এস্প – এইচ. জি. ওয়েলস

এস্প – এইচ. জি. ওয়েলস

শীতকালের রাত্রি। ঘুমটা স্বভাবতই বেশ গাঢ় ছিল। মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেল যখন এমন আরামের নিদ্রাটা মাটি হয়ে গেল কলিংবেলের আওয়াজে। উঠতে হল। লেপটা দিয়েই সর্বাঙ্গ জড়িয়ে দরজাটা খুললাম। দেখলাম ডাকপিওন দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা জরুরি টেলিগ্রাম দিল আমার হাতে।

ঘরে এসে খুলে ফেললাম। দেখি চারটে কথা লেখা রয়েছে “এক্সট্রিমলি ইম্পরট্যান্ট : কাম শার্প”। রঘুনাথন

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম, কী এমন প্রয়োজন যে এক্ষুনি আমায় মাদ্রাজ যেতে হবে! কিছুই মাথায় এল না, তবে এটুকু বুঝলাম, নিশ্চয়ই খুব জরুরি কোনও ব্যাপার, নাহলে ড. রঘুনাথন এভাবে আমাকে ডাকতেন না।

পরের দিনই মাদ্রাজ রওনা হয়ে গেলাম। ড. রঘুনাথনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা বলে রাখা ভালো। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের ওপরে আমার খুব উৎসাহ ছিল। একবার কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে তাঁর একটা বক্তৃতা ছিল। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ড. রঘুনাথনের নাম তখন বেশ প্রসিদ্ধ। শুনতে গিয়েছিলাম তাঁর কথা। খুবই ভালো লেগেছিল উনি যা যা বললেন। পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি কথায় কথায় বলেছিলেন, যা-কিছু প্রশ্ন জাগবে মনে, ওঁকে লিখে পাঠাতে; উনি সাধ্যমতো উত্তর দেবার চেষ্টা করবেন। পরে রিসার্চসংক্রান্ত ব্যাপারে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম আমরা।

মাদ্রাজে গাড়ি পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম ড. রঘুনাথন নিজেই এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে। আমায় দেখে একগাল হেসে উঠলেন তিনি।

: হ্যালো ইয়ংম্যান, হাউ আর ইউ? অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট ইয়োর থিসিস?

: ফাইন, থ্যাংকস। মাই থিসিস ইজ অলসো প্রগ্রেসিং। বাট স্যার, ইউ ডেফিনিটলি লুক পেল, শরীর খারাপ হয়নি তো?

: না, নো দ্যাটস নাথিং, কিছু হয়নি আমার। চলো, বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করে আছে। গাড়ি করে আমরা প্রায় মাইল পঁচিশ দূরে সমুদ্রের ধারে একটা নির্জন জায়গায় এসে পৌঁছলাম। এখানেই দেখলাম তাঁর বাসস্থান, গবেষণাগার সব। দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের ধারে তাঁর বাড়িটাকে মনে হচ্ছিল একটা স্বপ্নপুরী।

রাত্রের খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পর ড. রঘুনাথন বললেন : চলো, একটু সমুদ্রের ধার দিয়ে বেড়িয়ে আসি।

বেড়াতে বেড়াতে তিনি একসময়ে বললেন : দ্যাখো সঞ্জয়, তোমার হয়তো খুব কৌতূহল হচ্ছে, কেন তোমাকে এভাবে ডেকে আনলাম। হয়তো কাজের অসুবিধে করেই এসেছ।

: না, না, অসুবিধে কিছুই হয়নি, আপনি ও সব কিছু ভাববেন না। : তোমার কোনও ক্ষতি হয়নি শুনে সত্যিই অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। এবারে আসল কথাটা শোনো। আচ্ছা, তার আগে বলি, যে-কাজে আমি তোমার সাহায্য চাইছি, এখানকার কেউই তাতে রাজি হবে না। আমি জানি, তুমি ছাড়া আর সবাই আমাকে পাগল বলবে।

যাই হোক, সংক্ষেপে ব্যাপারটা তোমায় বলি। মাসখানেক আগে একদিন রাত্রে বারান্দায় বসেছিলাম সমুদ্রের দিকে চেয়ে। আলোগুলো সব নেভানো ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল আকাশ থেকে একটা আলোর মালা ক্রমশ সমুদ্রের ওপরে নেমে আসছে। খুবই অবাক হয়ে গেলাম। সবচেয়ে মজার কথা, আমার মনে হল যেন কতগুলো রকেট মিলে ওই মালাটা তৈরি করেছে। মহাকাশে কোনও পরীক্ষা চালানো হচ্ছে বলে আমার জানা ছিল না। পরের দিন খোঁজ নিয়ে জানলাম, সত্যি সেরকম কোনও পরীক্ষা চালানো হয়নি। ওই আলোগুলো আমার কাছে রহস্যাবৃতই থেকে গেল।

এরপর থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, জেলেদের মধ্যে দুর্ঘটনার সংখ্যা। অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। রোজই দুটো-তিনটে নৌকাডুবির খবর আসতে লাগল। বরুণদেব কুপিত হয়েছেন ভেবে অশিক্ষিত জেলেরাও ঘটা করে তার পুজো আরম্ভ করে দিল।

কয়েকদিন পরে একদিন বিকেলবেলা বিচ-এর ওপরে বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে চোখে পড়ল কিছুদুরে মরে পড়ে রয়েছে একটা সামুদ্রিক জীব। কাছে যেতেই দেখলাম প্রাণীটার আকৃতিটা অদ্ভুত। অনেকটা গিরগিটির মতো দেখতে, লম্বায় হাত ছয়েক হবে। ছ’টা পা রয়েছে, দুটো কানকোও দেখলাম রয়েছে, কিন্তু চোখের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। আমার কীরকম কৌতূহল হল, একজন প্রাণিবিশেষজ্ঞ বন্ধুকে দেখালাম ওটা।

তিনি দেখে তো অবাক। তিনিও স্বীকার করলেন এরকম কোনও প্রাণীর কথা কখনও শোনেননি। তাঁর ধারণা আমি নাকি মানুষের অজ্ঞাত কোনও গভীর জলের জীবকে আবিষ্কার করেছি। উনি বললেন, সমুদ্রের গভীরে সূর্যের আলো কোনওদিনই পৌঁছয় না, কাজেই সেখানকার বাসিন্দাদের চোখেরও প্রয়োজন থাকে না।

ওটাকে আমি প্রিজার্ভ করে রাখলাম।

কয়েকজন জেলের কাছে শুনলাম, সমুদ্রে মাছ ধরার সময়ে তারা নাকি ওই অদ্ভুত জীবের একটা ঝাঁককে মাঝসমুদ্রের দিকে যেতে দেখেছে। এদেরই একজন খবর দিল, কতগুলো অদ্ভুত ‘কুমির’ তার নৌকোটাকে ডুবিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল, সে কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে গেছে।

আমারও কিন্তু মনে হয় এসব দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে ওই অতিকায় গিরগিটিগুলো। এখন কথা হচ্ছে এগুলো এল কোথা থেকে? যদি গভীর সমুদ্র থেকেই এসে থাকে, তা হলে হঠাৎ ওপরে ভেসে উঠল কেন?

যা-ই হোক, এখন আমি কিছু অনুসন্ধানের কাজ চালাতে চাই। এখানেই একান্তভাবে প্রয়োজন তোমার সাহায্য। তুমি যদি রাজি থাকো, তা হলেই সম্ভব হবে অনুসন্ধানের পরিকল্পনা।

: আমি রাজি আছি স্যার– দেখলাম আমাকেও প্রচণ্ড কৌতূহলে পেয়ে বসেছে। ব্যাপারটা সত্যিই ইন্টারেস্টিং।

পরের দিন সকালবেলা রঘুনাথন বলতে আরম্ভ করলেন তাঁর কার্যসূচি।

: দ্যাখো সঞ্জয়, সমুদ্রের যে অঞ্চলটায় সেদিন সেই আলোর মালা তলিয়ে যেতে দেখেছিলাম, খোঁজ নিয়ে জানলাম ওখানটা খুব গভীর। তীরের এত কাছে অবশ্য এমনিতে বেশি গম্ভীর হবার কথা নয়, কিন্তু কোনও ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে একটু দূরেই সমুদ্র বেশ গভীর।

আমার প্রথম কাজ হবে ওই জায়গাটায় নামা, এর জন্যে আমি কয়েকটা জিনিস তৈরি করতে দিয়েছি।

আমি যাতে করে নিচে নামব, তা হল একটা ইস্পাতের ফাঁপা বল, এর ভেতরটায় থাকবে পুরু ডানলোপিলোর গদি আর একটা বসার জায়গা। অত্যন্ত পালিশ করা থাকবে এর বাইরেটা। এটার চেয়ে আয়তনে বড় আরেকটা ইস্পাতের বলের মধ্যে এটাকে রাখা হবে। কতগুলা পিভট দিয়ে আটকানো থাকবে। বল দুটো। বাইরে থেকে ভেতরের বলটায় প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হবে। বড় বলটার ভেতরদিকটাকেও কড়া পালিশ করা হবে আর বল দুটোর মধ্যেকার জায়গাটা থাকবে বায়ুশূন্য। ঠিক থার্মোফ্লাস্কের পদ্ধতি আর-কি।

জলের মধ্যে যখন সবসুদ্ধ নামতে আরম্ভ করবে, তখন ঘর্ষণের ফলে প্রচণ্ড উত্তাপের সৃষ্টি হবে। সেই তাপ যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে তারই জন্যে এই ব্যবস্থা।

বাইরের সবকিছু দেখতে পাবার জন্যে সঙ্গে একটা পোর্টেবল টেলিভিশন সেট নিয়ে যাব। কয়েকটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের দরকার হবে। বেতারযন্ত্রও একটা সঙ্গে রাখব।

একটা মাঝারি স্টিমার আর তিনজন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে যাত্রা করলাম। ঘণ্টাখানেক বাদে রঘুনাথনের নির্দেশমতো একটা জায়গায় নোঙর করা হল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ড. রঘুনাথনকে বলের মধ্যে করে নামিয়ে দিলাম। দুটো খুব ভারী পাথর বেঁধে দেওয়া হল, নয়তো ফাঁপা বল দুটো ভেসে থাকত। জাহাজের সঙ্গে বল দুটো বাঁধা রইল একটা খুব মোটা চেন দিয়ে।

ঠিক হল নিচে ওঁর কাজ হয়ে গেলে রঘুনাথন বেতারে আমাদের জানাবেন, আর আমরা চেনটা গুটিয়ে ওঁকে তুলব। একটা বেতারযন্ত্রের সামনে আমি বসে রইলাম যে কোনও সময়ে সংকেতের আশায়।

কথা ছিল ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই উনি সংকেত করবেন; কিন্তু যতক্ষণ না তা করছেন, তাঁকে যেন তোলা না হয়।

.

এদিকে চার ঘণ্টা পেরিয়ে পাঁচ ঘণ্টা, ছ’ঘণ্টা হয়ে গেল তবুও কোনও নির্দেশ আসে না। আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম, কী করা উচিত ঠিক করে উঠতে পারলাম না! এইভাবে যখন প্রায় দশ ঘণ্টা কেটে গেছে, অবশেষে সেই বহুপ্রত্যাশিত সংকেত এল।

ড. রঘুনাথকে যখন বাইরে বার করা হল দেখি উনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

জ্ঞান হবার পরে উনি যা যা বলেছিলেন যতদূর সম্ভব ওঁর নিজের ভাষাতেই লিখে রাখার চেষ্টা করলাম।

: বলতে পারো সঞ্জয়, আমাদের জ্ঞান আর চিন্তার সীমা কতটা? জানি এ প্রশ্নের উত্তর হয় না, তবুও জিজ্ঞেস করলাম। কারণ থেকে থেকে আমার মনে হয় আমরা কিছু জানি না। কল্পনাশক্তিও আমাদের অত্যন্ত সীমিত।

আজ আমি প্রত্যক্ষ করেছি আমার জীবনের বিচিত্রতম ঘটনা। ধীরে ধারে সবই বলছি। তোমায়।

তোমরা আমাকে জলে নামিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বেশ জোরে ডুবে যেতে লাগলাম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। লিফট চলতে আরম্ভ করার পরেই যেরকম হালকা হালকা মনে হয়, অনেকটা সেই ধরনের। টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে উঠতে লাগল নানারকম মাছের ছবি। প্রথমে চারিদিকে জলটাকে ধূসর দেখাচ্ছিল। তারপর একসময়ে তা গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। এই অন্ধকারের মাঝে থেকে থেকে ভেসে আসতে লাগল আলোর ফুলঝুরি। গোড়ায় বুঝিনি এগুলো কীসের আলো। পরে মনে হয়েছিল ওগুলো হয়তো গভীর জলের বৈদ্যুতিক মাছের আলো।

যা-ই হোক, একসময়ে একটা বিরাট ঝাঁকানি দিয়ে বলটা স্থির হয়ে গেল। বুঝলাম আমি পৌঁছে গেছি।

টেলিভিশন স্ক্রিনটায় দেখলাম চারিদিকে আর গাঢ় অন্ধকার নেই, একটা যেন আবছা আলো রয়েছে। মনে হল ফসফরাস জাতীয় কোনও জিনিস মেশানো রয়েছে পলিমাটির সঙ্গে। চারিদিকের ঘোলা হয়ে ওঠা জল থিতিয়ে যেতে বেশ সময় নিল। ঘণ্টাখানেক বাদে যখন জলটা পরিষ্কার হল দেখতে পেলাম সমতল জায়গাতে এসে পৌঁছেছি।

কিছুটা দূরে মনে হল অসমতল ভূমি আরম্ভ হয়েছে। কতকগুলো উঁচু ঢিপির আবছা ছায়া চোখে পড়ল; এ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেলে, উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখলাম না। চুপ করে বসে রইলাম। ভাবলাম, কিছুই যখন দেখা গেল না, তা হলে সংকেত পাঠাই এবার।

এমন সময়ে হঠাৎ মনে হল লোহার গোলাটা যেন একটু নড়ে উঠল। গোড়ায় ভেবেছিলাম মনের ভুল। কিন্তু খানিক বাদে আবার; এবার বেশ জোরে। ব্যাপারটা কী দেখার জন্যে আমি সার্চলাইটটা জ্বেলে দিলাম। টেলিভিশনটার ওপরে চোখ পড়তেই আনন্দে আর বিস্ময়ে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছা করল। দেখতে পেলাম কতকগুলো অদ্ভুত সরীসৃপ চারিদিকে ঘুরছে, আর মাঝে মাঝে সম্মিলিতভাবে ধাক্কা মারছে। বুঝলাম আমার অনুমান ঠিক, কাছাকাছিই কোথাও তাদের আস্তানা।

একটা অদ্ভুত প্যাটার্ন করে এরা ঘোরাফেরা করছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল ওরা একটা চোঙামতো কী খাড়া করার চেষ্টা করছে। বিস্ময়ে হতবাক আমি তখন, কারণ নলটা ওরা আমার দিকেই তাক করছে। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না কতকগুলো সরীসৃপের দ্বারা কী করে সম্ভব ওই ধরনের কাজ।

তখনও আমার অনেক কিছুই দেখতে বাকি ছিল। থাক সে কথা। সময়মতো সবই বলা যাবে।

এদিকে দেখতে পেলাম এরা অদ্ভুত আকারের বহু জিনিস এনে জড়ো করছে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে সেগুলো এক বিস্ময়কর রূপ নিল। অনেকটা সেনাবাহিনীর ট্যাংকের মতো। মনে হল স্বপ্ন দেখছি। চিমটি কাটলাম নিজেকে। নাঃ, এই তো জেগে রয়েছি; সামনে ওদেরকে দেখতে পাচ্ছি।

হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। মাথার ভেতরটা কেমন যেন হালকা মনে হতে লাগল। আস্তে আস্তে আমার চোখের পাতা বুজে এল। ঘুম আর জেগে থাকার মাঝামাঝি একটা অবস্থায় পড়ে রইলাম আমি।

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি না। একসময়ে মনে হল কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। সমস্ত ইন্দ্রিয় আমার এক মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল।

মাথাটা এবার বেশ জোরেই ঘুরতে আরম্ভ করল। এই অবস্থায় মনে হল, মনের মধ্যে কে যেন এক অন্য লোক চিন্তা করছে। তোমাকে এই পরিস্থিতি ভালো করে বোঝাতে পারছি না; আমি চাইছিলাম কোনও একটা বিষয় চিন্তা করতে, কিন্তু কিছুতেই তা পারছিলাম না। কে যেন জোর করে আমার মনটা অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরে মনে হল আবার কে ফিসফিসিয়ে উঠল। চারদিকে তাকালাম, কিন্তু কে থাকবে আমার সঙ্গে ভারত মহাসাগরের এই গভীরে?

আর তার পরেই ব্যাপারটা বুঝলাম। স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার মধ্যে এক দ্বিতীয় চিন্তার স্রোত ক্রমাগত বয়ে চলেছে।

মনে হল দ্বিতীয় সত্তা প্রশ্ন করছে।

: সমুদ্রের নিচে কেন এসেছ?

কতগুলো অদ্ভুত প্রাণীর রহস্য আবিষ্কার করতে।

: তাই নাকি? তবে শোনো–এবার বেশ বুঝতে পারলাম আমি, এই চিন্তাধারা আমার নয়, আমারই মনের মধ্যে যেন অন্য কে কথা বলছে।–”যাদের খোঁজে এসেছ, তারাই এই খবর পাঠাচ্ছে।

: অবিশ্বাস্য। আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি পাগল হয়ে গেছি।

: না, না, তুমি পাগল হওনি। স্বপ্নও দেখছ না। বাস্তবকেই প্রত্যক্ষ করছ।

: অসম্ভব। কতগুলো কুমির

: কুমির? কুমির কাদের বলছ? আমাদের? তবে শোনো, আমরা তোমাদের গ্রহেরই প্রাণী নই। তোমাদের সূর্যের নিকটতম প্রতিবেশী নক্ষত্র আলফা সেন্টরির এক গ্রহ থেকে সম্প্রতি আমরা এসেছি। আমাদের গ্রহের নাম ‘এস্প’।

স্বভাবতই তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমরা কেন এলাম এখানে। প্রত্যেক গ্রহেই জীবনের অস্তিত্বের জন্যে কয়েকটা আবশ্যিকের প্রয়োজন। তার মধ্যে একটা হল নাতিশীতোষ্ণ তাপ। আমাদের গ্রহ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় তারার দিকে। তোমাদের হিসেবে আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এস্প’। সময় থাকতে তাই আমরা বেরিয়ে পড়েছি নতুন বাসস্থানের সন্ধানে। আমাদের গ্রহটা সম্পূর্ণটাই জলমগ্ন। কোথাও এতটুকু ডাঙাও মাথা উঁচিয়ে নেই। আমরাও জলেরই বাসিন্দা। তবে ওখানের জলে ভারী জলের পরিমাণটা একটু বেশি। এখানে অবশ্য আমাদের মোটেই অসুবিধে হচ্ছে না।

আমরা যখন এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করব তোমাদের সঙ্গে কোনও বিবাদ করার ইচ্ছে আমাদের নেই। যদিও না জেনে আমাদের কয়েকজন তোমাদের কয়েকটা নৌকো উলটে দিয়েছে, তোমাদের সঙ্গে একটা প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কই আমরা আশা করব।

ড. রঘুনাথন থামলেন। একটু হেসে আবার বললেন–এই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা, সঞ্জয়। তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি এর একবর্ণও তুমি বিশ্বাস করনি। যা-ই হোক কথাটা গোপন রেখো। আজ আমি বুঝতে পারছি, সেদিন রাত্রে যে আলোর মালা সমুদ্রে নামতে দেখেছিলাম তা সত্যিই অসংখ্য মহাকাশ-জাহাজ দিয়ে তৈরি।

ভাবছি কালকে আবার সমুদ্রের তলায় নামব। এখনও অনেক কিছু জানার আছে।

এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। পরের দিন রঘুনাথনকে আবার নামিয়ে দিলাম। কিন্তু প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেও কোনও সংকেত না পেয়ে তাঁকে তুলতে বললাম। সবটা যখন উঠে এল চেনের প্রান্তে বাঁধা ইস্পাতের বলটাকে পেলাম না।

পরিষ্কার শেকল থেকে কে যেন খুলে নিয়েছে সেটা। এরপর আর কেউ কোনওদিন ড. রঘুনাথনের দেখা পায়নি। বি.দ্র. : ভারী জলের ফরমূলা D2O, D হল হাইড্রোজেন অ্যাটম H- এরই ভারী আইসোটোপ। সমুদ্রে হেভি-ওয়াটার কিছু পরিমাণ থাকে।