আবিষ্কার – জর্জ আর আর. মার্টিন

আবিষ্কার – জর্জ আর. আর. মার্টিন

হাইপারস্পেস আছে। এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। গণিতের মাধ্যমে হা আমরা এটা প্রমাণও করেছি। যদিও হাইপারস্পেস-এ গতিপ্রকৃতি এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এই বিষয়ে নিশ্চিত যে নর্মাল স্পেসের আইনকানুন এখানে খাটবে না। হাইপারস্পেসে আলোর গতিবেগই যে গতির শেষ সীমা একথা ভাবার কোনও কারণ দেখি না। এইসব কারণেই নর্মাল স্পেস থেকে হাইপারস্পেসে যাবার এবং ইচ্ছেমত ফিরে আসার সহজ পথ খুঁজে বার করতে হবে। উপযুক্ত হাইপার ড্রাইভ আবিষ্কারের জন্যে অর্থ বরাদ্দ করো… আমি নক্ষত্রলোকে পৌঁছে দেবো।

–ড. ফেড্রিক ডি ক্যানফেরেলি, এফটিএল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা (২০১৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে জেনিভাতে অনুষ্ঠিত টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট কমিটির সভায় প্রদত্ত বক্তব্যের সারাংশ)।

সকলেই জানে যে, পিপীলিকা রবারবৃক্ষ হেলাতে পারে না।

-–এফটিএল ফাউন্ডেশনের সংকল্প।

পেটমোটা এক চাউস ফাইল বগলে করে হন্তদন্তভাবে ঘরে ঢুকলেন কিনেরি। রীতিমতো লড়াকু যুবক। মাথা-ভরতি কদমছাঁট চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখেমুখে শাণিত বুদ্ধির আভা।

এফটিএল ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর জেরোমি স্বেচার-এর দু’চোখে ক্লান্তির ছাপ। কথা না বলে তিনি অপলক নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিনেরিও অভ্যর্থনার তোয়াক্কা না করে টেবিলের ওপরে ফাইলটা রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।

-–গুডমর্নিং স্বেচার, আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন নিশ্চয়? হবারই কথা… অন্য কেউ হলে ঢুকতেই পারত না… সিকিউরিটির বেড়াজাল ভেদ করে যে ঢুকতে পারব ভাবতেই পারিনি। সত্যি, কী বিচিত্র লোক আপনি৷ দেখা করতে হলে এত কাঠখড় পোড়াতে হবে? বিরক্তির সুরে গড়গড় করে বলে গেলেন কিনেরি।

–আপনিও তো মশাই সোজা লোক নন। দেখা হবে না বলা সত্ত্বেও গায়ের জোরে ঢুকে পড়েছেন। স্বেচারের কণ্ঠে চাপা উম্মার আভাস। ডেপুটি ডিরেক্টর লম্বাচওড়া বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। সর্বাঙ্গে মেদের উল্লাস। দুই চোখের ওপরে ঘন কালো মোটা । একমাথা ধূসর চুলে ভরা।

–আমার সম্বন্ধে আপনার অনুমান যথার্থ। যেমন বুনো ওল তেমনই বাঘা তেঁতুল না হলে কি চলে! যাক, বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করব না। এখানেই আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এবার কাজের কথায় আসি। বলুন তো আর কতকাল ঘুরতে হবে?

–ঘুরতে হবে! কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন মি. কিনেরি। মৃদু হাসির মধ্যেই ধীরে ধীরে বললেন স্বেচার।

–ওঃ, আবার না জানার ভান করছেন? আমি কে, কী জন্যে যাতায়াত, সেটা নিশ্চয় আপনার অজানা নয়। আর এটাও জানেন নিশ্চয়, আমার মতো একজন পদার্থবিজ্ঞানী বছরের পর বছর কেন আপনাদের কাছে ধর্না দিচ্ছি! আমি নিশ্চয় আশা করব আপনার মধ্যে এখনও বিজ্ঞানীসুলভ মনোভাব আছে এবং হাইপারস্পেস সম্বন্ধে আমার জমা দেওয়া থিসিস আপনি দেখেছেন। আর এটাও নিশ্চয় আপনার অজানা নয় যে একমাত্র আমার থিয়োরিই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত। লোপেজ এর পরে আমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ… একমাত্র আমি হাইপারস্পেস সমস্যার সমাধান করেছি। সেও তো আজকের কথা নয়। তিরিশ বছর হয়ে গেল। হাইপার ড্রাইভ ইঞ্জিনের নক্সা প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। সে কথাও আপনার অজানা নয়! তা ছাড়া হাইপারস্পেস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁদেরও এ কথা অজানা নয়। বেশ রাগত স্বরে কথাগুলো বলে গেলেন কিনেরি।

স্বেচার নিরুত্তর। শুধু নির্নিমেষনয়নে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মোটা জোড়া থেকে থেকে কুঁচকে উঠছে।

–কিন্তু এখন আবার ফান্ডের প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার মতো ক্ষমতা আমার ইউনিভার্সিটির টাকা দেবার নেই। আর সেই জন্যেই আমি এফটিএল-এর দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু মি. স্বেচার, আপনি, মানে আপনারা যা করলেন… ছিঃ ছিঃ, আমার পোপোজালে কোথায় আপনারা খুশি হবেন তা নয়, পুরো ব্যাপারটাই চেপে গেলেন? একবছর হয়ে গেল কোনও উচ্চবাচ্য নেই! অথচ বারে বারে আমি জানতে চাইছি। আর আপনারাও একই জবাব লিখে চলেছেন, যথাসময়ে জানানো হবে। আবার টেলিফোন করলেই সেক্রেটারির উত্তরও বাঁধা গতে… হয় কনফারেন্সে আছেন নয়ত জরুরি মিটিং, নয়ত বিশেষ কাজে বাইরে। কথা শেষ করে দুই হাত টেবিলের ওপরে রেখে জিজ্ঞাসুনেত্রে স্বেচারের দিকে তাকালেন কিনেরি।

নিরুত্তাপ স্বেচারও একমনে পেপারওয়েট আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে চলেছেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন– খুব রেগে গেছেন দেখছি! আপনি তো জানেনই, রেগে গেলে কোনও কাজ হয় না, উপরন্তু শরীরের ক্ষতি হয়। শান্ত হোন… এক কাপ কফি খান!

দপ করে জ্বলে উঠলেন কিনেরি।

–আমি মানুষ বলেই রেগে উঠেছি… অন্য কেউ হলে… থাক সে কথা। আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে হাইপারস্পেস ড্রাইভের জন্যই এফটিএল ফাউন্ডেশনের জন্ম। আর আমি যখন হাইপার ড্রাইভ ইঞ্জিন আবিষ্কারের মুখে তখন আপনারাই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন, এমনকি আমার কথা শোনার সময় পর্যন্ত আপনাদের নেই।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নড়ে চড়ে বসলেন স্বেচার। কয়েক মুহূর্ত কিনেরির দিকে তাকিয়ে বললেন প্রথম থেকেই এক ভুল অনুমানের ওপরে কাজ করে চলেছেন মি. কিনেরি। আলোর চেয়ে দ্রুত গতিবেগ সম্ভব কিনা এবং তা সম্ভব হলে আয়ত্ত করার উপায় কী হবে। এই বিষয়ে গবেষণার জন্যই এফটিএল ফাউন্ডেশানের জন্ম। এককথায় বলা যায়। নক্ষত্রলোকে পৌঁছোবার সহজতম দ্রুত উপায় খুঁজে বার করাই এর প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছোবার অন্যতম পথ হল হাইপারস্পেস। এখন আমরা অন্য এক পথের সন্ধান পেয়েছি… সে পথে…

কথা শেষ হবার আগেই কিনেরি বলে উঠলেন– হ্যাঁ হ্যাঁ, সব পথেরই হদিশ আমার জানা আছে। কানাগলি দেখেছেন? কানাগলি? ঢুকলে আর বেরোবার পথ থাকে না। এতে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। করদাতাদের পয়সা খোলামকুচি নয় সেকথা যেন আপনাদের স্মরণে থাকে। বলিহারি যাই আপনাদের! এলিসনের টেলিপোর্টেশান রিসার্চে টাকা লাগালেন। ক্লডিয়া ডানিয়েলের এসপার ইঞ্জিনে মদত যোগালেন, চুঙের টাইম স্টেসিস হাইপোথিসিস-এর পেছনে এখন ছুটছেন… একবার ভেবে দেখুন কী বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হল? সত্যি কথা বলতে কী জানেন? ক্যানফেরেলির মৃত্যুর পর থেকেই কোটি কোটি টাকার নয়ছয় হয়েছে। এঁদের মধ্যে একজনই সঠিক পথে চলেছিলেন… লোপেজ… লোপেজের পথই ছিল নির্ভুল। ফল কী হল? না– গবেষণা থেকে সরিয়ে দিলেন ওঁকে। সায়েন্টিস্ট লোপেজ হয়ে গেলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর! সত্যি আপনাদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়!

স্বেচারের মুখে কোনও কথা নেই। এক মনে পেপারওয়েট ঘুরিয়েই চলেছেন। উত্তেজনায় কিনেরির মুখমণ্ডলও রক্তলাল হয়ে উঠেছে। নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরেছেন তিনি।

-–আমি শুনলাম আপনি নাকি সিনেটার মার্কহ্যামের সঙ্গেও দেখা করবেন? সেখানেও কি এই সব অভিযোগ তুলবেন? খুব ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন স্বেচার।

–একেবারে ধ্রুব সত্য। আপনাদের কাছ থেকে সঠিক জবাব পেয়ে গেলে অবশ্য ভেবে দেখতে হবে। যদি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন, আমি শুধু সিনেটারের কাছেই যাব না, সিনেট টেকনোলজিক্যাল কমিটির কাছেও যাব… আপনাদের কীর্তিকাহিনি সব ফাঁস করে দেব। তখন কিন্তু আমাদের দোষারোপ করতে পারবেন না।

মৃদু মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন স্বেচার। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান দিয়ে টানটান হয়ে বসলেন।

–মি. কিনেরি, সন্তুষ্ট হওয়া না হওয়া আপনার ব্যাপার। তবে আমার তরফ থেকে কোনও ত্রুটি রাখব না। মি. কিনেরি, আপনি কি মনে করেন জনসংখ্যার চাপে নাভিশ্বাস ওঠা পৃথিবীর বুকে আর কি কোনও খালি জায়গা আছে?

–না… হ্যাঁ, সে দিক থেকে…

–না না… পাশ কাটাবার চেষ্টা করবেন না… ভালো করে চিন্তা করে দেখুন। তাহলে আমি বলি শুনুন… পৃথিবীতে আর তিল ধারণের স্থান নেই। শুধু পৃথিবী না চাঁদ, মঙ্গল এবং ক্যালিস্টোতে পর্যন্ত জনসংখ্যা উপচে পড়ছে। এ বিষয়ে কাগজে কাগজে যথেষ্ট লেখালেখি হচ্ছে। এক কথায় মানুষ এখন এক কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এখন নক্ষত্রলোকেরই প্রয়োজন। সারা মানবজাতি এখন এফটিএল ফাউন্ডেশানের দিকে তাকিয়ে আছে… আর এই প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলার জন্যে কনফেরেলির দূরদৃষ্টির তুলনা নেই। আবার জনসাধারণের কাছে ফাউন্ডেশনের অর্থই হল হাইপারস্পেসের মন্ত্রগুপ্তি।

কিনেরি অধৈর্য হয়ে উঠলেন। একটু চিৎকার করেই বলে উঠলেন– থামুন থামুন… এসব গালগল্প বছরভরে শুনে আসছি… আপনার কর্মচারীদের মুখে মুখে শুধু একই কথা। এসব কথা আমার জানা… নতুন কিছু থাকে তো বলুন মি. স্বেচার।

কথা না বলে মৃদু হাসলেন স্বেচার। চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে নীলাকাশ ছুঁই ছুঁই শহরের বিস্তৃতি… সমান্তরালে স্থান সীমিত হওয়ায় লম্বভাবে আকাশের বুকে হাত বাড়িয়েছে মেগাপোলিশ।

-–মি. কিনেরি, একথা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, লোপেজ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর হওয়া সত্ত্বেও নিজের হাইপারস্পেস রিসার্চ প্রজেক্ট গ্রান্ট পেল না কেন? হাইপারস্পেস নিয়ে লোপেজের গবেষণা অনেকদূর এগিয়েওছিল।

–হ্যাঁ, সেটা অবশ্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক… কথা শেষ করতে না দিয়ে স্বেচার বলতে শুরু করলেন– না না মি. কিনেরি, অতীতের ঘটনা আলোচনা করে সময় নষ্ট করতে চাই না… এখন আর তার প্রয়োজনও নেই… আপনার কথা মানছি যে, বেশ কিছু উদ্ভট থিয়োরির পেছনে অনেক টাকাই ঢালা হয়েছে… কারণ, নেই-মামার চেয়ে কানা-মামা ভালো। কিছু না হওয়ার চেয়ে অন্তত কিছু চেষ্টা চলুক। হাইপারস্পেস আমাদের কাছে কানাগলি ছাড়া আর কিছু নয়… কিন্তু জনসাধারণের হাইপারস্পেসের স্বপ্নকে ইচ্ছে করেই ভেঙে দিইনি… কারণ স্বপ্নভঙ্গের কারণে মানসিক অবসাদ আসবে… আর তার ফলে বেঁচে থাকার আশা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন কিছুই থাকবে না… একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটাও বিচিত্র নয়।

–না না হাইপারস্পেসের স্বপ্ন মিথ্যে নয়… একবার আমাদের কাগজগুলো ভালো করে দেখুন… আমাকে ফান্ড দিন… দু’বছরের মধ্যে হাইপারস্পেস ইঞ্জিন বানিয়ে দেব।

কিনেরির সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বেচার। মোটা জ্বর নিচে বড় বড় চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।

–আমি জানি মি. কিনেরি… হাইপারস্পেস ইঞ্জিন আপনিই বানাতে পারবেন সে বিশ্বাস আমার আছে। মনে করে দেখুন কনফেরেলির কথাগুলো! হাইপারস্পেসেও আলোর গতিবেগই যে গতিবেগের শেষ সীমা এমন ভাবার কোনও কারণ নেই– একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি এই কথাগুলো। হাইপারস্পেসে এ নিয়ম খাটে না। আমি খুবই দুঃখিত মি. কিনেরি। এ কথার মধ্যে একটুকুও ছলচাতুরী নেই। আজ থেকে ঠিক তিরিশ বছর আগে লোপেজ-ই হাইড্রাইভ আবিষ্কার করেছিলেন। এ কথা এখন আপনি ছাড়া বাইরের আর কেউ জানে না… আর তখনই আমরা জানতে পারলাম হাইপারস্পেসের সর্বোচ্চ গতিবেগ আলোর গতিবেগ নয়।

-–কম… অনেক কম সর্বোচ্চ গতিবেগ।