1 of 2

মহাপ্লাবন – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

কোনও ভণিতা না করেই আসিফ ও তানিয়ার মস্ত বিপদের কথা রানাকে সংক্ষেপে জানালেন কমোডর জোসেফ কার্ক। ভারী হয়ে গেছে দু’জনেরই মন।

‘আপনারা কি ভাবছেন ওদেরকে আমেরিকায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘উপায় খুঁজছি,’ বললেন কার্ক, ‘এদিকে অ্যানালাই করা হচ্ছে ওদের পাঠানো ডেটা। ভিডিয়োতে যে ঢিবিটা, প্রথমে দেখলে মনে হবে ওটা আগ্নেয়, কিন্তু আসলে তা নয়। গন্ধক, আর্সেনিক, কয়লা বা অন্যকিছু নয়, শুধু উৎক্ষেপ করছে গরম পানি।’

‘এসব ঢিবি কতটা বড়?’ জানতে চাইল সোহেল। ‘ভিডিয়ো থেকে কিছুই বোঝা যায় না।’

‘সোনার ডেটা অনুযায়ী, একেকটা প্রায় বিশতলা বাড়ির সমান উঁচু,’ বললেন কার্ক। ‘অন্যগুলোও মোটামুটি এমনই।’

‘কী পরিমাণ পানি বেরোচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ওগুলোর কারণেই কি সাগরের উচ্চতা এত দ্রুত বাড়ছে?’,

‘ক্যামেরার সবচেয়ে কাছের গিযার থেকে যে গতি তুলে বেরোচ্ছে পানি, তাতে প্রতি মিনিটে উঠে আসছে পাঁচ লক্ষ কিউবিক ফিট। বর্ষার সময়ে একদিনে নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে যে পরিমাণ পানি ঝরে, ধরে নিতে পারেন, এরকম দশটা ঢিবি থেকে বেরোচ্ছে সে পরিমাণের পানি।’

‘আছে কতগুলো?’ জানতে চাইল সোহেল।

‘জানা নেই,’ বললেন কার্ক, ‘আসিফ আর তানিয়ার পাঠানো ভিডিয়োতে দেখা গেছে অন্তত চল্লিশটা ঢিবি। তবে এডিট করা হয়েছে রেকর্ডিং। আরও লম্বা ছিল ভিডিয়ো।’

‘সবাই যার্তে বুঝতে পারে, সেজন্যে সংক্ষিপ্ত ডেটা আর ভিডিয়ো দিয়েছে ওরা,’ মন্তব্য করল সোহেল।

‘আমারও তাই ধারণা,’ বললেন কার্ক, ‘স্যাটেলাইট ডেটা থেকে মনে হচ্ছে, পুব চিনের সাগর থেকে বেরোচ্ছে জোরাল স্রোত। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ স্রোত। আগে তাইওয়ান আর ওকিনাওয়ার মাঝে যে উত্তরমুখী স্রোত ছিল, সেটা পুব দিকে সরে চলে গেছে দক্ষিণে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়ার প্যাটার্ন, সাধারণ দিন হচ্ছে কুয়াশাভরা। চিনের শুকনো কিছু এলাকায় শীতের আগেই আসছে একের পর এক তুষার ঝড়।

‘শক্তিশালী ওই স্রোত উত্তরদিকে যাচ্ছে বলে বেয়ারিং স্ট্রেইট পর্যন্ত সাগরে কমে যাচ্ছে পানির লবণাক্ততা, ফলে বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা। জাপান সাগর এতই পাল্টে যেতে শুরু করেছে যে, আগামী কয়েক মাসে ওটা হয়ে উঠবে মিষ্টি পানির বড় একটা লেক।’

‘এত পানি উঠছে এসব ঢিবি থেকে?’ বিস্মিত হয়েছে রানা।

‘আমাদের তা-ই ধারণা,’ বললেন কার্ক। ‘তবে হঠাৎ কেন এভাবে উঠে আসছে, তার কোনও ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই। কীভাবে পানির উঠে আসা ঠেকানো যাবে, তা-ও জানি না। শুধু জানি, চিনের পুব সাগরে কী যেন করেছে ওরা। ফলে…’ চুপ হয়ে গেলেন কার্ক। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, ‘আপনাদের কাজ কতটা এগোল, মিস্টার রানা?’

লো হুয়াং লিটনের সঙ্গে দেখা করেছে, জানাল রানা। তাতে লাভ হয়নি। ‘লোকটার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই কারও হাতে। যতটুকু যা শুনেছি, সেসব এসেছে এক মাঝারি মাপের ইয়াকুয়া অপরাধী নেতার কাছ থেকে।’

‘একটু আগে জরুরি তথ্য দিয়েছেন আপনি,’ বললেন কার্ক, ‘লো হুয়াং লিটনের কোম্পানি তৈরি করে নানান ধরনের রোবট।’

‘তা-ই জেনেছি,’ বলল রানা, ‘ভাল করে দেখার সুযোগ হয়নি।’

‘এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি আসিফ আর তানিয়ার তোলা ভিডিয়োর স্টিল ছবি, বুঝতে পারবেন ওগুলো কী ধরনের,’ জানালেন কার্ক।

কমপিউটার স্ক্রিনের দিকে চেয়ে অপেক্ষায় থাকল রানা। তিন সেকেণ্ড পর এল লিঙ্ক। ওটার ওপর ক্লিক করতেই দেখা গেল সাদা-কালো ছবি। ওখানে রয়েছে সাদা একটা রোবটিক বাহু, কাঁধ আর মুখ।

‘কী বুঝলেন, মিস্টার রানা?’

‘হ্যাঁ, সোহেলের ভবিষ্যৎ স্ত্রীর যমজ বোন,’ মন্তব্য করল রানা।

‘তলিয়ে গেছে সাগরে,’ বললেন কার্ক, ‘ওটা ভূমিকম্প এলাকা। একটা ক্যানিয়নের নিচে।’

‘পানির নিচে কী করছে আমার শালী?’ জানতে চাইল সোহেল।

‘ডিপওঅটার মাইনিং,’ বললেন কার্ক, ‘কিন্তু বড় কোনও বিপর্যয়ের ফলে ধসে পড়ে চিনাদের তৈরি সব ফ্যাসিলিটি। দুমড়ে গেছে সব টিনের বাক্সের মত।’

‘কী খুঁজছিল ওরা?’ জানতে চাইল রানা।

‘জানি না। তবে ওটা বোধহয় খুব দামি। নইলে এত খরচ করত না। পানির নিচে খনি থেকে কিছু তুলতে গেলে খরচ পড়বে পঞ্চাশ থেকে এক শ’ গুণ। অর্থাৎ, ওরা যদি প্ল্যাটিনাম বা সোনাও তুলত, বেশি খরচের কথা ভেবে বন্ধ করত খনিতে কাজ।’

‘অর্থাৎ, সোনার চেয়েও দামি কিছু,’ বলল সোহেল।

‘আমাদের জিয়োলজি ডিপার্টমেন্ট খুঁজে দেখছে, কী ধাতুর জন্যে এত গভীর সাগরে মাইনিং হলো,’ বললেন কার্ক। ‘আপাতত কোনও জবাব দিতে পারছে না ওরা।’

‘খনি বন্ধ করে দিয়েছে চিনারা,’ বলল সোহেল। ‘দেখে তো মনে হচ্ছে জায়গাটা পরিত্যক্ত।’

‘আপাতত তাই,’ স্বীকার করলেন কার্ক, ‘ভিডিয়োতে আমরা দেখেছি, পরে আর ফ্যাসিলিটি চালু করা হয়নি।’

চেয়ারে হেলান দিল রানা। কী যেন অস্বাভাবিক লাগছে ওর। সেটা কী, বুঝতে পারছে না। হিনার দিকে তাকাল। ‘কবে প্রথম যি-ওয়েভ আর ভূমিকম্প টের পেলেন ডক্টর শিমেযু?’

‘প্রায় একবছর আগে,’ রানার জানা কথাটাই বলল হিনা।

কার্কের দিকে মনোযোগ দিল রানা। ‘কার্ক, আপনার ইন্টারনেটের গতি বেশি। আমাদের জন্যে একটা কাজ করুন, একটু খোঁজ নিয়ে জানান এনসিআর প্রথম কবে ইনকর্পোরেটেড হয়েছে।’

পেরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বললেন কার্ক, ‘পার্টনারশিপ ঘোষণা করা হয় আজ থেকে এগারো মাস আগে।’

মৃদু মাথা দোলাল ‘রানা। ‘আর কবে থেকে হঠাৎ করে জাপানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল চিন?’

‘এগারো মাস আগে,’ একমিনিট পর বললেন কার্ক। ‘ওই একই দিনে এনসিআর ইনকর্পোরেটেড হয়।’

এর কোনও ব্যাখ্যা নেই রানার কাছে। তবে বুঝতে পারছে, গোপন কিছু আছে গোটা ব্যাপারটার ভেতর। ‘চিন সরকার নিজেদের এলাকায় খনি থেকে কিছু তুললে, এবং পরে খনি বন্ধ করলে, এত গোপনীয়তা বজায় রাখত না। মনে হচ্ছে, যে ধরনেরই হোক সেই ধাতু, সেটা পাওয়ার জন্যে মরিয়া তারা। সাগরতল থেকে নতুন ‘ওর’ না পেয়ে এখন খুঁজছে জাপানের দ্বীপে। নইলে খুন হতেন না শিমে এবং তাঁর অনুসারীরা।’

‘অসম্ভব নয়,’ বললেন কার্ক।

‘এ নাটকে উপস্থিত বেশ কয়েকটা পক্ষ,’ বলল রানা। ‘লো হুয়াং লিটন আর তার রোবট। চাইনি কূটনীতিকরা। পারস্পরিক শান্তির জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠা চিন-জাপান। এবং তা হচ্ছে চিনের আগ্রহে। অথচ, গত কয়েক দশক ধরে তারা বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অপরাধের জন্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে জাপানকে।’

‘তুই আসলে কী ভাবছিস?’ জানতে চাইল সোহেল।

‘চিনের ওই ক্যানিয়নে যে ধাতু ছিল, ওটা ফুরিয়ে গেছে, তাই চিনের কর্মকর্তারা ভাবছে ওই একই জিনিস পারে জাপানের উপকূলে,’ বলল রানা। ‘লো হুয়াং লিটনকে সামনে রেখে এগোচ্ছে। বন্ধুত্বের আড়ালে আছে অন্যকিছু। এনসিআরকে ব্যবহার করে ওই ধাতু খুঁজছে তারা।’

‘জিনিসটা কী হতে পারে?’

‘জানি না,’ মাথা নাড়ল রানা।

‘আপনার থিয়োরি জানিয়ে দেব জিয়োলজি টিমকে,’ বললেন কার্ক। ‘নতুন কোনও সম্ভাবনা বেরোতে পারে। তবে আমাদের প্রথম কাজ, যেভাবে হোক আসিফ ও তানিয়াকে চিন থেকে সরিয়ে আনা। দ্বিতীয় কাজ, জানতে হবে কী করেছে চিন সরকার। তৃতীয় কাজ, বন্ধ করতে হবে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা ওই পানির স্রোত। কিন্তু কীভাবে এসব করব, আমাদের জানা নেই।’

‘প্রথমে ধরতে হবে লো হুয়াং লিটনকে,’ বলল রানা। ‘ওর পেট থেকে বেরোবে অনেক কিছুই।’

‘নিশ্চয়ই নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল আছে তার,’ বললেন কার্ক। ‘কঠিন হবে তাকে বাগে পাওয়া।’

‘ভাবছি, হানা দেব তার ফ্যাক্টরিতে,’ বলল রানা, ‘প্রয়োজনে কিডন্যাপ করব তাকে।’

‘এসব কিছুই করতে হবে না,’ বলল হিনা। এইমাত্র আবার ঢুকেছে ঘরে। হাতে রানার নতুন মোবাইল ফোন। সিম কার্ড তুলতে হয়েছে ওটার জন্যে।

স্ক্রিনে দপ-দপ করে জ্বলছে একটা টেক্সট্ মেসেজ।

‘এইমাত্র এল,’ বলল হিনা, ‘আপনাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে লো হুয়াং লিটন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *