কৃষ্ণগহ্বর
কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবরের ধারণার শুরু হয়েছিল প্রায় দুই শত বছরের বেশি সময় আগে। ১৭৮৩ সালে কেমব্রিজ ডন জন মিশেল ‘ডার্ক স্টার’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশন অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডন-এ। ওই লেখায় তিনি ইঙ্গিত করেন, একটি নক্ষত্র যথেষ্ট ভারী ও ঘনবিন্যস্ত হলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্ৰ এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে সেখান থেকে আলোও আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। নক্ষত্রটির পৃষ্ঠতল থেকে কোনো আলো নিঃসৃত হলেও তা বেশি দূর যাওয়ার আগেই নক্ষত্রটির মহাকর্ষীয় টানে আবারও পেছনে ফিরে যাবে।
মিশেল প্রস্তাব করলেন, এ ধরনের নক্ষত্রের সংখ্যা অনেক হতে পারে। অবশ্য এ ধরনের কোনো নক্ষত্র আমরা দেখতে পারব না। কারণ, তাদের কাছ থেকে কোনো আলোই আমাদের কাছে এসে পৌছাবে না। তবে তাদের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ আমরা ঠিকই অনুভব করতে পারব। এ ধরনের বস্তুকেই এখন আমরা ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে জানি। কারণ, তারা আসলে সে রকমই, অর্থাৎ স্থানের মধ্যে কালো শূন্যতা। এর কয়েক বছর পর প্রায় একই ধরনের একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী মারকুইস দ্য ল্যাপ্লাস। অবশ্য মিশেলের গবেষণা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না বলেই ধারণা করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, ল্যাপ্লাস তাঁর লেখা দ্য সিস্টেম অব দ্য ওয়ার্ল্ড বইটির শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণেই এ বিষয়টি যোগ করেছিলেন। অথচ পরের সংস্করণ থেকে তা বাদ দিয়েছিলেন। সম্ভবত একে নিছক পাগলাটে ধারণা বলে মনে করেছিলেন তিনি।
মিশেল ও ল্যাপ্লাস দুজনই আলোকে কণা হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন। অনেকটা কামানগোলার মতো, যা মহাকর্ষের প্রভাবে ক্রমেই ধীরগতির হতে থাকে এবং একসময় তা তার নক্ষত্রপৃষ্ঠেই ফিরে যায়। কিন্তু এটি মাইকেলসন-মর্লির ১৮৮৭ সালে করা পরীক্ষার সঙ্গে খাপ খায় না। কারণ, তাঁদের পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যে আলো সব সময় একই গতিতে চলাচল করে। মহাকর্ষ আলোকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সে-সম্পর্কিত একটি উপযুক্ত তত্ত্ব ১৯১৫ সালের আগপর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সে বছরই আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। সাধারণ আপেক্ষিকতা ব্যবহার করে ১৯৩৯ সালে রবার্ট ওপেনহাইমার এবং তাঁর ছাত্র জর্জ ভলকভ ও হার্টল্যান্ড স্নাইডার দেখালেন, নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশি ভরের কোনো নক্ষত্রের পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নিজেরই মহাকর্ষের বিরুদ্ধে নিজের চুপসে যাওয়া ঠেকানোর মতো তার কোনো অবলম্বন থাকে না। আর ভরের এই নির্দিষ্ট সীমাটি হবে প্রায় আমাদের সূর্যের ভরের মতো। এই ভরের চেয়ে বেশি ভরের জ্বালানিশূন্য নক্ষত্রেরা নিজের ওপর ভেঙে পড়ে এবং কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। আর তাদের অসীম ঘনত্বের পরম বিন্দু থাকে। অবশ্য এটি আইনস্টাইনের নিজের তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী হলেও তিনি কখনোই কৃষ্ণগহ্বর বা অসীম ঘনত্বে সংকুচিত কোনো বস্তুর ধারণা মেনে নিতে পারেননি।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হস্তক্ষেপে ওপেনহাইমার পারমাণবিক বোমা নিয়ে গবেষণায় মন দিলেন। যুদ্ধের পর মানুষ পারমাণবিক ও নিউক্লিয়ার ফিজিকসে বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে এর পরের ২০ বছর ধরে মহাকর্ষীয় চুপসে যাওয়া ও কৃষ্ণগহ্বর-সংক্রান্ত বিষয় অবহেলায় পড়ে ছিল।
মহাকর্ষীয় চুপসে যাওয়া-বিষয়ক আলোচনা আবারও জেগে উঠেছিল ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে, কোয়াসার আবিষ্কারের পর। কোয়াসার হলো অনেক দূরের বস্তু, যা খুবই ঘনবিন্যস্ত এবং শক্তিশালী অপটিকেল ও বেতারতরঙ্গের উৎস। কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে বস্তু পড়ে যাওয়াই একমাত্র যুক্তিসংগত প্রক্রিয়া। এটিই একটি অতি ক্ষুদ্র স্থানে এত বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারার ব্যাখ্যা দিতে পারে। সে কারণেই ওপেনহাইমারের গবেষণা পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল। এরপর মানুষ কৃষ্ণগহ্বর তত্ত্ব নিয়ে আবারও গবেষণা করতে শুরু করেছিল।
১৯৬৭ সালে ওয়ার্নার ইসরায়েল এক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হাতে পেয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ দেখালেন, ঘূর্ণনশীল নয়, এমন একটি পতনশীল বা চুপসে যাওয়ারত নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষগুলো যদি নিখুঁতভাবে গোলাকার না হয়, তাহলে তাতে বিদ্যমান পরম বিন্দুটি নগ্ন বা উন্মুক্ত হবে। অর্থাৎ পরম বিন্দুটি বাইরের দর্শকেরা দেখতে পাবে। এর অর্থ দাঁড়াবে, পতনশীল একটি নক্ষত্রের পরম বিন্দুতে সাধারণ আপেক্ষিকতা অকার্যকর হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ একই সঙ্গে বাকি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের আগাম ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রথম দিকে ইসরায়েলসহ অধিকাংশ বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন, এতে পরোক্ষভাবে এটি বোঝা যায় যে সত্যিকারের নক্ষত্র নিখুঁতভাবে গোলাকার না হওয়ার কারণে তাদের পতন উন্মুক্ত পরম বিন্দুর সৃষ্টি করবে। এর ফলে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাও ধ্বংস হবে। তবে এ-সংক্রান্ত একটি বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন রজার পেনরোজ ও জন হুইলার। সেটি হলো অঘূর্ণনশীল একটি নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় পতনের ধ্বংসাবশেষ দ্রুতবেগে শান্ত হয়ে একটি গোলাকার অবস্থায় এসে দাঁড়াবে। তাঁদের প্রস্তাব ছিল যে সেখানে একটি মহাজাগতিক সেন্সরশিপ থাকবে। এর মানে হলো প্রকৃতি নিজেই নীতিমান। আর এ কারণেই কৃষ্ণগহ্বরের পরম বিন্দু দর্শকের আড়ালে থাকবে, যা বাইরের কেউই দেখতে পাবে না।
ডিএএমটিপিতে আমার অফিসের দরজার একবার একটি বাম্পার স্টিকার লাগিয়েছিলাম। সেখানে লেখা ছিল : কৃষ্ণগহ্বর দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে। স্টিকারটি আমার বিভাগের প্রধানের কাছে এতই বিরক্তিকর মনে হয়েছিল যে তিনি কৌশলে আমাকে লুকাসিয়ান প্রফেসর পদের নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর এর ভিত্তিতে আমাকে আগের চেয়ে ভালো একটি অফিসকক্ষে সরিয়ে দেন। পরে আমার পুরোনো অফিসকক্ষের দরজায় লাগানো সেই আপত্তিকর নোটিশটি নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলেন তিনি।
কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আমার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালের এক ইউরেকা মুহূর্তে। আমার মেয়ে লুসির জন্মের মাত্র কয়েক দিন পরের ঘটনা। বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় হঠাৎ বুঝতে পারলাম, কৃষ্ণগহ্বরে আমি কার্যকারণ কাঠামো তত্ত্ব ব্যবহার করতে পারি। এই তত্ত্বটি পরম বিন্দুর উপপাদ্যের জন্য গড়ে তুলেছিলাম। বিশেষ করে, ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রফল (অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা) সব সময়ই বাড়তে থাকবে। দুটি কৃষ্ণগহ্বর যখন পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়বে ও একত্র হয়ে যাবে, তখন চূড়ান্ত কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফল আগের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফলের যোগফলের চেয়ে বেশি হবে। এটিসহ অন্যান্য আরও কিছু ধর্ম জিম বার্ডিন বার্ডন কার্টার ও আমি আবিষ্কার করেছিলাম। এই আবিষ্কার এটিই ইঙ্গিত করে যে এই ক্ষেত্রফল হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপির মতো। একটি কৃষ্ণগহ্বরের বাইরের অবস্থার জন্য তার ভেতরে একই রকম কতগুলো অবস্থা বিদ্যমান—এটি তার পরিমাপক হতে পারে। কিন্তু ক্ষেত্রফল আসলে এনট্রপি হতে পারে না। কারণ, কৃষ্ণগহ্বরের যদি এনট্রপি থাকে, তাহলে তাদের একটি তাপমাত্রাও থাকতে হবে। আর তাতে কৃষ্ণগহ্বর উত্তপ্ত বস্তুর মতো উজ্জ্বলতা ছড়াতে থাকবে। সবার ধারণা, কৃষ্ণগহ্বর পুরোপুরি কালো এবং কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো আলো বা অন্য কিছু বেরিয়ে আসতে পারে না।
কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে লেস হোচেস সামার স্কুলে ১৯৭২ সালে উত্তেজনার চরম মুহূর্তে পৌঁছেছিল। সে সময় আমরা কৃষ্ণগহ্বর- সংক্রান্ত প্রধান সমস্যাগুলোর অধিকাংশই সমাধান করে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে ডেভিড রবিনসন ও আমি নো-হেয়ার থিওরেম প্রমাণ করেছিলাম। এই উপপাদ্যমতে, একটি কৃষ্ণগহ্বর এমন একটি অবস্থায় স্থির হবে, যাকে শুধু দুটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। সেই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো ভর আর ঘূর্ণন। এই উপপাদ্য আবারও ইঙ্গিত করল যে কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি আছে। কারণ, বিভিন্ন নক্ষত্র নিজের ওপর ভেঙে পড়ে একই ভর আর ঘূর্ণনের কৃষ্ণগহ্বর গঠন করতে পারে।
কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণগত কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়ার আগেই এসব তত্ত্ব বিকশিত হয়েছিল। ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনো সক্রিয় গবেষণাক্ষেত্র পরিচালনা করা উচিত। কিন্তু এ ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে তাঁর এই বক্তব্য সঠিক ছিল না। তবে একটি সমস্যার কখনো সমাধান পাওয়া যায়নি। সেটি হলো কসমিক সেন্সরশিপ হাইপোথিসিসের প্রমাণ। অবশ্য একে ভুল প্রমাণ করার জন্য অনেকবার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে সব গবেষণায় এটিই মৌলিক ভিত্তি। তাই এটি যাতে সত্য হয়, সে ব্যাপারে প্রবলভাবে আগ্রহী ছিলাম। এ সমস্যার ফলাফল নিয়ে কিপ থর্ন ও জন প্রেসকিলের সঙ্গে একটি বাজি ধরেছিলাম। বাজিতে আমার পক্ষে জেতা খুবই কঠিন ছিল। তবে কেউ যদি উন্মুক্ত পরম বিন্দুর কোনো বিপরীত উদাহরণ খুঁজে পায়, তাহলে আমার জন্য হেরে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল যথেষ্ট। আসলে আমি এই বাজির আগের সংস্করণে হেরে গিয়েছিলাম। কারণ, শব্দ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম না। টি-শার্টের বিনিময়ে একটা ফয়সালার প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। তবে তাতে থর্ন আর প্রেসকিলকে খুশি করা যায়নি।
ধ্রুপদি সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ব্যবহার করে আমরা বেশ সফলতা পেয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে ‘দ্য লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস-টাইম’ শিরোনামের গবেষণাপত্র প্রকাশের পর তত্ত্বটি নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে গিয়েছিলাম। পেনরোজের সঙ্গে আমার গবেষণা প্রমাণ করেছিল যে সাধারণ আপেক্ষিকতা পরম বিন্দুতে অকার্যকর হয়ে যায়। কাজেই পরের অনিবার্য পদক্ষেপটি ছিল বড় পরিসরের জন্য প্রযোজ্য সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং খুবই ক্ষুদ্র পরিসরের জন্য প্রযোজ্য কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটানো। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ে আমার আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আর সে সময় পরম বিন্দু-সংক্রান্ত সমস্যাটিকে খুবই কঠিন বলেই মনে হচ্ছিল। কাজেই প্রস্তুতিমূলক চর্চা হিসেবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী একটি কৃষ্ণগহ্বরের কাছে কণা ও ক্ষেত্রগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, তা-ই নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ভেবে অবাক হলাম, এমন কোনো পরমাণু কি পাওয়া সম্ভব, যার নিউক্লিয়াসই হবে আদিম মহাবিশ্বে গঠিত ক্ষুদ্র আদিম কৃষ্ণগহ্বর?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে একটি কৃষ্ণগহ্বরে কোয়ান্টামক্ষেত্র কীভাবে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকে, তা নিয়ে গবেষণা করতে লাগলাম। আশা করছিলাম, একটি ঘটনার তরঙ্গের অংশ শোষিত হবে এবং বাকিটা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ভীষণ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, কৃষ্ণগহ্বর থেকেও নিঃসরণ হয়ে থাকতে পারে। প্রথমে ভাবলাম, এটা সম্ভবত আমার গণনার ভুলের কারণে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম যে সেটিই সত্যি ছিল। অর্থাৎ একটি কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপিসহ ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রফল শনাক্তের জন্য যা দরকার, ওই নিঃসরণটি ছিল অবিকল সেটিই। একে একটা সরল সূত্রে প্রকাশ করা যায় : যেখানে S হলো এনট্রপি আর A ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রফল। এই সমীকরণে প্রকৃতির তিনটি মৌলিক ধ্রুবক আছে : c, আলোর বেগ; G, নিউটনের মহাকর্ষ ধ্রুবক; এবং h, প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। এই সমীকরণ প্রকাশ করে যে মহাকর্ষ আর তাপগতিবিদ্যার (তাপের বিজ্ঞান) মধ্যে একটি গভীর আর আগে কখনো ভাবা যায়নি, এমন কোনো সম্পর্ক রয়েছে।
একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিকিরণ নিঃসরণের মাধ্যমে সেখান থেকে শক্তি বেরিয়ে যায়। কাজেই কৃষ্ণগহ্বরটি ভর হারিয়ে একসময় সংকুচিত হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে কৃষ্ণগহ্বর পুরোপুরি উবে একসময় হারিয়ে যাবে। এতে একটি সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, যা পদার্থবিজ্ঞানের হৃৎপিণ্ডে আঘাত হেনেছিল। আমার গণনায় দেখা যায় যে ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রফল যদি কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপির সমান হয়, তাহলে এই বিকিরণ হবে তাপীয় এবং এলোমেলো। তাহলে কৃষ্ণগহ্বরটি কী দিয়ে গঠিত, সে-সংক্রান্ত সব তথ্য বিকিরণের মাধ্যমে কীভাবে বাকি থাকবে? আর তথ্যগুলো হারিয়ে গেলে সেটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সঙ্গে খাপ খায় না।
এই প্যারাডক্সটি নিয়ে ত্রিশ বছর ধরে বিতর্ক চলছে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে নতুন একটি সমাধান পাওয়ার আগপর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। তথ্য হারাবে না, কিন্তু তাকে কার্যকরী কোনো উপায়ে ফিরিয়েও আনা যাবে না। বিষয়টি অনেকটা এনসাইক্লোপিডিয়া পুড়িয়ে ফেলার মতো। অর্থাৎ কেউ যদি সব ধোঁয়া আর ছাই জমিয়ে রেখে দেয়, তাহলে এনসাইক্লোপিডিয়ার মধ্যে থাকা তথ্যগুলো তাত্ত্বিকভাবে হারাবে না বটে, কিন্তু তার পাঠোদ্ধার করা খুবই কঠিন। আসলে এই ইনফরমেশন প্যারাডক্স নিয়ে জন প্রেসকিলের সঙ্গে কিপ থর্ন আর আমি বাজি ধরেছিলাম। জন যখন এ বাজিতে জিতে গেল, তখন তাকে বেসবল এনসাইক্লোপিডিয়া দিয়েছিলাম। হয়তো তার বদলে তাকে আমার শুধু ছাই দেওয়া উচিত ছিল।
তথ্যনির্দেশ
কৃষ্ণগহ্বর : প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘ব্ল্যাক হোল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। সে বছর অ্যান উইন নামের এক সাংবাদিক ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়াম নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিল, সে বিষয়ে ওই রিপোর্টে কিছু উল্লেখ করেননি তিনি। এদিকে “মহাকর্ষীয় প্রবল আকর্ষণে নিজের ওপর পুরোপুরি ভেঙে পড়া কোনো নক্ষত্র’ বোঝাতে সংক্ষিপ্ত শব্দ হিসেবে মার্কিন পদার্থবিদ জন হুইলার ১৯৬৭ সালে ‘ব্ল্যাক হোল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপরই শব্দটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে ভেঙে পড়া এ ধরনের নক্ষত্রের ধারণাটি প্রথম দিয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার ও হার্টল্যান্ড সাইন্ডার, ১৯৩৯ সালে।
এদিকে ইংরেজি ‘ব্ল্যাক হোল’ শব্দটির উৎপত্তির সঙ্গে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক পথিক গুহ। ১৭৫৬ সালে কলকাতা ছিল ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি। কথিত আছে, ইংরেজদের সঙ্গে এক ঝামেলার কারণে সে বছরের জুনে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নিয়েছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তারপর তাঁর সেনার হাতে বন্দী হয় ১৪৬ জন। তাদের ৬৪ জনকে একটি কুঠুরিতে আটকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে সে রাতে সেই নরকে ৪৩ জন মারা গিয়েছিল। ইতিহাসে এ ঘটনাটি অন্ধকূপ হত্যা বা ব্ল্যাক হোল অব ক্যালকাটা নামে পরিচিত। অন্যদিকে কৃষ্ণগহ্বরকে মহাকাশের নরক হিসেবে কল্পনা করে ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ব্ল্যাক হোল শব্দটি বিভিন্ন বক্তৃতায় ব্যবহার করতেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট হেনরি ডিকি। তবে শব্দটি জনপ্রিয় করার পেছনে জন হুইলারের অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে।
ঘটনাদিগন্ত : কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা। এখান থেকে কোনো বস্তু বা বিকিরণ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। সাধারণ আপেক্ষিতা অনুসারে ঘটনাদিগন্ত হচ্ছে কোনো একটি ঘটনার স্থান-কালের সীমানা, যার বাইরে অবস্থিত কোনো পর্যবেক্ষকের ওপর ওই ঘটনার কোনো প্রভাব পড়ে না। সাধারণভাবে একে প্রত্যাবর্তনের শেষ বিন্দু বলা হয়। অর্থাৎ এখানে মহাকর্ষীয় টান এতই বেশি হয় যে কোনো কণার পক্ষেই সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয় না।
জন মিশেল : ইংরেজ পাদরি এবং বিজ্ঞানী জন মিশেল (১৭২৪-১৭৯৩ খ্রি.) জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব, আলোকবিজ্ঞান, মহাকর্ষসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবার ভূমিকম্প যে তরঙ্গের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়, সেটিও তিনি প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁকে ভূকম্পনবিদ্যার জনক বলা হয়।
ল্যাপ্লাস : ফরাসি এই গণিতবিদ, পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিদের পুরো নাম পিয়েরে-সাইমন মার্কুইস দ্য ল্যাপ্লাস (১৭৪৯-১৮২৭ খ্রি.)। সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের অন্যতম হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়। অনেকে তাঁকে ফ্রান্সের নিউটন হিসেবে অভিহিত করেন।
মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষা : একসময় ধারণা করা হতো, আলো ইথার নামের এক রহস্যময় মাধ্যমে চলাচল করে। ১৮৮৭ সালে আলবার্ট এ মাইকেলসন ও এডওয়ার্ড মর্লির পরীক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। সে কারণে পরস্পর সমকোণে আলোর বেগ পরিমাপ করেছিলেন। ইথারের অস্তিত্ব সত্যিই থাকলে তাঁদের মাপা গতি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন, দুই দিকেই আলোর একই বেগ পাওয়া যাচ্ছে। এভাবেই ইথারের অস্তিত্ব নাকচ হয়ে গিয়েছিল। এ আবিষ্কারের জন্য তাঁরা ১৯০৭ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ওপেনহাইমার : মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার (১৯০৪-৬৭ খ্রি.) ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। জাতে ইহুদি এই বিজ্ঞানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লস অ্যালামসে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প ম্যানহাটন প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁকে পারমাণবিক বোমার জনক বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন হিরোতে পরিণত হন। তবে যুদ্ধের পর পারমাণবিক বোমা তৈরি ফর্মুলা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পাচারের অভিযোগে তিনি বিচারের মুখোমুখি হন এবং ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।
রেডিও বা বেতারতরঙ্গ : বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মধ্যে যাদের কম্পাঙ্ক ৩০০ গিগাহার্টজ থেকে ৩ কিলোহার্টজ (বা যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার) তাদেরই বেতারতরঙ্গ বা রেডিও- তরঙ্গ বলা হয়। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালিতে এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যই সবচেয়ে বেশি। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটি ফুটবল মাঠের সমানও হতে পারে, আবার ফুটবলের মতো ছোটও হতে পারে। এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমা ১ মিলিমিটার থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই তরঙ্গ খালি চোখে দেখা যায় না। অন্যান্য বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণের মতো বেতারতরঙ্গও আলোর গতিতে ভ্রমণ করে। প্রাকৃতিক উপায়ে বেতারতরঙ্গ সৃষ্টি হয় সাধারণত বজ্রপাত বা মহাজাগতিক বস্তু থেকে। কৃত্রিমভাবে তৈরি বেতারতরঙ্গ মোবাইল টেলিযোগাযোগ, বেতার যোগাযোগ, সম্প্রচার, রাডার ও অন্যান্য দিকনির্দেশনা ব্যবস্থা, কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ, কম্পিউটার নেটওয়ার্কসহ অসংখ্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
এনট্রপি : এনট্রপি হচ্ছে একটি সিস্টেমের এলোমেলো বা বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। যে সিস্টেম যত এলোমেলো, তার এনট্রপি তত বেশি। তাপগতিবিদ্যার সূত্রমতে, মহাবিশ্বের সব বস্তুর মধ্যেই কিছু না কিছু এনট্রপি জড়িত। এতে যখনই কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে, তখনই তার এনট্রপি বেড়ে যায়। এনট্রপি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো বস্তুর ভেতরের অণু-পরমাণুগুলো আর এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হওয়া। বিজ্ঞানী বোলজম্যানের মতে, এনট্রপি একটি সম্ভাবনা। এনট্রপি ও সম্ভাব্যতার মধ্যে লগারিদমিক সংযোগ প্রথম উত্থাপন করেছিলেন বোলজম্যান। তখনকার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, তাপগতিবিদ্যায় সম্ভাব্যতার ধারণা সংযোজন করা উচিত। এভাবে তাঁর হাত ধরে পরিসাংখ্যিক তাপগতিবিদ্যারও জন্ম হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকে এনট্রপি নামক একটি গাণিতিক রাশির মাধ্যমে পরিমাপ করা সম্ভব।
প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক : কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ-বিন্যাস ব্যাখ্যা করতে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে এই ধ্রুবক প্রবর্তন করেন। তাঁর নামানুসারে এই ধ্রুবকের নামকরণ করা হয়েছে। পারমাণবিক পরিসরে কণা ও তরঙ্গের আচরণ ব্যাখ্যা করে এই ধ্রুবক। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্ল্যাঙ্ক বললেন, বিকিরণের শোষণ বা নিঃসরণ বিচ্ছিন্ন প্যাকেট বা গুচ্ছাকারে ঘটে। এই বিচ্ছিন্ন গুচ্ছ বা প্যাকেটের ক্ষুদ্রতম একককে তিনি বললেন কোয়ান্টাম। বিকিরিত রশ্মির ন্যূনতম মান নির্ধারিত হয় বিকিরণের কম্পাঙ্ক দিয়ে। অর্থাৎ কম্পাঙ্ক যত বেশি, তার কোয়ান্টামের শক্তিও তত বেশি। বিভিন্ন বিকিরণগুচ্ছের শক্তি পরিমাপের জন্য সমীকরণ প্রকাশ করলেন E=hv. এখানে E শক্তি, v কম্পাঙ্ক আর h হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। সেই হিসাবে প্রতি কম্পাঙ্কে যে পরিমাণ শক্তি থাকে, সেটিই প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক। এর মান 6.62607004 × 10^-34 m^2 kg/s।
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক : দুটি এক কেজি ভরের বস্তুকে পরস্পর থেকে এক মিটার দূরে রাখা হলে তারা পরস্পরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে, তার মানই হচ্ছে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। এ ক্ষেত্রে বলকে নিউটন এককে প্রকাশ করা হয়। মহাকর্ষীয় ধ্রুবককে G দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ১৭৭৪ সালে এন ম্যাসকেলিন প্রথম মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান নির্ণয় করেছিলেন। পরে ১৭৯৮ সালে বিজ্ঞানী ক্যাভেন্ডিশ গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে আরও নির্ভরযোগ্য ফলাফল নির্ণয় করেছিলেন। আধুনিক পদ্ধতিতে মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান ৬.৬৭× ১০-১১ মিটার^৩ কিলোগ্রাম^-১ সেকেন্ড^-১।