সোনার হরিণ নেই – ৩৯

উনচল্লিশ

এই সকালের একটা সামান্য ব্যাপার মনে পড়ল বাপীর। গাড়ি চালাচ্ছিল। তখন ঝমঝম বৃষ্টি। জোর বাতাস। সামনের কাঁচের ওধারে ওয়াইপারটা উঠছে নামছে। তা সত্ত্বেও কাঁচটা থেকে থেকে ঝাপসা ধূসর হয়ে যাচ্ছিল। ফলে সামনের সবও ঝাপসা। বাপী এক-একবার হাত দিয়ে হিমাভ কাঁচের খানিকটা ঘষে দিচ্ছিল। তক্ষুনি শুধু ওইটুকু জায়গার ভিতর দিয়ে সামনের যা-কিছু সব তকতকে পরিষ্কার

সেই গোছেরই কিছু হয়ে গেল। ভিতরের কোনো খুব আবছা আর্দ্র জায়গায় হঠাৎ ঘষা পড়েছে। তার ওধারে ঝকঝকে তকতকে কারো অস্তিত্বের ঝিলিক। দু’চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো ছটা তার। কয়েক পলকের জন্য বাপীর মনে হল শক্ত হাতে জীবনের সব ঝড়-জল-জঞ্জাল ঘষে-মুছে দিতে পারলে তবেই সেখানে পৌঁছনো সম্ভব।

মিষ্টি বেশ একটা ধাক্কা খেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। এ-জন্যে বাপীর একটুকু উদ্বেগ নেই। মিষ্টির ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিক্রিয়া অন্য রকম হবার কথা। তাকে রেশমার কথা বলা হয়েছে। ঊর্মিলার কথা বলা হয়েছে। গৌরী বউদির কথাও বলল। সব বলার পিছনেই গোপনতার সুড়ঙ্গ-পথ থেকে আলোয় আসার তাগিদ বাপীর। মিষ্টির সামনে কোনো মিথ্যের মুখোশ পরে থাকাটা যন্ত্রণার মতো।

ঠাণ্ডা মাথায় মিষ্টি সত্যি ভেবেছে। ভেবে হাল্কা হতে পেরেছে।…ওই লোকের প্রবৃত্তি ছকে বাঁধা হিসেবের শাসন জানে না, আবার নিজেই নিজেকে টেনে তোলে। এই জোর না থাকলে অমন বিচ্ছিরি সত্যি কথাও মুখের ওপর বলে দিত না। ও কিছু জানতেও পারত না।…আর সত্যি কথাই বা কতটা সত্যি? তার থেকে মনের তলায় জমা পরিতাপটুকুই হয়তো বেশি সত্যি। কারণ, এত দিনের মধ্যে মিষ্টি কি কোনো জানোয়ারের অস্তিত্ব টের পেয়েছে? পুরুষের দুরন্ত ভোগ হয়তো দেখেছে। ভেসে যাওয়া দেখেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়াও দেখেছে। অনুভব করেছে। জানোয়ার স্বার্থপর। একলা ভোগী। জানোয়ার তার দোসরের মন নিয়ে মাথা ঘামায় না।

মিষ্টির মেজাজ উল্টে এত ভালো হয়ে গেছে যে রাতের প্রগলভ শয্যায় এই ভাবনার আভাসটুকুই দিয়েই ফেলেছে। খুশিতে বুক বোঝাই বাপীর। কিন্তু আকাশ থেকে পড়া মুখ।—সে কি! আমার মধ্যে তুমি জানোয়ার দেখোনি?

মিষ্টি অনায়াসে মাথা নেড়েছে। দেখে নি।

—তোমার দশ বছর বয়সে বানারজুলির সেই জঙ্গলেও না? যার জন্য আজও আমার পিঠে এই দাগ

তার পিঠের তলায় একটা হাত গুঁজে দিয়ে সেই দাগে আঙুল ঘষতে ঘষতে মিষ্টি জবাব দিয়েছে, জঙ্গলের জীব-জন্তুদের ভালবাসা-বাসি দেখে দেখে তখন তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছল।

কিন্তু দিনের আলোয় মিষ্টির কাছে আসার রীতি এখন একটু অন্যরকম। এই থেকে কি ধরনের দুশ্চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বাপী আঁচ করতে পারে। সময় সময় কৌতুকও বোধ করে। দামাল ছেলের ঝড়ের মুখে বুক পেতে দেবার স্বভাব হলে তাকে আগলে রাখতেই হয়। বেপরোয়ার মতো জ্বলন্ত আগুনে হাত বাড়ানোর স্বভাব হলে সে-হাত টেনে ধরতেই হয়। মিষ্টির এখন এই গোছের দায়। নিজের সহজ অথচ অনমনীয় ব্যক্তিত্বের ওপর আস্থা খুব। সেটা বড় করে তুলে এমন দুরূহ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা।

