অ্যাপয়েন্টমেন্ট – এরিক ফ্র্যাঙ্ক রাসল

অ্যাপয়েন্টমেন্ট – এরিফ ফ্র্যাঙ্ক রাসেল

পেশিবহুল দীর্ঘদেহ, ঠিক যেন জাঁদরেল কুস্তিগির। বাঘের মতো সাহসী দুর্ধর্ষ। দারুণ পে কর্মব্যস্ত তাঁর জীবন… অলসতা দু’চক্ষের বিষ। অন্ধকার জগতের একচ্ছত্র অধিপতি, যাঁর ঘণ্টা-প্রতি মূল্য কয়েক হাজার মুদ্রা। ওঁর চেয়ে দামি ব্যক্তি আর যে কেউ হতে পারে এমনটি মনে হয় না।

হ্যাঁ… ওঁর নাম হেনরি কারান।

অপরাধের কি বিচার হয় না?

জঙ্গলের রাজত্বে অবশ্যই হয় না। আর বিরোধীদলকে কজা করা তা যেমন করেই হোক না কেন সেই হল নিয়ম। কিন্তু এর শেষ কোথায়?

প্রকাণ্ড বড় সাজানো-গোছানো অফিসে দরজা ঠেলে ঢুকলেন কারান। টুপিটা স্ট্যান্ডে রেখেই বিশাল টেবিলের একপাশে প্রকাণ্ড চেয়ারে বসে পড়লেন। সামনে সুদৃশ্য দেওয়াল ঘড়ি। সময় এখন বারোটা বাজতে ঠিক দশ মিনিট বাকি।

চেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের দরজার দিকে চেয়ে রইলেন। দশ সেকেন্ড চলে গেল। অধৈর্য কারান টেবিলের পাশে অনেকগুলো বোতামের মধ্যে লাল বোতামটা সজোরে টিপে ধরলেন। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন মিস রীড।

–বলি, ব্যাপারটা কী? দিনে দিনে দেখি অধঃপতনই হচ্ছে। রাতারাতি বয়সটা বেড়ে গেল না কিছু মতলব আছে? প্রশ্নের ঝড় তুললেন কারান। ক্ষেপে উঠলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না তাঁর।

দীর্ঘাঙ্গিনী সুন্দর মুখশ্রীসম্পন্না যুবতী মিস রীড। পরিধেয় বস্ত্রেও সুরুচির পরিচয়। মুখমণ্ডল জুড়ে অজানা আতঙ্ক। এইরকম নম্র স্বভাবেরই কদর করেন কারান।

–দুঃখিত স্যার। আমি…

ব্যস ব্যস! অজুহাত দিয়ে লাভ হবে না। চলাফেরা কথাবার্তায় গতি চাই… বুঝলে,–গতি! চটপটে না হলে জীবনে কিছুই হবে না। বুঝলে?

–আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার।

–ল-লোর্দোকি কি ফোন করেছিল?

–না স্যার।

–ধরা না পড়লে ও এতক্ষণে ডেঞ্জার-জোন পেরিয়ে গেছে। আবার ঘড়ির দিকে তাকালেন… অসহিষ্ণু হাতে টেবিলে টরেটক্কা বাজাতে শুরু করলেন।

–কিন্তু ও যদি উলটোপালটা করে… তখন কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না… হ্যাঁ হ্যাঁ ফোন করলে বলে দিও… আমি কিন্তু কোনও রিস্ক নেব না… বুঝলে… একবার জেল খাটলে বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল! আপন মনে গজগজ করতে লাগলেন কারান।

-–ঠিক আছে স্যার… ফোন এলেই বলে দেব। কিন্তু এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক…

-–একদম চুপ করে থাকবে! বলেছি না যখন আমি কথা বলব… তুমি কথা বলবে না। হ্যাঁ শোনো, মাইকেলসন ফোন করলে বলবে ফায়ারফ্লাই উড়ে গেছে… সঙ্গে সঙ্গে ভসকে ফোন করে জানাবে… এক মুহূর্তও যেন ওর দেরি না হয়।.. কী, শুনছ? নাকি অন্যদিকে মন পড়ে আছে? মনে থাকবে তো? এক সেকেন্ডও যেন দেরি না হয়। একনাগাড়ে গজগজ করে চলেছেন কারান।

–উঃ কী যে করি… বারোটা কুড়িতে মিটিং আছে, খুব জরুরি… যেতেও হবে অনেক পথ। কতক্ষণ যে চলবে কে জানে! শোনো, আমার কথা জিজ্ঞেস করলে সটান বলে দেবে তুমি জানো না… কখন ফিরব বা ফিরব না তাও জানো না। কী, মনে থাকবে তো? কী হল, কথার উত্তর দিচ্ছ না যে! তবে জেনে রাখো ফিরতে ফিরতে আমার চারটে বেজে যাবে। বুঝলে?

–বুঝেছি। কিন্তু স্যার…

–ভালো করে বুঝেছ… চারটের আগে কেউ আমার দেখা পাবে না!

–স্যার এক ভদ্রলোক যে বসে আছেন… উনি বললেন যে, আপনার সঙ্গে নাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে ঠিক বারোটা বাজতে দু’মিনিটে।

–কীসব বকছ পাগলের মতো? তোমার হয়েছেটা কী? ধমকে উঠলেন কারান। একটু শুনুন– উনি যা বলেছেন আমি শুধু সেইটুকুই বলেছি। ভদ্রলোকের কথাবার্তায় খুব সিরিয়াস মনে হয়েছে স্যার।

–হুঁ, কথা শুনেই সব বুঝে গেলে? সিরিয়াস! সব ভেক্ ভেক্.. দেখো ভালো করে, হয়তো ভুল ঠিকানায় এসেছে। তা নয়ত সোজা পথ দেখতে বলো!

–তাহলে সবটা শুনুন স্যার। আমি বলেছি আপনি অফিসে নেই। অনেকক্ষণ বেরিয়ে গেছেন… ফেরার কোনও ঠিক নেই। সব শুনে ভদ্রলোক চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, আমি অপেক্ষা করছি… আপনি নাকি ঠিক বারোটা বাজতে দু’মিনিট আগেই ফিরবেন।

নিজেদের অজান্তেই দুজনে ঘড়ির দিকে তাকালেন। কারান নিজের হাতঘড়িটা চোখের সামনে মেলে ধরলেন। না… দুটো ঘড়ি একই বলছে…

–শোনো… ভদ্রলোককে বিদায় করো! নিজে থেকে না গেলে বলো, দারোয়ান দিয়ে বের করে দিতে হবে?

–না স্যার… দারোয়ানের দরকার হবে না… ভদ্রলোক বৃদ্ধ তারপরে দৃষ্টিশক্তিহীন… অন্ধ!

–বৃদ্ধ আর অন্ধ হলেই বা আমার করার কী আছে… এর পরে হাত-পা থাকলেও আমার যে কথা সে কাজ। যাও যাও… বার করে দাও।

মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রীড। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে এক অদ্ভুত মুখে ফিরে এলেন।

–না স্যার পারলাম না। উনি বারবার করে বলছেন আজকের দিনটা নাকি অনেক দিন আগেই ঠিক করা ছিল… ঠিক বারোটা বাজতে দু’মিনিটে। ব্যক্তিগত এক জরুরি বিষয়েই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে উঠল কারানের মুখমণ্ডল। বড় বড় চোখ করে ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন তিনি কয়েক মুহূর্ত। ঘড়ির কাঁটা এখন বারোটা বাজতে ঠিক চার মিনিট। ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলেন– অন্ধ লোক! আমি কোনও অন্ধ লোককে চিনি না… আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে আমি ভুলি না… যাও যাও, কথা না বাড়িয়ে হাত ধরে পথে নামিয়ে দাও।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় রীড কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্যার একবার না হয়…

–না না না! এক্ষুণি ওকে বার করে দাও!

–স্যার… হয়তো আপনার নিকটজন ওঁকে পাঠিয়েছেন… কথা বললে হয়তো বুঝতে পারবেন।

একটু চিন্তা করে বললেন– তা হতে পারে… এতক্ষণে তোমার ব্রেন কাজ করছে। দেখছি। যাক, ভদ্রলোকের নাম কী?

–নাম বলছেন না!

–কী কাজ তাও বলছেন না?

–হুম! বেশ ঠিক দু’মিনিট সময় দিচ্ছি। দান-খয়রাত চাইলে সটান জানালা দিয়ে ফেলে দেব, মনে থাকে যেন। অযথা সময় নষ্ট করতে বারণ করো। যাও নিয়ে এসো।

রীড ভদ্রলোককে নিয়ে এলেন… একটা চেয়ার টেনে বসতে বললেন। পরে দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেলেন। ঘড়িতে বারোটা বাজতে ঠিক তিন মিনিট বাকি।

…কারান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভদ্রলোকের আপাদমস্তক দেখলেন বারবার। সচরাচর এমন লম্বা-চওড়া লোক দেখা যায় না, একমাথা ধবধবে সাদা চুল। সর্বাঙ্গে ঢিলেঢালা কালো অঙ্গরাখা… সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক দ্যুতি। চক্ষুবিহীন অক্ষিকোটর-দুটি দারুণ বাঙময়।

দৃষ্টিহীন চোখ দুটো যেন দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি প্রাণবন্ত। অন্ধ চাহনিতে হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত যেন ছবি তুলে নেয়… এ কী চোখ… এ যে দৃষ্টিমানদের চেয়েও অনেক তীক্ষ্ণ! কেমন যেন শিহরণ বয়ে গেল সর্বাঙ্গে। কালো কালো অক্ষিকোটর দুটি যেন ব্যঙ্গ করে উঠল।

জীবনে এই প্রথম ভয় পেলেন কারান।

-–বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি?

-–কিছু না… কোনও কিছু করারই প্রয়োজন নেই! কী গম্ভীর কণ্ঠস্বর! নিচুস্বরে কথা বললেন, যেন গমগম করে উঠল সমস্ত ঘর। নিস্পৃহ নির্মোহ কণ্ঠস্বর। পৃথিবীর অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত। স্থির হয়ে চেয়ারে বসে মণিহীন অক্ষিকোটর দুটি কারানের ওপরে নিবদ্ধ। কী শীতল বরফকঠিন সান্নিধ্য। অজানা আতঙ্কে কারানের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। ক্রোধে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল।

–দেখুন, অযথা আমার সময় নষ্ট করবেন না… আপনার কী প্রয়োজন বলে ফেলুন চট করে, আর না হলে পথ দেখুন!

–ভুল করছেন! সময়টা আপনার নয় বরং এই সময়-ই আপনাকে টেনে নিয়ে যায়।

–কী বলতে চাইছেন? হেঁয়ালি ছেড়ে কাজের কথায় আসুন। কে আপনি? কী আপনার পরিচয়?

-–আমাকে আপনি চেনেন… সকলেই আমাকে চেনে। প্রত্যেকেই নিজেকে সূর্যের মতো শক্তিশালী ভাবে, কিন্তু কালো মেঘও সূর্যকে ঢেকে দেয়… আবার সূর্যও তো অক্ষয় অমর হয়। সময় হলে…

হিমশীতল স্রোতের মুখে কারান যেন নিষ্প্রভ শক্তিহীন।

–এত হেঁয়ালি কেন? পাগলের মতো কথা বলছেন!

–না… হেঁয়ালি বা পাগলামি করছি না। কণ্ঠস্বরে লৌহকঠিন প্রত্যয়ের সুর। হঠাৎ কারানের মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ হল। ক্রোধে জ্বলে উঠল দুই চোখ। টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে উঠলেন– চুপ। পাগলামি বন্ধ করুন! সোজা কথায় বলুন কী চান আপনি?

স্থান-কাল-পাত্র যেন বিলীন হয়ে গেল। ক্রমেই অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেধহীন অবয়বশূন্য মহাকালের অসীম হাত এগিয়ে এল কারানের দিকে। মৃত্যুর মুখে উচ্চারিত হল… তোমাকে!

মৃত্যু কারানকে নিয়ে গেল মহাকালের কোলে।

ঘড়িতে তখন বারোটা বাজতে ঠিক দু’মিনিট বাকি!