-মুখের যা অবস্থা হয় তার দ্বারা ধরা-করার ব্যাপারটা কতদূর হবে কে জানে। তবে আবুকে অন্য দিক থেকে একটু আশার কথা শোনাতে পেরেছে বাপী। বাবা ওর দরখাস্ত বড়সাহেবকে দিলেই ও মিষ্টিকে ধরবে। মিষ্টি বাপের আদুরে মেয়ে, তার ওপর আবুকে ওরও ভারী পছন্দ। তাছাড়া এটা ওটা ভেট দিয়ে দিয়ে আবু মেমসাহেবকেও খুশি রেখেছে। আবুর চাকরি তাহলে হবে না কেন?
কিন্তু আবু কোনো চিন্তা-ভাবনার ধার ধারে না। নিজের কাছে ও পাকাপোক্ত বীটম্যান একজন হয়েই বসেছে। বাপ অর্থাৎ হেড বীটম্যান কালুর চার ভাগের তিন ভাগ কাজ ও-ই করছে এখন। বীটম্যানদের প্রথম কাজ জঙ্গলে টহল দেওয়া। বাপী তার সেই টহলের দোসর এখন।
জঙ্গলের মধ্যেই মাটির ঘরে থাকে ওরা। সব বীটম্যানরাই তাই। অনেকটা দূরে দূরে ওদের ঘর। ভাড়া গুনতে হয় না, এমনিতেই থাকতে পায়।
সকালে মুখে কিছু গুঁজেই বাপী ছোটে আবুর ওখানে। দেরি হলে আবু একলাই বেরিয়ে পড়বে। কারণ কালু তো এখন আর সকালের মুখ দেখে না। পড়ে পড়ে ঘুমোয় বা ঝিমোয়। বাপীর ধারণা ছেলে অনেক কাজ বুঝে নেবার পর থেকে ওর নেশার মাত্রা বেড়েছে। আর নিজে থেকে কিছু বলে না বলে বাপীও মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না।
টহল দেবার সময় বীটম্যানদের হাতে পাকানো বাঁশের লাঠি থাকে। কিন্তু আবু নিজের পিয়ারের সেই লোহার খাপ আঁটা ইস্পাতের ফাল বসানো লাঠিটা সঙ্গে নেয়। বাপীর হাতেও থাকে তার নিজের ছোট লাঠি। শাল শিশু অর্জুন জারুল দেবদারু ইউক্যালিপটাস গাছগুলোয় ঘা মারতে মারতে এগোয় তারা। ফুর্তি করার জন্য ঘা মারা নয়। কোনো গাছে পোকা ধরল কিনা ঘা মারার শব্দ থেকে সেটা বোঝা যায়। বাপী বুঝতে পারে না, কিন্তু আবু ঠিক বুঝতে পারে। গাছের শত্রু উই, গান্ধীপোকা, গঙ্গাফড়িং, পঙ্গপাল। কোন্ শত্রু নিকেশের জন্য কি ওষুধ দরকার আবু তাও জেনে ফেলেছে। কোনো গাছে পোকা ধরলে বা শত্রুর সন্ধান পেলে বীটম্যানের কাজ ওপরঅলার কাছে রিপোর্ট করা।
ফাঁকি না দিলে বীটম্যানের আরো অনেক কাজ। চারাগাছের বেড নিয়ম করে পরীক্ষা করা একটা বড় দায়িত্ব। জলের নালা দিয়ে ঠিক মতো জল আসছে কিনা, বেশি জল আসছে কিনা, ওর কাছাকাছি সজারু গর্ত খুঁড়ল কিনা, এইসব। বুনো শূয়োরও কত সময় চারাগাছ মুড়িয়ে দিয়ে যায়। সেরকম সম্ভাবনা দেখলে লোকজন ডেকে লাঠি আর টিন কানেস্তারা নিয়ে আশপাশের বড় গাছের ডালে বসে পাহারা দিতে হয়। পাহারা মানে টিনকানেস্তারা পিটে জানোয়ারদের ভয় দেখানো।
কিন্তু আবুর সেরকম পাহারাদার হতে ইচ্ছে করে না। বীটম্যান হলেই ও একটা বন্দুক পেতে চেষ্টা করবে। ওর বাপের যদি সেরকম হিম্মত থাকত তাহলে ঠিক একটা বন্দুক আদায় করতে পারত। কিন্তু রাত হলেই তো নেশায় পেয়ে বসে বাপটাকে। তার হাতে বন্দুক দেবে কে? না, বাপের ওপর খুব একটা শ্রদ্ধাভক্তি নেই আবুর। বাপীর বাবা মানে কেরানীবাবু নেহাত ভালোমানুষ বলে ওর বাপের দোষত্রুটি ধামাচাপা দিয়ে রাখে—এ কথা আবু নিজের মুখে ওকে বলেছে।
জঙ্গলের মধ্যেই একটা ভাটিখানা আছে বাপী এতদিন সেটা জানত না। এক—দিনের অভিজ্ঞতার তাও জানা হয়ে গেল। বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিল দুজনে, হঠাৎ কোত্থেকে একটা বড়সড় হরিণ ঝড়ের মতো ওদের পাশ দিয়ে ছুটতে লাগল। ওটার গায়ে একটা তীর বেঁধা। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
ব্যাপার ভালো করে বোঝার আগেই বাপী দেখে আবুর দুচোখ ঝলসে উঠেছে, চোয়াল কঠিন। হ্যাঁচকা টানে বাপীকে টেনে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু তীর ধনুক হাতে উল্টোদিকের ছুটন্ত লোক দুটো দেখেই ফেলল ওদের। থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
আবু তারস্বরে একটা বিকট চিৎকার করে লোক দুটোকে তাড়া করল। জঙ্গল—চোর বা অন্য কোনো বিপদ-আপদ দেখলে বীটম্যান অন্য বীটম্যানদের বা ফরেস্ট গার্ডদের এমনি চিৎকার করে জানান দেয়।
লোক-দুটো চোখের পলকে উধাও। আরো কয়েকবার চিৎকার করেও আর অন্য কোনো বীটম্যানের সাড়া পেল না। ওর যতো উত্তেজনা ততো রাগ। মাল বা পলিয়া জঙ্গল-চোরদের এই কাজ। ফাঁক পেলে তীর ধনুক দিয়ে তারা হরিণ মারে, রাতে কাটা গাছের কাঠ সরায়।…হরিণটা নিশ্চয় কোথায় মরে পড়ে থাকবে। তখন প্রথম দোষটা পড়বে ওর বাবার ঘাড়ে। এ-এলাকায় তার নিজের টহল দেবার কথা, অন্য লোকও মোতায়েন রাখার কথা। আর এ-দিকের ফরেস্ট গার্ডের কাছেও জবাবদিহি করতে হবে।
আবু তার বাবার খোঁজে ছুটল। পিছনে বাপী। কিন্তু কালু ঘরে নেই। দাঁত কড়মড় করতে করতে হনহন করে আবু আবার জঙ্গলের আর এক দিকে চলল।
গাছ-গাছড়ার আড়ালে একটা মাটির ঘর। সেখানে আসতেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এলো বাপীর। সামনেই পেল্লায় কড়ার মধ্যে ফুটছে কি। উৎকট গন্ধটা সেদিক থেকে আসছে। এদিকটায় মাটির ওপরেই বসে আছে আবুর বাবা কালু, তার সঙ্গে আরো তিন-চারজন। সকলের হাতেই মাটির ভাঁড়।
আবু ঝাঁঝালো গলায় খবরটা কালুকে দিল। কালু বসে বসে দুলছিল। ঘোলাটে চোখ। জঙ্গল-চোরের উদ্দেশে একটা বিচ্ছিরি গাল দিয়ে উঠল সে। তার সঙ্গীরা আরো কিছু গালাগাল যোগ করল। কালু ছেলেকে হুকুম করল, চোর দুটোকে গাছের সঙ্গে কষে বেঁধে রাখ—আমরা যাচ্ছি। আর বলল, খুঁজে-পেতে মরা হরিণটাকে ঘরে নিয়ে যেতে—রাতে ভোজ হবে।
বাপীর হাত ধরে টেনে আবু রাগে গজগজ করতে করতে ফিরল আবার। অভিসম্পাতও করল, দিনের বেলায়ই বেহেড মাতাল হয়ে আছে—মরুক—ধরা পড়ে মরুক সব!
বাপী সেই প্রথম জানল ওটা ভাটিখানা। চুরি করে মদ চোলাই হয় ওখানে। সকলেই জানে, পাহারাদাররাও জানে। কিন্তু ভাবখানা দেখায় যেন কেউ কিচ্ছু জানে না।
বাপী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, হরিণ মারার ব্যাপারটা ধরা পড়লে তোমার বাবার শাস্তি হবে?
আবু ঝাঁঝালো জবাব দিল, হওয়া তো উচিত। কিন্তু শাস্তি দেয় কে—এখানে ছোট থেকে বড় সব শালা চোর!
বাপী ঘাবড়েই গেল।—আমার বাবাও?
—না, তোর বাবার অত সাহস নেই—তা বলে তোর বাবার বাপ-খুড়োরা কেউ কম যায় না—বুঝলি?
বাপীকে হাঁ করে থাকতে দেখে রাগের মুখেও আবু হেসে ফেলেছিল। তারপর চুরির ব্যাপারটার ব্যাখ্যাও করেছিল। বাপীর বাবার বাপ-খুড়ো বলতে জঙ্গলের বড় মাঝারি ছোট সাহেবরা। এবারের বড়সাহেব অর্থাৎ মিষ্টির বাবা আসার পর থেকে জঙ্গলের চুরি নাকি আগের থেকেও বেড়ে গেছে। কন্ট্রাকটারদের গাছ ইজারা দেওয়ার সময় মোটা ঘুষের টাকা ওই সাহেবসুবোদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। অনেক শিশুগাছ ইচ্ছে করেই চিহ্ন দেওয়া হয় না। চিহ্ন না থাকা মানেই সরকারী হিসেবে সে গাছ নেই। শিশুগাছ খুব দামী। ভালো কাঠ আর তক্তা হয়। টাকা খেয়ে বড় সাহেব মেজ সাহেবরা সেই সব মার্কা ছাড়া গাছ কাটতে দিলে কে আর ধরবে? কার বুকের পাটা আছে যে বলে দেবে? তাছাড়া ঘুষ দিয়ে বেআইনী শিকারও কম হচ্ছে নাকি এখন এখানে?
মিষ্টির বাবা পর্যন্ত এরকম খারাপ কাজের মধ্যে আছে শুনে বাপীর মুখে কথা সরে না। কিন্তু কাউকে বলার জো নেই, এমন কি পিসীকেও না। আবু সাবধান করে দিয়েছে, খবদ্দার কাউকে বলবি না—তোর বাবার কানে গেলে উল্টে তোকেই ধরে পিটবে। আর বড়সাহেব মেজসাহেবদের কানে গেলে তো তোর আমার বাবারই চাকরি নট।
মুখে না বলতে পারুক, এত সব জানার ফলে বাপীর ভিতরে ভিতরে রাগ খুব। জঙ্গলটা একটু আদর-যত্ন আর দেখা-শুনার আশায় মানুষের মুখ চেয়ে আছে, আর মানুষই কিনা সব থেকে বেশি হামলা করছে তার ওপর।
বড়সাহেবের বাংলোয় ওই আদুরে মেয়ের দেখা পাওয়া গেল স্কুল খোলার ঠিক আগের দিনটিতে। এসেছে বাপী তাই জানত না। তবে রোজই একবার করে এদিকটায় টহল দিয়ে যায়।
সকালে মিষ্টিকে বারান্দায় দেখেই আনন্দে বুকের ভিতরটা দাপাদাপি করে উঠল। কিন্তু ডাকবে কি, বড়সাহেব এই বারান্দায় বসেই কাগজ পড়ছে।
ডাকতে হল না, মিষ্টি নিজেই দেখল ওকে। ঘাড় বেঁকিয়ে বাপকে একবার দেখে নিয়ে ও গেটের কাছে চলে এলো।
বাপী গেট-এর ওধারে।
—জানো, আমি ফার্স্ট হয়েছি—বাবা বলল। দাদাও পাশ করেছে—
ফার্স্ট বা পাশের ধার ধারে না বাপী, ওকে দেখেই খুশিতে টইটম্বুর।—কবে ফিরলি?
—কাল বিকেলে। ছুটির মধ্যে তুমি আর আবু খুব জঙ্গল চষলে তো?
খুব। বাপী কথা বলবে কি প্রায় দেড় মাস বাদে মিষ্টিকে দেখে চোখে পলক পড়ে না। মিষ্টির বয়েস এখন মাত্র নয়, কিন্তু এই দেড়টা মাসের মধ্যে ও যেন দিব্বি বড়সড় হয়ে উঠেছে। মাথায় বেড়েছে, মুখ আরো ফর্সা হয়েছে। বলল, এদিকে কত কি কাণ্ড হয়ে গেল তুই জানিসও না—দুপুরে জঙ্গলে আসবি তো? সব বলব—
— মিষ্টি!
পিছনের বারান্দা থেকে ধমকের সুরে মায়ের আচমকা ডাক। তাঁর হাতের কাচের গেলাসে দুধ। অপ্রসন্ন চাউনি।
জবাব দেওয়া হল না। মিষ্টি ঘুরে আবার বারান্দার দিকে ছুট। বাপীরও আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস নেই। মহারাণীর মুণ্ডুপাত করতে করতে বাড়ির দিকে চলল। ফিরে আসা হয়েছে জানলে বাপী ঠিক হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসত। শুধু কর্তা কেন, ঘুষ ছাড়া গিন্নীরও খুশি মুখ দেখা যায় না। এখন কতক্ষণে দুপুর হবে আর কতক্ষণে একলা পাবে মিষ্টিকে ঠিক নেই।
ঠিক সময়েই দুপুর হল। মিষ্টিকেও একলাই পেল। কিন্তু এতদিন বাদে জঙ্গলে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েও মেয়েটার হাব-ভাব অন্য রকম। গেট পর্যন্ত ছুটে চলে আসারও তাড়া নেই। নেহাত গেট-এর কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বলেই আসা। বাপীর সবুর সয় না। আবার ওর মুখ দেখে শংকাও একটু। গলা চেপে জিজ্ঞাসা করল, তোর মা ঘুমোয়নি?
—ঘুমিয়ে কাদা। আর বাবাও বাড়ি নেই।
—তাহলে কি হল, জঙ্গলে যাবি না?
মিষ্টি একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল ওকে। এরকম করে দেখাটাও নতুন ঠেকছে বাপীর।
—আবু কোথায়?
—আবুকে দিয়ে কি হবে? সে জঙ্গলে ঘুরছে কি বাড়িতে ঘুমুচ্ছে কে জানে!
কড়ার করে নেওয়ার সুরে এবারে মিষ্টি বলল, জঙ্গলে ঢুকে তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না?
এতদিন বাদে এসেও সেই পুরনো কথাই আগে বলবে বাপী ভাবেনি। বলার ফলে রাগের সঙ্গে ওই লোভটাই ভিতর থেকে ঠেলে উঠতে লাগল।—তোর কি ননীর শরীর নাকি যে হাত দিলে গলে যাবি? হাত দেব না সে তো সেই কবেই বলেই রেখেছি!
গেট খুলে আর বন্ধ করে মিষ্টি বেরিয়ে এলো। কত দিনের মধ্যে জঙ্গলে পা দেয়নি। বেরুনোর তাগিদ তারও কম নয়। জঙ্গলে ঢুকে বাপী ওর হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে উঠে হাত ছাড়িয়ে নিল!
—ফের?
বাপী থতমত খেল একদফা। দেড় মাসের মধ্যে কতটা বড় হয়ে গেছে ঠাওর করে উঠতে পারল না। —হাত ধরতেও দিবি না?
—না। কলকাতার সোনাদি বলেছে তুমি একটা অসভ্য ছেলে, তোমার সঙ্গে একলা জঙ্গলে আসতেই বারণ করেছিল। বলেছিল, তোমার মতলব খারাপ।
বাপী হতভম্ভ।—সোনাদি কে?
—আমার এক দূর-সম্পর্কের মাসির মেয়ে। তারও এখন তোমার মতো তেরো বছর বয়েস।
—সে আমার কথা জানল কি করে?
—সোনাদির কাছে তোমার সঙ্গে চুপিচুপি জঙ্গলে বেড়ানোর গল্প করেছি না? আমাকে একলা পেলে তুমি কত রকমের দুষ্টুমি করো তাও বলেছি। তাই শুনেই তো সোনাদি আমাকে সাবধান করে দিল—আমি কি অত বুঝতাম?
বাপীর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। আবার ভয়ও কম নয়।—আর তোর সোনাদি তোর মাকেও বলে দিল?
ঠোঁট উল্টে মিষ্টি জবাব দিল, হুঁঃ, সোনাদি অত বোকা কিনা। ওদের বাড়ির পাশের এক বজ্জাত ছেলে এক সন্ধ্যায় চুপি চুপি ছাদে উঠে গিয়ে সোনাদিকেই পিছন থেকে জাপটে ধরেছিল—সোনাদি সেকথাই তার মাকে আজ পর্যন্ত বলেনি—তারপর সেই পাজী ছেলে চুমু খেতে চেয়ে সোনাদিকে চিঠি পর্যন্ত লিখেছে—সোনাদি তাও মাসিকে বলেনি, বুঝলে?
বাপীর ভয়ডর উবে গেল। এ কথা শোনার পর একটা অজানা ইচ্ছে মুখের দিকে এগিয়ে আসছে, আর হাত দুটো আগের থেকে আরো বেশি নিশপিশ করছে। বলল, তোর সোনাদির খুব বুদ্ধি, তোর যদি সে-রকম বুদ্ধি থাকত!
সঙ্গে সঙ্গে বনমায়ার গল্পে চলে এলো সে। আগের বার বনমায়ার পালানো আর ফিরে আসার গল্প ঢের আগেই মিষ্টিকে বলেছিল। এবারেও বনমায়া কি কাণ্ড করে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে তার ভালবাসার পুরুষ হাতির সঙ্গে চলে গেছল, একমাস ধরে ফুর্তিটুর্তি করে কবে আবার ফিরেছে—ওকে দেখে ভীম বাহাদুর ক্ষেপে গিয়ে কি করেছিল, আর আবু কি বলেছিল—এই সব।
এই গল্প শোনানোর ফাঁকে বাপী কখন ওর একটা হাত নিজের হাতের দখলে নিয়ে নিয়েছে, মিষ্টির খেয়ালও নেই। ও-দিকে মিষ্টিও এবারে সোৎসাহে কলকাতায় টারজানের ছবি দেখে আসার গল্প বলল। জঙ্গলের রাজা টারজান। টারজানের মতো বীর আর কাউকে হতে হয় না—গাছের ঝুরি ধরে অনেক দূরের গাছে দোল খেয়ে চলে যায়, পাহাড় থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে, তার সেই ভীষণ ডাক শুনলে হাতি-বন্ধু, আর শিম্পাঞ্জী চলে আসে, লড়াই করে বাঘ সিংহ কুমির মেরে ফেলে। মনে করতেও গায়ে কাঁটা মিষ্টির।
ভাগ্য বটে মিষ্টিটার। কলকাতায় গিয়ে এমন ছবিও দেখে এলো। শুনেই বাপীর রক্ত নাচছে, আর টারজান হবার সাধ যাচ্ছে। হঠাৎ কি ভেবে জিজ্ঞাসা করল, জঙ্গলে টারজানের সঙ্গে কোনো মেয়ে ছিল না?
—ছিল না কি গো! টুকটুকে মেমসাহেব মেয়ে! তারও পরনে টারজানের মতো এইটুকু চামড়ার মতো কি—আর বুক শুধু একটু ঢাকা—তাতেও কি সুন্দর দেখাচ্ছিল।
বাপীর নিঃশ্বাস বন্ধ—টারজান সেই মেয়ের গায়ে হাত-টাত দিত না? মিষ্টির খিলখিল হাসি। দিত না আবার—দুজনে জড়াজড়ি করে গাছের শিকড় ধরে দোল খেত, টারজান মাটিতে শুয়ে থাকলে মেয়েটা তার বুকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ত—
আনন্দে বাপী মিষ্টির দু কাঁধ ধরে বড়সড় দুটো ঝাঁকুনি দিল।—তবে? তোর সোনাদি জঙ্গলের খেলা কিচ্ছু জানে না—বুঝলি? জঙ্গলের সব অন্য রকম।
টারজানের ছবি চোখে লেগে থাকায় মিষ্টি খুব যেন সেটা অস্বীকার করে উঠতে পারল না।
.
নতুন বছরের শুরু থেকেই বাপীর পড়াশুনা শিকেয় উঠেছিল। সেবারের হাফ—ইয়ারলি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ভালোমানুষ হরিবাবুরও মেজাজ গরম। ভালো নম্বর কিছুতে নেই, তার মধ্যে দু’পেপারে ফেল! পড়াশুনার জন্য সেই প্রথম ছেলের গায়ে হাত তুলতে গেছলেন তিনি। এক স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া ঘরের বাইরে পা দিলে আস্ত রাখবেন না বলে শাসিয়েছেন।
বাপী কী করবে? দু’বেলাই বইখাতা নিয়ে সময়মতো পড়তে বসে। কিন্তু ওর চোখের সামনে কেবল জঙ্গল আর আবু আর মিষ্টি আর টারজান। পড়ার ফাঁকে তারা কখন যে এসে হাজির হয় বাপী নিজেও জানে না। তাছাড়া পড়তে বসেই দীপুদার ওপর রাগ, আবুর এই ছ’মাসের মধ্যেও চাকরি না হওয়ার জন্য বড়সাহেবের ওপর রাগ। আর সব থেকে বেশি, চাকর-বাকরের মতো ওকে হেলা-ফেলা করার জন্য মিষ্টির মায়ের ওপর রাগের যত সব কাল্পনিক ফয়সলা মাথায় ভিড় করে আসে।
…এর মধ্যে চালাকি করে একদিন মিষ্টিকে বাড়িতেও আনা গেছল। তারপর আর একদিন মিষ্টি নিজেই এসেছে। পিসী বড়সাহেব-টাহেব পছন্দ করে না। কিন্তু বড়সাহেবের এই মেয়েটাকে পিসীরও ভালো লেগেছিল। দুদিন আদর করে খেতে দিয়েছে। আর বাপীকে বলেছে সুন্দরই তো মেয়েটা, আর বেশ বাড়ন্ত গড়ন।
পড়তে বসলে এ-সবও বাপীর মনে পড়ে। বাড়ন্ত গড়নের মেয়ে আরো একটু চটপট বড় হয় না কেন তাও ভাবে।
পরীক্ষার ফল নিয়ে বাবার কাছে বকুনি খাওয়ার দিন-কতকের মধ্যে আবার বিপর্যয় নেমে এলো একটা। অথচ এর উল্টো হবার কথা
মাত্র চারদিন আগে বড়সাহেবের কাছেও আবুর একটু খাতির কদর হয়েছে। আবুটা ডাকাতই বটে। সাঁঝের আঁধারের আগে গভীর জঙ্গলে ঢুকেছিল। একা। গাছে একটা বন-বিড়াল দেখে পিছন থেকে বড় পাথর ছুঁড়ে ওটাকে পেড়ে ফেলেছিল। বন-বিড়াল এমনিতেই ভীষণ হিংস্র। পাথরের ঘায়ে ভালো মতো জখম হয়েও মাটিতে পড়ে ওটা তেড়ে এসে আবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আবুর লাঠির পেল্লায় ঘায়ে আবার মুখথুবড়ে পড়েছে। তারপর আবু লাঠিপেটা করেই ওটাকে শেষ করেছে।
এই বন-বিড়ালটাই একধার থেকে জঙ্গলের ছাগল ভেড়া আর মুরগি মারছিল। এমন দুঃসাহসের জন্য বড়সাহেব সন্দীপ নন্দী পাঁচ টাকা পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। আর চাকরির আশ্বাসও দিয়েছেন।
বাপীর আনন্দ ধরে না। বাবা যতই শাসন করুক, ছুটির দিনে ঘরে বসে থাকা ওর কুষ্ঠিতে নেই। চারদিন পরের বোরবারে মিষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিল। আর মনের আনন্দে বেশ দূরেও চলে গেছল। আবুর এত বড় বীরত্বের পর ওদেরও যেন ভয় সাজে না।
গোঁ-ভরে একটা খরগোসের পিছনে ছুটেছিল বাপী। ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে মিষ্টি দাঁড়িয়ে গেছল।
একটু বাদে বিশহাত দূরের শিশুগাছটার দিকে চোখ পড়তে মিষ্টির ছোট্ট শরীরটা একেবারে নিস্পন্দ কাঠ যেন। সব রক্ত যেন ঠাণ্ডা জল হয়ে যাচ্ছে।
গাছের মোটা গুঁড়িটার পাকে-পাকে জড়িয়ে আছে একটা অতিকায় ময়াল সাপ। সমস্ত গায়ে ঝকঝকে কালো-সাদার ছোপ-ছোপ দাগ। তার লম্বা চ্যাপটা মুখটা সামনের দিকে টান হয়ে এগিয়ে আছে। চোখ দুটো মিষ্টির চোখের সঙ্গে আ কে আছে। একটা সোঁ-সোঁ নিঃশ্বাস যেন মিষ্টির গায়ে এসে লাগছে।
নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। সর্ব অঙ্গ অবশ। গলা দিয়ে একটু শব্দও বার করতে পারছে না।
ওকে দুচোখে আটকে নিয়ে সাপ্টা আস্তে আস্তে গুঁড়ি থেকে শরীরের প্যাঁচ খুলছে!
তারই মধ্যে ফিরে এসে বাপী এই দৃশ্য দেখে ভেবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল প্রথম। তার পরেই মাথার মধ্যে যা খেলে গেল ও-ই জানে। বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে মিষ্টিকে এক ধাক্কা। সেই ধাক্কায় চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ল ও। সঙ্গে সঙ্গে বাপী ওকে টেনে তুলল।—ওঠ! ছোট্! নইলে আস্ত গিলে ফেলবে।
পাগলের মতোই ছুটেছে দু’জনে। বাংলোয় এসেও মিষ্টির সমস্ত মুখ নীল—বর্ণ। থরোথরো কাঁপুনি। বাপীর সেই ধাক্কার ফলে হাত-পা কেটে ছড়ে রক্তাক্ত। কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে বাইরের লোক পর্যন্ত ছুটে এসেছে। বড়সাহেব বাংলোতেই ছিলেন।
কি হয়েছে না হয়েছে তাঁর জেরায় পড়ে বাপীকে সবই বলতে হয়েছে। কোথায় কত দূরে ঘটেছে এব্যাপার—তাও। আর মায়ের ধমকে ছুটির দিনে জঙ্গলে বেড়ানোটাও মিষ্টি ফাঁস করে দিয়েছে।
তারপর বাপীরও তার বুদ্ধি আর বীরত্বের পুরস্কার মিলেছে।
বড়সাহেবের থমথমে মুখ। তিনি কিছু বলেননি। মেমসাহেব সকলের চোখের সামনে বাপীর একটা কান ছিঁড়েই নিতে চেয়েছে। তারপর গালাগাল করতে করতে ঘাড় ধরে বাংলো থেকে নামিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যার পর বাবার সপাসপ গোটাকতক চটির ঘা।
জীবনের সব সাধ-আহ্লাদই বুঝি শেষ বাপীর। নিঝুম রাত। পিসীর দু’হাত তফাতে সরে শুয়ে আছে। ঘুমোতেই চাইছে।…ভাবছে, রাতের ঘুম সকালের মধ্যে আর একেবারে না ভাঙলে কি হয়?
.
‘পাথরে পাঁচ কিল’— রেগে গেলে পিসী বলত কথাটা। বলত, তোকে কিলোলে কি হবে, তার পাঁচগুণ ব্যথা নিজের হাতে ফিরে আসবে। ফাঁক পেলেই অপমানের ব্যথা ও রকম পাঁচগুণ ফিরিয়ে দেবার গোঁ এখন বাপীর। ওকে এরপর বাংলোর গেটের কাছে দেখলেই দীপুদা তেড়ে আসে। মেমসাহেব মহারাণীর সঙ্গে চোখা চোখি হলেই ভ্রুকুটি। যেন বাইরের এই রাস্তাটাও তার খাস দখলের। চাকরির লোভে আবু যখন তখন বাংলোয় যায়, মেমসাহেবকে ভেট দেয়, মিষ্টিকেও এটা সেটা দিয়ে বা জঙ্গলের গল্প বলে তোয়াজ করে। আগের মতো আবুও ওদের অত দোষ ধরে না। উল্টে উপদেশ দেয়, ভালো করে মন দিয়ে পড়াশুনা কর, মানুষ হ’—নইলে ওদের কেন—কারোই কোনোদিন পাত্তা পাবি নে।
বাপীর সব থেকে বেশি রাগ মিষ্টির ওপর। ও না থাকলে তো সাপের পেটেই চলে যেত একেবারে। যে যা-ই বলুক, ওর তো কেনা হয়ে থাকা উচিত বাপীর কাছে। তা না, হাব-ভাব এমন, যেন দোষটা বাপীরই।
এর পরেও ছুটির দিনের দুপুরে আর সুযোগ পেলে, সকালেও বাংলোর দিকে হানা না দিয়ে পারে না। বকা-ঝকা মার-ধরের পরোয়া করে না। কিন্তু মিষ্টি সহজে কাছেই আসতে চায় না, দূর থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দেয় আসবে না। বাপীর মাথায় তখন সব থেকে বেশি আগুন জ্বলে। রাগের চোটে ভেংচি কাটে। ডবল রেগে গিয়ে মিষ্টিও জিভ ভেঙায়, তারপর মায়ের কাছে বা দাদার কাছে নালিশ করতে ছোটে। বাপী ওর রাস্তায় বেরুনোর অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকে। একলা পেলে মিষ্টিকে খেয়ে ফেলার কথা বলে, মিষ্টি খেয়ে জল খাবার কথা বলে, জিভ চকচক করে ওকে শোনায় মিষ্টি খেতে কত আরাম। তার ফলে বাবার কাছে বেদম প্রহার আবার একদিন।
দিন গেলে সব শাসনের কড়াকড়ি আপনা থেকে কমে আসে, সেই হিসেব বাপীরও আছে। ওই মহারাণী কদিন আর মেয়েকে চোখে চোখে আগলে রাখবে? জঙ্গলের স্বাদ একবার পেলে বাতিল করা আর সহজ নয়। বিকেল হলে মহারাণী মেয়ের রাস্তায় আসা ঠেকাতে পারে না। আর ফাঁক পেলে ওই মেয়ে এখনো জঙ্গলে ঢুকে পড়ে—কিন্তু দূরে যায় না, খুব কাছাকাছির মধ্যেই থাকে। বাপীরও সেই সুযোগের অপেক্ষা
ওকে দেখলেই মিষ্টি চোখ পাকায়, মা তোমার সঙ্গে মিশতে বারণ করেছে, কথা বলতেও বারণ করে দিয়েছে। ফের আমার সঙ্গে দেখলে তোমাকে রক্ষে রাখবে না বলে দিলাম।
বাপীর মাথায় রক্ত ওঠে। আর মিষ্টির মাথাটা আচ্ছা করে কোনো গাছে ঠুকে দিয়ে পালাতে ইচ্ছে করে। অথচ মনের মতো পেয়ারা কুল কামরাঙা আচার—টাচার ঘুষ পেলে মিষ্টি নিজেই স্বীকার করে বাপীর কোনো দোষ নেই—ওর জন্যেই ওকে ময়াল সাপের পেটে ঢুকতে হয় নি। একদিন এ-ও কবুল করেছে যে বাপীর সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে ওর খু-উ-ব ভালো লাগে, কিন্তু মায়ের ভয়ে পারে না।
ওই মায়ের অবাধ্য হবার মতো এতটুকু সাহস নেই বলেই বাপী আরো রেগে যায়। ওকে বেইমান বলে, ভীতু বলে। বলে, ননীর পুতুল—মায়ের আঁচলের তলায় থাক্গে। ধরা পড়ার ভয় না থাকলেও মিষ্টি বারান্দা ছেড়ে গেটের দিকে আসতে না চাইলে কিল চড় দেখায়, জিভ ভেঙায়। আদুরে মেয়েও বিষম রাগে ফোঁস করে উঠবেই। নিজেও যা-তা বলবে, পাল্টা কিল চড় দেখাবে, জিভ ভেঙাবে—আর তারপর মায়ের কাছে বা দাদার কাছে নালিশও করবে। এমনি নালিশের ফলে ওর মা মহারাণী আবার একদিন ওকে ডেকে কান মলে দিয়েছিল। দীপুদাও বোনের নালিশ শুনলেই গাঁট্টা মারতে ছুটে আসে।
এমনি করেই আবার একটা বছর শেষ। বাপী নতুন ক্লাসে উঠেছে। বরাত—জোরে কিনা জানে না, মোটামুটি ভালই পাশ করেছে। ফেল করলে ওর নিজের অন্তত অবাক হবার কিছু ছিল না। কারণ পরীক্ষার আগে পর্যন্তও মনের অর্ধেকটা ওই সাহেববাংলোর দিকে পড়ে থাকত। আর পরীক্ষার পরের ছুটির দিনগুলোতে তো মিষ্টিকে ধরে একেবারে ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছে করত। ক্লাস পরীক্ষায় এবারও ফার্স্ট হয়েছে সেই দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না মেয়ের। বাড়ির চাকর বা বাগানের মালির সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াবে, তবু ওর সঙ্গে নয়। তিন-চারটে মেয়ে বন্ধু হয়েছে এখন। চা-বাগানের ছোট বা মাঝারি সাহেবদের মেয়ে, সঙ্গে লোক নিয়ে ওর চোখের ওপর দিয়ে হাসতে হাসতে তাদের বাড়ি চলে যায়। ডাকলে মুখের ওপর বলে দেয়, তুমি বজ্জাতি করো, তোমার সঙ্গে মিশব না। কেবল ভালো কিছু লোভের টোপ ফেলতে পারলে একটু আধটু আসে। আর এলেও বাপীরই বেফাঁস রাগের ফলে ঝগড়া বেধে যেতে দশ মিনিটও সময় লাগে না।
এটাই যে জীবনের সব থেকে দুর্বৎসর বাপী জানত না। বছরের মাঝামাঝি সময়ে মন-মেজাজ বরং একটু ভালো হয়েছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরুতে দীপুদা কলকাতায় পড়তে চলে গেছে। বাপী অনেকখানি নিষ্কণ্টক। দাদা না থাকার ফলে ওই মেয়ে এখন অনেকটা একলা হয়ে যাবে। বাপীর আশা, ভুলিয়ে-ভালিয়ে আবার ওকে আগের মতো জঙ্গলে টানা যাবে।
.
…সকলে ধরে নিয়েছিল এ-বছর বনমায়ার চরিত্র ভালো হয়ে গেছে। দেখা গেল তা নয়, এবারে দিনমানে ছাড়া অবস্থাতেই পালিয়েছে। গাছ পাতা খাওয়ানোর জন্য ভীম বাহাদুর ওকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল। ছেড়ে দিয়ে ঘণ্টা দু’ ঘণ্টার জন্য নিজেও কোথায় গেছল। ফিরে এসে দেখে বনমায়া উধাও। ডেরাতেও নেই। পরে বাপীকে আবু হেসে হেসে বলেছে, বনমায়া গেলেই দোষ, ওকে জঙ্গলে ছেড়ে ভীম বাহাদুর নিজে কোথা গেছল?
কোথায় গেছল শুনে বাপীর রক্তেও দোলা লেগেছে। ভীম বাহাদুর চা—বাগানের আড়াই-পাত্তি তোলা এক কামিন মেয়ের প্রেমে পড়েছে ওকে বিয়ে করবে বলে টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় আছে। ফাঁক পেলে সেই মেয়ের সঙ্গে ফষ্টি—নষ্টি করতে যায়।
বরাত ভালো, কর্তাবাবুরা এবারে আর বনমায়ার পালানো নিয়ে ভীম বাহাদুরের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠেনি। তারাও বুঝে নিয়েছে, বছরে দেড় বছরে বনমায়া একবার করে পালাবেই আর দিনকতক গেলে নিজে থেকে ফিরেও আসবে।
কিন্তু উধাও হবার সেই রাতেই বনমায়া তার প্রেমিক হাতিকে নিয়ে বেশ একটা রগড়ের কাণ্ড করে গেছে। আসলে ওরা বানারজুলি জঙ্গলের খুব দূরে কোথাও যায়নি তখন পর্যন্ত। বেশি রাতে দুটোতে মিলে জঙ্গলের সেই গোপন ভাঁটিখানায় এসেছে। সেখানে যে দুটো লোক ভাঁটি আগলায় প্রাণের ভয়ে তারা একটা গাছের মগডালে গিয়ে উঠেছে। বনমায়া আর তার সঙ্গী বুনো হাতি হাঁড়ি—ভরতি দারু চোঁ-চো করে মেরে দিয়েছে। তারপর দুটোতে মিলে সে কি আহ্লাদ আর নাচানাচি। সেই আহ্লাদে আর নাচানাচিতে ভাঁটিখানা ভেঙে গুঁড়িয়েছে, সামনের অনেক ছোট গাছপালা মুড়িয়েছে। আবু আর বাপী ছুটে গিয়ে সেখানকার অবস্থাখানা দেখে এসেছে। বাপের আড়ালে হেসেছে শুধু আবু। নইলে ওর বাবা কালু আর অন্য বীটম্যানদের বনমায়ার ওপর সে কি রাগ!
ভালো মেয়ের মতো এবার বনমায়া দু সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে এসেছে। এবারে আর ভীম বাহাদুর রাগ করবে কোন্ মুখে? দৃশ্য দেখে বাপীর বেজায় হাসি পাচ্ছিল। বনমায়া তার খুদে চোখ দুটো বেঁকিয়ে ভীম বাহাদুরকে দেখছিল আর থেকে থেকে মাথা নাড়ছিল আর শুঁড় দোলাচ্ছিল। যেন বলছে, এমন কাজ আর কক্ষনো করব না। ভীম বাহাদুরও যেন আড়ি করে অর্থাৎ মুখখানা হাঁড়ি করে গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে।
এই সময় আবুর একটা কথায় সামনে যারা ছিল সকলেই হেসে উঠেছে। এমন কি ভীম বাহাদুরও। বনমায়ার বুকের কাছে পেল্লায় দুটো আদরের চড় বসিয়ে আবু বলল, তিন বছর ধরে পালিয়ে গিয়ে রস করে আসছিস—বাচ্চা—কাচ্চা হবার নাম নেই কেন? তোর মরদটাকে ধরে এনে ডাক্তার দেখা—
.
সকলের সঙ্গে বাপীও হেসেছে বটে, কিন্তু এ-সব কথা শুনলেও ভিতরে ভিতরে কি-রকম হতে থাকে। সকলের অলেক্ষ্য বনমায়ার সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। জন্তু জানোয়ারের প্রেম বা ভালবাসাবাসির কিছুই আর অস্পষ্ট নয় ওর কাছে। বয়েস তো চৌদ্দ গড়াতে চলল, তবু মানুষের ব্যাপারটাই যা একটু আবছা এখন পর্যন্ত। আবু অবশ্য বলে, সব এক ব্যাপার। মানুষ ওদের থেকে আরো পাজী জানোয়ার। ভালোবাসাবাসির ব্যাপারে বেশির ভাগ জন্তুর সময়ের বাছবিচার আছে, বছরের মধ্যে কোনো একটা সময় ধরে ওরা মেলে। মানুষ সম্বৎসর ভোগের দাস।
এই ভোগটা ভালো করে বোঝার জন্য একটা দুর্বোধ্য তাড়না। ফাঁক পেলেও এক-এক সময় চা-বাগানের দিকে চলে যায়। সেখানকার পাতা-তোলা সোমত্ত বয়সের মেয়েগুলোকে চেয়ে চেয়ে দেখে বিশেষ করে। এদের মধ্যে কোনটা ভীম বাহাদুরের ভালবাসার মেয়ে জানতে ইচ্ছে করে। ওরা গায়ে জামা-টামা পরে না, খাটো কাপড় একদিকের কাঁধ-বুক পেঁচিয়ে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত নেমে আসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওদের ঢলঢলে শরীরের বাঁধুনিতে আর উঁচু বুকে কি-রকম মিষ্টি-মিষ্টি ঢেউ খেলে। চোদ্দ বছরে বাপী এখন মাথায়ও ঢ্যাঙা হয়েছে বেশ। ওর সেই হাঁ করে দেখাটাও কম-বয়সী কতগুলো মেয়ে বোধ হয় টের পেয়ে গেছে। ওর দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসে এক সময়। কালো মুখে সাদা দাঁতের সারি ঝকঝক করে। একটা দুটো মেয়ে আবার দুষ্টুমি করে হাত তুলে কাছে ডাকেও। বাপী তক্ষুনি ছুটে পালায়। কিন্তু তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাথাটা ঝিম-ঝিম করে।
আজ আবুর ওই রসিকতার কথাগুলোই বাপীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আবু অন্য কাজে চলে না গেলে সঙ্গে নিত। বড়সাহেবের বাংলোর কাছে এলে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল।
বারান্দায় দুহাত শূন্যে ঝাঁকিয়ে মিষ্টি তার বাবার কাছে কিছু একটা আব্দার করছে। ওর পরনে একটা লাল ডুরে শাড়ি। গায়ে চকচকে নতুন জামা!
বাপীর চোখে পলক পড়ে না। এই বেশে মিষ্টিকে আর কখনো দেখেনি। জামা আর শাড়ির একটা লালচে আভা মিষ্টির চোখে মুখে ঠিকরোচ্ছে। মিষ্টিরও বয়েস দশের মাঝামাঝি এখন। আগের থেকে মাথায় বেড়েছে আর আরো হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে বাপী সেটা আগেই লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু এখন ওকে দেখেই মনে হল ও হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে মস্ত বড় হয়ে গেছে। রূপকথার সেই রাজকন্যাদের মতো হয়েছে।
বাবার পিছনে মিষ্টি ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল, বাপী জোরে একটা হাততালি দেবার লোভ সামলাতে পারল না। মিষ্টি ঘাড় ফেরালো। অন্য দিন হলে ও হয়তো জিভ ভেঙচে ঘরে সেঁধিয়ে যেত। গত পরশুও তাই করেছে। বাপীকে পাল্টা ভেঙচি কাটার সুযোগ না দিয়ে ঢুকে গেছল। কিন্তু আজ এই নতুন সাজটা দেখানোর তাগিদে পায়ে পায়ে বারান্দা থেকে নেমে গেটের দিকে এগুলো। বাপীর অমন ভেবাচেকা খাওয়া চাউনি দেখে ওর ঠোটে টিপ-টিপ হাসি।
সব রেষারেষি ভুলে বাপী বলেই ফেলল, কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে তোকে— মাইরি বলছি।
মিষ্টিরও একমুখ হাসি।—কলকাতায় দিদিমাকে চিঠি লিখেছিলাম, আমার জন্য সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে পাঠাতে—লোকের সঙ্গে কাল শাড়ি জামা দুইই পাঠিয়েছে। বাবাকে আজ আচ্ছা করে ধরেছি জিপে করে বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে, আমি এই শাড়ি পরে যাব—বাবা রাজি হয়ে গেছে।
শুনে সত্যি হিংসে হচ্ছে বাপীর। চাইলেই শাড়ি পায়, বাবার সঙ্গে জিপে করে বেড়াতে পায়। মাথা খুঁড়লেও শাড়ি-পরা মিষ্টির পাশে বসে জিপে করে একটু বেড়ানোর উপায় নেই। সাহেব মেমসাহেব ছেড়ে মিষ্টিকেও এ কথা বললে ও বেয়াদপী ভেবে মুখ মচকাবে। কি, না ওর বাবা কেরানী, কেরানীর ছেলের এত সাহস বরদাস্ত হবার নয়। কেরানীর বোনের হাতের তৈরি আমসত্ত্ব-আচার বা দুধ—কলা-মুড়ি তো বেশ, চেটেপুটে খেতে পারিস।
তবু, এই মিষ্টিকেই আজ দারুণ লাগছে বাপীর। তাই ঠেস-ঠিসারায় ওকে রাগাতে চাইল না। উল্টে খুব মোলায়েম করে বলল, আজ দুপুরে এই শাড়িটা পরে চুপিচুপি জঙ্গলে বেড়াতে আসবি? আয় না, একেবারে জঙ্গলে দেবীর মতো দেখতে লাগবে তোকে—
মিষ্টির মন ভিজল, কিন্তু ভরসা পেল না। ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, হুঁ, বাড়িতেই বলে শাড়ি সামলাতে পারি না, এদিক ধরি তো ওদিক খোলে—শাড়ি পরে জঙ্গলে ঢুকে আছাড় খেয়ে মরি আর কি।
—না রে না, আমি তো থাকছি সঙ্গে, আছাড় খাবি কেন?
শোনামাত্র মিষ্টি চোখ পাকালো। ও, এই ফাঁকে আমার গায়ে হাত দেবার মতলব তোমার—কেমন? ফের তুমি আমাকে তুই-মুই করে কথা বলছ?
মুহূর্তের মধ্যে বাপীও আগের সেই বাপী। দু চোখে রাগ জমাট বাঁধছে। সেই সঙ্গলোভও চিকিয়ে উঠছে। অনেক দিনের মধ্যে গায়ে দূরে থাক, হাতে হাত ঠেকাবারও সুযোগ হয়নি। রাগের চোটে হাত দুটো ডবল নিশপিশ করছে, আর ওই ফোলা গাল দুটো ছিঁড়ে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু মিষ্টিও সেয়ানা কম নয় এখন। এই চোখ-মুখ দেখেই গেট ছেড়ে এক ঝটকায় তিন পা পিছিয়ে গেল। তারপর বাপীর মতো করেই পলকা রাগে চোখ পাকাতে চেষ্টা করল। এখানে ও-ছেলের কোনো জারিজুরি খাটবে না জানে বলেই ঠোঁটে মজার ছোঁয়া।
—ডাকব মাকে?
গেট ছেড়ে বাপী হনহন করে হাঁটা দিল। রাগের মাথায় বনমায়ার ফিরে আসার খবরটাই ওকে বলা হল না। কিন্তু রাগটা আজ আর বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেল না!… আবু যদিও বলে ভালোবাসাবাসির ব্যাপারে মানুষে জানোয়ারে তফাৎ নেই, তবু ওর চোখে মেয়েরা এখনো আবছা রহস্যের মতো। আজ শাড়িপরা মিষ্টিও যেন ওমনি একটু রহস্যের ওধারে চলে গেছে।
এর দিন-কতকের মধ্যে সেই রহস্যের পর্দা ছিঁড়ে-খুঁড়ে একাকার। কি কারণে স্কুলের ছুটি চলছে তখন।
কলকাতা থেকে জাঠতুতো ভাই মণিদা এসেছে। সঙ্গে তার নতুন বউ গৌরী। গৌরী বউদি। মাত্র মাসখানেক আগে বিয়ে হয়েছে তাদের। কলকাতা থেকে নেমন্তন্নর চিঠি এসেছিল। বাবা লিখেছে যাওয়া সম্ভব নয়। সুযোগ সুবিধে হলে মণিদা যেন বউ নিয়ে বেড়াতে আসে।
নতুন বউ নিয়ে মণিদা গেছল দার্জিলিং বেড়াতে। ফেরার পথে দিন চার—পাঁচের জন্য এখানে আসা। আগে থেকে জানান দিয়েই এসেছে তারা। শুনে বাপী একমাত্র কারণে খুশী হতে পারে নি। দুখানা মাত্র ঘর। অতিথিরা এলে থাকার ব্যবস্থা কি হবে শুনেই বাপীর মাথা গরম হয়েছিল। বাবার ঘরটা বড় একটু। পিসীর সঙ্গে সেই কটা রাত বাপীকে বাবার ঘরে শুতে হবে। এমন বিড়ম্বনার মধ্যে বাপীকে স্মরণীয়কালের মধ্যে পড়তে হয় নি।
কিন্তু মণিদা আর তার নতুন বউ গৌরী বউদিকে দেখে বাপীর সেই চাপা কৌতূহল নতুন খোরাক পেল। গৌরী বউদির বছর কুড়ি হবে বয়েস আর মণিদার আটাশ। বয়সের তুলনায় মণিদাকে একটু ভারিক্কী গোছের দেখায়। ওদিকে নাম গৌরী হলেও গৌরী বউদি ফর্সা নয় আদৌ। কালোই বলা চলে। কিন্তু মুখখানা বেশ চকচকে, চোখ দুটো হাসি-হাসি।
উঠতে বসতে চলতে ফিরতে পুষ্ট যৌবনের কোনো মেয়েকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল বাপীর। আরো কিছু উষ্ণ অথচ মজার খোরাক পেতে লাগল মণিদার উদ্দেশে গৌরী বউদির হাসি-মাখা চোখের ইশারার ব্যাপার-ট্যাপারগুলো লক্ষ্য করে। মণিদা হয়তো পিসীর সঙ্গে কথা কইছে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর, গৌরী বউদিও সেখানেই। হঠাৎ দেখা গেল, পিসীকে গোপন করে চোখের ইশারা করে আর সামান্য একটু ঘাড় বেঁকিয়ে কি বোঝাতে চেষ্টা করে গৌরী বউদি ঘরে চলে গেল। আর তার একটু বাদেই মণিদাও চলল সেদিকে। বাবার সামনেও দুরাত এই কাণ্ড দেখেছে। খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ গল্পসল্প অনেকক্ষণ ধরে। বাপীকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়, ও ঠিক লক্ষ্য করেছে। গৌরী বউদি উসখুস করছে একটু আর মণিদার দিকেই চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতে গৌরী বউদির সেইরকম ইশারা আর তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে যাওয়া। তার একটু বাদেই মণিদা গোটা দুই হাই তুলে বলল, যাই, শুয়ে পড়িগে।
বাপীর অজানা রহস্যের সব কিছু এখন ওই একটা ঘরের আড়ালে। ভিতরে এক অবুঝ অবাধ্য তাড়না। ওই কাঠের ঘরের কোন্ ফাঁকে বাইরে থেকে চোখ লাগালে ভিতরের সব দেখা যায় তাও ওর জানা। ওটা পিসীর আর ওর ঘর। আচার আমসত্ত্ব এমন কি পয়সা চুরি করার জন্যও নিজের উপস্থিতি গোপন করে পিসী ঘরে আছে কিনা বা কি করছে না করছে—কত সময়ে দেখতে হয়। জলে টলে ভিজে এলে তো দেখতেই হয়—কারণ ওই এক ব্যাপারে পিসীর মাথার ঠিক থাকে না।
…বাবা শুলেই ঘুম। পিসীকে বাইরে যাবার কথা বলে পা টিপে বাইরের সেই ফাটলেও চোখ লাগিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ততক্ষণে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। চোখ নিঃশব্দে দিনের বেলাতেও লাগিয়েছে। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া সারতেই বেলা হচ্ছে ইদানীং। মণিদাকে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোতে দেখে, আর গৌরী বউদিকে কলকাতা থেকে আনা গল্পের বই পড়তে দেখে।
মণিদাকে দেখে বাপীর মনে হয়েছে, মোটাসোটা ভাল মানুষ। খেতে আর ঘুমোতে ভালবাসে। যার মধ্যে রহস্যের ছিটে-ফোঁটাও নেই। যা-কিছু সব ওই গৌরী বউদিকে ঘিরে। চোখের ইশারায় বা ভ্রুকুটি বা ঠোটের হাসি দিয়ে মণিদাকে যেন যেমন খুশি চালানোর ক্ষমতা রাখে।
বাপীর একটা সুবিধে, নতুন যে দেখে সে-ই ওকে খুব নিরীহ গো-বেচারা গোছের ছেলে ভাবে। মণিদা আর বিশেষ করে গৌরী বউদি তো ভাবেই। নইলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়ানোর সময় বুকের কাপড় খসে গেলেও পিসীর সামনে যেমন তাড়াতাড়ি তুলে দেয়, ওর সামনে নয়। সকাল সাড়ে নটার মধ্যে সেদিন বাপীর সঙ্গে গৌরী বউদি আর মণিদার জঙ্গল দেখতে বেরুনোর কথা। জঙ্গলের ব্যাপারে ও যেমন ডানপিটে সেটা অবশ্য তারা জেনেছে। পাথর দিয়ে এক দিন দুটো বুনো মুরগী মেরে এনে তাদের খাওয়ানো হয়েছে। তাদের অবাক হতে দেখে পিসী ওর জঙ্গলের দস্যিপনার গল্প করেছে। কিন্তু ওর পড়াশুনার ব্যাপারে বাবা আবার যা বলেছে তাতে সকলেই ওকে হাবাগোবাই ধরে নিয়েছে। তা না হলে জঙ্গলে বেরুনোর আগে গৌরী বউদি এমন কাণ্ড করে সেদিন।
…গৌরী বউদি বলেছিল, একেবারে স্নান সেরে বেরুবে। দেরি দেখে তার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে বাপী ঢুকে থতমত খেল। কিন্তু ওকে দেখে মণিদা বা গৌরী বউদির ভ্রুক্ষেপ নেই। প্যান্ট আর শার্ট পরে তৈরি হয়ে মণিদা চৌকিতে বসে সিগারেট টানছে। গৌরী বউদির হাতে পাট-ভাঙা শাড়ি, তার উল্টো-সোজা দেখে নিচ্ছে। পরনে শুধু ব্লাউস আর সায়া। ওকে দেখে শাড়ির দিকে চোখ রেখেই বলল, দাঁড়া রে বাবা, যাচ্ছি তো জঙ্গলে, অত তাড়া কিসের—এ তো আর সিনেমার টিকিট ফুরিয়ে যাবার মতো কিছু নয়!
স্নানের আগে বাপী গৌরী বউদিকে একবার তাড়া দিয়েছিল বটে। এখন ঘর থেকে সরে না গেলেও কেউ কিছু ভাববে মনে হল না। গৌরী বউদি যত্ন করে শাড়ি পরছে। বাপী আড়চোখে দেখছে দাঁড়িয়ে, আর মণিদা আগে কখনো জঙ্গল টঙ্গল দেখেছে কিনা সে-সম্বন্ধে দুই একটা অবান্তর কথা জিজ্ঞাসা করছে।
ধীরে সুস্থে শাড়ি পরা শেষ হল গৌরী বউদির। ঘাড় বেঁকিয়ে পিছন দিকটা দেখে নিয়ে ওকে বলল, পিছনে পায়ের দিকটা টেনে দে দেখি।
এ-রকম উদ্ভট ফরমাসের জন্য বাপী আদৌ প্রস্তুত ছিল না। পিছনে গিয়ে উপুড় হয়ে বসে শাড়ির ওপর দিয়ে দুহাতে একটা পা ধরল, কিন্তু কি ভাবে টানবে বুঝতে পারছে না।
গৌরী বউদি হেসে বাঁচে না। হাসছে মণিদাও। গৌরী বউদি হাসি সামলে বলল, তুই এ-রকম হাঁদা, অ্যাঁ? পা ধরে টানছিস! শাড়ির তলার দিকটা টান করে দিতে বললাম তোকে আর তুই পা চেপে ধরে শাড়িটা কুঁচকে দিলি?
এবারে বাপীর মাথায় ঢুকেছে। তাই করেছে। আর সন্তর্পণে বড় নিঃশ্বাস নিয়েছে। স্নো-পাউডারের গন্ধ…। মিষ্টির গায়ের মতো নয়।
ওদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে। গা ছমছম করছে বলে হোক বা পায়ে ঠোক্কর খাবার ভয়ে হোক, গৌরী বউদি বেশির ভাগ সময় বাপীর হাত ধরে থেকেছে। জঙ্গলের গল্প করতে করতে বাপীর মাথায় আরো বেশি হাবা-গোবা সাজার ঝোঁক চেপেছে। ভিতর থেকে কে যেন ইন্ধন যুগিয়েছে। খুব বোকার মতো যে-প্রসঙ্গে আসতে চায় তার সুযোগের অভাব জঙ্গলে নেই। দুটো বন-মোরগ দেখে লোভীর মতো মণিদা বলে উঠল, মার না-পারবি?
বোকা-বোকা গম্ভীর মুখে বাপী মাথা নেড়েছে। ও দুটোর একটা পুরুষ, একটা মেয়ে—ভালবাসাবাসির সময় মারতে নেই।
এই প্রসঙ্গে আসতে চায় বলেই বলা। নইলে আগে-পিছে মুরগি দুটো এমনিই চরছিল। ওদের দেখে জঙ্গলে ঢুকে গেছে। কিন্তু এ-কথা শুনে মণিদা আর গৌরী বউদি দুজনেই হাঁ প্ৰথম। তারপর তাদের দুজনের চোখোচোখি। মণিদা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আর গৌরী বউদি হাসি সামলানোর চেষ্টায় হাত ছেড়ে শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজেছে. তাও কি সহজে হাসি থামে।
তেরছা চোখে চেয়ে গৌরী বউদি জিজ্ঞাসা করল, তুই জানলি কি করে?
আরো সাদা মুখ করে বাপী জবাব দিল; জঙ্গলে বেশিদিন থাকলেই জানা যায়। আমাদের সাড়া পেয়ে ঝোপে ঢুকে গেল বলে, নইলে দেখতে একটা আর একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
আবার ঝলকে ঝলকে হাসি গৌরী বউদির, আর মণিদার সঙ্গে চোখোচোখি। এত হাসির কি হল বাপী যেন বুঝতেই পারছে না।
গৌরী বউদি জিজ্ঞাসা করল, তুই নিজে থেকে জেনেছিস, না কেউ তোকে বলে দিয়েছে?
বাপী সতর্ক। আবার প্রসঙ্গ বিস্তারের ঝোঁকও অদম্য।—গোড়ায় গোড়ায় আবু বুঝিয়ে দিয়েছে। ও তো সব জন্তু-জানোয়ারের নাড়ি-নক্ষত্র জানে, আর চোখেও দেখেছে।…ওর সঙ্গে থেকে আমিও কম দেখি নি।
এমন সাদাসিধে ছেলের মুখ থেকে আরো শোনার লোভ গৌরী বউদির। তক্ষুনি জিজ্ঞাসা করল তুই আর কি দেখেছিস?
বাপী তখন ভালবাসাসির সময় পুরুষ ময়ূর পাখনা মেলে মেয়ে ময়ূরকে কেমন নাচ দেখায় সেকথা বলেছে, সাপের সেই পাকে পাকে জড়ানো মারাত্মক ভালবাসাবাসির কথা বলেছে। একই প্রসঙ্গে তিন বছর ধরে বনমায়ার বজ্জাতির কথাও বলেছে।
আদিম ইশারা কাকে বলে বাপী সঠিক না জানলেও নতুন কিছু দেখছে। গৌরী বউদির কালো মুখে লালের ছোপ লেগেছে। থেকে থেকে মণিদার সঙ্গে চোখে চোখে কিছু কথা হচ্ছে তার। দুজনেরই, বিশেষ করে গৌরী বউদির মুখে চাপা হাসি ঠিকরে পড়ছে।
কি দিন কি দিন আজ! ফেরার পথে একদিকে চোখ পড়তে বাপীর পা দুটো আটকে গেল মাটির সঙ্গে। অদূরে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে ভীম বাহাদুর। তার তিন হাত দূরে বসে একটা উঠতি বয়সের কালো-কালো পাহাড়ী মেয়ে। বাপী দেখামাত্র বুঝে নিয়েছে মেয়েটা কে।
এই দলটিকে দেখে ভীম বাহাদুর বেশ লজ্জা পেয়েছে। কারণ বাপী তো আর ওর অচেনা নয়। ওদের হাব-ভাব দেখে আর বাপীর মুখ দেখে গৌরী বউদি কৌতূহলে টইটম্বুর। খানিক এগিয়ে জিজ্ঞসা করল, তুই চিনিস নাকি এদের?
—চিনব না কেন। লোকটা হল ভীম বাহাদুর, বনমায়ার মাহুত,—মেয়েটা ভীম বাহাদুরের ভালবাসার মেয়ে। কাজে ফাঁকি দিয়ে দুটোতে জঙ্গলে এসে ঢুকেছে—
এর পর বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মণিদার চাউনি দেখে বাপীর মনে হয়েছে তার বেজায় জল-তেষ্টা পেয়েছে। আর জলের অভাবে ঘন ঘন গৌরী বউদির দিকে তাকাচ্ছে। গৌরী বউদি কেবলই হাসি চাপছে, আর সঙ্গের হাবা ছেলেটাকেই গোপন করে ইশারায় মাথা নাড়ছে বা ভ্রূকুটি করে মণিদার কোনো ইচ্ছে নাকচ করে দিচ্ছে।
…নিঝুম দুপুরের বাতাসেও কি যে কানাকানি ছিল বাপী জানে না। বাবা বেরিয়ে গেছে। পিসীও শুয়ে। ও-ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ যেন জোর করে বাপীর পা দুটোকে সেই ঘরের পিছনে টেনে নিয়ে গেল। তারপর একটা চোখ সেই ফাটলে।
তারপরেই বাইরে একেবারে কাঠ ও। ভিতরে প্রবল ঝাঁকুনি। বুকের ধপধপানি ভিতরের কেউ শুনতে পাচ্ছে কিনা সেই ভয়। শরীরের রক্ত শিরশির করে গা বেয়ে নামছে তো নামছেই। আবার একই সঙ্গে মাথার দিকে আগুন ছুটেছে। নদীর ঢেউয়ের মতো পায়ের নীচের মাটি দুলছে।
কতক্ষণ কেটেছে জানে না। হঠাৎই আবার একটা ঝাঁকুনি খেয়ে চমক ভাঙল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাপী ঘরের বাইরে ছুটল। ছুটে একেবারে জঙ্গলে। সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছে। বুকের ভিতরটা আরো বেশি ঢিপ ঢিপ করছে।
জঙ্গলে ঢুকেও হন হন করে হেঁটেই চলেছে বাপী। অথচ এর থেকে বাড়ির কুয়োটাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ভালো হত। গা মাথা ডুবিয়ে বসে থাকতে পারলে ভালো হত।
.
চোখের সামনে আর রহস্যের পর্দা বলে কিছু নেই। এতদিন সেটা অল্প অল্প নড়ছিল, দুলছিল। তার ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু আভাস উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল তার সবটাই যে এমন আজব কল্পনা বাপী ভাবতেও পারে নি। কিন্তু তাই যেন ঢের ভালো ছিল আর মিষ্টি ছিল।
এক হ্যাঁচকা টানে পর্দাটা ছিঁড়ে দিয়েছে কেউ। কেউ কেন, বাপী নিজেই দিয়েছে। আর সেই মুহূর্তে ওর বুকের তলার রূপকথার জগৎটা ভেঙে গুঁড়িয়ে একাকার হয়ে গেছে।
গৌরী বউদিকে নিয়ে মণিদা চলে গেছে। বাপী হাঁপ ফেলে বেঁচেছে। গৌরী বউদির পাশে মণিদাকে একটু বেঁটে দেখায়। বাপী গৌরী বউদির মাথায় মাথায় হবে। যাবার আগে গৌরী বউদি ওকে দু গাল টিপে আদর করে গেছে। কলকাতায় গেলে তাদের ওখানেই উঠতে বলেছে। মাঝের দুটো দিন বাপী আগের মতো কাছে যেতে পারে নি, তাকাতে পারে নি। মনে হয়েছে, ভালো করে ওর মুখের দিকে তাকালেই চুরি ধরা পড়ে যাবে। একেবারে জল-ভাত ছেলে না ভাবলে গৌরী বউদির সন্দেহ হতে পারত।
যেমন আবুর হয়েছিল।
আগেও বাপীকে তারিফের সুরে অনেক সময় বলেছে, তুই একটা ভিজে বেড়াল, দেখলে মনে হবে কিছু জানিস না, কিছু বুঝিস না—ভাজা মাছখানাও উল্টে খেতে জানিস না। মজা লুটতে চাস তো এই ভাবেই থাকবি আর দরকার হলে ঝোপ বুঝে কোপ মারবি।
মণিদারা চলে যাবার পরেও বাপীর মনে স্বস্তি নেই একটুও। ও যেন কি একটা সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। তার থেকে যত বেরিয়ে আসতে চায়, ওটা ততো টানে। আর ভিতরে একটা অজানা যন্ত্রণা ছড়ায়। নিজেকে শাস্তি দেবার জন্যেই বিনা তাগিদে পড়ার বই নিয়ে বসে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু যন্ত্রণাটা তখন মাথায় নড়াচড়া করতে থাকে। বই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
ছোট লাঠিটা হাতে করে জঙ্গলে চলে আসে। দমাদম পিটে এক-একটা গাছের ছাল তুলে দেয়। নয় তো পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ঘা করে দেয়। একটা ময়ূর দেখে পাথর নিয়ে খ্যাপার মতো তাড়া করেছিল। এরকম করলে যন্ত্রণার চাপ-ধরা বাতাসটা হাল্কা হতে থাকে।
কিন্তু সে আর কতক্ষণ। অবাধ্য পা দুটো তারপর ওই বড়সাহেবের বাংলোর দিকে এগোবেই। বরাত এমন, পর পর দুদিনই মিষ্টির বদলে ওর বাবা-মাকে বারান্দায় দেখেছে। মেরে ফার্স্ট হয় ক্লাসে, সকালের দিকে ঘরে বসে তার পড়াশুনা করাই স্বাভাবিক এটা মনে হয় না। অকারণ রাগে একটা খারাপ গালাগাল ভিতর থেকে ঠেলে বেরোয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই সাহেব আর মেমসাহেবকে ঘিরেই একটা কুৎসিত ছবি মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। নিজের ভিতর থেকে সেটা উচ্ছেদ করার তাগিদে বাপী হনহন করে সামনে এগিয়েছে।
সেই সামনে এগনোর শেষ চা-বাগানের আড়াই-পাতি তোলা মেয়েদের কাছাকাছি এসে। যে মেয়েগুলো ওকে দেখলেই মজা পায়। দাঁত বার করে হাসে। ওকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাসা চলে মনে হয়। সেদিনও এক ফুর্তিবাজ মেয়ে হাত তুলে ওকে ডেকে বসল। বাপী সেদিন আর আগের মতো ছুটে পালালো না। কটা দিনের মধ্যে ভিতরটা কত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নিজেরও জানা ছিল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
মেয়েটা কম করে আট-ন বছরের বড় ওর থেকে। ঠোঁট আর কালো কালো চোখ দুটোও হাসিতে ভেজা। বেতের ঝুড়ি বাঁধা কোমর সোজা করে দাঁড়াল। অবাক সুরে জিগ্যেস করল, তুমি ইখেনে কি দেখতি আস গো খোকাবাবু?
বাপী বলল, তোমাদের পাতা তোলা দেখতে ভালো লাগে।
শুনে মেয়েটা শক্ত মাটিতে আছাড় খেল যেন।—পাতি তুলা দেখতি ভালো লাগে—মোদের দেখতি লয়। হায় হায় হায় হায়—
আশপাশের আট-দশটা মেয়ে খিল-খিল করে হেসে উঠল। বোকা মুখ করে বাপীও হেসেছে একটু একটু। তারপর চলে এসেছে। একটা ছোট ছেলেকে রসে পেয়েছে ভেবেই এমন হাসাহাসি ওদের! বয়েসটা যে বাপীর রাতারাতি কত বেড়ে গেছে ওরা জানবে কি করে। এত বেড়েছে যে নিজের ভিতরে আর কুলিয়ে উঠছে না। মনে হয় এজন্যেই এমন যন্ত্রণা।
ঘরের সামনের জমিতে বসে হাত-দা দিয়ে একটা বাখারি চাঁছিল আবু রব্বানী। বাপী কাছে আসতে মুখ তুলে একবার দেখে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল।
বাপী সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিল মেজাজ-পত্র ভালো নয়। ওর পাশে আরো কটা চাঁচা বাখারির টুকরো পড়ে আছে।
হাত দুই ফারাকে বাপীও মাটির ওপরেই বসল। বলল, দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুরে তোমাকে জঙ্গলে না পেয়ে এখানে এলাম—
বাখারি চাচার ফাঁকে আবু একবার টেরিয়ে দেখে নিল ওকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞসা করল, ছুটির মধ্যে এ কদিন সকাল দুপুর কোথায় ডিউটি দিলি— বড়সাহেবের বাংলোয়?
বাপী ঢোক গিলল।—না, কলকাতা থেকে দাদা-বউদি এসেছিল।
এবার আবু অবাক একটু।—তোর আবার দাদা-বউদি কে?
জ্যাঠতুতো দাদা।…বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল। এখানেও এসে ছ-সাত দিন ছিল—
বাখারি ছেড়ে আবুর ছোট ছোট চোখ দুটো এবার সোজা ওর মুখে এসে আটকালো। এভাবে কি দেখার আছে ভেবে না পেয়ে বাপীর অস্বস্তি।
—দাদার বয়স কত?
—সাতাশ-আটাশ।
—আর বউদির?
—বছর কুড়ি। আবুর চাউনি আর রকম-সকম দেখে বাপী ঘাবড়েই যাচ্ছে।
—দেখতে কেমন?
—কালো।…তবে ভালোই।
আবু এবার কানে গোঁজা একটা বিড়ি টেনে নিয়ে দাঁতে লাগালো। কোমরের লুংগিতে গোঁজা দেশলাই বার করে ধরালো সেটা। বন-বেড়াল মারার পর চাকরিটা হয়েই গেছে ধরে নিয়ে বিড়ি খেতে শুরু করেছিল। ওকে বলেছিল, কোনো একটা নেশা না থাকলে পুরুষমানুষকে মানায় না। কিন্তু বাপের হাল দেখে হাঁড়িয়ার ওপর হাড়ে চটা। তাই বিড়ি ধরেছে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এবার হাল্কা চালে বলল, তাই বল্, নতুন বউদির সেবাযত্ন করে বেশে রসে-বসে ছিলি কটা দিন—নইলে ছুটির দিনগুলোতেও তোর মতো ছেলে সকাল দুপুর ঘরে কাটায়।
বাপীর ফাঁপরে পড়ার দাখিল। আবু নিজেই বলে জঙ্গলের সব জানোয়ারের মন-মেজাজ বোঝে। এখন মনে হল, ওর দিকেও আর একটু ভালো করে তাকালে ভিতরে যা আছে সব গলগল করে বার করে নেবে।
হেসেই পাশ কাটাতে চেষ্টা করল। —বাবা আপিস নিয়ে এত ব্যস্ত এ কদিন, আমাকে বাজার পর্যন্ত করতে হয়েছে— বুঝলে?
ডাহা মিথ্যে কিছু বলে নি। সত্যি কদিন ধরে বাবার কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। রাতে ছাড়া কলকাতার অতিথিদের সঙ্গে দুদণ্ড বসে গল্প করারও সময় পায় নি। কৈফিয়ত দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজ জঙ্গলে যাও নি যে?
বিড়িটা দাঁতে চিবিয়ে আবু অস্ফুট রাগত জবাব দিল, এ শালা জঙ্গলের নিকুচি করি আমি।
জঙ্গল-অন্ত-প্রাণ আবুর মুখে এ কি কথা।—কেন চাকরি হবে না তোমার?
—হবে। তোর শ্বশুরের নাতি-নাতনী হবার পরে হবে।
শ্বশুর কাকে বলছে বাপীর সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। আগেও ঠাট্টা করে বড়সাহেবকে ওর শ্বশুর বলেছে। কিন্তু নাতি-নাতনী হবার কথাটা শোনা মাত্র একটা দৃশ্য ভিতরে থেকে ঠেলে ওঠার উপক্রম, সঙ্গে সেই যন্ত্রণাটাও। আবু নিজের খেয়ালে আছে তাই বাঁচোয়া। বলল, তোর পিসীর কাছ থেকে কিছু ধার যোগাড় করে দিতে পারিস—একটা খাকী ফুল-প্যান্ট আর মোটামুটি একটা ভালো জামা দরকার। শিলিগুড়ি চলে যেতে পারলে একটা কাজ হয়ে যেত— যুদ্ধের চাকরিতে সেখানে অনেক লোক নিচ্ছে শুনলাম।
বাপী হতভম্ব।—যুদ্ধের চাকরি!
আবুর গলায় বিরক্তি।—কি লেখাপড়া করিস, পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে কিনা জানিস না?
সে তো ইংরেজদের সঙ্গে জার্মানির—এখানে কি?
এখানেও হতে পারে, নইলে ঝুড়ি ঝুড়ি লোক নিচ্ছে কেন? আবার পাঠিয়েও দিতে পারে, এই বানারজুলির রাস্তা দিয়েও ট্রাক বোঝাই মিলিটারি যাচ্ছে আসছে, দেখিস না?
বাপী ভয়ানক দমে গেল। বানারজুলি ছেড়ে, এই জঙ্গল ছেড়ে আর ওকে ছেড়ে আবু কোথাও চলে যেতে পারে ভাবলেও বুকের ভেতর টনটন করে। তার ওপর বলে কিনা যুদ্ধের চাকরি নেবে, যুদ্ধে যাবে!
—কি রে, শুনেই ঘাবড়ে গেলি যে। ওর মুষড়ে পড়া মুখ দেখে আবুর একটু ভালো লেগেছে।—আরেএই শর্মা না পারে কি, কোনো শালার একটা চান্স দেবার নাম নেই—এখানে বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজব?
গলায় একটু জোর এনে বাপী বলল, এখানেই ঠিক তোমার কাজ হয়ে যাবে, দেখো।
—আর হয়েছে। আমাদের বড়সাহেবের ছোট বাবা এসে সক্কলের পেছনে হুড়ো দিয়ে গেছে, এখন চাচা যে যার আপনা প্রাণ বাঁচা–কে কাকে দেখে? চোখ-কান বুজে নতুন বউদির সেবা-যত্নই করে গেলি, এদিকের কোনো খবরই রাখিস না বুঝি?
মাথার যে অবস্থা চলেছে সত্যি কোনো খবরই রাখে না বাপী। বাবাকে একটু বেশি ব্যস্ত দেখেছে কদিন এই যা। আর মণিদারা চলে যাবার পর এ দুদিন বাবার সঙ্গে দেখাই হয় নি বলতে গেলে। আগেই বা কতটুকু হত।
আবুর মুখে মোটামুটি খবর শুনে সেও তাজ্জব। বড়সাহেবের ছোট বাবা বলতে উত্তরবঙ্গের সহকারী ডিভিশন্যাল ফরেস্ট অফিসার—দু’কথায় অ্যাসিসট্যান্ট ডি এফ ও। তার ওপরে ডি এফ ও—সে লালমুখো খাঁটি সাহেব। আর ওই এ-ডি-এফ-ও এদেশের মানুষ হলেও বাঙালী নয়। কারো লাগানো—ভাঙানোর জন্যে হোক বা বানারজুলি জঙ্গলের রিপোর্ট দেখে হোক, জানান না দিয়ে সে হুট করে এসে হাজির হয়েছিল। চার-পাঁচ দিন থেকে সব দেখে শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফিরে গেছে।
না বুজেই বাপী জিগ্যেস করল, অত রেগে গেল কেন?
—রেগে যাবে না, যার চোখ আছে সে-ই বুঝবে এ জঙ্গলের বারোটা বাজতে আর বেশি বাকি নেই। আধ্যেক নালা শুকনো, জল চলে না, কত চারা-বেড শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেল, তাও ছাগল-গরুতে মুড়িয়ে যাচ্ছে, দামী দামী শিশু গাছ-গুলোর চার ভাগের এক ভাগ লোপাট, শালজঙ্গল তো আরো বেশি ফাঁকা হচ্ছে—ওদিকে জঙ্গল কূপ-এর ইজারাদাররা সেই একই টাকা দিচ্ছে। সাহেবদের পিয়ারের বা খদ্দের-শিকারীরা এসে একধার থেকে বাঘ ভালুক শুয়োর হরিণ মেরে মেরে জঙ্গল কানা করে দিচ্ছে—জঙ্গল বাঁচবে কি মন্ত্রের জোরে? ছোট থেকে বড় সব শালা চোর—বুঝলি?
সত্যিকারের রাগে বেগনে মুখ আবুর। বাপী কিছু জানত, কিন্তু এতটা জানত না। শেষের কথায় আরো মুখ শুকালো। ভয়ে ভয়ে বলল, আমার বাবাও?
—ধেৎ। এবারে আবু ঠাণ্ডা একটু।—তোর বাবা হল গিয়ে ধার্মিক চুনোপুঁটি মানুষ, তেনার কথা কে বলছে। জঙ্গলটা সায়েব-সুবোদের লুটের মাল, তাদের পেট মোটা হচ্ছে। নড়ুক নডুক— ধৰ্ম্মের কল বাতাসে ভালো করে নড়ুক।
ঝটকা মেরে উঠে ঘরে চলে গেল। হাত-দা টা ওর হাতেই। বাপীর মনে হল, হাতের কাছে তেমন কাউকে পেলে একটা কোপ-টোপ বসিয়ে দিতে পারে।
মিনিট সাত-আটের মধ্যে আবার বেরিয়ে এলো। পরনে হাতে-কাচা পরিষ্কার পাজামা গায়ে ফুলকাটা পাঞ্জাবি। এ-ই ওর বাবু-পোশাক। চাঁছা বাখারিগুলো জড়ো করে হাতে নিল।—চল্।
আবু চল্ বললেই চলে অভ্যস্ত বাপী। ওর হাতের বাখারিগুলো বেশ পুরুষ্ট। ভাবল তেমন ভালো কোনো চারাগাছের জন্য হয়তো ওগুলোর দরকার। কিন্তু আবু জঙ্গলের পায়ে-হাঁটা পিছনের রাস্তা ধরে চলল। ও-দিকে শুধু ঝোপ-ঝাড় আর নীচু-জাতের খেটে-খাওয়া মানুষদের একটা দুটো করে মাটির ঘর ছাড়া আর কিছু আছে বলে জানে না। এদিকে যারা থাকে তারা বেজায় গরিব।
আরো একটু ভিতরের দিকে প্রায় দেড় মাইল হাঁটার পর আবু ওকে নিয়ে এক জায়গায় এসে থামল। একই মাটির ছাদের নিচে পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা সামান্য বড় আর একটা ছোট। ছোট ঘরটার সামনেটা হাঁ করা, অর্থাৎ দরজা নেই। বড় ঘরের সামনে হোগলার ওপর বাখারি লাগিয়ে দরজা বসানো। ঘর দুটোর চারদিকে একটু জায়গা নিয়ে গাছের ডালের বেড়া দেওয়া হয়েছে। ডালগুলো বাঁশের খুঁটির সঙ্গে মোটা তার দিয়ে কষে বাঁধা। সামনেও দুটো বাঁশের খুঁটির সঙ্গে আটকানো গাছের ডালের গেট।
কাছাকাছির মধ্যে আর কোনো মাটির ঘরও নেই।
আবু গলা চড়িয়ে হাঁক দিলে, কই গো, বাদশা-বেগমরা এখনো সব ঘুমিয়ে নাকি?
বাপীর মুখে কথা নেই, ভিতরে বেশ অবাক। আবুর সঙ্গে এতকাল ঘুরছে, কিন্তু এখানে এই প্ৰথম
প্রায় একই সঙ্গে পাশাপাশি ঘর দুটো থেকে দুটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। আর দরজাঅলা ঘরটার ভিতর থেকে পুরুষের গলা ভেসে এলো, আবু ভাই এলে? দুলারি, আবু ভাইকে ভিতরে আসতে বল্ না—
দুজনেরই পরনে আধ-ময়লা জোড়াতাপ্পির শাড়ি। পুরুষের গলা থেকে বোঝা গেল হোগলার দরজার সামনে যে, সে-ই দুলারি। বছর উনিশ-কুড়ি, অর্থাৎ আবুর বয়সী হবে। যেমন ঢ্যাঙ্গা, তেমনি আঁটোসাঁটো শরীর। গায়ের রং কালো ঘেঁষা তামাটে। মাথার এলোমেলো লালচে চুলে কখনো বোধ হয় তেলের ছোঁয়া পড়ে নি। সুন্দরও নয়, কুৎসিতও নয়। রুক্ষ মুখ, ধার-ধার চাউনি
বাপীকে দেখে নিল একবার। তারপর আবুর দিকে চোখ। গলার স্বরও পুরুষালি ধাঁচের, ঘরের লোকের উদ্দেশে জবাব দিল, বলতে হবে না, শুনতে পাচ্ছে।
দরজাশূন্য পাশের ছোট ঘরের সামনের মেয়েটা হয়তো দুলারির থেকে বছর দুই ছোট হবে। অত লম্বাও নয়। বেশ ফর্সা। ঢলঢলে মুখ। নাক চাপা একটু। তেলের অভাবে এরও মাথার চুল রুক্ষ, তবু অন্যজনের মতো নয়। চাউনি দেখে মনে হবে এই মেয়েটার একটু রস-বোধ আছে।
গেট সরিয়ে আবু ভিতরে ঢুকল। এতক্ষণের বিরক্তি-ভরা মুখটা একটু হাসি হাসি দেখাচ্ছে এখন। ঘাড় ফিরিয়ে বাপীকে বলল, আয়—।
বড় মেয়েটার সামনে এসে হাতের বাখারিগুলো বাড়িয়ে দিল, ধরো, কাল’ এসে ও-ঘরের দরজা বানিয়ে দেব।
—তোমার দরজার জন্যে আমরা মরে যাচ্ছিলাম? ওই রেশমাকে দাও, ঘরে কেউ ঢুকতে চাইলে বাখারি-পেটা করবে।
রেশমা কোনো মেয়ের নাম হয় বাপী জানত না। কিন্তু বেশ মিষ্টি লাগল। মেয়েটার চোখে ভ্রুকুটি, ঠোটে হাসি।
হাতের বাখারি আবু মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, ওঃ, সব দায় যেন আমার ওসব দরজা-টরজা নিজেরাই বানিয়ে নিও। যতো ভালো করতে যাই ততো সব পেয়ে বসে—
দুলারিরও ঠাণ্ডা তেরছা জবাব।—অত ভালো করার জন্য কে সাধছে তোমাকে?
—ফের তুই আবু ভাইয়ের সঙ্গে ক্যাটক্যাট করে কথা বলিস দুলারি? ভিতর থেকে পুরুষের কর্কশ গলা।
যে-মুখ করে দুলারি ঘরের দিকে চোখ ফেরালো একবার, বাপীর মনে হল ভিতরে যে আছে তাকে সে একটুও কেয়ার করে না। আবু এগিয়ে যেতে দরজা ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াল। আবু ভিতরে চলে গেল।
বাপী হাঁ করে দাঁড়িয়ে। এরকম বাতাস থেকে ঝগড়া টানার কারণ কিছু বুঝছে না। এবারে দুটো মেয়েরই ওর দিকে চোখ। তারপর দুলারির আবার তেমনি ঠাণ্ডা চাঁছাছোলা কথা।—কি বুদ্ধি, এখেনে বাবু-ঘরের ছেলে এনে হাজির!
ভিতর থেকে আবু ডাকল, বাপী, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন, ভিতরে আয়।
অগত্যা বাপীও পায় পায় ভিতরে এসে ঢুকল। পিছন থেকে এগিয়ে এসে দুলারি গম্ভীর মুখে একটা তেলচিটে ছেঁড়া-খোঁড়া চাটাই মাটিতে পেতে দিল।
চাটাইয়ের ওপর আবু গ্যাঁট হয়ে বসল। হাত ধরে ওকেও বসালো। দড়ির খাটিয়ায় বসা কালো কালো দাড়ি-বোঝাই লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বাপী বিমূঢ় হঠাৎ। এই লোকটাকে তো ও খুব চেনে। কাঁধের পেল্লায় ঝোলায় ছোট-বড় তিন-চারটে ঝুপড়ি নিয়ে সাপুড়ের পেটমোটা বাঁশি বাজিয়ে বানারজুলির রাস্তায় আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে কত রকম সাপের খেলা দেখাতো। বছরখানেক হল একে আর দেখছে না। তার এ কি হাল! দাড়ির জন্য গাল দেখা যাচ্ছে না, সমস্ত কপাল নাক আর চোখের নিচটা বসন্তের শুকনো গর্তে ছেয়ে আছে। চাউনিও কি—রকম ঘোলাটে।
আবু জিজ্ঞসা করল, ছট্টু দাদাকে দেখেছিস কখনো?
বাপীর নাম জানা ছিল না। বলল, সাপের খেলা দেখাতো…
লোকটার বয়েস চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। দাড়ির জন্য দুলারির ডবল বয়েস মন হল। ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, নিজে এখন খোদার খেলা দেখছি।
আবু বলল, গেলবারের বসন্তে ছোট্ট দাদার চোখ দুটোও গেছে। এখন আবার বুকের ব্যামোয় ধরেছে। এই হল ছোট্ট দাদার বিবি দুলারি আর ওই রেশমা— ছোট্ট দাদার বোন।
দুলারি খাটিয়ার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, আর রেশমা দরজার কাছে। ওদের দিকে একবার করে তাকাতে গিয়ে ঘরের এককোণে থাকে থাকে সাজানো কটা সাপের ঝুড়িও চোখে পড়ল। ওগুলোতে এখনো সাপ আছে মনে হল।
বাপীর পরিচয় শুনেই ছোট্ট দাদা বলল, বাপকে ধরে আবুর চাকরিটা জলদি পাইয়ে দাও খোকাভাই—নইলে ও যুদ্ধে চলে যাবে বলছে।
এরপর আবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে। আবুর মতো ছেলে আর হয় না। আল্লার শেষ মার থেকে ও-ই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। ভাঙা ঘর মেরামত করে দিয়েছে, জঙ্গলে মুরগি খরগোস যা পায় মেরে এনে ওদের দিয়ে যায়, নইলে কাঠ বেচে দুলারি আর কটা টাকা পায়, গোটা মাসের আটা-চালও হয় না তা দিয়ে। ঘরের পিছনে খানিকটা জমি সাফ করে এই আবুই চারদিকে গাছের ডালের বেড়া দিয়েছে। পিছনের জমিতে এখন লাউ কুমড়ো আর শাকটাক বেশ হচ্ছে। সোৎসাহে ছোট্ট মিয়া বলল, তোমার লঙ্কা গাছে এখন খুব লঙ্কা ধরেছে আবু ভাই।
আবু নির্লিপ্ত মুখে নিজের প্রশংসা শুনছিল। ওদিকে দুলারির মুখে কৃতজ্ঞতার ছিটেফোঁটা নেই। শুধু রেশমার হাসিমাখা দুচোখ আবুর মুখের ওপর। দেখামাত্র বাপীর স্নায়ুতে সাড়া জাগল একপ্রস্থ। আবু যে খুব ভালো তাতে ওরও কোনো সন্দেহ নেই। তবু আবুর এত দয়া এত উদারতা সব ওই রেশমার জন্য। এ একেবারে অকাট্য সত্য। এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
আবু উঠে পড়ল। ওকেও ডাকল, চল, কেমন লঙ্কা হল দেখে আসি।
এদিক থেকে দুলারি হুকুম করল, রেশমা যা—
আবু ওমনি ঝাঁঝিয়ে উঠল, রেশমা যাবে কেন, আমি চিনি না?
পাল্টা ঝাঁঝে দুলারি বলল, গেলে তোমার গায়ে হলকা লাগবে?
সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, আবু ভাইয়ের সব কথায় তুই জবাব দিস কেন?
পিছনের ছোট সবজি বাগান দেখতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। রেশমা ওদের দশ হাতের মধ্যেই ছিল। আবু ওর দিকে ফিরেও তাকায় নি। বাপীর তবু মজা লাগছিল। আবুর সঙ্গে এতদিন এত মিশেছে, অথচ এত বড় ব্যাপরটা ঘূণাক্ষরে জানতে পারে নি। ওর পেটে পেটে এত!
কিন্তু ফেরার পথে ওই রেশমার কথা শুনে বাপী অবাক আবার। রেশমার বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে মরদও আছে। লোকটা আবার মুসলমান নয়, খ্রীষ্টান।। জঙ্গলে কুলির কাজ করে কাঁদনা—রেশমা তার বউ। দিন-রাত মদ খায় লোকটা, ঘরে এক পয়সাও দেয় না। নেশায় বাগড়া দিতে গেলে বউটাকে ধরে দেদার ঠেঙায়। মেরে শুইয়ে ফেলে একেবারে। যেদিন খুব বেশি মারধর হয়, রেশমা তার ভাজের কাছে পালিয়ে আসে। দুদিন চারদিন বাদে আবার যায়, আবার মার খায়, আবার আসে। ছ’ মাস ধরে এরকমই চলছে।
শুনে বাপীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আবুর কি-যে আশা ভেবে পেল না।
.
দু’ সপ্তাহের মধ্যে বানারজুলির জঙ্গলের শান্তি তছনছ হয়ে গেল। নাড়াচাড়া কিছু পড়বে সেটা সহকারী ডি. এফ. ও. চলে যাবার পরে সকলেরই মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই নাড়াচাড়ার ফল যা দাঁড়াল সেটাই নীল আকাশ থেকে আচমকা বাজ পড়ার মতো।
আবু আর বাপীর অন্তত সেই রকমই মনে হল।
মাঝে এখানকার রেঞ্জ অফিসার সন্দীপ নন্দী তিন-চার দিনের জন্য হেডকোয়ার্টার্স চলে গেছলেন। এর দিনকতক বাদে স্বয়ং ডি.এফ.ও. লালমুখো খাঁটি সাহেব এসে হাজির। সক্কলকে অবাক করে এখানকার বড় সাহেব অর্থাৎ নন্দী সাহেবের’ বাংলোয় তিন দিন তিন রাতের অতিথি হলেন তিনি। আগের সহকারী ডি. এফ. ও.-র জন্য চা-বাগানের বাংলো ঠিক করা হয়েছিল। এবারের পরিদর্শনের ফল কি দাঁড়াবে তখনো কেউ জানে না। আবু চুপি চুপি বাপীকে বলেছিল, তোর শ্বশুরের বাংলোয় শহর থেকে বাবুর্চি আর খানসামা এসেছে, আধপেটি বিলিতি বোতলও এসেছে—আর কত রকমের মাংস আছে ঠিক নেই।
বিলিতি সাহেবকে নিয়ে ঘটা করে দুদিন জঙ্গল দেখানো হল। ফাইলপত্রও পরীক্ষা করা হল। জঙ্গলের গলদের প্রধান আসামী আবুর বাবা কালু রব্বানী। লালসাহেব জানলেন, জঙ্গলের ভিতরে ভাঁটিখানা গজিয়ে ওঠার মূলে সে। আসামীর তালিকায় আরো তিনজন বীটম্যান, একজন ফরেস্ট গার্ড, একজন সেচের বাবু। বাপীর বাবা হরিবাবুর ফাইল আর গাছপালার হিসেবনিকেশও বিলিতি সাহেবের কাছে সন্তোষজনক নয়। এদের সকলের যথাযোগ্য দন্ডের নির্দেশ দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
এরপর এখানকার বড়সাহেবের সেই দণ্ড বিধানের পালা। হেড বীটম্যান কালু রব্বানী, তিনজন বীটম্যান, একজন ফরেস্ট গার্ড আর সেচবাবুর চাকরি গেল। তদন্তসাপেক্ষে হরিবাবুকে সাসপেন্ড করা হল।
কপাল শুধু আবু রব্বানীর। বড়সাহেব নিজে ডেকে তাকে বীটম্যানের চাকরি দিলেন। চাকরি পেয়ে আবু সাহেবকে সেলাম ঠুকল আর ঘরে এসে নিজের কপাল চাপড়ালো।
বাবার চোখে জল দেখেছে বাপী। পিসীর পায়ে হাত রেখে বাবাকে বলতে শুনেছে, আমি কোনদিন এক পয়সাও কারচুপি করিনি, তুমি তো জানো।
পিসীর চোখেও জল। বাবাকে হাত ধরে টেনে তুলেছে আর বলেছে, এত ভেঙে পড়িসনে, ঠাকুর এত বড় অবিচার কক্ষনো করতে পারেন না।
ঠাকুরের ওপর বাবার ভরসা এখন কতটুকু বাপী জানে না। দিনের মধ্যে পাঁচ বার করে তাকে ঘর থেকে ছুটে বেরুতে দেখছে। কোথায় যায় বাপী তাও আঁচ করতে পারে। বিচার যে করবে তার কাছে। ওই বড়সাহেবের বাংলোয় মেজসাহেবের বাংলোয়। চোখে না দেখলেও বাপী জানে, আবুর মতে আসল চোর যারা, বাবা তাদেরই হাতেপায়ে ধরছে, কান্নাকাটি করছে।
আরো তিন সপ্তাহ বাদে বাবার ছট্ফটানি কমল। মুখ থমথমে এখন। তার বিচার হয়ে গেছে। বড়সাহেব দয়া করেছে। চাকরি থাকল। তিন বছরের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ। সঙ্গে ওয়ার্নিং।
এবারেও আবু ওকে চুপিচুপি বলেছে, পাছে মরীয়া হয়ে বাবা হেড কোয়ার্টারস-এ ছোটে আর হাটে হাঁড়ি ভেঙে সব ফাঁস করে দেয় সেই ভয়ে বড়সাহেব আর মেজসাহেব এই দয়া দেখালো। বলেছে, তোর বাবা তো আর আমার বাপের মতো মুখু নয়!
ভেতর-বার সব জ্বলছে বাপীর। সেই কবে থেকে জ্বলছে। দূর থেকে বাংলোটাকে দেখে। চোখের আগুনে ওটা ভস্ম হয় না। বাড়ির মানুষগুলোও ভস্ম হয় না।
…তারপর সেই দিন। যে দিনটা বাপী এ জীবনে আর কোনদিন ভুলবে না। কোনদিন না।
মিষ্টি জঙ্গলে। মিষ্টি একা। ওদের বাংলোর খুব কাছেই। একটা রঙিন প্রজাপতির পিছনে তাড়া করেছে।
সেটা শনিবার। প্রচণ্ড কিছু ঘটবে বলেই বাপীর এই মতি কিনা কে জানে। আকাশ সেদিনও মেঘলা ছিল। বানারজুলি জঙ্গলে ওকে বড্ডোই টানছিল। শনিবার দেড়টায় ছুটি। ক্লাসের মাস্টারমশাইকে পিসীর শরীর খারাপের কথা বলে বারোটায় বেরিয়ে এসেছে। তারপর বাড়ি। তারপর জঙ্গল। নিজের মনে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দূর থেকে দুটো চোখে একবার মিষ্টিকে ভস্ম করার আশা নিয়েই এদিকে এসেছিল। বেলা এখন আড়াইটের কম নয়।
দূর থেকে মিষ্টিকে দেখেই বাপীর পা দুটো থেমে গেল একবার। ওকে দেখে নি। দেখলেই ছুটে পালাবে। সেই পথ আগলানোর জন্যেই আধ মিনিটের মধ্যে পিছন দিকে চলে এলো। মিষ্টি এখনো প্রজাপতির পিছনে। মাঝে কিছুদিন কাছাকাছি না হওয়ার ফলে বেশ ডাগরটি লাগছে। বাপীর দু চোখ লোভে চিকচিক করছে। আগের মতো নয়, এই লোভ বাপীর কাছেও নতুন। চোখের সামনে জোড়া জোড়া মুখ। মণিদা আর গৌরী বউদি…ভীম বাহাদুর আর তার ভালবাসার মেয়ে…আবু আর রেশমা। পিছন থেকে বাপী নিঃশব্দে এগোচ্ছে। তার চোখে শুধু লোভ নয়, দুর্জয় আক্রোশও।
প্রজাপতির পিছনে আর না গিয়ে মিষ্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাপী তখন ওর পাঁচ হাতের মধ্যে। মিষ্টি থমকে তাকিয়ে মতলব বুঝতে চেষ্টা করল। বলল, পিছন থেকে চুপি চুপি আসা হয়েছে—কেমন?
একেবারে কাছে এসে বাপী জবাব দিল, চুপি চুপি আসব কেন। তোকে দেখেই তো এলাম—
একটা হাত ধরল। এক ঝটকায় সেই হাত ছাড়িয়ে মিষ্টি ধমকে উঠল, ফের গায়ে হাত! গিয়ে বলব মাকে?
প্রাণপণ চেষ্টায় বাপীর বাইরেটা মোলায়েম তখনো।—ঠিক আছে, আমাদের বাড়ি চল্, পিসী ক্ষীরের পুলি বানিয়েছে—খেলে আর ভুলতে পারবি না।
মিষ্টি মুখ মুচকে জবাব দিল, হ্যাঁঃ, তোমার বাবা চুরি করে ধরা পড়েছে, আমার বাবা ক্ষমা করে দিল বলে—আর কক্ষনো তোমাদের বাড়ি খেতে যাই—
কথাগুলো মুগুরের ঘায়ের মতো মগজে এসে লেগেছে। তারপর যা ঘটার চোখের পলকে ঘটে গেল। আচমকা দুটো হাতসুদ্ধু বেড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে বাপী ওকে শূন্যে তুলে নিয়ে ভিতরের দিকে ছুটল। মিষ্টি ভালো করে চেঁচাবারও ফুরসৎ পেল না। ওর হাঁ-করা মুখের মধ্যে বাপী নিজের মুখ চেপে ধরেছে।
পঁচিশ-তিরিশ, গজের বেশি এগনো গেল না। ওর ঠোটে মুখে মিষ্টি দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। জুতোসুদ্ধু পা ছুঁড়ছে।
দাঁড়িয়ে গেল। তার পরেই মিষ্টি মাটিতে। বাপী ওর ওপরে। ভিতর থেকে যে শয়তানটা বেরিয়ে এসেছে, বাপী নিজেও তাকে ভালো চেনে না। তার স্থান কাল বোধ নেই, ভালো-মন্দ জ্ঞান নেই, পরিণামের হিসাব নেই। তার শুধু লোভ, শুধু আক্রোশ। মুখে দাঁতে ঠোটে জিভে নরম মাংসের স্পর্শ। মুখে মুখ চেপে গলা দিয়ে ওকে টু শব্দও বার করতে দিচ্ছে না। আর হাত দুটোরও সর্বাঙ্গের মাংস খুবলে তুলে নেবার উল্লাস।
এই উল্লাসের মুখে আবার একটা ধাক্কা খেয়েই শয়তান থমকালো। তারপর পলকে কোথায় সেঁধিয়ে গেল। এবার বাপী দেখছে। দেখছে মিষ্টির সমস্ত মুখ আবির-গোলা লাল। চামড়া ফেটে এক্ষুনি রক্ত বেরিয়ে আসবে বুঝি। বড় হাঁ—এর মধ্যে একটা বিকট কান্না ধরে আছে। ওটা মুক্তি না পেলে দম-বন্ধ হয়ে মরেও যেতে পারে।
নিজের অগোচরেই ওকে ছেড়ে বাপী হাত-দুই সরে গেল। খুব শব্দ না করেই কান্নাটা মুক্তি পেল। তারপরেই এক্তে উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি পনের-বিশ হাত ছুটে গেল। পলকের জন্য ঘুরে দাঁড়াল একবার। মাটি থেকে বড়সড় একটা পাথর তুলে নিয়ে প্রাণপণ জোরে ছুঁড়ে মারল ওকে। লাগলে কি হত বাপী জানে না। লাগল না। বাপী নিজের অজান্তে মাথা নুইয়ে ফেলেছিল। মুখ তুলে দেখে মিষ্টি নেই।
তখনো বিকেল। আবুর ঘরের সামনের উঠোনে বসেছিল বাপী। শরীর অবসন্ন। কিছু একটা ঘটবে জানে। কিন্তু ও কি করবে জানে না। তাই এখানে। আবু এলো। সঙ্গে আরো দুজন বীটম্যান। আবুর থমথমে মুখ। বলল, বাড়িতে না দেখেই বুঝেছি তুই এখানে। চল্ বড়সাহেবের বাংলোয় যেতে হবে, তোকে ধরে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে—
বাপী ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
আবু রেগে গেল।—হাঁ করে দেখছিস কি, আমি বড়সাহেবের গোলাম না এখন? তারপর ঝুঁকে গলা খাটো করে বলল, তোর বাবাও আছে সেখানে, দুষ্টুমি করেছিস, না হয় মারধর খাবি একটু, অত ভয়ের কি আছে, চল্–
কি দুষ্টুমি বা ভয়ের কতটা, আবুও জানত না। বাংলোর বারান্দায় মেমসাহেব, সাহেব আর বাপীর বাবা। দরজার ওধারে মিষ্টি।
আর কাউকে কিছু করতে হল না। যা করার বাবাই করল। চুলের মুঠি ধরে কিল-চড় ঘুষি মেরে মেরে ওকে কাঠের মেঝেতে ফেলল প্রথম। তারপর একজন বীটম্যানের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে পাগলের মতো পিটতে লাগল। চাপা আর্তনাদ করে করে বাপী উল্টে-পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু বাবা ওর প্রাণটা বার হওয়ার আগে আর থামবেই না। পিঠ হাত পা কপাল নাক মুখের চামড়া ফেটে চৌচির। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। জিভে ঠোটে গরম তাজা রক্তের নোনা স্বাদ।
এবার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে বাপীর। আরো অন্ধকার। গায়ে মুখে মাথায় লাঠির ঘা পড়ছে এখনো কিন্তু আর যেন অত লাগছে না। ও কি রকম ঘুমপাড়ানি অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
.
সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন কিনা বাপী ঠাওর করে উঠতে পারল না। নিজের ঘরের চৌকিতে শুয়ে আছে। কোণে ডিম-করা হারিকেন। আলোর থেকে অন্ধকার বেশি। ঘরে কেউ নেই।
পিসী রাত থাকতে ওঠে। তাই উঠে গেছে বোধ হয়। কিন্তু তা হবে কেমন করে। রাতে শোবার পর ঘরে হারিকেন জ্বলে না। তাহলে ও শুয়ে কেন?
মাথা উঁচিয়ে খোলা দরজার দিকে দেখতে গিয়ে টের পেল কেন। ঘাড়ে মাথায় কপালে মুখে আর সমস্ত গায়ে ভীষণ যন্ত্রণা। শুধু ব্যথা নয়, জ্বলেও যাচ্ছে। নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে।
স্বপ্ন নয়। মনে পড়ছে। সাহেববাংলোর বারান্দা থেকে কে যেন এক সময় ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারপর একবার দুবার চোখ তাকিয়ে খুব সম্ভব আবুর মুখখানাই দেখেছিল। জিভটা মুখের ভিতর নড়াচড়া করল, তারপর নিজের ঠোঁট দুটোও চেটে দেখল। না, রক্ত লাগছে না। কেবল জ্বালাই করছে। ঠোটে আর তার ওপরে নিচে কোন ওষুধ-টষুধ লাগানো হয়েছে বোধ হয়। জিভটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল। কিন্তু তার থেকে ঢের বিচ্ছিরি নোতা রক্ত। সেটা মনে পড়তে গা-টা কেমন করে উঠল। নিজের শরীরের রক্তের এমন গা-গুলনো গরম নোনতা স্বাদ, জানত না।
—ক’বার তোকে ঘরে যেতে বললাম, বসে বসে বসে রাত করছিস কেন?
বাইরে বাবার বিরক্তি ঝরা ভারী গলা। বাপীর দু কান খাড়া। কিন্তু যাকে বলল তার কোন জবাব শোনা গেল না…কাকে বলল? নিশ্চয় আবুকে। ও হয়ত চলে গেল। কারণ একটু বাদেই পিসীর কথা কানে এলো।
—এটুকু আর বাকি রেখে জ্যান্ত ফিরিয়ে আনলি কেন—একেবারে শেষ করে দিলেই তো হত।
আর এক প্রস্থ চাবুকের মতই বাবার ঝাঁঝালো জবাব।—শেষ করতেই চেয়েছিলাম, আর শেষ করাই উচিত ছিল—বুঝলে? কিন্তু ও শেষ হবার ছেলে নয়, তার আগে আমাকে শেষ করবে।
মুখের মধ্যে বাপীর জিভ নড়ে-চড়ে উঠল আর একবার। ঠোঁট দুটো চেটে নিল। রক্ত নয়। রক্তের থেকেও বিস্বাদ কিছু যেন ভিতর থেকে ঠেলে উঠেছে। যত রাগ ততো ঘৃণা। বাবার গলা শুনেই এই, মুখ দেখলে হয়তো ফিনকি দিয়ে রক্তই ছুটবে।
কিন্তু মুখ রাতে দেখা গেল না। সকালেও না। সকালে যখন চা-বাগানের ডাক্তার এলো, তখনও না। রাতে বা সকালে পিসীর সঙ্গেও কোন কথা হয়নি বাপীর। রাতটা কি-রকম ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। পিসী ডাক্তারকে বলল, সমস্ত রাত জ্বরে ভাজা ভাজা হয়েছে।
ডাক্তার পরীক্ষা করল। নাক মুখ আর সমস্ত গা হাত পা উল্টে-পাল্টে দেখল। তারপর গম্ভীর মুখে বাইরে চলে গেল। একটু বাদেই বাপীর কানে মধু। পিসীকে ডাক্তার বলছে, চিকিৎসা যা করার করছি, কিন্ত আপনার উচিত পুলিশে খবর দেওয়া—ছেলেকে এ-রকম শাসন করা চলে কিনা সেটা তারা বুঝিয়ে দেবে।
ঘাড় উঁচিয়ে বাপী পিছনের দরজার দিকে তাকালো। বাবা কোথায়? বাবা কি শুনল?
দুপুরে আবু এলো। বাবা তখন আপিসে। পিসী তার পুজোর জায়গায়। আবু ঘরে ঢুকলে পিসীকে গোবরজলের ছড়া দিতে হয় বলে ভিতরে কমই ঢোকে। আজ ও ঘরে বা দিতেই একটা উদ্গত অভিমানে বাপী অন্য দিকে মুখ ফেরাল। পিসী শোয় বলে আবু চৌকি ছোঁবে না। হাত দুই তফাতে দাঁড়িয়ে ওকে দেখল একটু। বলল, রাগ তো হবেই তোর, আমি শালা কেমন গোলাম ভাল করে দেখে রাখ—
বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা বাপীও বুঝল। আস্তে আস্তে ওর দিকে ফিরল আবার। আর মনে মনে ভাবল, চোখে যদি জল আসে তো নিজের চোখ দুটো উপড়ে ফেলবে।
আবু বলল, কাল রাতেও খবর নিতে এসেছিলাম। পিসী বলল খুব জ্বর তোর। তোর বাবার মুখের দিকে চেয়ে আর ঘরে ঢোকার সাহস হল না। এখন আপিসে কাজ করছে দেখে ঝট করে চলে এলাম।
বাপী বলল, একটা কিছু টেনে নিয়ে বোসো না—
—আর বসে না, এক্ষুনি তো জঙ্গল ঠাঙাতে বেরুতে হবে। তারপর গলা খাটো করে বলল, এত বড় কাণ্ড হবে জানলে আমি তোকে বানারজুলি থেকেই পাচার করে দিতাম। সামনে ঝুঁকল একটু, কি করেছিলি রে তুই—মেয়েটার একেবারে সব্বোনাশ টব্বোনাশ করে বসে আছিস নাকি? কুকুর বেড়ালকেও তো কেউ এভাবে মারে না—
সর্বনাশ কাকে বলে বাপী তাও এখন বেশ বুঝতে পারে। একটা মেয়ের নরম মাংসের ওপর পাগলের মতো সেই হামলার পর ভিতরের শয়তান আরো বেপরোয়া কিছুর দিকে ঝুঁকতে চাইছিল। কিন্তু মিষ্টির হাঁ-করা মুখের দম—আটকানো কান্না দেখে সেই শয়তান উধাও হয়েছিল। এখন খেদ। আবু যা বলছে তাই হলে কি হত? না-হয় একেবারে মেরে ফেলা হত ওকে। তার বেশি কি হত?
আবু চেয়ে আছে। কিন্তু বাপী কি করেছে না করেছে মুখে কি বলবে? মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, অতটা না।
দাঁতে দাঁতে ঘষে আবু বলল, যদি মরদ হোস তো একদিন শোধ নিবি। তারপর একটা চোখ ছোট করে অন্য চোখে সটান তাকিয়ে শুধলো, কি-রকম শোধ বুঝলি?
কেন যেন বাপীর জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োচ্ছে একটু। মাথা নাড়ল। বুঝেছে।
কিন্তু দু-মাস না যেতে রাগে আর পরিতাপে নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করেছে বাপীর। জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ারের মতোই একটা চলন্ত জিপে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে। রেঞ্জ অফিসার সন্দীপ নন্দী দিনাজপুর না কোথাকার জঙ্গলে বদলি হয়ে গেল এ-খবর প্রথম আবুই দিয়েছিল ওকে। বলেছিল, অনেক দুর্নাম রটেছে বড়সাহেবের নামে, কত আর চাপা দেবে? তাই মানে মানে নিজেই তদবির করে সরে পড়ছে।
আগে কায়মনে কিছু চাইলে বাপী সেই প্রার্থনা ভগবান নামে অদৃশ্য কারো কাছে পেশ করত। সেই মারের পর ভগবানের নাম আর মুখেও উচ্চারণ করে নি। তবু নিজের বুক চিরে কাউকে রক্ত দিলে যদি এই বদলি বন্ধ হত, তাও দিত। কিন্তু কিচ্ছু করা গেল না। ওরা চললই।
এত দিনের মধ্যে বাপী আর বাংলোর কাছে আসেনি। আজও দূরেই দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে ব্যস্তসমস্ত বাবাকে দেখেছে। মেজসাহেব ছোট সাহেব, ফরেস্ট গার্ড, বীটম্যানদের দেখেছে।…মেয়ের হাত ধরে মেমসাহেব জিপে উঠল। সাহেব সামনে। জিপটা আসছে। বাপী রাস্তা আগলে দাঁড়িয়েছিল, ধারে সরে গেল। মিষ্টি দেখেছে ওকে। মাকেও দেখিয়েছে। জিপটা বেরিয়ে গেল। বাপী মিষ্টির দিকেই চেয়ে আছে। মিষ্টিও। সামনে বাবা, পাশে মা, তবু ওর ভয়-ভয় মুখ।
জিপ দূরে বাঁকের আড়ালে মিলিয়ে গেল। শিরায় শিরায় রক্ত ফুটছে বাপীর। মুখে বলছে না কিছু। মনে বলছে। কদ্দূর পালাবি? তোকে আর পাব না ভেবেছিস?
পরের দু বছরে বাপীর ভেতর-বার বদলেছে। পড়াশুনাটা মোটামুটি ভাবে করে গেছে। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। পৃথিবীর যুদ্ধ তখন ঘরের কোণে এসে গেছে। চা-বাগানের ক্লাবে খবরের কাগজ আসে। রোজ সন্ধ্যার পর সেখানে গিয়ে বাইরের বেঞ্চিতে বসে বাপী কাগজ পড়ে। কিন্তু যুদ্ধের এত খবর মনে খুব একটা দাগ কাটে না। ওরও ভিতরে অবিরাম যে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে সেটা কম কিছু নয়। মিষ্টি নামে একটা মেয়ে কোথাও না কোথাও আছেই। বাপী হিসেব ভোলেনি। ওই মেয়ে বারো পেরিয়েছে এখন। কল্পনায় আর একটু বড় দেখেছে ওকে। আরো সুন্দর দেখেছে। আরো বড় হোক। আরো সুন্দর হোক। দেখা হবে। হবেই হবে।
বানারজুলির জঙ্গল তেমনিই টানে ওকে। আবু ভীষণ ব্যস্ত। তার দেখা কম মেলে। কাজে গাফিলতি নেই। তার ওপর রোজ চা-বাগানের বস্তি এলাকায় গিয়ে বাপের জন্য হাঁড়িয়া জোগাড় করে নিয়ে আসতে হয়। চাকরি খোয়ানোর ফলে কোন সন্ধ্যাতেই এই জিনিস থেকে ও বাপকে বঞ্চিত করে নি। জঙ্গলে বেশি ভাগ সময় একলাই ঘুরে বেড়ায় বাপী। কিন্তু এ ঘোরাটা অন্য রকম। জীবজন্তুর ভালবাসাবাসির দিকে আর চোখ নেই। এ দু’ বছরেও বনমায়া তার হিসেবমতো নিখোঁজ হয়েছে আর সকলের প্রত্যাশিত সময় মতোই ফিরেছে। কিন্তু এ নিয়েও বাপী আর আগের মতো অত উত্তেজনা বোধ করে না। এমন কি চা-বাগানের আড়াই-পাতি তোলা হাসি উছলানো মেয়েদের দিকেও আর বেশি ঘেঁষে না। নিজের মনে জঙ্গলে ঘোরে। এখানকার নিস্তব্ধতা ভালো লাগে। গাছ-পালার সরসর শব্দও ভালো লাগে।
যা একটু কৌতূহল কেবল বসন্তের কোপে অন্ধ সাপুড়ে ছটু মিঞার বউ দুলারি আর তার ননদ মাতাল কাঁদনার বউ রেশমাকে নিয়ে। দুলারি এক রকমই আছে। পুরুষালি ছাঁদ, মুখে কম কথা, আর আবুকেও চোখ রাঙানোর সাহস। কিন্তু মাতাল স্বামীর হাতে মার খাওয়া রেশমার মুখখানা আরো ঢলঢলে হয়েছে। বছর উনিশ এখন ওর বয়েস। আবু বলেছে মাসের মধ্যে কম করে বিশ-বাইশ দিন রেশমা এখন তার ভাজের কাছেই থাকে। কাঁদনা এসে হাতেপায়ে ধরে খুব কাকুতি-মিনতি করলে তবে যায়। কিন্তু দুদিন বাদে আবার দাগড়া-দাগড়া মারের দাগ নিয়ে পালিয়ে আসে। মদ খেলেই ইদানীং ওর নাকি বউয়ের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে মাথায় সন্দেহ গজাতে থাকে। তারপর মেরে শুইয়ে না ফেলা পর্যন্ত সন্দেহের পোকাগুলো মাথা থেকে সরে না। রেশমা আর নাকি তার মরদের ঘরে যাবেই না পণ করেছে।
এত কথা বাপী আবুর মুখ থেকে শুনেছে। আর কাঁদনার সন্দেহ কতটা সত্যি আবুর মুখের দিকে চেয়ে তাই আঁচ করতে চেষ্টা করেছে। ওদের নিয়ে কৌতূহলের আরো কারণ, দুলারি আর রেশমা দুজনেই এখন রোজগারের রাস্তায় নেমে পড়েছে। সাপের ঝুড়ি আর বাঁশি নিয়ে দুজনে একসঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাপ-খেলা দেখাতে বেরোয়। দু বছরে অন্ধ ছুটু মিয়ার কাছে বিদ্যেটা রপ্ত করে নিয়েছে। সকালে ঘরের কাজ থাকে, রান্নাবান্না থাকে, খুব বেশি ঘুরতে পারে না। কিন্তু দুপুর পেরুনোর আগে অনেক দূরে দূরে চলে যায় ওরা। ভয়-ডর নেই। দুলারির তো একেবারে নেই।
ওরা কোথাও সাপ খেলা দেখাচ্ছে দেখলে বাপী গুটিগুটি না এগিয়ে পারে না। শুধু বাপী কেন জোয়ান বয়সের অনেকেই এগোয়। দুলারি আর রেশমা দুজনেই ঘাগরা পরে বেরোয়। সেই ঘাগরা ওদের হাঁটু ছাড়িয়ে এক বিঘতও নামে না। গায়ে রংবেরংয়ের আঁট কোর্তা। ছটু মিয়ার খেলা অনেক দেখেছে বাপী। সেই একই খেলা এদের হাতে যেন অন্যরকম। গাল ফুলিয়ে সাপুড়ের বাঁশি বাজিয়ে পালা করে খেলা দেখায়। সাপ ডাইনে বাঁয়ে দোলে। হাঁটু মুড়ে বসে ওরাও তেমনি দোলে। ছোবল মারার মতলবে সাপ সামনে পিছনে দোলে। ওদের তখন উত্তেজনা বাড়ে। ওরাও সামনে পিছনে দোলে। ছোবল খাবার জন্য মাটিতে উল্টো করে হাত পাতে, আবার ছোবল পড়ার আগে পলকে হাত সরায়। এই করে সাপের উত্তেজনা বাড়ায়। নিজেদের আর যারা গোল হয়ে দাঁড়ায়—তাদেরও। সাপের ছোবল একবার না একবার লেগেই যায়। ঝর ঝর করে রক্ত পড়ে। তখন ঠাণ্ডা হয়ে পাতা আর শেকড়বাকড় চিবিয়ে চটপট লাগিয়ে দেয়।
বাপী লক্ষ্য করেছে ছোবল খাবার লোভ রেশমার থেকেও দুলারির বেশি। অন্ধ ছোট্ট দাদাকে যত বুড়োই দেখাক, দুলারির বয়েস এখন বড় জোর বাইশ। কিন্তু সাপ খেলা দেখানোর সময়েও মুখখানা করে রাখে বত্রিশের মতো। রেশমার মতো হাসে না। কিন্তু ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে দোলে ওর থেকেও বেশি। খপ করে একসময় দু-হাতে সাপের গলা চেপে ধরে বুকের কাছে নিয়ে আসে। সাপের মুখ নিজের মুখের কাছে। সাপের চেরা-জিভ চিড়বিড় করে। দুলারিও তখন ঘন ঘন জিভ বার করে আর টেনে নেয়। যেন জিভেই ছোবল নেবার বাসনা। বাপীর কেমন যেন তখন সাপের চেয়েও ওই দুলারিকেই বেশি ভয় করে।
পরীক্ষা এসেই গেল। পড়াশুনায় আপনা থেকেই একটু মন বসেছে। তারই মধ্যে আচমকা দুর্যোগ। যে ‘ম্যালোরি’ জ্বরের ভয় পিসীর, তাই তাকে খেয়ে বসল। পাঁচদিনের মাথায় ধুপ করে মরে যেতে বোঝা গেল ওটা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। ডাক্তারের মুখে ওই নাম বাপী পরে শুনেছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাত্র আট দিন বাকি তখন
বাবা কাঁদল না। পাথর হয়ে থাকল। বাপীও কাঁদল না। বুকের একখানা হাড় খসে গেল। তবু না। আছড়ে পড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তবু না। কেবল আবুর চোখে জল দেখেছিল।
পরীক্ষায় ছেদ পড়ল না। পরীক্ষা শুরু হল, শেষও হল। গত দু বছরের মধ্যে বাবার সঙ্গে বাপীর কদিন মুখ-দেখাদেখি হয়েছে হাতে গোনা যায়। পিসী চোখ বোজার পর মুখ-দেখাদেখি দু বেলাই হচ্ছে এখন। বাবা মোটামুটি রাঁধতে জানে। বাপীর হাতে ছেড়ে দিলে রান্না একরকম সে-ও করতে পারে। কিন্তু বাবা মুখ বুজে নিজেই রান্না করে। বাপী দেখে। কিছু বলে না। পরীক্ষা হয়ে যাবার পর বাবা সকালের বাজারটা ওকে মাঝে মাঝে করতে দেয়।
একই বাড়িতে দুটি প্রায় অচেনা বাসিন্দা দুজন। সকালে বাবার আপিস থাকে। আগে খেয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু রাতে বা ছুটির দিনেও খাবার সময় বাপী দূরে সরে থাকে। বাবা বুঝে নিয়েছে ও তার সঙ্গে বসে খাবে না। তাকে সামনে দেখলে আজও বুকের একেবারে তলা থেকে একটা বিতৃষ্ণা ঠেলে ওঠে বাপীর। বাবা তাও বুঝতে পারে কিনা বাপী জানে না। বাবা ডাকে না। ওরটা সাজিয়ে রেখে নিজে খেয়ে চলে যায়।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরোল। বাবা এতটা আশা করে নি নিশ্চয়। আর বাপী ফল নিয়ে মাথাই ঘামায় নি। পাশ করবে জানত।
…ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। খবর আসার পরদিনই বাবার মুখ দেখল। এ-ঘরে এসে বলল, বড়সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে, কাল বিকেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। আমি নিয়ে যাব।
কে এখন বড়সাহেব বাপী সে-খোঁজও রাখে না। কি কথা হয়েছে বা কেন দেখা করতে হবে না বুঝে মুখের দিকে চুপচাপ চেয়ে রইল।
বাবা বলল, এ জঙ্গলে আর একজন ক্লার্ক নেওয়া হবে সেটা আগেই ঠিক হয়ে ছিল। বড়সাহেবকে তোর কথা বলে আমি আটকে রেখেছিলাম। ম্যাট্রিক পাশ চাই। আজ রেজাল্টের কথা বলতে সাহেব কালই দেখা করতে বললেন।
কথা শেষ করে বাবা চলে যাচ্ছিল, বাপী বলল, আমি কলেজে পড়ব।
হরিবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন. ছেলের মুখ এবারে ভালো করে দেখে নিলেন। সেই পুরনো বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা নিজের মুখে আরও কত এঁটে বসেছিল বাপী জানে না। গলার স্বরেও কিছু প্রকাশ পেয়েছে কিনা বলতে পারে না।
হরিবাবুর মুখে কঠিন আঁচড় পড়তে লাগল। গলাও অসহিষ্ণু ভারী।—কলেজ মানে তো সেই জলপাইগুড়ি, সেখানে হস্টেলে থেকে পড়ার ইচ্ছে?
বাপী চুপ।
—আমার সে ক্ষমতা নেই।
বাপীর জবাবও এবারে স্পষ্ট।অর্থাৎ একবার সেখানে গিয়ে দেখব কোন ব্যবস্থা হয় কিনা।
হরিবাবু থমকালেন। মুখের ওপর এতকাল কোন কথা শুনে অভ্যস্ত নয়। তাঁর চোখে এটা অবাধ্যতা। কিন্তু সামনে যে দাঁড়িয়ে সে এখন তাঁর চেয়েও তিন আঙুল ঢ্যাঙা। দু বছর আগের সেই মারের পর থেকে ছেলে বদলেছে এ তিনি লক্ষ্য করেছেন। শাসন নিষ্ফল হয় নি ভেবেছেন। দিদি মাঝে না থাকাতে বাপ—ছেলের ফারাকটা এখন আরও বেশি স্পষ্ট। কিন্তু ছেলের এই মুখে আর এই স্পষ্ট জবাবে যেন আরও কিছু লেখা আছে।
অসহিষ্ণুতা চাপতে পারলেন না।—সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা হয় কিনা দেখার জন্য এখানকার চাকরি বসে থাকবে?
বাপী নিরুত্তর।
এই নীরবতার মধ্যেও ধৃষ্টতা দেখলেন হরিবাবু।—ম্যাট্রিক পাশ করে খুব লায়েক ভাবছিস নিজেকে, কেমন? স্টুপিড! এখানে আমার ব্যবস্থাই ব্যবস্থা এ যেন মনে থাকে!
থমথমে মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
পরদিন খেয়ে-দেয়ে সকাল দশটা নাগাদ আপিসে বেরুনোর জন্য তৈরি হয়ে ছেলেকে কাছে ডাকলেন। বললেন, চারটে বাজার মিনিট পনের আগে আপিসে আসতে হবে, সেখান থেকে আমি সঙ্গে করে বড়সাহেবের বাংলোয় নিয়ে যাব।
বাপী চুপচাপ অন্য দিকে চেয়ে রইল।
আপিসে বেরুনোর সময় মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে চান হরিবাবু। আজ রাখা গেল না। চাপা গর্জন করে উঠলেন, আমার কথা কানে যাচ্ছে?
বাপী এবারে সোজা বাবার মুখের দিকে তাকালো। ঠাণ্ডা মুখ। ঠাণ্ডা গলা।— তুমি আর না পড়াতে পার, পড়াবে না। এভাবে জুলুম করছ কেন?
হরিবাবু ঠিক দেখছেন? ঠিক শুনছেন? পায়ে এখন চটি নেই, ফিতে বাঁধা জুতো। তাই খুলে হাতে নেবেন? কিন্তু ছেলের এই মুখের দিকে চেয়ে কটা মুহূর্তের মধ্যেই আবার তাঁর মনে হল, আগের সেই দিন আর নেই। কতটা নেই ঠাওর করে উঠতে পারলেন না। ছেলের ঠাণ্ডা চাউনির ভিতর থেকে কিছু ঠিকরে পড়ছে মনে হল তাঁর। উদ্গত রাগ ঠেলে তল করলেন।
—আচ্ছা, বড়সাহেবের সঙ্গে দেখাশুনা কথাবার্তা হোক। তারপর আর কিছু ভাবার থাকে তো বিকেলে ঘরে এসে ভাবা যাবে।
হরিবাবু হনহন করে চলে গেলেন।
বাপী তার এক ঘণ্টার মধ্যে স্নান সারল। খাওয়া সারল। অন্য দিন দেরি হয়। আজ তাড়া।
এরই মধ্যে আবু এসে হাজির। খুশি উপছানো মুখ।— তোর পেটে পেটে এত যে আমাকে খবর পর্যন্ত দিলি না—অ্যাঁ?
—কি খবর?
—আজ বড়সাহেবের সঙ্গে তোর মোলাকাত হবে, কাল পরশু থেকে তুই আমাদের ছোট কেরানীবাবু। শুনেই ছুটে চলে এলাম আমি——
বাপীও হাসছে অল্প অল্প।—কার কাছে শুনলে?
—একবার আপিসে গেছলাম, তোর বাবাই ডেকে খবরটা দিলেন। আমি তোকে এর পর কি বলে ডাকব রে—হ্যাঁ? লোকের সামনে না হয় আপনি-টাপনি করে বলব—কি বলিস?
——আগে কাজ হোক, তারপর ভেবো। চকিতে ভেবে নিল কি।—বাবা নিজে ডেকে তোমাকে শুধু এই খবরটা দিল, না আর কিছু বলল?
—খবরটা জানিয়ে আমাকে বললেন, সাড়ে তিনটের সময় ঘরে গিয়ে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসিস। চারটেয় বাংলোয় বড়সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা।
বাপী হাসছে মনে মনে। বাবার তাহলে নিজের হুকুমের ওপর ভরসা একটু কমেছে। মনে মনে নয়, বাইরেও হাসল বাপী। বলল, ওই বাংলোর বারান্দাতেই বাবা আমাকে মেরে মেরে একেবারে শুইয়ে ফেলেছিল—নিজের রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম আমি।
আবু থতমত খেল একটু।—দূর, দু বছর আগের সেই মার তোর গায়ে লেগে আছে, না সেই বড়সাহেব আছে। এই লোকের কাছে কাজের কদর আছে বলেই তো তোর বাবার সুবিধে হয়েছে।
বাপীর মজাই লাগছে। আবার বলল, আর পরদিন দুপুরে এসে তুমি বলেছিলে, যদি মরদ হোস্ একদিন শোধ নিবি—আর আজ ছোট কেরানী হয়ে বসছি দেখেই এত খুশি তুমি?
এবারে আবুকে ঢোঁক গিলতে হল।—আচ্ছা ছেলে তো তুই, সেসব কথা এখনও মনে করে বসে আছিস! তারা এখন পৃথিবীর কোন্ রাজ্যে আছে তার কিছু ঠিক আছে? তাছাড়া খোদার মর্জি হলে ছোট কেরানী হলেও শোধ নেবার দিন আসতে পারে। খুশির দিনে ও-সব মাথায় রাখিস না, অনেক কাজ এখন, যাই—ঠিক সাড়ে তিনটেয় এসে যাব, রেডি থাকিস—
চলে গেল।…না ওকেও কিছু বলা গেল না। বলা নিরাপদ ভাবল না। সমূহ সমস্যার সমাধান পিসীই করে রেখে গেছে। নইলে আবুকেই বলতে হত। তার কাছ থেকে সাহায্য চাইতে হত। তার দরকার হল না, বাঁচোয়া। আবু যে ওকে ভালবাসে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাপীর মতলব জানলে ওকে আগলাবার জন্য কি কাণ্ড করে বসত, কে জানে। হয়ত বাবার কাছেই ছুটত আবার। চাকরি ওর কাছে মস্ত জিনিস এখন।
…কি করবে না করবে বাপী গত রাতেই ঠিক করে ফেলেছিল। দরকার শুধু নগদ কিছু টাকার। বানারহাট পৌছুতে পারলে সেখান থেকে জলপাইগুড়ি পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মাইলের বেশি নয়। ভাড়া সেই দিনে বড়জোর এক টাকা। খুব কম হলেও আরও তিন-চার টাকা বাপীর হাতে থাকা দরকার। সপ্তাহের বাজার আর টুকিটাকি কেনার জন্য বাবা ওর হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাপী বরং ওই পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল হেঁটে যাবে, তবু ও-টাকার এক পয়সাও ছোঁবে না। আবুকে বলে দেখবে ভেবেছিল পাঁচটা টাকা ধার দিতে পারে কিনা।
কিন্তু গত রাতের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। চৌকির নিচে পিসীর ছোট বাক্সটার কথা মনে পড়ল। চাবি বাপীর কাছেই। পিসী মারা যাবার পরে এ পর্যন্ত আর খুলে দেখা হয় নি ওতে কি আছে না আছে। যদি কিছু থাকে তা বাপীর ছাড়া আর কার?
জামাকাপড়ের তলা থেকে হাতে তৈরি ছোট্ট থলে বেরুলো একটা। বেশি শব্দ না করে বিছানায় উপুড় করে ফেলল। সবই কাঁচা টাকা, আর একটা আধুলি। মোট সাড়ে সতের টাকা। বাপীর কাছে ঐশ্বর্য। টাকা থলেয় পুরে ওটা কপালে ঠেকাল। ভগবান-টগবান নয়, পিসীকে প্রণাম করল। তারপর সমস্ত রাত আর সকাল কাটল এই দুপুরের প্রতীক্ষায়।
সঙ্গে যা নেবার চটপট গুছিয়ে নিল। টিনের ছোট সুটকেসে ধুতি, শার্ট, গেঞ্জি একটা গরম সোয়েটার। শতরঞ্জী মোড়ানো পুঁটলিতে শুধু নিজের পুরনো কম্বল, রঙিন চাদর একটা, আর গায়ের আলোয়ান। বিছানা-বালিশের বিলাসিতা মন থেকে ছেঁটে দিয়েছে। ওই টিনের সুটকেসই দিব্বি মাথায় দিয়ে শোয়া যাবে।
বারোটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। বাবার বাজারের টাকা তার বিছানায় বালিশ চাপা দিয়ে রেখে এসেছে।…আবু আসবে সাড়ে তিনটেয়। ঘরে শেকলতোলা দেখে ভাববে ও আগেই বাবার আপিসের দিকে চলে গেছে। আপিসে না পেয়ে আবার ঘরের দিকে ছুটবেই। মোট কথা, ও নেই জানাজানি হতে বিকেলে চারটে গড়াবে। ততক্ষণে ও অনেক দূরে।
জঙ্গল দিয়ে নয়, সোজা রাস্তা দিয়েই চলল। জঙ্গলে আবুর সঙ্গে ফের দেখা হয়ে গেলে মুশকিল। ভয় শুধু ওকে। রাস্তায় আর কোন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই বা। কে কি বুঝবে? বেরিয়ে যখন পড়েছে, আর ওকে ফেরাবার সাধ্য কারও নেই।
বরাত ভাল। আধ মাইল না যেতে এক ঠেলা-অলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুটো লোক ঠেলায় লোহালক্কর চাপিয়ে বানারহাট যাচ্ছে। বাপীর কাছে প্রত্যেকটা পয়সা দামী এখন। তবু দু আনায় রফা করে টিনের সুটকেস আর শতরঞ্জীর পুঁটলি ঠেলায় তুলে দিল। ঝাড়া হাতে-পায়ে ওকে দেখলেও এখন আর কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।
আরও মাইলখানেক এগিয়ে বাপী মনে মনে নিজের বিবেচনার তারিফ করল। সামনের দিক থেকে আসছে সাপুড়ে ননদ-ভাজ। দুলারি আর রেশমা। পরনে খাটো ঘাগরা, মাথায় ছোট বড় সাপের ঝুড়ি। ও-দিক থেকে খেলা দেখিয়ে ফিরছে। রোদের তাতে দুজনারই লালচে মুখ
ওকে দেখে রেশমা দাঁড়িয়ে গেল। তাই দুলারিও। মরদের হাতে ঠেঙানি খেয়ে রেশমা কাঁদে কেমন বাপী জানে না। কিন্তু হাসে বেশ।
—ভরদুপুরে কোথায় গো বাপী-ভাই?
আবুর সঙ্গে এত খাতির, বয়েসও বছর দুই বড় হবে, রেশমা ওকে তাই বাপী—ভাই বলে ডাকে। দুলারির মুখে এযাবৎ কোন ডাক শোনে নি।
—এই সামনে। তোমাদের আজ এত বেলা, দুরে গেছলে বুঝি?
—হ্যাঁ গো, আজ ভাল রোজগার হল। কদিনের মধ্যে তোমার বীটম্যান সাহেবের দেখা নেই কেন?—বলো, দাদা খোঁজ করছিল।
দুলারির কপালে ভ্রুকুটি।—বলো রেশমা খোঁজ করছিল।
নিরীহ মুখে বাপীও একটু মজাই করল। বলল, খানিক আগে আমার ওখানেই ছিল, এতক্ষণে বোধ হয় তোমাদের ঘরেই বসে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে রেশমা বলল, চল ভাবী, পা চালিয়ে চল—বেলা বাড়ছে।
গম্ভীর চোখে রেশমার মুখে ঝপ করে একটা ছোবল বসাবার মত চাউনি দুলারির।
ওরা এগুলো। বাপী দাঁড়িয়ে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জাও পেল। এক সঙ্গে দুজনেই ওরা পিছন ফিরে তাকালো। বাপী ঘুরে তাড়াতাড়ি পা চালাল।
…মাতাল ঠেঙাড়ে সোয়ামীর সঙ্গে রেশমার ছাড়াছাড়ি এক-রকম হয়েই গেছে যখন, আবুটা ওকে নিকে করে ফেলছে না কেন বাপী ভেবে পায় না। ওদের সমাজে এটা কঠিন ব্যাপার মনে হয় না।…তবে যত সেয়ানাই হোক, আবুর ভেতরটা নরম। হয়তো ওই মাতাল কাঁদনার জন্যও একটু দরদ আছে। কিংবা দুজনাই এখন ওরা জঙ্গলের চাকুরে বলে হয়তো চক্ষুলজ্জায় পেরে উঠছে না।
বানারহাটে পৌঁছে প্রথমেই নিশীথের মামা-বাড়িতে এলো বাপী। নিশীথ সেন। ক্লাসে ওর সঙ্গেই সব থেকে বেশি খাতির। নিশীথ সেন জন্ম থেকেই বলতে গেলে দিদিমার কাছে মানুষ। বাবা-মা কলকাতায়। বাবা সেখানে কবিরাজ। অন্য ভাই-বোনেরা তাদের কাছেই থাকে।
এ-বাড়িতে বাপীর আগেও যাতায়াত ছিল। শুনল, নিশীথ আগের দিনই জলপাইগুড়ি চলে গেছে। সেখানে ওর আর এক মামা থাকে। কাঠের কারবারী। ভাল অবস্থা। এখন সেখানেই উঠেছে। তারপর হস্টেলে থেকে কলেজে পড়বে। জলপাইগুড়ির মামার অনেকগুলি ছেলেপুলে। সেখানে থাকলে ওর পড়াশুনার ব্যাঘাত হবে।
ঠিকানা নিয়ে বাপী আবার বেরিয়ে পড়ল।
সমস্যার সমাধান এত সহজে হয়ে যাবে কল্পনাও করে নি। কলেজে পড়ার জন্য ও কিভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে শুনে নিশীথও প্রথমে বেশ ঘাবড়েছিল। বাপীও আই. এস. সি.-ই পড়বে। সায়েন্সের মাইনে সাত টাকা। ভর্তির ফী ছাড়াও অ্যাপারেটাসের জন্য কশান মানি পনের টাকা জমা রাখতে হয়। হস্টেলে থাকা-খাওয়া বাবদ এ-সবের ওপর মাসে আরও চল্লিশ টাকার ধাক্কা
মুশকিল আসান এক দিনের মধ্যে ওই নিশীথই করে ফেলল। এখানকার মামাও নিশীথকে বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করার জন্য বকাঝকি করেছিল। ও রাজী হয় নি। মামা-মামীর সঙ্গে কথা বলে তাদের একচৌকি ছেলেমেয়ে অর্থাৎ দুটি ছেলে আর দুটি মেয়েকে পড়ানোর ভার বাপীর ওপর চাপিয়ে দিল। মামা—মামীকে বোঝালো ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করা বন্ধু অল্পের জন্য স্কলারশিপ মিস করেছে। এমন মাস্টার পাওয়া ভাগ্যের কথা। বিনিময়ে বাপী এখানেই থাকবে খাবে আর দশ টাকা মাইনে পাবে।
মামার কাছে ছ মাসের মাইনে আগাম পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। পনের টাকা বাপীর কাছে আছে, বাকি যা লাগে নিশীথ ধার দিল। কলেজে ভর্তি হওয়ার সমস্যা মিটল।
কিন্তু কদিনের মধ্যে বাপীর ক্লান্তি এসে গেল। ওর কল্পনা যে সাম্রাজ্যের সিংহাসনের দিকে ছোটে, বাস্তবটা সে তুলনায় একটা কুৎসিত ঘায়ের মতো। নিশীথের মামার ছেলে-মেয়েদের প্রতিও ভিতরটা বিরূপ। যুদ্ধের চাকরিতে লোক নেওয়া হচ্ছে। ভাবে সব ছেড়েছুড়ে ওতেই ঢুকে পড়ে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে কেমন হয়। আবার নিজেই জানে, সব সম্ভাবনা তাহলে ভরাডুবি হয়।
দিন-কুড়ির মধ্যে কলেজের আপিসে ডাক পড়ল। কেন, বাপী কল্পনা করতে পারে নি। বানারজুলি থেকে বাবা আপিসে চিঠি দিয়েছে তার ছেলে ওখানে ভর্তি হয়েছে কিনা। হয়ে থাকলে কোন্ ঠিকানায় আছে। জবাবে আপিসের কেরানীবাবু ওর ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে, আর ওকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা ছেলের ঠিকানা জানে না, এ কেমন কথা?
বাপী যা-হোক জবাবদিহি করে চলেছে।
মাসের শেষে ওর নামে বাবার কাছ থেকে তিরিশ টাকা মনিঅর্ডার। কুপনে শুধু লেখা মাসে-মাসে তিরিশ টাকার বেশি পাঠানো সম্ভব নয়।
মাসে তিরিশ টাকা পাঠানোই বাবার পক্ষে কতখানি বাপী তা জানে। টাকার জন্য নয়—সেই ঘৃণা, সেই বিদ্বেষ। টাকা নিয়ে তক্ষুনি পোস্ট অফিসে ছুটল। গাঁটের পয়সা খরচ করে তিরিশ টাকাই ফেরত পাঠাল। কুপনে লিখল, টাকার দরকার নেই। কারও কাছ থেকে কোন আশা নিয়ে সে ঘর ছেড়ে আসে নি।
পরের মাসের মাঝামাঝি টেলিগ্রাম। কাউকে দিয়ে আবু তার পাঠিয়েছে। হরিবাবুর অবস্থা সংকটাপন্ন। চলে এস।
এবারে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছে বাপীর। কিন্তু তবু অভিমান। তবু বিদ্বেষ। যাবে? যাবে না।…যাবে?
…সেই দিনই বানারজুলি পৌঁছেছে। তার পরদিন বেশি রাতে বাবা চোখ বুজল। হঠাৎ বুকের বাঁ দিকে প্রচণ্ড ব্যথায় শয্যা নিয়েছিল। তার পরেই এমন অবস্থা যে স্থানীয় ডাক্তার হাসপাতালে সরাতেও সাহস করে নি। আগের সমস্ত রাত এমন কি পরদিন বিকেল পর্যন্ত বাবার পুরো জ্ঞান ছিল। বাপী এসে দাঁড়াতেই বাবা বড় বড় চোখে ওকে দেখেছে। সেই বড় বড় চোখের জল দুই গালে গড়িয়েছে। বাবা যেন অব্যক্ত আকৃতিতে ওকে সব ভুলে যেতে বলছে।
বাপীর ভিতরটা দুমড়ে ভেঙেছে। সমস্ত রাত বসে তার বুকে হাত বুলিয়েছে। বাবা তারপর পরম তৃপ্তিভরে থেকে থেকে ওকে দেখেছে।
পরদিন ভোররাতে সব শেষ। পিসী যেতেও বাপী কাঁদতে পারে নি। এখনও পারল না। পিসীর বুকে আছড়ে পড়ে যেমন কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, বাবার দিকে চেয়েও তেমনিই একটা ইচ্ছে ভিতর থেকে ডুকরে উঠছে। এত দিনের সব ঘৃণা আর বিদ্বেষ ফিরে ওকেই চাবুক হেনেছে।
বাবার কাজ মেটার পরেও কিছুদিন থেকে যেতে হল। এবারের বড় সাহেব সত্যি ভাল লোক। বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ডের বারোশো কত টাকা ওর হাতে তুলে দিলেন। মালপত্রসহ ওকে বানারহাট পৌঁছে দেবার জন্য জীপও দিলেন।
সঙ্গে আবু। বানারহাট পর্যন্ত ওর সঙ্গে যাবে। কিন্তু মুখে কথা নেই।
যেতে যেতে বাপী এবারে লোভীর মতই বানারজুলির জঙ্গল দেখছে। আবার সামনে তাকিয়েই জীপটাকে দাঁড়াতে বলল। পথের ধারে গাছের গুঁড়িতে বনমায়া বাঁধা। ও সামনে যেতেই গলা দিয়ে শব্দ বার করে শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম জানালো। বাপী ওর কপালে আর শুঁড়ে বারকয়েক হাত বুলিয়ে আবার ফিরে এলো। চোখের কোণ দুটো বড় বেশি শিরশির করছে। গেল বারে বানারজুলি ছাড়ার সময়ে এমন হয় নি।
একটু সহজ হবার জন্যেই আবুকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বিয়েটা হচ্ছে কবে?
বিকৃত মুখ করে আবু জবাব দিল, বিয়ের নিকুচি করেছে। শালার মরদ ঘরে থাকতে তার বিবিকে বিয়ে করা অত সোজা!
বাপী হেসে ফেলল। কিন্তু ভেতর হাল্কা হল না। আবুর সঙ্গে, এই বানারজুলির সঙ্গে, বানারজুলির জঙ্গলের সঙ্গে, বানারজুলির আকাশ-বাতাসের সঙ্গে কি-যে নাড়ির যোগ এ আগে জানত?
সেই যোগ ছিঁড়ে আজ ও ভেসে চলল। একেবারে একা।
.
জলপাইগুড়ি ফিরে বাপীর প্রথম কাজ ঠাঁইবদল। নিশীথের মামা বাড়িতে ওই দুই মাসের মধ্যেই হাঁপ ধরে গেছল। পড়ার সময় ছাড়াও ছোট চারটে ছেলেমেয়ে ছেঁকে ধরে থাকে ওকে। ওদের সঙ্গে খেলতে হবে, গল্প শোনাতে হবে। তাছাড়া নিশীথের মামা-মামীরও বাড়তি ফাইফরমাসের কামাই নেই।
নিশীথের সঙ্গে হস্টেলে থাকার বায়না ছিল বাপীর। হাতে সাড়ে বারোশ’র ওপরে টাকা তখন অনেক টাকা। কিন্তু মাসে সর্বসাকুল্যে পঞ্চাশ টাকা খরচ ধরলে দু’ বছরের মধ্যে ও-টাকা ফুরোবে বাপীর সে-হিসেব আছে। তাই নিশীথকে বলল, খাব-দাব না, তোর মামাতো ভাইবোনদের পড়ানোর টাকা কতটা বাড়াতে পারিস দেখ্, নইলে আই. এস. সি. পাশ করতেই জমা টাকা শেষ হবে।
নিশীথের কানে কিছু ঢোকালে ভালই ঢোকে। কোমর বেঁধে মামা-মামীর সঙ্গে ফয়সলা করে এলো। বন্ধুর জন্য মাসে পঁচিশ টাকাই দাবী ছিল তার—একটা জোয়ান ছেলের দু’বেলার ভাত আর জলখাবার দিতে মাসে পনের টাকাও খরচ হত না নাকি মামার? যুদ্ধের বাজারে খাওয়া-পরার খরচ বাড়ছে না?
মামা-মামী মাসে কুড়ি টাকায় ফয়সলা করল। সেই সঙ্গে বিকেলের জল—খাবার যোগান দিতেও রাজি হল। ছেলেমেয়ের রেজাল্ট ভালো হলে পরের বছরে আরো মাইনে বাড়ানোর কড়ার করে নিশীথ হস্টেলে ফিরল। এবারে আর এক প্ল্যান মাথায় ঘুরছে তার। এখন পুঁজি থেকে মাসে তিরিশ টাকা খরচ হলেও দু’ বছরে আই. এস. সি. শেষ করার পর বি. এস. সি. পড়ার পুরো টাকা হাতে থাকে না। তাই বাপীকে পরামর্শ দিল, তোর ওই কামানো টাকা নিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা কর, কলেজের মাইনে সাত টাকা আর হস্টেলের সীট-রেন্ট ছ’ টাকা যদি মাপ হয়ে যায়, তাহলে বি. এস. সি. পাশ করা পর্যন্ত আর ভাবনা থাকবে না। কিন্তু বাপী রাজি হল না। এক পিসীর কাছে ভিন্ন এযাবৎ আর কারো কাছে মুখ ফুটে কিছু চায় নি। এ-প্রস্তাব সরাসরি ভিক্ষে চাওয়ার মতো। কিন্তু নিশীথ নাছোড়বান্দা। হস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্টকে ধরে ওর সীট-রেন্টের ছ’টা টাকা বাঁচিয়ে ছাড়ল।
বাপীর এতেও খারাপ লাগল খুব। তবে এবারে অনেকটা নিশ্চিন্ত বটে। আবু রব্বানী বানারজুলির বাড়িটা কি করবে কে জানে। বাপী ওটা ওকে বিক্রী করে দিতে বলেছিল। শুনে রাগ-রাগ মুখ করে আবু বলেছে, তুই কি একেবারে বিবাগী হতে যাচ্ছিস নাকি—ছোট-বড় দেড়খানা কাঠের ঘর বিক্রী করে কি ঐশ্বর্য পাবি শুনি? তার থেকে বাপ আর পিসীর স্মৃতি থাক না—
বলেছে ঠিকই। তবে দেড় ঘরের সামনে পিছনে আর পাশে জমি খানিকটা আছে। কিন্তু তারও কি-বা দাম তখন। পিসীর মুখে গল্প শুনেছিল, বাবা যখন ওখানে ঘর তুলেছে, সর্বসাকুল্যে খরচ পড়েছিল নব্বুই টাকা। জমির দাম ধরে। কাঠ জঙ্গল থেকে ওমনি পেয়েছিল বাবা। শুধু ঘরামি আর মিস্ত্রীর খরচ। তারাও আবার জঙ্গলের খাতিরের কন্ট্রাকটারের লোক।
আবুর মন বুঝে বাপী ওকে ভাড়াটে পাওয়া যায় কিনা দেখতে বলে এসেছে। মাসে পাঁচ-সাত টাকা যা মেলে। ও-সব জায়গায় তাও পাওয়া সহজ নয় জানে। যতদিন না ভাড়াটে জোটে আবুকে বাড়িটা দেখাশুনা করতে বলেছে; আর সম্ভব হলে রাতে ওখানে ওকে থাকতে বলেছে।
খুব একটা বড় ভাবনা বাপীর মাথার ওপর কিছু নেই এখন। তবু ভালো লাগে না। বাপীর কিছুই ভালো লাগে না। না নিজে পড়তে, না নিশীথের মামাতো ভাইবোনগুলোকে পড়াতে। বয়েস সবে সতের এখন। কলেজে ওর বয়সী বা ওর থেকে বড় ছেলেরা কত রকম হৈ-চৈ ফুৰ্তিতে দিন কাটায়। কিন্তু বাপীর ভিতরের বয়েসটা ওদের সক্কলকে ছাড়িয়ে ঢের এগিয়ে গেছে। ও-সব খেলাধুলো হৈ-চৈ ওর জন্য নয়। তার থেকে নিরিবিলি ভালো লাগে। ভাবতে
ভাল লাগে। ভাবনার মধ্যে অনেক বড় হতে ভাল লাগে। বয়সে নয়, ক্ষমতায়। এমন ক্ষমতা, যার কোনো শেষ নেই। তল-কূল নেই। কেরানীর ছেলে বলে যারা নাক সিঁটকেছে, যারা চোখ তাকিয়ে দেখে নি, তাদের চোখ ঠিকরে যায় এমন বড়।
ছুটির দিনে বা অন্য দিনেও ফাঁক পেলেই বিকেলের দিকে একলা দু’ আড়াই মাইল পথ হেঁটে করলা নদী বা তিস্তার ধারে এসে বসে থাকে। করলার থেকে তিস্তার দিকটা বেশি নিরিবিলি। সামনে সরু খালের মতো তিরতিরে জল। হাঁটুর ও আধখানা ডোবে না। তার ওধারে ধু-ধু বালুর চর। তার শেষে ডুয়ার্স-এর জঙ্গলের রেখা। সতৃষ্ণ চোখে বাপী সেই সবুজ রেখার দিকে চেয়ে থাকে। তখন বানারজুলি ওকে ভয়ানক টানে। খাল পেরিয়ে কতদিন সেই চড়ার ওপর দিয়ে ওই জঙ্গলের রেখা লক্ষ্য করে কতদূর হেঁটে চলে গেছে ঠিক নেই। কিন্তু ওই সবুজ রেখা ঠিক তেমনি দূরে
মাথার ওপর দিয়ে আজকাল ঘন ঘন এরোপ্লেন উড়ে চলে যায়। বাপী কাগজ পড়ে রোজ। পৃথিবীর যুদ্ধ এখন ঘরের কোণে। কিন্তু মাথার ওপর এরোপ্লেন দেখলে ওর যুদ্ধটুদ্ধ মনে থাকে না। মনটা ঢের ওপর দিয়ে উড়ে চলতে থাকে।
…বিষম চমকের দিনের সেই শীতের বিকেলেও বাপী তিস্তার পারে একলা বসে। যুদ্ধের বোমা কলকাতায় পড়েছে। রেডিও মারফৎ সর্বত্র সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া খবর এসে গেছে। অনেকে বলাবলি করছে জাপানীদের দলে ভিড়ে সুভাষ বোসের এই কীর্তি। তার আজাদ হিন্দ ফৌজ নাকি ভারতের কোন কোন জায়গা দখল করেছে। এবার বার্মা থেকে কলকাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা তারই সূচনা।
দিকে দিকে আতঙ্ক। এমন কি এই জলপাইগুড়িতেও। কিন্তু বাপীর ভিতরে আতঙ্কের বদলে অন্য রকম উত্তেজনা। আর মাথার ওপরের ওই এরোপ্লেনের মতো তার উদ্ভট কল্পনা পাখা মেলে দিয়েছে। সুভাষ বোস আর যা-ই করুক দেশের ক্ষতি কক্ষনো করতে পারে না। বোমা ফেললেও না। গত বছরের জানুয়ারিতে ওই লোকের ইংরেজের তাঁবেদার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হবার খবর ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাপীর বুকের তলায় যে আনন্দের বান ডেকেছিল, আজও মনে আছে। তখন ও বানারজুলি চা-বাগানের ক্লাবের বারান্দায় বসে রোজ সন্ধ্যায় খবরের কাগজ পড়ত। এ খবর পড়ে আবুর সঙ্গে পরামর্শ করেছিল, সুভাষ বোস যদি পালিয়ে এই বানারজুলির জঙ্গলেই এসে উপস্থিত হয়, তাহলে কেমন করে ও আর আবু তাকে এই জঙ্গলের মধ্যেই সকলের চোখের আড়ালে রাখবে। বাপীর তখনো ধারণা, পালানোর সব থেকে ভালো জায়গা একমাত্র জঙ্গল।
এই সুভাষ বোস নাকি ভারতের কোনো কোনো মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা তুলেছে—ফিসফিস করে এ কথাও কেউ কেউ বলে। বাড়িতে রেডিও আছে এমন বড়লোকের ছেলেও কলেজে আছে। তাছাড়া সৈন্য বিভাগের দুই একজন হোমরাচোমরার আত্মীয়ও দু’পাঁচ জন আছে। এরাই বলাবলি করে।
বাপীর বদ্ধ বিশ্বাস, কলকাতায় বোমা পড়েছে এবং আরো পড়তে পারে— সে শুধু শত্রু নিপাতের জন্য। যারা দেশের শত্রু তাদের ছাড়া আর কারো কোনো ক্ষতি হবে না বা হতে পারে না। কলকাতা কেমন, কলকাতা কি তাও বাপী জানে না। কিন্তু কলকাতা শুনলেই কতগুলো মুখ সামনে ভেসে ওঠে। কলকাতায় থাকুক না থাকুক, ওটা যেন তাদেরই খাস বাসের জায়গা। তা ছাড়াও বাপীর বিশ্বাস তারা কলকাতাতেই আছে। অতএব বোমায় যে শত্রুরা নিপাত হয়েছে বা হবে তাদের মধ্যে ওই চেনা মুখ কটা আছে। …সন্দীপ নন্দী তার মেমসাহেব মনোরমা নন্দী আর তাদের ছেলে সুদীপ নন্দী। বাপীর এই কল্পনায় ওরা দেশেরও শত্রু। কলকাতার এই বোমায় বা পরের বোমায় তারা সব শেষ হয়ে গেলে থাকল শুধু একজন। মিষ্টি।
কল্পনায় সেই অবস্থায় মিষ্টিকে মুখোমুখি দেখছে বাপী আর হেসেছে। মিষ্টি ও দেখছে ওকে। এখন এক বাপী ছাড়া ওর কোনোদিকের কেউ নেই। এবারে বাপীর কি দণ্ড দেবে ভেবে না পেয়ে ওর চোখেমুখে এত ভয়!
বাপীর তাই আরো বেশি হাসি পাচ্ছে। ও-যে কত উদার হয়ে একলার জগৎ থেকে মিষ্টিকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এসেছে তা জানবেই বা কেমন করে, বিশ্বাসই বা করবে কি করে।
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ শব্দে আবার একটা এরোপ্লেন উড়ে গেলে বাপীর চমক ভাঙল। সামনে তিস্তার খাল। তারপর ধূ-ধূ বালুচর। তার ওধারে ডুয়ার্সের বনের রেখা।
বাপী হাসছে আবারও। একটা বয়েস ওর অন্য ছেলেদের থেকে ঢের এগিয়ে গেছে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে আর একটা বয়েস কল্পনার জগতের মধ্যে আটকে আছে। নইলে কোথায় বোমা আর কোথায় মিষ্টি।
জলপাইগুড়ি এসে বানারহাটের একজন অসম বয়সী সঙ্গী পেয়েছে বাপী। এখন সঙ্গী, আগে ছিলেন সেখানকার স্কুলের ড্রইং মাস্টার। নাম ললিত ভড়। বছর চল্লিশ বয়েস। ম্যাট্রিক পাশ। আর্ট স্কুল বা কলেজের ডিপ্লোমা ডিগ্রি কিছু নেই। নিজগুণে আর্টিস্ট। তাই কোনো সরকারী স্কুলে চাকরি জোটেনি। বেশ বড়সড় মোটা মানুষ। পান-খাওয়া কালো ছোপ ধরা দাঁত। একমাথা চুল আর একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তিন মাসে একবার চুলে কাঁচি পড়ে, আর মাসে দুবার গালে ক্ষুর। আঁকার থেকেও ললিত ভড়ের শাস্ত্রজ্ঞান বেশি। চুল-দাড়ি কাটা না কাটা নিয়েও দু’পাঁচটা সংস্কৃত শ্লোক ঝেড়ে দিতে পারেন। বানারহাটের স্কুলের সব ক্লাসেই একটা বেত নিয়ে ঢুকতেন। কিন্তু সেই বেতের ঘা একমাত্র টেবিলের ওপর ছাড়া কখনো হয়তো কারো গায়ে পড়েনি। বেত হাতে ক্লাসে ঢোকেন কেন জিজ্ঞাসা করলে নিজেই বলতেন, ওটা পারসোনালিটি কমপ্লেক্স। বুঝলি কিছু?
বুঝুক না বুঝুক, ছেলেরা মাথা নাড়ত, বোঝেনি। ললিত ভড় তখন কালো ছোপ-ধরা দাঁত বার করে ধমকের সুরে বলতেন, সব তো বুঝে ফেলেছিস এখন এটা বাকি—বড় হ’, বুঝবি।
জলপাইগুড়িতে তাঁর পৈতৃক ভিটে। বাড়ি বলতে দু’খানা খুপরি কাঠের ঘর। এককালে .এই জলপাইগুড়ির কোথায় নাকি তাঁদের ঘর-বাড়ি আর অনেকটা জমিজমা ছিল। বন্যায় সব খেয়ে দিয়েছে। বানারহাটে থাকতেই ভদ্রলোক এখানকার কোনো বে-সরকারী স্কুলে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই চাকরি এতদিনে হয়েছে।
বানারহাটের স্কুলের ছেলেরা ললিত ভড়কে বলত পেটুক ভড়। না, কেউ তাঁকে পেটুকের মতো খেতে দেখেনি কোনদিন। তবু তাঁকে পেটুক বলার পিছনে একটা মজার ব্যাপার আছে। আঁকার হাত পরিষ্কার। বোর্ডে যা এঁকে দেন ছেলেদের তাই আঁকতে হয়। কিন্তু কোনদিন কেউ তাঁকে ফুল লতা পাতা গাছগাছড়া নদী পাহাড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিষয়ে কিছু আঁকতে দেখে নি। তাঁর আঁকার মধ্যে খাবার বিষয় থাকবেই। আম, আতা, কলা, পেঁপে, আঙুর, বেদানা, পেয়ারা, জাম-জামরুলের থোকা—লাউ, কুমড়ো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলুর ঝুড়ি, বড় বড় টোমাটো, ফলন্ত সিম গাছ, বেগুন গাছ—হাঁড়িভরতি রসোগোল্লা বা দই, ডিশভরতি সিঙ্গাড়া বা তালশাঁস সন্দেশ—দশ বিশ সের ওজনের রুইকাতলা, পোলাউ কালিয়া পঞ্চব্যঞ্জনের সামনে বসা তৃপ্তমুখ ভোজনবিলাসী— কথামালার সেই লোলুপ নেকড়ের সামনে নধর মেষশাবক, নাগালের বাইরে থোকা-থোকা আঙুর ডালের নিচে শেয়াল, কাকের মুখে মাংসের টুকরো দেখে ধূর্ত শেয়ালের চাটু কথা—এইসব তাঁর আঁকার বিষয়। সর্ব ব্যাপারে কিছু না কিছু খাওয়ার যোগ থাকবেই।
মাস দেড়েক আগে রাস্তায় একদিন হঠাৎ দেখা তাঁর সঙ্গে। বাপীকে দেখে আনন্দে আটখানা। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই কাঁধ জড়িয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। বানারজুলিতে গরিবদের কুঁড়েঘর তো কতই দেখেছে বাপী। নিজেদের অবস্থাও সেই রকমই ছিল। কিন্তু ঘুণধরা এই কাঠের খুপরি ঘর দুটোয় এসেই বাপীর মনে হয়েছিল, দারিদ্র্য এখানে একেবারে হাঁ করে আছে।
হাঁক দিয়ে স্ত্রীকে ডাকলেন। দুটো ছেলে ঘরে এলো। পরনে হাফপ্যান্ট, আদুড় গা। আট আর বারোর মধ্যে বয়েস। দরজার কাছে ময়লা শাড়ি জড়ানো বছর চোদ্দর একটা মেয়ে। এই ছেলে দুটো আর মেয়েটা বেশ লম্বা আর ফর্সাও— কিন্তু গায়ে কারো মাংস নেই। শুধু হাড়গুলো চামড়ায় মোড়া। এত রোগা ছেলেমেয়ে বাপী আর দেখেইনি বোধ হয়।
মাস্টারমশাইর বউ এলেন। উনিও হাড়-চামড়া-মোড়া লম্বা ফর্সা কাঠি একখানা। ললিত ভড় বললেন, আমার বানারহাট স্কুলের ছাত্র বিপুল, ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে কলেজে পড়তে এসেছে—দেখ তো ওকে দেবার মতো ঘরে কিছু আছে কিনা।
মুখে হাসিও না রাগও না, একবার ওর দিকে তাকিয়ে ভড়-গিন্নী কলের পুতুলের মতো চলে গেলেন। বাপীর মুখের দিকে চেয়েই ললিত ভড় বললেন, থাক, তোকে আর লজ্জা পেতে হবে না, স্কুলে তোরা আমাকে পেটুক-ভড় বলতিস আমি জানি না নাকি! কিছু খেতে না দিলে মনে মনে ঠিক নিন্দে করবি—
লাল-কালো দাঁত শুধু না, খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁক দিয়েও খুশি ঠিকরে পড়ছিল। এর পরেই সোৎসাহে ওকে শোনাতে লাগলেন, হাতে কিছু টাকা এলেই পিছনের জমিটুকুতে কি-কি আনাজ লাগাবেন—ভালো মাটি, খাসা তরিতরকারি হবে।
চকিতে রেশমা আর দুলারির কথা মনে পড়ে গেছল বাপীর। অন্ধ হুটু মিয়ার ঘরের পিছনে তারাও তরকারির বাগান করেছিল। কিন্তু তাতে অভাব মেটেনি। তারা এখন সাপের খেলা দেখায়।
একটা মাঝারি সাইজের ডালায় নুন আর গোলমরিচ ছড়ানো তেলে ভাজা চিঁড়ে এনে সামনে রাখল সেই রোগা মেয়েটা। কিছু সেদ্ধ মটরশুঁটিও আছে ওতে।
—খা-খা—খাসা জিনিস। ললিত ভড় নিজেও ডালা থেকে একমুঠো তুলে নিলেন।
সত্যি মুখরোচক। রোগা ছেলে দুটো হাঁ করে দেখছে। বাপী কাছে ডাকতে ওরাও এসে খেতে বসে গেল। মেয়েটা আবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। বাপী বলল, তুমিও চারটে নাও না, আছে তো—
ললিত ভড় ডাকলেন, লজ্জা কি রে, আয় আয়। বাপীকে বললেন, আমার মেয়ে কুমকুম, ও-ই বড়, ক্লাস এইট-এ পড়ে—খুব ভালো মেয়ে।
কিন্তু ভালো মেয়ে এলো না। অন্য ঘরে চলে গেল। বাপী বিমনা একটু। …মিষ্টির থেকে বছরখানেকের বড় হতে পারে মেয়েটা। কিন্তু কৌতূহল হওয়া দূরে থাক, মেয়ে বলেই মনে হয় না।
চিঁড়ের ডালার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিল, আবার বুকের ভিতরে কেমন করছিলও। কথা বলতে বলতে ললিত ভড় চিঁড়েভাজা তুলে নিচ্ছেন। ছেলে দুটো চটপট খাওয়া সারছে। ওই চিঁড়ের ডালায় বাপী আর একটিবার মাত্র হাত দিয়েছে। তার মধ্যে ডালা খালি।
ললিত ভড়ের শিল্প-কলায় সর্বদা ভালো ভালো খাবার জিনিস থাকে কেন বাপী তা এতদিনে বুঝতে পারছে।
মনের মতো শ্রোতা পেলে ড্রইং মাস্টার ললিত ভড় সব থেকে খুশি। ভালো খাবার পাওয়ার থেকেও কিনা তা অবশ্য বাপীর যাচাই করার সুযোগ হয় নি। এই তিস্তার পারেই মাঝে মাঝে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। লম্বা হাঁটার ঝোঁকে অনেক দিনই এদিকে চলে আসেন। ছেলেমেয়ে বউ যত হাড়-চামড়া-সার হোক, তাঁর দেহখানা লম্বার ওপর নাদুসনুদুস।
দেখা হলে এ-সময় যুদ্ধের কথা ছাড়া আর কি কথা হবে। তখন যুদ্ধ নিয়েই অনর্গল বলে যান ললিত ভড়। মেজাজ তিরিক্ষি হতেও সময় লাগে না। —ওসব যুদ্ধ-টুদ্ধ হল রাজরাজড়ার ব্যাপার, বুঝলি? ও আমাদের কিছু নয়। আমাদের শুধু পেটের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ লেগেই আছে। আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখে ইংরেজ এই যুদ্ধটাই বেশ করে শিখিয়েছে। ইচ্ছে করলেই ওরা বেশি দিতে পারে, কিন্তু দেবে কেন? ভরা পেটে আর গোলাম হতে চাইবে কেউ? ইস্কুল-কলেজের বড় বড় ছেলেগুলোকেও এটা বোঝাতে গেলে ওরা আবার বোকার মতো হাসে। ওদের কাছে আমি সদৃশপ্রাজ্ঞ, মানে যেমন চেহারা, তেমনি বুদ্ধি।
এই প্রসঙ্গে লাল-কালো দাঁত আর দাড়িবোঝাই মুখ খিঁচিয়ে একদিন বলেছিলেন, শ্লোক আছে, স্বদেশের ঠাকুর, বিদেশের কুকুর—মানে জানিস? স্বদেশে যার সম্মান, বিদেশে তার অনাদর। আমাদের ঠিক উল্টো। ইংরেজ বিদেশে এসে ঠাকুর আর আমরা স্বদেশে থেকে কুকুর। আমাদের মরণ ভাগাড়ে, অপরং বা কিং ভবিষ্যতি—যুদ্ধ লাগুক, থামুক, আমাদের আবার ভবিষ্যৎ কি?
পরের বছরেও ড্রইং মাস্টার পেটুক-ভড়ের মুখে হা-হা হাসি দেখেছে বাপী। কিন্তু তাঁর কথাবার্তা আর শ্লোকের ধার আরো ঝাঁঝালো। কলকাতার কাগজগুলোতে তখন সমস্ত চব্বিশ পরগণা আর বাংলার বহু জায়গা জুড়ে দুর্ভিক্ষের বার্তা। চালের বস্তা সব নাকি পাখা মেলে উবে যাচ্ছে। ডাল তেল নুন মশলাও উধাও। ভাত ছেড়ে ভাতের একটু ফ্যানের জন্য দিকে দিকে আর্তনাদের খবর। দুর্ভিক্ষ শব্দটাই শুধু শোনা ছিল, ব্যাপারখানা কি বাপীর জানা ছিল না। এখনো খুব স্পষ্ট নয়। কারণ উত্তর বাংলা মোটামুটি ধান-চালের দেশ। কিন্তু অন্য প্রান্তের দুর্ভিক্ষের বাতাসে এখানেও অনেক কিছুর দর চড়া। ত্রাসে যে যতটা পারছে ঘরে এনে মজুত করছে। পড়াতে গিয়ে নিশীথের মামা বাড়িতেই তো কত চালের বস্তার ঠিকি দেখেছে বাপী।
এই প্রসঙ্গে পেটুক-ভড়ের রুদ্রমূর্তি এক এক সময়।—রাশি রাশি লোক মরছে বুঝলি? খিদের জ্বালায় মানুষগুলো পিঁপড়ের মতো পটাপট মরে যাচ্ছে। ওরা হিসেব দিচ্ছে পনের লক্ষ, কিন্তু কম করে পঁয়ত্রিশ লক্ষ হবে, শুনে রাখ আমার কাছে। সরকারী ফিগার চ্যালেঞ্জ করে কাগজে ওই খবর বেরিয়েছে। দুর্ভিক্ষ অল্পকাল, স্মরণ থাকে চিরকাল—সেই চন্দ্রগুপ্তর আমল থেকে এ পর্যন্ত কত কোটি লোক দুর্ভিক্ষে মরেছে এই দেশে তাও আমি হিসেব করে বলে দিতে পারি। কিন্তু আগের কালে পথঘাট ছিল না, গাড়িঘোড়া ছিল না—যেখানে দুর্ভিক্ষ হত পটাপট লোক মরত। কিন্তু এখন হয় কেন? এখন মরে কেন? আগের কালে দুর্ভিক্ষ তাড়ানো ছিল রাজধর্ম—রাজরাজড়ারা সুফলার ধান আগেকার জন্য মজুত রাখত আর বিলোতো। এখন কে মজুত করেছে? কারা বিলোচ্ছে? আমি ছবির মধ্যেও খাবার যোগান দিই, কিন্তু এই রাজরাজড়ারা কি করে?
আর একদিন শুকনো মুখ দেখেই বাপীর মনে হচ্ছিল ভদ্রলোকের কিছু খাওয়া হয় নি। সকাল থেকেই খাওয়া হয় নি কিনা কে জানে। কথার ফাঁকে দু’বার উঠে তিস্তার ওই তিরতিরে জলেই কুলকুচি করে এসেছেন।
—শাস্ত্রমতে দুর্ভিক্ষ কেন হয় জানিস? ঈতির দোষে। ‘ঈতি’ কি জানিস? ঈতি হল অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি পঙ্গপাল মুষিক আর যুদ্ধ। এই দুর্ভিক্ষে ঈতির প্রথম চারটেই বাদ। কেবল যুদ্ধ। যুদ্ধ মানে কি? মানুষের উপদ্রব আর মানুষের লোভ। বুঝলি? কিন্তু আমার কথা কে শোনে—আমার হল গিয়ে ‘দারিদ্র্যদোষো—গুণরাশিনাশী’–অভাবের আগুনে সব গুণ পুড়ে ছাই। স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছেলেদের সেদিন এই দুর্ভিক্ষটা কি আর কেন তাই বলছিলাম—পাশ দিয়ে যেতে পণ্ডিতমশায় এই টিপ্পনী কেটে গেল।
ফেনা-ওঠা শুকনো মুখ আবার তিস্তার জলে ধুতে গেলেন। বাপী পকেটে হাত দিল। একটা আধুলি আছে জানে। পারতপক্ষে খরচ করে না।
মুখ ধুয়ে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।—চলুন।
খেয়াল না করেই ললিত ভড় ওর সঙ্গে চললেন। মুখেরও কামাই নেই— আসল কথা হল টাকা, বুঝলি? টাকা থাকলেই জ্ঞান বুদ্ধি মান সম্মান প্রতিপত্তি সব থাকল তোর। আর টাকা না থাকলে নিজের জনেরাও চিবুনো ছিবড়ের মতো ছুড়ে ফেলে দেবে। তোর এখনো কেউ নেই বলেই বলছি এটা মনে রাখিস— নইলে ঠকতে হবে।
লোকালয়ে এসে বাপী একটা জিলিপি ভাজা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার মধ্যে ফুরফুরে টাটকা মুড়ি।—গরম জিলিপি আর মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে মাস্টারমশাই।
এবারে বাস্তবে ফিরলেন ললিত ভড়। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ওর সঙ্গে। জিলিপি-ভাজা বড় কড়ার দিকে চেয়ে চোখ দুটো একটু চকচক করে উঠল কিনা বাপী জানে না।
—আজ থাক, তোকে আর একদিন খাওয়াব’খন।
বাপী জোর দিয়ে বলল, আজ আমি। একদিন আমি আপনাকে খাওয়াতে পারি না। পকেট থেকে আধুলিটা বার করে দেখালো, এই দেখুন পয়সাও এনেছি—
দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ললিত ভড় পিছনে। আমতা আমতা করে বললেন, তোর যখন এত ইচ্ছে, একটা কাজ কর তাহলে…কিছু বেশিই নে, বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়া যাবে…ওরাও মুড়ি আর গরম জিলিপি খুব ভালবাসে। আর, আমার জন্যে এক পয়সার পান কেন, মুখটা কেমন হয়ে আছে।
চার আনায় মস্ত এক ঠোঙা মুড়ি, পনের পয়সার তিরিশটা গরম জিলিপি আর দু’হাত দূরের দোকান থেকে এক পয়সায় দুটো পান কেনা হল। একটা পান ললিত ভড় তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন।
কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এসে কি যে আবার দরকারী কাজ পড়ে গেল তাঁর বাপী বুঝল না। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, আচ্ছা তুই যা, আমি একটা কাজ সেরে এখনই আসছি—আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, তোরা শুরু করে দে—
বাপী কিছু বলার অবকাশ পেল না, তার আগেই হন হন করে উনি আর একদিকে চলে গেলেন।
ওঁর বাড়িতে পা দেবার পর ব্যাপারখানা বোঝা গেল। প্রথম দিনের পর বাপী এযাবৎ আরো চার-পাঁচ দিন এখানে এসেছে। ভড়-গিন্নী কাছে আসেন না, মেয়ে আর ছেলে দুটোর সঙ্গে কথাবার্তা হয়।
ওকে দেখে রোগা পাংশুমূর্তি কুমকুম এগিয়ে এলো। পিছনে ভাই দুটো। হাতে মুড়ির ঠোঙা আর জিলিপির ঝুড়ি দেখে ছেলে দুটোর চোখে মুখে চাপা উল্লাস। পারলে ছিনিয়ে নেয়।
কুমকুম জিজ্ঞাসা করল, এ-সব কেন?
আমতা আমতা করে বাপী বলল, মাস্টারমশাই পাঠালেন, কোথায় একটু কাজে গেলেন, এখুনি আসবেন—
হাত বাড়িয়ে কুমকুম জিলিপি আর মুড়ির ঠোঙা নিলে আর সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে বলে উঠল, সমস্ত দিন বাড়িসুদ্ধ সকলকে উপোস করিয়ে এখন জিলিপি পাঠালেন—
থতমতো খেয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাড়িসুদ্ধ সকলে উপোস কেন?
—মাসের শেষে মায়ের বাক্স থেকে বাবা দশ টাকা চুরি করে ধরা পড়েছে তা তোমাকে বলেনি বুঝি! মায়ের জেরার চোটে ধরা পড়েছে। দশ-দশটা টাকা কলকাতায় কোন্ দুর্ভিক্ষের ফান্ডে মণি-অর্ডার করে পাঠানো হয়েছে। রাগ করে মা আজ সমস্ত দিন নিজেও রাঁধেনি, আমাকেও রাঁধতে দেয়নি—দুপুর থেকে সব্বার উপোস চলছে।
বাপী পালিয়ে এসেছে।
আবার একটা অদম্য ইচ্ছা মাথায় নতুন করে চেপে বসেছে। অনেক অনেক বড় না হলেই নয়। অনেক—অনেক টাকা রোজগার না করলেই নয়।…অপমানের শোধ নেবার জন্য অনেক বড় হওয়া দরকার, আর অনেক টাকা দরকার। আবার ললিত ভড়ের মতো মানুষের জন্যেও দরকার।
পড়াশুনা ভালো লাগুক না লাগুক, পরীক্ষায় পাশ না করলে চলবে না, এটা ভালোই জানে। নিশীথের সঙ্গে একঘরে থাকে তাই বই-এর সমস্যা নেই। ফাইনাল পরীক্ষার চার-পাঁচ মাস মাত্র বাকি আর। নিশীথের ঘুম ভাঙার আগেই ও পড়াশুনো কিছুটা সেরে রাখে।
বিষম হাঁপাতে হাঁপাতে ললিত ভড়ের বারো বছরের বড় ছেলেটা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো। সমস্ত রাস্তা ছুটেই এসেছে বোধ হয়। দু’ চোখ কপালে।— বাপীদা শিগগীর দিদি তোমাকে যেতে বলল, একপাল পুলিশ এসে আমাদের ঘর তছনছ করছে, বাবাকে তারা ধরে নিয়ে যেতে এসেছে।
বাপী হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত। তারপর বুকের মধ্যে কাঁপুনি। প্রথমেই ক’মাস আগে গিন্নীর বাক্স থেকে মাস্টারমশাইর দশ টাকা চুরি করে দুর্ভিক্ষের ফান্ডে পাঠানোর ব্যাপারটা মনে পড়ল। এবারে কি বাড়ির বাইরে কোথাও কিছু করে বসল নাকি ভদ্রলোক!
কিন্তু এই বাচ্চা ছেলে কি আর বলতে পারবে; জামা গায়ে চড়িয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। নিশীথ তখনো ঘুমুচ্ছে।
…বাড়িতে অনেক পুলিশই বটে। পাড়ার মানুষেরা সব দূরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ এগিয়ে আসতে ভরসা পাচ্ছে না। ছেলেটার হাত ধরে বাপী পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। ললিত ভড়কে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। এবারে পুলিশ ভ্যানে তোলা হবে।
বাপীকে দেখে লাল-কালো দাঁত বের করে অদ্ভুত বোকার মতো হাসলেন ললিত ভড়। সমস্ত ব্যাপারখানা যেন তাঁর কাছেও দুর্বোধ্য। বিড়বিড় করে বললেন, কি ব্যাপার কিছু বুঝছি না, তুই এদের একটু দেখিস—
একজন পুলিশের ভদ্রলোক বাপীর দিকে এগিয়ে এলো হঠাৎ। গম্ভীর কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, হু আর ইউ?
—বিপুল তরফদার।
—ইনি কে হন? আঙুল তুলে ললিত ভড়কে দেখালেন।
-–আমাদের মাস্টারমশায় ছিলেন।
—কি করা হয়?
—আমি? কলেজে পড়ি…।
—কোথায় থাকা হয়?
—কলেজের হস্টেলে।
লোকটা ফিরে গেল। তার দু’মিনিটের মধ্যে ললিত ভড়কে ভ্যানে তুলে নিয়ে ওরা চলে গেল। আশপাশের সকলে ছুটে এলো। সকলের মুখে এক কথা, হাটে বাজারে লেকচার দিয়ে বেড়ানোর ফল। চেঁচামেচি করে ছেলেগুলোর কান বিষানোর খবর কি ওরা রাখে না—আগে ধরে নি সেটাই আশ্চর্য।
ললিত ভড়ের ঘরে এলো বাপী। দুটো ঘরই লণ্ডভণ্ড করে রেখে গেছে ওরা। কাগজপত্র ছড়ানো। বিছানা-টিছানাগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাক্স-প্যাঁটরা হাঁ-করা খোলা। রোগা মেয়ে কুমকুম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে। হাড় বার করা ছেলে দুটোর চোখে ভয় আর বিস্ময়। ভড়-গিন্নীরই শুধু তেমনি কলের পুতুলের মতো মুখ
পুলিশের এক অফিসারের ছেলে কলেজে পড়ে। নিশীথের সঙ্গে তার বেশি ভাব। নিশীথকে বলে সেই ছেলের মারফৎ খোঁজ নেবার পর জানা গেল, পুলিশের চোখে ‘বিপজ্জনক’ মানুষের লিস্ট-এ নাকি ললিত ভড়ের নাম উঠেছে। পোলিটিকাল প্রিজনারদের এখন আর শিগগীর ছাড়া পাবার কোনো আশা নেই।
পরের দশ-পনের দিনের মধ্যে বাপী অনেকবার ললিত ভড়ের বাড়ি এসেছে। কিন্তু ভড়-গিন্নীর কলের মুখখানা মনের পড়লে আসতে ইচ্ছে করে না। ললিত ভড়ের খবর নেবার চেষ্টাও তলায় তলায় করেছে। একদিন শুনল, তাঁকে জলপাইগুড়ি থেকে বাইরে কোথায় চালান করে দেওয়া হয়েছে।
সেদিনই তাঁর বাড়ি এসে দেখে বাইরে থেকে ঘর তালাবন্ধ। পাশের বাড়িতে খবর নিয়ে জানল, ছেলেমেয়ে নিয়ে ভড়-গিন্নী বাড়ি তালাবন্ধ করে দিনাজপুরে চলে গেছেন। সেখানে তাঁর ভাইয়ের বাড়ি।
এ-খবর জানার পর বাপী হালকা বোধ করেছে একটু। ছেলে দুটো, মেয়ে আর কলের মুখ ভড়-গিন্নীর ভাবনায় ওর গলার কাছে কি দলা পাকিয়ে থাকত।
সেই থেকে বাপীর উপচে-ওঠা গলগলে ঘৃণা আর বিদ্বেষের পাকে আর একটা নাম জড়িয়েছে।
সে-নাম পুলিশ।
আই. এস. সি. পাশ করল। তারপর আরো নিঃসঙ্গতার মধ্যে পরের দুটো বছরও কেটে গেল। আই. এস. সি. পাশ করে নিশীথ কলকাতায পড়তে চলে গেছল। মেডিকেল কলেজে জায়গা না পেয়ে সে কলকাতায় বি. এ. পড়া শেষ করেছে। মাঝেসাঝে চিঠি লেখে। বি. এ. পাশ করার খবর দিয়েছে। এদিকে বাপী বি. এস. সি পাশ করেছে।
নিশীথের মামা-বাড়িতে চার ছেলেমেয়ে পড়ানোয় ছেদ পড়েনি। মাইনে পঁয়তিরিশ টাকায় উঠেছে। এক মাস দেড় মাসের ছুটিছাটায় হস্টেল বন্ধ থাকলে নিশীথের এই মামা-বাড়িতেই এসে থাকতে হয়, খেতে হয়। তখন মাইনে আবার কুড়ি টাকায় নেমে আসে। ফোর্থ ইয়ারের শুরু থেকে বাপী স্কুলের উঁচু ক্লাসের তিনটে ছেলেকে একসঙ্গে পড়ানোর কাজ জোটাতে পেরেছিল। বিকেলে হস্টেলে এসে ঘড়ি ধরে দেড় ঘণ্টা পড়ে যেত। অঙ্ক, অ্যাডিশনাল অঙ্ক আর মেকানিকস—এই তিন বিষয়। এখনো পড়ে। দশ টাকা করে দেয়। তিনজনে তিরিশ টাকা। ফোর্থ ইয়ারে উঠে বাপীর ব্যাংকের বাকী শ’ আড়াই টাকা আর খরচ হয় নি। মুশকিল দাঁড়িয়েছে বি. এস. সি. পরীক্ষার পর। সেই তিন ছেলের একজনের বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে আসতে হয়—বাকি দু’জনও সেখানেই আসে। আবার বাপীকে নিশীথের এই মামা-বাড়িতে ঠাঁই নিতে হয়েছে। তবে মাইনে এবার কুড়ির বদলে পঁচিশে এসেছে। মোট রোজগার তিরিশ আর পঁচিশ পঞ্চান্ন। খরচ নেই বললেই হয়।
বি. এস. সি.’র ফল বেরিয়েছে জুনের শেষে। বাপী পোস্ট অফিসে এসেছিল। একটা খাম কিনে সেখানে দাঁড়িয়েই কলকাতায় নিশীথকে চিঠি লিখেছে। ওর বি. এ. পাশের রেজাল্ট কিছুদিন আগেই জেনেছিল। নিশীথ বাপের কাছে কবিরাজি শিখবে আর চাকরির চেষ্টাও করবে লিখেছিল। বাপী তাকে লিখল, সুযোগ-সুবিধে হলে ওর জন্যেও একটা চাকরির চেষ্টা যেন অবশ্য করে। চাকরির সুবিধে হতে পারে কলকাতায় নিশীথের বাবার সঙ্গে এমন অনেকের চেনা-জানা থাকা সম্ভব।
খাম পোস্ট করে ফেরার সময় অবিশ্বাস্য চমক। উল্টো দিক থেকে যে মানুষটি আসছেন তাঁকে দেখে বাপী হাঁ—
ড্রইং মাস্টার ললিত ভড়।
চুলদাড়ি বোঝাই সেই মুখ। তবে চুল আর দাড়ি দুই-ই এখন কাঁচা-পাকা সেই রকম কালো ছোপ-ধরা লাল দাঁত। আড়াই বছরে ভদ্রলোক শীর্ণ হয়েছেন একটু। বাপীকে দেখে খুশীতে উপচে উঠলেন।—কদিন ধরে তোর কথাই ভাবছি, কলেজ বন্ধ হস্টেল বন্ধ— কে খবর দেয়? আমি ভাবলাম কোথাও চলেই গেছিস।
খুশী বাপীও কম নয়।—আপনি কবে ছাড়া পেলেন? কবে এলেন?
—বারো-চৌদ্দ দিন হবে। এখান থেকে রাজসাহীতে চালান করে দিয়েছিল, সেখানেই ছিলাম।
—কেমন ছিলেন?
—খারাপ আর কি। গোড়ার কিছুদিন গুঁতোর চোটে চোখে অন্ধকার দেখতে হত, কিন্তু আমি কার নাম আর কি চক্রান্তের কথা বলি বল? ওরা বিশ্বাসই করতে চায় না। তারপর অবশ্য ভালই ছিলাম, ওরা আমাকে নিয়ে মজা করত, ভালোভালো খাবারের ছবি এঁকে দিলে আমাকে একটু ভালো খেতে দিত। হা হা হাসি।
কিন্তু বাপীর দু’ চোখ জ্বলছে পুলিশ মারধর করেছে, অকারণে আড়াইটে বছর আটকে রেখেছে, সামান্য সম্বল চাকরিটাও গেছে। জিগ্যেস করল, আপনি ফিরেছেন আপনার ছেলেমেয়ে জানে? তারা তো সব দিনাজপুর চলে গেছল…
—হ্যাঁ, বউয়ের ভাই সেখানে কোর্টের মুহুরি। নিজের জায়গা-জমি আছে, গোরু আছে দুটো, পুকুরে মাছ আছে—ভালই আছে নিশ্চয়।
—আপনি ফিরে এসে সেখানে যান নি?
—যাব রে, সবে তো এলাম। হাসছেন—চাকরিটা আবার হল কিনা বোঝার জন্য স্কুলের হেড-মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গেছলাম। দেখেই আঁতকে উঠল ভদ্রলোক, চাকরির কথা বলব কি। আরো হাসছেন।—তার আর দোষ কি বল, ছাপোষা মানুষ, জেল-খাটা লোককে টানাবে কোন্ ভরসায়?
জেল-খাটা লোককে বাপী একটা মিষ্টির দোকানের দিকে টেনে নিয়ে গেল। খুশি-খুশি বিব্রত মুখে ললিত ভড় বললেন, আবার এখানে কেন রে?
বাপী বলল, আপনার খাওয়া পাওনা আছে মাস্টারমশাই—আমি বি. এস. সি. পাশ করেছি, ডিসটিংশনও পেয়েছি।
শুনেই সানন্দে খেতে বসে গেলেন ললিত ভড়। কাউকে খাইয়ে এত তৃপ্তি আর কি পেয়েছে বাপী? প্রচুর খাওয়ার পর খুশির ঢেকুর তুলে ললিত ভড় মন্তব্য করলেন, তুই বড় ভালো ছেলে, আর বড় নরম মন—তোর কি হবে না।
অর্থাৎ ভালো ছেলে আর নরম হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাপী হেসেই ফেলেছিল।
আবার ঠাঁই বদল। নিশীথের মামার বাড়ি ছেড়ে বাপী ললিত ভড়ের দু ঘরের একটাতে উঠে এসেছে। কেন তাঁকে বুঝতে দেয় নি। উল্টে বলেছে, ও-ই একটু মাথা গোঁজবার জায়গা পেল। ললিত ভড় কেন স্ত্রী বা ছেলেমেয়েকে দেখতে একবার দিনাজপুর যান নি, কেন জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার খবরটা পর্যন্ত তাদের দেন নি সেটা বাপীর থেকে ভালো আর কে আঁচ করতে পারে? বাপী এখানে চলে না এলে মানুষটার উপোস বরাদ্দ। হাতে অঢেল সময় এখন, আর একটা টিউশন যোগাড় করে নেওয়া বাপীর পক্ষে খুব অসুবিধে হবে না। যাদের পড়ায় তাদের বললেই হতে পারে। তাদের কাছে ওর অঙ্ক শেখানোর সুনাম খুব।
ললিত ভড়ের কাছে উঠে আসার ফলে বাপীর লাভও কিছু হয়েছে। এক তো মানুষটার সঙ্গ ভালো লাগে। ভদ্রলোক নিজে রান্নাবান্নায়ও পটু বেশ। দেড় মাস তাঁর কাছে থেকে বাপীর মোটামুটি রান্নাও শেখা হয়ে গেল। আর তাঁর কাছ থেকে কিছু যোগব্যায়ামও শেখা হয়েছে। বেশি খিদে হয় বলে নাকি ও-পাট ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু জানেন অনেক কিছু।
মাত্র দেড় মাস। ছেচল্লিশ সালে ষোলই আগস্ট থেকে তামাম ভারতে এক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠল। গোটা দেশ রক্তে ভেসে যেতে লাগল। সে এক বীভৎস সময় এখানেও। মানুষের বিশ্বাস গেছে, বুকের ভেতরটা দুভাগ হয়ে গেছে। দুদিন আগের গলাগলি ভাব গলা-কাটাকাটির দিকে গড়ালো। কেবল ভয় আর কেবল সন্দেহ সম্বল। বাপীর থেকে-থেকে তখন বানারজুলির আবু রব্বানীর কথা মনে হয়েছে। দুলারি আর রেশমার কথা মনে হয়েছে। বাপীকে কাছে পেলে তারা এখন কি করবে?
গোলযোগের প্রথম ঝাপটার পরেই ললিত ভড় বাপীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিনাজপুরে ছুটে গেছেন। তারপর একটা বছরের মধ্যে একটা চিঠি না, একটা খবর না। কেউ বেঁচে আছে কি নেই তাও বাপী জানে না।
এক বছর বাদে, সাতচল্লিশের পনেরই আগস্ট জলপাইগুড়ির মানুষ অন্তত হেসেছে আর হাঁপ ফেলে বেঁচেছে। একদিন আগেও বুক ধুকপুক সকলের। দেশ স্বাধীন হবে, দুশ’ বছরের দাসত্বের শেকল ভাঙবে—কিন্তু এ-জায়গার মানুষদের ভাগ্যে কি আছে?
পরদিনই বিপরীত উল্লাস। জলপাইগুড়ির বলতে গেলে সবটাই ভারতের এলাকায় পড়েছে। কিন্তু দিনাজপুরের অনেকটা পাকিস্তানের দিকে চলে গেছে। দিনাজপুরের মানুষ কি করছে বাপী জানে না। বিপুল উল্লাসের জয়ধ্বনি দিয়ে জলপাইগুড়ির মানুষ ট্রেজারিতে স্বাধীন ভারতের তিন-রঙা পতাকা তুলেছে।
কলকাতায় নিশীথের সঙ্গে বাপীর চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। পরের মাসেই নিশীথের টেলিগ্রাম। চাকরির একটা ব্যবস্থা হয়েছে। পত্রপাঠ চলে এসো।
টেলিগ্রাম হাতে বাপী বিহ্বল খানিকক্ষণ।
…কলকাতা!
…চাকরি করতে বাপী সত্যি কলকাতা যাবে?
…এই বাইশ বছরের জীবনের বুকের তলার সব থেকে বড় সাধ সফল হবে এবার?
…দশ বছর আগে বানারজুলির বড়সাহেবের আট বছরের এক মেয়ে প্রথম দিনের আলাপে ওকে বলেছিল,, কলকাতা দেখনি আবার ফটফট করছ—তুমি জংলি ভূত একটা। সেই কলকাতা!
.
কলকাতা।
হাওয়ায় ভেসে কলকাতা এসেছে বাপী। ওকে নেবার জন্য নিশীথ স্টেশনে হাজির ছিল। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছে। বাপী ওকে চিঠিতে লিখেছিল দুদিন ওর বাড়ীতে থেকে জ্যাঠাতুতো দাদার অর্থাৎ মণিদার বাড়িটা খুঁজে নেবে। আপাতত সেখান থেকেই চাকরি করবে।
মণিদার বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলে তাকেও চিঠি লিখত। জানে না। ঠিকানা বানারজুলির বাড়িতে কোথাও পড়ে থাকতেও পারে। বাপীর স্মরণশক্তি প্রখর। মণিদা কাস্টমস-এ চাকরি করে এটুকু আজও মনে আছে। কারণ বাবা এক রাতে ঠাট্টা করে তাকে বলেছিল, কাস্টমসের চাকরির তো মাইনে থেকে উপরি বেশি শুনেছি।
বাবার কথায় মণিদা খুব হেসেছিল।
কিন্তু মণিদার আপিসের ঠিকানাই বা পাবে কোথায় যে একটা চিঠি লিখে জানাবে, ও আসছে।
শনিবার সকালে এসে পৌঁছেছিল। নিশীথ সেদিন ছুটি নিয়েছে। ও প্রায় বছরখানেক আগেই চাকরিতে ঢুকে গেছে। ওর আপিস ডালহৌসিতে। কেরানী হলেও আপার ডিভিশন।
শনি-রবি দুটো দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে নিশীথ কলকাতা দেখালো ওকে। চিড়িয়াখানা মিউজিয়াম বোটানিক্যাল গার্ডেনও বাকি থাকল না। ঠাট্টা করে বলল, সব দেখে রাখ, এই প্রথম কলকাতায় এসেছিস বুঝতে পারলে লোকে বাঙাল বলবে।
দেখে শুনে গোড়ায় বাপী হাঁ হয়ে গেছল সত্যি কথা। বই-এ পড়েছিল, আজব শহর কলকাতা। এমন তাজ্জব রকমের আজব কে জানত! ট্রাম বাস লরি ট্যাক্সি মোটর ঠেলা রিকশার মিছিল দেখে দুদিনেই মাথা ঝিম-ঝিম করেছে। গোটা কলকাতা শহরটা যেন সদা ব্যস্ত, ছুটছে আর ছুটছে। আসার সময় ট্রেনে বাসে ঘুরে ফিরে মিষ্টির কথাই বেশি মনে এসেছিল। কোথায় আছে ওরা এখন জানে না। কিন্তু বাপীর বদ্ধ ধারণা, কলকাতায় আছে। মিষ্টি কথায় কথায় একদিন বলেছিল, একটু উঁচু ক্লাসে উঠলেই ও কলকাতায় দাদুর কাছে থেকে পড়াশুনা করবে। ওর মা-তে বাবা-তে সেই রকমই নাকি কথা হয়ে আছে।
ট্রেনে আরো কিছু মনে পড়াতে বাপীর হাসি পেয়ে গেছল। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দু-দুবার সেই বিশাল ছাপা সরকারী গেজেট এনে পড়া। কেন সে শুধু ও-ই জানে।
সেই থেকে বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল, আর কেউ থাকুক না থাকুক, মিষ্টি অন্তত কলকাতাতেই আছে। একদিন না একদিন দেখা হয়ে যাবেই। একটা ক্রুর অভিলাষ ভিতর থেকে ঠেলে উঠতে চেয়েছে। কলকাতায় চাকরি হওয়াটা সেই অনেক অনেক বড় হওয়া আর শোধ নেওয়ার প্রথম ধাপ। কিন্তু এই কলকাতা দেখে বাপী হকচকিয়ে গেছে। ওদের হদিস মেলা দূরে থাক, এই ব্যস্তসমস্ত শহর থেকে মণিদাকে খুঁজে বার করবে কি করে ভেবে পেল না।
মণিদাকে না পেলেও অবশ্য ঘাবড়াবার খুব কিছু নেই। হাতে চারশ টাকার মতো মজুত আছে। চাকরির মাইনেয় কোনো মেসে থাকার খরচা চলেই যাবে। তবু নতুন জায়গায় একটু অভ্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মণিদাকে পেলে ভালো হয়।
যে জন্যে কলকাতায় আসা সেটা আর যাই হোক, লোয়ার ডিভিশন কেরানীর চাকরি নয়। এ রকম চাকরি বাপী চার বছর আগে ঘরে বসেই করতে পারত। করবে না বলেই ঘর ছেড়েছিল, বাবাকে ছেড়েছিল। চার বছর বাদে বি. এসসি. পাশ করার পর সেই লোয়ার ডিভিশন চাকরি মনে ধরার কথা নয়। আকর্ষণ একটাই। কলকাতা। বড় হতে চাও তো বড় গণ্ডিতে এসে বোসো। কলকাতা সেই বড় গণ্ডি। ভাগ্যের জোর থাকলে এখান থেকেই ফকির উজির হয়, ছেঁড়া কাঁথার মানুষ হাত বাড়িয়ে স্বপ্নে লাখ টাকা মুঠোয় ধরে। বাপী তাই কলকাতার এই বড় গণ্ডিতে এসে একটু বসার জায়গা পেয়েই খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল। আপার ডিভিশন লোয়ার ডিভিশন নিয়ে মাথা ঘামায় নি। নইলে ওর থেকে অনেক খারাপ ছাত্র নিশীথ সেন আপার ডিভিশন। যত ছোটই হোক, বাপীর কাছে কলকাতায় এসে স্থিতি হতে পারাটাই ভাগ্যের পাশার একটা বড় দান।
কিন্তু বাস্তবের মুখোমুখি হতে না হতে ভিতরে ধাক্কা খেল। কবিরাজ বাবার একজন অন্তরঙ্গ ভক্তকে নিশীথ রামকাকা বলে ডাকে। নাম রামচরণ গাঙ্গুলী। ব্রুকলিনের কোনো বিভাগের তিনি মেজবাবু। বড়বাবু মন্মথ সোমের সঙ্গে তাঁর বেজায় খাতির। রেসের মাঠে হরিহর আত্মা দুজনে। এই খাতিরের সুতো ধরে বাপীর চাকরি। বড়বাবু মন্মথ সোমকে অজীর্ণ রোগে ধরেছিল। রামকাকার অনুরোধে নিশীথের বাবা দু’মাস বিনে পয়সায় চিকিৎসা করে তাঁকে সারিয়ে তুলেছেন। সেই মওকায় নিশীথ রামকাকাকে বন্ধুর চাকরির জন্যে ধরে পড়েছিল।
কিন্তু প্রথম দিন খিদিরপুর ব্রুকলিন ডিপোয় হাজিরা দিয়ে বাপী ভিতরে ভিতরে হতাশ। যদিও সেই দিনই কাজে জয়েন করার ব্যাপারে কোনরকম অসুবিধে হয় নি। রামকাকা বাপীকে বড়বাবু মন্মথ সোমের কাছে নিয়ে এসেছেন। বিশাল হলের এক কোণে তিন দিক ঘেরা একটু ছোট জায়গায় তিনি বসেন। সামনে তাকালে সমস্ত দপ্তরটি তাঁর চোখের সামনে।
বাপীর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। যুদ্ধোত্তর হওয়ায় কলকাতার কেরানীবাবুরাও বেশির ভাগ তখন ধুতি ছেড়ে ট্রাউজার আর শার্ট ধরেছে। ধুতি পাঞ্জাবি পরে প্রথম দিন আপিসে উপস্থিত হওয়াটা নিশীথের পছন্দ ছিল না। কিন্তু উপায় কি। বিকৃত মুখ করে বলেছিল, একটু কম ঢ্যাঙা হলেও তো আমারটা দিয়ে দিন-কতক চালিয়ে দিতে পারতিস।
বড়বাবুকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলে দিয়েছিলেন রাম গাঙ্গুলি। কিন্তু তার সুযোগ কম দেখে বাপী স্বস্তি বোধ করল। চার দিকের চেয়ার ঠেলে টেবিলের তলায় পায়ের নাগাল পাওয়া সহজ নয়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালো।
বাপী জানে আগে থাকতে বলা কওয়া আছে। তবু রাম গাঙ্গুলি পরিচয় দিতে মুখ তুলে চুপচাপ খানিক দেখলেন ওকে। ছোটখাটো রোগা মানুষ, ফ্যাকাশে মুখ গম্ভীর। যাচাই করে দেখার মতো হিসেবী চাউনি। বসতে বললেন না।
—এ বছর বি. এসসি. পাশ করেছেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। দ্বিতীয় প্রশ্নের আগে বাপী এবারে বুদ্ধিমানের মতো বলল, আমার নাম বিপুল, আপনি তুমি করে বলুন।
—ডিসটিংশনে পাশ করেছ?
—হ্যাঁ স্যার।
—অনার্স পড়লে না কেন?
বাপী এর কি জবাব দেবে ভেবে পেল না। চুপ করে রইল।
—কোন্ কলেজ থেকে পাশ করেছে?
বলল।
—বাড়ি কোথায়?
বলল।
—দেশ?
এবারে একটু মাথা খাটাল বাপী। দেশ ভাগ হয়েছে যখন কাজে লাগতেও পারে। বলল, দেশ কখনো দেখিনি স্যার, শুনেছি পূর্ববঙ্গে।
বাপী কেন, বাপীর বাবাও দেশ দেখেনি। বড়বাবুর দু চোখ আবার ওর মুখের ওপর আটকে রইল খানিক। তারপর যে মন্তব্যটা করলেন সেটাই অপ্রত্যাশিত এবং হতাশার কারণ—একেবারে ভাঙা হাটে এসেছ, চাকরি আজ আছে কাল নেই, কি লাভ।
নিশীথ অবশ্য কলকাতায় আসার পর পর বলেছিল, টেম্পোরারি চাকরি। বাপী জানে গোড়ায় সব চাকরিই টেম্পোরারি। তাছাড়া কেরানীর পাকা চাকরি করছেই বা কে। কিন্তু ভাঙা হাটের চাকরি, আর, আজ আছে কাল নেই শুনে ঘাবড়ালো একটু।
বড়বাবু চেয়ার ঠেলে উঠলেন। ওকে আসতে ইশারা করে সামনে এগোলেন। হল পেরিয়ে বারান্দার ওদিকে আর একটা ঘর। দরজার বাইরে চাপরাসী টুলে বসে। বড়বাবুকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল।
বাপীকে অপেক্ষা করতে বলে বড়বাবু সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন।
এবং দু মিনিটের মধ্যে ওরও ডাক পড়ল।
মস্ত টেবিলের ওধারে যিনি বসে তিনি বড়বাবুরও ওপরওয়ালা বোঝা গেল। বাঙালী। বড়বাবু অবশ্য তাঁর সামনের চেয়ারে বসে। সাহেব তাঁর সমবয়সী হবেন।
বাপী এবারেও দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার সারল। বাঙালী সাহেব মাথা নাড়ালেন কি নাড়লেন না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার শুধু দেখলেন ওকে। তারপর বড়বাবুকে বললেন, ঠিক আছে।
বড়বাবুর ঠোটের ফাঁকে এবারে সামান্য হাসির রেখা লক্ষ্য করল বাপী।
ওকে সঙ্গে করে নিজের জায়গায় ফিরলেন আবার। নিজে বসে এবারে ওকে ও বসতে বললেন। সেই ফাঁকে আবার একটু দেখেও নিলেন।
—বয়েস কত?
—বাইশ।
বয়েস পছন্দ হল না কি আর কিছু, বাপী সঠিক বুঝে উঠল না। বয়েসই হবে বোধ হয়। কারণ, আর একবার মুখ থেকে বুক পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার বললেন, ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটের বয়েস যাই থাক, ঠিক ঠিক বয়েস কত? বলতে বলতে একটা ছাপা ফর্ম বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে, বয়েসের জন্য তোমার চাকরি আটকাবে না—আমার তো তেইশ-চব্বিশ মনে হচ্ছে।
চাকরি পাওয়ার আগ্রহটাই বাপীর সব আপাতত। প্রতিবাদ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ ভাবল। জবাব দিল, হতে পারে স্যার…সার্টিফিকেটে কমানো আছে কিনা বাবা জানতেন।
হতে পারে শুনে অখুশি নন। ভদ্রলোকের ঠোটের হাসিটুকু চেষ্টা করে হাসার মতো। তেমনি একটু হেসে মন্তব্য করলেন, নানা আশায় ছেলের দুই-এক বছর বয়েস সব বাবাই কমিয়ে লেখান। ওই ফর্মটা ফিল-আপ করো, সার্টিফিকেটের বয়সই লিখবে।
অর্থাৎ উনি ধরেই নিলেন বাপীর বয়েস তেইশ-চব্বিশের কম নয়।
পৃথক দরখাস্ত করারও দরকার হল না। ফর্ম ফিল-আপ করা হতে ওতেই তিনি খসখস করে লিখলেন কি, নিজের নাম সই করলেন, তারপর সেটা নিয়ে আবার চলে গেলেন।
মিনিট পাঁচ-সাত বাদে খালি হাতে ফিরলেন। চেয়ারে বসে আবার একটু চেয়ে রইলেন। ভদ্রলোকের এই দেখাটাই কেন যেন অস্বস্তিকর বাপীর কাছে।
—রামবাবুর মুখে তোমার কথা সব শুনেছি, বাবা-মা তো নেই, ভাই-বোন বা অন্য কোনো আত্মীয়-পরিজনও নেই?
রামবাবুর মুখে শোনা মানে নিশীথের মুখে শোনা। সে কি বলেছে না বলেছে কে জানে। তাই জ্যাঠতুতো দাদার কথাও বলা গেল না। জবাব দিল, না স্যার…
খুব সদয় মুখ করে বললেন, ভেরি আনফরচুনেট। যাক, কাজটা কিছুই নয়, তার ওপর পিওরলি টেম্পোরারি, স্টিল ক্যারি অন।
সেইদিনই কাজে বহাল হয়ে গেল। তিন-চার দিনের মধ্যেই চাকরির ব্যাপারটা বুঝে নিল। ব্রুকলিন ডিপো যুদ্ধের বহু রকমের মাল স্টকের অফিস। এই আপিস এখন অনেকটাই গুটনো হয়ে গেছে। তবু সময় সময় কাজ জমে গেলে ছাঁটাই কর্মচারীদেরই কিছু কিছু আবার অস্থায়ীভাবে ডেকে নেওয়া হয়। বাপী ছাঁটাই মার্কা না হলেও বড়বাবুর কল্যাণে ঢুকে গেছে।
নিশীথের ওপর গোড়ায় একটু অভিমানই হয়েছিল বাপীর। এরকম চাকরির জন্য এভাবে ছুটে আসত কিনা সন্দেহ। মাইনে ষাট টাকা ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স আঠারো—সর্বসাকুল্যে মাস গেলে আটাত্তর টাকা।
মেজাজ খারাপ করে নিশীথকে বলেই ফেলেছিল কথাটা। নিশীথ কানে তোলেনি, বলেছে, ওই বড়বাবুটির ক্ষমতা কত জানিস না, লেগে থাক আর ভদ্রলোকের মন রেখে চল—
ঊনিশ-বিশ একই কথা রাম গাঙ্গুলি বলেছেন।—বড়বাবু কাউকে রাখবেন বলে ধরে থাকলে তাকে হটানো সহজ নয়, বুঝলে? বাজে ভাবনা না ভেবে তাঁর মন রেখে চলো।
মন রেখে কি করে চলতে হয় বাপীর সেটাই ভালো জানা নেই। চাকরির মাসখানেকের মধ্যে কপাল দেখা রতন বনিক ওর বশংবদ হয়ে ওঠার পর সেও বলেছে, আপনি হলেন গিয়ে বড়বাবুর লোক, আপনার ‘রিট্রেঞ্চ’-এর ভাবনা কি! বড়বাবুর ইয়েস তো বড়সাহেবের ‘ইয়েস’, এনার ‘নো’ তো ওনারও ‘নো’।
বড়বাবুর লোক ভেবেই রতন বনিক ওরও অনুগত হয়ে উঠছে কিনা, বাপীর সেই সংশয়। বড়বাবুর মন পাওয়ার আশায় বাপী শুরু থেকেই যতটা সম্ভব মন দিয়ে কাজ করছে। ছুটির পরেও এক ঘণ্টা তিনি আপিসে থাকেন বেশির ভাগ চাকুরেরা ছুটির সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু বাপী তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে। বাপীর ধারণা মুখে কিছু না বললেও ভদ্রলোক ভিতরে ভিতরে খুশিই হন একটু।
.
মণিদার বাড়ির হদিস মিলেছে চাকরিতে ঢোকার চার দিন বাদে।
আফিস পালিয়ে নিশীথ তার স্ট্র্যান্ড রোডের হেড অফিসে ঠিকানার খোঁজে গেছল। বরাতক্রমে যে ঘরে ঢুকে নিশীথ মণিলাল তরফদারের খোঁজ করছিল, ভদ্রলোক সে ঘরেই দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা কইছিল। নিজের নাম কানে যেতে এগিয়ে এসেছে। মণিদা নিজেই বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে আর বাপীকে চলে আসার কথা বলেছে। পার্ক সার্কাসের দিকে ঠিকানা। নিশীথ তাকে বলে এসেছে বাপী রোববার যাবে। খবরটা দিয়ে নিশীথ মন্তব্য করেছে, তোর মণিদাকে দেখে সেরকম বড় চাকরে-টাকরে মনে হল না রে। বলেছিলি কাস্টমস-এ ভালো চাকরি করে…পরনে দেখলাম ঢলঢলে ট্রাউজার আর গায়ে টুইলের শার্ট—তাও সে রকম পাটভাঙা পরিষ্কার নয়।
বাপীর ধারণা ছিল মণিদা ভালো চাকরিই করে। তাই বলেছিল। একথা শোনার পর সেখানে থেকে চাকরি করার কতটা সুবিধে হবে সেই ভাবনা। মণিদার বাড়ির হদিস মিলতে এ ছাড়াও একটু অস্বস্তি। আট বছর আগে বানারজুলির একটা সকাল আর দুপুর ভিতরের কোনো গোপন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজের ছেলেবেলাটাকে এক এক সময় একেবারে শেকড়সুদ্ধু টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে বাপীর।
রবিবার সকালে নিশীথ ওকে বাড়ির সেকেলে গাড়িতেই পৌঁছে দিয়ে গেল। নিজে ঢুকল না কারণ বাবা তাড়া দিয়ে রেখেছে। রবিবার সকালে বাবার কাছে হাতে-কলমে কাজ শিখতে হয়, কবিরাজি ওষুধপত্র বানাতে হয়। কিন্তু বাইরে থেকে মণিদার ফ্ল্যাট দেখেই ও হয়তো অপ্রস্তুত একটু। বেশ ভালো চাকরি না করলে এ জায়গায় এরকম ফ্ল্যাটে থাকা সম্ভব নয়।
রাস্তার ওপর শেষ বাড়িটা মণিদার। সামনে ছোট একটু পার্কের মতো। খোলামেলা জায়গা। নিচের দরজার সামনে দো-ভাঁজ লুঙ্গি করে কাপড় পরা একটি লোক দাঁড়িয়ে। নিশীথ তাকে জিজ্ঞেস করতে সে দোতলাটা দেখিয়ে দিল।
ওকে ছেড়ে নিশীথ নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল।
একতলায় মাদ্রাজী পরিবারের বাস মনে হল। বাপী পায়ে পায়ে দোতলায় উঠে এলো। হাতে রংচটা টিনের সুটকেস আর ময়লা শতরঞ্জী মোড়া দড়িবাঁধা শীর্ণ শয্যা। সিঁড়ির মুখের দরজা পেরিয়ে ভিতরে পা দিতেই হাতের জিনিস দুটো বেমানান লাগল। এও বেশ বড়সড় একখানা ঘরের মতোই। বিস্কুট রঙের তকতকে মেঝে, মাঝামাঝি ডাইনিং টেবিলের চারদিকে চেয়ার। বাপী কখনো টেবিল-চেয়ারে ভাত খায়নি, তবু সস্তার জিনিস যে নয় ওগুলো আঁচ করতে পারে। টেবিলে শৌখিন পেয়ালা আর ছোট বড় ডিশ পড়ে আছে। একটু আগেই বাড়ির লোকেরা প্রাতরাশ সেরে উঠে গেছে বোঝা যায় ওদিকের দেয়াল আলমারির কাঁচের পাল্লা দিয়ে ঝকঝকে ক্রকারি সেট দেখা যাচ্ছে।
সামনে পর পর তিনটে ঘর। পুরু পর্দা ঝুলছে। শেষের ঘর থেকে রেডিওর গান কানে আসছে।
হাতের টিনের সুটকেস আর বিছানার পুঁটলি চট করে চোখে পড়বে না এমন এক কোণে রাখল বাপী। তারপর প্রথম ঘরের পর্দাটা সরিয়ে দেখল।
এটা বসার ঘর। গদির সোফা সেট ডিভান সাজানো। বাপীর হকচকিয়ে যাওয়ার দাখিল। পর্দা সরানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি যার সঙ্গে সে বছর ছ-সাতেকের একটি ছেলে। আধশোয়া হয়ে একটা পাতলা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল, তার একখানা পা হাতলের ওপর। পাশের সোফায় মণিদার চোখের সামনে খবরের কাগজ। মুখে আধখানা চুরুট. পরনে চকচকে লুঙ্গি, গায়ে জালি গেঞ্জি।
—বাবা!
দরজায় অপরিচিত লোক দেখে ছেলেটা মণিদাকে ডাকল।
মণিদার মুখের কাজ থেকে কাগজ সরল। চুরুটটা হাতে নিয়ে এক গাল হাসি। কাগজ ফেলে সোফা ছেড়ে উঠল—কত বড় হয়ে গেছিস রে বাপী! আয় আয়—বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি তো?
বাপী হাসিমুখে মাথা নাড়ল। অসুবিধে হয়নি। তারপর এগিয়ে এসে মণিদাকে একটা প্রণাম ঠুকল।
তিনটে ঘরেরই মাঝখানে একটা করে ভিতরের দরজা। বাইরের বারান্দার দিকেও একটা করে দরজা। ভিতরের দরজার পর্দাগুলো তোলা এখন।
মণিদা হাঁক দিলেন, কই গো কে এসেছে, দেখে যাও—
হাঁক শোনার আগেই ওই শেষের ঘর থেকে গৌরী বউদি ওকে দেখে এগিয়ে আসছিল। ও-ঘর থেকেই রেডিওর গান শোনা যাচ্ছিল। সেটা এখনো চলছে। কে এলো বা কে আসবে জানাই ছিল নিশ্চয়। কিন্তু এগিয়ে আসতে আসতে গৌরী বউদি যেন খুব পরিচিত মানুষ দেখছে না। এ ঘরে পা ফেলার আগেই বাপী যেটুকু দেখার দেখে নিয়েছে। সামান্য মোটার দিক ঘেঁষেছে গৌরী বউদি, নইলে আট বছর আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। তখন কুড়ি ছিল বয়েস, এখন আঠাশ হবে! এই আট বছরে মণিদা ফুলে আরো গোলগাল হয়েছে। ফলে তাকে আরো বেঁটে দেখায়। কিন্তু সামান্য মোটা হবার ফলে গৌরী বউদিকে আগের থেকে একটু লম্বা মনে হয়।
মণিদা জিজ্ঞসা করলেন, ওকে চিনতে পারো?
গৌরী বউদির সেই হাসিমাখা চকচকে চোখ দুটো পরিষ্কার মনে আছে বাপীর। তখন মনে হত, ওই দুটো চোখ দিয়েই গৌরী বউদি অনেক কথা বলতে পারে। এখন কতটা পারে জানে না, এখন সামান্য একটু হাসি শুধু ছুঁয়ে আছে। বাপীর দিকে তাকিয়েই বলল, জানা ছিল বলে পারছি, না থাকলে পারতুম না। খাসা মানিক-মানিক চেহারাখানা হয়েছে তো এখন।
বাপী তাকেও একটা প্রণাম সারতে গেল। তার আগেই গৌরী বউদি দু’পা সরে গিয়ে বলল, প্রণাম-টনাম দরকার নেই, বোস—জোয়ান-মর্দ ছেলে পায়ে হাত দিতে এলে বিচ্ছিরি লাগে।
বাচ্চা ছেলেটা বই হাতে সেইভাবেই শোফায় আধ-শোয়া হয়ে নতুন লোকটাকে দেখছিল আর মা-বাবার কথা শুনছিল। তার দিকে চোখ যেতেই গৌরী বউদির সামান্য মেজাজ চড়ল।—এই ছেলে! নবাবের মতো শুয়ে কি পড়া হচ্ছে তোর?
ছেলে সোজা হয়ে বসল।—কি করব বাবা তো শুধু কাগজই পড়ছিল, স্কুলের পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিল না—
এমন সামান্য কারণেও গৌরী বউদির চকচকে চোখে বিতৃষ্ণাই দেখল যেন বাপী। কথাগুলোও রূঢ় একটু।—সমস্ত দিন তো বাইরেই কাটাও, সকালের একটা ঘণ্টাও যদি না দেখতে পারো তো কাল থেকেই ওর জন্যে একজন মাস্টার ঠিক করো। কৈফিয়ত দাখিলের সুরে মণিদা বলল, আজ রোববার, দেব’খন দেখিয়ে—
—তোমার কাছে ওর বারো মাসই রোববার। ছেলের দিকে ফিরল, ওঘরে গিয়ে নিজে যা পারিস পড়গে যা, আমি আসছি—রেডিওটা বন্ধ করে নিস।
বাপী লক্ষ্য করছে মায়ের মতোই মুখ ছেলের। মণিদার আদলের ছিটেফোঁটাও নেই। মনঃপূত হোক না হোক মায়ের হুকুমে উঠে চলে গেল। এদিকের পর্দা ঠেলে দরজার কাছ থেকেই গলা একটু চড়িয়ে গৌরী বউদি বলল, ভিখু, চায়ের জল চড়াও, আর মিটসেফ-এ খাবার কি আছে দেখো—
….বানারজুলিতে নতুন বউ গৌরী বউদির সঙ্গে এই গৌরী বউদির কিছু একটা বড় তফাৎ এর মধ্যে চোখে পড়ছে বাপীর। বানারজুলি থেকে ফেরার আগে বাপীকে গাল টিপে আদর করে এসেছিল মনে আছে। এই গৌরী বউদির আর কিছু না হোক, মেজাজ বেশ বদলেছে বোঝা যায়।
সোফায় বসে মণিদা নেভানো চুরুটটা আবার ধরিয়েছে। দরজা ছেড়ে এদিকে আসতে একটু সহজ হবার তাগিদে বাপী বলল, সকালের চা জলখাবার খেয়েই বেরিয়েছিলাম—
ওর মুখোমুখি সোফাটায় বসল গৌরী বউদি।—কেন, এখানে জুটবে কি জুটবে না ভেবে?
বাপী তাড়াতাড়ি বলল, তা কেন, যতবার দেবে ততোবার খেতে পারি। চট করে অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে গেল, ছেলেটাকে এমন তাড়া দিয়ে পড়তে পাঠালে যে আমি কে জানলও না—কি পড়ে, রোববারেও ওর কি এত পড়া?
চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে মণিদা বলল, ক্লাস ওয়ান। ভাগ্যে বাপী হেসে ফেলেনি। কারণ সঙ্গে সঙ্গে রুষ্ট চোখের একটা ঝাপটা খেল মণিদা। সঙ্গে ঝাঁঝালো কথারও। ক্লাস ওয়ান হোক আর যাই হোক, সঙ্গে নিয়ে না বসলে ওইটুকু ছেলে নিজে থেকে দিগগজ হয়ে যাবে? উইকলির রেজাল্টগুলো চোখ তাকিয়ে দেখেছ একবারও? লজ্জা করে না মুখ নেড়ে কথা বলতে?
মণিদার মুখখানা একটু চুপসেই যেতে দেখল বাপী। তাড়াতাড়ি ওই আবার সামাল দিতে চেষ্টা করল। তুমি কিছু ভেব না বউদি, এবার থেকে আমিই ওকে নিয়ে বসব—কি নাম ওর?
গৌরী বউদি জবাব দিল না। এবারে মণিদার আগ্রহ দেখা গেল।—তাই তো রে। তোর সেই বন্ধুটি বলছিল ডিস্টিংশনে বি. এসসি. পাশ করে তুই এখানে এসে কি একটা চাকরিতে ঢুকেছিস। আমার সকাল দুপুর বিকেল রাত্তির চাকরির জোয়াল কাঁধে—তুই একটু নিয়ম করে ছেলেটাকে দেখলে তো ভালোই হয়— কি বলো?
শেষের বিনীত জিজ্ঞাসা বউয়ের উদ্দেশে। জবাব না দিয়ে গৌরী বউদি এবারে দু’চোখে বাপীকে যাচাই করে নিচ্ছে। অগত্যা বাপী বলল, ডিস্টিংশনে বি. এসসি. পাস করাটা কিছু-নয়—ছেলে পড়িয়ে অভ্যেস আছে। এই করেই তো নিজের পড়াটা চালিয়েছি।
গৌরী বউদির দু চোখ ওর মুখের ওপর থেকে পাশের খোলা দরজার দিকে ঘুরল।—বাচ্চু!
মায়ের একডাকে ওদিক থেকে ছেলেটা ছুটে এলো। বাপীকে দেখিয়ে গৌরী বউদি বলল, এ তোর একজন কাকু হয়, এখানে থাকবে—কাল থেকে রোজ সকালে আর সন্ধ্যায় এই কাকু তোকে পড়াবে—বুঝলি?
বাপী দেখল, গৌরী বউদির মুখখানা একটু প্রসন্ন এখন। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা দেখে প্রথম সুযোগে পড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এখানে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে যেটুকু করা যায়। তবু আধঘণ্টা হয় নি এসেছে, মুখের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গৌরী বউদি ছেলেকে ডেকে ওই ফয়সলা করে ফেলার মধ্যে এই বিনিময়ের হিসেবটুকুই যেন বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠল। মণিদা বা গৌরী বউদি এ পর্যন্ত পিসী বা বাবার সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেনি।
ছেলেটা সোজা তাকিয়ে কাকুর মুখখানা একবার দেখে নিল। জীবটি বিপজ্জনক কিনা বোঝার চেষ্টা। সে রকম মনে হল না। মায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, মাস্টার কাকু?
মাস্টার ঠিক করার কথা প্রায়ই শোনে, তাই এ প্রশ্ন।
—না, বাপী কাকু। জঙ্গলের কতরকম গল্প বলবে তোকে শুনিস’খন। কিছু মনে পড়তে গম্ভীর মুখে সামান্য হাসির আভা ছড়ালো। কি মনে পড়তে পারে বাপী সেটা সেই মুহূর্তে আঁচ করেছে।
ছেলের গলায় অভিমান ঝরল।—হ্যাঁ জঙ্গলের গল্প শুনবে, আজ পর্যন্ত আমাকে চিড়িয়াখানাই দেখালে না তোমরা
—এবারে কাকু দেখাবে’খন। এখনো এক ঘণ্টা পড়তে হবে, বই নিয়ে বোসগে যা।
দ্বিতীয়বার বলতে হল না, বাচ্চু চলে গেল। ভিখু বাড়ির আধবুড়ো চাকর। তার সামনে ডিশে কিছু খাবার আর এক পেয়ালা চা রাখল। দাদা বউদির সামনেও এক পেয়ালা করে চা রেখে প্রস্থান করল।
পেয়ালা তুলে নিয়ে গৌরী বউদি আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, জঙ্গলে জন্তুজানোয়ারদের আর কি নতুন ভালবাসাবাসি দেখেছিস?
ডিশের খাবার সবে একটু মুখে তুলেছিল। বাপীর বিষম খাবার দাখিল। মাথাটাও ঝিমঝিম করে উঠল। ভিতরের গোপন সুড়ঙ্গ থেকে এক দুপুরের দৃশ্যটা বেরিয়ে আসার জন্য ডানা ঝটপট করেছে। বানারজুলির জঙ্গলের সেই একটা দিন মণিদাও ভোলেনি হয়তো। বউয়ের রসিকতার কথা শুনে তার ভারী গালের খাঁজে খাঁজে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে।
পলকা ধমকের সুরে গৌরী বউদি আবার বলল, বল না! ইস লজ্জা দেখো ছেলের—
বাপীর মনে হয়, গৌরী বউদি ওকে সেই আট বছর আগের মতোই বোকা ভাবছে। এখনো সেই বোকাবোকা ভাবটাই ধরে রাখার চেষ্টা বাপীর। লোকের চোখে ধুলো দেবার মতো এর থেকে ভালো কৌশল জানা নেই। হাসতে চেষ্টা করে বোকার মতোই বলল, তখন কি কিছু বুঝতাম নাকি!
…বানারজুলিতে এই গৌরী বউদির মুখে অনেক রকমের খুশির ছটা দেখেছিল বাপী, মুখে খিলখিল হাসি দেখেছিল।…জঙ্গলে যাবার আগে পাট-ভাঙা শাড়ি পরার পর ওকে পিছনে পায়ের দিকটা টেনে দিতে বলেছিল, আর উদ্ভট ফরমাসটা না বুঝে বাপী উপুড় হয়ে বসে শাড়ির ওপর দিয়ে দু হাতে তার একটা পা চেপে ধরে কি করে টানবে ভেবে পাচ্ছিল না। গৌরী বউদি তখন ওকে হাঁদা বলেছিল আর হেসে সারা হয়েছিল।…তারপর জঙ্গলে ওর সেই সব কথা শুনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে হেসেছিল আর ঘন ঘন সেই হাসি মণিদার দিকে ঠিকরে পড়ছিল। এ পরিস্থিতি অতটা হাসির না হলেও বাপীর মনে হয়েছে গৌরী বউদি এখন আর সেরকম হাসে না বা হাসতে পারে না। ধার ধার মুখের এই হাসির মধ্যে যেন কিছু হিসেব লুকনো আছে। অপচয় নেই।
ঠোটের ফাঁকে এমনি একটু হাসি খেলে গেল। ভুরুর মাঝে হাল্কা ভাঁজ পড়ল একটু।—এখন সব বুঝে ফেলেছিস? তার পরেই আত্মস্থ। —যাক জঙ্গলের গল্প করতে গিয়ে ছেলের মাথায় আবার এসব ঢোকাতে যেও না।
বাপী তখুনি মাথা নাড়ল। অমন কাজ সে করবে না। এর ফলেও গৌরী বউদি কয়েক পলক চেয়ে রইল। এই বয়সের ছেলের সরলতা দেখে ভিতরে ভিতরে মজা পাচ্ছে হয়তো।
মণিদা প্রসঙ্গ ঘোরালো। ওর চাকরির খোঁজ নিল। শোনার পর বীতশ্রদ্ধ। — বি. এসসি. ডিস্টিংশনে পাশ করার পর এই চাকরি করতে ছুটে এলি, মাইনে কত?
গৌরী বউদির সামনে এ প্রশ্নটাই যেন কাম্য ছিল। অকপটে বলে দিল, সব মিলিয়ে মাসে আটাত্তর টাকা—
—দেখ কাণ্ড। হালছাড়া চোখে মণিদা একবার তার বউয়ের দিকে তাকালো। তারপর ওকেই বলল, এরকম কেরানীর চাকরি করবি তো আমাকে জানালি না কেন, আমার ওখানে চেষ্টা করে দেখতাম। কাকাও তো লিখতে পারত—
—বাবা চার বছর আগে মারা গেছেন, তোমাকে বললাম না টিউশনি করে নিজের পড়া চালিয়েছি।
গৌরী বউদি নির্লিপ্ত কিন্তু মণিদা অপ্রস্তুত একটু।—জানব কি করে বল, তুইও তো কিছু লিখিসনি। পিসীর মারা যাবার খবর অবশ্য কাকাই জানিয়েছিল।
বাপী তাড়াতাড়ি কাজের কথায় ফিরে এলো।—এ চাকরিও এক্কেবারে টেম্পোরারি, কবে আছে কবে নেই—তোমার ওখানে এখনো একটু চেষ্টা করে দেখো না মণিদা।
মণিদার গলায় এবারে অতটা উৎসাহ নেই। বলল, দেখি—
কিন্তু এটুকু আশার মুখেও গৌরী বউদি ছাই ঢেলে বসল—যাক, তোমাকে আর দেখতে হবে না, যা করছে করুক পরে দেখা যাবে’খন—তোমার ওখানে ঢুকে পরের ছেলে হাতকড়া পড়ুক শেষে
বাপী অবাক। সত্যি মাথায় কিছু ঢুকল না। মণিদা সামাল দিতে চেষ্টা করল, বললেই কি চাকরি হওয়া অত সহজ নাকি—
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাইরে চটির শব্দে ঘাড় ফেরালো।—এসো সন্তু এসো—
মণিদার ওখানে ঢুকলে হাত-কড়া কেন পরতে হবে তখনকার মতো বাপীর সেটা দুর্বোধ্যই থেকে গেল।
দামী চটির আওয়াজ তুলে পর্দা ঠেলে যে ঘরে ঢুকল সে বেশ লম্বা একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ। বয়েস বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে। গায়ের রং ফর্সা, মুখ সুন্দর নয়। পরনে দামী কাপড়ের সাদা পাজামা গায়ে মুগার পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির দুটো হাতই পাঁচ-ছ’ আঙুল করে গোটানো। এক হাতের আঙুলে ঝকঝকে সাদা পাথরের আংটি, অন্য হাতে নীল পাথরের। ডান হাতের পুষ্ট কব্জিতে মস্ত একটা সোনার ঘড়ি। পাঞ্জাবির বুক খোলা, তার একদিকে সোনার চেনে সোনার বোতাম আটকানো। সব কটা বোতামের মাঝখানে একটা করে পাথর ঝিকমিক করছে— ওগুলোর নামই হীরে কিনা বাপী জানে না।
ভদ্রলোক নতুন মুখখানা দেখে নিয়ে বলল, রোববারের আড্ডা জমে গেছে দেখছি—
সোফায় মণিদার পাশে বসল। মণিদা নেভা চুরুট অ্যাশপটে গুঁজতে গুঁজতে পরিচয় দিল, আমার খুড়তুতো ভাই বাপী এসেছে উত্তরবঙ্গের সেই বানারজুলির জঙ্গল থেকে এখানে চাকরি করতে—ওর সঙ্গে গল্প করছিলাম।
জলপাইগুড়ির পাঁচটা বছর মণিদার মাথায় নেই। ব্যাকব্রাশ চুলের দরুন ভদ্রলোকের কপালখানা বেশি চওড়া দেখায়। সে তুলনায় চোখদুটো সামান্য ছোট। হাসিমাখা চাউনি বাপীর মুখের ওপর। হালকা মন্তব্য করল, জঙ্গল থেকে এসেছে বলছ, ভায়ার মুখখানা দেখে মনে হয় বৃন্দাবন থেকে আসছে।
মণিদা জোরেই হেসে উঠল। কিন্তু বাপীর চোখ তখন গৌরী বউদির দিকে। মুখের ধার-ধার ভাব মিলিয়ে গেছে। রসিকতা উপভোগ করল, হাসির সঙ্গে আবার একটু ঠেসও ছুঁড়ে দিল।—তোমার কি আর অত ভুল হয়, জঙ্গল থেকে এলেও ওর ভেতরখানা বৃন্দাবন থেকে আসার মতোই।
সাদা কথায় আবার বোকাই বলা হল ওকে। কিন্তু শুধু ওর ভেতর বোঝানোর জন্যে গৌরী বউদি যেন কথাগুলো বলল না। মণিদার এতেও হাসি। তারপর বাপীর সঙ্গে পরিয় করিয়ে দিল, এ হল সনৎ চৌধুরী, মস্ত কন্ট্রাক্টর, পাশের বাড়িটা ওর
বাপীর খুব ইচ্ছে করছিল, উঠে এসে সনৎ চৌধুরীকেও একটা প্রণাম ঠুকে গৌরী বউদিকে বুঝিয়ে দেয়, সত্যি কত জলভাত ছেলে ও। পেরে উঠল না। কোনরকমে দু’হাত জুড়ে নমস্কার সারল।
পকেট থেকে শৌখিন সিগারেট কেস বার করে ভদ্রলোক নিজের ঠোটে একটা সিগারেট ঝুলিয়ে কেসটা মণিদার দিকে বাড়িয়ে দিল।
মণিদা বলল, সিগারেট তো খাই-ই না, তবে তোমার দামী সিগারেট দেখলে লোভ হয়, দাও—
সিগারেট ধরিয়ে সনৎ চৌধুরী হৃষ্টমুখে বাপীর দিকে তাকালো—ভায়ার এখানে থাকা হবে নাকি?
হাঁ বা না কিছুই না বলে বাপী হাসতে চেষ্টা করল একটু। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মণিদা বলল, হ্যাঁ, কলকাতায় আমি ছাড়া ওর আর কেউ কোথাও নেই—
এই প্রশ্ন আর জবাবের মধ্যে গৌরী বউদি মজার কি পেল বাপী জানে না। কিন্তু মজাটুকু শুধু চোখেই ঠিকরলো। মুখে বলল, আমাদের তো মোটে তিনখানা ঘর, সন্তুর ওখানেও পাঠিয়ে দিতে পারো—অতবড় বাড়িতে একলা থাকে— দুজনেরই উপকার হবে।
নাম ধরে ডাকাটা বাপীর কানে ধরা পড়েছে। সনৎ বা সন্তু চৌধুরীর হাসিমাখা ভ্রুকুটি গৌরী বউদির দিকে।—উপকার হবে কিরকম?
—ও একটু চালাক চতুর হবে আর তুমি সৎসঙ্গ পাবে।
বাপী ছাড়া সকলেই হাসছে। কিন্তু শুধু মণিদার হাসিটা বোকা-বোকা লাগছে বাপীর।
মণিদা বলল, যাই বাজারটা সেরে আসি—
সন্তু চৌধুরী তক্ষুনি বলল চলো আমিও যাই।
গৌরী বউদি সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকালো।—এই! একরাশ বাজার করে এনে আমাকে হেঁসেলে পাঠানোর মতলব?
সন্তু চৌধুরীর সাদামাটা জবাব, ছুটির দিনে আমার শুধু একটু ভালো খাওয়ার মতলব —সেটা তোমার ভিখুর দ্বারা সম্ভব হলে হেঁসেলে যাবে না।
এ কথার ফাঁকে বাচ্চু লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে সোজা সন্তু চৌধুরীর কোলে এসে জাঁকিয়ে বসল।—সন্তুকাকু, মা বলেছে আমি ওই বাপী কাকুর সঙ্গে এবারে চিড়িয়াখানা দেখতে যাব।
—খুব ভালো কথা। কবে?
জবাবের আশায় বাচ্চু তার মায়ের দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যেই কিছু একটু ভেবে নিল গৌরী বউদি। সন্তু চৌধুরীকেই জিজ্ঞাসা করল, দুপুরের দিকে তোমার গাড়িটা ফ্রি থাকবে?
—হুকুম হলেই থাকবে।
মণিদা জামা-কাপড় বদলাতে যাচ্ছিল। বাধা পড়ল।— দুপুরে তোমার কি কাজ? মণিদার বিব্রত মুখ।—খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রামের পর আমার তো একবার বেরুতেই হবে।…গাড়ি থাকলে আর কি, বাপীই নিয়ে যেতে পারবে’খন।
ঘর ছেড়ে চলে গেল। গৌরী বউদি ছেলেকে বলল, ঠিক আছে আজই যাবি।
বাচ্চু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু সেই মুহূর্তে স্নায়ুতে স্নায়ুতে একটা সাড়া পড়ে গেল বাপীর।…গৌরী বউদির ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসি, পলকের তেরছা চাউনি সন্তু চৌধুরীর মুখের ওপর। বাপীর মনে হল, গৌরী বউদি ছেলেকেই শুধু খুশী করল না। পলকের ওই কটাক্ষে সন্তু চৌধুরীর প্রতিও কিছু যেন অযাচিত করুণার আশ্বাস।
…ভদ্রলোকের ছোট ছোট চোখে হাসি চিকচিক করছে।
.
সুখ কাকে বলে?
চেয়ারে বসে টেবিলের ভালো ভালো সাজানো খাবার আয়েস করে গলা দিয়ে নামানো? ভালো ঘরে খাটের উপর গদির বিছানায় শুয়ে আরামে রাত কাটানো?
তা যদি হয় তো দেড়টা মাস বেশ সুখেই কেটে গেল বাপীর। বাইশ বছরের মধ্যে এমন সুখ আর আরামের নাগাল আর কখনো পায় নি। তবু ভোর হতে না হতে ঘুম ভাঙে। এটা বরাবরকার অভ্যাস। কিন্তু এই সুখ যখন ছিল না, ঘুম ভাঙার পরেও তখন ইচ্ছে করলে বিশ-তিরিশ মিনিট আমেজের মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারত। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে এখন এই গদির শয্যা পিটে খোঁচা মেরে তুলে দেয়।
খাট-পাতা মাঝের ঘরটা সম্ভবত অতিথি-অভ্যাগতর জন্য। কিন্তু দেড় মাসের মধ্যে বাপী একমাত্র পাশের বাড়ির সন্তু চৌধুরী ভিন্ন এই ফ্ল্যাটে অন্য কোনো নতুন মুখ দেখে নি। শুধু খাট নয়, দেয়াল ঘেঁষে চকচকে ড্রেসিং টেবিলও আছে একটা। জিনিসপত্র রাখার দেয়াল আলমারি আছে। ড্রেসিং টেবিলের পাশে আলনাও। গৌরী বউদি বাপীর জন্য এই ঘরটাই বরাদ্দ করেছে। খাটে নিজের ছেঁড়া খোঁড়া বিছানা-বালিশেরও ঠাঁই হয় নি। গৌরী বউদি বলেছে তোর ওই রাজ-শয্যা এখানে চলবে না—সরিয়ে রাখ।
নিজেই চাদর বালিশ আর একটা সুন্দর বেড-কভার বার করে দিয়েছে। বলেছে, সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে—আমি নোঙরা দেখতে পারি না।
গোড়ার তিন-চার দিনের মধ্যে নিশীথ ওর খবর নিতে এসেছিল। থাকার ব্যবস্থা দেখে ওরও চমক লেগেছিল।—লোয়ার ডিভিশন হলে কি হবে, রাজার হালে আছিস দেখছি।…তোর মণিদা তাহলে বড় চাকরিই করেন।
এত আরাম সত্ত্বেও ভোর না হতে বাপীর ঘুম ভাঙে। বাথরুম, মুখ-হাত ধোয়া সেরে বসার ঘরের দরজা খুলে পা-টিপে তিনতলার ছাদে উঠে যায়। আধ ঘণ্টার ওপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো মজবুত আর তরতাজা রাখার মহড়া চলে। নিঃশব্দে খানিক হাত ছোঁড়া ছুঁড়ি ঝাঁপাঝাঁপির পর লম্বা ছিপছিপে শরীরটাকে নানাভাবে দুমড়ে বাঁকিয়ে চুরিয়ে হাড়গোড়সুদ্ধু যথেচ্ছ বশে আনার চেষ্টায় দরদর করে ঘাম ছুটতে থাকলে এ-পর্বের শেষ। বানারজুলির দৌড়ঝাঁপ আর জঙ্গল টহল দিয়ে বেড়ানো বন্ধ হবার পর থেকে বাপীর এই অভ্যেস। কোন দিন বাদ পড়লে বিচ্ছিরি লাগে, গা ম্যাজম্যাজ করে। ঘরের বদলে এখানে খোলা ছাদ পেয়ে আরো সুবিধে হয়েছে। দেড় মাস ললিত ভড়ের বাড়িতে একসঙ্গে কাটানোর সময় সেই পেটুক-ভড় ওর এই কসরত করা দেখে খুশি হয়ে দু-তিনটে যোগব্যায়ামও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জানতাম তো অনেক কিছু, এসব করলে রাক্ষুসে খিদে হয়—তাই ছেড়ে দিয়েছি।
ঘাম মারতে সময় লাগে। ততক্ষণে পুবের কোণে লাল সূর্যটা খুব একটু একটু করে আকাশের ডাঙায় উঠে বসে। বাপীর ভিতরে তখন শুচি ভাব-টাব কিছু জাগে না। দেখতে শুধু ভালো লাগে। রোজ দেখে রোজই নতুন মনে হয়।
নিচে নেমে প্রথম কাজ শেভিংয়ের পর নিঃশব্দে স্নান সেরে আসা। আগে তিন দিনে এক দিন শেভ করত। —কিন্তু গৌরী বউদির তাও চোখে লেগেছিল। একবার চারদিন পরের শেভ করা মুখের দিকে চেয়ে চা খেতে খেতে বলেছিল, কালো মুখখানা তো ভালই দেখায়, খোঁচা খোঁচা দাড়ি রেখে ভূতের মতো থাকিস কেন—রোজ কামাতে পারিস না?
গৌরী বউদি মিষ্টি কথার ধার ধারে না। এই বলাটুকুর মধ্যেও বকুনির সুর। শুধু শেভ করা নিয়ে নয়, বাড়িতে আধ-ময়লা ধুতি পরে থাকাটাও তার চক্ষুশূল। সেই গোড়ার তিন-চার দিনের মধ্যে বলেছিল, বাড়িতে পরিষ্কার পাজামা পরবি, টাকা না থাকে তো আমার থেকে ধার নিয়ে কয়েকটা করিয়ে নে—মাস কাবারে দিয়ে দিবি।
পুঁজির টাকায় হাত পড়ে নি। সেই দিনই আপিস ফেরত একসঙ্গে তিনটে পাজামা আর তিনটে সাদা পাঞ্জাবির অর্ডার দিয়ে এসেছিল। আপিসের জন্য পাঞ্জাবি বানানোর কথা আগেই ভেবে রেখেছিল।
….গৌরী বউদির ধারালো মুখে হাসি-ছোঁয়া রসিকতাও ঝরে। প্রথম যেদিন শেভিংয়ের পর স্নান সেরে মাথা আঁচড়ে সেই পাজামা পাঞ্জাবি পরে চায়ের টেবিলে এসে বসেছিল, গৌরী বউদি বড় বড় চোখ করে ওর দিকে চেয়ে ছিল। ঠোঁটে হাসির ফাটলও দেখা গেছল একটু। তারপর বাচ্চু আর মণিদার সামনেই বলেছিল, বাঃ, তোকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে যে রে!
মণিদা ভারী মুখ টিপে হাসছিল। মায়ের কথা শুনে আরো বেশি হেসেছিল সাত বছরের ছেলেটা। আর যতটা সম্ভব বোকার মতো লজ্জা পেতে চেষ্টা করছিল বাপী। কিন্তু ভিতরের গোপন সুড়ঙ্গ থেকে কারা যেন কিলবিল করে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।
স্নান সারা হবার পর বাপীর একটা বড় কাজ কাতুকুতু দিয়ে আর খুনসুটি করে বাচ্চুর ঘুম ভাঙানো। এখানে আসার চার-পাঁচ দিনের মধ্যে মায়ের কাছে বায়না তুলে বাচ্চু তার শয্যা বদল করেছে। এতদিনে ছেলেটা বাড়িতে প্রায় নিঃসঙ্গ ছিল। কার সঙ্গে কথা বলবে, `কার সঙ্গে খেলা করবে? সন্তু কাকা অবশ্য খুব ভালো, ওকে কত রকমের খেলনা কিনে দেয়, ছবির বই কিনে দেয়, ওর জন্য বড় বড় লজেন্স চকোলেটের বাক্স নিয়ে আসে। কিন্তু এক রবিবার সকালে ছাড়া তাকে আর পাচ্ছে কতটুকু। সন্ধ্যার পরে যখন আসে তখন কেবল মায়ের সঙ্গেই আড্ডা দেয়। বাচ্চুকে তখন পড়ার বই নিয়ে বসতে হয়। বাবা বেশির ভাগ দিন সকাল দশটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না। যেদিন আগে এসে পড়ে সেদিন বাচ্চুর খুব মজা। বাবা ওর সঙ্গে গল্প করে, খেলা করে, নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। মায়ের সঙ্গেই সব থেকে কম ভাব। মা মারে-টারে না, কিন্তু একটু কিছু হলেই এমন করে তাকায় যে তাতেই ওর কান্না পায়। মা কখনো ওর সঙ্গে খেলেটেলে কিনা বা ওকে আদর করে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটা পরিষ্কার জবাব দিয়েছিল, মা খেলতেও জানে না, আদর-টাদরও জানে না।
দুদিনের মধ্যেই বাপীকাকুকে খুব ভালো লেগে গেছে বাচ্চুর। ওর ভিতরেও তো কত কথা জমা হয়, কিন্তু সে-সব শোনার বাড়িতে আর দ্বিতীয় লোক নেই। বাপীকাকু শোনে, হাসে, ওর বুদ্ধির তারিফ করে। বিকালে আপিস থেকে ফিরে ওকে নিয়ে বেড়াতে যায়, নয়তো দুজনে ছাদে গিয়ে হুটোপুটি করে। কিন্তু খেলাধুলো বা ছুটোছুটিতে এতবড় মানুষটা কেন যে সব সময় ওর সঙ্গে হেরে যায় বাচ্চু ঠিক বুঝতে পারে না। আর কত রকমের মজার গল্প করে করে পড়ায়। পড়তে একটুও খারাপ লাগে না।
রাতে বাপীকাকুর সঙ্গে শোয়ার হুকুম মিলেছে এই পড়াশুনার ছুতো ধরে। বাবা-মা ঘুম থেকে ওঠে সাড়ে সাতটায়, বাচ্চু তারও পরে। মুখ হাত ধোয়া আর সকালের খাওয়া সেরে পড়তে বসতেই সাড়ে আটটা। ওদিকে ন’টা বাজতে না বাজতে বাপীকাকুর আপিসের তাড়া। সকালে পড়বে কখন। অথচ বাপীকাকু ওকে বলেছে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারলে বাবা-মা ওঠার আগে ওর পড়াই শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সকালে ও ওঠে কি করে?
পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ছেলের পড়াশুনার উৎসাহ তার মা ঠিকই লক্ষ্য করেছে। আর ফাঁকে ফাঁকে সকাল সন্ধ্যায় বাপীর পড়ানোর ব্যাপারটাও ঠিকই দেখেছে। যত হাঁদাই ভাবুক, গরিবের ছেলের এদিকে যে কিছু পটুতা আছে, সেটা তার মনে হয়েছে। এই জন্যেই শেষে ছেলের বাপীকাকুর সঙ্গে শোয়ার অনুমতি মিলেছে।
বাপী ঠিক ছ’টায় ওকে ঠেলে তোলে। মুখ হাত ধুইয়ে পড়াতে বসতে সাড়ে ছটা। আটটার মধ্যে পড়া শেষ। অত ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতে সহজে চায় না। কিন্তু ওঠার পরে ওইটুকু সকালের মধ্যে স্কুলের সব পড়া সেরে ফেলার মজাটাও জানা ছিল না। আর প্রথম দিনেই ওর পড়া নিয়ে বাপীকাকুর সাহস দেখে তো বাচ্চু অবাক। চায়ের পাট শেষ হতে মা বলেছিল, যা আবার বই নিয়ে বোসগে—
মায়ের হুকুম হলে বাচ্চু প্রতিবাদ জানে না। প্রতিবাদ জানে না। বাচ্চু কেন, কেউ জানে না। কিন্তু বাপীকাকু টক করে বলে দিল, সকালে দেড় ঘণ্টা টানা পড়া হয়ে গেছে, আবার বই নিয়ে বসবে কি? ওকে বলেছে, না রে, এখন আর পড়তে হবে না, তোর খেলার জিনিস কি আছে বার কর, আমি দেখব। তারপর আবার হেসে মাকে বলেছে, আমার হাতে ছেড়েছ, কটা দিন সবুর করে দেখো—
বাচ্চু ভেবেছিল, মা রেগেই গেল। বাপীকাকুর দিকে ভুরু কুঁচকে একটু তাকিয়েও ছিল। তারপর বাবার দিকে ফিরে কি রকম মজার সুরে বলেছিল, আবার দেমাকও একটু আছে দেখি!
বাপীর আপিস সেই খিদিরপুরে। নটার মধ্যে সে একলাই ভাত খেতে বসে যায়। মণিদা সাড়ে নটায় খেতে বসে। তার আগে বাপী খাওয়া শেষ করে বেরিয়েই পড়ে। সকালের খাওয়ার সময় কেউ তদারক করতে আসে না। তবু ভিখুর কল্যাণে সকালের সেই তাড়ার মধ্যেও খাওয়াটা ভালোই জোটে। দশটা—পাঁচটা আপিস। লোয়ার ডিভিশন হলেও সেখানকার আপার ডিভিশনরাও ইদানীং ওর প্রতি তলায় তলায় ঈর্ষান্বিত একটু। তার কারণ বড়বাবু মন্মথ সোমের অহেতুক স্নেহ। সেই স্নেহ যে এখন বাড়তির দিকে সেটা বাপীই সব থেকে ভালো অনুভব করতে পারে।
বড়বাবুকে হাসতে বড় দেখে না কেউ। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলার সময় মন্মথ সোম একটু-আধটু হাসেনও। প্রায়ই ওকে নিজের খুপরিতে ডেকে নিয়ে সামনে বসিয়ে কাজ করান। সকলের চোখে, বাপীর চোখে তো বটেই, এ-ও এক ভাগ্যের লক্ষণ। কাজের ফাঁকে অন্য কথাও দু-চারটে বলেন। বাপী এখন কোথায় আছে তাও জেনে নিয়েছেন। অত দূর থেকে ট্রাম-বাসের ভিড় ঠেলে ঠিক দশটায় হাজিরা দেওয়া ধকলের ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপীর কখনো লেট হয় না— এজন্যেও ভদ্রলোক খুশি। নিজের মুখেই সে-কথা বলেছেন। চাকরি-বাকরির মন্দা বাজার আর অনিশ্চয়তার কথাও মাঝে মাঝে বলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ দেন, লেগে থাকো, আমি তো আছি—দেখা যাক।
দুটোর সময় নিজের একটা খুপরি ঘরে টিফিন করতে যান তিনি। ইদানীং মাঝে মাঝে বেয়ারা মারফৎ সেখানেও ডাক পড়ছে বাপীর। নিজের টিফিন বাক্স থেকে টিফিন বার করে ওকে খেতে দেন। বাপী তখন খুব লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু ভদ্রলোক বলেন, আমি তো তোমার বাবার মতো, লজ্জা কি, খাও।
কেরানী মহলে মন্মথ সোমের সুনাম খুব নেই। কিন্তু বাপী মনে মনে তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারে না। নিশীথের বাবা তাঁর রোগ সারিয়েছেন, সেই কৃতজ্ঞতায় অজানা অচেনা একটা ছেলের প্রতি এত স্নেহ যাঁর, বাপী তাঁকে খারাপ ভাববে কেমন করে। নিশীথের রাম-কাকাও মাঝে মাঝে ওকে বলেন, বড়বাবু তোমার ওপর খুব খুশি—তোমার ভাবনা নেই।
অতঃপর, মাইনে যা-ই হোক, আপিসেও বাপীর সুখের দিনই চলেছে। বিকেলে বাড়ি ফেরার দশ মিনিটের মধ্যে খাবার টেবিলে ভিখু জলখাবার সাজিয়ে দেয়। পরিপাটী ব্যবস্থা। ভিখুর ওঠা-বসা চলা-ফেরা সবই বাড়ির কর্ত্রীর নির্দেশে। এখানে কর্তা কেউ নেই, একজন শুধু কর্ত্রী। ভালো খাওয়া-দাওয়া বা আরামে থাকার ব্যাপারে গৌরী বউদির এতটুকু কার্পণ্য নেই সেটা স্বীকার করতেই হবে। রাতের খাওয়া সকালের থেকেও ভালো। খাবার টেবিলে সে-সময় বাপীর দোসর শুধু বাচ্চু। মণিদা তো থাকেই না, গৌরী বউদিও সে সময় কমই বাড়ি থাকে। থাকলেও রেডিওর গান বা নাটক শোনে। নয়তো গল্পের বই পড়ে। সন্তু চৌধুরী এলে তার সঙ্গে গল্প করে।
রাতের খাওয়ার পর বাচ্চুর সঙ্গে গল্প করতে করতে আরামের শয্যায় শুয়ে ঘুম।
যা-ই হোক, সুখের এই যদি হিসেব হয়, বাপী সুখে নেই এ সে নিজেও জোর করে বলতে পারবে না। কিন্তু থেকে থেকেই বাপীর কেমন মনে হয়, এরকম সুখের সঙ্গে কোনো শিকড়ের যোগ নেই। একটা আলল্গা সুখের হাওয়ায় ও ভাসছে। হঠাৎ কোনো কারণে হাওয়াটা বন্ধ হতে পারে। হলে ধুপ করে মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে।
ফলে এই দুটো মাস চোখকান সর্বদাই সজাগ তার। সুবিধে এই, মুখ দেখে সেটা কেউ বুঝতে পারে না। এই দেড়টা মাসে বাপী অনেক জেনেছে, অনেক বুঝেছে।
মণিদা তেমন বড় চাকরি কিছু করে না। কাস্টমস-এর ইন্সপেক্টর। আগে ছিল প্রিভেনটিভ অফিসার, তার থেকে ইন্সপেক্টর হয়েছে। মণিদা কথায় কথায় নিজেই গল্প করেছে, এর মধ্যেই বার দুই একটু প্রমোশনের কথা উঠেছিল তার। কিন্তু আর প্রমোশন-টমোশন চায় না। এই বেশ আছে।
কেন বেশ আছে বাপী ভালই আঁচ করতে পারে। সেই আটচল্লিশ সালে ইন্সপেক্টরের মাইনে সর্বসাকুল্যে সাড়ে চারশ-পাঁচশর মধ্যে। বাপীর ধারণা, ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে এই হালে মাস চালাতে কম করে বারোশ টাকা লাগে মণিদার। সেটা কি করে আসে আর কোত্থেকে আসে বোঝা কিছু শক্ত নয়। বাবার সেই ঠাট্টা ভোলে নি। বলেছিল, ওখানে তো মাইনের থেকে উপরি বেশি শুনেছি। প্রমোশন নিলে এই উপরিতে ঘাটতি পড়ে নিশ্চয়। মণিদা কেন সকাল দশটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে ঘরে ফেরে না তাও আঁচ করা সহজ। কাস্টমস-এর ব্যাপারে হানাদারির কাজ লেগেই আছে। এটা যত বেশি হয়, পকেটে কাঁচা টাকার আমদানিও ততো বাড়ে। শুধু টাকা কেন, ভালো ভালো জিনিসও কম আনতে দেখছে না বাপী।
ফাঁকতালে মণিদাকে নিজের ওখানে চাকরির তাগিদ দিতে গিয়ে বাপী আরো কিছু বুঝে নিয়েছে। মণিদা খোলাখুলি বলেছে, কেরানীর চাকরির ভবিষ্যৎ ওখানেও কিছুই নেই। আর প্রিভেনটিভ অফিসারের চাকরি সেরকম ধরা-করার জোর না থাকলে হয়ই না। তার ওপর ঘুষ লাগে এন্তার। এই প্রসঙ্গেও নিজের সম্পর্কে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছিল। প্রিভেনটিভ অফিসার থেকে প্রমোশন পেতে আমারই কালঘাম ছুটে গেছল, বুঝলি? বছরের পর বছর ওই এক জায়গায় ঘষ্টে মরছিলাম। শেষে সন্তুর এক খাতিরের মুরুব্বির জোরে হয়েছে— তাও কি এমনি, করকরে পাঁচটি হাজার টাকা তার পকেটে গুঁজে দিতে হয়েছে।
দুয়ে দুয়ে চারের হিসাবটা বাপী বড় সহজে করে ফেলতে পারে। ওর ধারণা মুরুব্বির পকেটে গোঁজা ওই পাঁচ হাজার টাকাও সন্তু চৌধুরীর পকেট থেকেই খসেছে। কিন্তু মণিদার উন্নতির জন্য তার এত উদার হবার কারণ কি?
সন্তু চৌধুরীর গল্প শুনতেও বাকী নেই। মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। শিবপুরে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিল। মামার কনট্রাক্টরি ব্যবসায় ঢুকে পড়েছিল। সেই মামাটির আবার অনেক রকম বদ দোষ আর নেশাটেশা ছিল। হুট করে মরেই গেল একদিন। ব্যবসার হাল সেই থেকে সন্তু চৌধুরীর হাতে। রোজগারপাতি আগেও ভালই হচ্ছিল। একেবারে লাল হয়ে গেল এক যুদ্ধের বাজারে। ধুলো-মুঠি ধরলে সোনা।
বাপী বোকা-মুখ করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ভদ্রলোকের এত টাকাকড়ি, তবু এত বয়েস পর্যন্ত বিয়ে করলেন না যে?
কত আর বয়েস, বত্রিশ-তেত্রিশের বেশি নয়। করবে হয়তো একদিন। হেসে হেসে মণিদা বলেছিল, মেয়ে জাতটার ওপরেই ওর বিতৃষ্ণা—এখন যারা এগিয়ে আসে তারা কেবল নাকি ওর বাড়ি গাড়ি আর টাকা দেখে এগিয়ে আসে—ওকে দেখে নয়। মামার সঙ্গে যখন ছিল, তখন এক মেয়েকে ওর মনে ধরেছিল, আর স্মার্ট ছেলে দেখে সেই মেয়েও বেশ ঝুঁকেছিল। কিন্তু মামার ফার্ম শুনে বাড়ির লোক ছেড়ে সেই মেয়েও বেঁকে গেল। সেই মামার ফার্মে তখন যে ও চার আনা মালিক হয়ে বসেছে রাগের চোটে সেটা আর বললই না। আর একবার এক জায়গায় বিয়ে প্রায় ঠিক, কিন্তু সেই বাড়ির লোকেরা চুপি চুপি ওর ব্যাংক—ব্যালেন্সের খবর নিচ্ছে দেখে রেগে-মেগে বিয়ে ভণ্ডুল করে দিল
আসলে ও একটু স্নেহের কাঙাল, বুঝলি। তোর বউদির কাছে ওটুকু পায় বলেই কেনা হয়ে আছে।
মণিদার এভাবে বলার আগ্রহটা ওর শোনার আগ্রহ থেকে কম নয়। বউদির স্নেহ আর অন্যজনের কেনা হয়ে থাকার নমুনা বাপী এই দেড় মাস ধরেই দেখছে। অবাকও লাগে। এর মধ্যে রাখা-ঢাকার কোনো ব্যাপার নেই। রোববারের সকালে ভদ্রলোকের বেশি বাজার করা এবং এখানে খাওয়া প্রায় বরাদ্দ। তাছাড়া সপ্তাহের মধ্যে সাত দিনই গৌরী-বউদি সন্ধ্যার পর হয় নিজের শোবার ঘরে বসেই তার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, নয় তার গাড়িতে হাওয়া খেতে বেরুচ্ছে, নয়তো ছটা-নটার শোতে সিনেমা বা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে। মণিদা সাধারণত রাত দশটার আগে ফেরে না, কিন্তু গৌরী বউদি মাঝেসাঝে বাইরে থেকে রাতের খাওয়া সেরে আরো পরে ফেরে। এ নিয়ে মণিদার মুখে কখনো কোনো অভিযোগের লেশমাত্র দেখে নি বাপী। এমন কি ফেরার পর কোথায় গেছল, সে-খবরও নেয় না। গৌরী বউদি নিজের থেকে বলল তো শুনল।
বানারজুলির সেই হাসি-খুশি গৌরী বউদির এত উন্নতি দেখে বাপীর তাক লেগে যায়। দুনিয়ায় কাউকে যেন কেয়ার করার কিছু নেই তার। … স্নেহ পাওয়া আর কেনা হয়ে থাকার নমুনা দেখে এখানকার প্রথম সকালেই বাপীর স্নায়ুগুলো এক-প্রস্থ নাড়াচাড়া খেয়েছিল। …মণিদা কাজে যাবে, সন্তু চৌধুরীর গাড়িতে বাপীর সঙ্গে ছেলেকে চিড়িয়াখানা দেখতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল গৌরী বউদি। তার পলকের কটাক্ষে সন্তু চৌধুরীও যেন কিছু অযাচিত করুণার আশ্বাস পেয়েছিল। …ও-রকম দেখাটা বা ভাবাটা নিজের একটা বিতিকিচ্ছিরি রোগ ভাবতে চেষ্টা করেছিল বাপী।
কিন্তু না। নিজের দুটো চোখ ওকে বড় ঠকায় না।
বাপীর এখন হাসি পায়। মণিদার কথা ভেবে অবাক হয় আবার একটু দুঃখও হয়। মণিদা সত্যি কি কিছু বোঝে না? আর রাগ হয় এই ছোট্ট ছেলেটার দিকে তাকালে। কাকুকে পেয়ে বাচ্চু বর্তে গেছে।
তবে গৌরী বউদিও বাপীর ওপর সদয় এখন। কারণ ছেলে। দেড় মাসের মধ্যে শেষের পর পর চারটে উইকলি রিপোর্টে বাচ্চু ক্লাসে ফার্স্ট। মাথা খাটিয়ে পড়াটা আনন্দের জিনিস করে তুলতে পারলে আর নিয়ম করে দু’বেলা নিয়ে বসলে ওটুকু ছেলের ফার্স্ট না হওয়াটাই আশ্চর্য।
বৈঠকখানায় বসে রবিবারের সেই সকালে বাচ্চুকে পালোয়ানের গল্প শোনাচ্ছিল বাপী। সামনে সেই পালোয়ানের ছবির বই খোলা। গৌরী বউদি এসে দাঁড়াল আর বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞাসা করল, আপিসের চাকরি কেমন চলছে?
তাৎপর্য না বুঝে বাপী বলল, খাঁড়া তো ঝুলছেই, যে-কোনদিন গলায় নেমে এলেই হল।
গৌরী বউদি বলল, তোকে ভাবতে হবে না, সন্তুকে বলে রেখেছি, ও নিয়ে নেবে। আজ এলে কথা বলে নিস—
ছেলের ফার্স্ট হওয়ার পুরস্কার সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। বাপীর ফাঁপরে পড়া মুখ। আমতা আমতা করে জবাব দিল, এ-রকম চাকরিতে একজনের মর্জির ওপর ভালো-মন্দ, তার থেকে ওই কাস্টমসেই কিছু হয় কিনা দেখ না বউদি।…সেই গোড়ার দিনে তুমি মণিদাকে বলেছিলে হাত-কড়া পরতে হবে….লোভটোভের মধ্যে গিয়ে না পড়লে তা কেন হবে।
ভুরু কুঁচকে তাকালো গৌরী বউদি। অখুশি, আবার একটু অবাকও। এ ছেলে এমন কথা বলতে পারে ভাবে নি। বলল, মাথা তো বেশ খেলে দেখছি। কাস্টমস-এর চাকরি কি আমার হাতের মুঠোয় যে চাইলি আর দিয়ে দিলাম।
বাইরে চটির শব্দ। বাপী আর কিছু বলার ফুরসৎ পেল না। সন্তু চৌধুরী ঘরে ঢুকল আর হেসে প্রথমে ছেলেটাকে তোয়াজের সুরে জিজ্ঞাসা করল, বাচ্চু-বাবুর কি করা হচ্ছে?
গল্প আর খেলার মাঝে মায়ের এসে দাঁড়ানোটা বাচ্চুর তেমন পছন্দ হয় নি। সোৎসাহে নিজের জগতে ফেরার ইচ্ছে। বলল, বাপীকাকুর কাছে পালোয়ানের গল্প শুনছিলাম—আমিও পালোয়ান হয়ে গেছি, বাপীকাকুকে একবার পাঞ্জায় হারিয়ে দিয়েছি। আর একবার হারাবো দেখবে?
গল্পের ফাঁকে এই কসরত একবার হয়ে গেছল। সোফায় বসে হাসিমুখে সন্তু চৌধুরী তাল দিল, বেশ, কেমন পালোয়ান দেখা যাক।
—বাপীকাকু চলে এসো।
সামনে ছোট টেবিলে কনুই রেখে আর এক প্রস্থ পাঞ্জা লড়ার মহড়া হল। বাপীকাকুর হাত নড়ছে না দেখে আগের বারের মতো বাচ্চু তার ছোট শরীরটা ওই হাতের ওপর চাপিয়ে দিতে বাপী হাল ছেড়ে হার মানল।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সন্তু চৌধুরী হাসি মুখেই মন্তব্য করল, ওকে অতটা ঠকানো উচিত নয় ব্রাদার, তোমার ড্র করা উচিত ছিল।
ছোট্ট ছেলেটা কি বুঝল সে-ই জানে। চ্যালেঞ্জের সুরে বলে উঠল, তুমি বাপীকাকুর সঙ্গে জিততে পারবে? লড়ে দেখো দেখি?
সন্তু চৌধুরীর খুশীর মেজাজ। তাকেও ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল। সিগারেট অ্যাশপটে গুঁজে সিল্কের পাঞ্জাবির হাত গোটাতে গোটাতে এগিয়ে এলো। পরিপুষ্ট বাহু। হালকা ব্যঙ্গের সুরে বলল, ওকে জোয়ান বানাচ্ছ, তোমার নিজের কেরামতিটা দেখা যাক।
এই ছেলেমানুষি দেখেই হয়তো গৌরী বউদির ঠোটের ফাঁকে হাসির আভাস একটু। বাচ্চু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। আর বাপী যেন একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেল। বলল, লেগে-টেগে যাবে না তো…?
শুনে জোরেই হেসে উঠল সন্তু চৌধুরী। বলল, তোমার পক্ষে ওই বাচ্চুই নিরাপদ তাহলে—
আমতা আমতা করে বাপী বলল, না, আমি আপনার কথা বলছিলাম…. সন্তু চৌধুরী থমকালো এবার। ছোট চোখ গোল হল। নিরীহ গোছের এই শেষের কথা শুনে গৌরী বউদিও কম অবাক নয়।
—আমার লেগে যাবে। এসো এসো, দেখাই যাক একবার
টেবিলের সামনের সোফায় জাঁকিয়ে বসল। এমন কথার পর সমুচিত শিক্ষা না দিলেই নয়।
মাথায় সমান সমানই লম্বা হবে দুজনে। কিন্তু গায়ে-গতরে সন্তু চৌধুরী হৃষ্টপুষ্ট অনেক বেশি। লোকটার গায়ে জোর কেমন বাপীর ধারণা নেই। তবু মনে হয়েছে, এই লোককে জব্দ না করতে পারলে সত্যের জোর বলে কিছু নেই। মনে হয়েছে, শরীরের জোরটাই সব নয়। তাই অমন কথা অতি সহজে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
টেবিলে কনুই রাখল। হাতে হাত মেলালো। ও-ঘর থেকে মণিদাও এসে হাজির তখন। মজা দেখছে। বাচ্চুর উত্তেজনা চরমে। আর গৌরী বউদি যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে চাপ দিয়ে বাপীর হাত নোয়াতে চেষ্টা করছে সন্তু চৌধুরী। কিন্তু হাতটা যেন মাটিতে পোঁতা লোহা একখানা। ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে সন্তু চৌধুরীর। নভেম্বরের গোড়ায় হালকা ঠাণ্ডা সত্ত্বেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম করছে। বাপীর মুখে ছেলেমানুষি কৌতুক। এক-একবার ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। ও যেন তাকে সুযোগ দিচ্ছে সময় দিচ্ছে।
হাত সোজা রেখেই সোজা হয়ে বসল একটু। তারপর জোর বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে মুখের হাসিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা বাপীর। ও জিতবে সেটা অবধারিত এখন। সেই চাপ ঠেকানোর চেষ্টায় সন্তু চৌধুরী দরদর করে ঘামছে। তবু ঠেকানো গেল না। কাত হয়ে হাতের পিছনটা টেবিলে শুয়েই পড়ল শেষে।
আনন্দে হাততালি দিয়ে তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে লাগল বাচ্চু। পকেট থেকে রুমাল বার করে সন্তু চৌধুরী ঘাম মুছছে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছেও। মণিদা অবাক বেশ। গৌরী বউদি বাপীকেই দেখছে। তার চোখে নতুন বিস্ময়।
পকেটে রুমাল রেখে সন্তু চৌধুরী হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা খুব অকৃত্রিম নয়। বাপীর অন্তত মনে হলো তার পুরুষকার ঘা খেয়েছে। সন্তু চৌধুরী হেসেই বলল, কংগ্রাচ্যুলেশনস।…তোমার চেহারাখানা বেশ ডিসেপটিভ ভায়া, না বুঝে ঠকেছি।
বাপী লজ্জা-লজ্জা করে সোফা ছেড়ে উঠল। বাচ্চুকে নিয়ে ও-ঘরে যাবে। আর তখনি কেন যেন একটু উদার হতে চাইল সন্তু চৌধুরী। বলল, তোমার বউদি আমার ফার্মে নিয়ে নেবার কথা বলছিলেন তোমাকে…একদিন বাড়ি এসো, আলোচনা করা যাবে।
বাপী নিরুত্তর। একটু বিব্রতও। জবাব গৌরী বউদিই দিল। তির্যক সুরে বলল, কোনো একজনের মর্জির চাকরি করার ইচ্ছে নেই ওর, কাস্টমস-এ ঢুকতে চায়— সন্তু চৌধুরী আবারও যেন তেতো গিলল একটু।—তুমি বলেছিলে বলেই বলা, ইন দ্যাট্ কেস আই কান্ট হেল্প।
বাচ্চুর হাত ধরে বাপী তেমনি বিব্রত মুখ করেই বেরিয়ে গেল। পরে সমস্ত দিনের মধ্যে গৌরী বউদি যে অনেকবার লক্ষ্য করেছে ওকে, সোজা না তাকিয়ে বাপী সেটা অনুভব করেছে।…সন্তু চৌধুরী বলেছিল, অ্যাপিয়ারেন্স ডিসেপটিভ। অর্থাৎ বাইরে যেমন দেখায় ভিতরে তেমন নয়। চাকরির কথায় আর পাঞ্জা লড়ার ব্যাপার দেখে গৌরী বউদিরও সেই সংশয়।
দিন পনের বাদে বাপীরই ভুলে সেই সংশয়ের ওপর আবার নতুন আঁচড় পড়ল একটা। রোববার না হলেও কি একটা ছুটির দিন সেটা। মণিদাও বাড়িতে। ফুরসৎ মিললে তার কাগজ পড়ার বাতিক, বসার ঘরে কাগজ পড়ছিল। এ ঘরে বাপী আর বাচ্চু। ছেলেটার এক্ষুনি বেড়াতে যাবার বায়না। সদ্য কেনা একটা সানগ্লাস পরে গৌরী বউদি ঘরে ঢুকল। হালফ্যাশানের মোটা লালচে ফ্রেমের চশমা। মস্ত মস্ত দুটো কালচে লাল কাঁচ। চোখ দুটির ওপর নিচের অনেকটা ঢাকা পড়েছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিল একটু। তারপর বাপীর দিকে।
—কেমন হল?
বাপীর মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে এলো, বেশ মিস্টিরিয়াস লাগছে। পরক্ষণে আবার সামাল দিল, বেশ ভালো লাগছে…
গৌরী বউদি নতুন চশমা হাতে নেমে এলো। ভুরু দুটো প্রায় স্বভাবে কুঁচকোয় এখন।—মিস্টিরিয়াস লাগছে মানে বেশ ভালো লাগছে?
বাপী আর তার দিকে তাকালও না, কথাও বোধ হয় কানে গেল না। বাচ্চুকে তাড়া দিল, যাবি তো চল—
গৌরী বউদি বসার ঘরে চলে গেল। সেখানে সামনে মণিদা। গৌরী বউদির ধার-ধার কথা কানে এলো, তোমার ওই ভাইকে যত হাঁদা ভাবি আমরা ততো নয়—বুঝলে? সন্তুও সেদিন ওই কথাই বলছিল।
—কি হল আবার…। মণিদার গলা।
গৌরী বউদির কথা আর শোনা গেল না। সিঁড়ি দিয়ে ততক্ষণে সে হয়তো নিচে নামছে। কারণ, নিচে থেকে তাগিদ দেবার মতো করেই গাড়ির হর্ন বেজে উঠেছে।
সরলতার মুখোশ খুলে গেলে সুবিধে হবে না বাপী জানত। কিন্তু পরের মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওটা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে গেল। বাপী তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোমেন ছোট কেরানী বিপুল তরফদারের প্রতি অমন অঢেল স্নেহের কারণটা আকাশ থেকে হঠাৎ একটা গোলার মতো নেমে সোজা ব্রহ্মতালুতে আঘাত করেছে। শনিবার হাফ-ডে। আপিসের কিছু কাজের অছিলায় সেদিন মন্মথ সোম তাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন। থাকেন হাওড়ায়।
ফাইল মেলানো দশ মিনিটে হয়ে গেল। তারপর ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা প্রচুর আপ্যায়ন করলেন। ঘরের তৈরি অনেক কিছু খাওয়ালেন। কিন্তু সেই ভালো ভালো খাবার বাপীর গলা দিয়ে নামে না। কারণ, সেই আপ্যায়নে যোগ দিয়েছে বছর একুশ-বাইশের একটি মেয়ে। সোম কর্তা-গিন্নীর একমাত্র মেয়ে। নাম ঊষা। ফর্সা আর মোটাসোটা, কিন্তু মুখে কোন রকম শ্রীর লেশমাত্র নেই। সেই মুহূর্তে বাপী ব্যাপার বুঝে নিয়েছে। আর সেই প্রথমে ওর বাইশ বছর বয়েস শুনে মন্মথ সোম কেন খুশি হন নি তাও বুঝেছে। এমন কি ছাঁটাইয়ের বাজারে চাকরি কেন পেয়েছিল তাও আর অস্পষ্ট নয়। কর্তা-গিন্নী মেয়ের সামনেই মেয়ের অনেক প্রশংসা করলেন।
পরের সপ্তাহেও এক রকম কাচপোকার মতোই মন্মথ সোম বাড়ি টেনে নিয়ে গেলেন ওকে। আপ্যায়নের ত্রুটি নেই। এবারে মেয়েকে রেখে কর্তা-গিন্নী মাঝে মাঝে উঠেও গেলেন। মেয়ের মুখ দেখেই বাপীর মনে হল সে স্থির জেনে বসে আছে দুজনের সম্পর্কটা কি দাঁড়াবে। বাপীর পছন্দ অপছন্দের কোনো প্রশ্ন নেই, ওই মেয়ের ওকে পছন্দ হয়েছে সেটা স্পষ্ট।
সরাসরি প্রস্তাব এল মেজবাবু রামনারায়ণ গাঙ্গুলি—নিশীথের রাম কাকার মারফৎ। সঙ্গে লোভের টোপ।—আর কি, বরাত তো ফিরে গেল তোমার, ওই একটিই মেয়ে, বড়বাবুর বাড়ি ঘরদোর যা-কিছু সব তোমারই—আর, মেয়েটারও খুব পছন্দ দেখলাম তোমাকে।
না, তাঁর গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় নি বাপী। বলেছে, মাপ করবেন, বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
রামবাবু আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, ঝাঁঝালো মুখে বাপী চেয়ার ঠেলে উঠে চলে গেছে।
চাকরি থাকবে না বুঝেছে। আর সেই দুর্ভাবনার কথাটা মণিদাকে না বলেও পারে নি। মণিদা যে সেটা গৌরী বউদিকে বলে দিয়েছে সেটা পরদিনই বোঝা গেছে। কারণ গৌরী বউদির চোখে কৌতুকের ঝিলিক। বিয়ে করতে রাজি নয় বলে চাকরি যাচ্ছে মণিদা তাও বলে দিয়েছে নিশ্চয়।
বড়বাবু—মন্মথ সোমের টেবিলে ডাক পড়েছে। থমথমে মুখ কিন্তু গলার স্বর নরম।—তুমি ভেবে দেখো একটু, লোয়ার ডিভিশন থেকে তোমাকে আপার ডিভিশন করে দিতেও আমার বেশি দিন লাগবে না।
—মাপ করবেন।
নিজের চেয়ারে ফিরে এসেছে।
মাসের সতের তারিখে রামবাবু ছাঁটাইয়ের নোটিস ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, কাল দুটোর মধ্যে এসে এ ক’দিনের মাইনে নিয়ে যেও।
হ্যাঁ, বাপী জ্বলতে জ্বলতেই বাড়ি ফিরছিল। মেয়েরাই ওর জীবনের প্রধান শত্রু। সমস্ত মেয়ে জাতটাকে ছারখার করে দেবার মতোই ভিতরের আক্রোশ আর জ্বলুনি।
দুপুর আড়াইটে তখন। মাথার ওপর শীতের সূর্যটাও আজ বেশি জ্বলছে। বাপী শর্টকাট করে সামনের ছোট পার্কের ভিতর দিয়ে আসছিল। পা দুটো থেমে গেল। সামনের বারান্দায় গৌরী বউদি দাঁড়িয়ে। আর লাগোয়া পাশের বাড়ির বারান্দায় সন্তু চৌধুরী দাঁড়িয়ে। সে যেন চোখের ইশারায় মাথা নেড়ে নেড়ে নিঃশব্দে কিছু আর্জি পেশ করছে। বাপীর মনে হল, গৌরী বউদিকে ডাকছে বা নিজে আসতে চাইছে। গৌরী বউদির ঠোটে হাসি, চোখে হাসি। অল্প অল্প মাথা নেড়ে আর্জি নাকচ করছে।
রাস্তাটা পার হবার পর দু’জনেই দেখল বাপীকে। বাপীর স্নায়ু আর নিজের বশে নেই তখন। ওকে দেখেই সন্তু চৌধুরীর বিমর্ষ মুখ। গৌরী বউদি সচকিত একটু। তারপর সন্তু চৌধুরীর দিকে চেয়ে হাসছে।
বাপীর ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বসার ঘর দিয়ে ঢুকতে হবে। এটাও দুপুরে বন্ধই থাকে। খটাখট শব্দে জোরেই কড়া নাড়ল।
গৌরী বউদি দরজা খুলে দিল। মুখখানা দেখল একটু ভালো করে। একেবারে অন্য রকম লাগছে। জিজ্ঞেস করল, এই মূর্তি কেন, কে তাড়া করল? সঙ্গে সঙ্গে নিজেরই হয়তো মনে পড়ল কিছু।—এ সময়ে যে? চাকরিটা গেল বুঝি?
ভিতরের গোপন সুড়ঙ্গের দরজা খোলা পেয়ে এক মুহূর্তে সেই আদিম হিংস্ৰ পশুটা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। বাপীর আর অস্তিত্ব বলে কিছু নেই, কাণ্ডজ্ঞান নেই। সামনে খোলা চুল পিঠে ছড়ানো, ঢিলে-ঢালা বেশ-বাসে যে দাঁড়িয়ে—তার মুখ দেখছে, বুক দেখছে—এক উপোসী জানোয়ার বড় লোভনীয় গ্রাসের কিছু দেখছে।
হ্যাঁ, চাকরিটা গেল।…এ সময়ে এসে গেলাম বলে তোমার খুব অসুবিধে হল?
জবাবটা দেবার আগে হঠাৎ ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে গৌরী বউদি তিন-পা পিছনে সরে গেছে। আর, তারপরে বিস্ময়ের অন্ত নেই তার। সে-ও চেয়ে আছে। ..তারপর। গৌরী বউদি পিছন ফিরে ঢিমেতালে এ ঘরের দরজা দিয়ে মাঝের ঘরে। সে-ঘরের খোলা দরজা দিয়ে নিজের ঘরে।
বাপীর বুকের তলার দানবটার তখনো দাপাদাপি থামে নি।
বসার ঘরের দরজা বন্ধ করে মাঝের ঘরে অর্থাৎ নিজের ঘরে এলো। সামনের ঘরের খোলা দরজার দিকে চেয়ে নিস্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে রইল খানিক। স্নায়ুগুলো কাঁপছে। কটা মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটে গেল খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু জানোয়ারটা আবার ভিতরে সেঁধিয়েছে।
আস্তে আস্তে সামনে এগলো। খোলা দরজা দুটো শব্দ না করে বন্ধ করতে গেল। আধখানা বন্ধ করার আগেই নিশ্চল আবার।
ও-ঘর থেকে গৌরী বউদি ডাকল, বাপী শোন্ তো—
গলায় স্বর যেমন সহজ তেমনি নির্লিপ্ত।
আধ-ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে এসে দাঁড়াল। গৌরী বউদি শয্যায় শয়ান। কাঁধের শাড়ি আধখানা খসে বুকের ওপর উঁচিয়ে আছে। ঘাড় ফিরে তাকালো। চোখে হাসি। ঠোটে হাসি।
—এদিকে আয়।
ভিতরের জানোয়ারটাকে আর চেষ্টা করেও খুঁজে পাচ্ছে না বাপী। কয়েক পা এগিয়ে এলো।
অল্প অল্প হাসছে গৌরী বউদি। সেই হাসিটা ওকে শয্যার আরো কাছে টেনে নিয়ে যাবার মতো।
—তুই এত পাকা হলি কবে থেকে?
—তোমরা বানারজুলি যাবারও অনেক আগে থেকে।
—হুঁ? চোখে বিস্ময় ঝরল। সেই সঙ্গে আরো কিছু।—তাহলে অত বোকার মতো থাকিস কেন?
—তাতে সুবিধে।
—কি সুবিধে?
—লোকে বোকা ভাবে সেই সুবিধে।
তেমনি অল্প অল্প হাসছে গৌরী বউদি। হঠাৎ বানারজুলির সেই ননদভাজ সাপুড়ে মেয়ে দুটোকে মনে পড়ল বাপীর। বিশেষ করে ছট্টুমিয়ার বউ দুলারিকে। সাপের ছোবল খাবার লোভ, ছোবল খাওয়ার নেশা। সাপ যত ফোঁসে সামনে পিছনে সেই মেয়ে তাতে দোলে আর হাত বাড়ায়।
—গৌরী বউদির চোখেও সেই লোভ। না, তার থেকেও বেশি কিছু। তাজা কাঁচা একটা পুরুষ দেখছে গৌরী বউদি।…ব্যভিচার বয়েস জানে না। কিছু মানে না। হাসছে অল্প অল্প। বলল, বসার ঘরে দরজা বন্ধ আছে তো? কেউ ঢুকে পড়লে চেয়ার টেবিলসুদ্ধ যাবে—
শয্যার মাথার দিকের দরজার দিকে তাকালো বাপী। ছিটকিনি তোলা। বসার ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে তিন ঘরের কোনটাতে কারো ঢোকার উপায় নেই বটে।
—দেখছি। বাপী ভিতরের দরজার দিকে পা বাড়ালো।
পিছন থেকে গৌরী বউদি বলল, দেখে আয়—তোর সঙ্গে কথা আছে।
ভিতরের জানোয়ারটার অস্তিত্বসুদ্ধু উবে গেছে। ওর সত্তা বিষাদে ডুবছে, তলিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে বাপীর আর বাচ্চুর নতুন তোলা ফোটো। ছেলেটা দুষ্টু দুষ্টু হাসছে বাপীর দিকে চেয়ে। বাপীর চোখ দুটো শিরশির করছে, বুকের হাড়ে হাড়ে কান্না গুমরে উঠতে চাইছে।
বসার ঘরে এলো। নিঃশব্দে বন্ধ দরজা দুটো খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। দরজা দুটো বাইরে থেকে আবার আস্তে আস্তে টেনে দিয়ে নিচে চলে এলো।
ফিরল রাত দশটার পরে। মণিদা তখনো বসার ঘরে। মাঝের ঘরের বিছানায় বাচ্চু নেই। অর্থাৎ আজ মায়ের কাছে ঘুমুচ্ছে। গৌরী বউদির মুখ দেখা গেল না। কিন্তু বাপী ঠিক জানে সে তার ঘরেই আছে।
…না, পরদিন সকালে মণিদার কোনো শাসন চাবুক হয়ে নেমে আসে নি। উল্টে তারই ভীরু মুখ। আমতা-আমতা করে বলল, হঠাৎ কি যে হল তোর বউদির…তোকে আজই চলে যাবার কথা বলছে।
যেতে হবে বাপী জানত। মাথা নাড়ল। আজই যাবে।
বাচ্চুর চোখে ধুলো দিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল। মাসের ষোল দিনের মাইনে নেবার জন্য দুপুরে ব্রুকলিনে এলো। বেরিয়ে আসার সময় দুঃখ আর সহানুভূতি জানাতে জানাতে রতন বনিক গেট পর্যন্ত এলো। ভালো মানুষ বিপুলবাবুর এত চট করে চাকরিটা চলে যাবে, এ ও ভাবতেই পারে নি।
কি মনে হতে বাপী বলল, যা হবার তো হল। আমাকে দিন কতকের একটু মাথা গোঁজার মতো জায়গা বলে দিতে পারো? তুমি থাকো কোন্ দিকে?
—ভবানীপুরের দিকে। রতন বনিক অবাক একটু।
বাপী হেসেই বলল, আজ থেকে থাকার জায়গাও নেই.:.যেখানে হোক একটু জায়গা পেলে হত, টাকাও কিছু দিতাম।
রতন বনিকের মুখখানা দরদে ছেয়ে গেল। বলল, একটা খুপরি ঘর তো আমারই আছে…কিন্তু সেখানে তো আপনি থাকতে পারবেন না, একেবারে বস্তির মতো।
বাপী আশার মুখ দেখল। লোকটা সত্যি ভালো।…আর ভদ্রলোকের থেকে অনেক ভালো। সাগ্রহে বলল, আমি খুব পারব, তোমার অসুবিধে হবে না?
রতন বনিক এরপর ছুটে গিয়ে বাকি সময়টুকুর জন্য ছুটি নিয়ে এসেছে। তারপর বাপীর সেই সামান্য মাল-পত্র বয়ে তাকে সঙ্গে করে টালি এলাকার খুপরি ঘরে এসে তুলেছে।
…গৌরী বউদি ঘর ছেড়ে বেরোয় নি। বাচ্চু তখন স্কুলে। মণিদা আপিসে।