বাছাই – হেনরি সেলসার

বাছাই – হেনরি সেলসার

আজ ডিকির বয়স বারো বছর পূর্ণ হল। এতদিন পরীক্ষার কথা নিয়ে আলোচনা আI করেননি কেউ। আজই প্রথম ছেলের সামনে পরীক্ষার কথা বললেন শ্রীমতি

জর্ডান। স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার আভাস বুঝেই তড়িঘড়ি স্বামী জবাব দিলেন। –ভুলে যাও… ভুলে যাও পরীক্ষার কথা… আমি বলছি ডিকি পাশ করবে। সকালবেলায় প্রাতঃরাশের টেবিলে বসেই আলোচনা হচ্ছিল। ডিকিও সামনে বসেছিল। পরীক্ষার কথা শুনে মায়ের দিকে তাকাল ডিকি। খুব স্মার্ট, সদাসতর্ক ডিকির একমাথা ভরতি সোনালি চুল। দু’চোখের তারায় তারায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ। পরীক্ষা নিয়ে কেন যে বাবা-মা মাথা ঘামাচ্ছে সেটাই ওর বোধগম্য হল না। আজ ওর জন্মদিন… জন্মদিনের কথা না বলে কেবল পরীক্ষার কথা। ওদের ছোট্ট ফ্ল্যাটে রংবেরঙের কাগজে মোড়া নানান আকারের উপহার জমা হয়ে আছে। জলখাবারের পরে কখন যে সে ওগুলো খুলবে সেই ভাবনায় অস্থির। ছোট্ট ওয়াল কিচেনে অটোমেটিক স্টোভে কী যেন তৈরি হচ্ছে… মিষ্টি সুবাসে চারপাশ ম ম করছে। ঘুম ভাঙার পরই মনে হয়েছিল আজ জন্মদিন… সকাল থেকে মা বাবার সঙ্গে হুল্লোড় করবে তা নয়… সকাল থেকেই পরীক্ষার কথা। ছলছল মায়ের চোখ–বাবার গম্ভীর মুখ– মেপে মেপে কথা– সব আনন্দ মাটি করে দিল।

–কোন পরীক্ষার কথা বলছ?

মুখের দিকে না তাকিয়ে মা বললেন– এটা এক সরকারি পরীক্ষা। ইন্টেলিজেন্স টেস্ট। বারো বছরের সব ছেলেমেয়েদেরকেই এই পরীক্ষায় বসতে হয়। সামনের সপ্তাহে তোমাকেও পরীক্ষায় বসতে হবে। তবে ভয় পাবার কিছু নেই ডিবি।

-মানে স্কুলের মতো পরীক্ষা?

–অনেকটা। তবে ভাবনার কিছু নেই। যাও ডিকি ঘরে গিয়ে কমিকস পড়ো। খাবার টেবিল থেকে সরিয়ে দেওয়াই যেন বাবার মতলব– এমন তো বাবা আগে কোনওদিন করেনি? নানান সাত-পাঁচ চিন্তা করল ডিকি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে উঠে পড়ল ডিকি। পায়ে পায়ে চলে গেল ঘরের এক কোণে। রাশ রাশ গল্পের বই ডাঁই করা… জ্ঞান হওয়া অবধি এটাই ওর একান্ত আপন জায়গা।

নতুন এক কমিক্স-এ বই সামনে মেলে ধরল। পাতার পর পাতা উলটে গেল– কতই জমকালো মজার মজার ছবি। কিন্তু কোনও কিছুতে ওর মন বসল না। খোলা জানালাপথে বাইরে তাকাল… দুই চোখে ওর কোনও দৃশ্যই দাগ কাটে না। মায়ের চোখের জল আর বাবার গম্ভীর মুখ ওর সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।

–আজ কেন বৃষ্টি হবে বাবা? কাল বৃষ্টি হলে কী ক্ষতি হত?

বাবা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সরকারি কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন। একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন– আজকে বৃষ্টির প্রয়োজন তাই… বৃষ্টি হলে ঘাস, গাছপালা বেড়ে ওঠে ডিকি।

–কেন বাবা?

–গাছপালার ধর্ম বেড়ে ওঠা তাই।

ভ্রূ-দুটো চুলকে উঠল ডিকির। খসখস করে চুলকে নিয়ে প্রশ্ন করল– আচ্ছা বাবা, গাছপালা সব সবুজ হয় কেন?

-–কেন হয়, কেউ জানে না… সবুজ সবুজ হয়। এত কেন কেন করো কেন? সব কেন’র কি জবাব হয়? বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন বাবা।

দিনের শেষে জন্মদিনের উৎসব শুরু হল। হাসি হাসি মুখে মা ওর হাতে উপহারের বাক্স তুলে দিলেন। বাবা কত আদর করলেন… ডিকি-ও আনন্দে উচ্ছল হয়ে মা’র দু’গালে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল। জন্মদিনের প্রকাণ্ড কেক কেটে উৎসবের সমাপ্তি ঘটল। খুশিতে ডগোমগো ডিকির দুই চোখের তারায় তারায় তৃপ্তির আভাস।

একঘণ্টা পরে আবার জানালার ধারে বসল ডিকি। সামনে আকাশের বুকে রাশি রাশি মেঘের পাহাড়। পাহাড় ফুড়ে আলোর তির বেরিয়ে আসছে এখানে সেখানে। ভারী সুন্দর লাগে ডিকির।

–বাবা, সূর্য কতদূরে আছে? আবার প্রশ্ন করে ডিকি।

–হাজার পাঁচেক মাইল হবে। প্রত্যয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন বাবা।

…কয়েকদিন পর সকালে আবার সেই প্রাতঃরাশের টেবিল। মায়ের দু’চোখে জল। পরীক্ষার সঙ্গে চোখের জলের কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটাই ওর কাছে বোধগম্য হল না। বাবা নিজেই এবার পরীক্ষার কথাটা তুললেন।

–ডিকি… আজ তোমার পরীক্ষার দিন। অসম্ভব গম্ভীর বাবার কণ্ঠস্বর।

–আমি জানি বাবা। আমি আশা করছি….

–না না, চিন্তার কোনও কারণ নেই। প্রতিদিন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। সরকার শুধু জানতে চায় ছেলেমেয়েরা কত স্মার্ট। ব্যস… শুধু এইটুকু মাত্র।

–আমি তো স্কুলে খুব ভালো রেজাল্ট করি। তাহলে আমাকে কেন পরীক্ষা দিতে হবে?

-–এ একেবারে আলাদা পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে ওরা এক কাপ কিছু একটা খেতে দেবে… তারপর ওরা একটা ঘরে নিয়ে যাবে… প্রকাণ্ড মেশিনের সামনে বসিয়ে দেবে। আর…

–কী খেতে দেবে বাবা?

–খুবই সাধারণ, কিন্তু দারুণ পিপারমেন্টের গন্ধ… আর এই পানীয়টাই তোমাকে প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে সাহায্য করবে। তা বলে মনে কোরো না যে, সরকার তোমাদের অবিশ্বাস করে… তবে এ সিদ্ধান্ত কম্পিউটারের।

ডিকির চোখেমুখে হতবুব্বি আভাস… অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। মায়ের দিকে তাকাতেই সজোরে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন মা। মায়ের বুকের মধ্যে রাশি রাশি আশ্বাস যেন খুঁজে পেল ডিকি।

–ছিঃ! কী বোকা ছেলে। ভয় কীসের… সবাইকে পরীক্ষা দিতে হয়। আমাদেরও দিতে হয়েছিল।

–তুমি ঠিক বলেছ। ঘাবড়াবার কী আছে? আর ডিকি তুমি তো ভালো ছেলে। দেখো, দারুণ ভালো রেজাল্ট করবে। তারপর বাড়ি ফিরে সারারাত গান শুনব, সিনেমা দেখব, গল্প বলব- বাবার কণ্ঠস্বরে কেমন যেন কৃত্রিমতার আভাস।

-–ঠিক আছে.. আর ভয় পাবো না বাবা।

…নির্ধারিত সময়ের ঠিক পনেরো মিনিট আগেই ওরা পৌঁছে গেল। সরকারি শিক্ষা মন্দির। প্রকাণ্ড এক প্রাসাদের মতো বাড়ি। মার্বেলের করিডোর পেরিয়ে কারুকার্যময় এক তোরণের মধ্য দিয়ে ওরা সোজা চলে এল স্বয়ংক্রিয় এলিভেটারের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। ওরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে ওদের পাঁচতলায় পৌঁছে দিল সেটা।

সামনেই সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত এক যুবক বসে। সামনে চকচকে টেবিল। ঘরের নম্বর ৪০৪। সব খুঁটিয়ে দেখল ডিকি। লিস্টে নাম মিলিয়ে ওদেরকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল যুবকটি।

কী ঠান্ডা ঘর। বিশাল ধাতব টেবিলের সামনে সার সার বেঞ্চ। অনেকটা বিচারালয়ের মতো। দু’চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে দেখে ডিকি। টেবিলের সামনে বেশ কয়েকজন পিতাপুত্র চুপচাপ বসে। ক্ষীণদেহী এক মহিলা দ্রুত পায়ে ফাইল হাতে নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে আসছে আর বাইরে যাচ্ছে।

মি. জর্ডান ফর্ম ভরতি করে সই করে দিলেন। ক্ষীণাঙ্গী ফর্ম নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

–দেরি হবে না তোমার নাম ধরে ডাকলেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যাবে। ভয়ের কিছু নেই। ঘরের লোক সব বুঝিয়ে দেবে। পুত্রকে আবার আস্বস্ত করলেন বাবা।

গোপনে লাউডস্পীকারে একজনের নাম শোনা গেল। ডিকির সামনে বসা ছেলেটি বাবার পাশ থেকে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ডিকির যেন মনে হল ছেলেটা দারুণ ভয় পেয়েছে।

এগারোটা বাজতে যখন পাঁচ মিনিট বাকি তখন ডিকির নাম ভেসে এল।

–নিশ্চয় ভালো হবে… কিছু ভেবো না… আমি এখানেই থাকব… শেষ হলেই ওরা আমাকে ডেকে নেবে! ছেলের দিকে না তাকিয়ে যন্ত্রের মতো বলে গেলেন বাবা।

ডিকি দুরু দুরু বুকে ঘরে ঢুকল। আবছা আলোয় ভালো করে দেখা যায় না। সামনেই ধূসর ইউনিফর্ম পরা একজন কথা বলে উঠল।

-–বসো–এখানে বসো। কী মধুর কণ্ঠস্বর। ডিকি যেন অনেক সাহস ফিরে পেল।

–তোমার নাম রিচার্ড জর্ডন?

–হ্যাঁ স্যার। –তোমার নম্বর হল ৬০০-১১৫৷ নাও… এটা খেয়ে নাও… দেখ কী সুন্দর টেস্ট৷ টেবিলের ওপর থেকে একটা প্লাস্টিকের কাপ তুলে নিয়ে ডিকির দিকে এগিয়ে দিল সে। পানীয়টা অনেকটা ঘোলের মতো… তবে গাঢ়.. কেমন যেন পিপারমেন্টের স্বাদ। ঢক ঢক করে কাপটা  শেষ করে ফেলল ডিকি।

-–ঠিক আছে… আমার সঙ্গে এস।

ওর সঙ্গে ডিকি ঘরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। সামনেই একটা কাঠের চেয়ার… চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোফোনটা ডিকির মুখের সামনে চলে এল।

–এবার হেলান দিয়ে বসো। তোমাকে কতকগুলো প্রশ্ন করা হবে… বেশ ভালো করে চিন্তা করে উত্তর দিও। বাকি কাজ কম্পিউটার নিজেই করে নেবে।

-–ঠিক আছে স্যার।

–সব বুঝেছ তো… আমি এবার চলে যাব… তুমি তৈরি হলেই যন্ত্রকে বলে দেবে… রেডি– ব্যস… বুঝেছ?

–হ্যাঁ স্যার।

ডিকির দুই কাঁধ টিপে ধরে আশ্বস্ত করে চলে গেল সে।

ডিকিও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল– রেডি।

পটপট করে কম্পিউটারে আলো জ্বলে উঠল। একরাশ গুঞ্জন শোনা গেল। পরক্ষণেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

–এর পরের সংখ্যা বলো– এক, চার, সাত, দশ…

…জর্ডান দম্পতি শোবার ঘরে মুখোমুখি বসে। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। নির্বাক নিশ্চল।

প্রায় চারটে বাজে, টেলিফোন বেজে উঠল। স্প্রিং-এর এর মতো লাফিয়ে টেলিফোনটা ধরবার চেষ্টা করলেন শ্রীমতি জর্ডান। কিন্তু ততক্ষণে স্বামী টেলিফোন তুলে নিয়েছেন।

–মি. জর্ডান? খুব ধীর-স্থির কণ্ঠস্বর।

–হ্যাঁ, কথা বলছি।

সরকারি শিক্ষামন্দির থেকে বলছি। আপনার ছেলে রিচার্ড জর্ডান ক্লাসিফিকেশান ৬০০-১১৫ সরকারি পরীক্ষা শেষ করেছে। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার ছেলের আইকিউ সরকার নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, নিউ কোডের ৫নং ধারার ৮৪ নম্বর উপধারা অনুযায়ী বেশি আইকিউ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর… এরাই প্রচলিত সমাজ এবং শাসন ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটায়…

মায়ের বুকফাটা আর্ত চিৎকারে ছোট ঘর যেন ফেটে গেল… বাবার দু’চোখে টলটলে জল।

-রিচার্ড জর্ডানের মৃতদেহ কি আপনারা-ই সৎকার করবেন না সরকার সকারের ভার নেবে… যেমন জানাবেন সেইমতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি সকারের খরচ পড়বে এক ডলার মাত্র।