1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৪

চৌত্রিশ

সাবমারসিবলের বাইরে এসেই দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করল রানা। হাত-পায়ের শক্তিশালী স্ট্রোকে এগিয়ে চলেছে সামনে।

পায়ের ফিনগুলো আকারে ছোট, তারপরেও যথেষ্টই সাহায্য করছে গতি বাড়াতে। মাস্ক পরায় সামনেটা দেখতেও পাচ্ছে পরিষ্কার। একহাতে রয়েছে হ্যামারহেডের ড্যাশবোর্ড থেকে খুলে আনা একটা ছোট কম্পাস। স্বাভাবিকভাবে উত্তর মেরুর দিকে ঘুরে থাকার কথা কাঁটা; কিন্তু রানা আশা করছে, এ-মুহূর্তে আশপাশের সবচেয়ে শক্তিশালী চুম্বকের দিকে ঘুরে যাবে ওটা… মানে, ম্যাগনেটিক টাওয়ারটার দিকে।

টাওয়ারটা যে ভুয়া, সে-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই ওর মনে। তবে এ-ও জানে, টাওয়ারের ম্যাগনেটিজমটা নকল নয়। ভেতরে কোনও ডিভাইস বসানো হয়েছে হয়তো, কিংবা রাখা হয়েছে উচ্চ ক্ষমতার কোনও চৌম্বকীয় পদার্থ। আসল ব্যাপার যা-ই হোক না কেন, তাতে কিছু যায়-আসে না ওর। আপাতত ওটা ওকে দিক দেখালেই চলে।

একটা ফ্লেয়ার জ্বালল রানা, আলোতে দেখে নিল কম্পাসটা। কাঁটাটা বাঁয়ে নির্দেশ করছে। ধরে নিল ওদিকেই আছে টাওয়ারটা। টাওয়ারকে পেছনে ফেলে পুবদিকে এগিয়েছিল হ্যামারহেড-সেটা মাথায় রেখে দ্রুত একটা হিসেব কষে নিল, তারপর হেডিং বদলে এগোতে থাকল সামনে।

পাঁচ মিনিটের মাথায় ডুবে থাকা একটা জাহাজের কাছে পৌঁছুল ও। ওটাকে পাশ কাটিয়ে আরও দু’মিনিট এগোবার পর দেখতে পেল পুরনো বিমানটার ট্রিপল টেইল। সাঁতারের গতি বাড়িয়ে দিল—স্রেফ সময় বাঁচাবার জন্যে নয়, শরীরকে সচল রাখবার জন্যেও। পরিশ্রমের মাধ্যমে গরম রাখছে পেশিগুলো, নইলে হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হবে।

ফিউযেলাযের গায়ে চওড়া ফাটলটার কাছে পৌঁছে গেল খুব শীঘ্রি। সাবধানে ঢুকে পড়ল ভেতরে। গতকাল যেমন দেখেছিল, সব ঠিক সেভাবেই আছে, দেরি না করে সাঁতার কেটে ঢুকে পড়ল ককপিটে—সবুজ সিলিণ্ডারটা ওখানেই দেখেছিল। দেয়ালের ব্র্যাকেট থেকে ওটা খুলে নেবার আগে চোখ ফেলল কো-পাইলটের সিটে। একটা কঙ্কাল বসে আছে ওখানে, এখনও স্ট্র্যাপ বাঁধা। গায়ে প্লাস্টিকের লাইফভেস্ট, গলায় ঝুলছে জং-ধরা একজোড়া ডগ-ট্যাগ। গায়ের মাংস বহুকাল আগে পচে-গলে খসে পড়েছে; আর কয়েক বছরের ভেতর কঙ্কালটাকেও খেয়ে ফেলবে সাগরের নোনা পানি।

মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। এই বিমানটার কারণেই আসলে ধোঁকা খেয়েছে ও-ম্যাগনেটিক টাওয়ারের ধাপ্পাটাকে সত্যি ভেবে বসেছে। অন্য কোনোদিকে মনোযোগ দেয়নি। ভাবতেই পারেনি, এই একটা রেক ছাড়া বাকিগুলো মিথ্যে হতে পারে। বিমানটার ব্যাখ্যাহীন দুর্ঘটনা, আর ভেতরে পাওয়া এই কঙ্কাল মিলিয়ে টাওয়ারের রহস্যটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল।

ক্ষণিকের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, সংবিৎ ফিরতেই মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করল ও, মন দিল হাতের কাজে। সিলিণ্ডারটা মেঝেতে নামিয়ে চেক করে দেখল, ক্ষয়ক্ষতির কোনও চিহ্ন আছে কি না। উদ্বিগ্ন হবার মত কিছু পেল না। পুরু স্টিল দিয়ে তৈরি সিলিণ্ডারটা, আশা করল, এত বছর পরেও ভেতরের গ্যাসটা ঠিকমতই আছে।

এবার ফেরার পালা।

.

উল্টে থাকা হ্যামারহেডের খোলের ভেতর বন্দি হয়ে আছে মুরল্যাণ্ড। জীবনদায়ী এয়ার পকেটের ভেতর মাথা আর কাঁধ থাকলেও হাতদুটো রয়েছে পানির নিচে ভাঁজ করা। অবস্থায়—কবজিদুটো রয়েছে ককপিটের বাইরে, লিফট বারের সঙ্গে আটকানো অবস্থায়। অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। হাত-পায়ে সাড়া পাচ্ছে না, তবে মাথা কাজ করছে ঠিকভাবে। তাই বুঝতে পারল, এয়ার ভালভ পুরোটা খুলে দেয়া উচিত হয়নি।

শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে খুব অল্পই বাতাস ব্যবহার করছে ও, বাড়তি বাতাসটা বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে, অপচয় হচ্ছে। একটা পা তাই তুলে আনল কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে, আঙুল জড়িয়ে কিছুটা ঘুরিয়ে দিল ভালভের সুইচ। বাতাসের হিসহিসে আওয়াজ কমে গেল, নীরবতা নেমে এল ককপিটে। ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে থাকল ও, অপেক্ষা করছে রানার ফিরে আসার জন্যে।

রানা যে ফিরবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই ওর মনে। বন্ধুটিকে খুব ভাল করেই চেনে সে—হার মানতে জানে না, পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক, শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যায়। মনে মনে তাই প্রার্থনা করল, রানার প্ল্যানটা যা-ই হোক না কেন, তা যেন কাজ করে… এবং দ্রুত কাজ করে। নিজে মরবে তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু ওর কারণে রানাও মারা যাক, তা চায় না মুরল্যাণ্ড কিছুতেই।

অপেক্ষার প্রহর এমনিতেই সহজে কাটতে চায় না, বিশেষ করে এ-অবস্থাতে মুরল্যাণ্ডের মনে হলো, সময় বুঝি থমকেই গেছে। পেরোতে থাকা প্রতিটা মুহূর্তের সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ, সমগ্র অস্তিত্বকে গ্রাস করতে চাইছে আতঙ্ক। সেসব ভুলে থাকার জন্যে গান গাইতে শুরু করল ও, ‘উই অল লিভ ইন আ ইয়েলো সাবমেরিন…’

বিটল্স্ ব্যাণ্ডের ক্লাসিক গান, সুর-তাল কিছুই ঠিক থাকছে না, তারপরেও এ-পরিস্থিতিতে বেশ মানানসই। গান গাইতে গাইতেই মনে মনে ঠিক করল মুরল্যাণ্ড, এরপর কোনও সাবমেরিন বা সাবমারসিবল বানালে সেটাকে হলুদ রঙ করবে। সেই সঙ্গে বসাবে একটা হিটার, পানির তলাতেও যেটা কাজ করে।