হিসেবের বাইরে অজস্র টাকা আসাটা ও কখনো ঝড় ভাবে, কখনো জ্বলন্ত আগুন ভাবে।

পরের পাঁচ-ছমাসের মধ্যে বাপী কাজ উপলক্ষে আরো দু’বার বানারজুলি গেছে। সঙ্গে মিষ্টিও গেছে। আবু রব্বানীও বারকতক কলকাতায় এসেছে। মিষ্টির চোখ-কান খোলা। বুদ্ধিও রাখে। টের না পাবার কারণ নেই। আরো কিছু গোপন ব্যবসার খবর তার জানা হয়ে গেছে। বানারজুলিতে মদের কারবার আর কলকাতায় মদ চোরাই-চালানের খবর। আর কলকাতায়ও বনজ নেশার জিনিসের বাড়তি চালান আসছে এখন, তাও বুঝেছে। বুঝবে না কেন। গোপন টাকা আমদানির পরিমাণ তার কাছে তো আর গোপন নেই। আবু রব্বানীকে মিষ্টি জেরার মুখে ফেলেছিল। সে মাথা চুলকে পালিয়ে বেঁচেছে। দোকেও সতর্ক করেছে।

সেবারে বানারজুলি থেকে ফিরেই মিষ্টির সাফ কথা!—এসব চলবে না। বাপী অজ্ঞতার ভান করছে।—কি চলবে না?

—মদের চোরাই কারবার আর চোরাই চালান। আর ওষুধের নামে নেশা যোগানো—

গুরুদায়িত্ব পালনের মুখখানা দেখে বাপীর মজা লাগছিল। মুখে নিরীহ বিস্ময়।—মদের কারবারে আমাকে পেলে কোথায়—ওসব তো আবু আর জিতের ব্যাপার।

—কার ব্যাপার আমি খুব ভালো করে জানি। বন্ধ করতে না পারো তোমার ক্যাপিট্যাল তুমি তুলে নাও।

—ও-বাব্বা! এও জেনে ফেলেছ?

—আমি ঠাট্টা করছি না। আমার খুব খারাপ লাগছে। আর ওষুধের নামে সব জায়গায় যা চলছে তাও বন্ধ করতে হবে।

আরো একটু উসকে দেবার লোভে বাপী বলল, তুমি চাইলেও লোকে নেশা বন্ধ করবে না। আমি বন্ধ করলে তক্ষুনি আর কেউ এসে শুরু করবে।

—যে করে করবে, তুমি করবে না। তুমি নিজেই বলেছিলে, যা করেছ সব আমার জন্যে করেছ—আমি বলছি আর দরকার নেই।

বাপী হাসছে মিটিমিটি।সেই কশাইয়ের গল্প শুনেছ—যে সকাল-বিকেল মাংস কাটত অথচ তার কাছেই যোগীরা যোগের পাঠ নিতে যেত?

—শুনেছি। মাংস কাটা কশাইয়ের কাজ ছিল। তাতে চুরি ছিল না। আমি চুরি চাই না। সাদা ব্যবসা করো।

ভিতরে ভিতরে বাপীর এই প্রথম নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। এতক্ষণের মজায় বিপরীত টান ধরল। চেয়ে রইল খানিক।—আমার মধ্যে তুমি তাহলে মস্ত একটা চোর দেখছ…চোর ভালো করার জন্য ক্ষেপে উঠেছ?

মিষ্টি থমকালো।—সোজা কথাকে অমন বেঁকিয়ে দেখো না।

—আমি সব সোজা দেখি। ডান হাতের বুড়ো আঙুল বার দুই নিজের বুকে ঠেকিয়ে বলল, ভেতরে দেখার চোখ থাকলে তুমি এখানে সব সোজা দেখতে, সব সাদা দেখতে।

ক্ষুব্ধস্বরে মিষ্টি জানান দিল, ওখানকার কথা বলছি না, আমি তোমার ব্যবসার কথা বলছি!

ব্যবসাও আমিই! এবারে তুমি বলো, যে করেই হোক, আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার বদলে তোমাদের সাদা রাস্তার কোনো চালাঘরের বাপীকে দেখলে তোমার বাবা মা দাদা ফিরে চাইত, না তুমি আমাকে বুঝতে আসতে?

মিষ্টিও তেতে উঠছে।—তোমার ক্ষমতা কে অস্বীকার করছে, কিন্তু আর কেন?

—আর নয় কেন? কালো রাস্তায় যা এসে গেছে তাই ঢের ভাবছ? না থামলে সব খোয়াবার ভয়?

ব্যক্তিত্বের ঠোকাঠুকির ফলে এই লোককে একেবারে জল করে দেবার সুযোগ ফসকালো মিষ্টি। এ-কথার জবাবে তার অশান্তিটা সত্যিকারের কেন সেটা খোলাখুলি বলতে পারত। বলতে পারত, আমার সাদা কালো নিয়ে ভয় নয়, ঐশ্বর্য কমা-বাড়া নিয়েও ভয় নয়—আমার ভয় শুধু তোমার জন্য, তোমার কখন বিপদ হয় সেই জন্য। তুমি যদি বিপদ আপদ এত তুচ্ছ না করতে, তাহলে আমারও তোমাকে নিয়ে অত ভয় থাকত না।

কিন্তু তার বদলে অপমানে মুখ লাল হয়েছে।—তুমি তাহলে আমাকে এত ছোট এত নীচ ভাবো?

—আমি মোটেই তা ভাবি না। আমি শুধু বলতে চাই আমার সম্পর্কে তোমার ভাবনা বা ধারণায় কিছু ভুল হচ্ছে। আমি অসিত চ্যাটার্জি না, আমাকে তুমি তার মতো করে চালাতে চেষ্টা করলে আরো ভুল হবে, আরো অসুবিধে হবে।

বাপী ঘর ছেড়ে চলে এলো। একটা বই টেনে নিয়ে বসল। এখন বই বলতে নিজের নিভৃতে চোখ যায় এমন কিছু বই। এ-ধরনের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে কেন নিজেই জানে না। পড়তে পাঁচ মিনিটও ভালো লাগল না। ঘাড়ের পিছনটা ব্যথা-ব্যথা করছে, শক্ত লাগছে। মনে হয় বাষ্পর মতো কিছু জমাট বাঁধছে ওখানে। ইদানীং মাঝে মাঝে এ-রকম হচ্ছে। এই মুহূর্তে নিজের ওপরেই সব থেকে বেশি অসহিষ্ণু। মিষ্টিকে এমন সব কথা বলে এলো কেন? বিয়ের এই আড়াই বছর পরেও মিষ্টি তো তেমনি মিষ্টি। ও যা বলেছে বা ভেবেছে শতেকে একশ জনই তো তাই বলবে, তাই ভাববে। জঙ্গলের রাজ্যে নীতির হিসেব কম। এগারো বছর ধরে বাপী না হয় তাইতেই অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু অন্য কেউ অভ্যস্ত না হলে তার এরকম আঁতে ঘা পড়ে কেন? আরো খারাপ লাগছে, ধৈর্য খুইয়ে অসিত চ্যাটার্জিকে এর মধ্যে টেনে আনল বলে। জীবনের সব থেকে বড় যে ভুলটা মিষ্টি মেনেই নিয়েছে, ইতরের মতো সেখানেই ঘা বসিয়ে এলো। একটু আগে নিজের মুখে যে সাদা মনের বড়াই করে এলো বাপী, সত্যি ওটা কতটুকু সাদা?

ছটফটানি বাড়তে থাকল। উঠে বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরনো কথা মনে পড়ল। এয়ারপোর্টের চাকরির সময় মিষ্টি বারকয়েক করে ঘাড়ে মাথায় মুখে জল চাপড়াতো। প্রথম দিনে হোটেলে বসে ওমনি জল চাপড়ে এসে নিজেই বলেছিল কথাটা। কিন্তু এখন আর জল দেবার দরকার হয় না। তার মানে তখন অশান্তি ছিল, এখন নেই। কিন্তু বাপীর কি অশান্তি? এখন সেই জল ওর নিজের মাথায় চাপড়াতে হয় কেন?

চোখ মুখ মুছে আবার মিষ্টির কাছে এলো। মিষ্টি চুপচাপ বিছানায় বসে। বাপী সামনে এসে দাঁড়াল।

মিষ্টি চোখ তুলে তাকালো। জবাব দিল না।

মাথার পিছনটা বেজায় ভারী লাগছে। শক্ত ঘাড়টা বাপী বার দুই জোরে এ—কাঁধ থেকে ও-কাঁধ পর্যন্ত ফিরিয়ে সোজা করল।—আমার আজকাল কি একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, হঠাৎ-হঠাৎ রাগ হয়ে যায়, খানিক আগেও দেখেছ খুশি মনে ছিলাম…

মিষ্টি আলতো মন্তব্য করল, রাজা-বাদশারা শুনেছি ঢালাও ফুর্তির সময়েও পান থেকে চুন খসলে হঠাৎ রেগে গিয়ে গর্দান নিয়ে ফেলত।

উপমাটা বেশ লাগল বাপীর! হেসে জবাব দিল, যা-ই বলো এখন আর রাগাতে পারবে না। রাজা-বাদশা ছেড়ে মাঝে মাঝে নিজেকে ভিখিরির মতো মনে হয়, আরো কত পাওয়ার ছিল—পাচ্ছি না। না, না, টাকা পয়সার কথা বলছি না, আমি কি রকম যেন থেমে যাচ্ছি।

কথাগুলো মিষ্টির দুর্বোধ্য লাগছে। বাপী বোঝাবে কি, যা বলল নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়।

আবার ঘাড় মাথা বার দুই সামনে পিছনে করল।

মিষ্টি চেয়েই ছিল। হঠাৎ কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ল।—ওরকম করছ কেন? —কি রকম যন্ত্রণা হচ্ছে…ঘাড়টাও সেই থেকে শক্ত হয়ে আছে। আজকাল মাঝে মাঝে এরকম হয়, তখন পাখার নিচে বসেও গরম লাগে। যাকগে, আমাকে তো চেনই, রাগ কোরো না।

মিষ্টি উঠে কাছে এসে দাঁড়ালো।—চোখ অত লাল কেন?

বাপী আয়নার দিকে ফিরে টান করে নিজের দু’চোখ দেখে নিল। বলল, জলের ঝাপটা দিয়ে এলাম বলে বোধ হয়—

শুধু চোখ নয়, শ্যামবর্ণ মুখও কেমন লালচে মনে হল মিষ্টির। হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, আমি একটুও রাগ করিনি, বোসো, আমি আসছি—

ঘর ছেড়ে চলে গেল। বাপীর এখন হালকা লাগছে একটু। গা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট চার-পাঁচের মধ্যে মিষ্টি ফিরল। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, ফাঁক পেলে আজকাল তুমি ও-সব কি বই পড়ো বলো তো? আমি তো কিছু বুঝিই না— বাপী হাসতে লাগল। জবাব দিল, বুঝতে চেষ্টা কোরো না, আমার মতো গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে যাবে। আমিও সব বুঝি না, অথচ নিজেকে যাচাই করার নেশায় পেয়ে বসে।

—কি যাচাই করার?

—নিজের ভিতরে কত সব অজানা অচেনা ভালো মন্দ হিংসে লোভ স্বার্থপরতার ব্যাপার নাকি আছে…যত বাজে ব্যাপার সব।

মিনিট পনেরোর মধ্যে জিত্ সোজা ভিতরে চলে এলো। সঙ্গে একজন বয়স্ক ডাক্তার। জিতের হাতে তার মোটা ব্যাগ। বাপী অবাক। তক্ষুনি বুঝল, ফোনে জিকে মিষ্টি ডাক্তার নিয়ে আসতে হুকুম করেছে। ঘাড় মাথা ব্যথা আর চোখ লাল হবার কথাও নিশ্চয় বলেছে। কারণ কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করে ডাক্তার চোখের কোল টেনে ধরে দেখল, পালস্ দেখল। তারপর ব্যাগ খুলে ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্র বার করল।

দেখা হতে যন্ত্র গোটাতে গোটাতে ডাক্তার জানতে চাইল বরাবরই তার হাই প্রেশার কিনা। বাপী জানালো প্রেশার এই প্রথম দেখা হচ্ছে।

মিষ্টি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, প্রেসার কত? রোগীর সামনে বলা ঠিক হবে না ভেবে ডাক্তার ইতস্তত করল একটু। মিষ্টির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, ওঁর বয়েস কত?

—বত্রিশ…–। মিষ্টিই জবাব দিল।

—তেত্রিশ। হালকা গলায় বাপী শুধরে দিল।—ছাব্বিশ সালের জানুয়ারিতে জন্ম, এটা আটান্নর আগস্ট।

আনুষঙ্গিক আরো কিছু পরীক্ষার পর ডাক্তার বাপীর পেশার খোঁজ নিয়ে উঠে দাঁড়াতে জিত্ তাকে বাইরের ঘরে এনে বসালো। মিষ্টিও এলো। ডাক্তারের কথা শুনে উতলা।

প্রেসার বেশ বেশি। ওপরেরটা একশ নব্বুই, নিচেরটা একশ। ব্যবসার টেনশনের দরুন এরকম হতে পারে। কিছুদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। আজকের মধ্যেই ইসিজি করানোর নির্দেশসহ ডাক্তার প্রেসকৃপশন আর ডায়েট চার্ট লিখে দিয়ে গেল। জিত্ তক্ষুনি ব্যবস্থা করতে ছুটল।

ঘরে ফিরেই মিষ্টি ফতোয়া দিল, এখন টানা রেস্ট, আর কোনো কথা নেই। ব্যবসার কাজকর্ম সব এখন বন্ধ—নো টেনশন।

বাপী হেসে জবাব দিল, ব্যবসার আমি কি পরোয়া করি যে টেনশনের মধ্যে থাকব?

মিষ্টি চেয়ে রইল খানিক। পলকা ঠেসের সুরে মন্তব্য করল, ব্যবসা ছাড়াও সেই ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত তুমি টেনশনের মধ্যেই কাটিয়ে এসেছ।

বাপী হাসি মুখে সায় দিল, তা খানিকটা সত্যি বটে।

ইসিজি-র রিপোর্ট মোটামুটি ভালো। কিন্তু মোটামুটি শুনে মিষ্টি একটুও খুশি নয়। হাই ব্লাডপ্রেশার থেকে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে বাপীর বাবার মারা যাবার ঘটনা অনেক আগেই শোনা ছিল। ফলে বেশ কিছুদিন মিষ্টির কড়া নজর আর কড়া শাসনের মধ্যে থাকতে হল বাপীকে।

ভালো লেগেছে। জীবনের আবার একটা নূতন স্বাদ পেয়েছে।

ঊর্মিলা মা হয়েছে। মেয়ের মা।

টেলিগ্রামে খবর এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টিও বিজয় মেহেরা আর ঊর্মিলার নামে গ্রিটিং টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে হলেও বাপী হাঁকডাক করে মিষ্টিকে খবরটা দিত। আর যদি বলত, চলো, এবারে আমরা গিয়ে ওদের একবার দেখে আসি—তাহলেও মিষ্টি অস্বাভাবিক কিছু ভাবত না। একবার ঘুরে যাবার জন্য ওরা কম ডাকাডাকি করছে না। কিন্তু বাপী কিছুই না বলে মিষ্টিকে ডেকে সুখবরের টেলিগ্রামটা তার হাতে তুলে দিল।

বাপী ইজিচেয়ারে বসে তখন খবরের কাগজ পড়ছিল। হাতের কাছে সে—রকম পড়ার কিছু না থাকলে সকালের দু-তিনটে খবরের কাগজ নিয়ে দেড় দু’ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি বা হোমরাচোমরাদের নিয়ে কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। মানুষের খবর খুঁটিয়ে পড়ে। এমনি দুটো খবর মনে দাগ কেটে গেল। একটা বিদেশের ঘটনা। দুই শ্রমিক বন্ধু দশ আনা ছ’আনা ভাগে একখানা লটারির টিকিট কিনেছিল। সেই টিকিট প্রথম হয়েছে। আমাদের টাকার হিসেবে তিন লক্ষের ওপর প্রাপ্য তাদের। কিন্তু এক কপর্দকও ভোগে এলো না কারো। কারণ ছ’আনার গোঁ অর্ধেকের থেকে সে এক পয়সাও ছাড়বে না—টিকিটের গায়ে তো আর বখরার ভাগ লেখা নেই! ফলে ক্রোধে উন্মাদ দশআনার হাতে ছ’আনা খুন। দ্বিতীয় ঘটনা এই কলকাতার। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী তার দুই মেয়ে আর ছোট্ট ছেলে সাজগোজ করে বাড়ির কর্তার সঙ্গে রাতের আনন্দ উৎসবের আমন্ত্রণে যোগ দেবার জন্য তৈরি। কর্তা গেল লন্ড্রিতে তার ধোপদুরস্ত জামা-কাপড় আনতে। আর ফেরেনি। বাস চাপা পড়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ।

খবরের কাগজ কোলের ওপরে ফেলে ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে বাপী ভাবছিল, জীবনের তাহলে ব্যাপারখানা কি!

আধ ঘণ্টা বাদে মিষ্টি কাছে এসে বসল। বলল, একটা গ্রিটিং পাঠিয়ে দিয়ে এলাম।

মুখ না তুলে বাপী জবাব দিল, বেশ করেছ।

মিষ্টি চেয়ে রইল একটু। ব্লাডপ্রেশারের রকম-ফের হল কিনা বোঝার চেষ্টা। কিছুটা বুঝতে পারে। রক্তের চাপ সেই থেকে এখনো একটু বাড়তির দিকে, তবে স্থির, বেশি ওষুধ-টষুধ খাইয়ে ডাক্তার সেটা হুট করে টেনে নামাতে চায় না।

প্রেশার বেড়েছে মনে হল না। ফলে কৌতূহল বাড়লো। সাত মাস আগে ঊর্মিলার চিঠিতে শুধু সম্ভাবনার আভাস পেয়েই যে লোক খুশিতে আটখানা, তিন-চার দিনের মধ্যে সেই চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি বলে মিষ্টিকে বকুনি পর্যন্ত খেতে হয়েছে—আজ এমন সুখবরের পরে তার এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে মিষ্টি প্রথমে অবাক, পরে সন্দিগ্ধ। তার কথা ভেবেই উচ্ছ্বাস চেপে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা। তাও বোঝা গেল না।

—তোমার শরীর-টরীর খারাপ না তো?

বাপী সোজা হয়ে বসল।—না তো… কেন?

—এত বড় একটা খুশির খবর পেয়েও এমন চুপচাপ যে?

বাপী হাসল।—এত বড় মানে কত বড়?

—খুব বড় নয়?

—তা অবশ্য…। তবে বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে যখন, ছেলেপুলে আসবে এ তো জানা কথাই।

নিজের অগোচরে মিষ্টির দৃষ্টি তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। খানিক চুপ করে থেকে সংযত মোলায়েম সুরে জিগ্যেস করল, আমাদের কত দিন বিয়ে হয়েছে?

এবারে বাপী আত্মস্থ একটু। মনে মনে হিসেব করে জবাব দিল, দু’ বছর আট মাস। …কেন?

—আমরা তাহলে এই জানা কথার বাইরে পড়ে আছি কেন?… ভেবেছ? তার দিকে চেয়ে বাপী হাসছে অল্প অল্প।—ভেবে কি হবে। আমাদের ছেলেপুলে হবে না এ তো আমি তুমি ঘরে আসার অনেক আগেই একরকম জেনে বসে আছি।

অবিশ্বাস্য কাতর সুরে মিষ্টি বলে উঠল, তুমি জানতে?

বাপী সাদাসিধে ভাবেই মাথা নাড়ল।—তোমার প্রথমবারের গণ্ডগোলের ব্যাপারটা দীপুদার মুখে শুনেছিলাম…।

—কিন্তু একেবারে হবেই না দাদা তো জানত না!

—তোমার দাদা না জানলেও সব শুনে আমার তাই মনে হয়েছিল। মিষ্টির ফর্সা মুখ তেতে উঠছে।—মনে হয়েছিল তাই তুমি নিশ্চিন্ত মনে বসে আছ? ভালো কাউকে দেখিয়ে চেষ্টাচরিত্র করার দরকার মনে করো নি?

হঠাৎ এরকম অভিযোগ কেন বাপী বুঝে উঠল না। বলল, চেষ্টা-চরিত্র যা করার তুমি নিজেই তো করেছ।…একজন ছেড়ে মায়ের সঙ্গে একে একে তিনজন এক্সপার্টের সঙ্গে কনসাল্ট করেছ—এরপর আমার আর কি করার থাকতে পারে?

—ও…! অস্ফুট স্বরে মিষ্টি বলল, তুমি এ-ও জেনে বসে আছ তাহলে। তোমার আর কিচ্ছু করার নেই? তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারতে না— বাইরের এক্সপার্ট দেখাতে পারতে না?

বাপী এই প্রথম মিষ্টির দুঃখটা অনুভব করল। জবাব দিল, যেতে চাও চলো…কিন্তু আমার ধারণা এ-সব ব্যাপারে আমাদের স্পেশালিস্টরা একটুও পিছিয়ে নেই। মাঝখান থেকে আরো কষ্ট পাবে।

—তুমি ছেলে চাও না? তুমি কষ্ট পাচ্ছ না?

বাপী নির্দ্বিধায় মাথা নাড়ল।—আমি এ নিয়ে কিছু ভাবিই নি। আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি—পেয়েছি ব্যস।

—ব্যস নয়! মিষ্টির গলার স্বর কঠিন।—সব জেনে তুমি উদার হয়ে বসে আছ—চুপ করে থেকে তুমি আমাকে দয়া করছ।

বাপী অবাক। আহত।—তার মানে।

—তা না হলে ঊর্মিলার মেয়ে হয়েছে শুনে তুমি আনন্দে লাফালাফি করতে— আমার মুখ চেয়ে চুপ করে আছ।

বাপী বুঝল। হাসিই পেল এবারে। তরল সুরে বলল, কোনো এক্সপার্ট দিয়ে আগে তোমার মাথাটা দেখাব ভাবছি। পরেই গলার স্বর গভীর একটু, গম্ভীরও। বলল, আমি ঠিক আগের মতো কেন নেই জানি না…ভেতরে কি হয় নিজেই বুঝি না. তোমাকে বোঝাব কি করে। যা-ই হোক আমাকে অবিশ্বাস কোরো না, আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছি, তার বেশি আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই নি।

মিষ্টির লালচে মুখ। অপলক চেয়ে রইল। একটু বাদে উঠে গেল। এই লোককে অবিশ্বাস করে না। মিথ্যে যে বলে না, তার অনেক প্রমাণ পেয়েছে। তবু ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। যা বলল, সত্যি হলে তাকে শুধু ভোগী ছাড়া আর কি বলবে? মিষ্টি শুধু সেই ভোগের দোসর। ভোগের ভোজে কদর তার। মানুষটা আগের মতো নেই তা-ও ঠিক। নিজের ভিতরেই সময় সময় কোথায় তলিয়ে যায় মিষ্টি ঠাওর করে উঠতে পারে না। কিন্তু ভেসে ওঠে যখন, আকণ্ঠ তৃষ্ণা। তখন মিষ্টিকেই সব থেকে বেশি দরকার। মিষ্টি তখন খুব মিষ্টি। মিষ্টি কোনো দিন মা হবে না সেজন্যেও এই লোকের এতটুকু খেদ নেই। মিষ্টি কেবল তার ভোগের জগতের মিষ্টি।

ক্ষোভের মুখে খুব সুবিবেচনা করছে না মিষ্টি তা-ও বোঝে। মনের তলার ক্ষীণ আশাটুকুও নির্মূল। পরিপূর্ণতার অভাব-বোধ যন্ত্রণার মতো। এ যন্ত্রণার ভাগীদার নেই। তাই ক্ষুব্ধ হয়। তাই এ-রকম ভাবে। নইলে, এই লোকের ভালবাসার গভীরতাও যে সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করতে হয় তাই বা অস্বীকার করে কি করে?

ঊর্মিলা,

টেলিগ্রামের পর মিষ্টি তোমার চিঠিও পেয়েছে। এতদিনে তুমিও মিষ্টির চিঠি পেয়ে থাকবে। তোমার মেয়ে হয়েছে শোনার পর আমার মনের কথা তোমাকে জানানো হয়নি। ছেলে শুনলে আমি নিশ্চয় এত খুশি হতাম না। কালে দিনে মেয়েটা যেন তোমার থেকে ঢের বেশি দুষ্টু হয়। আর, তুমি তোমার মা-কে যত জ্বালিয়েছ, ও যেন তার মা-কে তার থেকে অনেক বেশি জ্বালায়। আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি মেয়ে দেখতেও তোমার থেকে সুন্দর হবে।

আমার শরীরের কথা ভেবে অত ঘটা করে উতলা হয়ো না। আসলে মিষ্টি তার নিজের উদ্বেগ খানিকটা তোমার ওপর চাপিয়েছে। ওই প্রেশার-ট্রেশার হয়তো বরাবরই ছিল। আমার তেমন কিছুই অসুবিধে হচ্ছে না। আসল গণ্ডগোলটা অন্য দিকে, যা আমারও জানা ছিল না। বাচ্চা বয়েস থেকে আমার কেবল খোঁজার ধাত, খোঁজার বরাত। যেমন ধরো সেই ছেলেবেলা থেকে মিষ্টিকে খুঁজেছি। ভিখিরির খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাকে পাওয়া যাবে না, বুঝে নিয়ে টাকা খুঁজেছি, ঐশ্বর্য খুঁজেছি। সে-দিকে এগোতে গেলে যা দরকার…অর্থাৎ তোমার মায়ের মনের ভাণ্ডারে ঢুকে পড়ার চাবিটি খুঁজেছি। তারপর একটু একটু করে সব পেয়েছি, মিষ্টির কাছেও পৌঁছে গেছি। কিন্তু তারপর? এই তারপরের গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে গেছি আমি। সেই ক্ষ্যাপার খোঁজার বাতিক যাবে কোথায়? কি খুঁজব? আরো টাকা আরো টাকা আরো টাকা? মিষ্টির মধ্যে আরো মিষ্টি আরো মিষ্টি আরো মিষ্টি? জীবন খোঁজার সেটাই শেষ কথা হলে ভেতরের খ্যাপা থামে না কেন? অত মাথা খোঁড়াখুঁড়ি কিসের?

যাক আর পাগলামি বাড়াব না। বিজয় তার কাজ নিয়ে সুখে থাকুক। তুমি তোমার মেয়ে নিয়ে সুখে থাকো। তোমাদের আমার এই খাপছাড়া রোগে পেয়ে বসলে মেয়েটার সর্বনাশ। তার থেকে চোখ-কান বুজে তোমরা আপাতত ওই মেয়ের দিকে মন দাও।

— বাপী।

চিঠিটা সামনের টেবিলের ওপর। মিষ্টি স্থাণুর মতো বসে আছে।

দুপুরে রোজ দু’আড়াই ঘণ্টার জন্য নিজের অফিসে নেমে আসে। আজও তাই এসেছিল। বাপীর ব্লাডপ্রেশার চড়ে থাকার পর থেকে মিষ্টিরই এই ব্যবস্থা। বাপীর চেম্বারে বসে তার নির্দেশমতো কিছু কাজকর্ম সেরে রাখে। বাপী সকালের দিকে বসে। তেমন দরকার পড়লে বিকেলেও খানিকক্ষণের জন্য নামে।

প্যাডসুদ্ধু চিঠিটা ড্রয়ারে ছিল। ড্রয়ার খুলতেই মিষ্টির চোখে পড়েছে। নিজের হাতে চিঠি আর লেখেই না, চিঠির গোড়ায় ঊর্মিলার নাম দেখে কৌতূহল স্বাভাবিক। প্যাডটা টেনে নিয়ে পড়ল। শেষ হতে আবারও পড়ল।

মিষ্টির মনে হচ্ছিল, হঠাৎ সে বড় কিছু পুঁজি খুইয়ে বসেছে। সেই যন্ত্রণায় বুকের ভিতরটা টনটন করছে। এরই মধ্যে সে এত সুলভ হয়ে গেছে যে তার মধ্যে ওই লোকের আর খোঁজার কিছু নেই, আর পাওয়ার কিছু নেই। চোখ-কান বুজে বিজয় আর ঊর্মিলাকে তাদের মেয়ের দিকে মন দেবার উপদেশের ফাঁকে একটাই ইঙ্গিত স্পষ্ট মনে হল মিষ্টির। অর্থাৎ ওই লোকের এটুকুও অবলম্বন নেই।

প্যাড থেকে লেখা পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে পরিষ্কার করে দু’ভাঁজ করল। সেটা হাতে করে নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলো। পাশের চেয়ারে জিত্ বা ওদিকের হল-এর কেরানীরা কেউ টের পেল না।

ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে বাপী মোটা বই পড়ছিল একটা। মিষ্টি চুপচাপ সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটা এত তন্ময় যে দু’মিনিটের মধ্যেও টের পেল না।

—ওটা কি পড়ছ?

মুখের কাছ থেকে বইয়ের আড়াল সরল। বাপী দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো। পৌনে চারটে। অর্থাৎ এরই মধ্যে উঠে আসবে ভাবে নি। বইটা ঘুরিয়ে মিষ্টির দিকে ধরল।

মিষ্টি জানে কি বই। শ্রীঅরবিন্দর লাইফ ডিভাইন। জিগ্যেস করল, ওতে কি আছে?

হেসে জবাব দিল, কে জানে, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না।

—তাহলে পড়ছ কেন?

রঙ্গ করে বাপী জবাব দিল, আমি পড়ছি না, আমাকে ঘাড় ধরে কেউ পড়াচ্ছে।

—আমিই বোধ হয়?

মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে এবারে খটকা লাগল বাপীর।…তার মানে? —তার মানে তোমার টাকা আর টাকার মতো আমাকে নিয়েও তুমি তাহলে এখন খুব ক্লান্ত?

বাপী বিমূঢ় খানিক। মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ কি হল বোঝার চেষ্টা

হাতের ভাঁজ করা চিঠিটা খুলে মিষ্টি সামনে ধরল। —এটা লিখে ডাকে না দিয়ে প্যাডেই রেখে দিয়েছিলে কেন—আমি পড়ব বলে?

এবারে বাপী হাসছে মিটিমিটি।—বাইরের টিকিট ছিল না বলে পাঠানো হয় নি। কিন্তু ওটা পড়ে শেষে কি তুমি এই বুঝলে নাকি?

ঊর্মিলা কি বুঝবে?

বাপী থমকে চেয়ে রইল। তারপর হাত বাড়ালো—দাও ওটা।

মিষ্টি নড়ল না। চোখে চোখ।

—দেখছ কি? ছিঁড়ে ফেলব। ঊর্মিলারও যদি তোমার মতো বুদ্ধি-বিবেচনা হয় তাহলে মুস্কিলের কথাই!

মিষ্টি ভিতরে ভিতরে অবাক একটু। অপ্রস্তুত হওয়া দূরে থাক, এই উষ্ণ ঝাঁঝেও ভেজাল নেই। জিগ্যেস করল, তোমার বুদ্ধি-বিবেচনায় এই চিঠির কি অর্থ দাঁড়ায়?

বাপী আরো অসহিষ্ণু।—যা-ই দাঁড়াক, এতে তোমাকে ছোট করার বা খাটো করার কোনো ব্যাপার নেই। তোমার নাম থাকলেও আমার এই ভাবনার মধ্যে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই—বুঝলে?

মিষ্টির মুখ লাল।—নিজের দাম জেনে খুশি হলাম।

হাল ছেড়ে বাপী হাতের বইটা পাশের ছোট টেবিলে ফেলে দিল। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, মিষ্টি, অনেক লেখা-পড়া শিখেছ বলে বাতাস থেকে অশান্তি টেনে এনো না।

ইজিচেয়ারে আবার শরীর ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঝল।

চিঠি হাতে নিয়ে মিষ্টি চলে গেল। একটা দুর্বোধ্য অস্বস্তি ওকেও ছেঁকে ধরেছে এখন।

মাসখানেক বাদে ঊর্মিলার জবাব এলো। মিষ্টিকে লিখেছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার করে লিখেছে, প্রেশার ট্রেশার যা-ই থাক, সব থেকে আগে পত্রপাঠ বড় ডাক্তার ডেকে ফ্রেন্ডের মাথাখানা খুব ভাল করে দেখিয়ে নাও

মিষ্টি চুপচাপ চিঠিটা বাপীর দিকে বাড়িয়ে দিল। পড়ে বাপী হাসতে লাগল। বলল, বাঁচা গেল, ঊর্মিলা তবু রোগ কিছুটা বুঝেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *