সীমানাহীন

সীমানাহীন

মাত্র ২১ বছর বয়সে আমার এএলএস (অ্যামিওট্রোফিক ল্যাটারাল স্কেলেরোসিস) রোগটি হয়েছিল। একে তখন খুবই অবিচার বলে মনে হয়েছিল। এ রকম অবস্থা আমার কেন হলো? তখন মনে হয়েছিল, আমার জীবন একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেল। আমার ধারণা, নিজের ভেতরে যে সুপ্ত সম্ভাবনা ছিল, তা কখনোই বুঝতে পারিনি। তবে ৫০ বছর পর এখন জীবন নিয়ে আমি বেশ পরিতৃপ্ত। আমি দুবার বিয়ে করেছি, তিনটি চমৎকার আর গুণী সন্তান আছে আমার। বৈজ্ঞানিক কর্মক্ষেত্রেও সফলতা পেয়েছি। আমার মনে হয়, বেশির ভাগ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীই একমত হবেন যে কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোয়ান্টাম বিকিরণ-সংক্রান্ত আমার অনুমান সঠিক। অবশ্য এ তত্ত্ব থেকে এখনো নোবেল পুরস্কার পাইনি। কারণ, এটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা বেশ কঠিন। অন্যদিকে মূল্যবান মৌলিক পদার্থবিদ্যার অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছি। আমার আবিষ্কারগুলো পরীক্ষামূলকভাবে নিশ্চিত না হওয়া সত্ত্বেও তাত্ত্বিক গুরুত্বের জন্যই এগুলো পেয়েছি।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দৈহিক অক্ষমতা আমাকে খুব বেশি অসুবিধায় ফেলতে পারেনি। আমার মনে হয়, আসলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অক্ষমতা নিজের জন্য মূল্যবান গুণ হিসেবে কাজ করেছিল। আমাকে কখনো আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের পড়াতে বা তাদের জন্য কোনো লেকচার দিতে হয়নি। আবার সময় নষ্ট করতে বিরক্তিকর কোনো কমিটিতেও কখনো বসতে হয়নি। কাজেই পুরোটা সময় গবেষণায় মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম।

আমার সহকর্মীদের কাছে আমি শুধুই আরেকজন পদার্থবিদ। তবে জনসাধারণের কাছে আমিই সম্ভবত বিশ্বের সুপরিচিত বিজ্ঞানী। এর পেছনের আংশিক কারণ হলো, আইনস্টাইনকে বাদ দিলে বিজ্ঞানীরা রকস্টারদের মতো ব্যাপকভাবে পরিচিত নন। আমার জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো গৎবাঁধা প্রতিবন্ধী জিনিয়াস হিসেবে আমি বেশ মানানসই। পরচুলা ও কালো চশমা দিয়ে কোনো ছদ্মবেশ নিতেও পারতাম না আমি। কারণ, হুইলচেয়ারটাই আমার সবকিছু ফাঁস করে দিত।

সুপরিচিত হওয়া এবং সহজে চেনার ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আছে। মন্দ দিকগুলোর মধ্যে খুবই সাধারণ কাজ, যেমন বাজার করতে গেলেও লোকজন ছবি তোলার জন্য চারদিকে ছেঁকে ধরে।

আবার অতীতে খবরের কাগজগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশ অযৌক্তিক আগ্রহও দেখিয়েছে। তবে আমার ক্ষেত্রে মন্দ দিকের চেয়ে ভালো দিকের পাল্লাই বেশি ভারী। লোকজন সত্যি সত্যিই আমাকে দেখে খুশি হতো। ২০১২ সালে লন্ডন প্যারা অলিম্পিক গেমসে আমি উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেবারই সর্বোচ্চসংখ্যক দর্শক পেয়েছিলাম।

একটি পরিপূর্ণ আর পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছি আমি। আমার বিশ্বাস, অক্ষম বা প্রতিবন্ধী মানুষদের এমন কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যেখানে তাদের শারীরিক ত্রুটি কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না। আবার তারা যা করতে পারে না, তার জন্য কোনো দুঃখ করাও উচিত নয়। আমার ক্ষেত্রে আমি যা করতে চেয়েছি, তার বেশির ভাগই করতে পেরেছি। আমি বিস্তর ঘুরে বেড়িয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়নেই গিয়েছি সাতবার। প্রথমবার এক শিক্ষার্থী দলের সঙ্গে গিয়েছিলাম, যাদের মধ্যে এক সদস্য ছিল ব্যাপ্টিস্ট। সে রুশ ভাষায় বাইবেল বিতরণ করতে চাচ্ছিল। সে কারণে সেগুলো পাচার করার জন্য আমাদের অনুরোধ জানিয়েছিল। অবশ্য কোথাও ধরা না পড়েই সেগুলো বহাল তবিয়তে পাচার করতে পেরেছিলাম আমরা। সেখান থেকে চলে আসার সময় কর্তৃপক্ষ আমাদের কৃতকর্ম আবিষ্কার করতে পেরেছিল। তখন কিছুক্ষণের জন্য আমাদের আটকে রাখা হয়েছিল। তবে বাইবেল পাচার করার অভিযোগ আনা আন্তর্জাতিক ঘটনার ও অসন্তোষের প্রচারণার কারণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিল। কাজেই তারা কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্য ছয়বার যাওয়ার কারণগুলো ছিল রুশ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। কারণ, সে সময় পশ্চিমের কোনো দেশে তাঁদের ভ্রমণের অনুমতি ছিল না। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সে দেশের সেরা বেশ কিছু বিজ্ঞানী পশ্চিমের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিলেন। তাই তারপর থেকে আমার আর কখনো রাশিয়ায় যাওয়া হয়নি।

আমি জাপানেও ছয়বার গিয়েছি। চীনে তিনবার এবং অ্যান্টার্কটিকাসহ প্রতিটি মহাদেশেও গিয়েছি, ব্যতিক্রম একমাত্র অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত, আয়ারল্যান্ড, চিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে দেখা করেছি। বেইজিংয়ের গ্রেট হলে এবং হোয়াইট হাউসে মানুষের সামনে বক্তৃতা দিয়েছি। সাবমেরিনে চেপে সাগরতলে গিয়েছি, আকাশে উড়েছি হট এয়ার বেলুনে এবং জিরো গ্র্যাভিটি ফ্লাইটে চেপে। আবার ভার্জিন গ্যালাকটিকের সঙ্গে মহাকাশে যাওয়ার জন্য আগাম বুক করে রেখেছি।

আমার শুরুর দিকের গবেষণা প্রমাণ করেছে, মহাবিস্ফোরণ ও কৃষ্ণগহ্বরের পরম বিন্দুগুলোতে চিরায়ত সাধারণ আপেক্ষিকতা অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর আমার পরের দিকের গবেষণা প্ৰমাণ করেছে, সময়ের সূচনা ও সমাপ্তিতে কী ঘটে, তা কোয়ান্টাম তত্ত্ব কীভাবে অনুমান করতে পারে। বেঁচে থাকা এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার এ সময়টি ছিল আমার জন্য খুবই উপভোগ্য। বিপুল এই মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমি যদি কোনো কিছু যোগ করে থাকি, তাহলে সেটি হবে আমার জন্য ভীষণ আনন্দের।

তথ্যনির্দেশ

প্যারা অলিম্পিক গেমস : শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক গেমস। ১৯৬০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি আয়োজিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক প্যারা অলিম্পিক কমিটি এটি পরিচালনা করে।

কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ : এটি এখন হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *