1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৭

সাত

নেপচুনের কমিউনিকেশন রুমে এক ঘণ্টা কাটাল রানা, তার ভেতর চল্লিশ মিনিট ব্যয় হলো নুমার ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের সঙ্গে আলোচনায়। আরাতামা মারু যেখানে ডুবে গেছে, সে-জায়গা ঘিরে চক্কর দিচ্ছে নেপচুন, এই ফাঁকে অ্যাডমিরালকে পুরো ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনাল ও। বেশ কিছু প্রশ্ন জন্ম নিল অ্যাডমিরালের মনে, যেগুলোর কোনও সন্তোষজনক জবাব নেই।

‘জাহাজটা ইচ্ছে করে ডুবিয়ে দিল, এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার,’ বলল রানা। ‘ক্রুদেরও খুন করেছে। ডাকাতির চেয়ে ব্যাপারটা টেরোরিজমের মতই দেখাচ্ছে বেশি।’

কমিউনিকেশন রুমের ফ্ল্যাটস্ক্রিন মনিটরে অ্যাডমিরালের চেহারা গম্ভীর হয়ে উঠল।

তোমরা কোনও মাদার শিপ খুঁজে পাওনি?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

মাথা নাড়ল রানা। ‘ওরা যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত গেছি আমরা। দু’পাশে আরও পাঁচ-পাঁচ দশ মাইল খুঁজেছি। রেডারে কিচ্ছু ধরা পড়েনি।’

‘হয়তো ধোঁকা দিচ্ছিল তোমাদের। রেডার রেঞ্জের বাইরে গিয়ে দিক পাল্টে যোগ দিত মাদার শিপের সঙ্গে।’

‘সেটাও ভেবেছি আমরা। আরও একটা সম্ভাবনার কথা ভেবেছি। ওই ছোট্ট বোট নিয়েই হয়তো ফিরতে চাইছিল আফ্রিকার উপকূলে। বাড়তি কিছু ফিউয়েল ড্রাম থাকলেই সেটা সম্ভব। ওই ড্রামগুলোই হয়তো বিস্ফোরিত হয়েছে।’

‘বুঝলাম,’ মাথা ঝাঁকালেন অ্যাডমিরাল। ‘কিন্তু জাহাজটায় ওরা হামলা করল কেন, সেটা কিন্তু পরিষ্কার হলো না। কাউকে কিডন্যাপ করতে চায়নি তো?’

‘আমার তা মনে হয় না,’ রানা বলল। ‘ক্যাপ্টেনের স্ত্রীকে উদ্ধার করেছি আমরা। তার ভাষ্যমতে, সাধারণ ক্রু ছাড়া বিশেষ কেউ ছিল না জাহাজে।’

‘হুম। কী মনে হচ্ছে তোমার—এই ঘটনার সঙ্গে আগের তিনটে জাহাজের কোনও সম্পর্ক আছে?’

‘যথেষ্ট মিল দেখতে পাচ্ছি। আমরা যদি হাজির না হতাম, তা হলে আরাতামা মারুও সবার অজান্তে উধাও হয়ে যেত।’

‘আর জলদস্যুদের বোটটা?’

‘আপাতত দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।’

থুতনি চুলকালেন অ্যাডমিরাল। ‘কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এভাবে একের পর এক জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে… কেন? কোনও আইডিয়া আছে তোমার?’

চেয়ারে হেলান দিল রানা। বলল, ‘আমার অভিজ্ঞতায় বলে, দুটো কারণে ইচ্ছেকৃতভাবে জাহাজ ডোবানো হয়। ইনশিয়োরেন্সের টাকার লোভে, নয়তো কোনও কিছু ধামাচাপা দেবার জন্যে।’

‘এখানেও তা-ই ঘটেছে বলে ধারণা তোমার?’

‘সাক্ষীদের খুন করে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে,’ বলল রানা। ‘কেউ কিছু লুকাতে চাইছে, কোনও সন্দেহ নেই।’

‘ক্যাপ্টেনের স্ত্রী কী বলছে?’

জেরা করার মত অবস্থায় নেই মেয়েটা। শুধু বলল, রাতে ডিনার করার জন্যে মেস হলে নেমেছিল। হঠাৎ কেঁপে উঠে নিভে গিয়েছিল সব বাতি। এরপর মাথাব্যথা শুরু হলো তার, তাল হারিয়ে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সময়ের যা হিসেব পেলাম, তাতে মনে হচ্ছে পুরো আট ঘণ্টা হুঁশ ছিল না তার। এখনও শরীরের ব্যালেন্স ফিরে আসেনি, কোনও কিছু না ধরে দাঁড়াতে পারছে না।’

‘কীসের জন্যে হতে পারে এমনটা?’

‘কী জানি,’ শ্রাগ করল রানা। ‘হয়তো কোনও নার্ভ এজেন্ট বা অ্যানেস্থেটিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাপারটা সাধারণ ডাকাতি না ভাবার পেছনে এটা আরেকটা কারণ। জলদস্যুদের কাছে এত সফিসটিকেটেড জিনিস থাকে না।’

একমত হলেন অ্যাডমিরাল। ‘এখন তা হলে কী করতে চাও?’

‘নিচে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করার ইচ্ছে,’ বলল রানা। ‘দেখতে চাই, ওরা আসলে কী লুকাতে চাইছে।’

দেয়ালে ঝোলানো ম্যাপের দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল। নেপচুনের পজিশন মার্ক করে রাখা হয়েছে ওতে।

‘যদি ভুল না করে থাকি,’ বললেন তিনি, ‘সাগর ওখানে তিন মাইল গভীর। নামবে কীভাবে? জাহাজে কোনও আর.ও.ভি. আছে?’

‘না,’ রানা মাথা নাড়ল। ‘অত গভীরে নামার মত কিছুই নেই। তবে ববি আছে অ্যাযোর্সের সান্তা মারিয়া আইল্যাণ্ডে। শুনলাম, একটা সাবমারসিবল নিয়ে গেছে ওখানে—কী এক রেসে অংশ নেবার জন্যে। আপনি যদি রাজি থাকেন তো ওই সাবমারসিবলটাই মডিফাই করে ফিরে আসতে পারি আমরা। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ লাগবে।’

ববি মুরল্যাণ্ড নুমায় রানার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও প্রথম শ্রেণীর। আগেই খবর দিয়ে রেখেছে, অ্যাযোর্সে গেলে যেন রানা অবশ্যই দেখা করে তার সঙ্গে।

‘বেশ,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘অ্যাযোর্সে তো এমনিতেই যাবার কথা তোমাদের। বিশ্রামও পাওনা হয়েছে নেপচুনের ক্রুদের। রওনা হয়ে যাও। সান্তা মারিয়ায় পৌঁছে যোগাযোগ কোরো আমার সঙ্গে। এর মধ্যে ভেবে দেখি, মডিফিকেশনের ঝামেলায় না গিয়ে বিকল্প কিছু করা যায় কি না।

‘ঠিক আছে, অ্যাডমিরাল।’

কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে দিলেন হ্যামিলটন। স্ক্রিন থেকে তাঁর ছবি সরে গিয়ে ফুটে উঠল নুমার লোগো।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। বেরিয়ে এল কমিউনিকেশন রুম থেকে। মন খুঁতখুঁত করছে ওর। বেশ কয়েকটা অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছে, যেগুলো ঘটার পেছনে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ পাওয়া যাচ্ছে না।

ধরে নেয়া যাক, ডাকাতির উদ্দেশ্যেই আরাতামা মারুতে হামলা করেছিল দস্যুরা। হয়তো কার্গো নয়, দামি কোনও জিনিস ছিল জাহাজে… কিংবা ছিল অনেক টাকা। সাক্ষী রাখতে চায়নি বলে ক্রুদের খুন করেছে, জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে—দুটোই নাহয় মেনে নেয়া গেল। কিন্তু আগুন ধরাল কেন? ওদের তো জানার কথা, খোলা সাগরে বহুদূর থেকে চোখে পড়ে ধোঁয়া; আর ধোঁয়া দেখলে যে-কোনও জাহাজই খোঁজ নেবার জন্যে ছুটে আসবে। তার চেয়ে শুধু গ্রেনেড বা বোমা ফাটিয়ে জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়াই কি নিরাপদ ছিল না?

দস্যুদের চেহারা-সুরতও ভাবিয়ে তুলছে ওকে। আটলান্টিকের এ-প্রান্তে জলদস্যুতার উদাহরণ নেই বললেই চলে। তা ছাড়া যতটুকু দেখতে পেয়েছে, তাতে আফ্রিকার হতদরিদ্র জলদস্যু বলেও মনে হয়নি মোটেই। শুধু কৃষ্ণাঙ্গ নয়, সাদা চামড়ার লোকও ছিল ওদের মাঝে। আর ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র; লড়াই করেছে প্রশিক্ষিত সৈনিকের মত। এগুলো প্রফেশনাল মার্সেনারিদের লক্ষণ।

পকেট থেকে দস্যুনেতার ফেলে যাওয়া ছুরিটা বের করল রানা। বাজার থেকে কেনা গড়পড়তা ছুরি নয়, নিশ্চয়ই বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে তৈরি করা জিনিস। কীভাবে ওটা ক্রেন অপারেটরের সিটে গেঁথে রাখা হয়েছিল, মনে পড়ল ওর। কাজটা কোনও সাধারণ দস্যুর নয়, ভয়ঙ্কর প্রকৃতির কোনও মানুষের—প্রতিপক্ষকে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে ভালবাসে। ছুরিটা রেখে গেছে রানাকে ব্যঙ্গ করার জন্যে।

অদেখা সেই শত্রুর কণ্ঠ মনে পড়ল রানার, উদ্ধত অহঙ্কার প্রকাশ পাচ্ছিল তার প্রতিটা কথায়। আফ্রিকার কোনও সাধারণ জলদস্যুর কণ্ঠ ছিল না ওটা। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, কণ্ঠটা আগেও কোথাও শুনেছে বলে মনে হচ্ছে ওর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *