ক্রিকেট বল – অ্যাভ্রো ম্যানহাটান

ক্রিকেট বল – অ্যাভ্রো ম্যানহাটান।

এক ঝলক ফেরাস-লিকুইড ঝপ করে পড়ে গেল। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করল এবং অচিরেই একটা ক্রিকেট বলের আকার নিল। চলমান বলের গতিবেগ হ্রাস পেলেও গড়াতে গড়াতে বলটা শেড পেরিয়ে একেবারে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল। বলটা গড়িয়ে আসার পথ বরাবর কংক্রিট-এর রাস্তাটা বেশ কয়েক ইঞ্চি বসে গেল। মনে হল বলটা নরম কাদার ওপর দিয়ে যেন গড়িয়ে এল।

প্রফেসর লে ঘড়ি দেখলেন। সময় এখন বিকেল ৩-৩৫ মি.। এতদিনের পরীক্ষা আজ সফল হল। সব উৎকণ্ঠার অবসান। এক নতুন বস্তুর জন্ম দিয়েছেন তিনি, যার আপেক্ষিক গুরুত্ব তখনও অজানা। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বস্তুটাই এখন রাস্তার মাঝখানে।

–রাস্তার মাঝখানে কী এটা? প্রশ্ন করলেন পি. সি. জেল্ক।

ট্রাফিক পুলিশ এবং প্রফেসর স্বয়ং বলটার দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

এটা কী?–আরে সারাটা পথ যেন চষে এসেছে বলটা? আবার প্রশ্ন জেল্কের।

রুমাল দিয়ে বেশ কয়েকবার কপাল মুছে প্রফেসর বললেন- কিছু কিছু নক্ষত্রের অ্যাটমগুলো সঙ্কুচিত নিষ্পেষিত হয়ে ওঠার ফলে অ্যাটমসৃষ্ট বস্তুসমূহ অস্বাভাবিক ভারী হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ ধরুন ভ্যান মানেন নামক নক্ষত্রের বস্তুসমূহের ঘনত্ব জলের ঘনত্বের তুলনায় ৩০০,০০০ গুণ বেশি। অন্যভাবে বলা যে, আলপিনের মাথার আকার এমন ঘনত্বের কোনও বস্তু এত ভারী হবে যে, হাত দিয়ে ধরলে বুলেটের মতো হাতের তালু ভেদ করে পড়ে যাবে।

তাই নাকি? জেন্ধের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময়। নিজের দুই হাতের তালু ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। ভাবলেন, এই হাত ফুটো করে বেরিয়ে যাবে!

কী জানি বাবা… এ কেমন বস্তু। আপনার ব্যাপার আপনিই ভালো জানেন প্রফেসর। এখন বলটাকে কারখানায় নিয়ে যান। যানবাহন বন্ধ হলে আর এক বিপদ হবে।

–বলছেন তো ঠিকই। কিন্তু আমি কি পারব? এবার নিচু হয়ে বলটা তোলবার চেষ্টা করলেন প্রফেসর। কিন্তু বলটা এক বিন্দু নড়ল না।

–কী হল? আটকে গেল নাকি? উদ্বিগ্ন হয়ে জেল্ক প্রশ্ন করলেন। কোনও উত্তর না পেয়ে সবুট এক লাথি কষালেন তিনি বলটার গায়ে। পরক্ষণে উঃ করে মাটিতে বসে পড়লেন। একটুও হেলল না বলটা, উপরন্তু পায়ের যন্ত্রণায় অস্থির জেল্ক।

গ্যারেজ থেকে ভ্যানগাড়িটা বার করল নবি ক্লার্ক। কিন্তু রাস্তা বন্ধ। ট্রাফিক পুলিশ জেল্ক ওর অনেক দিনের শত্রু। তাই ব্যঙ্গ করে সে বলে উঠল– কী হল? গাড়ি বন্ধ করে রাস্তায় ফুটবল খেলছেন নাকি?

ব্যঙ্গের ধার দিয়েও গেল না জেল্ক। বলল– না না, মাটির সঙ্গে আটকে গেছে।

এবার গাড়ি থেকে নামল ক্লার্ক। গজগজ করতে করতে পা দিয়ে সরাবার চেষ্টা করল বলটাকে। কিন্তু যে কে সেই!

–কী এটা? প্রফেসরের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ল সে।

-–কিছু না… একটা এক্সপেরিমেন্ট! আচ্ছা তোমার কাছে কোনও যন্ত্র আছে? কারখানায় বলটা তুলে নিয়ে যেতে হবে।

এবার ভ্যান থেকে সাত পাউন্ডের পেল্লায় এক হাতুড়ি বার করল ক্লার্ক। তারপরে গায়ের জোরে হাতুড়ি-পেটা করল বলটাকে। প্রচণ্ড ধাক্কায় হাত থেকে হাতুড়ি ছিটকে গেল। ক্লার্কও আর্তনাদ করে দুই হাতের আঙুল চেপে রাস্তায় বসে পড়ল।

–অপূর্ব! এই হাতুড়ির ঘাটাই অন্তত তিনশো পাউন্ডকে নাড়াতে পারত৷ দারুণ ব্যাপার! বলটার ওজন বেশ ভালোই হবে! উৎফুল্ল প্রফেসর উত্তেজনায় অধীর।

জেল্ক এবার দমকলকে খবর দিলেন। দমকলবাহিনী বলটার চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখল। যে কোনও পরিস্থিতিতে উদ্ধার করাটাই ওদের কাজ। তাদের দড়ি দিয়ে সে বলটাকে বাঁধল ভালো করে। তারপর দড়ির অপরপ্রান্তটা দমকলের গাড়ির সঙ্গে আটকে দিল। ড্রাইভার ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করল। গাড়ি এক চুল নড়ল না… এক মিনিটের মধ্যে তারের দড়িটা পটাং করে ছিঁড়ে গেল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বেশ কিছুটা সামনে ছুটে গেল গাড়িটা।

এবার এক পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল ইউনিফর্ম পরা চারজন পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত রাস্তাটা ঘিরে ফেলল। তারপর বলটাকে মোটা জালের ঘেরাটোপ দিয়ে আটকে রাখল। তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা পৌঁছে গেল। খবরের কাগজেও সযত্নে মেপে মেপে সংবাদ পাঠানো হল। এর পরেই সৈন্যবিভাগ সম্পূর্ণ জায়গাটাতেই জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ বোর্ড টাঙিয়ে দিল। অবশ্য সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে ঘোষণা করা হল যে, ভয়ের কোনও কারণ নেই… তেজক্রিয়তার কোনও নিদর্শন এখনও পর্যন্ত ধরা পড়েনি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সৈন্যবিভাগের তিনজন উচ্চপদস্থ অফিসার সরেজমিনে এলেন। ওম্যান ইনস্টিটিউড থেকে চায়ের আসরে জেনারেল বললেন– প্রফেসর লে… এমনভাবে পাবলিসিটি করার কীসের প্রয়োজন ছিল? জনসাধারণের কত অসুবিধে হচ্ছে।

–পাবলিসিটির কোনও ব্যাপার নয়। বলটা হঠাৎই গড়িয়ে কারখানার বাইরে চলে এল। মানে, হঠাৎ অতিরিক্ত কোনও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আকর্ষণেই বলটা গড়াল। অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারিনি। তবে আমি বলি…

কথা শেষ হবার আগেই চিৎকার করে উঠলেন জেনারেল ট্যাঙ্ক ক্রেন। ট্যাঙ্ক ক্রেন নিয়ে এসো। জলদি!

বলটাকে বেশ ভালো করে বাঁধতে ক্রেনের লোকজনদের বেশ কিছুক্ষণ লাগল। বলটার চারপাশে কংক্রিট খুঁড়ে গর্তটা আরও বড় করার সঙ্গে সঙ্গে বলটা আরও গভীরে নেমে গেল। তা সত্ত্বেও বেশ পোক্ত করে সেটাকে বেঁধে ফেলা হল।

এবার ক্রেনের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। ক্রেনের লোহার দড়িতে টান ধরল। ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার… থার্ড গিয়ার দেবার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বিকট আর্তনাদ করে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। এক ইঞ্চিও বলটাকে নাড়ানো গেল না।

–আরও… আরও জোরে অ্যাক্সিলেটার চাপো। চাপাস্বরে গর্জন করে উঠলেন জেনারেল।

ব্যস! দুম করে চেনটা ছিঁড়ে গেল এবং ক্রেনের ইঞ্জিনটাও সামনে উলটে গেল। তৎক্ষণাৎ অ্যালডারসটে লোক ছুটল… ক্রেনটাকে তোলার জন্যে আর একটা ভারী ক্রেন চাই। বলটাকে সরানো এবং ক্রেনটাকে উদ্ধার করার জন্যে মিলিটারি কর্তারা প্রচণ্ড তৎপর হয়ে উঠলেন। সামান্য বলটাকে হটাতে না পারলে পুরো মিলিটারির বদনাম। জনসাধারণ কী ভাববে!

পরের দিন ভোরে সব খবরের কাগজেই বড় বড় করে সরকারের অপদার্থতার কথা ফলাও করে ছাপা হল। প্রফেসর লে আর তার যুগান্তকারী অবদানের ভূয়সী প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভূত সমস্যার আশু সমাধানও দাবি করা হল। এর ফলে জনগণ আতঙ্কে অধীর হয়ে উঠল। আশু কর্তব্য জানার জন্যে কাতারে কাতারে জনতা ভিড় জমাল প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। সকলের একই কথা… সমাধান চাই… এক্ষুণি চাই। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছেও জরুরি বার্তা গেল। মাটির গভীরে নাচতে নাচতে বলটা যদি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু ভেদ করে অস্ট্রেলিয়ায় আত্মপ্রকাশ করে তাহলে যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কারণ যে মাঠে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের ফোর্থ টেস্ট চলবে ঠিক সেইখানেই বলটি মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসার কথা।

জনতাকে শান্ত করার জন্যে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই বারবার নিজের প্রাসাদের বাইরে এসে জনতার উদ্দেশে ভিক্টরি চিহ্ন দেখাতে হয়েছে। কিন্তু বলটাকে তুলে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবার মতো কোনও সমাধানসূত্র এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দুপুরবেলায় আরও এক নাটকীয় ঘটনা ঘটল। বিরোধী দলের মধ্যে কট্টর গোঁড়ারা দাবি করল যে, এক্ষুণি বলটাকে লক্ষ করে হাইড্রোজেন বোমা নিক্ষেপ করা হোক। আর তা না হলে বর্তমান সরকার পদত্যাগ করুন।

এইবার গ্রীনহ্যান কমন থেকে আমেরিকায় বায়ুসেনার বিশাল বিমান উড়ে এল। সঙ্গে নিয়ে এল ২৫০ টনের বিশাল এক ক্রেন। ২৫০ টন যদি অকৃতকার্য হয় তাহলে কয়েকদিনের মধ্যে ৫০০ টনের ক্রেন তৈরি হয়ে যাবে।

দ্বিপ্রহরের খাওয়ার পরেই প্রধানমন্ত্রী নিজের বাসগৃহ ছেড়ে সোজা চলে এলেন সমস্যার মূল কেন্দ্রে। সরেজমিনে দেখা এবং সকলের মনে সাহস জুগিয়ে সমাধান করাটাই আসল কাজ। দুই আঙুলে চিহ্নের মাঝে পিং পং-এর বল আটকে অবশ্যম্ভাবী জয়ের বার্তা পৌঁছে দিলেন।

অকুস্থলে ইতিমধ্যে অস্থায়ী রেললাইন, নানান আকারের ক্রেন, দমকলের গাড়ি, মিলিটারি জিপ, ট্যাঙ্ক আর উদ্বিগ্ন মুখে অসংখ্য জনগণ গিজগিজ করছে। অনেক কষ্টে এবং অগুনতি লোকের সাহায্যে প্রধানমন্ত্রী বলের কাছে গিয়ে পৌঁছোলেন।

–এমনটা যে হবে একেবারেই বুঝতে পারিনি স্যার। ওঃ, আপনার অমূল্য সময়ের কী ভয়ঙ্কর অপচয়। দারুণ মিনতি মাখানো সুরে কথাগুলো বললেন প্রফেসর।

কোনও কথা না বলে শুধু ক্ষমাসুন্দর চোখে প্রফেসরের দিকে তিনি তাকালেন একবার। তারপর বলের দিকে তাকালেন…

…দড়ি চেন লোহার শেকল ঘষে ঘষে দারুণ মসৃণ আর চকচকে হয়ে উঠেছে বলটা। ওঃ, সামান্য একটা বল নিয়ে কী কাণ্ডটাই না হচ্ছে! রাগে গড়গড় করে উঠল প্রধানমন্ত্রীর সর্বাঙ্গ। হাতের ছড়িটা দিয়ে সজোরে এক খোঁচা মারলেন। আশ্চর্য! এক খোঁচাতেই গর্ত ছেড়ে লাফিয়ে উঠল বলটা… আপন মনে গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তার ধারে নর্দমার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

হো হো করে হেসে উঠলেন প্রফেসর। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালেন। ঠিক এখন দুপুর ৩টে বেজে ৩৩ মিনিট।

–আমার অনেক আগেই এটা ভাবা উচিত ছিল। এটা আনস্টেবল কম্পাউন্ড। এর মলিকিউলার গঠনপ্রকৃতি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে যায়। তাহলে এখন তো আর কোনও সমস্যাই নেই!

যেমন কথা তেমন কাজ। বলটা তুলে নিয়ে বেমালুম পকেটে পুরে নিলেন প্রফেসর।

–বুঝলেন স্যার… বিজ্ঞানীর কাজের কোনও শেষ নেই… দেখুন না এখনই আবার এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে! কথা শেষ করে কারখানায় ঢুকে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন প্রফেসর।