1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৮

আট

অনেকগুলো সাগর আর মহাসাগরের সংযোগস্থলে মাথা তুলে রেখেছে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশ। সেতু হতে পারত সাগরগুলোর মাঝে, তা না হয়ে হয়েছে বাধার প্রাচীর। উত্তরের বিশাল মরুভূমি, আর মধ্যভাগের ঘন জঙ্গল প্রায় দুর্ভেদ্যই বলা চলে। তাই কোনোকালেই কোনও বাণিজ্যপথ তৈরি হয়নি আফ্রিকার বুকে, কারণ এই দুর্গম মহাদেশের ওপর দিয়ে লাভজনকভাবে পণ্য পরিবহন সম্ভব নয়।

অতীতে আটলান্টিক আর ভারত মহাসাগরের মাঝে যাতায়াত করতে চাইলে দক্ষিণ আফ্রিকার তলা দিয়ে দশ হাজার মাইলের একটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হতো জাহাজগুলোকে, মোকাবেলা করতে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন জলপথের হাজারো বিপদ-আপদ। সুয়েজ খাল খননের পর সেই লম্বা সফর অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; আর বাস্তবতা হলো, এতে আফ্রিকার কোনও উপকার হয়নি। বাণিজ্যতরীগুলো এখন অনায়াসে সুয়েজ খাল দিয়ে ইয়োরোপ ও আমেরিকা থেকে পৌঁছুতে পারে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়। সহজে আনা-নেয়া করতে পারে তেল, খনিজ পদার্থ ও নানাবিধ পণ্য। এতে বেশিরভাগ দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতির উন্নয়ন হলেও আফ্রিকা আজও পড়ে আছে পেছনে, পড়ে পড়ে পচছে রোদের তাপে উচ্ছিষ্টের মত।

ফলাফল হিসেবে দেখা দিয়েছে হানাহানি, দুর্ভিক্ষ আর নানা রকম রোগব্যাধি। আফ্রিকার উপকূলের অনেক দেশই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর এলাকা। সোমালিয়া তো পুরোই একটা অরাজক দেশ, সুদানের অবস্থাও ভাল নয়। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে সভ্যজগতের অবহেলার নির্মম শিকার আইভরি কোস্ট, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে।

লাইবেরিয়ার সমস্যা কমবেশি সবাই জানে। নানা ধরনের স্ক্যাণ্ডাল ও দুর্নীতির দায়ে একের পর এক শাসকের পতন হয়েছে সেখানে, দেশটা ডুবে গেছে অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলতায়। শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে আইভরি কোস্টেও। ইতিহাসের দিকে তাকালে সবচেয়ে খারাপ দশা সিয়েরা লিওনের। বেশিদিন আগের কথা নয়, দেশটাকে আফগানিস্তানের চেয়েও বিপজ্জনক বলে ভাবা হতো; সেখানকার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান ছিল ‘হাইতি আর ইথিওপিয়ার চেয়ে নিম্নমানের। এতই নাজুক অবস্থায় ওরা চলে গিয়েছিল যে, একসময় হাতে গোনা কিছু দক্ষিণ আফ্রিকান মার্সেনারি দেশটা প্রায় দখলই করে নিয়েছিল।

সে-আমলের ক্ষমতাসীন সরকারই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে নিয়ে এসেছিল মার্সেনারি দলটাকে। সরকারি ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে তারা, কৌশলে জন্ম দেয় বিশাল এক বিপ্লবী-বাহিনীর। সেই বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে দেশের সমস্ত খনি দখলে নেবার চেষ্টা করে তারা। খনিগুলো ছিল সিয়েরা লিওনের একমাত্র সম্পদ।

বিশৃঙ্খল সেই পরিস্থিতিতে ধূমকেতুর মত উদয় হন জোসেফ আকুম্বা। সিয়েরা লিওনেরই নাগরিক, কিন্তু প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মার্সেনারিদের কাছে। মিলিটারি থেকে উত্থান তাঁর, অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ। খুব সাবধানে নিজের ভিত গড়েন তিনি, অধীনস্থ সৈনিকদের কাছ থেকে আদায় করে নেন নিঃশর্ত বিশ্বস্ততা, এরপর সুযোগ বুঝে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে দখল করে নিয়েছেন ক্ষমতা।

পরের কয়েক বছরে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন আকুম্বা, নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করেছেন, আদায় করেছেন পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করলেও দেশকে স্থিতিশীল করেছেন তিনি—এই অজুহাতে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো মেনে নিয়েছে তাঁকে। খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ সিয়েরা লিওনকে হাতে রাখতে চায় সবাই। এখন আর কেউ প্রশ্ন তোলে না তাঁর ছোট ভাই ড্যানিয়েল আকুম্বার বিষয়ে। সিয়েরা লিওনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন ড্যানিয়েল, সোচ্চার ছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে। গত তিন বছর ধরে কারাগারে বন্দি তিনি।

আপন ভাইকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে খারাপ লেগেছে প্রেসিডেন্ট আকুম্বার, তবে তাকে ঠেকানোর আর কোনও পথ ছিল না। তা ছাড়া হুকুমটা দেবার পরেই টের পেয়েছেন, দেশের জন্যে কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মম হতে পারেন তিনি—এই উপলব্ধি তাঁকে নতুন সাহস জুগিয়েছে। সিয়েরা লিওনের মত দেশ গণতন্ত্রের জন্যে প্রস্তুত নয়। যতদিন না লোকে সে- পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে, দেশটাকে সোজা পথে চালাবার জন্যে চাই তাঁর মত কঠিন ও একরোখা নেতা।

আফ্রিকার সনাতন স্বৈরশাসকদের সঙ্গে অবয়বে বিশেষ অমিল নেই প্রেসিডেন্ট আকুম্বার। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, ওজন আড়াইশো পাউণ্ড, ছোটখাট একটা দৈত্যই বলতে হয়। মাথাটা প্রকাণ্ড কালো তরমুজের মত, মুখে ছোট করে ছাঁটা গোঁফ ও দাড়ি। সবসময় ইউনিফর্ম পরে থাকেন, চোখে থাকে কালো সানগ্লাস। বুক ভরা মেডেল-রিবন, এতটুকু জায়গা খালি নেই। হাতে রাখেন একটা ঘোড়সওয়ারীর চাবুক।

লাঠির বদলে চাবুক রাখার আইডিয়াটা আকুম্বা পেয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত সমরনেতা জেনারেল প্যাটনের কাছ থেকে। তিনিও লাঠির বদলে এমন একটা চাবুক রাখতেন সবসময়। প্যাটনের ভক্ত আকুম্বা; শুনেছেন, নিজেকে তিনি হানিবাল দ্য গ্রেটের আধুনিক অবতার ভাবতেন। এ-কারণে আকুম্বা নিজেও হানিবালের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ধীরে ধীরে সে-আগ্রহ পরিণত হয়েছে গাঢ় অনুরাগে।

নানা দিক থেকেই প্রাচীন কার্থেজের জেনারেল হানিবাল ছিলেন পৃথিবীর বুকে ত্রাস সৃষ্টিকারী শেষ আফ্রিকান। অগণিত পদাতিক সৈন্য ও বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে আল্পস পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি, রোমান সাম্রাজ্যের মাটিতেই অভিযান চালিয়েছেন রোমানদের বিরুদ্ধে, পরাস্ত করেছেন ওদের বাহিনীর পর বাহিনী। শেষমেশ স্রেফ দূরপাল্লার অস্ত্রের অভাবে পতন ঘটাতে পারেননি রাজধানী রোমের, নইলে আফ্রিকার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত।

ওসব সুদূর অতীত। চরম অন্ধকারে এখন নিমজ্জিত হয়েছে আফ্রিকা। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যে ডুবে গেছে গোটা মহাদেশ। বাকি পৃথিবী এসবের নীরব দর্শক। খনিজ পদার্থ, তেল ও দামি ধাতুর সবচেয়ে বড় জোগানদার আফ্রিকা; সেগুলোর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে মাঝে মাঝে নড়েচড়ে বসে তারা, নানা রকম পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তাতে গরিব দেশগুলোর ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয় না। ঘুরেফিরে বিদেশি মোড়লদের সঙ্গে হাত মেলায় ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসকেরা, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে তাদের আদেশ- নির্দেশ নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। এটাই যখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, দুনিয়া কেন আফ্রিকার জন্যে আলাদা কিছু ভাবতে যাবে?

এসবের মাঝেই জন্ম নিয়েছেন আর্কুম্বা, বড় হয়েছেন এসবের মাঝে। আর সেজন্যেই তিনি চান, তাঁর শাসনামল যেন অন্য কোনও স্বৈরশাসকের মত না হয়। হ্যাঁ, বাকিদের মত বুলেটপ্রুফ রোলস-রয়েসে চড়েন তিনি; সঙ্গে থাকে সশস্ত্র দেহরক্ষীর বিশাল বাহিনী। সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন, মসনদে টিকে থাকার জন্যে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে লোক-দেখানো কিছু চুক্তিও করেছেন। কিন্তু দিনশেষে বিদেশিদের হাতের পুতুল হবার কোনও ইচ্ছে নেই তাঁর। বরং চান আরও বড় কিছু হতে… এমন কিছু, যার জন্যে সারাজীবন লোকে স্মরণ করবে তাঁকে। নতুন যুগের হানিবাল দ্য গ্রেট হতে চান তিনি, হতে চান জলজ্যান্ত কিংবদন্তি।

কাজটা সহজ নয়। আকুম্বা জানেন, কিংবদন্তি হবার জন্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন যথেষ্ট নয়; তাতে বড়জোর সুশাসক হিসেবে কিছু নামডাক হতে পারে, যার আয়ু ক্ষণস্থায়ী। হানিবাল দ্য গ্রেটের সমতুল্য হতে চাইলে হানিবালের মতই ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে তাকে—সমীহ আদায় করতে হবে দুনিয়ার বড় বড় সব দেশের কাছ থেকে। আর সেজন্যে চাই একটা মারণাস্ত্র, যেটা আফ্রিকার সীমানা পেরিয়ে দুনিয়ার যে-কোনও প্রান্তে আঘাত হানতে সক্ষম… ঘটাতে সক্ষম অপরিসীম ধ্বংসযজ্ঞ। সোজা কথায়, হানিবালের অপ্রতিরোধ্য হস্তিবাহিনীর একটা আধুনিক প্রতিস্থাপক চাই তাঁর।

সুখবর হলো, সেই অস্ত্র আকুম্বার হাতের মুঠোয় এসে গেছে প্রায়।

রাজধানী ফ্রিটাউনের প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসে, নিজের খাসকামরায় এ-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন আকুম্বা-জানালার দিকে মুখ করে। পালিশ করা মার্বেল পাথরের মেঝেতে প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁর কালো ছায়া। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন তিনি, অন্যমনস্ক। হাতঘড়ি দেখে খানিক পর উল্টো ঘুরলেন তিনি, মেহগনি কাঠের প্রকাণ্ড এক ডেস্কের পেছনে এসে বসলেন। চোখ থেকে খুলে রাখলেন সানগ্লাস। অপেক্ষা করছেন একটা ফোন কলের। একটু পরেই মৃদু শব্দে বেজে উঠল রিংটোন।

কোনও তাড়াহুড়ো করলেন না আকুম্বা, রিসিভারটা আলতো করে তুলে কানে ঠেকালেন।

‘কর্টেজ,’ শান্ত গলায় বললেন তিনি, ‘আশা করি ভাল খবর দেবে।’

‘ভালমন্দ দু’রকমই আছে,’ খসখসে গলায় জানানো হলো ওপাশ থেকে।

তোমার মুখ থেকে এ-ধরনের জবাব চাই না আমি,’ গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। ‘ব্যাখ্যা করো।’

‘যতটা গর্জেছে, ততটা বর্ষেনি আপনার অস্ত্র, বলল কর্টেজ। ‘হ্যাঁ, জাহাজের ক্ষতি হয়েছে… তবে আগের তিনবারের চেয়ে খুব বেশি নয়। নেভিগেশন আর কন্ট্রোল সিস্টেম ধ্বংস হয়েছে, তারপরেও পার্শিয়াল পাওয়ারে ঠিকই আগে বাড়ছিল ওটা। অর্ধেক ক্রুও জীবিত ছিল… মানে, যারা জাহাজের নিচের ডেকগুলোয় আটকা পড়েছিল আর কী। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার ওই ডিভাইস ঠিকমত কাজ করছে না।’

খবরটা সহজভাবে নিতে পারলেন না আকুম্বা। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল তাঁর। সাধের ওই মারণাস্ত্র আবারও প্রত্যাশিত পারফর্মেন্স দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, এ-খবর হজম করা কঠিন।

ছোট্ট একটা চিরকুটে একটা নাম লিখলেন তিনি। বেল বাজিয়ে ডাকলেন একজন এইডকে, তার হাতে ধরিয়ে দিলেন চিরকুটটা।

‘একে নিয়ে এসো, নির্দেশ দিলেন তিনি। এইড চলে গেলে আবার কথা বললেন কর্টেজের সঙ্গে। প্রশ্ন করলেন, ‘ক্রুদের কতজন জীবিত ছিল?’

‘বললাম তো, প্রায় অর্ধেক।’

‘ধরে নিচ্ছি এখন আর বেঁচে নেই তারা?

‘না… সবাই খতম।’

কর্টেজের গলায় দ্বিধার সুর টের পেলেন আকুম্বা। সামনে একটু ঝুঁকে গেলেন তিনি। ‘কার্গোর খবর কী?’

‘অফলোড করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে,’ জানাল কর্টেজ।

‘আর জাহাজটা?’

‘সাগরদেবীর পেটে।’

সন্তুষ্ট হতে পারলেন না আকুম্বা। কর্টেজের কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসের অভাব টের পাচ্ছেন। ধমকের সুরে বললেন, ‘কিছু একটা চেপে যাচ্ছ তুমি, কর্টেজ। খোলাসা করো!’

গলা খাঁকারি দিল কুচিয়ো। ‘অস্ত্রধারী কিছু লোক আমাদেরকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছে। জাহাজ নিয়ে হঠাৎ উদয় হলো। ওটার পতাকা দেখেছি আমি- আমেরিকান। লক্ষণ ভাল নয়। আমার তো মনে হচ্ছে, আপনার গুমর ফাঁস হয়ে গেছে, মি. প্রেসিডেন্ট।’

সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখলেন আকুম্বা, পরক্ষণে বাতিল করে দিলেন। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে আরাতামা মারুর ওপর হামলা করার সুযোগ পেত না কর্টেজ, তার আগেই থামানো হতো ওকে। এদেরকে কাকতালীয়ভাবে উদয় হওয়া কোনও রেসকিউ টিম ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলেন না।

‘কী করেছ ওদের নিয়ে?’ জিজ্ঞেস করলেন আকুম্বা।

‘কিছুই না। পালিয়েছি। যাতে পিছু নিতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করেছি। এর বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না।’

অবাক হলেন আকুম্বা। কর্টেজের সম্পর্কে ভাল করেই জানা আছে তাঁর। এই লোক কারও ভয়ে পালিয়ে আসবে, চিন্তাই করা যায় না।

‘তোমার ধার কমে যাচ্ছে, কুচিয়ো,’ ভর্ৎসনার সুরে বললেন তিনি।  

‘মোটেই না,’ আহত গলায় বলল কর্টেজ। ‘ওদেরকে সামনাসামনি দেখলে বুঝতেন। যাকে লিডার মনে হলো, সে রীতিমত শক্তপাল্লা। আপনি বরং ওদের পরিচয় জানার চেষ্টা করুন।’

মাথা ঝাঁকালেন আকুম্বা। তিনিও একই কথা ভাবছেন।

‘আপনার ওই অপারেশনের খবর কী?’ একটু অপেক্ষা করে জানতে চাইল কর্টেজ। ‘কী যেন নাম রেখেছেন… পাইথন, না? ওটা কি শুরু করছেন?’

অপারেশন . পাইথন আকুম্বার কূটকৌশলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নমুনা। ওটার মাধ্যমেই অসীম সম্পদের মালিক হবে তাঁর দেশ; আসবে সমৃদ্ধি ও স্থিতি। কিন্তু যদি ব্যর্থ হয়… আর ভাবতে চাইলেন না তিনি। যদিও জানেন, অস্ত্রটা যদি প্ল্যান মোতাবেক কাজ না করে, ব্যর্থতা এড়াবার কোনও উপায় নেই।

‘কাজটায় আর দেরি করা চলে না,’ কর্টেজকে বললেন তিনি।

‘আমি এসে সাহায্য করব আপনাকে?’ প্রস্তাব দিল কর্টেজ, কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ। আকুম্বাকে আগেই জানিয়েছে, যা তিনি করতে চাইছেন তা স্রেফ পাগলামি। এরচেয়ে বড় পাগলামি হলো, কাজটা করার জন্যে নিজের আর্মিকে দায়িত্ব দেয়া। সে-কথা কানে তোলেননি প্রেসিডেন্ট। কর্টেজ বাইরের লোক-সেনাবাহিনী তাঁর কতটা অনুগত, আর ওদের সামর্থ্য কতখানি, তা ওর জানবার কথা নয়।

মৃদু হাসলেন আকুম্বা। অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা দিচ্ছেন তিনি কর্টেজকে তার কাজের জন্যে, কিন্তু সন্দেহ নেই, এরচেয়েও বেশি টাকা বা ক্ষমতা লাভের সুযোগ পেলে লোকটা তাঁর পেছনে দৌড়াবে। এ-ধরনের মানুষের খাঁই পূর্ণ হবার নয়।

‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে,’ মৃদুকণ্ঠে বললেন তিনি। ‘শস্যখেতে সাপ থাকা ভাল—ইঁদুর খেয়ে ওরা ফসল বাঁচায়। কিন্তু বাড়িতে সাপ ঢুকলে বিপদ—যাকে-তাকে ছোবল দেবে, গিলে খাবে কচি বাচ্চাদের।’

একটু অপেক্ষা করে কথাটার অর্থ পরিষ্কার করে দিলেন প্রেসিডেন্ট। ‘তোমার টাকা তুমি পাবে, কর্টেজ। এত টাকা, যা দিয়ে ছোটখাট একটা দেশ হয়তো কিনে নিতে পারবে। কিন্তু ভুল করেও যদি কোনোদিন সিয়েরা লিওনে পা রাখো, খুন করব তোমাকে… লাশটা ছুঁড়ে দেব আমার বাগানের পোষা কুকুরগুলোর মুখে।’

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা বিরাজ করল, তারপর হালকা হাসির আওয়াজ ভেসে এল টেলিফোনে।

‘আপনার ব্যাপারে জাতিসংঘের ধারণা ভুল, বলল কর্টেজ। ‘নির্দয়, বর্বর মানুষ আপনি। অবশ্য আপনার মত লোকই দরকার আফ্রিকায়। যা হোক, যতক্ষণ টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, আপনার কাজ করতে থাকব। টাকা যেন ফুরিয়ে না যায়—পত্রপত্রিকায় সে-ধরনের আশঙ্কার কথা পড়েছি। বিকল্প কোনও পদ্ধতিতে পাওনা আদায় করতে ভাল লাগবে না আমার।’

হুমকিটা বুঝতে পারলেন আকুম্বা। তাকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না কুচিয়ো, অথচ পাওয়া উচিত। কোনও কিছুকেই ভয় করে না সে। এই বিশেষ গুণটির জন্যেই তাকে ভাড়া করা হয়েছে।

‘সান্তা মারিয়ায় চলে যাও,’ বললেন তিনি। ‘কী করতে হবে, সেটা ওখানে পৌঁছুবার পর জানাব আমি।

‘আরাতামা মারুর কী হবে?’ জিজ্ঞেস করল কর্টেজ। ‘কেউ যদি ওটায় তল্লাশি চালাতে চায়?’

‘তেমন কিছু ঘটলে সেটা সামাল দেবার জন্যে প্ল্যান আছে আমার।’

আবার হাসল কর্টেজ। ‘খালি প্ল্যান আর প্ল্যান। শুনলে হাসি পায়। শুভকামনা রইল, মি. প্রেসিডেন্ট। খবরের কাগজ থেকে জেনে নেব ওসব প্ল্যান কাজে লাগল কি না। নীরব সমর্থন থাকবে আমার।’

লাইন কেটে গেল। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন আকুম্বা। হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিলেন। চোখ তুলে তাকালেন দরজা খুলে যাওয়ায়। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিয়ে ফিরে এসেছে এইড। দু’জন অস্ত্রধারী প্রহরী তাকে এস্কর্ট করে নিয়ে আসছে।

লোকটা ভেতরে ঢুকলে হাতের ইশারা করলেন আকুম্বা। এইড আর প্রহরীরা বেরিয়ে গেল। এবার তিনি তাকালেন নবাগতের দিকে। চেহারায় বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

‘মি. ম্যালোন,’ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন প্রেসিডেন্ট, ‘তোমার অস্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। আবার!’

নির্বিকার রইল নাথানিয়েল ম্যালোন। ক্রুদ্ধ পিতার সামনে দাঁড়ানো অবাধ্য সন্তানের মত লাগছে তাকে। অনুমতির ধার ধারল না, এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল আকুম্বার মুখোমুখি। হাবভাবে মনে হলো, এটা তার অধিকার।

গত সতেরো মাস ধরে প্রেসিডেন্ট আকুম্বার জন্যে একটা ডাইরেক্টেড-এনার্জি ওয়েপন তৈরি করছে সে। লার্জ হ্যাডরন কলাইডারে যে-ধরনের সুপারকণ্ডাক্টিং চুম্বক রয়েছে, ঠিক একই ধরনের চুম্বকের সাহায্যে বানানো হয়েছে অস্ত্রটা। পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাকে বিদ্যুতায়িত করে আলোর গতিবেগে নিয়ে যায় ওটা, তারপর কণাগুলো একত্র করে ঘন একটা রশ্মির মত বানায়, সেই রশ্মি বা বিম দিয়ে রাঙিয়ে দেয়া হয় নির্দিষ্ট টার্গেট—ধ্বংস হয়ে যায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সার্কিট।

ঠিকমত টিউন করা হলে অতিকায় এক মাইক্রোওয়েভ বিমে পরিণত হয় রশ্মিটা, আভেনের মত গরম করে তুলে জৈব পদার্থে—সোজা ভাষায় মাংস বা গাছপালায়-একেবারে আগুন ধরিয়ে দেয়। কংক্রিট বা ইস্পাতের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়েও বাঁচার উপায় নেই।

আকাশে দু’শো মাইল পর্যন্ত কাজ করে এই রশ্মি, আগ্রাসী বিমান হামলা ঠেকিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। যুদ্ধের ময়দানে যদি রশ্মিটা ব্যবহার করা হয়, সেটা দেখাবে পানির পাইপ দিয়ে পিঁপড়ের গোটা একটা দল ধুয়ে-মুছে সাফ করবার মত। অস্ত্রটা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছুবে, তখন ওটা দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া যাবে গোটা একটা শহর। তাতে নিউক্লিয়ার বোমার মত স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সবকিছু উজাড় হয়ে যাবে না, বরং শল্য-চিকিৎসকের ছুরির মত নিখুঁতভাবে ধ্বংস করা যাবে বাছাই করা এলাকা, এমনকী নির্দিষ্ট কোনও বিল্ডিং। চাইলে সেখানকার মানুষদের মেরে ফেলা যাবে, কিংবা মানুষদের বাঁচিয়ে রেখে চোখের পলকে ধ্বংস করে দেয়া যাবে সব ধরনের প্রযুক্তি। প্রাণহানি ছাড়াই একটা শহরকে বন্ধ্যাভূমিতে পরিণত করা যাবে, কারণ আজকালকার জামানায় কম্পিউটার, টেলিফোন, বিদ্যুৎ বা বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ছাড়া কোনও জনপদ কল্পনাই করা যায় না।

কিন্তু এ-ধরনের ক্ষমতার মালিক হতে চাইলে অস্ত্রটা কার্যকর হতে হবে—এখন পর্যন্ত সেটাই হয়নি। আর সে- কারণেই আকুম্বা অসন্তুষ্ট। অধৈর্য গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাজ হলো না কেন, বলতে পারো?’

চেয়ারে হেলান দিল ম্যালোন। ‘আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম—আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। বলিনি?’

‘এবারেরটা তোমার শেষ পরীক্ষা হবার কথা ছিল।’

‘কী হয়েছে বোটটার?’

‘বোট না, শিপ,’ শুধরে দিলেন আকুম্বা। ‘বড়-সড় একটা সমুদ্রগামী জাহাজ।’

কাঁধ ঝাঁকাল ম্যালোন। ‘বোট বলুন, বা শিপ… আমার কাছে সবই এক।’

‘সবকিছুকে এক কাতারে দেখা তোমার একটা বদভ্যাস,’ বিরক্ত গলায় বললেন আকুম্বা। ‘নব্বুই হাজার টনের একটা জাহাজ কখনোই বোটের সমতুল্য হতে পারে না।’

‘বেশ, তা হলে জাহাজ-টার ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেটাই নাহয় বলুন,’ খোঁচা মারা সুরে বলল ম্যালোন। প্রেসিডেন্টের আচরণ তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। লোকটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে একটা মিস্ত্রি, যাকে বাজার থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ কিনে কোনও টিভি বা কম্পিউটার মেরামতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

‘ওটা এখন সাগরের তলায়,’ বললেন আকুম্বা।

‘আর কার্গো?’

‘তোমার চাহিদা অনুযায়ী টাইটেনিয়ামের প্রলেপ দেয়া একশো টন ওয়াইবিসিও সরিয়ে নেয়া হয়েছে ওই জাহাজ থেকে।’

‘তা হলে তো খবর ভাল।’

‘না!’ চাবুক দিয়ে ডেস্কের ওপর একটা বাড়ি মারলেন আকুম্বা, মেজাজ হারিয়েছেন। ‘খবরটা ভাল হতো, যদি তুমি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে। ভাল হতো, যদি অস্ত্রটা যেভাবে চেয়েছি সেভাবেই কাজ করত—এক আঘাতেই জাহাজ সম্পূর্ণ অচল হয়ে যেত, আর প্রত্যেকটা ক্রু মারা যেত। কিন্তু তা ঘটেনি, জাহাজটাকে আংশিক সচল অবস্থায় পেয়েছে আমার লোকেরা, অর্ধেকের মত ক্রুও জীবিত ছিল। তাদেরকে পরে আলাদাভাবে খুন করতে হয়েছে।’

প্রেসিডেন্টের মেজাজ-মর্জির সঙ্গে পরিচিত ম্যালোন। চাবুকের আওয়াজে একটু কেঁপে উঠলেও সাহস হারায়নি। নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘তাতে কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে মানে?’ তেতে উঠলেন আকুম্বা। ‘আমার লোকেরা চোখে পড়ে গেছে। আমেরিকান একটা জাহাজ হাজির হয়েছিল ওখানে। ভুল লোকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছি আমরা, আর এর জন্যে দায়ী তুমি… তোমার খামখেয়াল।’

চেয়ারে নড়েচড়ে বসল ম্যালোন। প্রেসিডেন্টের ক্রোধ দেখে ভীত হবার কথা তার, কিন্তু হচ্ছে না। সে জানে, যতই খেপুক লোকটা, ওর কিছুই হবে না। ফুলের টোকাও দেয়া হবে না ওর গায়ে। আকুম্বার হাত-পা বাঁধা—ওকে ছাড়া তাঁর মহা-পরিকল্পনা সফল হবার কোনও সম্ভাবনা নেই।

শুরু থেকেই সবদিক গুছিয়ে কাজে নেমেছে ম্যালোন। কিডন্যাপিঙের নাটক সাজানোর আইডিয়াটা সে-ই দিয়েছিল। আকুম্বার কাজটা শেষ করার পর আবার পুরনো দুনিয়ায় ফিরতে চায় সে, নিজ থেকে উধাও হয়ে গেলে তা সম্ভব হতো না।

এনার্জি ওয়েপন তৈরির পুরো কাজ সে করেছে এক হাতে। ডিজাইন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটা জিনিস তার নিজের বানানো। এমনকী মূল অস্ত্রটা নির্মাণের সময়ও সে-ই সুপারভাইজর হিসেবে থেকেছে, কাউকে দায়িত্বটায় ভাগ বসাতে দেয়নি। নিজেকে পুরো প্রজেক্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে, যাতে ওকে বাদ দিয়ে এক কদমও আগে বাড়তে না পারে ওর নিয়োগকর্তা। কাজেই ফাঁপা হুমকি বা ধমকি দেয়া ছাড়া ওর বিরুদ্ধে কিছুই করা সম্ভব নয় আকুম্বার পক্ষে।

মনে মনে হাসল ম্যালোন। শান্ত গলায় বলল, ‘যে- কোনও যন্ত্রই ফাইন টিউনিঙে সময় লাগে। আপনার কি ধারণা, যেনতেনভাবে একটা সুপার-কলাইডার বানালেই সেটা কাজ করে? কক্ষণো না। বেসিক একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাবার আগেও মাসের পর মাস টেস্টিং আর ক্যালিব্রেশন করতে হয়।’

‘মাসের পর মাসই পেয়েছ তুমি,’ রুক্ষ শোনাল আকুম্বার কণ্ঠ। ‘না, আর কোনও এক্সপেরিমেন্ট নয়, পরের বার ফুল- স্কেল ডেমোনস্ট্রেশন হবে।’

‘অস্ত্রটা তৈরি নয়।’

আত্মনিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ল আকুম্বার জন্যে। ‘তৈরি যাতে থাকে, সে-ব্যবস্থা করো,’ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি। ‘নইলে আমাদের বিরুদ্ধে যখন অ্যাকশন শুরু হবে, আমার পাশাপাশি তোমাকেও মরতে হবে।’

বিভ্রান্তি ফুটল ম্যালোনের চেহারায়। কীসের অ্যাকশন? শুরু থেকেই আকুম্বা তাকে বলেছেন, অস্ত্রটা তৈরি করা হচ্ছে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে—তাও কোনও নির্দিষ্ট দেশের কাছে নয়, বিশ্বের ক্ষমতাধর সবগুলো দেশের কাছেই বিক্রি করা হবে ওটা। এতদিন পরস্পরের দিকে নিউক্লিয়ার মিসাইল তাক করে রেখেছে ওরা, এখন থেকে নাহয় এনার্জি ওয়েপন তাক করবে। মাঝখান থেকে টাকা-পয়সার বন্যায় ভাসবে ওরা। প্ল্যানটা নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত। তা হলে মরার কথা উঠছে কেন?

‘আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,’ বলল সে।

‘কারণ, তোমাকে এতদিন আমি মিথ্যে কথা বলেছি,’ বাঁকা হাসি হাসলেন আকুম্বা। ‘অস্ত্রটা নিয়ে আমার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিকল্পনা আছে। তোমার মত ভদ্রলোকের সঙ্গে ছলনা করেছি বলে দুঃখিত।’

খোঁচাটা জায়গামত লাগল। এক নিমেষেই ম্যালোন বুঝতে পারল, তাকে কোন্ চোখে দেখেন প্রেসিডেন্ট। প্রজেক্টের জন্যে নিজেকে অপরিহার্য করে তুললেও এক বিন্দু সম্মান আদায় করতে পারেনি সে। নিজের আবিষ্কার নিয়ে গর্ব, অগাধ ধনসম্পদের হাতছানি… সবই তেতো লাগল তার। সার্নের দিনগুলোতেও নিজেকে এতটা ছোট লাগেনি কখনও।

একটা ফাইল টেনে নিলেন আকুম্বা। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘দারুণ এক নকশা সাজিয়ে এ-দেশে এসেছ তুমি, ম্যালোন। ভেবেছ আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে। ভয়ঙ্কর একটা মারণাস্ত্র বানাবে, অথচ সেটার কোনও দায় নেবে না। সুইস ব্যাঙ্কে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে ফিরে যাবে পুরনো জীবনে, কিডন্যাপারদের হাতে বন্দিজীবনের গল্প শুনিয়ে হিরো সাজবে। তোমার কষ্টের কাহিনী শুনে ব্যথিত হবে লোকে, জীবনবাজি রেখে পালানোর কাহিনী শুনে হবে রোমাঞ্চিত। কী করে তা হতে দিই, বলো?’

‘আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল,’ থমথমে গলায় বলল ম্যালোন।

‘চুক্তি বদলানো যায়। আর তুমি সেটা সহজ করে দিয়েছ আমার জন্যে।’

ফাইল থেকে দুটো ছবি বের করলেন আকুম্বা, ঠেলে দিলেন ম্যালোনের দিকে। প্রথমটা পুলিশের তোলা। তুষারাবৃত প্ল্যাটফর্মের ওপর পড়ে থাকা ফিলিপ নোয়ার মৃতদেহের ছবি। দ্বিতীয়টাতে দেখা যাচ্ছে সাদা কাপড়ের ওপর সযত্নে রাখা একটা পিস্তল। অস্ত্রটা বড়ই পরিচিত।

‘তুমি একটা খুনি, ম্যালোন,’ শীতল গলায় বললেন আকুম্বা।

চেয়ারের ওপর কুঁকড়ে গেল ম্যালোন।

‘অমন করছ কেন? বিদ্রূপের সুরে বললেন আকুম্বা। ‘কথাটা তো সত্যি। জায়গামত সিকিউরিটি ক্যামেরা ছিল না বলে সত্যটা জানে না কেউ। কিন্তু শুনে রাখো, যদি তুমি পালাবার চেষ্টা করো, বেঈমানি করো, কিংবা অনর্থক দেরি করাও আমার কাজে, সব ফাঁস করে দেব আমি। প্ৰমাণ হিসেবে পুলিশের হাতে তুলে দেব তোমার ফিঙ্গারপ্রিন্টঅলা ওই পিস্তলটা।’

মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে ম্যালোনের। পরিষ্কার বুঝতে পারছে, ফাঁদে পড়ে গেছে সে। আকুম্বার মনে যা-ই থাকুক না কেন,

সেই মোতাবেক কাজ করতে হবে তাকে। নইলে ধ্বংস হয়ে যাবে চিরতরে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে, এরপর মুখ খুলল। ‘আপনি ভাল করেই জানেন, আমি বেঈমানি করব না। প্রজেক্টটা আমার নিজের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ।’

‘তারপরেও ব্যর্থ হচ্ছ তুমি।’

‘ব্যর্থ হচ্ছি স্রেফ আপনার টাইমটেবলের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে। একটু যদি সময় দেন…

আকুম্বা মাথা নাড়লেন। ‘না। ওটা বদলানো যাবে না।’ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ম্যালোনের। এর অর্থ, সত্যটা এবার স্বীকার করে নেয়াই ভাল।

‘বেশ,’ সে বলল, ‘আমি দেখছি কী করা যায়। তবে আপনার জানা থাকা দরকার, অস্ত্রটার শক্তি বাড়ানোর স্রেফ দুটো পন্থা আছে–হয় আরও ভাল কোয়ালিটির কাঁচামাল এনে দিতে হবে, নয় তো… আপনি যদি কাজটা দ্রুত শেষ করাতে চান, বাড়তি সাহায্য লাগবে আমার।’

হেসে উঠলেন আকুম্বা, প্রথমে নিঃশব্দে, এরপর উচ্চকিত হলো, তাঁর হাসির আওয়াজ। ম্যালোনের মুখ দিয়ে শেষ কথাটা বের করাতে পেরে আনন্দিত।

‘যাক, শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলে!’ বললেন তিনি। ‘যতটুকু গিলতে পারবে, তারচেয়ে বেশিই কামড় দিয়ে বসেছ, তাই না? সমস্যাটা এখন তোমার নাগালের বাইরে চলে গেছে, একাকী সমাধান করতে পারছ না।’

‘ব্যাপারটা মোটেই তা নয়,’ মিনমিনে গলায় বলল ম্যালোন।

‘নয়? তা হলে এখনও কাজ শেষ হয়নি কেন? দেড় বছর সময় পেয়েছ তুমি, যত টাকা চেয়েছ ততই দেয়া হয়েছে। আমার তরফ থেকে খামতি কোথায়? তোমার পেছনে যা খরচ করেছি; তা দিয়ে এ-দেশের কত লোকের খাবার আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তা জানো?’

এ-অবস্থাতেও কৌতুক বোধ করল ম্যালোন। তাকাল চারদিকে। রাজপ্রাসাদ বললেও কম বলা হয় বিল্ডিংটাকে—বানানো হয়েছে বিদেশ থেকে আনা পাথর দিয়ে। দেয়ালে কারুকাজ, ছাত থেকে ঝুলছে বহুমূল্য ঝাড়বাতি। বাথরুমে পর্যন্ত লাগানো হয়েছে সোনায় মোড়ানো ফিটিংস। ওর পেছনে টাকা অপচয় হয়েছে… এগুলোর পেছনে হয়নি?

‘যন্ত্রটা অত্যন্ত জটিল,’ সোজা হয়ে বলল সে। ‘খুঁটিনাটি দেখার জন্যে আরও বিশেষজ্ঞ দরকার। আমি তো আর সবজান্তা নই।’

গনগনে চোখে তার দিকে তাকালেন আকুম্বা। তাঁর রক্তিম দৃষ্টি যেন এনার্জি ওয়েপনের রশ্মির মত দগ্ধ করছে ম্যালোনকে। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এসব আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।’ চেয়ারে হেলান দিলেন। ‘কাজে ফিরে যাও। যা যা চেয়েছ, সব পাবে- কাঁচামাল আর বাড়তি সাহায্য। এরপর তিনটে হাতই কাটা পড়বে তোমার!’

ভুরু কুঁচকে কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন তিনি ওর মুখের দিকে। সামান্যতম দয়ামায়ার চিহ্ন নেই সে দৃষ্টিতে।

‘তিনটে হাত??’ ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ম্যালোন।

‘বুঝলে না? ডান হাত, বাঁ হাত আর তোমার মিথ্যে অজুহাত। কোনও কৈফিয়ত শুনব না আমি আর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *