ব্যাবসা – ম্যাক রেনল্ড

ব্যাবসা – ম্যাক রেনল্ড

শুনুন… ও মশাই… শুনছেন?… পাশ কাটিয়ে যাওয়া প্রথম পদযাত্রীকে চিৎকার করে ও ডাকলেন সময়-ভ্রমণকারী। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পদযাত্রী। কয়েক পা এগিয়ে এসে সময়-ভ্রমণকারী বললেন–দেখুন, বিংশ শতাব্দী থেকে আসছি। হাতে মাত্র পনেরো মিনিট সময়, তারপরেই আমাকে ফিরে যেতে হবে। না না, আমি বুঝতে পারছি.. কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমার কথাগুলো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? তাই না?

–অসুবিধে? অসুবিধে হবে কেন… আপনার অবস্থা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি।

–আরে, আপনি দেখি দারুণ ইংরাজি বলেন।

–হ্যাঁ, এই ভাষার নাম এখন আমের… ইংরাজি। তা ছাড়া আমি তো ভাষা-বিজ্ঞানের ছাত্র… অতীতের ইংরেজি ভাষা নিয়েই পড়তে হয়।

–চমৎকার! শুনে দারুণ ভালো লাগল। শুনুন আমার সময় খুব কম। কাজের কথায় আসা যাক।

–কাজের কথা?

–হ্যাঁ, কাজের কথা… বুঝতে পারছেন না। হাতে সময় নেই বললেই চলে। সকলে মিলে আমাকে বাছাই করে ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দিয়েছে… আর সেইজন্যেই আমার গুরুত্ব অনেকখানি।

–বুঝলাম। তবে আপনি যতটা ভাবছেন বোধহয় সেটা সঠিক নয়। আজকাল তো হরদম লোক ভবিষ্যতে বেড়াতে আসছে।

–তাই নাকি? দারুণ সুখবর শোনালেন ভাই। কিন্তু আমার ব্যাপারটা একটু আলাদা। সময় খুবই কম। আর কম বলেই এখনকার সব কিছু দেখা সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম কী…

–বেশ তো… আপনার কাছে কী কী আছে বলুন?

–কী বলতে চাইছেন? আমার কাছে কী আছে মানে? সময়-ভ্রমণকারীর কণ্ঠে বিস্ময়ের। আভাস।

পদযাত্রীর মুখে বিরক্তির চিহ্ন।

–বেশ লোক তো আপনি। সহজ কথাটাই বুঝতে পারছেন না… আরে আপনি তো প্রমাণ চান… ভবিষ্যতে যে এসেছেন তারই কিছু নমুনা। আপনি জানলেও আমার সাবধান করে দেওয়া কর্তব্য বলেই বলছি… সময়-ভ্রমণের কতকগুলো বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে, যেমন, ভবিষ্যতের কোনও জ্ঞান নিয়ে আপনি অতীতে মানে আপনার নিজের সময়ে ফিরতে পারবেন না… তা না হলে ভবিষ্যতের জ্ঞানের আলো অতীতের অনেক কিছু পালটে দিতে পারে। সেইজন্যেই নিজের যাবতীয়’ মানেই ‘সব’। কালে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের যাবতীয় জ্ঞান আপনার স্মৃতি থেকে নিঃশেষে মুছে যাবে।

–এ কথা তো সকলেই জানে।

–নিশ্চয় জানবে। না জানার তো কিছু নেই। এবার সেই জন্যেই তো এক কথায় আপনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম… আপনার সঙ্গে নিশ্চয় ব্যাবসা করব।

–শুনুন, আপনি ব্যাবসা বলতে কী বলতে চাইছেন বলুন তো?

–এই সোজা কথাটা কেন বুঝতে পারছেন না, সেটা বুঝতে পারছি না। ব্যাবসা মানে বিনিময়… বিনিময়কেই বোঝাচ্ছি–অর্থাৎ আপনার কালের কিছু নিদর্শনের বদলে এখনকার কিছু নমুনা আপনাকে দিয়ে দেব। অবশ্য আপনার সময়ের কী জিনিসই বা দেবেন আর তার মূল্যই বা কী? তবে ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যবান হলেও হতে পারে। এই পর্যন্ত বলে পদযাত্রী চুপ করে গেলেন। বড় বড় চোখে বিংশ শতাব্দীর দিকে। তাকিয়ে রইলেন। পরে একটু কেশে নিয়ে বললেন–যাই হোক, আমার কাছে এই আণবিক পকেট ছুরি আছে। এই ছুরির অশেষ গুণ… আপনাদের সময়ের কোনও ছুরির সঙ্গে এর তুলনাই চলে না।

–তাই নাকি? দেখুন, আর মাত্র দশ মিনিট আছে… আমারও এমনই একটা জিনিসের দরকার… আর ছুরিটা হলেই আমি প্রমাণ করতে পারব… আমার ভবিষ্যতে আসা নিয়ে কারোর কোনও সন্দেহ থাকবে না।

–আণবিক ছুরিটাই এক দারুণ প্রমাণ হবে… কী বলেন? কথায় সায় দিলেন পদযাত্রী।

–সত্যি আমার ভাগ্যটা দারুণ ভালো… নচেৎ আপনার মতো এমন সরল ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পাওয়া… যাকগে সে সব কথা… ছুরিটা দিন তাহলে?

–দেবো দেবো… নিশ্চয় দেবো… কিন্তু শুধু শুধু আমার ছুরিটা দেবো কেন? ছুরির বিনিময়ে আমি কী পাব? মানে আপনি কী দেবেন সেটা তো বলুন।

–কিন্তু… দেবার মতো কিছু তো আনিনি… আমি তো বিংশ শতাব্দীর লোক…

–সে তো জানি… আমিও ত্রিংশ শতাব্দীর লোক। বিনিময় ছাড়া আমাদেরও কিছু দেওয়া নিষেধ!

থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধি। কয়েক সেকেন্ড… মিনিট কেটে গেল। তারপর বললেন… শুনুন ভাই… আমার তো সময় বেশি নেই… বিনিময়ের কথা বলছেন… তা হলে আমার রিস্টওয়াচটা…

–রিস্টওয়াচ! এ যুগে এর কোনও দাম নেই… এ ছাড়া আর কী দিতে পারেন?

–টাকা… বেশ কিছু টাকা আছে আমার সঙ্গে।

–টাকা… এক হাজার বছর অতীতের টাকা নিয়ে কী করব… আমি তো আর Numismatics মানে প্রাচীন মুদ্রাসংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনা করি না।

-–শুনুন, ভাই শুনুন… যা বলছি তাই যদি আপনার কাজে না লাগে… তাহলে… অথচ বিংশ শতাব্দীর নিদর্শন চাই আমার।

–নিদর্শন নিয়ে ভাবনা করবেন না… ছুরিটা দিয়ে দেব… কিন্তু উপযুক্ত বিনিময় ছাড়া তো…

–বেশ… আমার বন্দুকটা নিন।

–বন্দুক… এখনকার যুগে বন্দুকের কোনও ব্যবহারই নেই… বন্দুক ছাড়া…

–হ্যায় ভগবান! যা বলি তাই নয়… অথচ সময়ও শেষ হয়ে আসছে… বেশ ভাই… এবার আপনি বলুন… দেখুন আমার তো জামাকাপড়, মানিব্যাগ… কিছু টাকা, একটা চাবির রিং আর একজোড়া জুতো সম্বল। এর মধ্যে…

–ব্যাবসা তো করতে চাই… তবে আপনার বিনিময়মূল্য খুবই নগণ্য…

–শুনুন ভাই… আর তো দেবার মতো কিছুই নেই… আমার যা আছে সব কিছুর বিনিময়ে অনুগ্রহ করে ছুরিটা দিন আমাকে… তবে হ্যাঁ… সব কিছু মানে প্যান্টটাকে বাদ দিয়ে… বুঝলেন না… বিংশ শতাব্দীর ভদ্রলোকের কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।

–উঃ, বলেও যে কী মুশকিলে পড়লাম। দেখুন… আপনার যা আছে সব খুলে দিন… প্যান্টটাও লাগবে।

–নিন ভাই.. যা আছে সব নিন… আর সময় নেই… এবার আপনার আণবিক ছুরিটা দিন!

বিনিময় ব্যাবসা হয়ে গেল। বিংশ শতাব্দীর ভদ্র ডাকাত পথ থেকে সরে দাঁড়ালেন। সঙ্গে একরাশ লুটের মাল… জামা, প্যান্ট, মানিব্যাগ, বন্দুক…। সামনেই জন্মদিনের পোষাক পরে বিংশ শতাব্দীর সময়-ভ্রমণকারী দাঁড়িয়ে… হাতে আণবিক ছুরি… সমস্ত মুখমণ্ডল দারুণ তৃপ্তিতে জ্বলজ্বলে…

ক্রমেই ঝাপসা হয়ে উঠছে.. কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া… এবারে আরও অস্পষ্ট… যাও! সব যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল।

ছুরিটা শূন্যে ভেসে রইল বেশ কয়েক মুহূর্ত… তারপর সময়-যাত্রীর অবয়ব অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল… ভবিষ্যতের কোনও কিছুই অতীতে যাবে না।

মৃদু হেসে ছুরিটা তুলে নিলেন পদযাত্রী। বিড়বিড় করে বললেন… আচ্ছা বোকা লোক… অতীতের সব লোকই এমন নাকি… অবশ্য ‘সময়’ ব্যাপারটি খুবই জটিল… এই যুগেই কি সময়ের সব জট খোলা গেছে… কিন্তু সময়-ভ্রমণ করবে অথচ সহজ সরল সত্যটা বুঝবে

… সময়-যাত্রীরা, সামনের দিকে, মানে, কোনও জিনিস অতীত থেকে ভবিষ্যতে নিয়ে আসতে পারে কারণ সময়ের স্বাভাবিক গতিই ভবিষ্যতের দিকে। সময়-স্রোতের বিপক্ষে মানে অতীতে কিছুই নিয়ে যাওয়া যাবে না… এমন কি স্মৃতিতেও না।

সব মালপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরলেন পদযাত্রী। দরজায় কোমরে হাত দিয়ে মার্গারেট।

–এত দেরি হল যে? কোথায় যাওয়া হয়েছিল?

-–আঃ, ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই অশান্তি শুরু করলে… কত সব জিনিস এনেছি দেখ!

-–আবার তুমি…

–রাগ কোরো না… ঠান্ডা মাথায় বোঝবার চেষ্টা করো… আসার পথে এক সময়-যাত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল…

–দেখা হয়ে গেলেই…

–অন্যায় কী করলাম… আরে আমি না করলে অন্য কেউ করবে…

–বুঝলাম… কিন্তু রাখবে কোথায় বলো তো… তিন-তিনটে আলমারি বোঝাই হয়ে গেছে…

–মার্গারেট… ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করো… একদিন না একদিন মিউজিয়াম বা কোনও কালেকটারের কাছে চড়া দামে বিকোবে… ভাবো এক বার। এক হাজার বছর অতীতের সব জামাকাপড়, বন্দুক…

কথা না বলে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কাঁধ নাচিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন গৃহকত্রী।

–উঃ, বোঝালেও বুঝবে না… মেয়েদের ভাবনার হদিশ পাওয়া খুবই কঠিন… কী জানি… হাজার বছর আগেও মেয়েরা কি এমনই ছিল? বিড়বিড় করে বলতে বলতে লুটের মাল গোছাতে মন দিলেন পদযাত্রী।