গণিতজ্ঞ – আর্থার ফেল্ডম্যান

গণিতজ্ঞ – আর্থার ফেল্ডম্যান

ওরা তখন বাগানে। নয় বছরের কন্যাকে ডাক দিয়ে জেনিয়া হকিন্স বললেন–দুষ্টুমি করে না জো… হুড়োহুড়ি না করে বাবার কাছে এসে বসো… বাবা কত মিষ্টি গল্প জানে।

দুই গাছের ডালে বাঁধা হ্যামকে এসে বসল জো। বাপি… ও বাপি… সত্যি গল্প? বলো না বাপি… সত্যি?

–হ্যাঁ গো হ্যাঁ, যেমনটি ঘটেছিল ঠিক তেমনটিই বলছি। কন্যার গাল টিপে সস্নেহে বললেন ড্রেক হকিন্স৷

হ্যামকের মধ্যে বাবার কাছে ঘন হয়ে বসল জো।

–আজ থেকে ঠিক দু’হাজার এগারো বছর আগে ডগস্টার-এর সিরিয়াস গ্রহের বাসিন্দারা পৃথিবী আক্রমণ করে।

-–বাব্বাঃ… কী নাম! ডগস্টার! ওঁরা দেখতে কেমন ছিল বাবা?

তা প্রায় মানুষের মতোই.. মানুষের সঙ্গে খুবই মিল ছিল। ওদেরও দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ এবং অন্যান্য সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গও মানুষেরই মতো।

–বুঝলাম… কিন্তু সত্যি কি কোনও তফাৎ ছিল না? বিজ্ঞজনের মতো প্রশ্ন করল কন্যা।

–নিশ্চয় প্রভেদ ছিল… আগন্তুকদের প্রত্যেকের দুটো করে সবুজ ডানা ছিল। দুই কাঁধের পাশ দিয়ে সবুজ পালক-এ ঢাকা বড় বড় দুই ডানা, আর ছিল রক্ত লাল লম্বা এক লেজ।

–লেজও ছিল? আচ্ছা বাপি, ওরা কতজন এসেছিল?

–ত্রিশ লক্ষ একচল্লিশজন ছিল বয়স্ক পুরুষ, আর তিনজন মাত্র মহিলা। সার্দিনিয়া দ্বীপে ওরা সর্বপ্রথম পদার্পণ করে। আর পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই ওরা সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে বসল।

–পৃথিবীর লোকেরা বাধা দেয়নি? যুদ্ধ করেনি?

–করেনি আবার! গুলি-গোলা, অ্যাটম বোমা, গ্যাস, আরও কত কী সব মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল!

-–ওগুলো কী বাবা… অস্ত্র জিনিসটাই বা কেমন?

-–ওহো… বুঝতে পারছ না বুঝি? না পারারই কথা। অস্ত্রশস্ত্র যে সব সেকেলে হয়ে গেছে… তাও অনেক অনেক বছর হয়ে গেল। শত্রুদের মারার জন্যে ভয়ঙ্কর সব হাতিয়ার ব্যবহার হত। বহুকাল হল অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে মামনি। উঃ, কী সব যুগ গেছে! শুনলেও গা শিউরে ওঠে! রক্ত, হত্যার নেশায় মানুষ সে যুগে পাগল হয়ে গেছিল! সে। যুগের কথা স্মরণ করে মনে মনে শিউরে উঠলেন ড্রেক।

–বুঝলাম! সে যুগে এখনকার মতো বুদ্ধির লড়াই হত না… তাই না বাপি? বড় বড় চোখ করে বলে জো।

-–ঠিক বলেছ মামনি… সে যুগে মানুষেরা বন্দুক দিয়ে লড়াই করত… বুদ্ধির ব্যবহার জানতই না। যাক সে সব কথা… আক্রমণকারী ভিনগ্রহীরা কিন্তু অজেয় ছিল… কোনও অস্ত্রেই ওদের নিধন করা গেল না।

–তারপর?

-–এরপর মানুষেরা মারাত্মক গ্যাস আর জীবাণুযুদ্ধ শুরু করল।

–জীবাণু? সে আবার কী বাপি?

–খুবই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জীব… খালি চোখে দেখা যায় না… মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়। আগন্তুকদের শরীরে সেই সব রোগজীবাণু ইঞ্জেকশন করে ঢুকিয়ে দেওয়া হল… তাতেও ওদের কিছুই হল না….

–উরি বাব্বা, তারপর… তারপর?

–সমস্ত পৃথিবী ওরা দখল করে নিল… পৃথিবীটা মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেল। তুমি তো জানোই মামনি, এই নবাগতরা অঙ্কে খুবই পারদর্শী ছিল… আর তেমনি ছিল ওদের বুদ্ধি… মানুষ ওদের ধারেকাছে আসতে পারত না। এক কথায় বলা যায় ভিনগ্রহী আক্রমণকারীরা গোটা মিল্কিওয়ে মানে আকাশগঙ্গার মধ্যে শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ ছিল। সংখ্যা নিয়েই ওদের খেলা… সংখ্যার সাহায্যে ওরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল।

-–তারপর কী হল বাপি? পৃথিবীর সব লোকগুলোকে কি ওরা মেরে ফেলল?

–না, ঠিক তা নয়, তবে অসংখ্য মানুষকে ওরা হত্যা করেছিল। আর অবশিষ্টদের ওদের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়ে দিল। মানুষ একরকম দাসত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল।

তুমি তো জানো মামনি, সেই আদ্যিকালে মানুষ যেমন করে গোরু-ঘোড়া-ছাগল পুষত… ঠিক তেমনিভাবে ভিনগ্রহীরাও মানুষকে পোষ মানিয়ে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করেছিল।

অবশিষ্ট মানুষকে ওরা হত্যা করে খাদ্যে রূপান্তরিত করেছিল।

–বাপি, ভিনগ্রহীরা কোন ভাষায় কথা বলত?

-–খুব… খুবই সাধারণ ভাষা… কিন্তু মানুষরা কোনওদিনও সেই ভাষা আয়ত্ত করতে পারল না। নবাগতরা কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর সব ভাষাই শিখে ফেলল।

–পৃথিবীর মানুষরা কী নামে ডাকত ওদের বাপি?

–সে এক মজার নাম দিয়েছিল। অ্যানভিল। বর্তমানে অপ্রচলিত ইংরাজি ভাষায় এর অর্থ হল, অর্ধেক-দেবতা অর্ধেক-শয়তান।

–তাহলে বাপি, মানুষ দাসত্ব মেনে নেবার পরে নিশ্চয় পৃথিবীতে শান্তি নেমে এসেছিল?

–তা এসেছিল। তবে সেই শান্তি বেশিদিন টিকল না দাসত্ব স্বীকার করার পরেও একজন সাহসী মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করল… গ্রীনল্যান্ডের অভ্যন্তরে সে লুকিয়ে রইল। সে হল নোওয়াল। সাহসী এই নোওয়াল ছিল একজন প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ।

–মনস্তত্ত্ববিদ! সে আবার কী?

-–যারা মনের কথা পড়তে পারে… নতুন ভাবনার জন্ম দেয়… মনের অসুখ ভালো করে দেয়… এরপর কী হল জানো… এই নোওয়ালই এক মুক্তির পথ বাতলাল… পৃথিবীকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখল।

–কিন্তু কেমন করে বাপি? উঃ, কী মজার ঘটনা!

–ব্যাপারটা খুবই জটিল। তবে আসল কথা হল মানুষের সব ভাবাবেগ এক গোপন প্রক্রিয়ায় অ্যানভিলদের মনে চালান করে বা রোপণ করে দেওয়া হল। অথচ ভিনগ্রহীদের মনে শোকদুঃখ, আবেগ, মন হু হু করা প্রভৃতি কিছুই ছিল না!

এতক্ষণ চুপ করে গল্প শুনছিলেন জেনিয়া। এবার জেনিয়া বলে উঠলেন– ড্রেক, জো-র মতো করে গল্পটা শেষ করো… এত বড় বড় কথা কি ও বুঝতে পারবে?

না না মা… আমি সব বুঝতে পারছি… না বাপি… তুমি সব বলো আমাকে! মাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল কন্যা।

–হ্যাঁ, যা বলছিলাম… নোওয়াল তো বিজ্ঞানের কলাকৌশলে দারুণ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে প্রত্যেক অ্যানভিলের মধ্যে মানবিক অনুভূতি ঢুকিয়ে দিল।

–মানবিক অনুভূতি? সেটা কী বাপি?

-–ভালো প্রশ্নই করেছ। মানবিক অনুভূতি হল, ভালোবাসা, ঘৃণা, উচ্চাশা, ঈর্ষা, হিংসা, অপরের ক্ষতির চেষ্টা করা, শত্রুতা, হতাশা, আশা, ভয়, আতঙ্ক, লজ্জা প্রভৃতি। ব্যাস, খুব অল্প সময়ের মধ্যে অ্যানভিলরা মানবিক আচরণ শুরু করে দিল। দশটা দিনও গেল না… অ্যানভিলদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। শয়ে শয়ে অ্যানভিল মারা পড়ল। কয়েক দিনের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ অ্যানভিল পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেল।

–তাহলে বাপি, অ্যানভিলরা নিজেরাই মারপিট করে মরে গেল?

-–তুমি ঠিকই বলেছ মামণি… তবে এরই মধ্যে এক ভিনগ্রহী, নাম তার জলিবার, অ্যানভিলদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুললেন। অবশিষ্ট ভিনগ্রহীরাও হানাহানি বন্ধ করে সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হল। তার মানে ভিনগ্রহীরা সব এককাট্টা হল। তার ফলে পৃথিবীর মানুষেরা নতুন করে দাসে পরিণত হল।

–তাহলে তো নোওয়ালের বুদ্ধি খাটল না। …গ্রীনল্যান্ডে বসে নোওয়াল তাহলে নিশ্চয় নতুন কোনও ফন্দি আটল?

-–না মামনি, নতুন কোনও ফন্দি নয়। তবে মানবিক অনুভূতির মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করল।

–মোক্ষম অস্ত্র? এই যে বললে অস্ত্র সব সেকেলে হয়ে গেছে।

–না না সে অস্ত্র নয়… বুদ্ধিটাকেই অস্ত্রের মতো কাজে লাগাল… অ্যানভিলদের মধ্যে স্বদেশে ফিরে যাবার প্রবল বাসনা জেগে উঠল। শুরু হল মানসিক ছটফটানি।

–বাব্বা, ভারী বুদ্ধি ছিল তো! গালে হাত দিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল কন্যা।

–খুউব বুদ্ধি ছিল… দেশে ফেরার জন্যে প্রতিটি অ্যানভিলই পাগল হয়ে উঠল। কতদিন ওরা তারার দেশ ছেড়ে পোড়া পৃথিবীতে এসেছে। সুতরাং একদিন সব অ্যানভিলরা উত্তর আমেরিকার কালো পাহাড়ে জড়ো হল। পাহাড়ি উপত্যকা ভরে অ্যানভিলরা উপচে পড়ল আশপাশে। দেশপ্রেমের গান গাইতে গাইতে ওরা সবুজ ডানা মেলে উড়ে গেল সেই দূর নক্ষত্রলোকে… নিজেদের জন্মভূমিতে।

পৃথিবীর মানুষেরাও মুক্তির আনন্দে নেচে উঠল। পুরো সাত দিন সাত রাত ওরা জয়োল্লাস করল।

–তাহলে বাপি… সব অ্যানভিলরাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।

–না না… সক্কলে চলে গেলেও দুই ছোট ছেলেমেয়ে কিন্তু একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেও পৃথিবীর বুকে ফিরে এল। ওদের বয়স তখন মাত্র দু’বছর। এই পৃথিবীর বুকেই ওদের জন্ম হয়েছিল… পৃথিবীই ওদের জন্মভূমি। তাই জন্মভূমির মায়া ওরা কাটাতে পারেনি। ওঁদের কী নাম বল তো মামনি?

–জানি জানি বাপি… একজন জিজ্জো আর একজন জিজ্জা। কিন্তু বাপি… এরপর ওদের কী হল?

-–ওরাও খুব বুদ্ধিমান বুদ্ধিমতী, ওরা বড় হল… ঘর সংসার হল… ছেলেমেয়ে হল… তারপর ওরা সংখ্যায় বেড়ে চলল… পৃথিবী ওদের স্বদেশ হল।

–বাঃ বাঃ! কী মজার গল্প… বলেই কন্যা হাততালি দিয়ে ছোট্ট দুই সবুজ পাখা মেলে বাগানে উড়তে শুরু করল।