মানুষ এক ভিন্ন জীব – এলান ব্লচ

মানুষ এক ভিন্ন জীব – অ্যালান ব্লচ্‌

আমি প্রত্নতত্ত্ববিদ। মানুষ নিয়েই আমার কারবার। অথচ ভেবে পাই না মানুষ সম্বন্ধে জানার কবে শেষ হবে! বোধহয় আমার কথার মানে বোঝা গেল না, –তাই না? আমি বলতে চাইছি আমাদের থেকে মানুষের তফাৎটা কোথায়… মানে আমরা হচ্ছি রোবট… রোবট আর মানুষের পার্থক্য কোথায়? আমাকে এটা জানতেই হবে। সেই জন্যই মাটি খুঁড়ে মানুষের হদিশ পাবারই চেষ্টা করে চলেছি আমি। এই গ্রহটা তো মরে গেছে অনেক অনেক দিন হয়ে গেল। একসময়ে কিন্তু আমি এক মানুষের সঙ্গে বাস করেছিলাম। আর তখনি বুঝেছিলাম মানুষ ভীষণ জটিল। স্কুলে শেখানোর মতো সহজ-সরল নয়।

বেশ কিছু রেকর্ড আমরা পেয়েছি… তারই ওপরে গবেষণা করে আমার মতো রোবট বিজ্ঞানীরা অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। কিন্তু জানার এখনও অনেক বাকি… আর সেখানেই হয়েছে যত গন্ডগোল… জানার মতো কিছু আর পাচ্ছি না। অবশ্য আমরা জানি এবং ঐতিহাসিকেরাও বলেছেন যে, পৃথিবী নামে এক গ্রহ থেকে মানুষরা এখানে এসেছিল। আমরাই তো পড়েছি যে, শুধু এই গ্রহেই নয় নক্ষত্রলোকেও কাঁপিয়ে বেড়িয়েছিল মানুষ নামক দু’পেয়ে জীব। গ্রহে গ্রহে গড়ে উঠেছিল উপনিবেশ… মানুষ, রোবট ও অন্য সব প্রাণীও একই সঙ্গে বসবাস করত। উপনিবেশ স্থাপন করেই ওরা অন্যগ্রহের সন্ধানে যাত্রা করত… আর কখনও ফিরে আসত না।

কী সব জাঁকজমকপূর্ণ দিন ছিল… যেন এক স্বর্ণযুগ। কিন্তু আমরা কি বুড়ো হয়ে গেলাম? এক-একজন মানুষকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত… যেন ঝকঝকে ইস্পাত… স্বর্গীয় ভাব… রাতের অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলত ওদের যান গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, এক নক্ষত্রলোক থেকে অন্য নক্ষত্রলোকে। আর আমরা সে সব ভুলে যেতে বসেছি।

…বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন যে, মানুষ প্রায় আমাদের মতন। মানুষের কঙ্কাল আর রোবটের কাঠামোর মধ্যে সাদৃশ্য অনেক। শুধু রোবট তৈরি হয় টাইটানিয়াম কম্পাউন্ড দিয়ে আর মানুষের দেহ গড়ে ওঠে ক্যালসিয়াম কম্পাউন্ডে। অবশ্য এ ছাড়া আরও কিছু পার্থক্য আছে। এবার আমি সেই কথায় আসছি।

সেবার আমার ফিল্ড ট্রিপের শেষ পর্যায়… অন্তর্বর্তী গ্রহে গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলাম। একদিন এক মানুষের সাক্ষাৎ পেলাম। মনে হয়, এই মানুষটাই বোধহয় সৌরমণ্ডলের সর্বশেষ মানুষ। নিঃসঙ্গ একাকী সে কত বছর জীবন কাটিয়েছে বলতে পারব না… তবে সে কথা বলা ভুলে গিয়েছিল। একবার ভাবুন তো… বিশাল গ্রহ… নির্জন, জনপ্রাণী নেই… একা এক মানুষ। যাই হোক, ধীরে ধীরে সে আমাদের ভাষা আয়ত্ত করে নিল… তার ফলে আমরা দুজনে অনেক গল্প করতাম… ও বলত আমি শুনতাম। মনে মনে ঠিক করলাম আমার সঙ্গে ওকে নিয়ে আসব। কিন্তু চলে আসার আগেই একটা মজার ঘটনা ঘটে গেল।

একদিন হঠাৎ ও বলে বসল যে, ওর খুব গরম লাগছে। পরীক্ষা করলাম… সত্যি খুবই গরম দেহ… বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ওর থার্মোস্টাট সার্কিটটা বিকল হয়ে গেছে। ফিল্ড স্পেয়ার ব্যাগ তো সব সময়েই কাছে কাছে থাকে। সুতরাং, চিন্তার কোনও কারণ দেখি না। বন্ধু বিকল হলে বন্ধুই তো সারিয়ে তুলবে। তাই তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেলাম। বন্ধুকে নিশ্চল করতে বেগ পেতে হল না। গলার মধ্যে লম্বা ছুঁচ ঢুকিয়ে আমরা যেমন আমাদের কাট-অফ সুইচটা বন্ধ করে দিই, ঠিক সেইভাবেই আমিও বন্ধুর গলায় ছুঁচটা ঢুকিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু নট নড়নচড়ন… ঠিক যেন নিশ্চল রোবট। কিন্তু বন্ধুর দেহটা খুলে ফেলতেই হতবাক আমি। ভেতরটা তো একেবারেই আমাদের মতো নয়। তাড়াতাড়ি আবার সব জোড়া দিয়ে চালু করবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বন্ধু নড়াচড়া করল

… চোখ মেলে তাকালও না। তারপর কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধু যেন গলে গলে ক্ষয়ে গেল। প্রায় এক বছরের মাথায় বাড়ি ফেরার জন্যে তৈরি হলাম। বন্ধুর তখন আর কিছু নেই… সাদা সাদা কাঠামোটাই পড়েছিল।

তখনই বুঝলাম মানুষ সত্যিই এক ভিন্ন জীব।