‘আর মিসাইল,’ গান থামিয়ে আপনমনে বলল সে, ‘হ্যাঁ, মিসাইলও রাখতে হবে সাবমারসিবলে, যাতে কর্টেজের মত আর কোনও বদমাশ গোলমাল পাকাতে এলে মিসাইল মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়।

চিন্তাগুলো মনের খাতায় টুকে রেখে আবার গাইতে শুরু করল ও। কী গাইছে, কতক্ষণ ধরে গেয়েছে, কিছুই জানে না। শুরুতে নিজের বেসুরো গলার ব্যাপারে সচেতন ছিল, একটু পর মনে হলো, না, ঠিকই আছে। বেশ ভালই তো গাইছে! আর তখুনি টের পেল, চোখে ঘোলা দেখছে ও, শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি পা-টা আবার তুলে আনল কন্ট্রোল প্যানেলে। অনুভূতি বলতে কিছুই নেই, স্রেফ আন্দাজের বশে আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরল এয়ারফ্লো কন্ট্রোলের নব। এদিক-ওদিক ঝাঁকি দিল কয়েকবার। হঠাৎ বেড়ে গেল বাতাসের আওয়াজ, ভালভটা ঘুরে গেছে। ককপিট ধীরে ধীরে ভরে উঠল পরিষ্কার বাতাসে। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এল। বুক ভরে বাতাস টেনে ফের গান গাইতে থাকল ও।

সময়জ্ঞান ভুলে গেছে মুরল্যাণ্ড। হঠাৎ সামনে পানি নড়ে ওঠায় ধ্যান ভাঙল। ভুস করে ওর সামনে মাথা জাগাল রানা। গান থেমে গেল মুরল্যাণ্ডের।

মুখ থেকে মাস্ক আর রেগুলেটর সরিয়ে হাসল রানা। ‘বেশ মৌজে আছ দেখছি। গান হচ্ছে!’

‘গান গাওয়ার অনেক রিয়ালিটি শো আছে, তার কোনও একটায় অংশ নেব বলে ভাবছিলাম,’ কৌতুক করার চেষ্টা করল মুরল্যাণ্ড, তবে পুরোপুরি সফল হলো না। ঠাণ্ডায় দাঁতে ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেছে তার। ‘কেমন বুঝলে আমার গান?’

‘গায়ক হিসেবে ভবিষ্যৎ অন্ধকার,’ বলল রানা। ‘তবে হ্যামারহেডের বাসিন্দা হিসেবে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে চলেছে।’ সবুজ সিলিণ্ডারটা উঁচু করে দেখাল ও। ‘একশো পার্সেন্ট অক্সিজেন। হ্যাণ্ডকাফটা কাটব এটা দিয়ে।’

‘জানতাম তুমি আমাকে হতাশ করবে না,’ কষ্টেসৃষ্টে একটু হাসল মুরল্যাণ্ড।

রানা ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করছে ট্যাঙ্কের ভালভের ওপর জমে থাকা শ্যাওলা। মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেলে থামল। পিনহোলটা দেখাল মুরল্যাণ্ডকে।

‘কাজ চলবে?’

‘পরীক্ষা করেই দেখো।’

ভালভ হ্যাণ্ডেলটা কিছুক্ষণ চাপাচাপি করল রানা। লাভ হলো না। শেষে বাড়ি দিল ড্যাশবোর্ডের ফ্রেমে। ধাতব একটা শব্দ তুলে এবার ঘুরে গেল হ্যাণ্ডেল, শোনা গেল হিসহিসে আওয়াজ। সিলিণ্ডারটা পানিতে ডোবাল ও, বুদের সরু ধারা বেরুতে থাকল সিলিণ্ডারের মুখ দিয়ে।

সন্তুষ্ট হয়ে সার্ভাইভাল কিট থেকে আরেকটা ফ্লেয়ার নিল রানা, কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর থেকে খুঁচিয়ে তুলে আনল সরু এক প্রস্থ অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্রিপ। দুটোই লাগবে ওর এই কাজে। মুরল্যাণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রচুর তাপ হবে।’

‘তা হলে তো ভালই,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘ঠাণ্ডায় জমে গেলাম।’ রানার মত নড়াচড়ার সুযোগ পায়নি ও, প্রায় বিশ মিনিট ধরে বসে আছে একইভাবে। গায়ে ওয়েটসুট নেই। হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।

‘আমি সাবধানে কাজ করব,’ আশ্বাস দিল রানা। চোখের ওপর টেনে দিল মাস্ক।

‘রানা,’ ওকে ডাকল মুরল্যাণ্ড। ‘যা-ই ঘটুক, আমি এখানে মরতে রাজি নই। দরকার হলে একটা হাত কেটে ফেলো… এমনিতেও হাতে কোনও সাড়া পাচ্ছি না।’

‘আর অকালে পৃথিবীকে তোমার বক্সিং প্রতিভা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত করি আর কী,’ বলল রানা। ‘ও-চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।’

‘আমি শুধু বলতে চাইছি যে…’

‘তুমি বরং আবার গান শুরু করো,’ মুরল্যাণ্ডকে থামিয়ে দিল রানা। ‘বিটল্স্ তো যথেষ্টই হলো, এবার মাইকেল জ্যাকসনের কিছু গেয়ে শোনাও।’

জবাবের প্রতীক্ষা করল না ও, মুখে রেগুলেটর গুঁজে ডুব দিল পানিতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্যি সত্যি গান ধরল মুরল্যাণ্ড।

রানা ততক্ষণে লিফট বারের পাশে গিয়ে পৌঁছেছে। লক্ষ করল, ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গেছে মুরল্যাণ্ডের হাতদুটো। কবজিদুটো যতটা পারে দু’দিকে সরাল, টান টান করল হ্যাণ্ডকাফের শেকল। এরপর ফ্লেয়ার জ্বেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্রিপটা নিয়ে। একটা প্রান্ত ঢুকিয়ে দিল শেকলের একটা লিঙ্কে, অন্য প্রান্তটা ধরল জ্বলন্ত ফ্লেয়ারের মাঝখানে। স্ট্রিপের ওই অংশটা আগুনে লাল হয়ে গেলে অক্সিজেন সিলিণ্ডারের ভালভ খুলল, গ্যাসের প্রবাহ বইয়ে দিল জ্বলন্ত অ্যালুমিনিয়ামের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধানো আলোর বিস্ফোরণ ঘটল যেন, তীব্র উত্তাপ ছড়িয়ে পুড়তে শুরু করল অ্যালুমিনিয়াম।

রীতিমত কসরত করতে হচ্ছে রানাকে, মনে হচ্ছে একটা বাড়তি হাত থাকলে ভাল হতো। অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্রিপ, ফ্লেয়ার আর সিলিণ্ডার—তিনটেই ধরে থাকতে হচ্ছে কিনা! উজ্জ্বল আলোয় চোখও ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, অক্সিজেনেই আগুন ধরেছে বুঝি; আদপে ব্যাপারটা তা নয়। বিশুদ্ধ অক্সিজেন স্রেফ সাহায্য করছে দাহ্য পদার্থকে অস্বাভাবিক তাপে এবং খুব দ্রুত তীব্রভাবে জ্বলতে। এ-মুহূর্তে অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্রিপটাকে জ্বালিয়ে রাখছে, শেকলের লোহায় আগুন ধরে গেলে ওটাকেও জ্বালাবে। হাতের কাছের জিনিস দিয়ে রানা আসলে খুব সাদামাটা একটা কাটিং টর্চ তৈরি করেছে।

ক্রমাগত ধোঁয়া আর বুদ্বুদ দেখা দিচ্ছে পানিতে। আলোটা বাড়ছে-কমছে। একেক সময় মনে হচ্ছে আগুনটা নিভে যাবে হয়তো, কিন্তু পরমুহূর্তে আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে বেড়ে যাচ্ছে উজ্জ্বলতা। ত্রিশ সেকেণ্ড পর সিলিণ্ডারটা সরিয়ে কাজ কদ্দূর হলো পরীক্ষা করল রানা। লাল হয়ে গেছে শেকলের লিঙ্ক, তবে এখনও গলে যায়নি। আবারও কাটিং টর্চটা ব্যবহার করল ও। পনেরো সেকেণ্ড পরেই আচমকা দু’দিকে ছুটে গেল মুরল্যাণ্ডের হাত।

মুক্ত হয়ে গেছে ও।

সিলিণ্ডারের ভালভ বন্ধ করে এয়ার পকেটে ফিরে এল রানা। ওকে দেখতে পেয়ে মুরল্যাণ্ডের ঠোঁটে ফুটে উঠল বিমল হাসি।

‘পারলে তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম,’ বলল সে। ‘কিন্তু কপাল খারাপ, হাত জমে বরফ হয়ে গেছে।’

‘নিচে কতক্ষণ হলো আমাদের?’ জানতে চাইল রানা।

‘ত্রিশ মিনিট।’

মনে মনে হিসেব করে নিল রানা। একশো ফুট গভীরতায় ত্রিশ মিনিট….. তারমানে ওপরে ওঠার সময় অন্তত একটা ডিকম্প্রেশন স্টপ নিতেই হবে ওদেরকে। মুরল্যাণ্ডকে যে-সিলিণ্ডারটা দিয়ে গিয়েছিল, সেটা খরচ হয়নি; নিজেরটাতেও রয়েছে খানিকটা বাতাস। বাড়তি মজুদ হিসেবে অক্সিজেনের সবুজ সিলিণ্ডারটা তো রয়েছেই। নির্বিঘ্নে ওপরে উঠতে পারবে ওরা।

মুরল্যাণ্ডকে মাস্ক আর রেগুলেটর পরতে সাহায্য করল ও, পায়ে পরিয়ে দিল ফিন। এরপর ইএলটি বিকন আর ভাঁজ করা লাইফরাফটটা নিল। দু’জনে বেরিয়ে এল সাবমারসিবল থেকে।

বাইরে এসেই রিকনটা অন করল রানা। হাত থেকে ছেড়ে দিতেই ওটা ভাসতে ভাসতে রওনা হলো সারফেসের দিকে। মুরল্যাণ্ডের দিকে ফিরে ইশারা দিল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে ধীরে ধীরে পা নাড়তে শুরু করল মুরল্যাণ্ড—উঠে যাচ্ছে ওপরে। ওর পিছু নেবার আগে হ্যামারহেডের দিকে শেষবারের মত তাকাল রানা। সাবমারসিবলের বাইরে, কাদার ওপরে পড়ে থাকা একটা ধাতব জিনিস কৃত্রিম আলোয় ঝকঝক করছে।

কুচিয়োর ছুরি! আরেকবার ওটা এসে পড়েছে রানার নাগালে–লোকটার শয়তানির চিহ্ন হিসেবে।

ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে ছুরিটা ছোঁ মেরে তুলে নিল রানা। এরপর অনুসরণ করল মুরল্যাণ্ডকে।

দশ মিনিট লাগল সারফেসে পৌঁছুতে। ডাইভিঙের নিয়মানুসারে সেকেণ্ডে এক ফুট করে উঠেছে দু’জনে। একবার ডিকম্প্রেশন স্টপ নিলেই চলত, তারপরেও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে দু’বার থেমেছে—একবার চল্লিশ ফুটে, আরেকবার বিশ ফুটে।

পানি ভেদ করে মাথা তোলার পর সূর্যের আলো দেখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করল দু’বন্ধু। র‍্যাফটের ইনফ্লেশন কর্ড টানল রানা, কার্বন ডায়োক্সাইডের চার্জ বিস্ফোরিত হলো, চোখের পলকে ছোট্ট র‍্যাফটটা প্রসারিত হয়ে ভাসতে থাকল পানিতে। প্রথমে নিজে উঠল, তারপর মুরল্যাণ্ডকে টেনে তুলল রানা।

.

র‍্যাফটে চিৎ হয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল দু’জনে। হাঁপাচ্ছে ভীষণভাবে। বিশ্বাস করতে পারছে না, সত্যি সত্যি সাগরতলের মৃত্যুফাঁদ থেকে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছে। অবাক হয়ে রানা লক্ষ করল, নিচের তুলনায় এখন বরং বেশি শীত করছে ওর… এখন শরীর আরও অসাড় ঠেকছে।

কয়েক মিনিট নীরবতায় কাটল। এরপর মুখ খুলল মুরল্যাণ্ড। শুধাল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে গরম জায়গা কোনটা?’

‘কী জানি,’ বলল রানা। ‘চিলির আতাকামা মরুভূমি বোধহয়।’

‘পরের মিশনে আমি ওখানে যাচ্ছি।’

বাঁকা চোখে তাকাল রানা। ‘মরুভূমিতে নুমার কোনও কাজ আছে বলে মনে হয় না।’

‘সেক্ষেত্রে ছুটি নিয়ে যাব। বাপ রে বাপ, যে-অভিজ্ঞতা হলো, এরপর আর পানিতে নামতে রাজি নই আমি।’

‘মরুভূমিতেও এর আগে গেছি আমরা-সাহারায়,’ মনে করিয়ে দিল রানা। ‘সেখানেও মরতে বসেছিলাম।’

‘মরতে হলে ডাঙায় মরাই ভাল, গোঁয়ারের মত বলল মুরল্যাণ্ড। ‘যা বলার বলে দিয়েছি, মরি বা বাঁচি, আগামীতে মরুভূমিতেই যাচ্ছি আমি।’

হেসে ফেলল রানা। তবে হাসির আড়ালে ঠিকই বুঝতে পারছে, মৃত্যুর কতটা কাছে চলে গিয়েছিল ওরা। আর এর জন্যে দায়ী ওর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। মুরল্যাণ্ডের দিকে তাকাল ও, অবশেষে রঙ ফিরতে শুরু করেছে তার চেহারায়।

‘সরি, ববি,’ নিচু গলায় বলল রানা।

‘কীসের জন্যে?’ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল মুরল্যাণ্ড।

‘ভুল করেছি বলে। সবকিছু না জেনে, আগ বাড়িয়ে একটা চাল দিয়ে বসেছিলাম। আরেকটু হলেই তুমি মরতে বসেছিলে।’

‘ভুল আমরা সবাই করি, রানা,’ সহজ গলায় বলল মুরল্যাণ্ড। ‘পার্থক্য শুধু এ-ই যে, সেই ভুলে মাঝে মাঝে মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়, এই আর কী। ও কিছু না।’

মাথা ঝাঁকাল রানা। কথাটা ভুল বলেনি মুরল্যাণ্ড।

পানির ওপর দিয়ে তাকাল ও। ত্রিশ গজ দূরে ঢেউয়ের মাঝে ভাসতে দেখল ইমার্জেন্সি বিকনটাকে—জ্বলছে-নিভছে ক্রমাগত। আশা করল, ওটাকে অনুসরণ করে শীঘ্রি হাজির হবে উদ্ধারকারী জাহাজ। অনেক কাজ বাকি ওদের।

একদিক থেকে চিন্তা করলে… রানার চেয়ে বড় ভুল করেছে কুচিয়ো কর্টেজ। তার ভুলেই বেঁচে গেছে রানা, ওর বুকে জ্বলে উঠেছে প্রতিহিংসার তীব্র আগুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *