শিকারিরা – ওয়াল্ট সেন্ডন

শিকারিরা – ওয়াল্ট সেল্ডন

যেমনটি শোনা গিয়েছিল ঠিক সেইভাবে স্পেসশিপ উপত্যকায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিল। যে শৈলশিরায় দাঁড়িয়ে লন আর জেনি স্বচক্ষে সব দেখল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে লন বলল, আমাদের যেতে হবে– দূরে, আরও দূরে পাহাড়গুলোর কাছে চারা ক্যানিওন যেতে হবে– এক খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে…

–চারা ক্যানিওনে-ও যখন ওরা পৌঁছে যাবে?

লন ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। জেনির চোখ দুটো যেন না জ্বলা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ… ধূমায়িত… এখন জ্বলে ওঠেনি। অবশ্য কোনওদিনও জ্বলে ওঠেনি। এটাই জেনির স্বভাব… শুধু জেনি কেন, এটাই হল স্ত্রীজাতির আসল চরিত্র… ধীর স্থির… সর্বক্ষণ। পুরুষের পাশে পাশে। পুরুষেরা যে দিকে যায় নারীও সে দিকে অনুসরণ করে। জেনি লনের স্ত্রী। ছায়ার মতো। লনের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে… সেই যে ঝকঝকে শহরে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ শুরু হল… দৈত্যাকার কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশপানে উঠে গেল, চারদিকে কেবল রাশি রাশি কাঠের টুকরো, বাড়ি ভাঙার ধ্বংসস্তূপ। নিধনযজ্ঞের পূর্ণাহুতি কবে হবে কে জানে?

ওরা একা নয়… কাতারে কাতারে মানুষ পাহাড় অভিমুখে ছুটেছে… এই মহাদেশের পাহাড়গুলোই হল মেরুদণ্ড। পলাতকরা দলবদ্ধ নয়… ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেউ গেছে পাহাড়ি ঢালে, কেউ বা লুকিয়েছে গভীর সব গিরিখাদে। সেখানেই তারা পাথর কাঠ আর মাটি দিয়ে গড়ে তুলেছে ছোট ছোট কুঁড়েঘর।

–কী হল, কথা বলছ না কেন… চারাতেও যখন ওরা পৌঁছে যাবে?

দু’কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে রইল লন। বলার কিছু নেই।

নিচের উপত্যকায় কী যেন রোদের আলোয় চমকে উঠল। ঘন গাছপালার মধ্যে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। মনে হয়, কয়েকশো গজ নিচে। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল… চোখ কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পরে বোঝা গেল কয়েকটা অবয়ব খুব সন্তর্পণে উঠে আসছে। এইদিকে। হাতে ওদের বিচিত্র সব অস্ত্র… সেই অস্ত্রের ওপরে আলোর প্রতিফলনই ওর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে।

–জেনি… চলে এসো। চাপাস্বরে লন ডাকল।

–কোথায়? কেবিনে?

–না না–কেবিনের মায়া করলে হবে না… দু’একদিনের মধ্যেই ওরা হদিশ পেয়ে যাবে… চারা ক্যানিওন…

আবার শুরু হল পথচলা উত্তরদিকে। বারে বারে পেছন ফিরে উপত্যকায় দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করল। বেশ কয়েকজনকে নজরে পড়ল। শুধু শহরেই নয়… অরণ্য উপত্যকাতেও ওরা ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রের মতো যানবাহন… ঠিক যেমনটি বেতার মারফত বারেবারে প্রচার করা হয়েছিল। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ হুবহু মিলে যাচ্ছে। একে একে সব ক’টা বেতারকেন্দ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। শহরের পর শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল।

গিরিখাত বেয়েই ওরা চলছিল। নিবিড় গাছপালার মধ্যে অতি সন্তর্পণে মৃদুগতিতে ওরা পালাচ্ছিল… দূরে, আরও দূরে কোনও নিভৃত আশ্রয়ে। পত্রবহুল বৃক্ষশাখার আলো আঁধারির মধ্যে ওরা বিশ্রাম নেয়… আবার পথ চলে। দৌড়োয় না অথচ লম্বা লম্বা পা ফেলে। ওদের চলার মধ্যে কেমন যেন ছন্দ থাকে।

মাঝে মাঝে ওপরে নজর যায়… চাঁদোয়ার মতো নীলাকাশ। দূরে দূরে উপত্যকায় ওদের অবস্থিতি। দেখা না গেলেও লনের বুঝতে অসুবিধে হয় না। পশ্চিমের নিবিড় অরণ্যাবৃত বিস্তৃত মালভূমিও নিশ্চয় শত্রু-কবলিত। হঠাৎ অস্পষ্ট এক অজানা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল লন। এ তো সেই ভিনগ্রহীদের কণ্ঠস্বর। সোজা পথ ছেড়ে কোনাকুনি উঠে আসছে ক’জন।

আরও উত্তরে গভীর গিরিখাত বেয়ে লন আর জেনি আবার পাহাড়ের পাদমূলে নামতে শুরু করল। নিরবচ্ছিন্ন পর্বতমালা যেখানে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেই স্থান থেকে মাইল খানেকের মধ্যে রয়েছে চারা ক্যানিওন। দুর্ভেদ্য অরণ্যের সঙ্গে সমতলে ছোটবড় টিলার সমাবেশ। বেশ কয়েকবার অস্ত্র গর্জনের শব্দ শোনা গেল। পাহাড় অধ্যুষিত উপত্যকায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল সেই অনুরণন। ওদের পেছনে গিরিসঙ্কটের ওপর থেকেও একই শব্দ ভেসে আসছে। বুঝতে বাকি রইল না যে, শিকারিরা ওদেরকে অনুসরণ করে চলেছে।

ঢালের সর্বশেষ প্রান্তে পর্বতের পাদদেশে ওরা নেমে এল– সামনে এক জলবিহীন ক্ষীণ নদীখাত। লন এক লাফে অতিক্রম করে ওপার থেকে জেনির জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। হাত ধরে লাফ দেবার সঙ্গে সঙ্গে হাত ফসকে জেনি মাটিতে পড়ে গেল। গোড়ালি মচকে গেল।

–উঃ মাগো!

–জেনি আর একটু কষ্ট করে চলো… আমাদের যে চারা ক্যানিওনের জঙ্গলে ঢুকতে হবে। স্ত্রীকে তাড়া দিল লন।

স্ত্রীর কটিদেশ বেষ্টন করে দ্রুত চলার চেষ্টা করল লন। মুখে না বললেও প্রতি পদক্ষেপেই জেনির মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হচ্ছে। জেনি জানে থামলে চলবে না… যে কোনওরকমে যেতেই হবে… দূরে আরও দূরে।

বছরখানেক আগের কথা মনে পড়ে গেল। হানাদারদের প্লেন তখন দেখা গেছে… সংখ্যায় ওরা বেশি নয়। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চলল… পরপর ক’টা প্লেন মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগোলকে রূপান্তরিত হয়ে সশব্দে ভেঙে পড়ল শহরের ওপরে। রাশি রাশি ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশকে মলিন করে দিল। তখন জেনি বলছিল– আহা রে… হানাদার হলেও ওদেরও তো জীবন আছে.. কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে… ওদের জন্যে কষ্ট হয়।

এরপর হানাদারদের আক্রমণ আরও তীব্র হয়। লন তখন এক এয়ারক্রাফট কারখানায় কাজ করত। নিজেরও একটা ছোট প্লেন ছিল। একদিন সেই প্লেনেই রাতের বেলায় শহর। ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল ওরা… মাঝে জ্বলন্ত এক শহরে নেমে বেশ কিছুটা জ্বালানি চুরি করে আবার আকাশপথে উত্তরে উড়ে চলে তারা। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। একদিন পাহাড়ের মাথায় প্লেনটা আছড়ে পড়ে। প্রাণে বেঁচে যায় ওরা। ভাঙা প্লেনের খণ্ডাংশ দিয়ে ওরা কেবিন তৈরি করে বসবাস শুরু করে। কিন্তু সেখানেও হানাদারদের সুতীক্ষ্ণ নজর এড়াল না।

গুলির শব্দে চিন্তার রেশ কেটে গেল ওদের। খুবই নিকটে শব্দের উৎস। সভয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল। গিরিখাত বেয়ে হানাদাররা নেমে আসছে। সংখ্যায় ওরা অনেক। জেনিকে জোর করে টানতে টানতে বিশাল এক গাছের আড়ালে আত্মগোপন করল লন।

যন্ত্রণায় মুখ টিপে রইল জেন। ব্যথায় সমস্ত দেহ যেন ছটফট করে উঠল।

এবার দু’হাতে বুকের মধ্যে তাকে তুলে নিল লন। পরম মমতায় আশ্বস্ত করতে চাইল। ধীরে ধীরে গাছের তলায় জেনিকে নামিয়ে দিল লন। সেও পাশে বসে পড়ল। দুজনেই আতঙ্ক আর ক্লান্তিতে জেরবার। এরপর আর কী করার থাকতে পারে! গভীর আশ্লেষে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। হৃদয়ে হৃদয়ে অব্যক্ত ভাব বিনিময় হল। চার চোখের মিলনে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আর ওদের চলার শক্তি নেই।

দূরে হানাদারদের কণ্ঠস্বর যেন কষাঘাত করছে বারে বারে। লনের শুষ্ক দুই ঠোঁট জেনির মুখমণ্ডল বারবার স্পর্শ করে আশ্বস্ত করার প্রয়াস করল। জেনির দু’গাল বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুধারা সযত্নে মুছিয়ে দিল লন। বিড়বিড় করে কত কথাই না বলে চলল… মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে যাওয়া সুখের দিনের স্পর্শ পেতে চাইল ওরা।

–লন… আমার লন… আমরা দুজনে একসঙ্গে আছি… এর চেয়ে আর কিছু কামনা করি না। জেনির স্বরে পরম তৃপ্তির ছোঁয়াচ।

হানাদারদের পায়ের চাপে ঝোঁপঝাড় ভাঙার আওয়াজ উঠছে। আরও কাছে এগিয়ে আসছে তারা।

হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল লন। শব্দ লক্ষ্য করে কয়েক পা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। দু’হাতের বজ্রমুষ্ঠি আর ইস্পাতের মতো টান টান সর্বাঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ের এক নতুন মাত্রা যোগ হল। দু’চোখের তারায় তারায় অবিশ্বাস্য এক বিদ্রোহ যেন মূর্ত হয়ে উঠল।

–শয়তানের দল! আর পালাব না… এবার মুখোমুখি…। চিৎকার করে বলে উঠল লন।

–লন… আমার লন… এ উত্তেজনা তোমায় মানায় না। ভুলে যেও না ওরা হানাদার… শিকারি… মায়া, দয়া সভ্যতার দান… কিন্তু ওরা সভ্য নয়! আর সভ্য নয় বলেই ওরা বিনা কারণে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে… জেনির শান্ত কণ্ঠস্বরে ধিক্কার ধ্বনিত হয়ে উঠল।

ধীরে ধীরে এক শিকারি লনের সামনে এসে দাঁড়াল। লনের আপাদমস্তক বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল… মাটিতে পড়ে থাকা জেনিকে বারেবারে লক্ষ করল। মনে হল শিকারি ভয় পেল আর ভয়ের কারণেই আত্মরক্ষার অজুহাতে চকচকে অস্ত্র ওদের পানে বাগিয়ে ধরল।

ভয়শূন্য চিত্তে লন তাকিয়ে রইল হানাদারদের দিকে। খুব ভালো করে লক্ষ করল শিকারি হানাদারকে। এত কাছ থেকে ওদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওর। এরাই তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহের জীব… সূর্যের তৃতীয় গ্রহ–চাঁদ যার একমাত্র উপগ্রহ। এদেরই নাম মানুষ!

লনের পাশে জেনি উঠে দাঁড়াল। অপেক্ষা শুধু ফট ফট দুটো শব্দ… মানব সভ্যতার নিদর্শন।