1 of 2

মহাপ্লাবন – ২

দুই

মহাচিনের শাংহাই শহর থেকে মাত্র নব্বুই মাইল পুব সাগরে ডুব দিলে যে-কেউ ভাববে, পেয়েছে সে সত্যিকারের নিমজ্জিত স্বর্গ। এ মুহূর্তে সে স্বর্গের দিকে নেমে চলেছে ধূসর ছোট একটা সাবমারসিবল। ওপর থেকে আসছে সূর্যের সবজেটে- সোনালি রোদ। সাগরের মেঝেতে বয়ে যাওয়া স্রোতে দুলছে বাদামি সামুদ্রিক-শৈবাল। ডুবোজাহাজ দেখে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য মাছ। দূরে নীল অসীমে হাঁ মেলেছে বিশাল ছায়া, ওটা প্রকাণ্ড হলেও নিরীহ ওয়েইল শার্ক বা তিমি হাঙর- চওড়া মুখ হাঁ করে প্রাণপণে পেটে পুরছে পানি ও খুদে সব প্ল্যাঙ্কটনের ঘোলাটে মেঘ।

সাবমারসিবলের নাকের কাছে কমাণ্ড চেয়ারে বসে আছেন ডক্টর উই হ্যানত্যান, মুগ্ধ হয়ে দেখছেন চারপাশের সাগর ও বিচিত্র সব প্রাণী।

পাশের চেয়ার থেকে জানাল নারীকণ্ঠ, ‘একটু পর পৌছুব সরীসৃপের চোয়ালে।’

তথ্যটা পেয়ে মৃদু মাথা দোলালেন ডক্টর হ্যানত্যান। চোখ রেখেছেন বাইরের দুনিয়ায়। আর দেখবেনই বা না কেন, আগামী পুরো একটা মাস প্রাকৃতিক আলো থেকে বঞ্চিত হবেন তিনি।

সমুদ্র-শৈবাল ভরা মেঝে পেছনে ফেলে সামনে পড়ল প্রবালের রঙিন মাঠ, ওপাশেই ভি আকৃতির ক্যানিয়ন। প্রথমে মনে হবে ওই ক্যানিয়ন বড়জোর সরু কোনও ফাটল। দেখতে অনেকটা খোলা মুখের মত।

ওটাই সরীসৃপের চোয়াল বা সার্পেন্ট’স জ’।

ভাসতে ভাসতে বা উড়তে উড়তে ক্যানিয়নের ওপরে পৌছুল সাবমারসিবল। নিচে সরাসরি অতলে নেমেছে সাগরের মেঝে।

‘নেমে যাও,’ নির্দেশ দিলেন ডক্টর হ্যানত্যান।

সাবমারসিবলের কন্ট্রোল নাড়ল মহিলা পাইলট। খুঁত নেই তার কাজে। দরকারি সব রসদ নিয়ে ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে নামতে লাগল খুদে ডুবোজাহাজ।

পাঁচ শ’ ফুট নামতেই হারিয়ে গেল সূর্যের আলো। নয় শ ফুট গভীরতায় আবারও আলো দেখলেন হ্যানত্যান। তবে এবারের আলো প্রাকৃতিক নয়, আসছে ক্যানিয়নের পাশের দেয়ালে গেঁথে রাখা স্থাপনা থেকে।

কিছু মডিউলের ওপর বসিয়ে দেয়া ছোটখাটো এক বাড়ি থেকে আসছে আলো। কেউ নেই লিভিং রুমের কাঁচের ওদিকে। জড়িয়ে পেঁচিয়ে ক্যানিয়নের মেঝে ভেদ করে নেমেছে সব মডিউল। ওখানে অসংখ্য পাইপ ও টিউব।

‘আশা করি ভুল হবে না ঠিকভাবে ডক করতে,’ বললেন ডক্টর হ্যানত্যান।

‘অবশ্যই, স্যর। অপেক্ষা করুন।’

প্রথমবারের মত পাইলটের দিকে তাকালেন ডক্টর। মহিলার চোখে নিষ্পলক, নির্বিকার দৃষ্টি। গায়ের ত্বক ও ঠোঁট লালচে। দেখতে ভাল, কিন্তু নির্মাতা তাকে দেয়নি মাথার চুল বা গায়ের রোম। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বুক-পেটের সব মেশিনারি।

ডক্টর হ্যানত্যান ভাল করেই জানেন, এ রোবটের প্রতিটা হাড় ও জোড়া তৈরি হয়েছে টাইটেনিয়াম দিয়ে। ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে ছোট ছোট হাইড্রলিক পাম্প, সার্ভো ও অসংখ্য তার। শেষেরগুলো কাজ করছে সাদা প্লাস্টিকের বুক, পেট ও ঊরুর প্যানেলের নিচে রক্তবাহী শিরার মত। নির্মাণকারীরা যতই ভাবুক তাদের রোবট মানুষের বিকল্প, দেখতে এখনও ওটা ম্যানিকিনের মতই। তারচেয়েও বড় কথা, পাইলটের শক্তিশালী কবজি ও আঙুল স্টিলের তৈরি। দরকারি কিছু ধরার জন্যে আঙুলের ডগায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে রাবারের খাপ।

ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ডক্টর হ্যানত্যান মনে মনে প্রশংসা করছেন এই রোবটটাকে। তবে সত্যিকারের মানব সৌন্দর্য নেই যান্ত্রিক মানবীর। ডক্টর ভাবলেন: কে জানে, কেন সুন্দর মুখ ও কোমল কণ্ঠ দিলেও মহিলা রোবটকে দৈহিক রূপ দেয়নি নির্মাতারা। আসলে শেষ হয়নি তাদের সব কাজ। মানুষ আর মেশিনের মাঝে আটকা পড়েছে রোবটিক সুন্দরী।

ডক কলারে মৃদু শব্দে সাবমারসিবল আটকে যেতেই ভিউ পোর্ট দিয়ে ওদিকে তাকালেন ডক্টর। রিনরিনে কণ্ঠে বলল রোবট: ‘কনফার্ম। সমস্যা নেই ডকিঙে। ঠিক জায়গায় রয়েছে সিল।’

দেরি না করে সিট ছেড়ে বোঁচকা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর, এগিয়ে গিয়ে খুলে ফেললেন সাবমারসিবলের ইনার ডোর। পাথরের মূর্তির মত বসে রইল রোবট, ঘুরেও দেখল না প্রফেসরকে। নির্বিকার, নিষ্পলক চোখ সরাসরি সামনে।

না, আধামানুষও হয়নি এই রোবট, ভাবলেন ডক্টর হ্যানত্যান। বাড়িতে ঢুকে দেখলেন ক্যাটারপিলারে ভর করে চলছে কিছু ধীর গতির মেশিন। বিড়বিড় করলেন তিনি, ‘সাবমারসিবলের পাইলটের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় এরা!’

ফোর্কলিফটের স্বয়ং নিয়োজিত প্যালেটের মত এসব মেশিন। সাবমারসিবল থেকে নেবে রসদ ও ইকুইপমেন্ট, পৌঁছে দেবে নির্দিষ্ট স্টোররুমে, এজন্যে কারও নির্দেশ লাগবে না।

একইসময়ে অন্য মেশিন সাবমারসিবলের পেটে তুলবে ‘ওর’। জিনিসটা আগে কখনও দেখেনি মানুষ। সাগরের বহু নিচ থেকে তোলা হচ্ছে এক ধরনের অ্যালয়। টাইটেনিয়ামের চেয়ে শক্ত, অথচ তিনগুণ হালকা। তা ছাড়া, আরও রয়েছে নানা উপযোগ, যেগুলো নেই পৃথিবীর অন্য অ্যালয় বা পলিমারে।

ডক্টর হ্যানত্যানের মত কম মানুষই জানেন এই অ্যালয়ের কথা। তাঁরা সংক্ষেপে নাম দিয়েছেন: সোনালি শিখা। ওটা পেতেই খনির কাছে তৈরি করা হয়েছে সাগরতলে এই স্থাপনা।

সব গোপন রাখতে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন বা রোবট। এ স্টেশনে একমাসের জন্যে থাকে একজন করে ইঞ্জিনিয়ার। তার অধীনে কাজ করে স্বয়ংক্রিয় চার শ’ মেশিন কৰ্মী।

এরা নানাধরনের। চিনা ডুবোজাহাজের পাইলটের মত দেখতে রোবট কম। একদলের নাম: জলকন্যা। হাত ও ক্যামেরাসহ চৌকো মাথা। পিঠে প্রপালশন প্যাক। মানুষের মতই এরা নানাদিকে যেতে পারে সাঁতার কেটে।

আরেকটি দল যেন সাধারণ রোভ। ঘুরে ঘুরে দেখে সাগরতল। এ ছাড়া, রয়েছে অন্যান্য রোবট, সেগুলো নির্মাণ এলাকায় ভারী মেশিন নতুন করে মেরামত করে। সাগরের বহু গভীরে খনন কাজে ব্যস্ত রয়েছে কিছু নতুন মডেলের রোবট। নিচের মডিউলের কাছে ছোট এক পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে ব্যাটারি রিচার্জ করে এরা। আগে ওই রিঅ্যাক্টর ছিল চাইনি অ্যাটাক সাবমেরিনের পেটে।

প্রথমবার সাগরতলের স্টেশন দেখে হতবাক হন ডক্টর হ্যানত্যান। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন চারপাশ। তারপর তাঁকে দেয়া হলো স্থাপনার ওপরের দিকে কাজ। ওখানে আছে বসবাস উপযোগী ঘর। তবে আজকাল আর প্রায় আসাই হয় না সাগরতলে।

হনহন করে হেঁটে অফিসে ঢুকলেন হ্যানত্যান। আগামী পুরো তিরিশটা দিন এটাই হবে তাঁর বাড়ি।

অধীর হয়ে ডেস্কের পেছনে বসে অপেক্ষা করছেন চাইনিয পিপল্স লিবারেশন নেভির কমাণ্ডার ফু মানচু। ডক্টরকে দেখে মেঝে থেকে তুলে নিলেন ডাফেল ব্যাগ।

‘আপনি আগেই তৈরি?’ হাসলেন ডক্টর হ্যানত্যান।

পুরো একমাস চুপ করে বসে থাকার পর আপনিও বাড়ি ফিরতে চাইবেন,’ বললেন ফু মানচু, ‘সঙ্গী বলতে তো শুধু এইসব মেশিন।

মৃদু হাসলেন হ্যানত্যান। ‘আমার কিন্তু ভালই লাগে। স্ত্রীর সঙ্গে তর্ক জুড়তে হবে না, আজ আমি ডিনার রাঁধব না।’

মাথা নাড়লেন মানচু। ভাবছেন, নির্বিকার চেহারার পলকহীন রোবটের চেয়ে ঝগড়াটে বউও ঢের ভাল।

‘আমাদের স্ট্যাটাস কী?’ কাজের কথায় এলেন ডক্টর হ্যানত্যান।

‘উত্তোলন কমে গেছে,’ বললেন কমাণ্ডার। ‘গত মাসের চেয়েও কম। আপনি তো জানেন, দু’মাস আগের চেয়েও কম ‘ওর’ পাওয়া গেছে গত মাসে।’

‘ফুরিয়ে আসছে খনি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হ্যানত্যান।

মাথা দোলালেন কমাণ্ডার মানচু। ‘জানি এই ধাতু কত দামি। আপনারা বলেছেন, কী হবে সোনালি শিখা পেলে। কিন্তু এমন কোনও উপায় পাওয়া যায়নি যে আরও তোলা যাবে। মন্ত্রণালয় থেকে কেউ না কেউ অভিযোগ তুলবে, খামোকা কোটি কোটি ডলার খরচ করছি আমরা।’

কথাটা মানতে পারলেন না ডক্টর হ্যানত্যান। টাকার অভাব নেই চিন মন্ত্রণালয়ের। তার ওপর, তাদের পাশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে রোবট নির্মাতা চাইনি বিলিয়নেয়ার লো হুয়াং লিটন। না, টাকা সমস্যা নয়। তবে কমপিউটার কন্সোলে চোখ যেতেই চমকে গেলেন। ভাবতে পারেননি এত কমে গেছে সোনালি শিখার উত্তোলন। ‘সারা মাসে এক শ’ কিলো? ব্যস?’

‘ফুরিয়ে গেছে শিরা,’ বললেন ‘কমাণ্ডার মানচু। ‘আমি নিজে চাই না বসদের এ কথা বলতে।’

খড়মড় করে উঠল ইন্টারকম। ওই কণ্ঠ মানবীয় এবং পুরুষের। ‘সিএল-ওয়ান রিপোর্ট দিচ্ছি। তৈরি ডিপ-বেসিন ইঞ্জেক্টর। চার্জ করা হয়েছে হার্মোনিক রিযোনেটরগুলো। ইমপ্যাক্ট রেঞ্জ, যেড মাইনাস ওয়ান হান্ড্রেড ফোর্টি।’

স্টেশনের অনেক নিচে পরবর্তী খননের জন্যে তৈরি একদল রোবট। আওয়াজ থেকে ডক্টর হ্যানত্যান বুঝলেন, ইঞ্জেক্টর তাক হয়েছে ফাটলের খুব গভীর অংশে। কমাণ্ডার মানচুর চোখে তাকালেন তিনি।

‘ভূগর্ভ ভেদ করা সোনার থেকে জানা গেছে, সরাসরি নিচে আছে সামান্য সোনালি শিখা,’ বললেন মানচু। ‘খনি চালু রাখতে হলে অত গভীরে না খুঁড়ে উপায় নেই। অথবা, বন্ধ করে দিতে হয় মাইনিং।’

অনিশ্চিত অনুভূতি হলো ডক্টর হ্যানত্যানের। অনেক গভীরে খনন করতে গেলে বহু গুণ বাড়বে বিপদের ঝুঁকি।

‘আমি নির্দেশ দেব?’ জানতে চাইলেন কমাণ্ডার মানচু। ‘না সম্মানটা আপনি নেবেন?’

হাত নাড়লেন হ্যানত্যান। ‘অর্ডারটা আপনিই দিন।’

ইন্টারকমের বাটন টিপে নির্দিষ্ট কমাণ্ড দিলেন মানচু। ‘কাজ শুরু করো। আগের নির্দেশ বাতিল হলো। যত দ্রুত সম্ভব তুলবে ওর। যেন পড়ে না থাকে এক ফোঁটা সোনালি শিখা। পরবর্তী নির্দেশ দেয়া পর্যন্ত চলবে কাজ।’

‘জী,’ জবাবে বলল সিএল-ওয়ান।

ক’সেকেণ্ড পর দূর থেকে এল গুনগুন শব্দ। খনিতে কাজ শুরু হলে সহ্য করতেই হয় স্টেশনের ভেতর এই আওয়াজ। তবে ডক্টর হ্যানত্যান জানেন, দু-এক দিনের ভেতর কানে সহ্য হয়ে যাবে শব্দটা। কাজ বলতে থাকবে না কিছুই। অবশ্য জরুরি মেশিন নষ্ট হলে তখন মেরামত করবেন, বুঝে নেবেন হালচাল, অথবা বদলে দেবেন ব্যাটারি।

‘স্টেশন আপনার দায়িত্বে থাকল, স্যর,’ বললেন কমাণ্ডার মানচু। ডক্টরের হাতে তুলে দিলেন ছোট একটা ট্যাবলেট কমপিউটার।

‘ওপরে ওঠার সময় উপভোগ করুন চমৎকার দৃশ্য, বললেন হ্যানত্যান, ‘আমি যখন নামলাম, রোদে ঝলমল করছিল চারপাশ।’

সূর্যের কথা ভেবে খুশিতে হেসে ফেললেন কমাণ্ডার মানচু। ডাফেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে চলে গেলেন দরজার কাছে। ওখান থেকে বললেন, ‘এক মাস পর আবারও দেখা হবে, স্যর।’

একাকী হয়ে গেলেন ডক্টর হ্যানত্যান। সময় কাটাবার মত কিছুর জন্যে তাকালেন চারপাশে। ডেস্কে পড়ে আছে অসংখ্য রিপোর্ট ও পেপারওঅর্ক। বিড়বিড় করলেন, ‘পারলে এবার বিলিয়নেয়ার হুয়াং এমন রোবট তৈরি করুন, যাতে চুকে যায় এসব ফালতু কাজ!’

হাতে দীর্ঘ সময়, আপাতত কাগজপত্র নিয়ে না বসলেও চলবে। ডেস্কে ট্যাবলেট কমপিউটার রেখে দেয়ালের পাশে রাখা অ্যাকুয়েরিয়ামের কাছে গেলেন তিনি। কাঁচের বাক্সে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েক রকমের গোল্ড ফিশ। ফ্যানটেইল, বাবল আই ও লায়নহেড। কমাণ্ডার মানচু বলেছেন, বিটা মাছ নাকি অন্য মাছের সঙ্গে বাঁচতে পারে না। তাই তাকের ওপর আরেকটা ছোট অ্যাকুয়েরিয়ামে রয়েছে ওই মাছটা।

কাঁচের এদিক থেকে বিটা ফিশের দিকে তাকালেন হ্যানত্যান। হন্তদন্ত হয়ে নানাদিকে যাচ্ছে ওটা। খনিতে খনন শুরু হতেই অস্থির হয়ে উঠেছে মাছগুলো। শান্ত করতে কৌটা থেকে নিয়ে গুঁড়ো খাবার পানিতে ছড়িয়ে দিলেন প্রফেসর। খাবারের গন্ধে ব্যস্ত হয়ে পানি সমতলে উঠে এল ওগুলো।

মৃদু হাসলেন ডক্টর। কী অদ্ভুত পৃথিবীর এ জীবন! সাগরতলে বাড়ির ভেতরে কাঁচের ঘরে বন্দি হয়েছে এসব মাছ। বাতাস খুন করবে তাদেরকে, আবার এত গভীর পানির ভেতরে বাতাস না পেলে তিনি নিজেই খুন হবেন। মাছ বা তাঁর কিছুই করার নেই। বড়জোর চেয়ে থাকা যেতে পারে কাঁচের জানালার ওদিকে। গতবারের মত সময় কাটলে আগামী মাসে তাঁর ওজন বাড়বে কমপক্ষে দশ পাউণ্ড। করার কিছুই নেই।

দুই অ্যাকুয়েরিয়ামে আরও খাবার ফেললেন ডক্টর। কিন্তু তখনই হঠাৎ থমকে গেল প্রতিটা মাছ। মনে হলো কাঁচের রঙিন পুতুল। আগে এমন হতে দেখেননি ডক্টর হ্যানত্যান।

অ্যাকুয়েরিয়ামের নিচের দিকে চলল প্রতিটি মাছ। নাড়ছে না পাখনা বা ফুলকা। যেন ড্রাগ দেয়া হয়েছে।

কাঁচের গায়ে টোকা দিলেন ডক্টর। তাতে চমকে গিয়ে নানাদিকে ছুটল মাছগুলো। কাঁচের দেয়ালে বাড়ি খেল ক’টা, যেন নেট দেয়া জানালায়

জানালায় ঢুকতে চাওয়া মৌমাছি। অ্যাকুয়েরিয়ামের নিচে নুড়িপাথর খুঁড়তে লাগল একটা বাবল আই মাছ।

বিস্মিত হয়ে তাকালেন ডক্টর হ্যানত্যান। থরথর করে নড়ছে অ্যাকুয়েরিয়ামের পানি। কাঁপতে শুরু করেছে ঘরের চারপাশের দেয়াল। ভয় পেয়ে ক’ পা পিছিয়ে গেলেন প্রফেসর। আরও বাড়ছে খনি খননের আওয়াজ। কিন্তু এত শব্দ হওয়ার কথা নয়! লাফ দিচ্ছে তাকে রাখা বই ও সাজিয়ে রাখা প্রবালের টুকরো। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে ভাঙল দুই অ্যাকুয়েরিয়াম।

ইন্টারকমের বাটন টিপলেন ডক্টর হ্যানত্যান। কড়া গলায় ডাকলেন খননের দায়িত্বে থাকা রোবটকে। ‘সিএল-ওয়ান! দেরি না করে এখনই কাজ বন্ধ করো!’

জবাবে শান্ত কণ্ঠে বলল ওটা, ‘দিন অথোরাইযেশন।’

‘আমি ডক্টর হ্যানত্যান।’

‘কমাণ্ড কোড?’ বলল রোবট। ‘নতুন কাজ দিতে হলে চাই অথোরাইযেশন।’

ডক্টরের মনে পড়ল, এতদিন কমাণ্ডারের কণ্ঠ শুনেছে সিএল-ওয়ান। এখন কর্তৃত্ব ফলাতে হলে চালু করতে হবে কমপিউটার, তারপর মানচুর কণ্ঠ মুছে সেখানে রেকর্ড করতে হবে নিজের কণ্ঠ।

ব্যস্ত হাতে ট্যাবলেট কমপিউটারের স্ক্রিনে টোকা দিলেন তিনি। টাইপ করতে লাগলেন কমাণ্ড ফাইলে। কিন্তু তখনই শুনলেন, নিচ থেকে এল প্রকাণ্ড সব পাথরের ঠোকাঠুকির ভারী গুড়গুড় আওয়াজ। যেন তুমুল বেগে উঠে আসছে বিকট শব্দের জেট বিমান। আরও বাড়ছে আওয়াজ। থরথর করে কাঁপছে স্টেশন।

মেঝে লাফ দিতেই পা পিছলে পড়লেন হ্যানত্যান। তাঁর মনে হলো ঘনিয়ে এসেছে মহাপ্রলয়। ধাতুর সিল ফাটিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল প্রবল জলরাশি। ফায়ার হোসের ছুঁড়ে দেয়া পানির বহু গুণ জোরে এসে প্রফেসরকে তুলে দেয়ালে আছড়ে ফেলল প্লাবন। দ্রুতগতি গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত মানুষের মত করুণ হাল হলো ডক্টরের দেহের। ক’সেকেণ্ডে ভরে উঠল প্রতিটি মডিউল। পানির নিচে শ্বাস আটকে মরতে হয়নি, প্রচণ্ড এক আঘাতে মুহূর্তেই মারা গেছেন ভদ্রলোক।

এদিকে খনি অফিসের বাইরে স্টেশন থেকে সরে গেছে সাবমারসিবল। তখনই শুরু হয়েছে কম্পন। ডুবোজাহাজের পুরু দেয়াল ভেদ করেও প্রচণ্ড আওয়াজ শুনছেন কমাণ্ডার মানচু। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় সামনের জানালা দিয়ে দেখলেন, ওপর থেকে নামছে বিশাল এক পাথরের চাঁই! একইসময়ে সাগরতল থেকে বিস্ফোরণের মত ছিটকে উঠল কাদা, বালি ও পাথর।

‘যাও!’ পাইলটকে নির্দেশ দিলেন কমাণ্ডার। ‘সরে যাও এখান থেকে!’

জড়তাহীন যান্ত্রিক দক্ষতায় কাজ শুরু করল পাইলট, তাতে নেই কোনও ব্যস্ততা।

ওপর থেকে পড়া অ্যাভালাঞ্চ হুড়মুড় করে নামল স্টেশনের ছাতে। পুরো স্থাপনা উপড়ে নিয়ে চলল সাগরতল লক্ষ্য করে। সাবমারসিবলের ওপর তুমুল বৃষ্টির মত ঝরছে নানান জঞ্জাল।

এই বোকা রোবট বুঝবেও না এটা কতবড় বিপদ, ঝুঁকে সাবমারসিবলের থ্রটলে হাত দিলেন কমাণ্ডার মানচু। পুরো সামনে ঠেলতে চাইলেন স্টিক, কিন্তু ওটা শক্ত হাতে ধরে রেখেছে মহিলা রোবট।

‘দায়িত্ব ছাড়ো আমার কাছে!’ ধমক দিলেন মানচু।

থ্রটল থেকে হাত সরিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে সিটে বসে রইল রোবট। পুরো সামনে থ্রটল ঠেলে ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কের ভাল্ভ্ খুললেন মানচু। পূর্ণ গতি তুলে উঠছে ডুবোজাহাজ।

‘ওঠ! ওঠ!’ বিড়বিড় করছেন মানচু।

এগোতে এগোতে উঠছে সাবমারসিবল। শিলাবৃষ্টির মত পাথরের ঘন এক পর্দা এসে লাগল ওটার গায়ে। ছোটগুলো মুঠোর সমান হলেও বড়গুলো তুবড়ে দিচ্ছে ছাত। ক্ষতিগ্রস্ত হলো প্রপেলার হাউসিং।

ডুবোজাহাজটাকে বিপদ থেকে সরাতে চাইছেন মানচু। কিন্তু বেঁকে গেছে প্রপেলার হাউসিং, সরাসরি পথে চলল না সাবমারসিবল। গতি বাড়লেও ঘুরে গিয়ে ঢুকল বিপজ্জনক এলাকায়।

‘না!’ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন কমাণ্ডার মানচু।

দ্বিতীয় পাথর-বৃষ্টি সরাসরি লাগল সাবমেরিনের নাকে- মুখে। ঠাস্ করে ফাটল ক্যানোপি। গাড়ির সমান বড় এক পাথরের আঘাতে চ্যাপ্টা হলো ডুবোজাহাজের পেট। বালি, মাটি ও ভারী পাথরের জঞ্জালের ওজনে সোজা সরীসৃপের চোয়ালের গভীর মেঝেতে আছড়ে পড়ল সাবমারসিবল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *