কাল্পনিক সময়

কাল্পনিক সময়

ক্যালটেকে থাকার সময় আমরা সান্তা বারবারা ঘুরতে গিয়েছিলাম। জায়গাটা উপকূল ধরে দুই ঘণ্টার পথ। সেখানে গিয়ে আমার বন্ধু ও সহযোগী জিম হার্টলের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বর থেকে কণারা কীভাবে নিঃসৃত হয়, তা গণনার উপায় নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। এ পদ্ধতিতে আমরা একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকা কণাদের সম্ভাব্য সব কটি পথ যোগ করেছিলাম। এতে দেখা গেল, একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে একটি কণার নিঃসৃত হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে ওই কৃষ্ণগহ্বরে একটি কণার পড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। কোনো উত্তপ্ত বস্তুর ক্ষেত্রে নিঃসরণ ও শোষণের যেমন সম্ভাবনা থাকে—এই বিষয়টিও অনেকটা সে রকম। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণ পাওয়া গেল যে কৃষ্ণগহ্বর এমনভাবে আচরণ করে, যেন তাদের একটি তাপমাত্রা ও একটি এনট্রপি আছে, যা তাদের দিগন্ত এলাকার সমানুপাতিক।

আমাদের এই গণনায় কাল্পনিক সময়ের ধারণা ব্যবহার করা হয়েছিল। একে সাধারণ বাস্তব সময়ের সাপেক্ষে সময়ের দিকে সমকোণে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেমব্রিজে ফিরে আমার প্রাক্তন দুই গবেষণা শিক্ষার্থী গ্যারি গিবনস ও ম্যালকম পেরির সঙ্গে এই ধারণাটিকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমরা কাল্পনিক সময় দিয়ে সাধারণ সময়কে প্রতিস্থাপন করেছিলাম। একে বলা হয় ইউক্লিডিয়ান পদ্ধতি। কারণ, এটি সময়কে স্থানের চতুর্থ দিক হিসেবে উপস্থাপন করে। এটি নিয়ে শুরুতে আমি ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন কোয়ান্টাম মহাকর্ষের গবেষণা সর্বোত্তম উপায় বলেই সবাই এটি গ্রহণ করেছে। কৃষ্ণগহ্বরের সময়ের ইউক্লিডিয়ান স্থান মসৃণ এবং সেখানে পদার্থবিদ্যার সব সমীকরণ ব্যর্থ হওয়ার মতো কোনো সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু নেই। এটি পেনরোজ আর আমার উত্থাপিত সিঙ্গুলারিটি থিওরেমের মৌলিক সমস্যার সমাধান দিয়েছিল, অর্থাৎ সেখানে বলা হয়েছিল, সিঙ্গুলারিটির কারণে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা ব্যর্থ হয়। ইউক্লিডিয়ান পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষ্ণগহ্বর কেন উত্তপ্ত বস্তুর মতো আচরণ করে এবং তাদের কেন এনট্রপি আছে, সে সম্পর্কে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলাম আমরা। গ্যারি ও আমি দুজন মিলে প্রমাণ করেছিলাম, ক্রমবর্ধমান হারে প্রসারণশীল কোনো মহাবিশ্ব এমন আচরণ করবে, যেন তার কৃষ্ণগহ্বরের মতো কোনো কার্যকরী তাপমাত্রা আছে। সে সময় ভেবেছিলাম, এই তাপমাত্রা হয়তো কখনোই পর্যবেক্ষণ করা যাবে না, কিন্তু এ কথার তাৎপর্য আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়েছিল ১৪ বছর পর।

আমি মূলত কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। কিন্তু আদিম মহাবিশ্ব-বিষয়ক একটি প্রস্তাব বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বে আমার আগ্রহটি পুনর্জন্ম পেয়েছিল। প্রস্তাবটি ছিল, একটা সময় আদিম মহাবিশ্ব স্ফীতিজনিত প্রসারণ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। এর আকার সর্বোচ্চ প্রসারণের হারে বেড়ে উঠেছিল, ঠিক দোকানে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ে। ১৯৮২ সালে ইউক্লিডিয়ান পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রমাণ করেছিলাম যে এভাবে বেড়ে ওঠা মহাবিশ্ব কিছুটা অসুষম হবে। প্রায় একই সময় আমার মতো একই ফলাফল পেয়েছিলেন রুশ বিজ্ঞানী ভিয়াতচেস্লাভ মোখানোভ। তবে তাঁর বিষয়টি পশ্চিমের দেশগুলোতে অনেক পরে জানা গিয়েছিল।

এই অসুষমতাগুলোকে একটি স্ফীতিশীল মহাবিশ্বে সক্রিয় তাপমাত্রার কারণে তাপীয় ফ্লাকচুয়েশন বা অস্থিরতা থেকে উদ্ভূত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। গ্যারি গিবনস ও আমি আট বছর আগে আবিষ্কার করেছিলাম এটি। পরবর্তী সময়ে অন্য আরও অনেকেই একই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কেমব্রিজে এ বিষয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিলাম আমি। সেখানে এই ক্ষেত্রটির প্রধান বিজ্ঞানীরা অংশ নিয়েছিলেন। এই সভায় স্ফীতি- বিষয়ক আমাদের বর্তমান চিত্রের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম আমরা। এর মধ্যে সব গুরুত্বপূর্ণ ঘনত্বের ফ্লাকচুয়েশনও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা গ্যালাক্সি গঠনে এবং একইভাবে আমাদের অস্তিত্বেরও পেছনের কারণ।

সেটি ছিল কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার (COBE) স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঘনত্বের ওঠানামার কারণে বিভিন্ন দিকে সৃষ্ট মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের পাথর্ক্য রেকর্ড করারও ১০ বছর আগের ঘটনা। কাজেই আবারও মহাকর্ষ গবেষণায় পরীক্ষার চেয়ে তত্ত্ব এগিয়েই রইল। পরবর্তী সময়ে এই ফ্লাকচুয়েশনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব (WMAP) এবং প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট। আবার সেগুলো ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গেও হুবহু মিলে গিয়েছিল

ইনফ্লেশন বা স্ফীতির প্রকৃত চিত্রটি ছিল মহাবিশ্ব একটি মহাবিস্ফোরণের পরম বিন্দুর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনোভাবে সেটি স্ফীতি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আমি ভাবলাম, এটি অসন্তোষজনক ব্যাখ্যা। কারণ, আগেই বলেছি, সব কটি সমীকরণ পরম বিন্দুতে এসে অকার্যকর বা ব্যর্থ হয়। তবে প্রাথমিক পরম বিন্দু থেকে কী বেরিয়ে আসবে, সেটি না জানা পর্যন্ত মহাবিশ্ব কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তা কেউ গণনা করতে পারবে না। বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো ক্ষমতা নেই। আমাদের দরকার ছিল একটি পরম বিন্দু ছাড়া স্থান-কাল, অনেকটা একটি কৃষ্ণগহ্বরের ইউক্লিডিয়ান সংস্করণের মতো।

কেমব্রিজে কর্মশালা আয়োজনের পর আমি ওই গ্রীষ্মকালটি কাটিয়েছিলাম সান্তা বারবারায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিকসে। বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বে কীভাবে ইউক্লিডিয়ান পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে জিম হার্টলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ইউক্লিডিয়ান পদ্ধতিতে মহাবিশ্বের কোয়ান্টাম আচরণ পাওয়া যায় কাল্পনিক সময়ে ফাইনম্যানের বিশেষ ধরনের ইতিহাসের যোগফলের মাধ্যমে। কারণ, কাল্পনিক সময় স্থানের আরেকটি দিকের মতো আচরণ করে। আর কাল্পনিক সময়ে ইতিহাসগুলো আবদ্ধ পৃষ্ঠের ওপর থাকতে পারে। এটি অনেকটা পৃথিবীপৃষ্ঠের মতো, অর্থাৎ যার কোনো শুরু বা শেষ নেই।

জিম আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে এটি সবচেয়ে স্বাভাবিক নির্বাচন, সত্যিই স্বাভাবিক নির্বাচন। আমরা সীমানাহীন (নো বাউন্ডারি) প্রস্তাবটি সূত্রবদ্ধ করেছিলাম। সীমানাহীন, অর্থাৎ মহাবিশ্বের এমন সীমানা অবস্থা, যা কোনো সীমানা ছাড়া আবদ্ধ। সীমানাহীন প্রস্তাব অনুযায়ী মহাবিশ্বের শুরুটা পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর মতো, যা কাল্পনিক সময়ের অক্ষাংশের ডিগ্রি হিসেবে কাজ করে। দক্ষিণ মেরুর একটি বিন্দু হিসেবে মহাবিশ্বের সূচনা হয়ে থাকতে পারে। উত্তর মেরুর দিকে চলতে শুরু করলে ধ্রুব অক্ষাংশের বৃত্তটি (যা মহাবিশ্বের আকারের প্রতিনিধিত্ব করবে) প্রসারিত হতে থাকবে। মহাবিশ্বের এই সূচনাবিন্দুর আগে কী ঘটেছিল, সেই প্রশ্ন করা অর্থহীন কারণ, দক্ষিণ মেরুর দক্ষিণে আসলে কোনো কিছুই নেই।

সময়কে অক্ষাংশের ডিগ্রি হিসেবে পরিমাপ করা হলে দক্ষিণ মেরুতে সময়ের একটি সূচনা থাকবে। তবে দক্ষিণ মেরু পৃথিবী নামক গোলকের যেকোনো বিন্দুর মতোই। প্রকৃতির একই নিয়ম দক্ষিণ মেরু এবং অন্যান্য জায়গার জন্যও প্রযোজ্য হবে। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনায় সেই বহু পুরোনো অভিযোগ খণ্ডন করা যায়—যেখানে বলা হয়, এটিই সেই জায়গা, যেখানে সাধারণ নিয়মগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। বরং মহাবিশ্বের শুরুর মুহূর্ত বিজ্ঞানের নিয়মের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। সময়কে স্থানের একটি দিকে রূপান্তরিত করে আমরা সময়ের সূচনাবিষয়ক যে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক জটিলতা আছে, তা এক পাশে সরিয়ে রেখেছিলাম।

সীমানাহীন অবস্থা ইঙ্গিত করে যে মহাবিশ্ব কোনো কিছু ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম দেখায় মনে হয়, সীমানাহীন প্রস্তাবনা যথেষ্ট স্ফীতি বা ইনফ্লেশন অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু পরে বোঝা গিয়েছিল যে মহাবিশ্বের প্রদত্ত রূপরেখার সম্ভাবনা পরিমাপ করতে হবে ওই রূপরেখার আয়তনের ওপর ভিত্তি করে। সম্প্রতি জিম হার্টল, থমাস হার্টগ (আমার প্রাক্তন শিক্ষার্থী) এবং আমি আবিষ্কার করেছি, স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব এবং স্থানের মধ্যে দ্বৈততা বিদ্যমান, যাদের ঋণাত্মক বক্রতা রয়েছে। এই বিষয়টি আমাদের নতুন পদ্ধতিতে সীমানাহীন প্রস্তাবকে নতুনভাবে সূত্রবদ্ধ করার সুযোগ দিয়েছিল। আবার এখানে উল্লেখযোগ্য, প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগও পেয়েছিলাম আমরা, যা এই ধরনের স্থানের জন্যই বানানো হয়েছিল। সীমানাহীন প্রস্তাবনা ভবিষ্যদ্বাণী করে যে মহাবিশ্ব প্রায় পুরোপুরি মসৃণভাবে শুরু হবে, কিন্তু তার ছোট বিচ্যুতি বা বক্রতা থাকবে। এই বক্রতা মহাবিশ্ব প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকবে এবং গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, জীবজগৎসহ মহাবিশ্বের অন্যান্য কাঠামোর গঠন সম্ভব করে তুলবে। মোদ্দা কথা, সীমানাহীন অবস্থাই সৃষ্টির প্রধান শর্ত। আর এর কারণেই আমরা এখানে আসতে পেরেছি।

তথ্যনির্দেশ

পরম বিন্দুতে পদার্থবিদ্যার সূত্র অকার্যকর : মহাবিস্ফোরণের পর এক সেকেন্ডের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মুহূর্তে (১/১০,০০০তম সেকেন্ড) পৌঁছালে দাঁড়ায় এক ট্রিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় পরমাণু টিকে থাকতে পারে না। তার নিউক্লিয়াসের প্রোটন, নিউট্রন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, যার নাম কোয়ার্ক বা প্রোটন ও নিউট্রনের মৌলিক কণা। তারও আগে পৌঁছালে, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের পর এক সেকেন্ডের ১০^৪৩ ভাগের এক ভাগ সময়ের মুহূর্তে পৌঁছালে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা পাওয়া যাবে ১০০ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডিগ্রি বা ১০^৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ সব নিয়ম অকার্যকর হয়ে যায়। জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামানুসারে মহাবিশ্বের ইতিহাসে এই সময়কে বলে প্ল্যাঙ্ক সময়। আর এই তাপমাত্রাকে বলে প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রা। প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রায় আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কিছু উদ্ভট আর পরস্পরবিরোধী ঘটনার আভাস দেয়। যেমন আলোককণারা নিজেরাই একত্র হয়ে এই তাপমাত্রায় একটা খুদে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করবে। অর্থাৎ আলো আর ছুটে বেড়াবে না। পদার্থবিদ্যার সাধারণ সূত্র দিয়ে তাই এই তাপমাত্রায় কী ঘটবে, সে সম্পর্কে আমরা কোনো ধারণাই পাই না।

সম্ভাব্যতা : সাধারণ অর্থে সম্ভাব্যতা হলো একটি অনিশ্চিত ঘটনা ঘটবে কি না, সে সম্পর্কে বিশ্বাসের মাত্রা। গণিত ও পরিসংখ্যানে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থায় একটি ঘটনা এবং একই জাতীয় সব ঘটনার অনুপাতকে ওই ঘটনার সম্ভাব্যতা বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *