1 of 2

মহাপ্লাবন – ৪৭

সাতচল্লিশ

নিজের বলা কথা বিস্ময় নিয়ে শুনছে রানা।

‘জাপান কখনও চিনের বন্ধু হবে না।’

ওরই কণ্ঠস্বর। মনে হচ্ছে না রেকর্ড করা মেসেজ। ও নিজে বললে আবারও ঠিক এভাবেই বলত।

স্ক্রিনের ভিডিয়ো বদলে যাওয়ায় রানা দেখল, চিনের সঙ্গে জাপানের উষ্ণ সম্পর্কের বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী।

এসব আপনার ফালতু কথা,’ একইসঙ্গে বলল রানার নকল দুই রোবট।

এবারে কণ্ঠ উত্তেজিত। বিশেষ করে প্রথম রোবটের। কথার ভেতর স্পষ্ট টিটকারি। মনিটরে আবারও বলা হলো একই কথা।

‘এসব আপনার ফালতু কথা,’ আবারও বলল দুই রোবট। এখন আরও নিখুঁত। কণ্ঠ যেন রানারই।

‘এ-দুটোকে শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করছে,’ বলল রানা।

‘আরও ভাল হতো প্রোগ্রাম করে দিলে,’ বলল সোহেল, করত হিমুরার পুলিশ স্টেশনের

‘নিখুঁতভাবে কাজ কাজ অ্যাসিস্ট্যান্টের মত।’

‘যে-কেউ বুঝবে ওটা মেশিন,’ বলল রানা। ‘কিন্তু এরা কথা বলছে মানুষের মত। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নড়ছে ঠোঁট। পিটপিট করছে চোখ। এমন কী ঘামছে। আমি এখানে না থাকলে তুই ভাবতি, সামনে দাঁড়িয়ে আছে যমজ রানা।’

‘তা ভাবতাম না, দেখতে তোর চেয়ে ওরা ঢের ভাল, ‘ বলল সোহেল। ‘তবে অবাক লাগছে, প্রোগ্রাম করার সময় কেউ নেই কেন!’

সারি সারি কমপিউটার টার্মিনাল দেখাল রানা। দপ-দপ করে জ্বলছে ছোট সব সবুজ বাতি। ‘মনিটরিং করছে এসব কমপিউটার। মেশিন ট্রেনিং দিচ্ছে অন্য মেশিনকে। বিরাম নেই। কীভাবে মানুষের মত আচরণ করতে হবে, সেটা রোবট শিখে না যাওয়া পর্যন্ত চলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর তারপর…’

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশের ঘরে গেল দুই রোবট। পিছু নিল রানা।

এদিকের ঘর সিমুলেটর। হুয়াঙের ফ্যাক্টরিতে এমন একটা আছে, তবে বড়। এখানে জায়গা কম বলে বাঁকা দেয়ালে রেখেছে কম স্ক্রিন। ওই আলোয় দেখা গেল চারপাশ।

সোহেলকে স্ক্রিন দেখাল রানা। ‘ওটা জয়েন্ট ট্রেড প্যাভিলিয়ন। হুয়াঙের পয়সায় তৈরি। আগামীকাল সকালে ওখানে চিনের সঙ্গে নতুন সহযোগিতা চুক্তিতে সই করবেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। ওটা নিয়েই গুঞ্জন তুলেছে পৃথিবীর রাজনৈতিক সমালোচকরা।’

‘আর এরপর আমেরিকার সঙ্গে জাপানের ডিফেন্স ট্রিটি বাতিল করতে ভোট হবে জাপানিস পার্লামেন্টের অধিবেশনে, ‘ বলল সোহেল। ‘ভোটের ফলাফল আমেরিকার বিপক্ষে গেলে হাত কামড়াবে ওই দেশের বর্তমান স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট।’

ট্রেডমিলে উঠে হাঁটছে দুই রোবট। অন্যরকম হয়ে গেল চারপাশের ভার্চুয়াল পরিবেশ। যেন পেছনের কোনও দরজা দিয়ে মেইন হলে ঢুকেছে রোবটদুটো। ভার্চুয়াল ভিড়ের সামনে জায়গা করে নিল তারা। মঞ্চে উঠলেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ও চিনের রাষ্ট্রদূত। রয়েছে ডিজিটাল হুয়াং লিটন। তার কারণেই সম্ভব হচ্ছে এই চুক্তি। উষ্ণ হয়ে উঠছে দুই দেশের সম্পর্ক।

করমর্দন শেষে চুক্তিতে সই করতে বসলেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ও চিনের রাষ্ট্রদূত। চিনের দূত দেশের পক্ষ থেকে চুক্তির ডানে সই করে কলম বাড়িয়ে দিলেন জাপানি প্রধানমন্ত্রীর দিকে। এবার চুক্তিতে সই করবেন প্রধানমন্ত্রী, এমনসময় ঝট করে এগোল দুই রানা। কোটের পকেট থেকে নকল পিস্তল নিয়েই তাক করল ভদ্রলোকের বুকে।

‘জাপান কখনও চিনের বন্ধু হবে না!’ চিৎকার করে বলল দুই রানা রোবট। পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার।

গুলির আওয়াজ পেল না রানা ও সোহেল। এমন কী নেই সিমুলেট করা আওয়াজ। তবে ট্রিগার টিপে দেয়ায় স্ক্রিনে ফুটল লাল কিছু বিন্দু। সিস্টেম রেকর্ড করেছে, বুকে গুলি খেয়ে মারা গেছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী, চিনা দূত এবং আরেক রাজনৈতিক নেতা। তাদের কাজ শেষ হতেই ঘুরে ছুট দিয়েছে দুই রোবট।

কাজ শেষ করল সিমুলেটর। শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তল রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দুই রোবট রানা।

স্ক্রিনে এল নতুন দৃশ্য। ওটা কোনও হোটেল লবি। চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছে দুই রোবট, নির্বিকার। বোধহয় অপেক্ষা করছে কারও জন্যে। পাশের টেবিল থেকে নিয়ে চোখের সামনে পত্রিকা ধরল একজন। কয়েক সেকেণ্ড পর জিভের লালা আঙুলে নিয়ে ওল্টাল পত্রিকার পাতা।

‘ঘটনা তো মারাত্মক!’ বলল সোহেল, ‘এটা পরিষ্কার, আমরা এসেছি এ দেশে নুমা বা আমেরিকান সরকারের তরফ থেকে। হুয়াং ওই হত্যাযজ্ঞ ঘটালে সবাই ভাববে তুই ছিলি আমেরিকার সিক্রেট এজেন্ট। জাপান বাতিল করবে নিরাপত্তা চুক্তি, সে ভয়ে তোকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খুন করিয়েছে সিআইএ বা নুমা। নিজেরা খুন হলেও আমরা বাঙালি বলে বাংলাদেশের ওপর খড়্গগ তুলবে আমেরিকা। জাপান সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয়, ভীষণ খেপে যাবে তারা, ফলে সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের দেশ।’

মাথা দোলাল রানা। ‘ফ্যাক্টরিতে আমার কথা রেকর্ড করেছিল হুয়াঙের লোক। সেসব থেকে তৈরি করেছে এই প্রোগ্রাম।

‘জাপান-চিন হয়ে উঠবে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আর তাদের শত্রু হয়ে উঠবে আমেরিকা,’ বলল সোহেল। ‘তাতে ভবিষ্যতে তিন দেশ মিলে যুদ্ধে জড়ালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

‘কিন্তু এই ল্যাব ধ্বংস করলে কিছুই করতে পারবে না,’ বলল রানা।

‘কিন্তু তা করতে দেয়া হবে না,’ অন্ধকার থেকে বলে উঠল কে যেন!

কথাটা এসেছে ঘরের দরজার কাছ থেকে। কণ্ঠস্বর লো হুয়াং লিটনের।

ঘুরে তাকাল রানা। দরজার কাছে কেউ নেই। কথা এসেছে দেয়ালের স্পিকার থেকে। সোহেলের পেছনে খুলে গেল গোপন দরজা। ছুটে ঢুকল তিনজন। ঘরের আরেক দিকের দরজা খুলে এল আরও দু’জন লোক।

সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সময় নিল না রানা, ঘুরেই গুলি পাঠাল প্রথম রোবটের দিকে।

কয়েকটা বুলেট বিঁধল রোবটের বুক, মুখ, মাথা ও ঊরুতে। কিন্তু কিছুই হলো না ওটার। ঝড়ের বেগে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে ছুটে এল সেটা রানার দিকে। পাকা কুস্তিগীরের মত ওকে ট্যাকল করল। ল্যাং মেরে ফেলল মেঝেতে। তার হাতের ঝটকায় ছিটকে পড়ল রানার হাতের পিস্তল।

শুরু হলো হ্যাণ্ড-টু-হ্যাণ্ড কমব্যাট। নিজের যান্ত্রিক সংস্করণের সোলার প্লেক্সাসে প্রচণ্ড ঘুষি বসাল রানা। কিন্তু তা পাত্তাও দিল না রোবট। ডানহাত ছুটিয়ে নিয়ে ঘুষি মারল রানা যান্ত্রিক চোয়ালে। ফেটে গেল নকল ত্বক। নিচে রয়েছে টাইটেনিয়ামের হাড় ও ছোট হাইড্রোলিক মোটর।

শক্ত হাতে রানার গলা চেপে ধরল রোবট। আটকে দিচ্ছে মগজে রক্ত সঞ্চালন। দু’হাতে যান্ত্ৰিক হাত খামচে ধরল রানা। ছিঁড়ে ফেলল নকল মাংস। আশা করছে পাবে তার। সেক্ষেত্রে ছিঁড়বে ওগুলো।

কিন্তু হাতে মাংসপেশি, প্রেশার পয়েন্ট বা দুর্বল কিছুই পেল না রানা। উপড়ে আনার উপায় নেই কোনও প্লাগ বা ব্যাটারি।

জ্ঞান হারাচ্ছে রানা। চোখে দেখছে কালো আঁধার। ঝট করে মাথা তুলে গুঁতো দিল রোবটের নাকে। মট্ করে ভাঙল নরম হাড়ের মত প্লাস্টিক। এতে কিছুই হলো না রোবটের ফাঁকা চোখে ওকে দেখল ওটা। বাড়ল গলার ওপর চাপ।

প্রায় অচেতন রানা দেখল, হুয়াঙের তিন লোকের সঙ্গে লড়ছে সোহেল। কিন্তু ওকে মেঝেতে পেড়ে ফেলল তারা। সোহেলের মাথায় পিস্তলের নলের বাড়ি দিল একজন।

‘বাড়াবাড়ি করলে খুন হবে,’ সতর্ক করল হুয়াং।

এমনিতেই লড়াই শেষ। রোবটের শক্তি রানার চেয়ে ঢের বেশি। সোহেলের বুকে চেপে বসেছে দু’জন গার্ড। হাল ছেড়ে মেঝেতে হাত রেখে শুয়ে থাকল রানা। সুযোগ পেলে পরে লড়বে। ওর কপাল ভাল, গলা থেকে চাপ কমাল রোবট। তবে সরিয়ে নিল না হাত।

ঘরে থেমেছে ধস্তাধস্তি। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লো হুয়াং। প্রতি পদক্ষেপে ক্লিক-ক্লিক শব্দ তুলছে চামড়ার দামি জুতো। রানার পাশে এসে বসল লোকটা। মন দিয়ে দেখল নকল রানার বুক ও মুখের বুলেটের ক্ষত। ক’মুহূর্ত পর বলল, ‘বোকামি কাকে বলে! আগেই রেসের ট্র্যাকে বলেছি, মানুষের সাধ্য নেই জিতবে মেশিনের সঙ্গে। আমার তৈরি মাসুদ রানা তোমার চেয়ে অনেক উঁচু পর্যায়ের যোদ্ধা। শক্তি ও গতি বেশি বলে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তোমার চেয়ে অনেক দ্রুত। আরও বড় কথা, ওর নেই ব্যথা বা ভয়। চাইলেও ওর ধারেকাছে যেতে পারবে না তুমি, মাসুদ রানা!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *