1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৯

ঊনচল্লিশ

দু’ঘণ্টা পর।

ল্যাপটপ কম্পিউটারের ওপর ঝুঁকে আছে রানা। ব্যস্ত। নষ্ট করবার মত সময় নেই হাতে। হোটেলে ফিরে ভেজা জামাকাপড় বদলাতে সামান্য সময় নিয়েছে কেবল, তারপরই লেগে পড়েছে কাজে। নুমা আর বিসিআই হেডকোয়ার্টারে ফোন করে বেশ কিছু তথ্য চেয়েছে। ই-মেইলের মাধ্যমে সেসব তথ্য আসার পর ডাউনলোড করে নিয়েছে ল্যাপটপে, মেলাতে শুরু করেছে।

দরজা খোলার আওয়াজ শুনে মুখ তুলল ও, মুরল্যাণ্ড এসে ঢুকেছে কামরায়। গোসল করে কাপড় পাল্টে এসেছে, ফ্রেশ দেখাচ্ছে তাকে।

‘এত সময় নিলে যে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হাঁটুর ক্ষত থেকে কাঁকর

থেকে কাঁকর পরিষ্কার করছিলাম,’ গোমড়ামুখে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘কীভাবে আছাড় খেয়েছিলাম, দেখোনি?’

হাসল রানা। ‘বৃষ্টির ভেতর দামি ইটালিয়ান লেদারের জুতো পরে দৌঁড়াতে গেলে এ-ই হয়।’

‘দৌড়াদৌড়ি করতে হবে তা তো বলোনি। আমি আরও ভাবলাম, ভাল একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি যখন, দু-চারজন সুন্দরীর দেখা পাব নির্ঘাত। তাদেরকে পটানোর জন্যে ভাল সাজগোজ থাকা চাই।’

‘যেভাবে মারামারি করেছ, তাতে অনেকেই পটে গেছে। গিয়ে খোঁজ নেবে নাকি?’

‘ঠাট্টা করছ?’ রানার পাশে গিয়ে বসল মুরল্যাণ্ড। ‘শুধু এটুকু বলো, আমার প্রিয় আরমানি শার্টটা অকারণে জীবন দেয়নি।’

‘আত্মোৎসর্গ বললে বোধহয় আরও ভাল শোনায়। তাতে কাজও হয়েছে। ল্যাপটপটা মুরল্যাণ্ডের দিকে একটু ঘুরিয়ে দিল রানা। স্ক্রিনে একটা লিস্ট ফুটে উঠেছে।

‘কী এটা?’

‘কুচিয়োকে কবে-কোথায় দেখা গেছে, তার কনফার্মড অফিশিয়াল তালিকা। বিসিআইয়ের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট থেকে পেয়েছি। খবরগুলো জোগাড় করা হয়েছে ইন্টারপোল, এফবিআই আর বিভিন্ন দেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি থেকে।

তালিকায় চোখ বোলাতে শুরু করল মুরল্যাণ্ড।

রানা বলল, ‘আঠারো মাস আগে পিয়ংইয়ঙে দেখা গেছে তাকে, এর পাঁচ সপ্তাহ পরে সিঙ্গাপুরে। ফ্যাং যে-তারিখ বলেছে, তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে রিপোর্টটা।’

‘ব্যাটা তা হলে মিথ্যে বলেনি। দেখা যাচ্ছে একটা আঙুল খুইয়ে বাকিগুলোর ওপর মায়া বেড়ে গেছে তার!’

নিঃশব্দে হাসল রানা, তারপর আবার খেই ধরল। ‘সিঙ্গাপুরের পর তাইওয়ানের কাওসিয়াঙে পাচ্ছি আবার কুচিয়োকে। চব্বিশ ঘণ্টা ছিল ওখানে, এরপর গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তিন মাস পর ইয়েমেনে আবার উদয় হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে; আর ছ’মাস পর মাদাগাস্কারে—এটা কনফার্ম।’

‘মাদাগাস্কার?’

‘হুঁ। মাদাগাস্কারে আরও দু’বার গেছে, একবার গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে। তিন মাস আগে অ্যাঙ্গোলার লোবিটোতে লম্বা সময় কাটিয়েছে… লম্বা মানে, ওর জন্যে আর কী… তিন সপ্তাহে চারবার দেখা গেছে ওকে ওখানে। তারপর আবার মিলিয়ে গিয়েছিল বাতাসে। এরপর আরাতামা মারুতে হামলার সময় ওকে দেখি আমি। মাঝে, যদি এনএসএ-র থিয়োরি ঠিক ধরা হয়, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে গিয়েছিল ওয়াইবিসিও লোড করার জন্যে।

‘বেশ,’ সোফায় হেলান দিল মুরল্যাণ্ড। ‘লোকটা কবে- কোথায় গিয়েছিল, তা জানলাম। কিন্তু কীসে চড়ে গেছে, তা জানব কী করে? জাহাজটা ওশনগোয়িং ইয়ট, ফ্রেইটার, কার্গো-ক্যারিয়ার… যে-কোনও কিছুই হতে পারে। এমনকী যে–সাবমেরিনটার কথা শুনলাম, সেটাই যে ওর বাহন নয়, তা-ই বা কে বলতে পারে?’

‘আমার তা মনে হয় না,’ দ্বিমত পোষণ করল রানা। ‘সান্তা মারিয়ায় ও যখন আমাকে খুন করার চেষ্টা করছিল, ঠিক সেই সময়ে পাঁচশো মাইল দূরে আসিফ-তানিয়ার দিকে টর্পেডো ছুঁড়ছিল সাবমেরিনটা। তারমানে, ওটার কমাণ্ডে অন্য কেউ ছিল। আর কুচিয়োর ব্যাপারে যদ্দূর জানি, নেতৃত্ব ভাগাভাগি করে না সে। এমনকী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ডও রাখে না, সব নিজে সামলায়, যাতে ওকে চ্যালেঞ্জ করার মত পজিশনে কেউ না থাকে।’

‘শুনে তো প্যারানয়েড মনে হচ্ছে,’ মন্তব্য করল মুরল্যাণ্ড। ‘আসলেই তা-ই। এর অর্থ, ওর হাতে যদি একটা সাবমেরিন থাকে, কিছুতেই সেটার কমাণ্ড আর কারও হাতে দেবে না। বিশেষ করে ফ্যাঙের কাছ থেকে ধার করে আনা মার্সেনারিদের হাতে তো নয়ই।’

‘গুড পয়েন্ট,’ মেনে নিল মুরল্যাণ্ড। ‘তা হলে সারফেস শিপ ব্যবহার করছে কুচিয়ো। কিন্তু এটুকু তথ্যে বিশেষ লাভ হচ্ছে না আমাদের। সাগরে হাজার হাজার জাহাজ ভাসছে।

‘তুমি ভুলে যাচ্ছ, ফেব্রুয়ারির চার তারিখে সিঙ্গাপুরে ছিল কুচিয়ো। তারমানে জাহাজটা তখন ওখানকার বন্দরে, বা বন্দরের আশপাশে ছিল। হারবার-মাস্টারের রেকর্ড থেকে সেদিনের জাহাজগুলোর নাম নিলে আমরা দুনিয়ার বাকি সব জাহাজকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারি।’

‘তাই তো! রেকর্ডটা পাওয়া গেছে?’

‘দায়িত্বটা ল্যারিকে দিয়েছি—এসব রেকর্ড নুমার জন্যে জোগাড় করা সহজ,’ বলল রানা। ঘড়ি দেখল রানা। ‘এতক্ষণে কাজ হয়ে যাবার কথা ওর। দেখি যোগাযোগ: করে।’

স্কাইপিতে কল করল ও। কয়েক সেকেণ্ড পরেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফুটে উঠল ল্যারি কিঙের চেহারা।

‘তোমরা কি ঘুমাও-টুমাও না?’ অভিযোগের সুরে বলল সে। ‘ভেবেছিলাম একটু সময় পাব। আমার হিসেবে মাঝরাত হয়ে যাবার কথা তোমাদের ওখানে।’

‘এখনও হয়নি,’ বলল রানা। ‘আর এখানে মাঝরাত হলেই বা কী? তোমার ওখানে তো দুপুর।’

‘দুপুরেও ঘুমোয় মানুষ… লাঞ্চের পরে। বিশেষ করে আমার মত যাদেরকে রাত জেগে কাজ করতে হয়।’

‘আমাদের কাজটা করে দিয়ে ইচ্ছেমত ঘুমাও, কেউ বাধা দেবে না।’

‘কাজ হয়ে গেছে,’ জানাল কিং। ‘একটা ফাইল পাঠাচ্ছি। ফেব্রুয়ারির চার তারিখে মোট একাত্তরটা জাহাজ ছিল সিঙ্গাপুরের বন্দর আর আউটার অ্যাঙ্কারেজে।’

‘ওরেব্বাপরে,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘এ-ও তো অনেক!’

‘লিস্ট আরও ছোট করতে হবে,’ চিন্তিত গলায় বলল রানা। ‘কুচিয়োকে আর যেসব জায়গায় দেখা গেছে, সেসব জায়গার লিস্ট এনে যদি ক্রস-রেফারেন্স করা হয়…’

‘জানতাম এ-কথাই বলবে, আমার ঘুমের বারোটা বাজাতে চাইবে,’ বলল কিং। ‘তবে সে-সুযোগ আর পাচ্ছ না, রানা। আগ বাড়িয়ে কাজটা করে রেখেছি আমি।’

‘অন্তর্যামী হয়ে গেলে নাকি?’ ভুরু কুঁচকে বলল রানা। ‘এতগুলো বন্দর থেকে হারবার-মাস্টারের রেকর্ড জোগাড় করলে কীভাবে?’

‘সবগুলো পাইনি,’ স্বীকার করল কিং। ‘তাই সাহায্য নিয়েছি স্যাটেলাইট ফটোর। বড় বড় বন্দরগুলোর ওপর সারা বছরই স্যাটেলাইট দিয়ে নজর রাখে এনএসএ; ওদের ডেটাবেজ থেকে ছবি নিয়ে এসেছি।’

‘কিছু পেলে?’

মাথা ঝাঁকাল কিং। ‘দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে বাকি সব বন্দরে একটা মাত্র জাহাজ হাজির ছিল প্রতিটা ক্ষেত্রে—মানে, যখন-যখন কুচিয়োকে ওসব জায়গায় দেখা গেছে।’

একটা বোতাম চাপল সে। স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা বিশাল অয়েল-ট্যাঙ্কারের ছবি—খোলটা কালো রঙের, ডেক সাদা পেইণ্ট করা। মাস্তুলে উড়ছে লাইবেরিয়ার পতাকা।

‘নর্দার্ন স্টার,’ নামটা পড়ল রানা।

সন্দিহান দেখাল মুরল্যাণ্ডকে। ছবির তলায় লেখা তথ্য অনুসারে ওটা একটা তিন লাখ টন ধারণক্ষমতার সুপারট্যাঙ্কার। সে বলল, ‘তুমি শিয়োর, ল্যারি? সামান্য এক মার্সেনারি সুপারট্যাঙ্কার নিয়ে ঘুরছে… এত ফাণ্ড আছে ওর?’

‘শার্লক হোমস পড়োনি কখনও?’ পাল্টা প্রশ্ন করল কিং। ‘সিনেমা দেখেছি,’ সরল স্বীকারোক্তি মুরল্যাণ্ডের। ‘ওটা গোনায় ধরা যায়?’

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিং। ‘এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ববি,’ বলল সে। ‘শার্লক হোমস বলেছেন, অসম্ভবকে যদি ছেঁটে ফেলো, তারপর যেটাই বাকি থাকে…. সেটা যতই অবিশ্বাস্য ঠেকুক না কেন… সত্য হতে বাধ্য। কেপ টাউন বাদে গত দেড় বছরে কুচিয়ো যত জায়গায় উদয় হয়েছে, সবখানে ছিল এই জাহাজটা। কেপ টাউনের রিপোর্টটা এমনিতেও কনফার্ম না, তাই ওটাকে বাদ দেয়াই যায়। তা ছাড়া জাহাজটা এত বড় যে, সুয়েজ খালে ঢুকবে না, সেজন্যেই সম্ভবত আফ্রিকার তলা দিয়ে ঘুরে ফ্রিটাউনে গেছে। পথে মাদাগাস্কারে থেমেছিল। তারিখ মিলে যায়।’

‘হুম,’ মাথা ঝাঁকাল মুরল্যাণ্ড। ‘জাহাজের মালিক কে?’

‘লাইবেরিয়ার এক কর্পোরেশন, তবে কাগজ-কলমের বাইরে ওটার অস্তিত্ব নেই।’

রানার দিকে তাকাল মুরল্যাণ্ড। ‘এনএসএ-কে তা হলে ওটার খবর জানিয়ে দিই না কেন? বাকিটা ওরাই সামলাক।’

মাথা নাড়ল রানা। অকাট্য প্রমাণ চাই ওদের। তা ছাড়া কর্টেজ আর বিজ্ঞানীরা যদি সত্যিই ওই জাহাজে থাকে, খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে ওদেরকে। হামলা চালাতে হবে অতর্কিতে, যাতে শত্রুরা প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ না পায়। নইলে লামিয়া-সহ বন্দি বিজ্ঞানীরা আরও বড় বিপদে পড়ে যাবে।

‘মি. ওয়েস্টলেককে যেভাবে খেপিয়ে দিয়ে এসেছি,’ বলল ও, ‘আমাদের মুখের কথায় কিছু করতে যাবেন বলে মনে করো?’

শ্রাগ করল মুরল্যাণ্ড। ‘মনে হয় না।’

‘রাইট। প্রমাণ চাই আমাদের।’

‘জাহাজটায় হানা দিতে চাইছ?’ আন্দাজ করল মুরল্যাণ্ড। ‘হ্যাঁ।’

মুখ কালো হয়ে গেল মুরল্যাণ্ডের। ‘জানতে পারি, খুনে ডাকাত আর সন্ত্রাসীতে ভরা একটা জাহাজ, যেটা সর্বক্ষণ হামলার আশঙ্কায় চোখ-কান খোলা রাখ,ে নিঃসন্দেহে, সেটায় সবার চোখ এড়িয়ে কীভাবে উঠব আমরা?’

রহস্যের হাসি হাসল রানা। একটা প্ল্যান খেলা করছে ওর মাথায়… পাগলাটে প্ল্যান।

‘ঠিক যেভাবে বাঘের মুখ থেকে দাঁত তুলতে হয়,’ বলল ও। ‘খুব সাবধানে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *