চিড়িয়াখানা – এডোয়ার্ড ডি. হচ

চিড়িয়াখানা – এডোয়ার্ড ডি. হচ্‌

আগস্ট মাস মানেই শিশুদের কাছে দারুণ মজার মাস। বিশেষত তেইশ তারিখের ও আশপাশের দিনগুলো। প্রতি বছর এই দিনেই আকাশের বুক চিরে দেখা দেয় রুপালি মহাকাশযান। প্রফেসর হুগোর আন্তঃগ্রহ চিড়িয়াখানা। চিকাগো শহরের একপ্রান্তে স্থির হয়ে দাঁড়ায় চলমান চিড়িয়াখানা। মাত্র ছ’ ঘণ্টার মেয়াদে।

দিনের আলো ফোঁটার অনেক আগে লাইন পড়ে যায়… প্রকাণ্ড লম্বা লাইন। ছেলে বুড়ো, যুবক যুবতী, কচি কঁচা কে নেই লাইনে। প্রত্যেকের হাতে এক ডলারের নোট। উত্তেজনায় সবাই অধীর… প্র. হুগোর চিড়িয়াখানা প্রতি বছরেই নতুন হয়ে আসে। কত সব নতুন নতুন কিম্ভুতকিমাকার জীবজন্তু… অজানা গ্রহ গ্রহান্তরের বিচিত্র সব বাসিন্দা। না জানি এ বছরেও আরও কী সব নতুন বিদঘুঁটে প্রাণীর দেখা পাওয়া যাবে।

অতীতে কত সব বিচিত্র জীবনমণ্ডলীর সাক্ষাৎ মিলেছে। শুক্রগ্রহের তিন ঠ্যাং-বিশিষ্ট প্রাণী, আবার মঙ্গলের লিকলিকে পাতলা ঢ্যাঙা লোক অথবা সুদূর নক্ষত্রলোকের সরীসৃপজাতীয় ভয়ঙ্কর হিংস্র জীব। এ বছরেও শহরের প্রান্তে তিন শহরের ঠিক মধ্যিখানে বিশাল ময়দানে স্থির হয়ে দাঁড়াল উড়ন্ত চিড়িয়াখানা। পদ্ম পাপড়ির মতো দু’পাশের ঢাকনাগুলো ধীরে ধীরে খুলে মাটিতে নেমে এল। স্পষ্ট দেখা যায় মহাকাশযানের অভ্যন্তরে সার সার পেল্লায় খাঁচার লাইন। মোটা মোটা লোহার রড অথবা কেউ যেন ভগবানের সাক্ষাৎ পরিহাস। ছোট্ট ঘোড়ার মতো জন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে চলে… চলার সময়ে ছোট্ট দেহটা যেন নেচে নেচে ওঠে… মুখে ওদের অনর্গল ঝড় তোলা বকবকানি। প্রফেসরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর দর্শকেরা… টিকিট কাউন্টারে ডলারের স্তূপ জমে যায়। টিকিট কাটা শেষ হলে প্রফেসরের কণ্ঠস্বর শোনা যায়… গুরুগম্ভীর ভরাট কণ্ঠস্বর বিচিত্র মায়াজাল বুনে চলে। মাথার ওপরে রামধনু রঙের অদ্ভুত টুপি। মাইক্রোফোন হাতে প্রফেসর বলে ওঠেন– আমার প্রিয় পৃথিবীর ভাইবোনেরা…

মুহূর্তের মধ্যে কোলাহল বন্ধ হয়ে যায়। প্রফেসর গমগমিয়ে বলে চলেন– পৃথিবীর প্রিয় ভাইবোনেরা, আবার আমি এসেছি, সঙ্গে এনেছি আনকোরা নতুন বিচিত্র সব প্রাণীর সম্ভার। তোমরা এক ডলারের বিনিময়ে দুর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করো। এখানেই দেখতে পাবে কান গ্রহের ঘোড়া-মাকড়শা মানুষ! লক্ষ লক্ষ মাইল দূরের নীল সূর্যের চারপাশে বন বন করে ঘোরে তার কান গ্রহ… যেমন বিচিত্র গ্রহ, ঠিক তেমনি বিচিত্র তার সব প্রাণী। এসো এসো… ঘুরে ঘুরে দেখ… বিচিত্র জীবদের চালচলন লক্ষ করো। কান পেতে শোনো ওদের কথাবার্তা, যদিও সব ভাষা তোমরা বুঝবে না। তোমাদের বন্ধুদের বলো, তারাও দলে দলে আসুক মনে রাখবে, সময় কিন্তু খুবই অল্প… ঠিক ছ’ঘণ্টা পরেই স্পেসশীপ চলে যাবে!

সারবন্দী দর্শকদের চোখেমুখে নিদারুণ বিস্ময় আর আতঙ্ক! কী ভয়ঙ্কর সব জীব… দেখলেও গা শিউরে ওঠে… ঠিক যেন ঘোড়া, কিন্তু তড়বড়িয়ে মাকড়শার মতো খাঁচার দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠছে আর নামছে।

–সত্যি ভাই, যা দেখলাম তার কাছে এক ডলার কিছুই নয়। চল চল বাড়ি যাই, ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসি। সকলেই প্রায় এমন কথা বলে বাড়ির সকলকে আনতে ছোটে।

সারাদিন ধরে জনস্রোত ধেয়ে আসে মহাকাশযানে। দু’পাশে বড় বড় খাঁচার সারি… মাঝে সরু পথ। সেই পথ ধরে উৎসুক নয়নে জনপ্রবাহ চলে মহাকাশযানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তবুও দেখার আশ মেটে না। কিন্তু সময়ের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। প্রফেসর হুগো মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন।

–এবার আমাকে বিদায় দাও পৃথিবীর ভাইবোনেরা। আবার আসব সামনের বছর একই দিনে একই সময়ে। সঙ্গে থাকবে নানান অজানা গ্রহের অজানা সব বিচিত্র প্রাণী। চিড়িয়াখানা যদি ভালো লাগে তবে তোমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বোলো কাল আমরা নিউ ইয়র্কে নামব… পরের সপ্তাহে চলে যাব লন্ডন, প্যারিস, রোম, হংকং, টোকিওতে। তারপরই পৃথিবীর পাট শেষ করে উড়ে যাব অন্য গ্রহে।

দর্শকসমাজ হাততালি দিয়ে বিদায় অভিনন্দন জানাল। মহাকাশযানও ধীরে ধীরে বাতাসে ভর করে আকাশে উঠে গেল। ঘরে ফেরার পথে সকলের মুখেই এক কথা– প্র. হুগোর তুলনা নেই… এ চিড়িয়াখানার কোনও তুলনাই হয় না।

ইতিমধ্যে তিনমাস কেটে গেল এবং তিন-তিনটে গ্রহ পরিক্রমা শেষ করে প্র. হুগোর রুপালি মহাকাশযান কান গ্রহের প্রকাণ্ড দুই পাহাড়ের মাঝে ধীরে ধীরে নামল। ঘোড়া মাকড়শা প্রাণীর দল খাঁচার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র গতিতে যে যার ঘরের দিকে দৌড় মারল… পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ওদের ঘরেও আনন্দের কলরোল শোনা গেল… প্র. হুগোর মুখে সাফল্যের হাসি।

একজনের ঘরওয়ালি লাফাতে লাফাতে বাইরে বেরিয়ে এল। এতদিন পরে বাড়ির কর্তা ফিরে আসায় দারুণ খুশি। বিচিত্র ভাষার কলকল শব্দ করে উঠল সে। জিভটা তালুতে ঠেকিয়ে এরা অনর্গল আওয়াজ করে চলে। খুবই জটিল ভাষা।

–উঃ বাব্বাঃ কতদিন পরে এলে বলো তো? আমি দুশ্চিন্তায় মরি। যাক বেড়ানো ভালো হয়েছে তো? কেমন সব দেখলে?

পুরুষ প্রাণী বলে উঠল, উঃ কী যে দেখলাম… বলে বোঝানো যাবে না… ছেলেমেয়েরা তো আসতেই চায় না। মোট আটটা গ্রহ আমরা দেখেছি… সেখানকার কত সব কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী।

ছোট্ট শিশুটি তরতর করে গুহার দেওয়াল বেয়ে ছাদে উঠে পড়ল। শিশু কণ্ঠে সে-ও বলে ওঠে– সবচেয়ে ভালো লাগল যেটা তার নাম পৃথিবী… অবশ্যই ওখানকার প্রাণীরা আছে বলেই। কী অদ্ভুত দেখতে.. দেহ ঘিরে সবাই পোশাক পরে… কী সব রং! সবচেয়ে আশ্চর্য কী জানো… ওরা দু’পায়ে চলে… আমার কেবলই ভয় হত এই বুঝি পড়ে যাবে…

–বাপস! কী সাংঘাতিক! শুনলেই তো ভয় লাগে… ঘরওয়ালি জননী বলে ওঠেন।

–না না, ভয়ের কিছু নেই… আমাদের সুরক্ষার জন্যে চারপাশ ঘিরে মোটা মোটা লোহার রডের তৈরি মজবুত ঘর ছিল… আমরা তো সেই ঘরের মধ্যে দিব্যি বসে– স্পেসশীপ থেকে বাইরে যাওয়া মানা ছিল। দু’পেয়ে প্রাণীরা দল বেঁধে আমাদের ঘরের সামনে ঝুঁকে পড়ে কিন্তু না, ঘরে ঢুকতে পারেনি। জানো, সামনের বছর তোমাকে নিয়ে যাব… খরচা একটু বাড়লেও দেখার মতো দু’পেয়ে প্রাণী।

ছোটও বলে উঠল– পৃথিবীর চিড়িয়াখানাটাই সবচেয়ে ভালো।