1 of 2

মহাপ্লাবন – ১৬

ষোলো

মুখে ফুলফেস হেলমেট পরে ওসাকা উপসাগরের ষাট ফুট তলা দিয়ে চলেছে আসিফ রেজা, পরনে ওয়েট সুট।. অশ্বারোহীর মত বসে আছে ববি মুরল্যাণ্ডের তৈরি রোভ ক্রো বা কাকের পিঠে। জোরালো স্রোতের টানে ওর মনে হচ্ছে, তুষার ভরা উঁচু পাহাড় থেকে সাঁই-সাঁই করে নামছে ও। শক্তহাতে ধরেছে মেশিনের হ্যাণ্ডেল। পেছনে বৃত্তাকার খাঁচায় বনবন ঘুরছে প্রপেলার। আহত হওয়ার ভয় নেই, তাই প্রপালশান ডাক্টের একটু আগে রেখেছে পা।

হেলমেটের মাইক্রোফোনের স্পিকারে বলল আসিফ, ‘গতি কমাও। পিছলে প্রপেলারে পা ঢুকলে নতুন গোড়ালি লাগবে। খরচা অনেক।’

ওপরে রয়ে গেছে রিভেটার, আসিফের কথা পৌঁছে দিল তানিয়ার কাছে। এক শ’ গজ দূরের সাগরে বোটে বসে রোভ নিয়ন্ত্রণ করছে ও। সাগরতলে ওর কণ্ঠ এল অস্পষ্টভাবে। ‘তুমিই না চেয়েছিলে পানির নিচে কাজটা করতে?’

পরেরবার হাসতে হাসতে তর্কে হারব। সাবধানে শরীর মুচড়ে দু’পাশ দেখল আসিফ। ওসাকা উপসাগরের ময়লা পানির মাঝ দিয়ে দূরে চোখে পড়ল তানিয়ার বোটের তলি। অন্ধকারের বুকে সাদা একটা রেখা।

এখন সাগর-সমতল থেকে মাত্র পঞ্চাশ ফুট নিচ দিয়ে চলেছে আসিফ। রোদেলা বিকেল, অথচ ওপর থেকে আসছে না কোনও আলো। বন্দরের পলি, পাথর ও বালি একটু পর পর সরছে এদিক-ওদিক ভারী জাহাজ চলাচলের কারণে। তার ওপর শহরতলী ও ইণ্ডাস্ট্রিয়াল দূষণে বহু গুণ বেশি জন্মেছে অ্যালগি। একসময়ে ওগুলো খেতে হাজির হতো হাজার হাজার মাছ। কিন্তু শেষে দেখা গেল মাছগুলোকেই বরং তাড়িয়ে ছেড়েছে সাগরতলের ওই বিষাক্ত শৈবাল।

‘প্রায় কিছুই দেখছি না,’ বলল আসিফ, ‘টার্গেট থেকে কতটা দূরে আছি?’

‘আরও সিকি মাইল, বলল তানিয়া, ‘একটু পর পাশ কাটিয়ে যাব ফেরি। তখন তোমাকে পৌছে দেব ওটার ঠিক নিচে। জাহাজটা দেখলেই আমাকে বলবে। তারপর তোমার কথা শুনে ঠিক করব কোর্স।’

‘তার মানে, বলে দিতে হবে কীভাবে ড্রাইভিং করবে?’ জানতে চাইল আসিফ। ‘ভাল। জীবনে প্রথম।’

‘তুমি তো আর কোনওকালেও ড্রাইভিং ঠিকভাবে শিখলে না,’ বলল তানিয়া। ‘এবার বাঁক নাও। একমিনিট পর দেখবে নাকের কাছে হাজির হয়েছে ফেরির খোল।’

স্রোত সামলে প্রতিটি সেকেণ্ড গুনতে লাগল আসিফ। মাথা উঁচু করে দেখছে দূরে। কিন্তু ওদিকে আছে শুধু ধূসর-সবজেটে পর্দা। আওয়াজের অভাব নেই। চিঁ-চিঁ তীক্ষ্ণ শব্দ তুলছে রোভের ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক প্রপেলার। গুঞ্জন তুলে দূরে যাচ্ছে তানিয়ার বোট। নিচু চাপা একটা আওয়াজ আসছে সরাসরি সামনে থেকে।

‘ফেরির ইঞ্জিনের শব্দ শুনছি,’ বলল আসিফ।

‘দেখতে পেয়েছ?’

‘এখনও না,’ বলল আসিফ, ‘বুঝতে পারছি, এজন্যেই কোটি বছর ধরে শরীরে সোনার তৈরি করেছে ডলফিনের দল।’

‘সোনারের চেয়েও ভাল জিনিস এই আওয়াজ,’ বলল তানিয়া, ‘কিছু দেখলে জানাবে। কমিয়ে দিচ্ছি রোভের গতি।

বেগ কমতেই টের পেল আসিফ, আপাতত মাত্র কয়েক নট ওর গতি। তাতে চাপ কমল হাতের ওপর থেকে। একটু দূরে দেখল বিশাল কী যেন। ‘দেখেছি,’ বলল আসিফ। ‘প্রস্রাব করা গরুর মত বিলজ ওঅটার ফেলছে। আমাকে সরাও দশ ডিগ্রি বামে। সরাসরি ফেরির নিচ দিয়ে যেতে চাই না।

জালি দিয়ে ঘেরা প্রপেলারের নাকের কাছ থেকে সরল ব্যাঙাচি আকৃতির রোভ।

‘সরাসরি বিশ সেকেণ্ড এগোও,’ বলল আসিফ, ‘তারপর আমাকে রাখবে ফেরির কিল থেকে দশ ফুট নিচে। বন্ধ করবে থ্রটল।’

ফেরির খোল পরিষ্কার দেখছে আসিফ। অনেকটা ওপরে ওঅটার লাইন। ত্রিশ বছর সাগরে চলে লোহার লাল খোলে এখন খয়েরি দাগড়া সব জং। জায়গায় জায়গায় পুরু হয়ে জন্মেছে শৈবাল। জাহাজের ষোলো ফুট নিচ দিয়ে চলেছে আসিফ। ভয় নেই মাথা ঠুকে যাবার। ‘এবার থ্রটল বন্ধ করো,’ বলল আসিফ।

ক’সেকেণ্ড পর থামল ইলেকট্রিকাল মোটর। ফেরির কিলের নিচে থামল রোভ। ড্রাইভিং বাতি জ্বালল আসিফ। ‘এবার গায়ে খাটতে হবে।’

ঊরু থেকে রোভের ফিতা খুলে সাঁতরে ওপরে উঠল ও। বিশাল জ্বাহাজের নিচে থাকা সত্যিই অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। ওর মনে হলো, উঠে স্পর্শ করতে পারবে আকাশের সারি সারি মেঘ। ‘পৌঁছে গেছি ঠিক জায়গায়।’

‘কেমন লাগছে?’ জানতে চাইল তানিয়া, ‘মাথার ওপরে ভাসছে তিরিশ হাজার টনি জাহাজ!’

‘ভাবছি বয়্যান্সির নিয়ম মেনে ভেসে থাকুক ফেরি! তবে আগামী দশ মিনিটে এখান থেকে বেরোতে না পারলে রীতিমত মানসিক কষ্টে পড়ব।’

জাহাজের খোলের যে অংশ বেছে নিয়েছে, সেটা খুঁজে নিতে বেশিক্ষণ লাগল না ওর। ওটা বো-র কাছেই। নুমার ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, ফেরি চললে কম ডাইন্যামিক প্রেশার পড়বে ওখানে। ‘রোভ রাখার জায়গা পেয়ে গেছি।’

‘দেখতে কেমন?’ জানতে চাইল তানিয়া

‘পুরু হয়ে খোলে লেগে আছে কোটি কোটি গুগলি,’ বলল আসিফ, ‘বুঝলাম, শাংহাই ফেরি কোম্পানি বাপের জন্মেও তাদের জাহাজ পরিষ্কার করেনি।’

ম্যাগনেট ব্যবহার করে জোঁকের মত জাহাজের গায়ে আটকে যাবে এই রোভ। কিন্তু লোহার খোলে গুগলি বেশি থাকলে মোটেও কাজ করবে না চুম্বক। যেখানে রোভটাকে রাখবে, আগেই উপড়ে নিতে হবে সেখানের সব গুগলি। এজন্যেই গোপনে ফেরির নিচে হাজির হয়েছে আসিফ। ওর সঙ্গে নিডল স্কেলার। শক্তিশালী ইলেকট্রিকাল ডিভাইস। দেখতে অ্যাসল্ট রাইফেলের মত। বাঁট রাখতে হবে কাঁধে। ওপরে খাড়া হ্যাণ্ডগ্রিপ। লম্বা ব্যারেলের শেষে টাইটেনিয়াম বাটালি। যন্ত্রটা আসিফ চালু করলেই তীব্র বেগে আগু-পিছু করবে ওটা। শক্তহাতে যন্ত্র ধরলে ছিটকে পড়বে সব গুগলি, বেরিয়ে আসবে জাহাজের মসৃণ খোল।

‘কাজ শুরু করলাম,’ স্ত্রীকে জানাল আসিফ। কাঁধে ঠেকাল নিডল স্কেলারের বাঁট। সুইচ টিপে গুগলির ওপর বাটালি রেখে এগোতে চাইল সাঁতরে। জাদুর মত কাজ করছে ধারালো বাটালি, একেকবারে খসে পড়ছে অনেক গুগলি।

‘কতটা পুরু গুগলির স্তর?’ জানতে চাইল তানিয়া।

‘অন্তত চার ইঞ্চি,’ বলল আসিফ।

‘ভাবলে অবাক লাগে, কীভাবে জাহাজকে নিজেদের বাড়ি বানিয়ে নেয় এরা,’ বলল তানিয়া। ‘জানো, জাহাজ বা বোট জলে নামার মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় ওগুলোর গায়ে জন্মায় মাইক্রোব?’

‘জানতাম না,’ বলল আসিফ। ‘তবে, তানিয়া, এগুলো মাইক্রোব নয়।’ কাজে মনোযোগ দিল ও।

নানান গুগলি নিয়ে বকে চলল তানিয়া। আজ থেকে হাজার বছর আগে উড ওঅর্ম থেকে বাঁচতে তাদের নৌকার তলিতে সীসার পাত লাগাত রোমানরা। পরে জাহাজের বহর রক্ষা করতে খোলের নিচে তামার পাত লাগাত ব্রিটিশরা। তানিয়া আরও বলল, জাহাজ বা নৌকায় মেরিন গ্রোথ ঠেকাতে দারুণ কাজে লাগে টিনের পাত। কিন্তু তাতে খুব দ্রুত বিষাক্ত হয়ে ওঠে পানি।

স্ত্রীর কথায় মন নেই আসিফের। ঠিক অ্যাংগেল-এ ধরে গায়ের জোরে চালাচ্ছে যান্ত্রিক বাটালি। ছিটকে পড়ছে শক্ত খোলের গুগলি। দু’বর্গ ফুট খোল পরিষ্কারের পর সাফ করল দশফুট পেছনের জায়গা। সামনের মসৃণ খোল থেকে একটু সামনে গুগলি-মুক্ত করল তৃতীয় আরেকটা অংশ।

কাজ শেষ করতে লাগল সাত মিনিট। ব্যথা হয়ে গেছে হাত ও কাঁধ।

‘…তারপর কীভাবে যে ওরা আবার হাজির হয়, ভাবাই যায় না,’ কথা শেষ করল তানিয়া।

‘ঠিক,’ সায় দিল আসিফ। প্রায় কিছুই শোনেনি। ‘এ হচ্ছে স্নো-ব্লোয়ারের কাজের মত। উড়িয়ে দাও তুষার।

‘তোমার কাজ শেষ?’ জানতে চাইল তানিয়া।

‘হ্যাঁ, শেষ।’ বেল্টে স্কেলার ঝোলাল আসিফ, ‘এবার ঠিক জায়গায় নেব রোভ। তুমি চালু করে দেবে ম্যাগনেট।’

রোভ সেট করা আছে যিরো বয়্যান্সিতে। পানির নিচে যান্ত্রিক কাক সরিয়ে নেয়া কষ্টকর কাজ। কিছুক্ষণের ভেতর হাঁফিয়ে গেল আসিফ। ঠিক জায়গায় ওটা রেখে বলল, ‘এবার চালু করো মেইন ম্যাগনেট।’

শক্তহাতে ধরেছে রোভ। শুনল গুনগুন শব্দ, তারপর খঠাং। রোভের ওপরে বড়, বৃত্তাকার সাকশান কাপটা দেখতে মাছের মুখের মত। ওটাই মেইন ম্যাগনেট, আটকে গেছে খোলের সঙ্গে। ‘চালু করো অন্যদুটো।’

এক সেকেণ্ড পর জাহাজের গায়ে আটকে গেল রোভের সামনের ও পেছনের ম্যাগনেট। হ্যাণ্ডেল ও রিগিং ধরে টান দিল আসিফ। খোলে পা রেখে প্রাণপণে ছুটিয়ে নিতে চাইল রোভ। একতিল নড়ল না যন্ত্রটা।

সন্তুষ্ট হয়ে খোল থেকে সরল। ‘উপড়ে ফেলেছি ছোট অনেক গুগলি, কিন্তু সে-জায়গায় এখন ধাতব বড় একটা। এবার তোমার বোটের দিকে আসছি।’

‘আচ্ছা,’ বলল তানিয়া, ‘আছি পোর্ট সাইডে দু’ শ’ গজ দূরে। সাঁতরে চলে এসো। হাতে বেশি সময় নেই। ফেরি ধরতে হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *