1 of 2

মহাপ্লাবন – ১৪

চোদ্দ

দূর থেকে দেখলে কেউ ভাববে, প্রচণ্ড বেগে চলেছে প্রকাণ্ড একটা সাদা সাপ। গতির কারণে একেবারে ঝাপসা। ওটা আসলে জাপানের নামকরা বুলেট ট্রেন। এইমাত্র সাঁই করে ঢুকে পড়ল একটা সুড়ঙ্গের ভেতর। পরক্ষণে বজ্রপাতের আওয়াজ তুলে বেরোল সুড়ঙ্গের আরেকমাথা দিয়ে।

জীবনে প্রথমবারের মত ‘টানেল বুম’ শুনল তানিয়া। বসে আছে বারো বগির ট্রেনের অষ্টম বগিতে। পাশেই জানালা। বাইরের প্রচণ্ড শব্দ মোটেও ঢুকছে না ভেতরে। যেন মসৃণভাবে ভাসতে ভাসতে চলেছে ওরা সবাই।

‘ভাল লাগছে টোকিও থেকে বেরোতে পেরে,’ আসিফকে বলল তানিয়া, ‘বিশেষ করে রানা যা বললেন। যখন-তখন খুন হবেন।’

চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চারপাশ দেখল আসিফ। না, ওদের কথা শুনছে না কেউ। টোকাইডো শিনকানসেন রেললাইন জাপানের মেইন বুলেট ট্রেন রুট। সে পথেই টোকিও থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে চলেছে ওরা। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যবহৃত হাই- স্পিড রেললাইন হলেও অফ আওয়ারে প্রিমিয়াম কার-এ পড়ে থাকে অনেক সিট।

‘আমিও তোমার সঙ্গে একমত, মস্তবড় বিপদে পা দিচ্ছে রানা আর সোহেল,’ বলল আসিফ, ‘তবে এটাই ভরসা, নিজেদের কাজ বোঝে ওরা।’

‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন বলেছেন, চাইনিয় প্যাট্রল এড়িয়ে পুব সাগরে যাওয়া অসম্ভব,’ বলল তানিয়া। ‘কী করা যায় সে ব্যাপারে কিছু ভাবছ?’

এই যে, এটা দেখো।’ নোটবুক কমপিউটার খুলে সামনের ট্রে টেবিলে রাখল আসিফ। চলার পথে অনেক সময় নিয়ে নুমা চিফের পাঠানো তথ্য ঘেঁটে দেখেছে। তানিয়ার দিকে স্ক্রিন ঘুরিয়ে দিল ও।

স্ক্রিনের অ্যাংগেল ঠিক করে চিনের পুব সাগরের ম্যাপ দেখল তানিয়া। বাঁকা সব রেখা নানাদিকে। ওগুলো দিয়ে বোঝানো হয়েছে কোথায় ঘুরছে চাইনিয নেভাল ভেসেল। বড় একটা অংশ ধূসর রঙের। ওই এলাকায় আকাশ থেকে চোখ রাখছে অ্যান্টিসাবমেরিন এয়ারক্রাফট। আরও আছে সারি সারি লাল বৃত্ত। ওগুলো সোনার বয়া। কোনও উপায় নেই যে ফাঁকি দেয়া যাবে চিনা কর্তৃপক্ষকে।

ওই এলাকা পাহারা দিচ্ছে চাইনিয মিলিটারি,’ বলল তানিয়া।

‘এত সিকিউরিটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ওখানে লুকিয়ে সত্যিই কিছু করছে ওরা,’ বলল আসিফ। ‘তবে তাদেরকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা কাজে না-ও আসতে পারে। এর চেয়ে কর্তৃপক্ষকে ই-মেইল করে বলে দেয়া ভাল: ‘ভাই, আমরা আসছি, আপনারা দয়া করে শাংহাই জেলখানায় আমাদের জন্যে দুটো সিট রাখবেন।’

‘মানতে হচ্ছে তোমার কথাই…’ বলতে বলতে থেমে গেল তানিয়া। হারিয়ে গেল নিজ মনে। হয়তো সত্যিই উপায় আছে যি-ওয়েভের এলাকায় পৌঁছে যাওয়ার। কেমন হয় ওরা দক্ষিণ থেকে পুব সাগরে গেলে? কয়েক সেকেণ্ড পর স্ক্রিনে মানচিত্রটা বড় করল ও। দেখল, প্রতিটি ভাইটাল জায়গায় রয়েছে নেভাল প্যাট্রল। কোথাও কোনও ত্রুটি রাখেনি চাইনি কর্তৃপক্ষ। ‘ধরো, আমরা যদি ব্যবহার করি শিপিং লেন?’

‘তাতে কী লাভ?’

‘এশিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর শাংহাই। আমরা যদি ওখান থেকে একটা মালবাহী জাহাজে করে রওনা হই?’

‘তারপর মাঝ সাগরে নেমে গেলাম। ….তারপর? সাঁতরে বাড়ি ফিরব কী করে?’

‘হুঁ, ভাবিনি। কিন্তু ঠিক জায়গায় যাওয়ার পর যদি আমরা জাহাজ থেকে কিছু ফেলে দিই? যেমন ক্যামেরা? সেটার সঙ্গে থাকবে সোনার। আর তারপর জাহাজে বসে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে চালাব সব।’

খুশি হয়ে উঠল আসিফ। ‘তবে ওই সোনার বা ক্যামেরা রেখে আসতে হবে সাগরের নিচেই।’

‘খরচ খুব বেশি পড়বে না,’ বলল তানিয়া।

‘ঠিক,’ সায় দিল আসিফ। ‘একেবারে শেষ সময়ে উঠব ফ্রেইটারে। তাতে সন্দেহ করবে কেউ কেউ। কিন্তু আমরা তো আর পেটমোটা রোভ তুলছি না জাহাজে। তাই লাগেজ খুঁজতেও যাবে না কেউ। অবশ্য ডেকের পাশ থেকে সাগরে ক্যামেরা বা সোনার নামালে দেখে ফেলবে যে-কেউ।’

‘দেখবে না,’ বলল তানিয়া, ‘উঠব ওসাকা টু শাংহাই-এর ফেরিতে। বুক করব কেবিন।’ স্বামীর দিকে কমপিউটার ঘুরিয়ে দিল ও। হাইলাইট করল শিপিং রুট। ‘এই কমপিউটারের তথ্য ঠিক হলে, ওই ফেরি যাবে টার্গেট এরিয়া থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূর দিয়ে।’

‘প্রথম সমস্যা মিটে গেল,’ বলল আসিফ। ‘কিন্তু রোভ? ওটা পাব কোথায়?’

টেবিলে তবলা বাজাতে শুরু করেছে তানিয়া। ‘সেটাই এখন ভাবছি।’

হঠাৎ মুচকি হাসল আসিফ। ‘বোধহয় পেয়ে গেছি উত্তর। বলো তো, ঠিক কখন রওনা হবে ওই ফেরি?’

ইণ্টারনেটে গিয়ে ওসাকা টু শাংহাই ফেরির স্কেজুয়াল দেখল তানিয়া। ‘সপ্তাহে দু’বার আসা-যাওয়া করে। আগামীকাল দুপুরে রওনা হবে শাংহাইয়ের দিকে।

‘তা হলে যথেষ্ট সময় পাব,’ বলল আসিফ।

‘কীসের জন্যে সময়?’

‘তোমার মনে আছে, কিছু দিন আগে ক্রো-র কথা বলেছিল ববি মুরল্যাণ্ড?’

ক’সেকেণ্ড পর বলল তানিয়া, ‘হ্যাঁ। ওঁর নতুন তৈরি রোভ। মেকানিকাল কাক। ছোঁক ছোঁক করার জন্যে।’

‘ওটা ক’দিন আগে পরীক্ষা করেছে হাওয়াই দ্বীপের কাছের সাগরে,’ বলল আসিফ, ‘হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা না হয়ে থাকলে, আমরা নুমা চিফকে অনুরোধ করতে পারি, যাতে ওটা জাপানে পাঠিয়ে দেন তিনি। তা হলে এয়ারপোর্ট থেকে সংগ্রহ করে নেব। সময়ও পাব ফেরির টিকেট কাটতে। রোভটাকে পেটে নিয়ে শাংহাই-এর দিকে যাবে ফেরি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *