রাখে হরি মারে কে – আইজাক আসিমভ

রাখে হরি মারে কে – আইজাক আসিমভ

মন্টি স্টেইন যে চতুরতার সঙ্গে জালিয়াতি করেছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। চুরির ফল হল এক লক্ষ ডলার। মন্টি স্টেইন নিজেও জানত যে, বিধিবদ্ধ সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পরে সে ধরা পড়বেই।

কিন্তু যেভাবে সে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে তা শুধুমাত্র অভূতপূর্বই নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই স্টেট অব নিউইয়র্ক বনাম মন্টগোমারি হার্লো স্টেইন কেসটি চিরস্মরণীয়। আর এই কেসের পরই ফোর্থ ডায়মেনশনের আইনটির প্রণয়ন হয়।

আপনারাই মনে করে দেখুন না, কী করেছিল জালিয়াতটা? জালিয়াতি করে এক লক্ষ ডলারেরও বেশি হাতিয়ে নেয়ার পরে সে খুব ঠান্ডা মাথায় টাইম মেশিনে ঢুকে পড়ে। আর টাইম মেশিনটাও কিন্তু ওর নিজের ছিল না। ছিল অসদুপায়ে জোগাড় করা। কিন্তু এর পরের কাজ ছিল খুব ছোট-টাইম কন্ট্রোলের ডায়ালটা সে সাত বছর একদিন ভবিষ্যতে বেঁধে দেয়।

স্টেইনের উকিল ছিলেন খুবই উঁদে। তাঁর বক্তব্য ছিল খুবই পরিষ্কার। মহাকাশের গভীরে আত্মগোপন করা আর সময়ের বুকে লুকিয়ে থাকার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এই সময়ের মধ্যেই অপরাধীকে খুঁজে বার করে শাস্তি দিতে হবে, এটাই হল আইনরক্ষক সরকারের কাজ।

সরকারি উকিলের যুক্তিও ছিল বেশ ধারালো। তাঁর মতে স্ট্যাটিউট অব লিমিটেশান বা বিধিবদ্ধ সময়সীমা নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা অনুচিত। ধরা পড়ার যে ভয়, সেই ভয়, শঙ্কা, মানসিক যন্ত্রণা যাতে চিরদিন ভোগ করতে না হয় সেই জন্যেই এই সময়সীমা বেঁধে দেওয়া। এক কথায় অপরাধীকে অনুকম্পা প্রদর্শন। নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার অর্থই হল, হয় সময়ের মধ্যে অপরাধী ধরা পড়বে, নচেৎ এই সময়সীমার মধ্যে সে যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করবে তাতেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে। কিন্তু স্টেইন তো এই সময়ের মধ্যে কোনও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেনি!

কিন্তু স্টেইনের উকিল পাহাড়ের মতো অনড়। অপরাধীর মানসিক যন্ত্রণা বা ভয় মাপার কোনও কথাই আইনে নেই। শুধু সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে।

সরকারি উকিল বললেন, সময় বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারটা স্টেইনের বেলায় প্রযোজ্য হয় না।

সরকারি উকিলের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্টেইনের বার্থ সার্টিফিকেট জমা দেওয়া হল। দেখা গেল স্টেইনের জন্ম হল ২৯৭৩ সালে। আর ৩০০৪ সালে সে অপরাধ করে। তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর। এখন ৩০১১ সাল… স্টেইনের বয়স এখন ৩৮ বছর।

তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠলেন সরকারি উকিল সর্বৈব মিথ্যা… ফিজিয়োলজিকালি স্টেইনের বয়স ৩৮ বছর নয়… মাত্র ৩১ বছর।

প্রতিবাদী পক্ষও থেমে থাকার পাত্র নয়– আমার অভিজ্ঞ বন্ধুকে আইনের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিই। আইনের চোখে ক্রনোলজিকাল অর্থাৎ কাল পরম্পরার বয়সটাই একমাত্র গণ্য বিষয়। আর এই বয়স নির্ণয়ের সহজতম পদ্ধতি হল আজকের দিন-তারিখ থেকে জন্ম-বছরটা বাদ দেওয়া।

সরকারি উকিল ক্ষেপে উঠলেন। তারস্বরে বলে উঠলেন– মাই লর্ড, স্টেইন যদি ছাড়া পায়, তাহলে আইনের অর্ধেক ধারাই অকেজো হয়ে যাবে। তাই আইনের রক্ষক হিসাবে…

খুব সুন্দর প্রোপোজাল। আইন পালটান… কালোপযোগী আইন প্রবর্তন করুন… সময়-ভ্রমণও তাতে অন্তর্ভুক্ত হোক। কিন্তু পরিবর্তিত আইন হওয়ার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত বর্তমান আইনেই তো বিচার হবে।

বিচারক নেভিল প্রেস্টন রায় দেবার জন্যে পুরো সাতদিন সময় নিলেন। তারপর নির্দিষ্ট দিনে রায় দিলেন। আর এই রায়টাই আইনের ইতিহাসে এক নূতন যুগের সূচনা করল। অনেকেই অবশ্য বিচারককে পক্ষপাতদুষ্ট বললেন। বললেন, বিচারক মানবিক দিকটাই বড় করে দেখেছেন আর অল্প কথায় রায় দিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করেছেন।

মাত্র একটি লাইনে কয়েকটি কথায় বিচারকের রায়—

“সময়ের বুকে লুকিয়ে স্টেইন বেঁচে গেল।”