মহাকর্ষীয় তরঙ্গ
১৯৬৯ সালে জোসেফ ওয়েবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছিল। সেটি করতে তিনি একটি বায়ুশূন্য পাত্রে দুটি অ্যালুমিনিয়াম দণ্ড ঝুলিয়ে একটি শনাক্তকারী যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যখন আসে, তখন তা একদিকে বস্তুকে প্রসারিত করে (তরঙ্গটি যেদিকে যাচ্ছে সেই বরাবর) এবং অন্যদিকে বস্তুকে সংকুচিত করে দেয় (তরঙ্গটির সমকোণ বরাবর)। ফলে ওই দণ্ড দুটি তাদের অনুনাদিত কম্পাঙ্কে, অর্থাৎ সেকেন্ডে ১ হাজার ৬৬০ সাইকেলে দুলতে থাকে। এসব দোলনদণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত ক্রিস্টালের মাধ্যমে ওই তরঙ্গ শনাক্ত করা যেতে পারে। ১৯৭০ সালের দিকে আমি প্রিন্সটনের কাছে ওয়েবারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন তাঁর যন্ত্রপাতিগুলোও পরীক্ষা করে দেখেছিলাম। আমার অদক্ষ চোখে তেমন কোনো ভুল দেখতে পাইনি। কিন্তু নিজের করা পরীক্ষার ফলগুলোকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে দাবি করেছিলেন ওয়েবার।
ওয়েবারের দণ্ডগুলোকে উত্তেজিত করার জন্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিস্ফোরণের সম্ভাব্য উৎসগুলোকে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হবে। আর ওই তরঙ্গের একমাত্র সম্ভাব্য উৎস হতে পারে, কোনো অতি ভরের নক্ষত্রের ভেঙে পড়ে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়া অথবা দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ হয়ে তা একত্র হয়ে যাওয়া। আবার এসব উৎস কাছাকাছিও হওয়া দরকার। অন্তত আমাদের
গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মধ্যে হতে হবে উৎসগুলো। আগের এক হিসাবে দেখা গেছে, এ ধরনের ঘটনা প্রতি শতকে মাত্র একবারই ঘটতে পারে। অথচ ওয়েবার দাবি করেছিলেন, তিনি প্রতিদিন একটি বা দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর এ দাবির অর্থ দাঁড়ায়, আমাদের গ্যালাক্সি এমন হারে ভর হারাচ্ছে যে তা গ্যালাক্সিটির জীবনকাল পর্যন্তও টিকে থাকতে পারবে না। অথবা এখন হয়তো এখানে কোনো গ্যালাক্সিই আর বেঁচে নেই।
ইংল্যান্ডে ফিরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ওয়েবারের এই বিস্ময়কর দাবিগুলোর সত্যতা স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করে দেখব। তাই আমার ছাত্র গ্যারি গিবসনকে সঙ্গে নিয়ে আমি একটি গবেষণাপত্রও লিখেছিলাম। গবেষণাপত্রটির বিষয়বস্তু ছিল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিস্ফোরণ শনাক্তের তত্ত্ব। সেখানে আরও সংবেদনশীল একটি ডিটেক্টর বা শনাক্তকারী যন্ত্রের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ভেবে দেখলাম, এ ধরনের কোনো ডিটেক্টর কারও একার পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। তাই তখন গ্যারি আর আমি দুঃসাহসী এক পদক্ষেপ নিলাম। সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলকে একটা আবেদন করলাম, যাতে দুটো ডিটেক্টর বানানোর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। (একটা দরকার অন্তত দুটি ডিটেক্টরের মধ্যে কাকতালীয় কোনো ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ, গোলমাল আর পৃথিবীর কম্পন থেকে সন্দেহজনক সংকেত আসতে পারে।) গ্যারি যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া আস্তাকুঁড় থেকে যন্ত্র সংগ্রহ করে তা ঘষামাজা করে বায়ুশূন্য চেম্বার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করল। পাশাপাশি একটি উপযুক্ত জায়গা খোঁজার কাজ চলতে লাগল।
একসময় ওয়েবারের দাবি পরীক্ষা করতে উৎসাহী অন্যান্য দলের সঙ্গে আমরা লন্ডনে সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের ১৩ তলায় একটা মিটিং করি। (সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল অন্ধবিশ্বাস মানতে পারত না। তারা আরও সস্তায় তা পেয়ে গিয়েছিল।) এই প্রজেক্টের কাজ পেতে সেখানে আরও দুটি দল অপেক্ষা করছিল। কাজেই গ্যারি আর আমি আমাদের আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নিলাম। এভাবে সেবার অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলাম!
সে সময় আমার দৈহিক অক্ষমতা দিনকে দিন বাড়ছিল। তাতে একজন পরীক্ষক হিসেবে আমার হতাশাও বাড়ছিল। আর পরীক্ষণীয় কোনো বিষয়ে কারও একার পক্ষে বিখ্যাত হওয়া খুবই কঠিন। কারণ, প্রায়ই একটা বড় কোনো দলের অংশ হয়ে একজনকে কাজ করতে হয়। আর এসব পরীক্ষায় অনেক সময় বছরের পর বছরও লেগে যায়। অন্যদিকে একজন তাত্ত্বিকের মাথায় হয়তো কোনো এক বিকেলে কিংবা বিছানায় শুয়ে থেকে (আমার ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল) একটা ধারণা আসতে পারে। এরপর সে বিষয়ে তিনি নিজের একটি গবেষণাপত্র লিখতে পারেন কিংবা সহকর্মী এক বা দুজনকে নিয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেন।
১৯৭০-এর দশক থেকে মহাকর্ষতরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্রগুলো অনেক বেশি সূক্ষ্ম বা সংবেদনশীল হয়েছে। বর্তমানের ডিটেক্টরগুলো লেজার ব্যবহার করে সমকোণী দুই বাহুর দৈর্ঘ্য তুলনা করে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের দুটি লাইগো ডিটেক্টর আছে। ওয়েবারের তুলনায় সেগুলো ১০ মিলিয়ন গুণ বেশি সংবেদনশীল হলেও সেগুলো এখনো নির্ভরযোগ্যভাবে মহাকর্ষতরঙ্গ শনাক্ত করতে পারেনি। সে কারণে একজন তাত্ত্বিক হয়ে থাকতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত।
তথ্যনির্দেশ
কম্পাঙ্ক বা ঘটনসংখ্যা : একটি তরঙ্গের জন্য প্রতি সেকেন্ডে সম্পূর্ণ চক্রের সংখ্যা। তরঙ্গের ওপর অবস্থিত কোনো কম্পনশীল কণা একক সময়ে যতগুলো পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন করে, তাকে কম্পাঙ্ক বলে।
জোসেফ ওয়েবার : মার্কিন পদার্থবিদ। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সামান্য উপকরণ দিয়ে প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র বানান জোসেফ ওয়েবার (১৯১৯-২০০০ খ্রি.)। এরপর এই তরঙ্গ শনাক্ত করার দাবি জানান। ১৯৭২ সালে অ্যাপোলো লুনার মিশনের মাধ্যমে একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্রও চাঁদেও পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সে সময়কার একাধিক পদার্থবিজ্ঞানী। কারণ, মহাকর্ষতরঙ্গ ধরতে যে ধরনের সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি দরকার, ওয়েবারের কাছে তা ছিল না বলে মনে করেন তাঁরা। তাই ওয়েবারের পরীক্ষার ত্রুটি আছে বলে তাঁর দাবিকে নাকচ করে দেন বিজ্ঞানীরা।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ : আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে পাওয়া একটি তরঙ্গ, যা আলোর গতিতে চলে। একটি বিপুল ভরের বস্তু আরেকটি বিপুল ভরের বস্তুর চারপাশে ঘুরলে বস্তু দুটি এই তরঙ্গ বিকিরণ করে। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন এ ধরনের তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ঠিক ১০০ বছর পর, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর ডিটেক্টরে এই তরঙ্গ প্রথমবার ধরা পড়ে। এ তরঙ্গের উৎস ছিল ১৩০ কোটি বছর আগে সূর্যের চেয়ে ৩৬ গুণ এবং সূর্যের চেয়ে ২৯ গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষ। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার শনাক্ত করা হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এরপর ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত চারটি মহাকর্ষীয় বা মহাকর্ষতরঙ্গ শনাক্ত করেছে লাইগো।
লাইগোর মহাকর্ষতরঙ্গ শনাক্ত : হকিংয়ের এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। তত দিনে মহাকর্ষতরঙ্গ শনাক্ত করা সত্যিই সম্ভব হয়নি। তবে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর ডিটেক্টরে এই তরঙ্গ প্রথমবার ধরা পড়ে। পরে আরও কয়েকবার এই তরঙ্গ শনাক্ত করেছে লাইগো। এই তরঙ্গ শনাক্তের জন্য ২০১৭ সালে নোবেল পুরস্কার পান বিজ্ঞানী রাইনার ভাইস, কিপ এস থর্ন ও ব্যারি বারিশ।
লাইগো : লাইগো বা LIGO-এর পূর্ণরূপ হলো লেজার ইন্টারোফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি। মহাকর্ষতরঙ্গ শনাক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের কাছে হ্যানফোর্ড এবং লুইজিয়ানার লিভিংস্টোনে ইংরেজি এল আকৃতির দুটি খুবই সংবেদনশীল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। এদের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার।