সোনার হরিণ নেই – ৩০

ত্রিশ

পরের দিনটা আবার হরতাল। ট্রাম ভাড়ার সেই এক পয়সার যুদ্ধ। তার পরের দিন জায়গায় জায়গায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা অমান্য করার ধুম, জনতা পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ। গুলি টিয়ারগ্যাস লাঠি। সৈন্যদের টহলদারি।

এরই মধ্যে বাপী হোটেল ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে। ফ্ল্যাটের মালিক কথার খেলাপ করেনি। অল্প কটা দিনের মধ্যে ছিমছাম সাজিয়ে দিয়েছে। হট্টগোল থেকে সরে এসে বাপী প্রায় চব্বিশটা ঘণ্টা ঠাণ্ডা নিরিবিলির মধ্যে সেঁধিয়ে থাকল।

আরও একটা দিন গড়িয়ে গেল। দুপুরের দিকে গাড়ি হাঁকিয়ে বাপী উল্টোডাঙার সেই গুদাম ঘর দেখতে গেছল। ইতিমধ্যে সেটারও কিছু সংস্কার হবার কথা। মিস্ত্রীর কাজও অনেক। ভিতরে পার্টিশন দিয়ে গোটাকতক খুপরি করতে হবে। এদিকের কাজ সবই এগোচ্ছে। জিত্ মালহোত্রা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করাচ্ছে। কিন্তু হাঙ্গামার চেহারা যা দাঁড়াচ্ছে, আসল কাজ কবে থেকে যে শুরু হবে বাপী ভেবে পাচ্ছে না বলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে।

সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে ফিরছিল। হাতঘড়িতে বিকেল চারটে। রাস্তাটা কেমন ফাঁকা আর থমথমে মনে হল। দূরে দূরে গলির মুখে ছোট ছোট জটলা। কিছু মিলিটারি ট্রাকেরও আনাগোনা চোখে পড়ল। গলির মুখে যারা দাঁড়িয়ে, মিলিটারি গাড়ি দেখে তারা ছুটছাট সরে যাচ্ছে। একশ চুয়াল্লিশ ধারা চলছে তখনও। হাওয়াটা তেমন সুবিধের ঠেকল না বাপীর।

সেই এয়ার অফিসের কাছাকাছি এসে গাড়ি আরও জোরে ছোটাল। কোন দুর্বলতার প্রশ্রয় দেবে না। তার অগোচরে আপনা থেকে যে অনুকূল পটভূমি গড়ে উঠেছে, খুব বুঝে-শুনে পা ফেলতে হবে সেখানে। সময় আসবে। আসবেই।

কিন্তু সময় আসারও রকমফের আছে, দশ মিনিট আগেও তা ভাবে নি। সামনে থেকে একদঙ্গল লোক হুড়মুড় করে ছুটে আসছে। অদূরে টিয়ার গ্যাসের শব্দ। ধোঁয়া। ঘন ঘন গোটাকতক বোমার আওয়াজ। হতচকিত বাপী গাড়িটা ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিল। পুলিশের তাড়া-খাওয়া লোকগুলো অনেক দূরে দূরে গিয়ে থামল।

বাপী গাড়ি থেকে নেমে খবর সংগ্রহ করল। দক্ষিণ কলকাতায় সেই দুপুর থেকেই আগুন জ্বলছে। গুলি চলেছে। লোক মরেছে। দু-দুটো সরকারী বাস জ্বালানো হয়েছে। সেই উত্তাপ এদিকেও ছড়িয়েছে। খানিক আগেও লাঠিচার্জ হয়ে গেছে, এখন টিয়ারগ্যাস চলছে। অন্যদিক থেকে বোমাবাজী শুরু হয়েছে।

বাপী গাড়িতে এসে বসল। দু-দুটো বাস পোড়ানো হয়েছে, বাস আর চলবে না। এতটা পথ আসতে একটাও বাস চোখে পড়েছে মনে হল না। রাস্তায় এখন ট্যাক্সিও দেখছে না।

ইউ-টার্ন করে গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে এয়ার অফিসের ফুটপাথের গা ঘেঁষে গাড়িটা দাঁড় করালো। কাচ তুলে দিয়ে দরজা লক করে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভিতরে ঢুকল।

বোর্ডে নাম দেখল। মালবিকা চ্যাটার্জির ঘর দোতলায়। ওপরে উঠে গেল। একজন বেয়ারাকে জিগ্যেস করতে ঘরের হদিস মিলল। অপেক্ষা করতে হল একটু। ভিতরে দ্বিতীয় কেউ আছে। মিনিট তিন-চারের মধ্যে বছর চল্লিশের একজন ফিটফাট ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো।

সুইং ডোর ঠেলে বাপী ভিতরে ঢুকল।

মস্ত টেবিলের ওধারে কলম হাতে মিষ্টি টাইপ করা একটা কাগজের দিকে চোখ নামিয়েছিল। মুখ তুলল।

একটা চকিত অভিব্যক্তির ঢেউ চোখের তারায় এসে স্থির হল। তারপর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি দেখা দিল একটু। গেলবারে অসিত চ্যাটার্জিকে সঙ্গে করে হোটেলে আসার পর যে হাসি আর চাউনি দেখেছিল বাপীর মনে আছে। সেই হাসি আর চাউনিতে ওকে কিছু বোঝানোর আকুতি ছিল। এ চাউনি বা হাসি সে—রকম নয়। অনেকখানি আত্মস্থ, ব্যক্তিত্বে বাঁধা।

—বসো। সমস্ত মানুষটাকেই দেখে নিল একবার

বাপীর পুরুষের পদক্ষেপ। এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। বলল, এই রাস্তা ধরেই আমার যাতায়াত। আজই চলেই যাচ্ছিলাম, সামনে গণ্ডগোল দেখে ফিরে এলাম। বাস পোড়ানো হয়েছে, গুলিটুলি চলছে, ট্যাক্সিও চলছে না।

শুধু ঠোঁটে নয়, চোখেও একটু হাসির ছোঁয়া লেগে আছে। মিষ্টি বলল, জানি। খবর শুনেই অনেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন—

বাপী জিজ্ঞাসা করল, তোমার তাড়া নেই?

ঠোটের আর চোখের হাসি আর একটু প্রশস্ত হল। জবাব দিল, লেগেই তো আছে, কত আর আগে আগে পালানো যায়।

বাপীও চেয়ে আছে। আল্ল্গা সহজতা নেই। বাড়তি গাম্ভীর্যও না। এই মেয়েকে দেখে কেউ বলবে না ঘরের লোকের কারণে বুকের তলায় বড় রকমের যন্ত্রণা পুষছে। বাপির ভিতরেই বরং একটা চিনচিন যন্ত্রণার অনুভূতি।…গেলবারে যা দেখেছিল তার থেকেও তরতাজা লাগছে। বয়েস যেন আরো কমেছে। সহজ ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায় বেশ স্বাতন্ত্র্যের ছাঁদ এসেছে। পরনে ঘন ছাইরঙের সিল্কের ওপর সাদা বুটির শাড়ি, গায়ে ধপধপে সাদা ব্লাউস। ঈষৎ ঝোলানো খোঁপা। … যৌবন আপন মাধুর্যে সুস্থির। যত দিন দেখেনি, বাপী একরকম ছিল। আজ এইটুকু দেখার মধ্যেই ভিতরে একটা তোলপাড় কাণ্ড হতে থাকল। কেউ তার একেবারে নিজস্ব কাউকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে যার ওপর আর কারো অধিকার নেই। থাকতে পারে না। কিন্তু আজ বাপী শান্ত সংযত সতর্ক। স্নায়ুগুলো সব নিজের বশে টেনে ধরে আছে। মুখ দেখে ভিতরের চেহারার আভাসও কেউ পাবে না। মাথায় যে সংকল্প এঁটে বসছে এই মুখের দিকে চেয়ে কেউ তা কল্পনা করতে পারবে না।…শেষ দেখবেই। রণে-প্রণয়ে নীতির ধার কে ধারে?

মিষ্টিই স্বল্প নীরবতার ছেদ টানল।—চা খাবে?

—খেতে পারি।

—আর কিছু?

আর কি?

মিষ্টি হাসল। হোটেলে লোক ধরে নিয়ে গিয়ে যে-রকম খাওয়াচ্ছ শুনলাম, সে-রকম আর এখানে কোথায় পাব?

বাপী শুনল। দেখল। খোঁচা বটে, কিন্তু বেঁধার মতো উগ্র নয়।—শুধু চা-ই বলো।

—ভাল প্যাটিস আর পেস্ট্রি খাওয়াতে পারি।

—তুমি খাবে?

—আমার দুটোর মধ্যেই হয়ে গেছে। চা খাব’খন। বেল টিপল। —শুধু চা-ই হোক।

মিষ্টি তাকালো একবার। জোর করে আগ্রহ দেখাল না। বেয়ারা আসতে দু পেয়ালা চায়ের হুকুম করল।

বাপী নড়েচড়ে বসল একটু।—দীপুদার সঙ্গে এর মধ্যে তোমার দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে তাহলে?

প্রশ্নের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা।—তাহলে কি রকম?

—দীপুদা বলেছিল, তার আগে “যে লোককে হোটেলে ধরে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছি তার জন্য তুমি আমার ওপর খুব রেগে আছ আর আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছ। …কিন্তু এখন এতটা রেগে আছ বলে মনে হচ্ছে না।

মিষ্টি হাসিমুখেই স্বীকার করল, এখন আর অত রাগ নেই। বলল, রাত এগারোটায় অমন অবস্থায় বাড়ি ফিরে যা-তা বকতে থাকলে কার মেজাজ ঠিক থাকে?

চোখে চোখ রেখে বাপী ঠাণ্ডা গলায় বলল, মেজাজ ঠিক না থাকলেও মালিকের মেয়েকে বিয়ে করে আমি মস্ত লোক হয়েছি আর তোমার হাজব্যান্ডকে মদ খাইয়ে মজা দেখছি—এমন কথা তুমি বলতে পারো ভাবিনি—এর পর এলে আমার কি করা উচিত?

একটু থমকে খুব চাপা ঝাঁঝের সুরে মিষ্টি বলল, সে তোমার কাছে অত আসবেই বা কেন?

—সেটা তাহলে তুমিই তাকে বলে দিও।

বেয়ারা চায়ের ট্রে রেখে গেল। মিষ্টি দু পেয়ালা চা ঢেলে একটা তার দিকে এগিয়ে দিল। প্রায় তখনই চকচকে কোট প্যান্ট টাই পরা অল্পবয়সী একজন লোক দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ঘরে দ্বিতীয় লোক দেখে সপ্রতিভ তৎপরতায় বলল, একসকিউজ মি—ডিস্টারব্যান্স ভাল রকম শুরু হয়ে গেছে, মিসেস চ্যাটার্জি নো কনভেয়ান্স, একটা গাড়ি যোগাড় হয়েছে—অনেক খদ্দের, যেতে চান তো চটপট উঠতে হবে।

মুখ থেকে চায়ের পেয়ালা নামিয়ে বাপী মিষ্টির দিকে চেয়ে বলল, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।

ঈষৎ বিব্রত হাসিমুখে মিষ্টি লোকটার দিকে তাকালো।

—ও. কে। যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।

চায়ের পেয়ালা শেষ হতেই বাপী বলল, চলো—

চোখে আর হাসি-ছোঁয়া-ঠোঁটে সামান্য বিড়ম্বনার অভিব্যক্তি।—গণ্ডগোলের মধ্যে তুমি আবার বাড়ি পৌঁছে দিতে যাবে…এঁদের সঙ্গে আপিসের গাড়িতেই চলে

যেতে পারতাম।

তার মুখের ওপর দু চোখ আরো একটু এঁটে বসল।—ভয় পাচ্ছ? সঙ্গে সঙ্গে বেশ স্পষ্ট প্রতিবাদ।—ভয় পেতে যাব কেন!

—গেলবারে তোমার ভদ্রলোককে নিয়ে যেদিন হোটেলে এসেছিলে, সেদিন একটু ভয়ই পেয়েছিলে মনে হয়েছিল….।

টেবিলে দু হাত, কৌতুক ছুঁয়ে আছে। চেয়েই রইল একটু। তারপর জবাব দিল, তোমার মধ্যে সারাক্ষণ সেদিন বানারজুলির চোদ্দ বছরের এক ক্ষ্যাপা ছেলেকেও দেখছিলাম…। মুখ লাল হঠাৎ। তাড়াতাড়ি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের কাগজপত্র একদিকে সরিয়ে রাখল।—চলো।

একরাশ হিংস্র লোভ গুঁড়িয়ে দিয়ে বাপীও উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি সিঁড়ি ধরে নামল। রাস্তায় এসে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বাপী চাবি লাগিয়ে নিজের দিকে সামনের দরজা খুলে বসল। ও-ধারের দরজার লক খুলে তাকালো।

মিষ্টি গাড়িটা লক্ষ্য করেছে। উঠে পাশে বসল। নিজেই দরজাটা বন্ধ করল। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বাপী আবার পাশের দিকে তাকালো। ওদিকের দরজার কাঁচ তোলা। ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে কাঁচ নামিয়ে দিতে পারে। সম্ভাব্য স্পর্শটুকুর লোভ থেকেও নিজেকে ছিঁড়ে এনে বলল, কাঁচটা নামিয়ে দাও, নইলে গরম হবে।

মিষ্টি কাঁচ নামালো।

গাড়ি আবার টার্ন নিয়ে চৌরঙ্গীর দিকে ছুটল। দুজনের মাঝে আধ হাতটাক ফারাক। অনেক দিনের একটা ভুলে-যাওয়া স্পর্শ বাপীকে ছেঁকে ধরছে! ফাঁক পেলেই গায়ে হাত দিত আর হামলা করত বলে ন-দশ বছরের এই মেয়ের মুখঝামটা আর তাই নিয়ে তার অনেক ঝাঁঝের কথাগুলো মগজে আছড়ে পড়ছে। ফাঁকা রাস্তা। স্পিডও বাড়ছেই। পাশে যে বসে আছে তাকে নিয়ে এর সহস্রগুণ বেগে সমস্ত বাধা-বন্ধনের ওধারে উধাও হয়ে যাবার তাড়না। একই সঙ্গে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা। সবুর! রণেপ্রণয়ে নীতির ধার কেউ ধারে না। শেষ দেখবেই।

চৌরঙ্গীর খানিক বাদে গাড়িটা বাঁয়ের রাস্তায় ঢুকে যেতে মিষ্টি সামান্য ঘুরে তাকালো।—এদিকে কোথায়?

—আমার ফ্ল্যাটে।

—তুমি হোটেলে নেই?

—ছিলাম। এখন নেই। একবার দেখে যাও, তোমার খুব তাড়া নেই তো? অস্বস্তি বোধ করছে কিনা বোঝা গেল না। ছোট জবাব কানে এলো, না…। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গাড়িবারান্দার নিচে গাড়িটা দাঁড় করালো। সামনেই লিফট। দুজনে উঠল।

বাপী চাবি লাগিয়ে সামনের মস্ত দরজাটা খুলে ডাকল, এসো—

গালচে বিছানো মস্ত হল। দামী সোফা-সেটি পাতা। মিষ্টি ভিতরে ঢুকতে বাইরের দরজাটা টেনে দিল। বিকেলের আলোয় সবে টান ধরেছে। বাপী তবু সুইচ টিপে লাইট জ্বালল। এত বড় ফ্ল্যাটে এখন তৃতীয় আর কেউ নেই মিষ্টি সেটা বুঝেছে। তবু তার মুখে অস্বস্তি বা উদ্বেগের ছায়া চোখে পড়ছে না। না, বাপী শয়তানকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেবে না। ক্রূর লোভে ভিতরে কেউ আছাড়িপাছাড়ি করছে টের পাচ্ছে। তবু সবুর। এটা সময় নয়। সময় আসবে। আসতেই হবে।

—বোসো।

মিষ্টি বসল না। হলের চারদিক দেখে নিল। ফ্ল্যাটের মালিক বড় বড় দেয়ালে কিছু শৌখিন ছবি টাঙিয়েছে। শিথিল পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেগুলিও দেখল। বাপী এগিয়ে এলো। বেডরুম দুটো, ডাইনিং স্পেস কিচেন বাথও দেখালো। তারপর আবার হলের সোফায় এসে বসল। তিন হাত দূরের সোফায় মিষ্টি।

—মোটামুটি মন্দ নয়, কি বলো?

মিষ্টি হাসছে।—তোমার এখন অঢেল টাকা, তাই তোমার কাছে মোটামুটি। সোফায় আরও একটু গা ছেড়ে দিয়ে বাপী জবাব দিল, অঢেল টাকা যে হবে সে তো তোমাকে অনেক বছর আগেই বলেছিলাম…সেই যে-বারে তুমি ভাবী বরকে ডেকে লেকে আমাকে অপমান করে তাড়ালে।

মিষ্টি সোজাসুজি চেয়ে রইল খানিক। স্পষ্ট করেই বলল, অপমান করতে চাইনি, তোমাকে কিছু বোঝাতে চেয়েছিলাম। তুমি কোনদিন কিছু বোঝবার লোক নও।

বাপী আবার সোজা হয়ে বসল। দু চোখ তার মুখের ওপর। সামান্য মাথা নাড়ল।—ঠিকই বলেছ—কো-নো দিন নয়।

মিষ্টি তেমনি চেয়ে রইল। গলার ঠাণ্ডা অথচ বাড়তি জোরটুকু কান এড়াবার নয়। বাপী তক্ষুনি নিজের নাক-মুখ বেড়িয়ে কল্পিত চাবুক বসাল একটা। রণে বা প্রণয়ে কাউকে আগে থাকতে সতর্ক করাও রীতি নয়। চাবুকের ঘায়ে মুখে হাসি ছড়াল।—যাক, আমার বোঝাবুঝি নিয়ে তোমার আর কি মাথাব্যথা।

মিষ্টিও হাসল।—মাথাব্যথা একটু আছে। সেই যেবারে তোমাকে অপমান করে তাড়ালাম বললে, তখন থেকে।…গেলবারে তোমাকে দেখে সেটা আরও বেড়েছিল। আমি খুব আশা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত তোমার সেই মালিকের মেয়েই ঘরে আসবে আর তোমার পাগলামিও ছাড়বে।

জমা বারুদের গায়ে আঁচ লাগছে। সেই আঁচ তফাতে রাখার চেষ্টায় বাপী নিঃশব্দে যুঝল খানিক। ভিতরের দৈন্যদশা বুঝতে বাকি নেই, মিষ্টি তা বেশ মিষ্টি করেই জানিয়ে দিল। ঠোটের ফাঁকে তির্যক হাসি ছড়িয়ে বাপী মোলায়েম সুরে জিগ্যেস করল, তা হল না বলে হতাশ হয়েছ?

মাথা নেড়ে হাল্কা জোরের সঙ্গেই জবাব দিল, হবো না! সেই ছেলেবেলা থেকে তুমিই আমার হাড় জ্বালিয়েছ—আমি কবে না তোমার ভাল চেয়েছি?

সুচারু ব্যক্তিত্বে আত্মস্থ হলেও এখন আপোসের দিক ধরেই সম্পর্কটা সহজ করে তোলার আগ্রহ স্পষ্ট। লুব্ধ দু চোখ পলকা কৌতুকে ঢেকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, ভালো দেখছ না?

—কি ভালো—মস্ত ব্যবসা অনেক টাকা বাড়ি গাড়ি?

—আর কি চাই। একটা পয়সা ট্রামভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে কলকাতা রক্তে ভাসছে। যাক গে, তোমার মতে তাহলে আমার এখন কি করা উচিত?

মিষ্টির দু চোখে হাসি ছুঁয়ে আছে, কিন্তু তরল নয় আদৌ। যা বলতে চায় তার সাদা অর্থ, যা হবার হয়েই যখন গেছে তার জের টেনে আর লাভ কি বাপু— সুস্থির হও, ভালো থাকো—আর কি চাই তা নিজেই বেশ জানো। বলল না। হাত উল্টে ঘড়ি দেখল।—এখন ওঠা উচিত।…ফ্ল্যাটে তো এখন পর্যন্ত লোকজন দেখলাম না, তোমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি?

—যখন যেখানে যা জোটে।

মিষ্টি তক্ষুনি হেসেই আমন্ত্রণ জানালো, তাহলে আমার ওখানেই চলো, এ রাতটার মতো কি জোটে দেখা যাক—

রমণী-মুখের ওই কমনীয় ব্যক্তিত্বের উপর একটা আঁচড় বসানোর সুযোগ পেল বাপী। জবাব না দিয়ে মুখের দিকে চেয়ে মিটি-মিটি হাসতে লাগল।

—কি হল?

—লোভ হচ্ছে…সাহসে কুলোবে না!

—কেন? আর একজনের মুখে তো তোমার প্রশংসা ধরে না এখন। কিছু বলার আগেই দুর্বল দিকটা আগলানোর চেষ্টা দেখে বাপীর মজা লাগছে। তার তাড়া নেই। টোপ আর একটু বসানো হোক। হৃষ্ট মন্তব্য করল, এখন আমার এই ভাগ্যটাও খুব ভালো, শুধু তোমার একজন কেন, দীপুদার সঙ্গে দেখা হলে তার মুখেও আমার খুব প্রশংসা শুনবে…কারণ দুজনের কাছেই আমি এখন একজন নিরীহ অথচ ধৈর্যশীল শ্রোতা।

মিষ্টির ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগল। নিরীহ যে কত সেটা খুব ভালো জানে।…দাদার ছেলেবেলার আচরণের খোঁচা হলে দুজনকে টানত না। সতর্ক চাউনি তার মুখের ওপর স্থির কয়েক পলক। —দেখা হয়েছে, অনেক প্রশংসাও শুনেছি…কিন্তু হঠাৎ এ-কথা কেন, ড্রিংক করে এই একজন দাদার নামে যা-তা বলেছে বলে?

বাপী একটু শব্দ করেই হেসে উঠল। —বলাবলির কথা ছাড়ো, এ ব্যাপারে দুজনা দুজনার ওপর সমান টান—একেবারে কর্ণার্জুনের টান যাকে বলে।

ছাড়তে বললেও বলবলিটা যে একতরফা হয়নি সেইটুকুই বুঝিয়ে দিল। মিষ্টি বুঝল। সুন্দর মুখের এই ব্যক্তিত্ব কমনীয় হলেও একটু আগের মতো সরল নয়।—আমার ওখানে যেতে তোমার সাহসে কুলোচ্ছে না কেন…দাদা কি বলেছে?

—তোমার ভদ্রলোকের কিছু রোগের কথা।…

চাপা ঝাঁঝালো গলায় মিষ্টি জানতে চাইল, কি রোগ? জুয়া খেলে, নেশা করে?

—দিল্লির অমন ভাল চাকরিটা নিতে পারলে না বলেও তোমার দাদা খুব দুঃখ করছিল।

সব থেকে দুর্বল জায়গাটি ধরে নিঙড়ে দেওয়ার কাজ সারা। ফর্সা মুখে তপ্ত লালের আভাস ছড়িয়ে পড়েছে। অপলক দু চোখ বাপীর চোখে আটকে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে ধারালো হাসির রেখা স্পষ্ট হতে থাকল। বলল, সবই বুঝলাম।…আমার মা বা দাদা কখন কোন্ রাস্তায় চলে ছেলেবেলা থেকে জেনেও তাদের কথায় তোমার এখন এত ভক্তিশ্রদ্ধা কেন সেটুকু শুধু বুঝলাম না।… যে সহজ কথাটা তাদের বুঝতে অসুবিধে তা নিয়ে আমি খুব মাথা ঘামাই না বা তাদের কিছু বলিও না। কিন্তু তুমি এমন এক ধৈর্যশীল শ্রোতা বলেই তোমাকে বলতে পারি। তারা শুধু রোগ দেখছে, কিন্তু তার জোরের আসল পুঁজিটুকু তাদের চোখে পড়ছে না। সেটা মিথ্যে হলে আর কাউকে কিছু বলতে হত না, আমি নিজেই ছেঁটে দিতাম। জোরের এই পুঁজিটুকুতে ভেজাল নেই বলেই রোগ বরদাস্ত করতে আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে না এটুকু তুমি অন্তত জেনে রাখতে পার।

ধীরে-সুস্থে কথাগুলো শেষ করে মিষ্টি আবার ঘড়ি দেখল। মুখ তুলে সোজাই তাকালো আবার। কঠিন আঁচড়টুকু ঠোঁটের ফাঁকে লেগে আছে এখনও। —এবারে উঠতে হচ্ছে।

জবাবটা বাপীর মগজের মধ্যে কেটে কেটে বসতে লাগল। দুর্বলতায় মোচড় পড়া সত্ত্বেও যা বলল বাপীর বুঝতে একটুও সময় লাগল না। জোরের আসল পুঁজি বলতে তার ঘরের ওই একজনের ভালবাসার পুঁজি, ভালবাসার জোর। মিষ্টির ধারণা এতে কোন ভেজাল নেই। আর, এ সম্বল যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার ওই রোগ বরদাস্ত করতেও অসুবিধে হবে না। অর্থাৎ ভালবাসা আছে বলেই অবস্থাগতিকে সেটুকু হারাবার ভয়ে এই আঁকড়ে ধরে থাকার রোগ।…এও বুঝিয়ে দিল, দাদা বা মা যা-ই বলুক, এ-জন্যে আর কারও প্রত্যাশারও কিছু নেই।

সহজ সংযমের মুখোশ ধরে রাখার চেষ্টায় বাপীকে যুঝতে হচ্ছে এখনো। বুকের পাতালে ফুঁসছে কেউ। গজরাচ্ছে।…সামনের দরজা বন্ধ। ফ্ল্যাটে তৃতীয় কেউ নেই। ওটা শেকল ছেঁড়ার আগে বাপী উঠে পড়ল। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। ছিটকিনি টেনে দরজা দুটো খুলে দিয়ে ডাকল, এসো—

লিফটে নিচে নামল পাশাপাশি গাড়িতে উঠে বসল। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি আবার বড় রাস্তায় পড়ে বেগে ছুটল। গণ্ডগোলের দরুণ ফুটপাথে লোক চলাচল কম। ফাঁকা রাস্তা।

মিষ্টি কোন কথা বলছে না। বাপীও চুপ। গাড়ি ছুটেছে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার মগজও থেমে নেই। মিষ্টির কথাগুলো হিসেব করছে। আর ওজন করছে। হিসেব করছে আর ওজন করছে আর নাকচ করছে।

…ভালবাসার পুঁজি বাপী চেনে। তার জোর কত জানে। এই পুঁজি, এই জোরের ওপর তার চিরকালের দুর্বলতা। বনমায়ার মরদ হাতির কবলে পড়ে করতে বসেছিল, তবু ওই আহত পাগলা হাতিটার প্রতি অগাধ দরদ তার। ভালবাসার বুকে দাগ বসিয়েছিল বলে বনমায়ার এককালের মাহুত ভীম বাহাদুর চা-বাগানের লম্পট সাহেবের বুকে ছোরা বসিয়ে পালিয়েছিল—বাপী তখন মনে প্রাণে প্রার্থনা করেছে, ভীম বাহাদুর ধরা যেন না পড়ে। … ব্রুকলিন পিওন রতন বনিকের মুখে সেই ভালবাসার নির্ভরতা দেখেছিল—বাপী নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারে না।…নিজের বুকের তলায় এই পুঁজি পুষছিল বলেই প্রাণ বাঁচানো সত্ত্বেও রেশমাকে অত বড় আঘাত দিয়ে সেই চরম বিপর্যয়ের মুখ থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পেরেছিল!…ভালবাসার নিঃশব্দ অথচ বিপুল স্রোত জঙ্গলের সাপধরা মানুষ হারমার মধ্যে দেখেছে। এই পুঁজি আর এই জোরের ওপর নির্ভর করে ঊর্মিলা বেঁচে গেল।…কোবরেজের ছেলে ছোট কবিরাজ নিশীথ সেনের মুখেও এই ভালবাসার ছোঁয়াটুকু দেখেছিল বলেই অনায়াসে তাকে এখানকার ম্যানেজারের চেয়ারে বসিয়ে দেবার কথা ভাবতে পেরেছিল। সেই ছোঁয়া মুছে গেছে জানা মাত্র তাকে মন থেকেই ছেঁটে দিতে দ্বিধা করেনি।

…অসিত চ্যাটার্জির হাসিতে খুশিতে রাগে ক্ষোভে বা আচরণে এই পুঁজি। আর এই জোরের ছিটে-ফোঁটাও দেখতে পেলে বাপী সেটুকু অনুভব করত। বুঝতে পারত। নিজের বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও জানতে বা চিনতে ভুল হত না।

বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া। কিন্তু শিরায় শিরায় রক্তের তাপ বাড়ছে। মিষ্টির কথাগুলো একটা চ্যালেঞ্জের মতো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আর যন্ত্রণা ছড়াচ্ছে।

অপেক্ষাকৃত ঘন বসতির কাছাকাছি এসে পড়তে বাপী গাড়িটা হঠাৎ সামনের রাস্তার ডাইনের বাঁকে ঘুরিয়ে দিল। ওই রাস্তাটা ফাঁকা পাবে।…ঘোরার মুখে স্পিড এমনিতেই কমাতে হয়েছে। হঠাৎ রাস্তার ও-ধারে ল্যাম্প-পোস্টের দিকে চোখ যেতেই ব্রেকে চাপ পড়ল। বাপী বিমূঢ়, নিস্পন্দ হঠাৎ।

ল্যাম্প-পোস্টের একটু তফাতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। গাড়িটা প্রায় থেমে যেতে সপ্রতিভ তৎপরতায় রাস্তায় নেমে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে এলো। তার পরেই আচমকা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো বিষম একটা ঝাঁকুনি খেয়ে মেয়েটা ছিটকে ঘুরে আবার ফুটপাথে উঠে সামনের অন্ধকারের দিকে হনহন করে হেঁটে চলল।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটল পনের সেকেন্ডের মধ্যে। গাড়িটা এভাবে থামতে মিষ্টি প্রথম মুখ ঘুরিয়ে বাপীর দিকে তাকালো। তারপর তার হতচকিত দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তার দিকে। মুখ দেখা গেল না, মেয়েটির ততক্ষণে ও-দিক ফিরে পালানোর তাড়া। কিন্তু মিষ্টির পাশের লোক গাড়ি চালানো ভুলে সেদিকে চেয়েই আছে।

—কি ব্যাপার, মহিলাকে চেনো নাকি?

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। বাপী মাথা নাড়ল। চেনে।

—ওভাবে পালিয়ে গেল কেন…আমাকে দেখে?

—হয়ত আমাকে দেখেই। তোমাকে দেখলে এগোতই না।

যাকে চেনে তাকে দেখেই অমন ত্রস্তে পালিয়ে গেল শুনে মিষ্টি অবাকই একটু। বলল, কিছু না পেয়ে লিফটের আশায় দাঁড়িয়ে ছিল হয়ত, ডেকে তুলে নিলে না কেন?

বাপীর দু চোখ সামনের দিকে। জবাব দিল, লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল না।

—তাহলে কি জন্য?

—আমার জন্য…যে কোন একটি পুরুষের জন্য…।

জবাবটা দিয়ে বাপী এবারে আড়চোখে তার মুখখানা লক্ষ্য করল। মিষ্টি স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকেই দেখছে। ওদের মনোহরপুকুরের বাড়ী বাপী চেনে না। সেই রাস্তায় এসে মিষ্টি একবার বাঁয়ে যেতে বলল একবার ডাইনে। তারপর আঙুল তুলে ছোট একটা একতলা দালান দেখিয়ে দিল।

গাড়ি থামতে মিষ্টি একাই নামল। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আসবে না?

—আজ না।

বেগে গাড়ি চালিয়ে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে বাপী আবার সেই রাস্তায় চলে এলো। যেখানে তাকে দেখে এক মেয়ে ত্রস্ত হরিণীর মতো অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেছে। বাপী আশপাশের রাস্তাগুলোতে চক্কর খেল খানিক। অন্ধকার ফুঁড়ে দেখতে চেষ্টা করল।

নেই।

মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমু। কুমকুম। কলকাতায় আসার বড় সাধ ছিল। আসতে পেরেছে।

কিন্তু কলকাতায় আসার সাধ কেমন মিটেছে নিজের চোখে দেখেও বাপী তাকে খুঁজছে কেন? অস্ফুট একটা ইতর গালাগালে নিজেকে বিদ্ধ করে ফেরার রাস্তায় গাড়ি ছোটাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *