1 of 2

মহাপ্লাবন – ৩৮

আটত্রিশ

আগের দুটো ল্যাপের মতই তৃতীয় ল্যাপটাও স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে রানার কাছে। কিন্তু চতুর্থ ল্যাপ শুরু হতেই দেখল এগিয়ে আসছে রোবট চালিত গাড়ি। ওটার হেডলাইটের আলো পড়ছে আয়নায়। ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ। চারটে হীরা আকৃতির উজ্জ্বল সাদা আলো জানিয়ে দিচ্ছে, শিকারের খুব কাছে পৌছে গেছে শিকারী।

ঘাড়ের কাছে চার আলোর ফলে সমস্যা হচ্ছে রানার। চোখ সরু করল। নিজের গাড়ির হেডলাইট দেখাই কঠিন।

চলছে চতুর্থ ল্যাপ, আরও কাছে চলে এল রোবটিক কার। আরও দ্রুত চলতে গিয়ে ঝুঁকি নিতে হচ্ছে রানাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বাঁক ঘোরার সময় চাকা গেল ট্র্যাকের কিনারায়। নিজের ওপর বিরক্ত হলো রানা। ভাবল, একটু বেশি আগে চাপ দিয়েছে অ্যাক্সেলারেটরে। মুহূর্তে পৌছে গেল পরের বাঁকে। আরেকটু হলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত গাড়ি। এদিকে ভুল করছে না আবেগহীন কমপিউটার, রানার গাড়ির সঙ্গে রোবটিক গাড়ির ব্যবধান থাকল মাত্র চার সেকেণ্ডের।

‘ডানে ত্রিশ ফুট দূরে বাঁক,’ জানিয়ে দিল ন্যাভিগেটর। হেরে যাচ্ছে নাকি! মনটাকে শান্ত রাখতে চাইছে রানা। মসৃণভাবে ঘুরিয়ে নিল স্টিয়ারিং হুইল। তীর বেগে ঘুরল বাঁক। পরক্ষণে রেস বাড়িয়ে গিয়ার ফেলেই ছুটল ক্ষিপ্র চিতার বেগে।

তবুও রোবটিক গাড়ির সঙ্গে কমে আসছে ব্যবধান।

রকেটের বেগে বিপজ্জনক বাঁকের দিকে চলেছে দুই গাড়ি। রানার কমলা-সাদা গাড়ির পেছনের উইং ছুঁই-ছুঁই করছে রোবটিক গাড়ির নাক। এখন আর উজ্জ্বল আলো পড়ছে না রানার চোখে। প্রথম সুযোগে ওকে পেরিয়ে যাবে রোবট। অথচ, কিছুই করার নেই ওর। বিড়বিড় করে বলল, ‘পেরোতে হলে আমার পাশ কাটিয়ে যেতে হবে তোকে।’

‘বামে সত্তর ফুট দূরে ওপরে উঠে বাঁক।

ঝড়ের বেগে আসছে বিপজ্জনক বাঁকা উত্তল পথ। এবার ব্রেক করতে হবে। ট্র্যাকের ভেতরে সরে গতি কমাল রানা

একই কাজ করল রোবটিক কার। তবে ওটার আগেই ব্রেক করেছে রানা। ওর গাড়ির পেছনে এসে ধুম করে বাড়ি খেল রোবটিক কার।

সামনে হোঁচট খেল রানা। পিছলে ট্র্যাক থেকে সরে যেতে শুরু করেছে গাড়ি। কিন্তু স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে নেয়ায় আবারও চাকা কামড়ে ধরল ট্র্যাক। নাক সোজা করেই সঠিক পথে ফিরল রানার গাড়ি।

গুঁতো মেরে পিছিয়ে গেছে রোবটিক গাড়ি। ছুটে এল নতুন উদ্যমে। তবে এবার তুমুল বেগে নয়। নাকে বাড়ি খেয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অ্যারোডাইন্যামিক শেপ। রানার মনে হলো বড় ক্ষতি হয়নি ওর নিজের গাড়ির।

মিসাইলের বেগে পিট ও ভিউয়িং স্ট্যাণ্ড পেরোল রানা। চট্ করে দেখেছে, প্ল্যাটফর্মে ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হুয়াং। বিড়বিড় করল ও, ‘মানুষ বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালাবে, তা ভুল কথা!’

.

প্ল্যাটফর্মে মুখে ফেনা তুলছে লো হুয়াং। ‘আমি আপনাকে পই- পই করে বলে দিয়েছি, রেসে হারলে চলবে না!’

টেলিমেট্রি মনিটর দেখছে সাবা সাবেলা। ‘আমার কিছু করার ছিল না। আপনি চেয়েছেন যেন সেফটি অফ করে দেয়া হয়। কাজটা বিপজ্জনক।’

‘মাসুদ রানাকে পাশ কাটিয়ে যান, সাবেলা।’

‘একটু আগে চেষ্টা করেছে রোবট। তবে আগের ল্যাপের চেয়েও জোরে ছুটছে মাসুদ রানা। যে-কোনও কিছু চট্ করে বুঝে ফেলে।’

‘তা হলে তাকে সাহায্য করা বন্ধ করুন,’ বলল লো হুয়াং।

‘কী করতে বলেন, স্যর?’

‘বন্ধ করে দিন ন্যাভিগেশন সিস্টেম।’

‘ওই অ্যানাউন্সমেন্টের জন্যে অপেক্ষা করবে, ফলে সোজা বিধ্বস্ত হবে দেয়ালে,’ জানাল সাবা সাবেলা।

‘সে বোঝাতে চাইছে ড্রাইভিঙে রোবটকে হারাতে পারে মানুষ। পারলে নিজে থেকে প্রমাণ করুক!

বড় করে দম নিল ইঞ্জিনিয়ার। ‘ওই লোক কিন্তু খুন হবে, স্যর। বাংলাদেশ আর আমেরিকান সরকার সন্দেহ করবে আপনাকে।’

‘সন্দেহ করলেই বা কী? দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই!’

আপত্তির সুরে তর্ক জুড়ল সাবেলা, ‘যেইন নিং কিন্তু বলেছেন বাঁচিয়ে রাখতে! তাকে বলির পাঁঠা বানাতে চান তিনি।’

প্রচণ্ড রেগে . ইঞ্জিনিয়ারের শার্টের কলার চেপে ধরল বিলিয়নেয়ার। ‘যা বলছি করুন! বন্ধ করুন ন্যাভিগেশন সিস্টেম!’

লো হুয়াং ছেড়ে দিতেই ট্র্যাক দেখল লোকটা। সরু পথে চতুর্থ বাঁকের দিকে চলেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড দেরি করল সাবা সাবেলা, তারপর সুইচ টিপে অফ করে দিল রিলে

রানা জানে, আবারও ওকে পেরোবার চেষ্টা করবে রোবট চালিত গাড়ি, কিন্তু সেক্ষেত্রে হতাশ হয়ে রেস বাদ দেবে না ও। জেদ চেপে গেছে, যেভাবে হোক হারাবে হুয়াংকে।

পরিচিত পাহাড়ি ট্র্যাকে প্রায় উড়ে চলেছে রানা— অধৈর্য এবং আগ্রাসী। তুমুল বেগে বিপজ্জনক বাঁক লক্ষ্য করে চলেছে ওর কমলা-সাদা টয়োটা গাড়ি।

‘বামে চল্লিশ ফু…’ বলতে শুরু করেও থেমে গেল ন্যাভিগেটর।

সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বাঁক নিল রানা। রাস্তার বাইরে খোয়া দিয়ে তৈরি স্ট্রিপে উঠল গাড়ির চাকা। ঝড়ের বেগে প্রায় ফুল স্পিডে পেরোল বাঁক। এখন ইঞ্জিনের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করছে রানা। রাতের আঁধারে লাল বাতি জ্বেলে সতর্ক করছে টেকোমিটার।

প্রচণ্ড বেগে পেছনে যাচ্ছে ট্র্যাকের কমলা ও সাদা স্ট্রিপ। নাগাসাকি উপসাগরে ঝিকমিক করছে অসংখ্য বাতি। রানার ঠিক পেছনেই রোবটিক কার। প্রতি মুহূর্তে কমিয়ে আনছে দূরত্ব।

নির্জন সেতু পেরিয়ে বিপজ্জনক পঞ্চম বাঁকের দিকে চলেছে রানা। ফুল স্পিডে কর্কশ আওয়াজ তুলছে ইঞ্জিন। আর গতি তুলতে পারবে না। হালকাভাবে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখেছে রানা, যে-কোনও সময়ে সতর্ক করবে ন্যাভিগেটর, আর তখনই অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা তুলে ব্রেক কষবে ও।

কিন্তু এক সেকেণ্ডের দশ ভাগের এক ভাগ পেরোতেই রানা টের পেল, সতর্ক করবে না কেউ। ওর চোখ পড়ল ট্র্যাকে আগের স্কিড করা দাগে। ওই একমুহূর্তেই কষল হিসাব। অনেক বেশি জোরে ছুটছে ওর গাড়ি। বাঁক খুব বেশি কাছে।

ব্রেক প্যাডেলে প্রায় দাঁড়িয়ে গেল রানা। গাড়িটাকে চরকির মত ঘুরে যাওয়া থেকে বাঁচাল অ্যান্টি লক সিস্টেম। পেছন ট্র্যাক ভরে উঠল রাবার পোড়া নীল ধোঁয়ায়। হার্নেস নিষ্ঠুরভাবে কামড়ে ধরল রানার কাঁধ। ব্রেক প্যাডেলে পা রেখে স্টিয়ারিং হুইল বনবন করে ঘোরাতে শুরু করে কাউকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিল ও।

গতি কমলেও আড়াআড়িভাবে ছেঁচড়ে চলেছে টয়োটা। চাকা থেকে টিয়ার-গ্যাসের মত বেরোচ্ছে গাঢ় ধোঁয়া। প্রচণ্ড বেগে দেয়াল লক্ষ্য করে পিছলে চলেছে গাড়ি।

উপায় না দেখে ব্রেক প্যাডেল ছেড়ে অ্যাক্সেলারেটরে চাপ দিল রানা। কর্কশ আওয়াজ তুলল ইঞ্জিন। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চাইছে রানা। ক’সেকেণ্ড পর খসখসে ট্র্যাক কামড়ে ধরল চার টায়ার। গতি এতই বেশি, ছিটকে ট্র্যাকের ভেতর দিকে চলে গেল গাড়ি। নেমে পড়েছে রাস্তা থেকে। আরেকটু হলে ছিঁড়ে নিত রোবটিক গাড়ির নাক। প্রচণ্ড বেগে রানার গাড়ি পেরিয়ে নীল ধোঁয়ায় হারিয়ে গেল ওটা।

কিন্তু ওই ধোঁয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল রোবট গাড়ির স্মোক সেন্সর। এদিকে অফ সেফটি মোড। নিজেও ব্রেক কষতে দেরি করেছে অটোমেটেড গাড়ি। ধোঁয়ার মেঘে ঢুকেই শুরু হলো স্কিড। সোজা গিয়ে বাইরের দেয়ালে গুঁতো দিল গাড়িটা। সংঘর্ষ হতেই ভেঙে ছিটকে উঠল ডানদিকের কার্বন ফাইবার। উপড়ে গেছে পেছনের উইং, ছুঁড়ে দেয়া কুঠারের মত পাক খেতে খেতে উড়ে গেল দেয়াল পেরিয়ে নাগাসাকি উপসাগরে। আহ্লাদী বেড়ালের মত দেয়ালে গা ঘষতে ঘষতে নুড়িপাথরের স্তূপে নাক গুঁজল রোবটিক গাড়ি।

ট্র্যাকের ভেতরের দিকে ঘাসের মাঠে থেমেছে রানার গাড়ি। কপাল ভাল ও আহত নয়। একেবারে শেষসময়ে দেখেছে বিধ্বস্ত হয়েছে অটোমেটেড গাড়ি। নাক গুঁজেছে নুড়িপাথরের স্তূপে। নষ্ট হয়েছে দুটো হেডলাইট। ট্র্যাকে আলো ফেলেছে অন্য দুটো।

রানার মনে হলো, রেসে ড্র করেছে ও। কিন্তু তখনই দেখল চরকির মত ঘুরছে রোবটিক গাড়ির চাকা। পিছিয়ে গেল গাড়িটা, নুড়িপাথর মাড়িয়ে উঠতে চাইছে ট্র্যাকে।

অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে বিড়বিড় করল রানা, ‘ও, তাই?’ প্রথমে উঠল না গতি, তবে সত্তর ফুট নালের মত ঘাসজমি পেরোতেই উঠে এল ট্র্যাকে। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নিয়েছে ও। চলেছে মাঠের মাঝ দিয়ে ট্র্যাকের অন্যদিকে। ওদিকেই ফিনিশ লাইন।

একবার রোবটিক গাড়ি দেখল রানা। নতুন করে গতি তুলেছে লো হুয়াঙের গাড়ি, তবে ওটা থেকে খসে পড়ছে নানান পার্ট। এখন একই গন্তব্যের দিকে চলেছে দুই গাড়ি উল্টো দিক থেকে। সংঘর্ষ অনিবার্য।

অ্যাক্সেলারেটর চেপে রাখল রানা। মাঠ পেরিয়ে কোনাকুনিভাবে চলেছে ফিনিশ লাইন লক্ষ্য করে।

তবে ওর গাড়ি ফিনিশ লাইন পেরোবার আধ সেকেণ্ড পর পৌছুল রোবট চালিত ভাঙাচোরা গাড়ি।

মৃদু হেসে ব্রেক কষে থামল রানা। ট্র্যাকের এক শ’ ফুট দূরে ওর চেয়ে অনেক ধীরে থামল রোবটিক কার।

হার্নেস খুলে গাড়ি থেকে বেরোল রানা। উন্মাদিনীর মত ছুটে আসছে হিনা। ধীরেসুস্থে হেলমেট আর ফায়ারপ্রুফ হুড খুলল ও। এদিকে প্রায় ধ্বংসস্তূপ প্রোটোটাইপ গাড়ির দিকে ছুট দিল লো হুয়াঙের ক’জন মেকানিক। কারও মুখে হাসি নেই। রেসে দ্বিতীয় হয়েছে তাদের গাড়ি।

‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ রানার কাছে জানতে চাইল হিনা।

‘আগে এত ভাল ছিলাম না,’ হাসল রানা। দরদর করে ঘামছে। গা থেকে আসছে পোড়া রাবারের গন্ধ।

‘এখনও ভাবতে পারছি না আপনি জিতে গেছেন,’ রানার হাত চেপে ধরল হিনা। ‘সত্যি, আপনি পাগল!’

‘হারতে পছন্দ করি না,’ বলল রানা। তর্জনী তুলল। ‘মানুষ পেল এক পয়েন্ট। রোবট? যিরো!’

ভিউয়িং প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে এল লো হুয়াং এবং তার ইঞ্জিনিয়ার। চেহারা গম্ভীর। ‘আপনি জিততে পারেননি,’ জোর দিয়ে বলল বিলিয়নেয়ার। ‘আপনি চিট করেছেন। ভেতর দিক দিয়ে এলে জেতার উপায় নেই।’

‘আপনি বলেছেন, ফিনিশ লাইনে পৌঁছুবে যে গাড়ি, জিতবে ওটা,’ বলল রানা। ‘আমার তো মনে পড়ছে না যে আর কোনও শর্ত দেয়া হয়েছিল!’

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রানাকে দেখল বিলিয়নেয়ার। ‘এ থেকে প্রমাণ করা যায় না যে মানুষই সেরা।’

‘আপনার সঙ্গে একমত নই,’ মৃদু হাসল রানা। ‘প্রমাণ হলো হারিয়ে দেয়া যায় রোবটকে। এ থেকে আরও একটা ব্যাপার বোঝা যায়, রোবটও হতে পারে বিপজ্জনক।’

গা জ্বলে গেলেও বুঝল লো হুয়াং, তর্কে জিততে পারবে না।

টুং শব্দ তুলল সাবা সাবেলার বাহুর মেডেল। স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে মেসেজ। কাঁধ ঝাঁকাল ইঞ্জিনিয়ার। ‘এখনই কেউ খেতে চাইলে ডিনার রেডি।’

কঠোর চোখে তাকে দেখল বিলিয়নেয়ার। সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে খাবারের রুচি। উদাস চেহারা করে দূরে তাকাল সাবেলা। খুশি হতো দূরে কোথাও যেতে পারলে। এবার যে- কোনও সময়ে হামলা হবে ভেবে কবজির ছোরার কাছে পৌছে গেল হিনার হাত।

অন্যরা গম্ভীর, তবে মৃদু হাসছে রানা। নরম সুরে বলল, ‘রেস জিতলে সবসময় দারুণ খিদে লাগে আমার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *