সোনার হরিণ নেই – ১৭

সতেরো

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। গায়ের পুরু কম্বল সরে গেছল। সেটা টেনে নিয়ে বাপী আবার ঘুমোতে চেষ্টা করল। এত শীতে গায়ত্রী রাইয়ের সাড়ে সাতটার আগে ঘুম ভাঙে না। মেয়ে আরো দেরিতে ওঠে। কিন্তু কি মনে পড়তে গরম আরামের তলায় ঘুমের চটকা ভেঙে গেল। কম্বলটা মুখ থেকে গলা পর্যন্ত নামিয়ে চোখ মেলে তাকালো।

পাহাড়ের বাংলোয় নয়, বানারজুলিতে বাপী নিজের বাংলোয় নিজের বিছানায় শুয়ে। পাঁচ দিন বাদে গত সন্ধ্যায় সকলকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে! নভেম্বরের শেষ দিন গেছে সেটা। আজ ডিসেম্বরের পয়লা। ওই পাঁচ দিনে প্রত্যাশার বাইরে মহিলার অনেক পরিবর্তন দেখেছে বাপী।

ওই পাঁচটা দিন ছবির মতো চোখে ভাসছে।

…সেই রাতে মা ছেড়ে মেয়ের মধ্যেও এমন কিছু নাড়াচাড়া পড়েছিল যে কারো মুখে একটি কথা সরেনি। নিঃশব্দে ডিনারের পাট শেষ হয়েছে। আগের বার যে কোণের ঘরটায় থাকত সেই ঘরেই বাপীর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। বাড়ির হাওয়া দেখেই হয়তো ঝগড়ুর মুখ সেলাই। সঙ্গে করে শোবার ঘরে নিয়ে আসার পর ফিসফিস করে না. জিজ্ঞাসা করে পারেনি।—কি হয়েছে বাপীভাই? ভয়ের কিছু?

সেই রাতে আর কথা বলার মেজাজ বাপীরও ছিল না। টান-ধরা স্নায়ুগুলো সব শিথিল হয়ে গেছল। ক্লান্ত লাগছিল। মাথা নেড়েছিল শুধু, ভয়ের কিছু না। ঘরের কাঁচের জানলাগুলো সব বন্ধ। তবু বেশ শীত। বিছানায় পায়ের কাছে গায়ের কম্বল ভাঁজ করা। তবু গায়ের সোয়েটারটা খুলবে না সবসুদ্ধই কম্বলের নীচে ঢুকে পড়বে ভাবছিল।

ঝগড়ুর চকিত মুখ দেখেই বাপী ঘুরে তাকিয়েছিল। ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে গায়ত্রী রাই। সেই রকমই ফ্যাকাশে সাদা মুখ। তেমনি নির্বাক। চোখোচোখি হতে এগিয়ে এলো। ঘুরে চারদিকে চেয়ে দেখল একবার। বিছানা দেখল। কম্বলটাও। তারপর ঝগড়ুর তটস্থ মূর্তির দিকে একবার তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওই তাকানোর অর্থ সঙ্গে আসার ইশারা বুঝে ঝগড়ুও পিছনে চলল। বাপী খোলা দরজার দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর বিছানায় বসল। মিনিট পাঁচ—সাতের মধ্যেই ঝগড়ু ফিরে এলো আবার। তার হাতে ভাঁজ-করা একটা মোটা সাদাটে কম্বল। মুখে চাপা উত্তেজনা। প্রায় অসম্ভব কিছু ব্যাপার ঘটেছে যেন। হাতের কম্বল বিছানায় ফেলে আগের কম্বলটা তুলে নিল।

এই কম্বলে হাত দিয়েই বাপী বুঝল খুব দামী জিনিস। ওপরের দিকটা খড়খড়ে। নিচের দিকটা পশমের মতো নরম। আর তেমনি গরম যে বোঝাই যায়। বাপী বলেছিল, যেটা ছিল তাতেই তো হয়ে যেত…

জবাবে ঝগড়ুর চাপা বিস্ময় আর চাপা খুশি।—মালকান যে নিজে হাতে এটা বার করে তোমাকে দিয়ে যেতে হুকুম করল! এটা সাহেবের কম্বল ছিল বাপীভাই, সাহেব চলে যেতে মালকান এটা যত্ন করে তুলে রেখেছিল—এই প্রথম নামানো হল!

বাপী আজ নিজের ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে। কিন্তু গায়ে সেই কম্বল গায়ত্রী রাই এটাও সঙ্গে নিয়ে এসেছে জানত না। কাল সন্ধ্যার পরেই পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু এটাই নয়। বিগত বীরেশ্বর রাইয়ের আরো কিছু সযত্নে তোলা দামী জিনিস এখন বাপীর দখলে। ওই দেয়ালের হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। গলা থেকে পা পর্যন্ত পশনের ড্রেসিং গাউন। তাতে কাশ্মীরী কাজ করা। চোখে পড়ার মতো জিনিস। কোথায় কি-ভাবে যত্নে রাখবে ওটা বাপীর এখন সেই সমস্যা।

পাহাড়ের বাংলোয় পরদিন সকালে চায়ের পাট শেষ হতে বানারজুলি ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। গায়ত্রী রাই নিজের মনে ভাবছিল কিছু। মেয়ে ফস করে বলে উঠল, বাপীর সঙ্গে আমরাও নেমে যাই চলো না মা, এ ছাইয়ের জায়গা আর ভালো লাগে না—আর কত শীতের জন্য অপেক্ষা করবে?

গায়ত্রী রাই মেয়ের দিকে চেয়ে রইল একটু। তারপর বাপীর দিকে। বলল, তোমার এখন যাওয়ার দরকার নেই, দিন কয়েক বাদে একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। ঊর্মিলা মায়ের সুবিবেচনা দেখে খুশি। কর্ত্রী এরকম হুকুম করতে পারে বাপীর কল্পনার মধ্যে ছিল না। মেয়েকে সঙ্গ দেবার জন্য এই নির্দেশ, একবারও মনে হয়নি। দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বাপী বলেছিল, জামা-কাপড় কিছু সঙ্গে আনা হয় নি।

পাছে মা আবার ওকে যেতে বলে, ঊর্মিলা আগ বাড়িয়ে বাধা দিল, তোমার অমন রাজ-সজ্জা ভুটান শহরে পাওয়া যাবে না নাকি! সঙ্গে সঙ্গে হাসি।—আর না পাওয়া গেলেই বা, আমার আর মায়ের শাড়ি পরেই কটা দিন কাটিয়ে দিও।

মেয়ের বাচালতায় মা হালকা ভ্রুকুটি করে একবার তার দিকে তাকালো শুধু। তারপর বাপীর দিকে। সোয়েটারের ওপর আলোয়ান চড়িয়েও সকালের শীত মানছে না, বুঝল। কিছু না বলে উঠে চলে গেল। একটু বাদে ফিরল যখন হাতে ওই কাশ্মীরী কাজ করা পশমের ড্রেসিং গাউন।

—এটা পরে দেখো তো।

জিনিসটা কার আর কত যত্নে ছিল বাপী দেখেই বুঝেছে। মায়ের বদান্যতায় মেয়ে অবাক যেমন খুশিও তেমনি। বাবার এসব জিনিস মা হাতে ধরে কাউকে তুলে দিতে পারে ভাবা শক্ত। গত রাতে বাবার কম্বল বার করে দেবার কথাও ঝগড়ুর মারফৎ ওর কানে গেছে, বাপী সেটা পরে বুঝেছে। ফাঁপরে পড়ার দাখিল। বলেছিল, না, না, এর কিছু দরকার নেই—আমার কষ্ট হচ্ছে না।

কোনো কিছুতে বাধা পড়লেই বিকৃত মুখ।—আঃ! পরে দেখতে বলছি না! মেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এসে মায়ের হাত থেকে গাউনটা নিল। আলোয়ান খুলিয়ে নিজের হাতে ওটা পরালো তাকে। অস্বস্তির একশেষ। সামনে এসে নিজের হাতে কর্ডের বেল্টও লাগিয়ে দিল। তারপর সকৌতুকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল, ফার্স্ট ক্লাস!

বড় আয়নাটার সামনে টেনে নিয়ে গেল ওকে। কিন্তু আয়নায় বাপী নিজেকে দেখবে কি। আয়নায় গায়ত্রী রাইয়ের দিকে চোখ পড়তে সে যেন অভাবনীয় কিছুই দেখল। রুক্ষমুখে কমনীয়তার অমন ঢল নামতে পারে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। দেখেই বুকের তলায় আর একখানা মুখ আঁতিপাতি করে খুঁজতে ইচ্ছে করেছিল। তার অদেখা মায়ের মুখ। ওর দিকেই চেয়ে আছে। আয়নার ভিতর দিকে চোখাচোখি হতে বাপী সরে এসেছিল।

বেড়ানোর অছিলায় ঊর্মিলা তারপর ওকে বাগানে টেনে এনেছে। ছদ্ম গাম্ভীর্যে টেনে টেনে বলেছে, কাল বাবার কম্বল পেয়েছ, আজ গরম গাউন পেলে, আরো কত কি পাবে ঠিক নেই—আমারই কপাল মন্দ।

—কেন?

—কেন আবার কি, এসব কি তোমার পাবার কথা নাকি?

—বিজয় মেহেরার পাবার কথা?

—না তো কি?

—তা হলে শেষ পর্যন্ত এসব তার কাছেই যাবে।

—আর গেছে। মা-কে তুমি যা করে ফেলেছ…

ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও খিলখিল করে হেসে উঠল তোমার বয়েস আর দশটা বছরও বেশী হলে বা মায়ের কম হলে কি যে হত বোঝাই যাচ্ছে।

ঘাড় ফিরিয়ে বাপী বাংলোর দিকে তাকিয়েছে একবার। মহিলা বারান্দায় বসে। দূর থেকে মনে হয়েছে ওদেরই দেখছে। মেজাজে থাকলে মেয়েটার জিভে লাগাম নেই। মা-কে নিয়ে এরকম রসিকতা একবার বানারজুলিতেও করেছিল, বাপী ভোলেনি।

ঊর্মিলা হাসিমুখেই আবার বলেছে, বাবাকে আমি কত ভালবাসতাম জানো না—আজ তার এসব জিনিস মা তোমাকে নামিয়ে দিল দেখে কি-যে ভালো লাগছে।

বাপীর মুখে দুটো আবেগের কথাই এসে গেছল এরপর। নিজের মা কবে চলে গেছে মনেও নেই, আজ তোমার মাকে দেখে মনে হচ্ছিল আমার মায়ের মুখখানাও বুঝি ওই রকমই ছিল। এমন আর ওঁকে আগে দেখিনি।

খুশি মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে ঊর্মিলা বলেছে, বাবার তুলনায় মা বরাবরই গম্ভীর ছিল একটু কিন্তু ভারী মিষ্টি ছিল। অনেকদিন বাদে আজ আমিও আগের মতো দেখলাম। বাবা চলে যাবার পর থেকে একেবারে যাচ্ছেতাই ভাবে বদলে গেল। কাল রাতে তোমার কথা শোনার পর বুঝলাম এতটা কেন হল। আশ্চর্য বড় হবার পরেও আমাকে কিচ্ছু বলেনি।

পাঁচটা দিন বড় ভালো কেটেছে বাপীর। তার স্বাদ এখনো ভিতরে লেগে আছে। সর্বদা মনে হয়েছে বাইরে গুরুগম্ভীর কিন্তু ভিতরে স্নেহের আধার নিজের মাকেই যেন সামনে দেখছে। মহিলার অগোচরে তাকে দেখার জন্য থেকে থেকে দু’চোখ লালায়িত হয়ে উঠেছে। আর মেয়েটারও বুদ্ধি খুব, অথচ সরল বটে। এই বন্ধুর কাছে আর যেন রেখে-ঢেকে চলার কিছু নেই। তাকে সব বলা চলে, সর্বরকমে বিশ্বাস করা চলে। মায়ের কথায় সায় দিয়ে রাগিয়ে দিলে গলা ছেড়ে ঝগড়া করেছে, মহিলার সামনেই তাকে তেল দেওয়ার খোঁটা দিয়েছে, আর বেশি রাগলে উঠে চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকাতে এসেছে। কিন্তু ফাঁক পেলেই বাপীকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে, নয়তো নিরিবিলি কোথাও গিয়ে বসেছে।

ঊর্মিলার শোনা বা বলার প্রসঙ্গ একটাই। বিজয় মেহেরা। তার চিঠি পেয়েছে। চিঠির লেনদেন এখনো কি করে চলছে ও আর সেটা প্রকাশ করতে রাজি নয়। না, একবার ধরা পড়ে ঝগড়ুকে আর এর মধ্যে টানে নি। তার থেকে ঢের পাকা ব্যবস্থা করেছে। একখানা চিঠি পেতে বিজয়ের দশ-বারো টাকা খরচ হয়ে যায় শুনেই পাকা ব্যবস্থাটা কি বাপীর আঁচ করতে অসুবিধে হয়নি। কবে কখন চিঠি পাবে জেনে ও পাহাড় থেকে নেমে আসে, বিজয় মেহেরা লোক মারফৎ মিরিক থেকে চিঠি পাঠায়। ঊর্মিলার দিক থেকে কোন অসুবিধে থাকার কথা নয়, ডাকে চিঠি দিলেই হল। বিজয়ের চিঠির জন্য কবে কখন পাহাড় থেকে নামবে সেটা নিশ্চয়ই ঊর্মিলাই জানিয়ে দেয়।

বিজয় লিখেছে; ডলির বন্ধু বাপী তরফদার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল—আলাপ হয়েছে আর ভালোই লেগেছে। ঘুরেফিরে ঊর্মিলার উদ্‌গ্রীব জিজ্ঞাসা, বিজয়কে বাপীর কেমন লেগেছে—তার সঙ্গে কথা বলে কি মনে হয়েছে। নাক-মুখ কুঁচকে বাপী প্রথমে জবাব দিয়েছিল, থার্ড ক্লাস।

সঙ্গে সঙ্গে গাঁট্টা উঁচিয়ে ঊর্মিলা চোখ পাকিয়েছে।—এই, খবরদার! তারপরেই আবেগে উন্মুখ। ওর মতো ছেলেকে ভালো না লেগে পারে—খুব ভালো লেগেছে—তাই না?

—তুমি জোর করে বলালে, তাই।

—আঃ, বলো না!

বাপী স্বীকার করেছে ভালো লেগেছে।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ আগ্রহ।—মাকে বলবে তাহলে?

—সর্বনাশ! আমার এ-কূল ওকূল দু-কূল যাবে।

—এখন কে বলতে বলেছে, ও বিলেত থেকে ফিরে এলে মওকা বুঝে বলবে। বেশি আনন্দ হলে ওর হাত দুটো বাপীর মাথার ওপর চড়াও হয়। চুলের ঝুঁটি ধরে মাথাটা সামনে-পিছনে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেছিল, তুমি দলে আছ যখন আমাদের বিয়ে আর কেউ ঠেকাতে পারবে না—এ আমি খুব ভালো করে বুঝে নিয়েছি—বুঝলে বন্ধু? মা-ও না—

বোকা মুখ করে বাপী বলেছিল, আমাদের বিয়ে মানে তোমার আর কার?

জবাবে মাথায় ঠাস করে একটা থাপ্পড়।

পিকনিকে গিয়ে কি করে ওদের প্রথম দেখা হল আর সেয়ানা ছেলে কি করে গুটি গুটি এতটা এগিয়ে এলো মনের আনন্দে গলগল করে মেয়ে সেই গল্পও করেছে।—গোড়ায় গোড়ায় আমি ওকে বিশ্বাস করেছি না কাছে ঘেঁষতে দিতে চেয়েছি! নিজের মাকে কি আমি চিনি না? কিন্তু এমন নাছোড়বান্দা কি বলব— লেগেই থাকল। আর কি সুন্দর চিঠি—কোনো এনজিনিয়ার ছেলে এত ভালো চিঠি লিখতে পারে তুমি ভাবতে পারবে না। অসভ্যের ধাড়ী, কিন্তু চিঠিতে একটা যদি খারাপ কথা থাকত।

বাপীর মনে হয়েছিল দেখতে চাইলে সে-সব চিঠি অনায়াসে এই মেয়ে সামনে ফেলে দিতে পারে। কারণ আরো যা বলেছে তা বোধ হয় এই বেপরোয়া মেয়ের দ্বারাই সম্ভব। গেলবারে বানারহাটে দু’জনের ঝগড়ার কথা। ও ছেলে যেমন গোঁয়ার তেমনি অবুঝ। চুপচাপ বিয়েটা করে রেখে তারপর বিলেত যাবে। তা যে হয় না ওকে কিছুতেই বোঝানো যায় না। ফলে সত্যি সত্যি ঝগড়া দু’জনের।—কি পাজী আর কত অসভ্য জানো? যদিবা বোঝানো গেল, পাঁচ—পাঁচটা ভালো করে চুমু খাবার আগে কিছুতেই ঠাণ্ডা হবে না।

মুখ লাল করে মেয়ে হেসে গড়াগড়ি।

বাপীর কান গরম। বুকের তলায় মোচড়। ওকে বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে সে নিজের ভিতরে ভিখিরিটাকে চাবুকের মুখে রেখেছে। বেপরোয়া মেয়ের এমন সরল বিশ্বাসের মর্যাদা দেবার জন্য ওর মায়ের মন সত্যি ফেরাতে পারবে কিনা কে জানে। কিন্তু চেষ্টা যে করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ওই পাঁচ দিনের মধ্যে দু’দিন সকালে ভ্যান নিয়ে গায়ত্রী রাই বানারজুলি থেকে ঘুরে এসেছে। কেন বা কি দরকারে যাওয়া কিছুই বলে যায়নি। সকাল আটটায় বেরিয়ে এগারোটার মধ্যে ফিরে এসেছে। স্নেহবশত দিন কয়েক আরামে কাটিয়ে যাবার জন্য মহিলা বাপীকে এখানে বসিয়ে রেখেছে, এ একবারও মনে হয়নি। বাপীর ধারণা তার অনুপস্থিতিতে ওকে এখন চিফ—একজিকিউটিভের মুখোমুখি হতে দিতে চায় না। তার সঙ্গে কথা বলার জন্যেই নিজে দু’দুবার গেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু কি কথা হতে পারে বাপী মাথা ঘামিয়ে অনুমান করতে পারেনি।

বিছানা আর ভালো লাগল না। উঠে মুখ হাত ধুয়ে এলো। বাইরে পাহাড়ের দিকটা ধূসর কুয়াশায় ছাওয়া। ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা। পশমের ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে এলো। সামনের দিকটায় কুয়াশার সঙ্গে কাঁচা রোদের বোঝাবুঝি চলেছে। কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। বাপী বাংলো থেকে নেমে এলো। ঘাসের মাথায় আর মেহেদীর পার্টিশনে শিশিরের ফোঁটাগুলো রোদের ছোঁয়া পেয়ে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। শীত পছন্দ নয় বাপীর, কিন্তু আজ অন্তত অদ্ভুত ভালো লাগছে।

গেট খুলে এগলো। পাশের গেটে এসে দাঁড়ালো। এই বাংলো নিঝুম এখনো। ঘুম ভাঙিয়ে ঊর্মিলাকে যদি হিড়হিড় করে টেনে বার করে আনা যেত, বেশ হত। কিন্তু বাপী জানে এই ভালো-লাগা-সকালে যে মুখখানা এক্ষুনি দেখার লোভ সে—মুখ ঊর্মিলার নয়। তার মায়ের। ওর ভিতরে যে আর এক কাঙাল সেঁধিয়ে আছে ক’দিন আগেও জানত না। স্নেহের কাঙাল। বাপীকে আরও সাবধান হতে হবে। মহিলা বুঝে ফেললে কোন মূর্তি ধরবে কে জানে। ভালোর কানাকড়িও ভালো। যেটুকু আপনি আসবে সেটুকুই ভালো।

গেট ছেড়ে বেশ অনেকটা পথ এগিয়ে গেল। তারপর রাস্তার পাশে এসে জঙ্গল দেখতে লাগল। থেকে থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে জঙ্গলের বাতাস ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের মতো বেরিয়ে আসছে। সামনের গাছগুলোর বিবর্ণ পাতা থেকে টপটপ শিশির পড়ছে। একটা নীলকণ্ঠ-পাখি অদূরের বাবলার ডালে তপস্বীর মতো বসে। একজোড়া ফিঙে সকালের আলোয় হাবুডুবু খেয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। বাপী চেয়ে চেয়ে দেখছে। ভালো-লাগার স্বাদটুকু যেন চোখের ভিতর দিয়ে আরো গভীরে ছড়াচ্ছে।

জঙ্গলেই ঢুকে পড়ত হয়তো। অদূরে পিপের শব্দ কানে আসতে ফিরে তাকালো। তারপরই সচকিত। রণজিৎ চালিহার জিপ। নিজেই চালিয়ে আসছে। বাপীকে দেখেছে। কিন্তু লোকটার হঠাৎ অমন হাঁ হয়ে যাওয়ার কারণ কি বাপী চট করে ঠাওর করে উঠতে পারল না। জিপটা সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ধাক্কা লোকটার দু’চোখে লেগে আছে এখনো।

তক্ষুনি বাপীর খেয়াল হল, কি দেখে এত অবাক। গায়ের গরম ড্রেসিং গাউনটা। খুবই চেনা নিশ্চয়। এটা শেষ পর্যন্ত এই গায়ে এসে উঠতে পারে ভাবাও শক্ত বোধ হয়। সামলে নিতে সময় লাগল না তা বলে।

—হ্যালো! গলার স্বরও অন্তরঙ্গ।—জঙ্গলের শোভা দেখছ? আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম আর ঘুম থেকে উঠেছ কিনা ভাবছিলাম।

এ বলে কি! গায়ত্রী রাই এরই মধ্যে এমন কি দাওয়াই দিয়ে গেল যে এই লোকের হাসি-হাসি মুখে এমন কথা!

—কাম অন বয়। দরাজ আহ্বান—তোমার সঙ্গে কথা শেষ করেই আবার আমাকে ছোটাছুটির মধ্যে পড়তে হবে।

চুপচাপ জিপে উঠে বাপী তার পাশে বসল, স্টার্ট দিয়ে রণজিৎ চালিহা ঘাড় ফিরিয়ে আর একবার দেখে নিল ওকে। বিশ-তিরিশ গজ এগিয়ে সামনের দিকে চোখ রেখে হালকা গলায় জিজ্ঞাসা করল, এই পোশাক তোমাকে মিসেস রাই প্রেজেন্ট করেছেন নিশ্চয়?

সকালের ভালো লাগার সুর তাল মান সব একসঙ্গে কেটে গেল। বাপী ছোট্ট জবাব দিল, হ্যাঁ।

—আই অ্যাম সো গ্ল্যাড। ইউ ডিজারভড ইট। ওটা যে পরত সে আমার কত কাছের মানুষ ছিল তুমি জানো না বোধ হয়।

ঘাড় ফিরিয়ে ভালো করে মুখখানা দেখতে ইচ্ছে করছিল বাপীর। তিন চার মিনিটের মধ্যে জিপ তার গেটের সামনে। তার আগে চালিহা আর সেই সঙ্গে বাপীও আগের বাংলোর দিকে চোখ ফিরিয়েছে, সকাল তখন সাতটা বেজে মিনিট কতক। বারান্দা মুখো দরজাই খোলা হয়নি এখনো।

বাপী আগে, চালিহা পিছনে। বারান্দায় উঠে চেয়ার এগিয়ে দিতে তেমনি সপ্রতিভ অন্তরঙ্গ সুরে চালিহা বলল, দাঁড়াও তোমার কোয়ার্টারস দেখি আগে, এখন পর্যন্ত দেখাই হয়নি।

বাপীর সঙ্গে ভিতরটা দেখে বাইরে এসে বসল—ফর সিঙ্গল ইট্স ফাইন। বোসো—

—একটু চা খাবেন?

—চা খাই না। তোমার খাওয়া হয়েছে?

—পরে হবে। চেয়ারটা একটু টেনে বাপী মুখোমুখি বসল।

রণজিৎ চালিহা এবারে ঘটা করে চেয়ে রইল একটু। চোখে কৌতুক, ঠোঁটে হাসি। মজার কিছু ঘটে যাবার পর রসিয়ে দেখার মতো। বলল, মিসেস রাইয়ের সঙ্গে দু’দিন আমার অনেক কথা হয়েছে, সবটাই তোমার কথা বলতে পারো। তুমি অত্যন্ত হার্ট হয়ে কাজ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছ তাও শুনেছি, বাট নাও উই আর রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ। এরকম যাচাইয়ের কেন দরকার হয়েছিল, হাতেকলমে এবার থেকে যে কাজ তুমি করবে, তাই থেকে নিজেই বুঝে নিতে পারবে।…তাছাড়া বেই-এর সেই আট হাজার টাকা ব্যাঙ্কে তোমার অ্যাকাউন্টেই জমা পড়েছে যখন বুঝতেই পারছ যাচাইয়ের ব্যাপারে ক্রুয়েল হলেও হাউ জেনারাস্ আওয়ার লেডি ক্যান্ বি।

বাপী হতভম্ব। আট হাজার টাকা ব্যাঙ্কে তার নামে জমা পড়েছে! সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক। ও কিছুই জানে না বুঝলে এই লোক আবার অবাক হবে। দেখছে। ফর্সা মুখে মোলায়েম হাসি। ভদ্র, অন্তরঙ্গ। তবু ভিতরের মানুষটাকে বুঝতে বাপীর খুব অসুবিধে হচ্ছে না। সুন্দর আর নরম খাপের ভিতরের তীক্ষ্ণ ছোরা চোখে দেখা না গেলেই বা। অত মদ না খেয়ে আর একটু মাথা খাটাতে পারলেই যে গায়ত্রী রাইয়ের জীবনের খাতা থেকে বাপী তরফদারের নামটা বরাবরকার মতো মুছে দেওয়া যেত—সেই খেদ ভদ্রলোকের হাসিমাখা চোখের তারার ভিতর দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে

—সো? বাপী, নো হার্ড ফিলিং—ফ্রম নাও অন্ উই আর ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইকোয়ালস—আই অ্যাম্ জাস্ট সিনিয়ার–গেট্ মি?

বাপী এবার হেসে মাথা নাড়তে রণজিৎ চালিহা দরাজ হাত বাড়িয়ে ওর হাত ঝাঁকালো। তারপর চটপট কিছু কাজের কথা। আগামী পরশু সে আসাম চলে যাচ্ছে। এবারে মাস তিনেকের আগে হয়তো ফেরা সম্ভব হবে না। এবারকার এক্সপ্যানশন প্রোগ্রাম সব ওদিকে। শিলঙে নতুন ঘাঁটি করার ইচ্ছে আছে। মণিপুরেরও বাজারে ভালো খবর আছে, কিন্তু একলা আর কত দিক সামলানো সম্ভব? এবারে এদিকের সব দায়িত্ব কাঁধে নেবার মতো একজন তাদের সঙ্গে এসে গেছে যখন-চালিহার এবারে সমস্ত আসামের ফিল্ড দেখে শুনে বুঝে আসার ইচ্ছে। তার বিশ্বাস ওটাই একদিন এই ব্যবসায় মেইন সেন্টার হবে। এদিকের কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে মিসেস রাই সবই জানেন। তবু আজ আর কাল বাপী তার সঙ্গে ঘণ্টা দু’তিন করে বসে সব বুঝে নিতে পারে।

হাতঘড়ি দেখল। আটটা বাজে। এবারে ওঠার তাড়া। বাপী জিজ্ঞাসা করল, মিসেস রাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যাবেন না?

মুখের দিকে না চেয়ে শব্দ না করে হাসল। যার অর্থ, তোমার অনেক কিছু এখনো জানতে বুঝতে বাকি বাছা। কিন্তু জবাব অমায়িক।—এ দু’দিন আমাকে কম করে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে বসতে হবে তার সঙ্গে—আমার লাঞ্চ আর ডিনারও এ দু’দিন তাঁর সঙ্গেই

বাপীকে সঙ্গে আসার ফুরসৎ না দিয়ে নেমে গিয়ে জিপে উঠল। ওর উদ্দেশে হাতটা নেড়ে দিয়ে জিপ ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল।

বাপী বারান্দায় এসে বসল আবার। পাহাড়ে গিয়ে এক দুপুরে ঊর্মিলার চোখে ধুলো দিয়ে এবারেও বাপী সেই জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছিল আর সেই গাছটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল…যেখানে বসে এক ন্যাঙটো সাধু তাকে আগে বাড়তে বলেছিল, আর বলেছিল পেয়ে যাবে। ফের তার দেখা পাবে আশা করেনি। পায়ওনি। তবু গেছল।

…এগিয়েই চলেছে বটে। এমন দুড়দাড় এগনোর ভুইফোঁড় বরাত নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য।

মনে মনে যা আঁচ করেছিল তাই। ড্রাইভার বাদশা এসে খবর দিল, ব্রেকফাস্ট রেডি, মেমসায়েব ডাকছেন। ঘরে এসে বাপী গায়ের গাউনটা খুলে ফেলল। তার এগনোটা বাইরে চট করে বেশি প্রকট না হওয়াই ভালো। একটা সোয়েটারের ওপর আলোয়ান চড়িয়ে নেমে এলো!

তখন পর্যন্ত বারান্দায় গায়ত্রী রাই একাই বসে। নাকে সোনালি ফ্রেমের চশমা এঁটে খবরের কাগজ পড়ছে। পাশে আরো গোটাকতক পুরনো খবরের কাগজ। এ ক’দিন কাগজের সঙ্গে যোগ ছিল না, তাই আট-দশ দিনের কাগজ একসঙ্গে নিয়ে বসেছে। টেবিলে তিনজনের তৈরি ব্রেকফাস্ট কোয়েলা সাজিয়ে দিয়ে গিয়ে থাকবে।

—বোসো। চালিহা এসেছিল? খবরের কাগজে চোখ

এমন একখানা খবর কি-ভাবে পেশ করবে ভাবছিল বাপী। প্রশ্ন শুনেই বোঝা গেল চিফ একজিকিউটিভের সাতসকালে নিজে ড্রাইভ করে আসার পিছনেও মহিলার কেরামতি কিছু আছেই। আসবে যে সেটা তার জানাই ছিল। আরো একটু ব্যতিক্রম বাপীর কান এড়ালো না। এযাবৎ ওর কাছে চিফ একজিকিউটিভের নামের সঙ্গে ‘মিস্টার’ জুড়ে তার মর্যাদা উঁচিয়ে রাখা হত সর্বদা। এই প্রথম তার মুখে শুধু চালিহা শোনা গেল।

—এসেছিলেন।…আপনি তাঁকে আসতে বলেছিলেন?

এখনো খবরের কাগজের ওপরেই চোখ।—আসতে বলিনি। যা বলেছি, বোকা না হলে আসার কথা। বোকা নয় জানোই তো। পাতলা ঠোটের ফাঁকে হাসির আভাস স্পষ্ট হল।—তোমার বেশ সকালে ওঠার অভ্যাস তাও তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। খবর পেয়ে কাল রাত ন’টায় এসেছিল, তখন আর তোমাকে ডাকিনি।

বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল তার দিকে। খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুললে ওই মুখের দিকে চেয়ে এমনি ঠায় বসে থাকতে পারে।…পাহাড়ে বাংলোর বাগানে বেড়াতে বেড়াতে ঊর্মিলা বলেছিল, তার মা বরাবরই গম্ভীর ছিল, কিন্তু ভারী মিষ্টি ছিল। হালকা গাম্ভীর্যের আড়ালের এই মিষ্টি দিকটাই দেখার চেষ্টা বাপীর। লোভও।

খবরের কাগজ সরিয়ে রাখল। টেবিলে কি দেওয়া হয়েছে একবার দেখে নিয়ে নিজের দুধ আর কর্নফ্লেকস-এর বাটি সামনে টেনে নিয়ে বলল, আরম্ভ করো, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

—ডলি কোথায়? খুব সহজে আজ এই নামটাই মুখে এসে গেল, বন্ধুত্বের যে ভিতের ওপর ওরা দাঁড়িয়ে তাতে কোনো দুর্বলতার ফাটল আর যেন ধরতেই পারে না।

—ঠেলে তোলা হয়েছে। মুখহাত ধুয়ে আসছে। এই মেয়ের গরম খাওয়া কপালে নেই, তুমি শুরু করো। আরো শীত চড়লে নটার আগে ঘুম ভাঙবে না দেখবে।

এখানে নয়, পাহাড়ের বাংলোতেও ঊর্মিলা ব্রেকফাস্টের মাঝখানে এসে হাজির হত। তারপর তার সকলের সঙ্গ ধরার তাড়া।

চামচে করে বাটির খাবার নাড়তে নাড়তে নিস্পৃহ মুখে গায়ত্রী রাই আবার জিজ্ঞাসা করল, চালিহা কি বলল?

—বললেন নো হার্ড ফিলিং এখন থেকে—দু’জনেই বন্ধু আমরা—আর সমান সমান, তবে তার মধ্যে উনি সিনিয়র।…আমার অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে আপনি আট হাজার টাকা জমা করে দিয়েছেন?

গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটে আবার একটু হাসি ঝুলছিল। টাকার কথা শুনেই পিছন ঘুরে দেখলেন একবার। সস-স!—কিপ ইট, মেয়ের কানে গেলে ঠাট্টা শুরু করে দেবে—এমনিতেই খুব ইয়ারকি দিচ্ছে এখন।

—কিন্তু আমার খারাপ লাগছে খুব—

আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল। বাধা পড়ল।

গুড মর্নিং মা। ঊর্মিলার লম্বা ঘুমের দরুন ফোলা-ফোলা মুখ মুছে আসা সত্ত্বেও ভেজা-ভেজা লাগছে। শুকনো ঝাঁকড়া চুলে মুক্তোর মতো কটা জলের ফোঁটা বসে আছে। গায়ে পা পর্যন্ত ঢাকা গরম হাউস কোট। বাপীর কাছে এসে দু’ হাত কোমরে তুলে দাঁড়ালো।—ঠিক জানি তুমি এসে জুটবে। আসকারা পেয়ে একেবারে মাথায় ওঠার মতলব—কেমন?

নিরীহ মুখে বাপী ফিরে জিজ্ঞেস করল, কার মাথায়?

—কি? আমার মাথার দিকে এগোলে তোমার মাথা আস্ত থাকবে? চেয়ার টেনে নিয়ে একটা টোস্টের আধখানা কামড় দিয়ে ছোট মেয়ের মতোই চিবুতে বসল।

বাপী বলল, মায়ের তো মাথার দিকে এগনো যায় না, পায়ের দিকে ঝুঁকতে হয়।

সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে একটা আঙুল তুলে আর মায়ের দিকে তাকিয়ে জোরালো প্রতিবাদের চেষ্টা। কিন্তু রুটির সঙ্গে মুখে আধখানা ওমলেট গুঁজে দেবার ফলে কথার বদলে গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুলো শুধু। গায়ত্রী রাই ধমকে উঠল, এই মেয়ে—গলায় আটকাবে!

মুখের জিনিস গোগ্রাসে তল করে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ফ্ল্যাটারি মা, স্রেফ ফ্ল্যাটারি—এই করেই তোমাকে ঘায়েল করেছে।

—মা অত সহজে ঘায়েল হয় না, তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে চা-টা ঢাল, জুড়িয়েই গেল।

কিন্তু মেয়ের কোনো তাড়া নেই। এই সকালে বাপীকে দাপটে রাখার মেজাজ যেন। আর এক দফা ডিম রুটি তল করে ঝাঁঝালো গলায় বলল।—এই ছেলে, কাল রাতে কোয়েলা তোমার ডিনার নিয়ে গেছল?

—গেছল।

—আজ আর কাল রাতেও যাবে, পরশু থেকে রাতে তুমি এখানে খেতে আসবে। তোমার সকালে আপিস বলে কোয়েলা শুধু রোজ লাঞ্চটা দিয়ে আসবে। কাল রাতেই কোয়েলার ওপর মায়ের এই হুকুম হয়ে গেছে।…আর মনে হয় তোমাকে খরচ টরচও কিছু ধরে দিতে হবে না।

এই গোছের প্রস্তাব আগেও এসেছে। বাপী নাকচ করেছে। শোনার পর এখনো বিব্রত বোধ করছে না এমন নয়। কিন্তু আর আপত্তি করাটা আরো বেশি বেমানান।

গম্ভীর টিপ্পনীর সুরে গায়ত্রী রাই বলল, আর ওর রেঁধে খাওয়া নিয়ে তুই কি বলেছিলি?

—বলবই তো। বাপী রান্নায় বসেছে দেখলে আমার মেয়েছেলের মতো লাগে। তারপরই খিলখিল হাসি। হাসির দমকে টেবিলের ডিশ ওলটানোর দাখিল।—সত্যি মা, সবই হল, একটু কেবল বাকি, বেচারী কোয়েলা…

মেয়ের দিকে চেয়ে অল্প অল্প হাসছে তার মা-ও। কাকে ছেড়ে কাকে দেখবে বাপী। গায়ত্রী রাইয়ের মুখের ওপরেই হঠাৎ দু’ চোখ হোঁচট খেল একপ্রস্থ। মেয়েকে জব্দ করার মতোই কিছু যেন বলতে পারে, কিন্তু বলছে না। কি কি কি? বাপীর মন অনেক সময় অনেক কিছু তাকে আগাম বলে দেয়। সেই মনের দিকে তাকাবে?

না। এমন প্রশ্রয় দেবে না। তাছাড়া গায়ত্রী রাইয়ের মুখের দিকে বা চোখের দিকে চেয়ে চকিতে যা মনে হয়েছে তা সত্যি হোক মিথ্যে হোক, বাপীর কাছে তার কানাকড়িও দাম নেই। যত সব আজগুবী কল্পনা।

কোয়েলা খাবারের ডিশগুলো নিতে আসতে গায়ত্রী রাই চিরাচরিত গাম্ভীর্যের খোলসে ঢুকে গেল। বাপীকে জিজ্ঞাসা করল, চালিহা আর কি বলল?

জবাব দেবার আগেই ঊর্মিলার আর এক দফা খাবি খাওয়ার দাখিল।—এর মধ্যে আঙ্কল-এর সঙ্গে কখন দেখা হল আবার?

গায়ত্রী রাইয়ের পাতলা ঠোটে হাসির দাগ পড়ল আবার। কোয়েলা চলে যেতে জবাব দিল, আজ ভোরেই বাপীর বাংলোয় এসে ওর সঙ্গে দেখা করে গেছে।

ঊর্মিলা একবার বাপীর দিকে তাকালো, তারপর বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে।—সত্যি মা, তুমি একখানা মেয়ে বটে!

বাপী জানালো, আজ আর কাল এদিকের সব কাজ বুঝিয়ে দেবেন বললেন। আর আসামের এক্সপ্যানশন প্রোগ্রামের আভাস দিলেন…তাঁর ধারণা, কালে দিনে আসামই আমাদের বিজনেসের মেইন সেন্টার হবে।

খুব ধীর ঠাণ্ডা গলায় গায়ত্রী রাই বলল, কালে দিনে আমরা আসামকে সারেন্ডার করব ধরে নিয়ে তুমি এদিকের অর্গানিজেশন কতটা মবিলাইজ করতে পারো দেখো! তাকে মুখে কিছু বলার দরকার নেই। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, মাস তিনেকের আগে সে ফিরছে না, এ সময় পর্যন্ত জিপটা তুমি ব্যবহার করতে পারো। এর মধ্যে ড্রাইভিংটাও শিখে নাও।

গায়ত্রী রাই খবরের কাগজ টেনে নিল। ঊর্মিলার মুখে চাপা আনন্দের ছটা, চোখে চকিত চপল ইশারা। বাপী জিপের দখল পেলে আর ড্রাইভিং শিখলে ওরই যেন মস্ত সুবিধে।

উঠে পড়ল।—মা তুমি তো এখন বেরুচ্ছ না, আপাতত আমি তোমার ভ্যানটা একটু ব্যবহার করছি—একটু ঘুরে আসব, বেশি দেরি করব না।

অনুমতির অপেক্ষা না রেখে ভেতরে চলে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রকের ওপর গরম জামা চাপিয়ে বেরিয়ে এলো। ভালো করে মাথা আঁচড়ানোরও সময় নেই। বাপীর উদ্দেশে একটু হাত নেড়ে দিয়ে মায়ের চোখ এড়িয়ে টক-টক করে নেমে গেল।

ভ্যানটা চোখের আড়াল হতে গায়ত্রী রাইয়ের ঠাণ্ডা দু’ চোখ বাপীর মুখের ওপর।—কোথায় গেল বুঝতে পারছ?

বাপীরই ফ্যাসাদ। ঢোঁক গিলে জবাব দিল, বোধ হয় রেশমার ওখানে…

রাগ না বিরক্তি না, আরো একটু গম্ভীর শুধু।—ও নেই ভালোই হল। তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।…মিরিকে বিজয় মেহেরার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে বলেছিলে, তার সম্পর্কে তোমার নিজের কি ধারণা?

বিপাকে পড়লেও বাপী সত্যি জবাবই দিল।—ধারণা ভালই।

—ডলির মুখ চেয়ে কিছু বলার দরকার নেই, তুমি আমার সঙ্গে কথা কইছ এই মুখ সদয় নয় একটুও।—কতটা সময় দেখেছ তাকে যে এক কথায় সার্টিফিকেট দিয়ে দিলে?

আবারও আমতা আমতা করে বাপী জবাব দিল, আমি তো ধারণার কথা বললাম…কথাও অবশ্য বেশ খানিকক্ষণ হয়েছে।

—কি কথা?

—নিজের প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা বলছিল।

—কি প্ল্যান-প্রোগ্রাম, আরো ডিগ্রি পকেটে নিয়ে এলেও আমি চাইলে এই ব্যবসায় ভিড়বে?

—ভিড়বে না বলল।

গায়ত্রী রাইয়ের চাউনি স্থির, তীক্ষ্ণ। এবারে এই জবাবই আশা করেছিল। একটু চুপ করে থেকে আবার জিগ্যেস করল, দেখে কি মনে হল, ড্রিঙ্ক ট্রিঙ্ক বেশি করে?

—সিগারেট একটু বেশি খায় দেখলাম। ড্রিঙ্ক-এর কথা আমিই তুলেছিলাম। মাত্রা ছাড়িয়ে খায় না বলল।

ওই মুখের যে কঠিন রেখাগুলো খুব চেনা বাপীর সেগুলোই দাগ কেটে বসতে লাগল।— গোড়ায় কারো মাত্রা ছাড়ায় না, শেষে কেউ মাত্রার মধ্যে থাকেও না। শোনো, তোমার কথায় আপাতত আমি চুপ করে আছি—ট্রাই টু গেট হার অফ দ্যা হুক এনিহাউ, যে নেশা আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে সে নেশা যে ছোঁবে তাকে আমি আমার মেয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেব না! পাহাড়ে তুমি আমাকে বলেছিলে, সেই ছেলেকে হটানোর রাস্তা বার করা যায় কিনা তার সঙ্গে দেখা করার পিছনে সে চিন্তাও তোমার মাথায় ছিল।…তিন বছরে আপনি যদি সব মিটে যায়, ভালো—নয়তো মাথায় রেখো।

মহিলার মুখখানা আবারও খুব ভালো করে দেখে নেবে বাপী? যা বলল তার পিছনে তার কোনো ইঙ্গিত খুঁজবে?

চিন্তাটা মন থেকে ঝেঁটিয়ে সরালো বাপী।

.

ঘণ্টা দুই কাজ বোঝালো রণজিৎ চালিহা। সবই যে সুড়ঙ্গ পথের কারবার এমন নয়। অনেক রকম মাদক জিনিস লেনদেনের বৈধ পরোয়ানাও আছে। সব বড় পাইকারি খদ্দেরেরই লাইসেন্স আছে। হোলসেল ডিলার হিসাবে তাদের প্রাপ্য মাল সরবরাহের ব্যাপারে কোনো বাধা নেই। আবার কারচুপির বড় ফাঁকটাও সেইখানেই। প্রাপ্যর দ্বিগুণ নিচ্ছে কেউ, কেউ তিন গুণ, কেউ পাঁচ গুণ। বাড়তি সাপ্লাইয়ের এই বিশাল ব্যাপারটা চলছে মুখের কথায়। কাগজ-কলমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে টাকা গুনে নিলে মাল দেবার পরে রাই অ্যান্ড রাই ডিলারের দায় শেষ। পাইকিরি খদ্দেররা এই বাড়তি মাল কোন পথে কিভাবে পাচার করছে তা নিয়ে রাই অ্যান্ড রাইয়ের মাথাব্যথা নেই। এই বাড়তি মাল বাঁধা দামের কিছু কমে ছেড়ে কড়কড়ে নগদ টাকা গুনে নিয়ে আসতে হবে। নেপাল, সিকিম, ভুটান, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, কুচবিহার আর বিহারের দ্বারভাঙ্গায় সমস্ত রকম মাল চালানের বড় ঘাঁটি। ব্যবসায়ের তারাই আসল পাইকিরি খদ্দের, সব দেনদেন এখন থেকে রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার বাপী তরফদারের মারফৎ হবে সকলের কাছে এই মর্মে অফিসিয়াল চিঠিও চলে গেছে।

সেই সব অফিসিয়াল চিঠির কপি দেখাবার সময় বাপীর মনে হল ক্রূর খেদে রণজিৎ চালিহার দু’ চোখ ছুরির ফলার মতো চিকচিক করছে। আশ্চর্য কিছু নয়। এই বাঁকা পথে যে পরিমাণ টাকা আমদানির আভাস পেল, বাপীরই কান-মাথা গরম হবার দাখিল।

সাড়ে বারোটার একটু আগে রণজিৎ চালিহা বেরিয়ে গেল। মিসেস রাইয়ের ওখানে লাঞ্চ আর আলোচনা। বাপীও সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পকেটে চেকবই আর পাশবই। মানুষ বশ করার একটাই তুরুপের তাসের ওপর তার বিশ্বাস। চা-বাগান এলাকায় ব্যাঙ্ক। খোঁজ নিয়ে দেখল, কদিন আগে তার সেভিংস অ্যাকাউন্টে আট হাজার টাকা জমা পড়েছে। চেক কেটে নগদ এক হাজার টাকা তুলল তার থেকে।

বিকেলে আপিস-ফেরতা সোজা রব্বানীর ডেরায়। এই কটা দিন বাপীর অপেক্ষায় ওরা বোধ হয় উন্মুখ হয়ে ছিল। আবুর আর তর সয় না।—কি ফয়সলা হল—ভালো কি মন্দ?

দুলারিও শোনার আশায় উদ্‌গ্রীব। বাপী জবাব দিল, আমি তো বলেই গেছলাম, যে ফয়সলা হোক ভালো হবে। পকেট থেকে হাজার টাকার বান্ডিলটা বার করে দুলারির হাতে ধরিয়ে দিল।—এ টাকাটা সাবধানে তুলে রাখো, হাজার টাকা আছে এখানে।

টাকার ধাক্কা দেখার জিনিসই বটে। দু’জনেই ওরা হাঁ। আবুরই প্রথম বিস্ময়ের বাঁধ ভাঙল।—এ কিসের টাকা? কার টাকা?

—তোমাদের আর রেশমার। এর থেকেই বুঝতে পারছ ফয়সলাটা কেমন হল। ফয়সলার পর ম্যানেজারকে জব্দ করার জন্যেই বোধ হয় আমাকে কিছু থোক টাকা দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সকলের ওপর দিয়েই চিন্তা-ভাবনার দুর্ভোগ গেছে, তাই সব আর একলা ভোগ করি কেন, তোমাদেরও কিছু ভাগ দিলাম। এরপর মেজাজ সাফ রেখে আমরা কোমর বেঁধে কাজে না নামলে অন্যায় হবে।…এর থেকে শ’আড়াই টাকা রেশমাকে দিও আর তাকেও এই কথা বোলো। কিন্তু মেমসায়েবের মেয়েকে যেন এসব কিছু না বলে সাবধান করে দিও, সেই মেয়ে তাহলে মওকা বুঝে আবার ওকে নিয়ে কোন্ রাস্তায় হাঁটবে ঠিক নেই— কক্ষনো যেন না বলে। আমি বারণ করেছি জানিয়ে দিও।

আবু হঠাৎ কোমর বেড়িয়ে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে বাপীকে শূন্যে তুলে দু’তিনটে পাক খেয়ে নিল। আনন্দ আর খুশি ধরে না—তোমার দিল বটে একখানা বাপীভাই। বাপীভাই তুমি কি জাদু জানো, আমাকে বলো— শীগগীর বলো।

দুলারির হাসি-উপচনো মুখখানা বেশ সুন্দর দেখছে বাপী।

.

ঘরের কাছে পৌঁছুতে শীতের সন্ধ্যা পার। গায়ত্রী রাইয়ের বাংলোয় সব আলো জ্বলছে। রাস্তার অন্ধকার দিকটা ঘেঁষে পাশ কাটানোর ফাঁকে বাপী একবার দেখে নিল। গায়ত্রী রাই আর রণজিৎ চালিহা খুশী মেজাজে কথা কইছে। ঊর্মিলা হয়তো ভিতরে।

নিজের বারান্দা আর ঘরের আলো জ্বেলে গায়ের গরম জামাটা খুলে বাপী সোজা কম্বলের নিচে ঢুকে গেল। রাতে রান্নার তাড়া নেই। ওবাড়ি থেকে ডিনার আসবে। পরশু চালিহা চলে যাবে, রাতে তখন ওকেই যেতে হবে।

বাপীর ধারণা এই রাতে শুধু ডিনার নয়, সেই সঙ্গে হয়তো ঊর্মিলাও আসবে। হাসিই পেল। মেয়ে ওকে একজনের কাছে এগিয়ে দেবার মানুষ ভাবছে। আর তার মা ওকে সেই একজনকে দূরে হটাবার মানুষ ভাবছে।

ডিনারের সঙ্গে নয়, বারান্দা আর ঘরের আলো দেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুপদাপ পা ফেলে ঊর্মিলা এসে হাজির।

—মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি কেমন মিষ্টি? কত মিষ্টি?

আচমকা প্রচণ্ড একটা ঘা খেয়েই যেন আস্তে আস্তে উঠে বসল বাপী। ঊর্মিলার মুখে দুষ্টুহাসি ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে।

—কি ব্যাপার?

—কি ব্যাপার? তেড়ে সামনে এগিয়ে এসো ঊর্মিলা।—সেই বাচ্চা বয়েস থেকে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ, এখন ধরা পড়ে কি ব্যাপার?

বাতাস টানতেও বুকে লাগছে বাপীর।—তোমাকে কে বলল?

—রেশমা। অনেক দিন আগে আবুর মুখে জঙ্গলসাহেবের মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলেবেলার জমাটি প্রেমের কাণ্ড-মাণ্ড শুনেছিল। আবুটাকে ধরতে পারলে বেশ হত, তার নাকি ধারণা এখনো তুমি সেই মেয়ের প্রেমে মজে আছ। সেটা যে সত্যি আমিও হলপ করে বলতে পারি—নইলে তিনকূলে তোমার কেউ নেই বলো অথচ আমাদের বাংলোয় এসে কাগজে কলকাতার প্লেগের খবর পড়ে মূর্ছা যেতে বসেছিলে কার ভাবনায় মশাই? আমাকে সব বলবে কি বলবে না, জানতে চাই—না বললে মাকে দিয়ে জিগ্যেস করাবো।

আবুর দোষ নেই, ছেলেবেলার গল্প করতেই পারে। তবু মনে মনে বিষম বিরক্ত বাপী।—কি বলব যদি শোনো এ ক’বছরের ফাঁকে সেই মেয়ের কাছে আর কেউ এসে গেছে, আর আমি দূরে সরে গেছি—তাহলে?

বাপীর মুখ দেখে হোক বা কথা শুনে হোক ঊর্মিলা ভেবাচাকা খেল একটু। তারপরেই ঝলসে উঠল।—মরদ হলে সেই ছেলে বা মেয়ের একটাকে তুমি গলা টিপে মারবে!

—তুমি তাই করবে ঠিক করেছ?

থতমতো খেল।—তার মানে?

—মানে ঘরে গিয়ে ভাবোগে যাও। আমি বেজায় ক্লান্ত এখন।

আবার শুয়ে পড়ার ফাঁকে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। বারান্দার আলো জ্বলছে। বেগতিক ঊর্মিলা পায়ে পায়ে প্রস্থান করল।

সঙ্গোপনের ক্ষতটা কেউ সজোরে আঁচড়ে দিয়ে গেল। বুঝে দিক বা না বুঝে দিক, রক্ত ঝরবেই। দিনের শুরু থেকে আজ খুশির পথে পাড়ি জমিয়েছিল বাপী। শেষটুকু এমন হবে ভাবেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *