1 of 2

মহাপ্লাবন – ২৩

তেইশ

বিলাসবহুল সুইটের জানালার পুরু কাঁচ ভেদ করে নিচের এরিনায় চোখ রেখেছে লো হুয়াং লিটন। লাঠি হাতে ভালই লড়ছে সোহেল আহমেদ। নিচ থেকে আসছে উত্তেজিত দর্শকদের চাপা গর্জন। টেবিল থেকে অপেরা গ্লাস তুলে চোখে লাগাল রিলিয়নেয়ার। কোথাও নেই বিশৃঙ্খলা। বোধহয় বাঙালিটাকে উদ্ধার করতে আসবে না কেউ।

‘সন্দেহ হয় কাউকে?’ জানতে চাইল নাগিনো

‘এখনও না,’ বলল লো হুয়াং।

‘তা হলে আপনার কথামত তাদেরকে খুঁজে বের করা যাচ্ছে না,’ তৃপ্তির সঙ্গে বলল গোখারো নাগিনো।

অপেরা গ্লাস রেখে পায়চারি শুরু করল বিলিয়নেয়ার। বাঙালিটা এখানে এসেছে বলে দমকা হাওয়ায় ফুৎ করে নিভে গেছে তার সাহসের কুপি। বলা হয়েছিল, খুন হয়েছে দুর্গের সবাই, অথবা হাসপাতালে মারাত্মকভাবে আহত। কিন্তু একেবারে ঘাড়ে এসে পড়েছে এই লোক। এজন্যে এখন মনে হচ্ছে, মস্তবড় বিপদে আছে সে।

এ বিষয়ে কী জানে খুলে বলল নাগিনোকে। তারপর বলল, ‘দারোয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী, আপনি খুঁজবেন মাসুদ রানা নামের এক লোককে। পরনে সাদা ডিনার জ্যাকেট। তার বন্ধু এরিনার এই লোক। এদের সম্পর্কে যা জেনেছি, বন্ধুকে বিপদে ফেলে ভেগে যাবে না এরা।

বাঁদরের মত ভেঙচি কাটল নাগিনো। ‘বাদ দিন। প্রাণের ভয় এমনই জিনিস, বিপদের সময় মনের জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যায় সব সাহস। মাসুদ রানা ভালই জানে, ধরা পড়লে মরবে। তাই চেষ্টা করছে ক্লাব ছেড়ে পালিয়ে যেতে।’

‘আপনার লোক নিশ্চয়ই ঠেকাবে,’ বলল লো হুয়াং।

‘অবশ্যই,’ বলল নাগিনো। ‘ভরসা রাখুন আমার ওপর। আর উপায় নেই এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার।’

মাথা দোলাল লো হুয়াং। ‘আমি তা হলে বিদায় নেব। পরে কী হয় আমাকে জানাবেন।’

‘আপনি এখনই চলে যাচ্ছেন?’

বিলিয়নেয়ার বুঝতে পারছে, কাজটা কাপুরুষের মত হয়ে যাচ্ছে, তবে ঝামেলা থেকে দূরে থাকাই ভাল। এসবের সঙ্গে সে জড়িত তা প্রকাশ পেলে সর্বনাশ হবে। কেঁচে যাবে পুরো প্ল্যান। সেক্ষেত্রে নিজেদের আড়াল করতে তাকে অকাতরে বলি দেবে চিনের পলিটিকাল নেতারা। ‘রয়ে গেলে আপনার কী লাভ? আপনি নিজেই তো বলেছেন: ওদের উপায় নেই এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার।’

নিজের প্যাচে পড়ে বিরক্ত বোধ করল নাগিনো। ‘কোনও গোলমাল হলে যোগাযোগ করব আপনার সঙ্গে, সেটা মাথায় রাখবেন,’ হুমকির সুরে বলল সে।

‘আপনি আপনার নিজের অবস্থান ভুলে গেছেন,’ বলল লো হুয়াং। ‘ইয়াকুযা সিণ্ডিকেটে আপনার চেয়ে অনেক ওপরের নেতাদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা। বছরের পর বছর তাদেরকে নানানভাবে সাহায্য করেছি।’ অনুমতি না নিয়েই দরজার নবে হাত রাখল সে। ‘সোহেল আহমেদের সঙ্গে অন্য কেউ থাকলে সে বা তাদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবেন। তা যদি না পারেন, অন্তত গায়েব করে দেবেন ওই বাঙালিটাকে।’

রাগে লাল হয়েছে গোখারো নাগিনো, তবে বাধা না দিয়ে চাপা স্বরে বলল, ‘সঙ্গে করে নিয়ে যান পাগলটাকে। আর কখনও এখানে তাকে আনবেন না।’

দরজা খুলে ওরেকে ইশারা করল বিলিয়নেয়ার। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তারা দু’জন।

এবার কী করবে ভাবছে বিচলিত নাগিনো। অপেরা গ্লাস তুলে এরিনার চারপাশে চোখ বোলাল। হাজারখানেক লোকের ভেতর এমন কেউ নেই, যাকে সন্দেহ করবে। দুরবিন নামিয়ে খালি গ্লাসের দিকে তাকাল সে। তখনই সুইটে ঢুকল এক ওয়েট্রেস।

‘স্কচ, ক্লান্ত সুরে বলল নাগিনো। পুরু গদিওয়ালা আরামদায়ক চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে।

নতুন গ্লাসে ড্রিঙ্ক দিল মেয়েটা।

তার দিকে না চেয়েই গ্লাস তুলে ঢকঢক করে গলায় স্কচ ঢালল নাগিনো। গলা ও বুক পুড়িয়ে পেটে গেল কড়া মদ। একটু শান্ত হলো ইয়াকুয়া নেতার মন। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে নতুন করে দেখল লড়াই। প্রথম রাউণ্ডের মতই দ্বিতীয় রাউণ্ড। মাস্তুলের মত উঁচু দানবটা হামলা করছে, আর নানাদিকে সরে বাঁচতে চাইছে বাঙালিটা। আনমনে বলল নাগিনো, ‘লো হুয়াং ঠিকই বলেছে। ব্যাটা ভাবছে কেউ এসে উদ্ধার করবে ওকে।’

‘তা হলে উচিত হবে না ওকে হতাশ করা,’ নাগিনোর পেছন থেকে বলল কেউ।

রিভলভিং চেয়ারে ঘুরে গেল ইয়াকুয়া নেতা।

দাঁড়িয়ে আছে বাদামি ত্বকের যুবক। পরনে সাদা ডিনার জ্যাকেট। একেই খুঁজছে তারা! মৃদু হাসছে সে, হাতে অস্ত্র নেই।

‘ও, তা হলে তুমিই মাসুদ রানা।’

‘তাতে কোনও ভুল নেই,’ একটা সিটে বসে পড়ল রানা।

‘এখানে ঢুকলে কী করে?’

‘সহজেই,’ হাসিটা অমলিন রানার। ‘তোমার বেশিরভাগ লোক গেছে আমাকে খুঁজতে, তাই করিডোর ফাঁকা। তোমার গার্ডটাকে অজ্ঞান করে চলে এলাম দেখা করতে।’

‘নিরাপত্তার জন্যে গার্ড লাগে না আমার,’ ডেস্কের মাঝের ফাঁকা অংশ থেকে নাকবোঁচা রিভলভার নিয়ে রানার নাকে তাক করল নাগিনো।

অলসভাবে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলল রানা। চোখে ভয় নেই। মুখে হাসি। কিন্তু হেরে যাওয়া লোকের মুখে এমন হাসি থাকে না। ‘আমি হলে ভুলেও ট্রিগারে চাপ দিতাম না।’

‘জানি, গুলি করলেই বেশি খুশি হতে,’ বলল নাগিনো। ‘কিন্তু মরবে তোমরা টোকিও উপসাগরের নিচে ডুবে।’

‘তার আগে আমার কথা শুনে নাও,’ বলল রানা। ‘যে- কোনও সময়ে অস্থির হবে তোমার হৃৎপিণ্ড। সব ধমনী ফেটে দরদর করে বেরোবে রক্ত। এমন কী রোমকূপ থেকেও।’

‘কী বলতে চাও?’

‘তুমিও বাঁচবে না,’ গম্ভীর হলো রানা, ‘ভাবতে পারো, আমরা দু’জন লাইলি-মজনুর মত, বাঁচলে বাঁচব একসঙ্গে, নইলে কেউই নয়। মরতে চাও না বাঁচতে, ঠিক করতে হবে তোমাকেই।’

‘মিথ্যা বলে বোকা বানাতে চাও?’ কড়া চোখে ওকে দেখল নাগিনো। ‘ইয়াকুয়া জয়েণ্টে এসব চলে না।’

পকেট থেকে খালি প্লাস্টিকের ভায়াল নিয়ে আস্তে করে লোকটার দিকে ছুঁড়ল রানা। বামহাতে ওটা ক্যাচ ধরল নাগিনো। আঠার মত কিছু লেগে আছে ভায়ালের গায়ে।

‘ভেতরে ছিল হেপারিন,’ বলল রানা, ‘শক্তিশালী রক্ত তরলকারী ওষুধ। ইঁদুরের বিষের মত বলতে পারো। মদের সঙ্গে গিলে ফেলেছ ফেটাল ডোয। নিচে এরিনায় তোমার যে লোকটা লড়ছে, তার তিন গুণ আকারের দৈত্যও খতম হবে। অ্যালকোহলের কারণে ড্রাগসের স্বাদ বোঝোনি। কিন্তু জিভে তো তিতা ভাব টের পাওয়ার কথা।’

জিভ দিয়ে দাঁত স্পর্শ করল নাগিনো। বাজে একটা গন্ধ পেল। ভাল করেই জানে, কী কাজ করে ইঁদুরের বিষ। আগে ব্যবহার করেছে শত্রুর ওপর।

‘গরম লেগে ওঠার কথা,’ বলল রানা। ‘লাফাতে শুরু করবে তোমার হৃৎপিণ্ড। এখনও শুরু হয়নি?’

গরম হয়ে উঠছে মুখের ত্বক, বুঝল নাগিনো। আগের চেয়ে জোরে চলছে হৃৎপিণ্ড। ঘামছে ভুরু। কড়া সুরে বলল সে, ‘জান নিয়ে এখান থেকে বেরোতে পারবে না।’

এক ভুরু উঁচু করল রানা। ‘তুমি নিজে আমাকে বাইরে দিয়ে এলে ঠেকাবে না কেউ। কাজটা করতে চাও কি না, সেটা তোমার ব্যাপার। ক্লাব থেকে বেরিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মত হ্যাণ্ডশেক করব। তখনই হাতের তালুতে পাবে অ্যান্টিডোট।’

‘অথবা, গুলি করে মারব তোমাকে, তারপর সার্চ করে ‘নেব ওষুধ,’ রিভলভারের হ্যামার তুলল নাগিনো।

‘তুলনাহীন বুদ্ধি,’ বলল রানা। হাতের তালু খুলল ও। ওখানে কয়েক রঙের পাঁচটা নানান আকার ও আকৃতির বড়ি। ‘এগুলোর ভেতর একটা অ্যান্টিডোট। কিন্তু ভুল হলে অন্য বিষের কারণে আরও তাড়াতাড়ি মরবে।’

চোখ সরু করল গোখারো নাগিনো। বুঝতে পারছে না, কেন তার ওপর আজ এত খাপ্পা স্রষ্টা! ইয়াকুয়াদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটির মাঝে আটকা পড়েছে মাসুদ রানা। অন্তত পঞ্চাশজন সশস্ত্র লোক খুঁজছে তাকে। অথচ ক্লাব ম্যানেজারের টেরিলটা উল্টে ফেলেছে লোকটা!

‘রিভলভারটা মেঝেতে রেখে পা দিয়ে আমার দিকে ঠেলে দাও,’ হঠাৎ করেই কড়া সুরে বলল রানা।

মাথা নাড়ল নাগিনো। প্রাণপণে ভাবছে, নিশ্চয়ই উপায় আছে কোনও না কোনও!

হাতঘড়ি দেখল রানা। ‘বেশি দেরি হলে কিন্তু কাজ করবে না অ্যান্টিডোট।’

বন্যার মত ছাপিয়ে ওঠা ভয়কে জয় করতে চাইল গোখারো নাগিনো। কিন্তু কাজটা অসম্ভব। পুরনো ঝরঝরে গাড়ির মত ধক-ধক করছে হৃৎপিণ্ড। মুখ ভিজে গেছে ঘামে। জ্যাকেটের আস্তিন দিয়ে মুখ মুছে মেঝেতে রিভলভার রাখল সে। লাথি মেরে পাঠিয়ে দিল রানার কাছে। ‘কী করতে হবে? সরিয়ে নেব সিকিউরিটি টিমের সবাইকে?’

রিভলভারটা তুলে নিল রানা। ‘সন্দেহ করবে ওরা।’

‘তা হলে কী করব?’

‘প্রথম কথা, মোবাইল ফোন দাও,’ জানাল রানা, ‘আমারটা তোমাদের লকারে। তোমার পরের কাজ সাহায্য করা। যাতে এরিনা থেকে সরাতে পারি আমার বন্ধুকে। তবে তা করব পুরনো আমলের স্টাইলে। তুমি-আমি হাতে-হাত মিলিয়ে কাজে নামব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *