বত্রিশ
অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এনসিআর অফিসে ফিরল লো হুয়াং, চিন্তিত। নিঃশব্দে দরজা পেছনে আটকে দিয়ে বসল ডেস্কের পেছনে। মনের ভেতর নেড়েচেড়ে দেখছে রানার সঙ্গে বলা কথাগুলো। কিছুক্ষণ পর সিদ্ধান্ত নিল: দেরি না করে পথ থেকে সরাতে হবে মাসুদ রানা আর নুমাকে।
ডেস্কটপ কমপিউটারের স্ক্যানারে আঙুল রাখল সে। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর খুলে গেল ডেস্কের ড্রয়ারের তালা। দ্বিতীয় ড্রয়ার থেকে স্পেশাল এক সেল ফোন নিল সে। ওটা আটকে নিল কমপিউটারের বিশেষ জ্যাক-এ। কি-বোর্ডে কয়েকটা টোকা দিতেই চালু হলো এনক্রিপশান প্রোগ্রাম। এক সেকেণ্ড পর ফোন থেকে গেল কল।
স্ক্রিনে ফুটল হলদে আইকন। কানেক্ট হচ্ছে কল। এনক্রিপটেড কোড মেনে নেয়ায় সবুজ হয়ে উঠল আইকন।
ওদিক থেকে বলল কেউ, ‘লাইন সিকিয়োর।’
‘সিকিয়োর লাইন,’ পাল্টা বলল হুয়াং, ‘যোগাযোগ করিয়ে দাও মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে।’
‘একমিনিট।’
অপেক্ষা করতে গিয়ে টাই ঢিলে করল বিলিয়নেয়ার। ব্যথা শুরু হয়েছে তার গলা ও ঘাড়ে। ডেস্ক থেকে স্কচ মদের বোতল নিয়ে গ্লাসে সোনালি তরল ঢেলে ঢকঢক করে গিলল। একটু পর কমপিউটারের স্পিকারের মাধ্যমে এল পুরুষ কণ্ঠ: ‘মন্ত্রী মহোদয় অপেক্ষা করছেন, স্যর। লাইন খোলা।’
অর্থাৎ, বেইজিঙের মন্ত্রণালয়ের নিজ অফিসে অপেক্ষা করছে যেইন নিং। ‘ঝামেলা হয়েছে,’ বলল লো হুয়াং, ‘আপাতত বন্ধ করতে হবে সব অপারেশন।’
কয়েক সেকেণ্ড স্ট্যাটিকের আওয়াজ হওয়ার পর ওদিক থেকে এল নিং-এর কণ্ঠ, ‘নানান দিক থেকেই ঝামেলায় পড়েছি আমরা। কিন্তু সব চালু করে দিয়ে এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।’
‘প্রকাশ পেতে পারে আমাদের সব,’ বলল লো হুয়াং। ‘আজ দেখা করেছে মাসুদ রানা। বলে গেছে, চিনের পুব সাগরে অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক সমস্যার কথা জেনেছে তারা।’
‘তাতে অবাক হচ্ছি না,’ বলল যেইন নিং। ‘কিন্তু তুমি বলেছিলে মারা গেছে লোকটা।’
ক্যাসিনোয় নিজ চোখে তাকে দেখেছে বিলিয়নেয়ার, তবে সে কথা চেপে গেল মন্ত্রীর কাছে। ‘আমাকে বলা হয়েছিল ওই দুর্গে মারা গেছে ওরা। এ-গুজব ছড়িয়ে দেয় জাপানি পুলিশ। ছেলেমানুষী বলতে পারেন। আসলে এখনও তদন্ত করছে তারা।’
‘আর তুমি নাদান শিশুর মত পড়লে তাদের ফাঁদে।’
অপমানে বুক জ্বলে গেল লো হুয়াং লিটনের। ‘গুরু, আপনি হয়তো ভেবে দেখেননি, মস্ত কোনও ভুল হলে কত বড় বিপদে পড়ব আমরা। ভাবুন একবার, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই আমার নিজ এলাকায় এসে হাজির হয়েছে মাসুদ রানা! এটা কাকতালীয় হতেই পারে না! তারা জেনে গেছে, সরীসৃপের চোয়ালে কী করেছে এনসিআর। এবার সার্ভে করবে। কোনওভাবে লুকাতে পারব না মাইনিং সাইট।’
‘ঘাবড়ে দিতে চাইছে,’ বলল যেইন নিং।
‘নিশ্চিত হবেন কী করে, গুরু?’
‘কারণ, ওরা আগেই সার্ভে করেছে,’ বলল বৃদ্ধ চিনা। ‘ওখানে কিছুই পায়নি।’
হতভম্ব হয়ে গেল লো হুয়াং লিটন। সে একমাত্র লোক নয় যে জরুরি তথ্য গোপন করছে! ‘কবে এটা হলো?’
‘গতকাল,’ বলল যেইন নিং, ‘একটা সিগনাল ধরা পড়ে আমেরিকান এক রোভ থেকে। সোনার থেকে বোঝা গেছে ওটা ছোট আকারের সাবমারসিবল। ধারণা করছি, গেছে খনি এলাকায়।’
টিসটিসে ব্যথা শুরু হওয়ায় মাথার তালু টিপতে লাগল লো হুয়াং লিটন। ‘কীভাবে হলো এমন? আমার তো ধারণা ছিল নেভি পাহারা দেয় ওই এলাকা।
কী ঘটেছে জানাল যেইন নিং। কথার ভেতর প্রশংসার ভাব থাকল। ‘স্বীকার করতে হবে, আমাদের জালের ভেতর ফুটো পেয়েছে ওরা। আমরা ভাবিইনি, ওদিক দিয়ে ঢুকে পড়তে পারবে। কিন্তু দুশ্চিন্তা কোরো না, ওরা এমন কিছু পাবে না যে হৈ-চৈ করতে পারবে।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ বলল লো হুয়াং। ‘সব তথ্য পাঠিয়ে দেবে ওয়াশিংটনে।’
‘সে সুযোগ পাবে না,’ জোর দিয়ে বলল যেইন নিং। ‘শাংহাই শহরে পৌচেছে নুমার দুই এজেন্ট। তবে দেরি হবে না তাদেরকে কারাগারে ভরতে। গুপ্তচর হিসেবে অভিযোগ তোলা হবে তাদের বিরুদ্ধে। টু শব্দ করার উপায় থাকবে না আমেরিকার। এমন কী বড় কোনও সার্ভের মাধ্যমে নিখুঁত সোনার ম্যাপ, ভিডিয়ো ফুটেজ বা গ্রাউণ্ড পেনিট্রেটিং সোনার থেকেও জরুরি কিছু পাবে না ওরা। সত্যিকারের কাজ হয়েছিল তোমার মেশিন দিয়ে গভীর সুড়ঙ্গের ভেতর। অতটা গভীরে যাবে না সোনার।
‘বড়জোর আমেরিকানরা জানবে, মাইনিং হয়েছে সাগরতলে, তবে পরে ভূমিকম্প বা অন্য কোনও কারণে তা পরিত্যক্ত হয়। ক্যানিয়নের নিচে রয়ে গেছে ধ্বংসস্তূপ। তবে সেসব এখন হাজার হাজার মাছের বাড়ি। নতুন কিছুই জানবে না তারা। আপাতত বোঝার উপায় নেই ওখান থেকে উত্তোলন করা হয়েছে সোনালি শিখা। আর শেষে ওরা যখন কিছু বুঝবে, ততক্ষণে আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে জাপানি সরকার। এদিকে তোমরা হোক্কাইডো থেকে তুলবে সোনালি শিখা। অবশ্য, খনিটা খুঁজে বের করতে পারলে তবেই।’
নরম সুরে বলল লো হুয়াং, ‘আমরা খনি পাওয়ার খুব কাছাকাছি পৌছে গেছি। আশা করি আজই হাতে পাব প্রাচীন কিছু তলোয়ার আর মাসামিউনের ডায়রি। শেষের ওটায় আছে কীভাবে কঠিন হয় ধাতু। ডায়রি থেকে জানব, কোথায় আছে ওই অ্যালয়। তবে শাংহাই-এ নুমা এজেন্ট আগেই সব ফাঁস করে দিলে আর কিছুই করতে পারব না।’
কিছুক্ষণের জন্যে চুপ হয়ে গেল যেইন নিং। ভাবছে ওয়েইকিউই খেলার জটিল কোনও কৌশল। এ সুযোগে আরেকটা ড্রিঙ্ক নিল লো হুয়াং লিটন।
অন্তত দু’মিনিট পর বৃদ্ধ বলল, ‘তুমি তো বললে তোমার কাছে এসেছিল মাসুদ রানা?’
‘জী। সাহায্য চেয়েছে। ওই খনি দেখতে চায়।’
‘ওয়েইকিউইর কঠিন চাল দিয়েছে,’ বলল যেইন নিং। ‘কাঁপিয়ে দিতে চেয়েছে তোমাকে।’
‘একটা বাড়তি কথাও বলিনি। কিছুই জানতে পারেনি।’
‘ওর খেলা পাকা খেলোয়াড়ের মত, প্রশংসা না করে পারছি না। জানা দরকার কতটুকু জেনেছে সে।’
‘আমার জানা নেই। ‘
‘খেলার প্রথম শিক্ষা ভুলে যেয়ো না,’ বিরক্ত হয়ে বলল নিং। ‘প্রতিপক্ষ সাহসী হয়ে ঝুঁকি নিলে, তখন ভাল সুযোগ পাবে তুমি। সাহসী লোক সে। ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না। তার মানে, তাকে ফেলা যাবে বিপদে। ওর গোয়ার্তুমি কাজে লাগাতে হবে নিজেদের পক্ষে।
‘তা কীভাবে করব, গুরু?’
‘আমরা চাই জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে আমেরিকার বিরুদ্ধে চেতিয়ে দিতে, তাই না?’
‘আমরা মাসুদ রানা আর সোহেল আহমেদকে সরিয়ে ফেললেও আমেরিকার সরকার বলবে: নিজে থেকে যা খুশি করেছে তারা,’ বলল লো হুয়াং, ‘কোনও দায় নেবে না শ্বেতাঙ্গরা। তার ওপর, এরা জাতে বাঙালি।’
‘গায়েব করে দাও,’ বলল যেইন নিং। ‘ওদের জায়গায় সেট করো আমাদের নতুন দু’জনকে।’
‘তার মানে… গুরু, আপনি বলছেন…
‘তাই বলছি,’ জোরের সঙ্গে বলল বৃদ্ধ, ‘আপাতত আমেরিকান সরকার বা নুমার হয়ে কাজ করছে মাসুদ রানা আর সোহেল আহমেদ। তারা চিন-নিপ্পন সহযোগিতামূলক চুক্তি অনুষ্ঠানে এসে জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে খুন করলে শুরু হবে ভীষণ হৈ-চৈ। প্ৰচণ্ড খেপবে জাপানি পাবলিক। তাতে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাপান-আমেরিকার সম্পর্ক। যেটা চিনের জন্যে অত্যন্ত লাভজনক হবে বলেই মনে করি।’
হাসল হুয়াং। ‘আপনি বরাবরের মতই সঠিক বলেছেন, পরম গুরু! সুযোগটা নিজে দেখিনি বলে মাফ করে দেবেন। ঠিক, সরাসরি মুঠোয় ধরা দিয়েছে এসে মাসুদ রানা!’