1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৪

চার

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে পূর্ব আটলান্টিকের বুকে। নুমা-র জাহাজ নেপচুন-এর ডেকে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা, তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে। এইমাত্র জাহাজের আপার ডেকে পঞ্চাশ চক্কর দিয়ে এল। নেপচুনের একটাই সমস্যা, সামনের ডেক আর পেছনের ডেক একই লেভেলে নয়। তাই প্রতিবার সামনের অংশটা শেষ করে সুপারস্ট্রাকচারে ঢুকতে হয়েছে ওকে, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়েছে দুটো লেভেল, তারপর যেতে হয়েছে আফট ডেকে। এভাবেই ওঠানামা করতে করতে দিতে হয়েছে এতগুলো চক্কর। হাঁপ ধরে গেছে।

এত ঝামেলার অবশ্য প্রয়োজন ছিল না, জাহাজের এক্সারসাইজ রুমে অনায়াসে সকালের শরীরচর্চা সেরে নেয়া যেত। কিন্তু খোলা আকাশের নিচে… ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ ছেড়ে জাহাজের বদ্ধ কামরায় গিয়ে ব্যায়াম করার কোনও আগ্রহ পায়নি রানা। সাগর হলো মুক্তির প্রতীক, মুক্ত পরিবেশ ছেড়ে কেন চার দেয়ালের ভেতরে ঢুকবে?

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রথম শ্রেণীর এজেন্ট হবার কারণে কঠিন শৃঙ্খলায় থাকতে হয় রানাকে, চলতে হয় হাজারো নিয়মকানুন মেনে। সদা-সতর্ক, এক ধরনের বন্দিজীবন সেটা। সেসবের কোনও বালাই নেই সাগরে। এখানে এলে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ পায় ও। সেজন্যেই সাগরকে ভালবাসে রানা, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রযাত্রায়।

এবার অবশ্য স্রেফ সাগরের টানে আসেনি ও। আমেরিকান সরকারের সমুদ্র-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল আণ্ডারওয়াটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সি, বা নুমায় স্পেশাল প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে অবৈতনিক একটা পদ রয়েছে ওর। ঠেকায়-বেঠেকায় ওর সাহায্য নেন নুমার ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন-বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের পুরনো বন্ধু; সেসব কাজের সুবিধের জন্যেই পদটা দেয়া হয়েছে ওকে। এবার সেই পরিচয়েই নেপচুনে উঠেছে ও—বিশেষ এক কাজের দায়িত্ব নিয়ে। আমেরিকান সরকার তো বটেই, বাংলাদেশেরও স্বার্থ আছে এতে।

দু’সপ্তাহ পেছনে চলে গেল রানার মন—বিসিআই চিফের চেম্বারে। কল্পনার চোখে দেখতে পেল রাহাত খানকে, চুরুট টানছেন গম্ভীর ভঙ্গিতে। কানে ভেসে এল তাঁর গলা।

‘আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব অংশে রহস্যজনক ব্যাপার-স্যাপার ঘটছে,’ কোনোরকম ভূমিকা না করে বললেন তিনি। ‘গত এক মাসে তিন-তিনটে জাহাজ উধাও হয়ে গেছে কোনও নিশানা না রেখে। দুটো আমেরিকান, আর একটা বাংলাদেশি।’

‘দুর্ঘটনা, স্যর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

মাথা নাড়লেন রাহাত খান। ‘কোনও ধরনের ডিসট্রেস সিগনাল দেয়নি ওরা। পূর্ব আটলান্টিকে গত মাসে কোনও টাইফুন বা সুনামি হয়নি। রহস্যজনক, বললাম তো।’

‘পাইরেসির শিকার হয়নি তো?’

‘ভারত মহাসাগর হলে সে-কথা ভাবা যেত। ধরে নেয়া যেত যে, সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। কিন্তু পূর্ব আটলান্টিকে তেমন কোনও জলদস্যু নেই। আর যদি জলদস্যুদের হাতে আটকও হতো, এতদিনে মুক্তিপণের দাবি পাওয়া যেত। কিন্তু কেউ যোগাযোগ করেনি এখন পর্যন্ত।’

‘কোনও মিল আছে জাহাজগুলোর মধ্যে? তা হলে হয়তো আন্দাজ করা যাবে কে টার্গেট করতে পারে ওগুলোকে।’

‘তিনটেই কার্গো শিপ, আর কোনও মিল নেই। আমেরিকান জাহাজদুটো যাচ্ছিল পর্তুগালের লিসবন আর মধ্যপ্রাচ্যে। সাধারণ রপ্তানিপণ্য বহন করছিল ওগুলো। বাংলাদেশি জাহাজটা… এমভি বাংলার উল্লাস… ব্রাজিল থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে ফিরে আসছিল চট্টগ্রামে।’

‘কোনোটাতেই তো তা হলে খুব দামি কার্গো ছিল না।’

‘সেজন্যেই কেউ কোনও তল খুঁজে পাচ্ছে না। আমরাও অন্ধকারে। বাংলার উল্লাস সরকারি জাহাজ- বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ওটার মালিক। ওরা মোটামুটি নিশ্চিত, দুর্ঘটনা নয়, কোনও ধরনের স্যাবোটাজ বা চক্রান্তের শিকার হয়েছে জাহাজটা। বিসিআইকে অনুরোধ করেছে ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখার জন্যে। কার্গো আর জাহাজের দাম বাদ দিলেও ত্রিশজন বাঙালি ক্রু ছিল ওটায়, ব্যাপারটা হালকাভাবে দেখার উপায় নেই।’

‘কিন্তু আমরাই বা কী করব, স্যর? আটলান্টিক মহাসাগরে তল্লাশি চালাবার মত রিসোর্স তো বিসিআইয়ের নেই।’

‘নুমার আছে,’ বললেন রাহাত খান। ‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। একটা জাহাজ পাঠাচ্ছে ওরা খোঁজখবর নেয়ার জন্যে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি আর নুমার প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে তুমিও উঠবে ওতে…

সে-রাতেই ঢাকা ছেড়েছে রানা। আমেরিকায় পৌঁছে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ব্রিফ নিয়েছে, তারপর উঠে পড়েছে নেপচুনে। হারানো তিন জাহাজের শেষ রিপোর্টেড পজিশন থেকে সম্ভাব্য গতিপথ ধরে এগোচ্ছে ওরা। তল্লাশি চালাচ্ছে জাহাজে বসানো নানা রকম অত্যাধুনিক ইকুইপমেন্টের সাহায্যে। এখন পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। দুয়ে এক রহস্য হয়ে উঠেছে জাহাজতিনটের অন্তর্ধান।

দিগন্তের দিকে তাকাল রানা, উদীয়মান সূর্যের কিরণে কালচে নীল থেকে ধীরে ধীরে ধূসর নীলে পরিণত হচ্ছে আকাশ। পাশ ফিরতেই ডানদিকে কিছু একটা চোখে পড়ল ওর। সরু একটা ধোঁয়ার রেখা, আকাশের পানে ‘উঠছে। দৌড়ানোর সময় ওটা দেখতে পায়নি ও, আঁধারে অদৃশ্য হয়ে ছিল ধোঁয়াটা। এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

চোখ পিটপিট করল রানা। আলোকস্বল্পতার জন্যে বোঝা যাচ্ছে না ধোঁয়ার উৎস। তাড়াতাড়ি পা চালাল ও, সিঁড়ি ধরে উঠে এল ব্রিজে।

চার্ট টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন ট্রেভর মিচাম—নেভিগেশন অফিসার ও অফিসার অভ দ্য ওয়াচকে নিয়ে প্লট করছেন অ্যাযোর্স দ্বীপপুঞ্জে যাবার কোর্স। দশদিনের ট্রিপ শেষে জাহাজের ফিউয়েল ও খাবারদাবার ফুরিয়ে এসেছে; রিফিউয়েলিং ও রিপ্লেনিশমেন্ট না করলেই নয়। আগেই ঠিক করা হয়েছে, ইয়োরোপের উপকূলে অ্যাযোর্সের সান্তা মারিয়া দ্বীপে করা হবে ওসব। জাহাজের ক্রুদেরও কয়েকদিনের বিশ্রাম দেয়া হবে ওখানে। এরপর আবার শুরু হবে তল্লাশি।

রানার উপস্থিতি টের পেলেও চার্ট থেকে মুখ তুললেন না ক্যাপ্টেন। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘দৌড়াদৌড়ি শেষ হয়েছে আপনার? ডেক তো ক্ষয় করে ফেলছেন।’

‘আপাতত শেষ,’ বলল রানা। ‘তবে জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে আপনাকে। হেডিং, ওয়ান-নাইন-যিরো।’

এক পলকের জন্যে চোখ তুললেন মিচাম। আবার চার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকে আগেই বলেছি, পানিতে কিছু পড়ে গেলে সাঁতার কেটে নিয়ে আসবেন। আমি জাহাজ ঘোরাতে পারব না।’

একটু হাসল রানা, পরক্ষণে গম্ভীর হলো। পরিস্থিতি গুরুতর।

‘স্টারবোর্ড সাইডে ধোঁয়া দেখতে পেয়েছি আমি,’ বলল ও। ‘মনে হয় না কেউ পিকনিক করছে ওখানে।’

সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন মিচাম। কৌতুক সরে গিয়ে চেহারায় ফুটে উঠেছে গাম্ভীর্য। সাগরে অগ্নিকাণ্ড কোনও হেলাফেলার বিষয় নয়। জাহাজের সবচেয়ে বড় শত্রুই হলো আগুন। আর যদি হোল্ডে দাহ্য পদার্থ থাকে, জাহাজের ধ্বংস নিশ্চিত।

রানার ওপর অগাধ আস্থা ক্যাপ্টেনের, সত্যিই ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে কি না তা চেক করতে গেলেন না। হুকুম দিলেন, ‘জাহাজ ঘোরাও। ওয়ান-নাইন-যিরো হেডিঙে নিয়ে এসো আমাদের। ফ্ল্যাঙ্ক স্পিড।’

সাড়া দিয়ে জাহাজের কোর্স বদলাতে শুরু করল হেলমসম্যান। রানাকে নিয়ে স্টারবোর্ড সাইডের ব্রিজ উইঙে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। বিষুবরেখার কাছাকাছি রয়েছে নেপচুন, এই এলাকায় দ্রুতই আলো ফোটে। খালি চোখেই এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব। চোখে পড়ছে ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী, পাক খেতে খেতে বাতাসের প্রবাহে খানিকটা পশ্চিমদিকে হেলে উঠে যাচ্ছে আকাশে।

‘কার্গো ভেসেলের মত লাগছে,’ বললেন মিচাম। চোখ থেকে বিনোকিউলার নামিয়ে তুলে দিলেন রানার হাতে।

জ্বলন্ত জাহাজটাকে ভাল করে দেখল রানা। মাঝারি আকারের একটা জাহাজ—কন্টেইনার শিপ নয়, বাল্ক ক্যারিয়ার। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভাসছে পানিতে।

‘তেলের ধোঁয়া,’ বলল ও। ‘পুরো জাহাজই ঢাকা পড়ে গেছে, তবে আফটের দিকে ধোঁয়াটা বেশি ঘন।’

‘ইঞ্জিন রুমে আগুন লেগেছে,’ অনুমান করলেন মিচাম। ‘কিংবা পেছনের কোনও বাঙ্কারে।’

রানাও একই কথা ভাবছে। জানতে চাইল, ‘কোনও ডিসট্রেস কল পেয়েছিলেন?

‘না। আপনি না বললে জানতেই পারতাম না যে, কোথাও কোনও আগুন লেগেছে।’

আগুনে ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম অচল হয়ে পড়েছে নাকি? সেজন্যে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি জাহাজটা? বিশ্বাস হলো না রানার। আজকালকার জাহাজে অনেক ধরনের ব্যাকআপ থাকে—হ্যাণ্ডহেল্ড ট্রানসিভার, ইমার্জেন্সি বিকন… এমনকী লাইফবোটেও রেডিও থাকে। এত বড় একটা জাহাজ আগুনে পুড়তে পুড়তে সাগরে ভাসবে, অথচ সাহায্যের আবেদন পাঠাবে না—এমনটা হতেই পারে না।

নেপচুনের নাক ঘুরে গেছে, এখন ওরা সরাসরি এগোচ্ছে জ্বলন্ত জাহাজটার দিকে। গতিও বাড়ছে। শান্ত সাগরে ত্রিশ নট পর্যন্ত স্পিড তুলতে পারে নেপচুন, পৌঁছুতে বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ মাইল দূরে রয়েছে জাহাজটা, রানার প্রাথমিক আন্দাজের চেয়ে কাছে—এটা সুখবর।

কিন্তু দশ মিনিট পর বিনোকিউলারে তাকিয়ে দমে গেল ও। বেশ কিছু জিনিস এবার চোখে পড়েছে, যা দুঃসংবাদের নামান্তর। জাহাজের ডেকের সবক’টা হ্যাচ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের শিখা, তারমানে পুরো জাহাজটাই জ্বলছে। আগুন স্রেফ ইঞ্জিন রুমে সীমাবদ্ধ নয়। বামদিকে কাতও হয়ে গেছে জাহাজটা, সামনের অংশ তলিয়ে গেছে অনেকখানি। এর অর্থ, খোলের ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করেছে। সবচেয়ে খারাপ খবর হলো, বেশ কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে ডেকে—রেইলের দিকে কাউকে টেনে আনছে তারা।

প্রথমে মনে হলো, আহত কোনও নাবিককে উদ্ধার করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরেই তাকে ছেড়ে দিল ওরা। ডেকের ওপর পড়ে গেল মানুষটা। নিজের চেষ্টায় কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়াল সে, উদ্‌ভ্রান্তের মত দৌড়াতে শুরু করল একদিকে। বেশিদূর যেতে পারল না, তিন কি চার কদম গিয়েই আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বেচারা।

ঝট্ করে পেছনের লোকগুলোর দিকে বিনোকিউলার ঘোরাল রানা। পরিষ্কার দেখল, একজনের হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। গর্জে উঠল অস্ত্রটা। এতদূর থেকে শব্দ শোনা না গেলেও মাযল ফ্ল্যাশ দেখতে পেল ও। একবার… দু’বার।

ডেকে পড়ে থাকা হতভাগ্য নাবিকের ওপর আবার বিনোকিউলার তাক করল রানা। নিথর হয়ে গেছে সে।

কী ঘটছে বুঝতে আর অসুবিধে হলো না। সশস্ত্র জলদস্যুরা হামলা করেছে জাহাজটায়। যা ভেবেছিল, পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। বিনোকিউলার নামিয়ে নিল রানা। উদ্ধার অভিযান নয়, আরও বড় কিছু এখন করতে হবে ওদেরকে।

‘ক্যাপ্টেন,’ বলল ও, ‘ঝামেলাটা ডালপালা মেলেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *