1 of 2

মহাপ্লাবন – ৩৪

চৌত্রিশ

গাড়ি হোয়াইট হাউসের ড্রাইভওয়েতে ঢুকতেই আরও গম্ভীর হলেন নুমা চিফ অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন। পাশের সিটে বসা তাঁর সহকারী কমোডর জোসেফ কার্কের গলা শুকিয়ে গেছে। তলব করেছেন নতুন প্রেসিডেন্ট। অত্যন্ত রাগী মানুষ। নিজের আছে হাজার দোষ-ত্রুটি, সেসবের ভেতর মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারির কথা বিশ্বের সবারই জানা, অথচ অন্যের বেলায় পান থেকে চুন খসলে হয়ে ওঠেন খড়্গ হস্ত। অল্পদিনেই সবাই বুঝে গেছেন, এই প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। তাঁর ধারণা: সুযোগ বুঝে যে-কোনও দুর্বল দেশে হামলা করে বা করিয়ে, একবার যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেই লাখে লাখে অস্ত্র বিক্রি করে আবারও ধনী হয়ে উঠবে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেই তাঁকে এখনও রাখা হয়েছে হোয়াইট হাউসে।

রিসেপশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন ও কমোডর কার্ককে। একটু পর তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ওভাল অফিসে।

বিশাল ডেস্কের ওদিকে বসে আছেন প্রেসিে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস বাগিয়ে দেখছেন ছোট এক অ্যান্টিক কাগজ। হ্যামিলটন ও কার্ক ঘরে ঢুকতেই ওটা পাশে রেখে হাতের ইশারায় দেখালেন সামনের সিট। তাঁরা বসতেই বললেন, ‘আপনাদের নুমার অনেক সুনাম শুনেছি। তাই জানতে চাইছি, হঠাৎ কেন এশিয়ায় গণ্ডগোল করছে আপনাদের লোক?’

‘আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না, মিস্টার প্রেসিডেন্ট,’ বললেন হ্যামিলটন।

‘স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে জানানো হয়েছে, জাপানে তুলকালাম কাণ্ড করছে আপনাদের স্পেশাল প্রোজেক্ট টিম। তারা আবার আমেরিকানও নয়। বাংলাদেশি। তা হলে কি ধরে নেব, নুমার নাম ভাঙিয়ে যা খুশি করছে তারা? স্থানীয় গ্যাংস্টার থেকে শুরু করে সরকার বিরোধীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার বছরের পুরনো এক কাঠের জাপানি দুর্গ। শুধু তাই নয়, চিন থেকে খবর এসেছে, তাদের দু’জনকে ধরতে গোটা শাংহাই শহরে জাল পেতেছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। গুপ্তচরের মত তাদের দেশে ঢুকেছে ওই দুই বাঙালি নুমা এজেন্ট।’

হ্যামিলটন জানতেন আগে হোক বা পরে, এ বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসতে হবে তাঁকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, সাগর বিষয়ক সমস্যা নিয়ে কাজ করছে ওরা। এবং আমার ধারণা, যে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছে গোটা পৃথিবীর ওপর, সেটার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে চিনের।’

‘চিনের সার্বভৌম ক্ষমতা অস্বীকার করে তাদের এলাকায় ঢুকেছে ওরা।’

‘জরুরি তথ্য পাওয়ার জন্যে আমিই বলেছি, দরকারে যে- কোনও দেশে যেতে পারো,’ বললেন অ্যাডমিরাল, ‘সেজন্যে যে-কোনও দায় মাথা পেতে নেব আমি।’

ভুরু কুঁচকে অ্যাডমিরালকে দেখলেন প্রেসিডেন্ট। ‘আশা করি আপনারা জানেন, চিন ও আমাদের বর্তমান সম্পর্ক। এ-ও অজানা নয়, জাপান আর আমাদের বন্ধুত্ব কতটা নাজুক। চিন ক’বছর ধরেই চেষ্টা করছে জাপান ও এশিয়ার অন্যান্য দেশকে নিয়ে ব্যবসায়িক ও সামরিক গোষ্ঠী গড়তে। কিছু দিন আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপরাধ বিচারে স্বাক্ষর করেছে জাপান ও চিন। এর পর পরই প্রথমবারের মত সাগরে যৌথ সামরিক মহড়া করেছে দুই নেভি। পারস্পরিক ব্যবসায়িক চুক্তি হচ্ছে আগামীকাল। এদিকে জাপানের পার্লামেন্টে প্রস্তাব উঠছে: অনুচিত হচ্ছে আমেরিকার সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি টিকিয়ে রাখা।’

‘কিন্তু এসবের সঙ্গে নুমার…’

হাত তুলে অ্যাডমিরালকে থামিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট। ‘চিন সরকার এখন নুমা বা আমেরিকান সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দিলে, সেটা হবে আগুনে তেল ঢেলে দেয়ার মত। গত বাহাত্তর ঘণ্টায় প্রাচীন দুর্গ পুড়িয়ে দেয়ার ছবি বহুবার এসেছে জাপানি প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায়।’

তিনি থামার পর বললেন অ্যাডমিরাল, ‘তাতে আমাদের কিছু করার ছিল না, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আমাদের লোক পুড়িয়ে দেয়নি ওই দুর্গ। সত্যি হচ্ছে, ওই দুর্গের বাসিন্দা আর আমাদের টিমের সবাইকে খুন করতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় ওখানে। আমাদের ধারণা, ওই হত্যার পরোয়ানা এসেছে চিন থেকে।’

‘তাই?’

‘জী। এবং শাংহাই-এ না গিয়ে উপায় ছিল না আমাদের টিমের। আমরা রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে নয়, ভাবছি পৃথিবী রক্ষার বিষয় নিয়ে। আপনি হয়তো জানেন, সাগরের পানি হুড়মুড় করে উঠে আসছে সাগরের পারের প্রতিটি দেশে। তা ঠেকাতে না পারলে ভবিষ্যতে কোনও রকম রাজনীতিই থাকবে না পৃথিবীতে।’

বাতাসে হাতের ঝাপটা দিলেন প্রেসিডেন্ট। ‘সাগরের কথা বাদ দিন। আমার তো মনে হচ্ছে আপনারা স্রেফ পাগল হয়ে গেছেন।

‘হয়তো আপনার কথাই ঠিক, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, অপমানে লাল হয়েছে অ্যাডমিরালের নাক। ‘তবে আমার ধারণা, পৃথিবী জুড়ে আসছে ভয়ঙ্কর মহাপ্লাবন। কাজেই পাগল হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে সুস্থ মস্তিষ্কের যে-কোনও লোকের। ভাল হয় একটু আগে পাওয়া ভিডিয়ো ফুটেজ আপনি নিজে একবার দেখলে।’

কিছুক্ষণ অ্যাডমিরালের চোখে চোখ রেখে তারপর বললেন প্রেসিডেন্ট, ‘ঠিক আছে, দেখছি। একটা রিমোট কন্ট্রোল তুলে দূরের দেয়ালে তাক করলেন তিনি। বাটন টিপতেই সরে গেল কাঠের প্যানেল। ওখানে দেখা দিল হাই-ডেফিনিশন মনিটর।

চালু হয়েছে ভিডিয়ো। দেখা গেল সাগরতলের দৃশ্য। একপাশে নানান ধরনের ইন্সট্রুমেন্টাল রিডিং।

‘ওটা সাধারণ রোভের ইন্টারফেস, প্রথমবারের মত মুখ খুললেন জোসেফ কার্ক।

মাঝে মাঝে ঝাঁকি খাচ্ছে ভিডিয়ো। তিন সেকেণ্ডের জন্যে দেখা গেল ঘুরপাক খাওয়া কাদামাটি ও পানি। পরের দৃশ্যে এল সোনার ইমেজ। মনে হলো সাগরতলে রয়েছে কোন্ আইসক্রিম আকৃতির পাহাড়ি ঢিবি। ওটার চূড়া থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে গরম পানি। একটু পর দেখা গেল সাগরতলে কীসের যেন ধ্বংসস্তূপ। জঞ্জালের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা রোবটিক হাত ও মুখ।

‘এসব কোথায় পেলেন?’ বেয়াড়া সুরে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট ডাম্প।

‘একটু আগে প্রচার করা হয়েছে ইণ্ডি নিউয নেটওঅর্ক থেকে,’ বললেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। এজন্যে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি কেউ। পরে বলা হলো, হ্যাক করা হয়েছে তাদের স্যাটেলাইট। কিন্তু ট্র্যান্সমিশনের সময় দেয়া হয়েছে কিছু সংখ্যা। ওগুলো আসিফ রেজা এবং তানিয়া রেজার নুমা আইডি কোড।’

‘যে দু’জন গোপনে গেছে শাংহাই শহরে,’ বললেন প্রেসিডেন্ট।

‘জী।’

‘আপনি জানতেন ওরা ধরা পড়তে পারে। তখন উপায় থাকবে না ওদেরকে ফিরিয়ে আনার।’

‘কাজটার গুরুত্ব বুঝেই ঝুঁকি নিয়েছে ওরা,’ বললেন হ্যামিলটন, ‘এবার চেষ্টা করতে হবে বের করে আনার।’

‘তা সম্ভব নয়,’ প্রস্তাবটা নাকচ করলেন প্রেসিডেন্ট। ‘আমরা এমন কী এটাও স্বীকার করব না যে তারা এ দেশ থেকে কোথাও গেছে।’

‘ওরা ধরা পড়লে অস্বীকার করে লাভ হবে না,’ বললেন জোসেফ কার্ক।

অ্যাডমিরালের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট, চেহারায় রাগ। ‘আপনারা বাজে ঝামেলায় ফেলেছেন আমেরিকাকে।’

‘সেজন্যে আমরা দুঃখিত,’ বললেন হ্যামিলটন। ‘তবে আরও বাজে হবে ওরা চাইনিযদের হাতে ধরা পড়লে।’

‘ওদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে, সেটা হবে আগুনে ঘি ঢালার মত,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘তার চেয়ে চুপ করে বসে থাকা ভাল। দেখা যাক কী হয়। যদি চাইনিযরা ধরে নেয় বিষয়টা পাত্তা দিচ্ছি না আমরা, হয়তো অতটা গুরুত্ব দেবে না।’

‘সেক্ষেত্রে গোপনে কবর দেবে আসিফ ও তানিয়াকে,’ নরম সুরে বললেন হ্যামিলটন।

‘আপনার কথা অনুযায়ী, চিনে যাওয়ার ঝুঁকি ওরা জেনে বুঝেই নিয়েছে,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। বন্ধ করলেন ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টিভির প্যানেল। ‘ওদেরকে ওই দেশ থেকে বের করতে গিয়ে জটিলতা বাড়াবেন না। আমার আর কিছু বলার নেই।’

চেয়ার ছাড়লেন অ্যাডমিরাল ও কমোডর।

‘ভাল থাকুন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওভাল অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন জর্জ হ্যামিলটন।

তাঁর পিছু নিলেন কার্ক। রিসেপশন এরিয়ার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, ‘স্যর, বিপদ আছে জেনেও ওদেরকে ওই দেশে যেতে উৎসাহিত করেছি আমরা।’

মাথা দোলালেন অ্যাডমিরাল। ‘দেখেছি ওদের ডেটা। সত্যিই উঠে আসছে সাগর। প্রেসিডেন্টও তা বুঝবেন। কিন্তু কিছু করবেন না। রাজনৈতিকভাবে তাঁর হাত-পা বাঁধা। তবে অর্ধেক ফ্লোরিডা তলিয়ে গেলে হাউমাউ করে উঠবে সবাই।’

‘স্যর, আমরা চুপ করে থাকলে, সেটা হবে মানব সভ্যতার সঙ্গে বেঈমানি।’

মৃদু মাথা দোলালেন হ্যামিলটন। ‘আসিফ ও তানিয়া আরও ডেটা পাঠালে হয়তো টনক নড়বে হোয়াইট হাউসের। তবে সেজন্যে বসে থাকব না আমরা। জানতে হবে চিনের কারণে ঘটছে কি না এই বিপর্যয়। কিছু করার জন্যে হাতে বেশি সময়ও পাব না আমরা।’

‘আমরা কি গোপনে কোনও সাবমেরিন পাঠাতে পারি, স্যর?’ জানতে চাইলেন কার্ক। ‘নেভিতে অনেকেই আপনার ভক্ত। হয়তো অনুরোধ করলে…

মাথা নাড়লেন হ্যামিলটন। ‘উপায় নেই। আসিফ ও তানিয়া ওখানে যাওয়ার পর আরও কড়া পাহারা দিচ্ছে চাইনি নেভি। আমাদের সাবমেরিন ওদের পানিতে ধরা পড়লে ধরে নেয়া হবে, সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আমেরিকা। ফলাফল ভয়ঙ্কর।’

ফয়েতে বেরিয়ে এলেন হ্যামিলটন ও কার্ক। নিচু গলায় বললেন অ্যাডমিরাল, ‘তবে একটা কথা পরিষ্কার, যা-ই ঘটুক, আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করব আসিফ-তানিয়াকে চিন থেকে বের করে আনতে।’

মাথা দোলালেন কার্ক। ‘জী, স্যর, তাই উচিত, নইলে ছোট হব নিজেদের বিবেকের কাছে।’

‘পরিস্থিতি আরও জটিল না করে গোপনে করতে হবে কাজটা।’ গাড়ির দিকে পা বাড়ালেন অ্যাডমিরাল। ‘এসো।’

গম্ভীর চেহারায় গাড়িতে উঠলেন দু’জন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *