প্রাগৈতিহাসিক এক ভোরের গল্প – জন. পি. ম্যাকনাইট
বিশ্রী এক কর্কশ শব্দে ভোঠের শান্তি ছুটে গেল। গুহার বাইরে ঘুমন্ত লোমশ মনুষ্য বি পদবাচ্য জীবের তন্দ্রা টুটে গেল।
তড়িৎবেগে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। গুহার সামনে হরিণের চামড়ার ওপরে শায়িত শিশুটির দিকে তাকিয়ে দেখল। না, শিশুটি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন… নিকটে ভয়ের কোনও কারণ চোখে পড়ল না।
বুনো মানুষটি টলতে টলতে গুহার সামনে মস্ত বড় এক পাথরের কাছে দাঁড়াল। পাথরের ওপারে শরতের সোনাঝরা রোদ ফটফট করছে। প্রকাণ্ড সব বৃক্ষশাখায় সূর্যস্নাত পাতাগুলো মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে। গাছের তলায় খরস্রোতা নদীর অস্পষ্ট কলতান সূর্যবন্দনায় মুখর। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে আর সাঁঝের বেলায় জীবজন্তু সব জলপান করতে এই নদীর পাড়েই নেমে আসে। প্রখর সূর্যের আলোয় ভালো করে তাকানো যায় না… চোখ ছোট করে সে ভালোভাবে নদীর পাড় পর্যবেক্ষণ করে। না– চারপাশ ফাঁকা, শুনশান, জলের ধারে বড় বড় নলখাগড়ার বন হাওয়ায় দোলে, রং বেরঙের প্রজাপতির দল মেলা বসায়।
অরণ্যমধ্যস্থ ফাঁকা জায়গায় এক চারাগাছ মাটিতে নুইয়ে পড়ে। পরের মুহূর্তে চারাগাছ ভাঙার আওয়াজ শোনা যায়। শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র শ্বাপদের মতো সে ঘুরে দাঁড়ায়। ঘন পাতার আড়ালে এক জমাট আঁধার যেন! সেখানে বিশাল কোনও জন্তু নিঃশব্দে আহারে রত।
সহজাত প্রবৃত্তির বশে পাথরের ধারালো অস্ত্রটা হাতে তুলে নিল। এই পাথরটাই প্রায় দুটো শীতকাল আগে নদীর ধার থেকে তুলে এনেছিল। দু’হাতের মধ্যে পাথরটাকে পরম আদরে মুঠো করে ধরল। মস্ত চওড়া হাতের তেলের মধ্যে পাথরটা যেন খাপে খাপে আটকে গেল। পয়মন্ত পাথর… এই পাথরের সাহায্যেই সে গত সন্ধ্যায় হরিণের চামড়া ছাড়িয়েছে… গুহার মুখেই বিশাল লম্বা এক জীবন্ত লতানো জন্তু কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল।… দংশনোদ্যত হতেই এই পাথরই ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিল। এক কথায় গদার চেয়ে এই পাথর অনেক কার্যকরী… তবে হ্যাঁ… গদার অগ্রভাগে যদি এমন ধারালো পাথর থাকে তাহলে… অসম্ভব কল্পনায় বুনোর চোখ দুটি ঝিকিয়ে উঠল।
এবার বুনো মানুষটা ওর নিজের লোমে ঢাকা পোশাকে দু’হাতের দিকে তাকাল… তাকাল ওর চওড়া বুকের দিকে। অব্যক্ত ভাষায় বিড়বিড় করল কিছুক্ষণ।
তারপর শায়িত মানবকের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। বড় বড় মাছি ভনভন করছে… দূরে কোথায় একঝাঁক পাখি কিচকিচ করে উঠল। তন্দ্রায় তার দু’চোখ বুজে এল। গুহার বাইরে তখন ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ ক্রমেই মধ্যাহ্নের কোলে ঢলে পড়ছে।
দিনের ভাটা জ্বলাকালীন বুনো ঘুমোয় না। কিন্তু আজকের দিনটা সম্পূর্ণ আলাদা। গতরাতে আকণ্ঠ ভোজন ওকে শ্লথ করে তুলেছে। এত খাওয়ার পরেও গুহার মধ্যে
এখনও অনেক মাংস পড়ে আছে… বড় বড় মাছির ঝাঁক থিকথিক করছে। একেই বলে। ভাগ্য! শিকার থেকে খালি হাতে সে গুহায় ফিরছিল। এমন সময়ে থমকে দাঁড়ায় বুনো এ কী দেখছে.. প্রকাণ্ড এক হরিণের অর্ধভুক্ত মৃতদেহ… তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করল বারবার… বেশ দূরে ঘন বেতবনের মধ্যে প্রকাণ্ড এক হিংস্র বাঘ নিদ্রামগ্ন। বুঝতে বাকি রইল না… শিকার শেষে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন পশুরাজ। নিঃশব্দে মৃত হরিণের ভুক্তবিশিষ্ট দেহটা ঘাড়ে করে গুহার মধ্যে নিয়ে এল বুনো। ব্যস! বুনোর গুহাসঙ্গিনী বড় বড় মাংসের খণ্ডগুলো অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝলসে নিল। মাংস সেঁকার সে কী সুমধুর ঘ্রাণ… বড় বড় নিঃশ্বাসে বুক ভরে সেই ঘ্রাণের আস্বাদ নিল বুনো। হরিণের নরম মাংস আগুনের স্পর্শে আরও নরম হয়ে উঠেছিল… দুই হাত আর ধারালো দাঁতের সাহায্যে গব গব করে খাওয়া শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে দুজনের পেটের আকার বীভৎস হয়ে উঠল… তার পরে এক সময়ে খাওয়া বন্ধ করে অগ্নিকুণ্ডের পাশেই শুয়ে পড়েছিল।
ভোরের ঠান্ডা বাতাসে বুনোর সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল। টলতে টলতে সে ভোরেই নদীর ধারে এসেছিল… কী আশ্চর্য… পাথরের খাঁজে বেশ কিছু মাংসসমেত রক্তমাখা হাড়… চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। মাংসসমেত হাড়গুলো চিবিয়ে বুনো প্রাতঃরাশ সেরে নিল… পরে আঁজলা করে নদীর শীতল জল পান করে গুহার বাইরে এসে বসেছিল। ভোর হলেই বুনোর ভাবনা শুরু হয়… আঁধার নামার আগেই আজকের খাবার চাই… কালকের ভাবনার কোনও মূল্য নেই ওর কাছে।
হঠাৎ শিশুর কান্নায় তন্দ্রা ছুটে গেল তার। তাকিয়ে দেখল গড়াতে গড়াতে হরিণের চামড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রায় জমির ওপরে গিয়ে পড়েছে। হাত-পা ছুঁড়ে বিষম কান্নায় মগ্ন। মাঝে মাঝে কেমন যেন ঘড়ঘড় শব্দ! তন্দ্রাচ্ছন্ন বুনোর মনে স্বপ্নের জাল বোনা চলে। শিশুর অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ওকে গুহার মধ্যে ভেসে আসা নদীর কলতানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নদীর ধারে শরবন আর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সেই শব্দ ক্রমেই যেন মধুর হয়ে গুহায় প্রবেশ করে… বুনোর ভারী ভালো লাগে। মনে হয় নদীও কি ডাকে ওকে?
“ওয়া ওয়া ওয়া”… শিশুর কান্নার শব্দ তো নয় যেন নদীর জলধারা পাথরের গায়ে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি তুলে দূরে পালিয়ে যায়। মাঝে মাঝে নদীর ধারে পাথরের ওপরে বুনো চুপ করে বসে থাকে।… নদীর বুকে রূপের ঝলকানি তুলে ছোট ছোট মাছ লাফিয়ে ওঠে… ওরা যেন বুনোর বন্ধু। মাঝে মাঝে বুনোর মনে হয়, জলের গভীরে কোথায় যায় ওরা? পথ হারিয়ে কি বুনোর মতো ঘুরে বেড়ায়, “কু কু কু… ওয়া ওয়া”… আবার শিশুটি শব্দ নিয়ে খেলা শুরু করে… বুনোর মনে হয় আঁধার নামে যখন, তখন বুঝি লেজঝোলা কোনও পাখি ছানাদের আদর করে বাসায় ফেরার ডাক দেয়… আঁধারে ঘন কালোর মাঝে শব্দ ধ্বনি বুঝি ওদের পরস্পরকে কাছে টানে… পথ দেখিয়ে বাসায় ফেরায়।
কিন্তু শিশুর ধ্বনি তরঙ্গের প্রকারভেদ ঘটে… দন্তবিহীন মাড়ির ওপরে ঘনঘন জিভ বোলায়… নধর দু’ঠোঁটে করুণ আর্তি ফুটে ওঠে। ঘনঘুনিয়ে কেঁদে ওঠে “মা মা মা” ডুকরে কাঁদে মানবসন্তান।
বিরক্ত হয়ে বুনো উঠে পড়ে। কিন্তু রমণী দ্রুত ছুটে আসে শিশুর কাছে… শিশুকে কোলে নিয়ে স্ফীতকায় স্তনের ওপরে চেপে ধরে। মুহূর্তের মধ্যে কান্না থেমে যায়। গুহার মধ্যে শুধু চুকচুক শব্দ ওঠে. স্তন্যপান করে শিশু।
বুনোর মস্তিষ্কের মধ্যে স্মৃতি নড়াচড়া করে। খুব অস্পষ্টভাবে আর এক শিশুর ছবি ভেসে ওঠে। শব্দবিহীন পায়ে দাঁতাল বাঘে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। দুজনের সামনে… বাধা দেবার চেয়ে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত তখনও ওরা… সেই শিশুও মা মা বলে ডাকত। অবরুদ্ধ কান্নায় ঠোঁট দুটো ফুলে ফুলে উঠত। আর সেই শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ ফেলে রমণী ছুটে এসে স্তন দিয়ে শান্ত করত ওকে… চুক চুক শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কী গভীর তৃপ্তি ভেসে উঠত রমণীর মুখমণ্ডলে।
নিজের অজান্তে ধারালো পাথরটা তুলে নেয় বুনো। আপন মনেই পাথরের গায়ে আঁচড় কাটতে থাকে। মস্তিষ্কের গভীরে অস্পষ্ট সেই করুণ ছবিটাই ওকে উত্তেজিত করে তুলেছে। এর কারণ ও জানে না। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া, সারা দেহে দারুণ অস্বস্তি… এমন আরও একদিন হয়েছিল ওর। অনেক বন পেরিয়ে একদিন সে পৌঁছে গিয়েছিল প্রকাণ্ড ওই পাহাড়ের চূড়ায়… সব গাছ ছাড়িয়ে এক্কেবারে নীল আকাশের বুকে। দুরু দুরু করে ওঠে বুক– দূরে বহু দূরে নদীর রেখা সরু রুপোলি ফিতে… নদীর শব্দ ভেসে আসে না… কী বিশাল সীমাহীন চারপাশ… এই বিশাল শূন্যতায় বুনো যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে… নিদারুণ অসহায় মানসিক অবসাদে ডুবে যায় ওর অপরিপক্ক চৈতন্য। এই সব চিন্তার জাল ছিঁড়ে উঠে দাঁড়ায় বুনো…। ঢালু কপালের ওপর থেকে একগোছা খোঁচা খোঁচা চুল সে সরিয়ে দেয়। গুহার সামনে প্রকাণ্ড পাথরের বুকে ঝুঁকে পড়ে নদীর পানে তাকায়। এখনও নদীর পাড় ফাঁকা… সামনের ঝোঁপঝাড় নিশ্চল নিথর। অরণমধ্যস্থ ফাঁকা জায়গায় কেউ নেই। কোনও কিছুই নড়ে না… ভোরের আলোয় সকলেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ… বেতের জঙ্গলও নিরুত্তাপ নিশ্চুপ।
ওর পেছনে নিঃশব্দে রমণী শিশুকে নামিয়ে রাখে. কোনও কথা না বলে গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। মুখে অস্পষ্ট ধ্বনি খেলা করে শিশুর। একসময়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘাড় ফিরিয়ে বুনো একবার সব দেখে নেয়।
ক্রমেই পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে! আপন মনেই মুখে আওয়াজ করে চলে বুনো। অনেক শীত পেরিয়ে মন চলে যায় ওর শৈশবের দিনগুলিতে। স্মৃতি সব অস্পষ্ট ধোঁয়া ধোঁয়া– সে-ও নিজে এমন ছোট ছিল। অসহায় এক মাংসের তাল। জঠরের জ্বালায় এমন করেই কি কেঁদে উঠত সে… অন্য কোনও রমণী বুকে টেনে নিয়ে ওকে সুধাপান করাত?
আপন মনেই নিজের পুরু ঠোঁটের সাহায্যে শিশুর শব্দ মনে করার চেষ্টা করে। খসখস। গুহার পাশে কোনও কিছু যেন নড়ল। চকিতে ঘুরে দাঁড়াল বুনো… বিপদের সম্ভাবনায় পেশিবহুল শরীর টানটান হয়ে উঠল।
গুহার ঠিক ধারে ঝোঁপঝাড় ভেদ করে মাথা তুলেছে এক বুনো কুকুর। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে। পেটের জ্বালায় অধীর… রক্তলাল চোখ দুটো ঘুমন্ত শিশুর ওপরে স্থিরনিবদ্ধ।
পেটটা মাটিতে ঘসে চোরাপায়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে আসে কালান্তক যম। মানবক অঘোর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কোনও কিছু বোঝার আগেই কুকুরটা বেশ খানিকটা এগিয়ে আসে। ঝাঁপিয়ে পড়ার তোড়জোড় শুরু করে।
বুনোর চোখ দুটো হিংসায় জ্বলজ্বল করে ওঠে। গুহা থেকে ওর দূরত্ব অনেকখানি। দৌড়ে এসেও শিশুকে বাঁচানো যাবে না। ওর পৌঁছানোর আগেই শিকার মুখে নিয়ে পালিয়ে যাবে কুকুরটা। বুনো কুকুরের হিংস্র দাঁতের কামড়ে মুহূর্তে মৃত্যু ঘটে যাবে… দাঁতাল বাঘের মুখেও প্রাণ দিয়েছিল এমনি আর একটি শিশু।
মুহূর্তের জন্যে পাথর হয়ে গেল সর্বাঙ্গ… শিশুর পরিত্রাণের আর কোনও উপায় নেই।
হঠাৎ শিশুর ঠোঁট নাড়ার দৃশ্যটা মানসপটে ভেসে উঠল। বুনোর ঠোঁটও নড়ে উঠল। নিজের ঠোঁটের শব্দে নিজেই চমকে উঠল। চারপাশের নিস্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করে বুনোর ঠোঁটে তীক্ষ্ণধ্বনি উঠল… মা… মা… মা… মা…।
বুনো কুকুর চমকে উঠল। দু’পাটি হিংস্র দাঁত বার করে বুনোর পানে গর্জে উঠল। পরক্ষণেই সে লাফ দিল ঘুমন্ত শিশুর দিকে।
সেই মুহূর্তে হরিণ বেগে ধেয়ে এল রমণী। পূর্ব অভিজ্ঞতায় সে অভিজ্ঞ। ঝড়ের বেগে শিশুকে তুলে ছুটে গেল গুহার মধ্যে।
শূন্য হরিণের চামড়ার ওপরে কুকুরটা লাফিয়ে নামল। সঙ্গে সঙ্গে বুনোর ছোঁড়া পাথরের আঘাতে গর্জন করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল… দৌড়ে এল বুনো… আঘাতের পর আঘাত, ফলে রক্ত মাংস সব একাকার হয়ে গেল।
শিশুকে কোলে নিয়ে গুহার মধ্য থেকে বুনোর সামনে এসে দাঁড়াল রমণী। দাঁতাল বাঘের নির্মম স্মৃতির চিত্রটায় ক্ষতবিক্ষত বুনোর মনের ওপরে শান্তির প্রলেপ নেমে এল। আকাশ বাতাস যেন মধুময় হয়ে উঠল। শিশুকোলে রমণীর দিকে আঙুল তুলে ধ্বনি তুলল বুনো… মা… মা… মা… মা… প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্যূষে ভালোবাসার বন্ধন আরও নিবিড় হয়ে এল।