1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৮

আটত্রিশ

আসিফ আর তানিয়ার কাছ থেকে বিদায় নেবার আটাশ ঘণ্টা পর সিঙ্গাপুরে পৌঁছল রানা ও মুরল্যাণ্ড। ওয়াশিংটনের ডালেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচন হয়ে কানেক্টিং ফ্লাইটে এসেছে। ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কেটেছিল, যাতে আরাম করে আসতে পারে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারে যাত্রাপথে।

রওনা হবার আগে ঢাকায় বিসিআই চিফের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে রানা, তাঁকে বিস্তারিত ব্রিফ করেছে ঘটনার অগ্রগতি নিয়ে। তারপর তাঁর অনুমতি চেয়েছে মিশনটায় যাবার জন্যে।

‘অবশ্যই যাবে,’ বলেছেন রাহাত খান। ‘তুমি তো জানোই, কিডন্যাপ হওয়া গবেষকদের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীও আছেন। কাজেই এতে আমাদেরও স্বার্থ আছে। তা ছাড়া ওই ডাইরেক্টেড-এনার্জি ওয়েপন নিয়ে আফ্রিকায় গোলমাল বেধে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরাও। বাংলাদেশি প্রচুর শান্তিরক্ষী কাজ করছে আফ্রিকায়, তাদের জীবনের ঝুঁকি দেখা দেবে। আফ্রিকার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে, প্রবাসীরা বিপদে পড়বে। তাই এর একটা বিহিত না করলেই নয়। গো অ্যাহেড, এম.আর.নাইন। বিসিআই থেকে যত ধরনের সাপোর্ট প্রয়োজন, সবই পাবে তুমি।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ, স্যর।’

‘সাবধানে থেকো। দু-দু’বার তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে ওরা। তৃতীয়বারের চেষ্টায় যেন তারাই নিশ্চিহ্ন হয় সে ব্যবস্থা করবে… ঠিক আছে?’

‘চেষ্টার ত্রুটি করব না, স্যর।’

‘বেস্ট অভ লাক।’

চিফের সঙ্গে কথা শেষ হবার পর পূর্ব এশিয়ায় নিযুক্ত কয়েকজন বিসিআই এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রানা। বিশেষ এক লোকের খোঁজ চেয়েছে। দু’ঘণ্টার মাথায় সিঙ্গাপুরের রেসিডেন্ট এজেন্ট মাহবুব জানিয়েছে, পাওয়া গেছে তাকে। ব্যস, তারপরেই টিকেট কেটে বিমানে চড়ে বসেছে ও আর মুরল্যাণ্ড।

এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হোটেলে এসে উঠেছে ওরা। মাহবুবের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিজের রুমের সোফায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছে রানা।

কর্কশ শব্দে হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠল ও। ফোন বাজছে। রিসিভার তুলে ঠেকাল কানে।

‘ইয়েস?’

‘মাসুদ ভাই, আমি মাহবুব। হোয়াইট রাজা-য় চলে যান, আধঘণ্টার মধ্যে।’

‘কোথায়?’

‘হোয়াইট রাজা বার অ্যাণ্ড রেস্টুরেন্ট। আজ সন্ধ্যায় ওখানেই ডিনার করার কথা লোকটার।’

‘ঠিক আছে,’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা। ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা সোয়া সাতটা, অথচ প্রচণ্ড অবসাদ অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন গভীর রাত, ঘুমানো উচিত এখন। আসলে জেট ল্যাগে আক্রান্ত হয়েছে ও। গত দু’দিন দু’দফা বদলেছে ওর টাইম জোন, শরীর এখনও তাতে অভ্যস্ত হতে পারেনি।

উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল রানা। পাশের রুমের দরজায় গিয়ে টোকা দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলল মুরল্যাণ্ড। শেভ করে, ধোপদুরস্ত পোশাক পরে পুরোপুরি তৈরি।

‘এ কী! তুমি তো দেখছি পুরো রেডি! ঘুমাওনি?’

‘কীসের ঘুম?’ এক গাল হাসল মুরল্যাণ্ড। ‘আমি নিশাচর প্রাণী। রাত আমাকে ডাকে।’

‘এখন অন্য এক ডাকে সাড়া দিতে হবে। পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি রেডি হয়ে আসছি। এই ফাঁকে তুমি খোঁজ বের করে ফেলো, হোয়াইট রাজা বার-টা কোথায়।’

.

হোটেলের খুব কাছেই হোয়াইট রাজা বার অ্যাণ্ড রেস্টুরেন্ট। ভিক্টোরিয়ান আমলে ইংরেজ ভদ্রলোকদের ক্লাব ছিল ওটা, ভেতরটা এখনও বয়ে চলেছে সেই আমলের রীতিনীতির স্মৃতিচিহ্ন। সবগুলো দেয়াল মেহগনি কাঠের কারুকার্যময় প্যানেল দিয়ে ঢাকা, রয়েছে প্রাচীন আমলের কাঁচ বসানো স্কাইলাইট। সোফা আর চেয়ারগুলো পুরনো ডিজাইনের, পুরু গদি দিয়ে মোড়া। দেখে মনে হয় স্বয়ং চার্চিল কখনও ওগুলোয় আসন গ্রহণ করেছিলেন।

বিশ মিনিটের মাথায় ওখানে পৌঁছুল রানা ও মুরল্যাণ্ড। ঘুরে দেখল ভেতরটা। যেখানে ব্রিটিশ ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির গণ্যমান্য সদস্যরা তাস খেলতেন, সেখানে এখন ধনী সিঙ্গাপুরী ব্যবসায়ী আর বিদেশি টুরিস্টদের আনাগোনা। দামি সি-ফুড আর সুরা পানের আসর বসিয়েছে তারা। সবার ওপর একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে মেইন বারে এসে বসল দু’জনে, কাঙ্ক্ষিত লোকটা এখনও আসেনি।

‘কী দেব, স্যর?’ জানতে চাইল বারটেণ্ডার।

‘আমি একটা ব্লাডি মেরি নেব,’ বলল মুরল্যাণ্ড।

‘নিশ্চয়ই, স্যর,’ বলল বারটেণ্ডার। রানার দিকে ফিরল। ‘আর আপনি?’

রেস্টুরেন্টের ভেতরে চোখ বোলাচ্ছে রানা, মুখ না ঘুরিয়েই বলল, ‘কফি। ব্ল্যাক। উইদাউট শুগার।’

‘জী, স্যর।’ চলে গেল বারটেণ্ডার।

‘কফি?’ ভুরু কুঁচকে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘বারে এসে কেউ কফি খায়?’

‘এখানে ড্রিঙ্ক করতে আসিনি আমরা।’

‘এক ঢিলে দুই পাখি মারতে তো কোনও দোষ নেই। রথও দেখলাম, কলাও বেচলাম।’

‘কোটাকে রথ, আর কোন্টাকে কলা ভাবছ, জানি না। তবে যে-কাজে এসেছি, তা সহজ নয়। সেজন্যেই কফি চাইলাম, শরীর যাতে ঝরঝরে থাকে।’

বারটেণ্ডার ফিরে এসেছে। ড্রিঙ্কের গ্লাস আর কফির কাপ এগিয়ে দিল। বারের পেছনে টাঙানো একটা তৈলচিত্রের ওপর নজর পড়ল রানার। তলায় পেতলের ফলক লাগানো আছে। নামটা পড়ল ও, ‘স্যর জেমস ব্রুক।’

‘ইনিই হোয়াইট রাজা,’ বলল বারটেণ্ডার।

‘তা-ই?’

‘জী। ১৮৪১ সালে ব্রুনেইয়ের সুলতান-বিরোধী একটা বিদ্রোহ দমন করেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে সারাওয়াকের রাজার খেতাব দেয়া হয় তাঁকে। ছোটখাট একটা রাজ্য ওটা, এখন নাম বদলে কুচিং হয়ে গেছে। স্যর ব্রুক ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেটা শাসন করেছেন ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। এরপর জাপানিদের হামলায় সেটা বেদখল হয়ে যায়।’

‘কিন্তু সারাওয়াক তো কারিমাতা প্রণালীর ওপারে… বোর্নিওতে।’

‘ঠিক। যুদ্ধ শেষ হবার পর রাজ্যটা ব্রিটিশদের উপহার দেন রাজার পরিবার। তাঁর সম্মানে এই ক্লাবটার নাম রাখা হয়েছে।’

‘হুম। বুঝলাম।’

‘এনজয় ইয়োর ড্রিঙ্ক।’ অন্য কাস্টোমারের কাছে চলে গেল বারটেণ্ডার।

কফিতে চুমুক দিল রানা। মুরল্যাণ্ডও চুমুক দিল তার ড্রিঙ্কে। এরপর বলল, ‘এখানে কী করছি আমরা, জানতে পারি? নিশ্চয়ই ইতিহাসের পাঠ নেবার জন্যে আসিনি?’

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘যাকে খুঁজছি, সে এখানে আসবে।’

‘কাকে যে খুঁজছি, সেটাই এখন পর্যন্ত বলোনি আমাকে। কে এই লোক? কর্টেজের সঙ্গে তার কানেকশন কী?’

‘তা হলে তোমাকে আমার একটা ক্লাসিফায়েড মিশনের গল্প শোনাতে হয়,’ বলল রানা। ‘সময় কম, তাই সংক্ষেপে বলছি। কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই বিশেষ এক ধরনের মাদকদ্রব্যের চালান বেড়ে যায় বাংলাদেশে। কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছিল না, তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মাদকের উৎসটাই বন্ধ করে দিতে হবে। খোঁজখবর নিয়ে আমরা জানতে পারি, থাইল্যাণ্ডের সীমান্ত এলাকায় তৈরি হচ্ছে মাদকটা, মায়ানমার হয়ে পৌঁছচ্ছে বাংলাদেশে। ছোট্ট একটা টিম সঙ্গে দিয়ে আমাকে পাঠানো হয় থাইল্যাণ্ডে-কারখানাটা ধ্বংস করে দেবার জন্যে। ওটার লোকেশন জানতাম না আমরা, তাই ভাড়া করি এক ইনফর্মারকে। লোকটার নাম ডেমিয়েন ফ্যাং—আধা-চায়নিজ, আধা-মালয়েশিয়ান এক গ্যাংস্টার; ওরিয়েন্টাল আণ্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষস্থানীয় লোক। ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটির পাশাপাশি তার আরেক পেশা হলো, গোপনে বিভিন্ন দেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর কাছে পূর্ব এশিয়ার গোয়েন্দা-তথ্য সরবরাহ করা। আমাদেরকে খুশি মনেই সাহায্য করতে রাজি হলো সে, সাতদিনের মাথায় কারখানাটার লোকেশন-সহ বিশদ তথ্য জোগাড়ও করে দিল। তবে যেটা সে চেপে গেল, তা হলো, ওই কারখানাটা আসলে ওরই। কোটি কোটি টাকা আয় হয় তার ওখান থেকে। আর সেজন্যে কারখানাটার নিরাপত্তার জন্যে দুর্ধর্ষ একদল মার্সেনারি রাখা হয়েছে, তাদের লিডার হলো…’

‘কুচিয়ো কর্টেজ?’ রানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল মুরল্যাণ্ড।

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘পেরুভিয়ান মিলিটারির একজন প্রাক্তন কমাণ্ডো সে। শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত হবার পর মার্সেনারি হিসেবে কাজ শুরু করে। ন্যায়-নীতির বালাই নেই, নির্দয় এক পাষণ্ড। টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। এনিওয়ে, একদিকে ফ্যাং আমাদেরকে কারখানার ঠিকানা দিল, আরেকদিকে কর্টেজকে জানিয়ে দিল আমাদের আসার খবর। তাই ওখানে অপারেশন চালাতে গিয়েই অ্যামবুশে পড়লাম আমরা। আমার টিমের একজন এজেন্ট মারা গেল, বাকি দু’জন-সহ আমি বন্দি হলাম। চাইলে তখুনি কর্টেজ খুন করতে পারত আমাকে, কিন্তু করেনি। ভেবেছিল, টর্চার করে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন রকম গোপন তথ্য জোগাড় করবে, তারপর মারবে। কিন্তু তার আগেই…’

‘ব্যস, আর বলতে হবে না,’ আবার ওকে থামিয়ে দিল মুরল্যাণ্ড। ‘তোমাকে বাগে পাবার পরেও বাঁচিয়ে রাখলে কী ঘটতে পারে, সে-ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা আছে আমার। নিশ্চয়ই কোনোভাবে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলে, তাই না? তারপর ধ্বংস করে দিয়েছিলে কারখানাটা।’

‘আমাকে একটু বেশিই চেনো তুমি,’ হাসল রানা। ‘হ্যাঁ, আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম পুরো কারখানায়। কুচিয়ো আটকা পড়ে গিয়েছিল ভেতরে। আমি ভেবেছিলাম, মারা গেছে সে।’

‘আর ফ্যাং?’

‘ওকেও কঠিন শাস্তি দেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমেরিকানদের কারণে পারিনি। বিসিআইয়ের কাছে অনুরোধ এসেছিল সিআইএ-র তরফ থেকে, ওকে যেন কিছু করা না হয়। ওদের ওরিয়েন্টাল নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফ্যাং, চীন আর উত্তর কোরিয়ার ভেতরের খবর সরবরাহ করে, তাই ওকে যেমন আছে তেমনই থাকতে দেয়া প্রয়োজন।’

‘তোমরা সে-অনুরোধ মেনে নিলে?’ বিস্মিত গলায় বলল মুরল্যাণ্ড। ‘লোকটা তোমাদের সঙ্গে এত বড় বেঈমানি করার পরেও?’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘মাঝে মাঝে কিছু ব্যাপারে সমঝোতা করে নিতে হয়—এটাই এসপিয়োনাজ জগতের নিয়ম। একটা অনুরোধ মেনে নিলে পরে দশটা অনুরোধ করার সুযোগ পাওয়া যায়। অবশ্য, ফ্যাংকে একেবারে ছেড়ে দিইনি আমি, ছোট্ট একটা শাস্তি দিয়ে তবেই ছেড়েছি।’

‘কী শাস্তি?’

‘বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা নেই ওর।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল মুরল্যাণ্ডের, তবে কিছু বলার সুযোগ পেল না। রেস্টুরেন্টের দরজায় নড়াচড়া, লক্ষ করে মুখ ঘোরাল। আপাদমস্তক সফেদ সাজে মোড়া এক লোক ঢুকেছে ভেতরে। মাথায় সাদা হ্যাট, গায়ে সাদা সুট, পায়ে সাদা জুতো, হাতে রূপার ছড়ি। লম্বায় বড়জোর সাড়ে পাঁচ ফুট, তেলতেলে সাদা মুখ, ঠোঁটের ওপরে সরু একজোড়া গোঁফ। বয়স চল্লিশের আশপাশে। ছোটখাট লোকটার দু’পাশে রয়েছে দু’জন ছ’ফুটি পালোয়ান টাইপের বডিগার্ড। তবে এসব ছাড়িয়ে মুরল্যাণ্ডের চোখ চলে গেল তার বাঁ হাতের দিকে-চারটে মাত্র আঙুল দেখা যাচ্ছে সেখানে।

‘বাঁচবে অনেকদিন,’ বলল ও। ‘ওই দেখো, বলতে না বলতে চলে এসেছে।’

রানা কিছু বলল না, ও-ও তাকিয়ে আছে ডেমিয়েন ফ্যাঙের দিকে। শেষবার যেমন দেখেছিল, এখনও তেমনই আছে লোকটা, বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

দরজা দিয়ে ঢুকে একটু থামল ফ্যাং। তারপর পা বাড়াল ভেতরে। কয়েক পা গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। চারপাশে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখতে পেয়েছে রানাকে। দিক পাল্টে এগিয়ে এল বারের দিকে।

‘মাসুদ রানা!’ কাছে এসে বলল সে। ‘ভুল দেখছি না তো?’

‘হ্যালো, ডেমিয়েন,’ নীরস গলায় বলল রানা।

এখানকার স্ট্যাণ্ডার্ড বড্ড নেমে গেছে,’ মুখ বাঁকিয়ে বলল ফ্যাং, ‘নইলে তোমার মত

তোমার মত লোককে ঢুকতে দেয়? ম্যানেজমেন্টের কাছে কমপ্লেইন করতে হবে দেখছি।’

‘তার কোনও প্রয়োজন নেই,’ হালকা গলায় বলল রানা। ‘আমাকে একটা ছোট্ট ইনফরমেশন দাও, তারপর দেখবে আমি ঠিক কপূরের মত উবে গেছি।’

‘ইনফরমেশন এমনি এমনি মেলে না,’ ফ্যাং বলল। ‘দিনকাল খারাপ, সবকিছুরই দাম বেড়েছে। তারপরেও… কী জানতে চাও, আর তার জন্যে কত দেবে, ঝটপট বলে ফেলো।’

‘কিছু দিতে হবে কেন? তোমার কাছে পাওনা আছে আমার, ইনফরমেশনটা দিলে সব শোধবোধ হয়ে যাবে।’

‘পাওনা? এটার পরেও?’ বাম হাতটা উঁচু করে দেখাল ফ্যাং। ‘শোধবোধের কথা এলে তোমার সবকটা আঙুল কেটে নেয়া দরকার আমার।’

শ্রাগ করল রানা। ‘বেশ, সেক্ষেত্রে তোমার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার সুযোগ দিচ্ছি। ভেবে দেখো সেটার দাম কত।’

‘আমার মর্যাদা?’ দাঁত খিঁচাল ফ্যাং। ‘কী সব আবোল- তাবোল বকছ? যা বলার জলদি বলো, রানা। ডিনারে দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’

‘বলতে চাইছি যে, সবার সামনে যদি তোমাকে আর তোমার দুই বডিগার্ডকে একটা পিটুনি দিই… পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ইনফরমেশনটা বের করে আনি, তা হলে আণ্ডারওয়ার্ল্ডে তোমার মর্যাদা কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে, সেটা ভাবো।’

সতর্ক একটা ভাব ফুটল ফ্যাঙের চেহারায়। আস্তে পিছিয়ে গেল দু’পা, যাতে রানা এগোতে গেলে বডিগার্ডরা ওকে মাঝপথে ঠেকাতে পারে।

‘পিটুনিটা তুমি খেলে তোমার মর্যাদা কোথায় যাবে, সেটাও ভেবে দেখা উচিত,’ বলল সে।

‘আমি ভাবাভাবিতে না, কাজে বিশ্বাসী।’

একদৃষ্টে রানার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ফ্যাং। তারপর বডিগার্ডদের উদ্দেশে বলল, ‘এই লোক ঝামেলা বাধাতে চাইছে। ওকে সিধা করো।’

মাথা ঝাঁকাল দুই বডিগার্ড। মুঠো পাকিয়ে এগিয়ে গেল রানার দিকে। ঢোক গিলে দৈত্যাকার দেহদুটো খেয়াল করে দেখল রানা। একেক জনের ওজন আড়াইশো পাউণ্ডের কম নয়। এদের সঙ্গে একা পেরে ওঠা অসম্ভব। তবে একটা সুবিধে রয়েছে ওর। একা ওকেই সিধে করতে বলেছে ফ্যাং; সে বুঝতে পারেনি, পাশে বসে থাকা সাদাসিধে চেহারার বিদেশি লোকটা রানার সঙ্গী। লড়াইটা একেবারে অসম হবে না।

দুই বডিগার্ড কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা, তারপরেই ঝট করে হাতের কাপ থেকে গরম কফি ছুঁড়ল তাদের মুখে। ছপাৎ করে চোখেমুখে পড়ল সেই কফি। চামড়া পুড়ে যাবার মত উত্তপ্ত নয়, তারপরেও গরম তো বটেই। কাতরে উঠল পালোয়ানরা, চোখ বন্ধ করে ফেলল, দু’হাত উঠে গেল মুখের দিকে। অরক্ষিত হয়ে গেল দেহ।

বসা অবস্থা থেকে ঝাঁপ দিল রানা, রাগবি খেলোয়াড়ের মত ট্যাকল করল একজনকে, কাঁধ দিয়ে আঘাত করল বুক আর পেটের সংযোগস্থলে। পাথরের মত শক্ত শরীর লোকটার, যেন একটা গাছের গুঁড়িকে আঘাত করেছে ও। তবে কাজ যা হবার ঠিকই হলো, হুঁক করে বুক থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেল লোকটার, তাল হারিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ল মেঝেতে। একলাফে তার বুকের ওপর চড়ে বসল রানা।

সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের ভেতর মুরল্যাণ্ডও সচল হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে একটা বারস্টুল তুলে নিল সে। দ্বিতীয় লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওটা সজোরে ভাঙল তার মাথায়। কাটা কলাগাছের মত মেঝেতে আছড়ে পড়ল পালোয়ান।

রানার চোয়াল লক্ষ্য একটা ঘুসি চালাল এক নম্বর ষণ্ডা, ঠিকমত লাগাতে পারল না। তার কাঁধ আর গলার সংযোগস্থলের প্রেশার পয়েন্টে বাম হাতের কনুই দিয়ে মোক্ষম এক খোঁচা মারল রানা। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল লোকটা, মাথা পেছনদিকে হেলিয়ে দিয়েছে, উন্মুক্ত করে দিয়েছে চোয়াল। সর্বশক্তিতে সেখানে একটা রাইট হুক মারল রানা। প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল বডিগার্ডের মাথা, জ্ঞান হারাল সঙ্গে সঙ্গে।

এত দ্রুত সবকিছু ঘটে গেছে, কিছু বুঝে ওঠার সময় পায়নি কেউ। এবার চেয়ার-টেবিল ছেড়ে উঠে এল রেস্টুরেন্টের কাস্টোমাররা। শুরু হলো গুঞ্জন, ফিসফাস। – সেলফোন বের করে ছবিও তুলতে শুরু করেছে অনেকে।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রানা। নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না, এত সহজে ঘায়েল হয়ে গেছে দুই দানব। ঘাড় ফিরিয়ে ফ্যাঙের দিকে তাকাল। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সে, চোখ বিস্ফারিত। তার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রানা।

ঢোক গিলল ফ্যাং। বোকার মত তাকাল এদিক-ওদিক। রানা তার দিকে এগোতে শুরু করতেই সাহস হারাল। হাতের ছড়ি ফেলে দিয়ে পাঁই করে উল্টো ঘুরল, পড়িমরি করে ছুট লাগিয়ে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে।

‘ধ্যাত্তেরি!’ গাল দিয়ে উঠল রানা। ‘ববি, এসো!’

দরজা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল দু’জনে। ডানদিক থেকে ভেসে আসছে ছুটন্ত পদশব্দ, ওদিকে তাকাতেই ফ্যাংকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দেখল। গাড়ি-টাড়ি খোঁজার ঝামেলায় যাচ্ছে না… গাড়ির চাবি সম্ভবত নেইও তার কাছে, বডিগার্ডদের কাছে থাকার কথা…. তাই দৌড়ে পালাতে চাইছে। তাকে ধাওয়া করল রানা ও মুরল্যাণ্ড।

বিনা নোটিশে হঠাৎ ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। একদিক থেকে ভাল হলো, পথচারীরা ঝটপট আশ্রয় খুঁজে নেয়ায় খালি হয়ে গেল সাইডওয়াক; কিন্তু একই সঙ্গে সঙ্কুচিত হয়ে এল দৃষ্টিসীমা। বাঁক নিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল ফ্যাং, ঠিকমত না তাকালে সেটা দেখতেই পেত না রানা। ইতিমধ্যে পঞ্চাশ গজ এগিয়ে গেছে লোকটা।

‘ব্যাটা এত জোরে দৌড়াতে পারে, জানতাম না,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা।

‘কারা তাকে ধাওয়া করছে, সেটা বুঝতে হবে তো!’ কৌতুক করল মুরল্যাণ্ড।

ধৈর্য ধরল রানা, অ্যাড্রেনালিনের প্রাথমিক ধাক্কায় এমন গতি পাচ্ছে ফ্যাং, কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা ধরে রাখতে পারবে না। হাজার হোক, রানা আর মুরল্যাণ্ডের ফিটনেস তার চেয়ে অনেক বেশি। নিয়মিত ব্যায়ামের সুফল পাওয়া যাবে শীঘ্রি।

ছুটতে ছুটতে এক ঝলকের জন্যে পেছনে তাকাল ফ্যাং, এরপর দিক পাল্টে ঢুকে পড়ল আরেকটা গলিতে। ওটার মুখে পৌঁছুতেই ভেজা পেভমেন্টে আছাড় খেল মুরল্যাণ্ড, ঘষটাতে ঘষটাতে চলে গেল কয়েক গজ। কিন্তু পরক্ষণেই আবার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, দৌড়ে চলে এল রানার পাশে। আড়চোখে রানা দেখতে পেল, বেচারার শার্ট ছিঁড়ে গেছে, রক্ত উঁকি দিচ্ছে কনুইয়ে, প্যান্টের হাঁটুও ছড়ে গেছে।

‘মনে আছে, পরেরবার শুকনো মরুভূমিতে যেতে চেয়েছি?’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘এখন কসম খেয়ে ফেললাম।’

হাসল না রানা, দম ধরে রাখা দরকার। গলির শেষপ্রান্তে একটা বেড়া দেখতে পাচ্ছে, দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটের মত ওটা বেয়ে ওপরে উঠে গেল ফ্যাং, লাফিয়ে পড়ল ওপাশে। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানে ওরাও পৌঁছে গেল। প্রথমে রানা টপকাল বেড়া, তারপর মুরল্যাণ্ড। ওপাশের ভেজা ঘাসের ওপর নেমে এল দু’জনে।

ছোট একটা পার্কের ভেতর পৌঁছে গেছে ওরা। চারদিকে গাছপালা আর ঝোপঝাড়। আলো নেই কোনও। চাইলে লুকাতে পারত ফ্যাং, তা না করে দৌড়াচ্ছে এখনও। শোনা যাচ্ছে পায়ের আওয়াজ। রানা ও মুরল্যাণ্ডও ছুটল সেই শব্দ লক্ষ্য করে। যখন দেখা পেল লোকটার, তখন হাঁপিয়ে উঠেছে সে, তবে পৌঁছে গেছে পার্কের আরেক প্রান্তে।

ওপাশে আরেকটা বেড়া। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে বেড়া বেয়ে ফ্যাং উঠল কিছুদূর, তারপর শক্তি হারিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল এ- পাশেই। তার দিকে এগিয়ে গেল ওরা। কলার ধরে দাঁড় করাল। বেড়ার ওপর তাকে ঠেসে ধরল মুরল্যাণ্ড।

‘দৌড়ঝাঁপ অনেক হলো, ডেমিয়েন,’ বলল রানা। ‘এবার বাতচিত করা যাক, কী বলো?’

‘তোমাকে কিচ্ছু বলব না আমি, ফুঁসে উঠল ফ্যাং। ‘কী জানতে চাই, সেটাই তো শুনলে না।’

‘কুচিয়োর খবর চাও তো? আমি জানি, তুমি ওকে খুঁজছ।’

‘তা হলে ভালয় ভালয় বলে দিলেই কি হয় না?’

‘ও জানতে পারলে আমাকে খুন করবে।’

‘যদি না তার আগেই আমার হাতে খুন হয়ে যায়।’

‘তুমি খুন করবে কুচিয়োকে?’ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ফ্যাং। ‘ওকে নাগালেই পাবে না। সবসময় তোমার চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে থাকছে ও।

‘প্রার্থনা করো, যাতে ভুল প্রমাণিত হয় কথাটা,’ বলল রানা। ‘কারণ, আজ তুমি আমাকে ওর খোঁজ দেবে।’

‘ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, রানা। আমাকে নিয়ে তুমি যা-ই করো না কেন, কুচিয়ো তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশিই করতে পারবে।’

রানার দিকে তাকাল মুরল্যাণ্ড। ‘আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ দেয়নি। ভয় দেখানোর কথা বলছি… চেষ্টা করে দেখবে নাকি?’

‘ভয় দেখাব কেন, যা করার সত্যি সত্যি করব,’ বলল রানা। ‘ধরো ওকে শক্ত করে।’

ল্যাং মেরে লোকটাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলল মুরল্যাণ্ড, চেপে বসল বুকে। নড়াচড়ার উপায় রইল না তার।

জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছুরি বের করল রানা। নাড়াল ফ্যাঙের চোখের সামনে। ‘চিনতে পারছ? কুচিয়োর ছুরি।’

‘ওটা আমাকে দেখাচ্ছ কেন?’ জিজ্ঞেস করল ফ্যাং।

‘এ-কথা জানাবার জন্যে যে, কুচিয়োর খবর না দিলে এই কুচিয়োর ছুরিই তোমার সর্বনাশ করবে। আগেরবার একটা আঙুল কেটেছিলাম, এবার বাকিগুলোও কেটে নেব। ভেবে দেখো, এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী করতে পারে কুচিয়ো তোমাকে নিয়ে।

‘ধাপ্পা দিচ্ছ তুমি!’ জোর গলায় বলতে চাইল ফ্যাং, কিন্তু ভেঙে গেল গলা। চোখের তারায় ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। ‘আমার কিছু হলে সিআইএ তোমাকে ছাড়বে না।’

ওদের পরোয়াই যদি করতাম, আজ তোমার হাতে একটা আঙুল কম থাকত না,’ কঠিন গলায় বলল রানা। ‘শেষ সুযোগ। মুখ খুলবে কি না বলো।’

ওর চেহারা জরিপ করল ফ্যাং। নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে রানার মুখ, মায়া-দয়ার চিহ্নমাত্র নেই। আবছা আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল হাতে ধরা ছুরিটার ফলা। পাগল হয়ে উঠল সে, মোচড়ামুচড়ি করে মুক্ত হতে চাইল। কিন্তু জগদ্দল পাথরের মত তার ওপর চেপে বসেছে মুরল্যাণ্ড, নড়তে পারল না এক চুল।

‘না, প্লিজ…’ অনুনয় করল ফ্যাং।

হাঁটু গেড়ে খপ্ করে তার ডান হাতটা ধরল রানা, ছুরির ফলা ঠেকাল কড়ে আঙুলে। বলল, ‘একটা একটা করে কাটতে থাকব তোমার আঙুল… যতক্ষণ না তুমি কথা বলতে শুরু করছ।’

‘কুচিয়ো মেরে ফেলবে আমাকে!’

‘আঙুলহীন হাত নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই তো ভাল, তাই না?’ বলল রানা।

‘আ…আমি পারব না।’

‘দেখা যাক, কতক্ষণ না পেরে থাকো। শুরু করছি।’

হালকা একটা পোঁচ দিল রানা। চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়ে এল ফ্যাঙের আঙুলের গোড়া থেকে। চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘না- আ-আ! থামো… প্লিজ, থামো। যা জানতে চাও, আমি বলব!’

ছুরিটা সরাল না রানা। ‘তা হলে বলো, কোথায় পাওয়া যাবে কুচিয়োকে?’

‘জ্…জানি না। সত্যি জানি না। এক বছর হলো ওর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি আমার।’

‘চাপা মেরো না। তুমি হলে ওর ধর্মবাপ-মার্সেনারি হিসেবে তুমিই প্রতিষ্ঠিত করেছ ওকে… তোমার মাধ্যমে কাজ পায় সে, প্রতিটা কাজের বিনিময়ে কমিশন নাও তুমি।’

‘সেসব পুরনো কথা। এখন আর কাজ খুঁজতে হয় না ওকে, পার্মানেন্ট একটা কাজ নাকি পেয়ে গেছে। গত দু’বছরে একবারও কাজ চাইতে আসেনি আমার কাছে।’

‘এইমাত্র বললে এক বছর, এখন আবার দু’বছর,’ গলার স্বর কঠিন হলো রানার। ‘হিসেবে গড়বড় করে ফেলছ, ডেমিয়েন। আঙুলটা বোধহয় কাটতেই হচ্ছে।’

‘না, না, আমি ঠিকই বলছি। দু’বছর হলো কাজ খোঁজে না, কিন্তু বছরখানেক আগে এসেছিল আমার কাছে—লোক চাইতে।’

‘মানে?’

‘লোক খুঁজছিল কুচিয়ো। ডেমোলিশন আর জাহাজের কাজে অভিজ্ঞ বেশ কিছু লোক দরকার ছিল তার। নিজে ম্যানেজ করতে পারছিল না, তাই আমার কাছে এসেছিল।’

এখন পর্যন্ত যা যা দেখেছে রানা, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে ফ্যাঙের কথার। ছোটখাট একটা বাহিনী গড়ে তুলেছে কর্টেজ, তার জন্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক জোগাড় করতে হয়েছে অবশ্যই। ফ্যাঙের দিকে আবার তাকাল ও। বলল, ‘হুম। একবারে নিশ্চয়ই সব লোক দিতে পারোনি ওকে? যোগাযোগ রাখতে কীভাবে?’

‘ই-মেইলে,’ জানাল ফ্যাং। ‘এখন যাও, আমার কম্পিউটারটাকে পিটিয়ে আর কিছু বের করতে পারো কি না দেখো।’

তিক্ততা অনুভব করল রানা—আধুনিক পৃথিবীর এই এক অসুবিধে। সামনাসামনি দেখাসাক্ষাতের প্রয়োজন হয় না, দুনিয়ার দুই প্রান্তে থেকেও ইন্টারনেট আর সেলফোনের কল্যাণে যোগাযোগ রাখতে পারে অপরাধীরা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফ্যাংকে দেখল ও। না, এত সহজে পুরোটা খুলে বলবে না ত্যাদড় লোকটা। নিশ্চয়ই কিছু লুকাচ্ছে।

‘আরও কিছু জানো তুমি,’ বলল ও। ‘ব্যাপার এটুকুই হলে তুমি এত দৌড়ঝাঁপ করতে না।’

চুপ করে রইল ফ্যাং।

‘ববি, হাতটা শক্ত করে ধরো,’ বলল রানা। ‘আঙুল কাটার সময় নইলে ঝাঁকি দেবে। ছুরিটা আবারও ফ্যাঙের আঙুলের গোড়ায় স্পর্শ করাল ও।

‘দাঁড়াও… দাঁড়াও!’ কাতর গলায় বলল ফ্যাং।

‘হয় মুখ খোলো, নয়তো আঙুলের আশা ছেড়ে দাও।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফ্যাং। নিচু গলায় বলল, ‘সাগরে থাকে ও… একটা জাহাজে। ঘরবাড়ি নেই ওর, জাহাজে চেপে ঘুরে বেড়ায় সারা দুনিয়াতে। এজন্যেই কেউ খুঁজে পায় না ওকে। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া যেতে পারে যে-কোনও দেশে। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে নাবিকদের মাঝে গা-ঢাকা দিয়ে ডাঙায় নামে ও।’

রহস্যটা পরিষ্কার হচ্ছে এবার। সবার চোখে ধুলো দিয়ে কী করে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কর্টেজ, তা বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার।

‘জাহাজটার নাম কী?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘জানি না,’ বলল ফ্যাং।

‘মিথ্যে বোলো না।’

‘সত্যি কথাই বলছি, কসম! ওর জায়গায় তুমি থাকলে আমাকে জানাতে?’

তা অবশ্য ঠিক, মানতে বাধ্য হলো রানা। একটু ভাবতেই একটা উপায় দেখতে পেল। ‘সেক্ষেত্রে শেষবার কোথায় আর কবে দেখা করেছিল তোমার সঙ্গে, সেটা বলো। ঠিক ঠিক তারিখ বলবে।’

‘এখানেই… সিঙ্গাপুরে। ফেব্রুয়ারির চার তারিখে। তারিখটা মনে আছে, কারণ ওটা ছিল চীনা নববর্ষের পরের দিন। ছুটি চলছিল সবখানে।’

‘গুড,’ উঠে দাঁড়াল রানা। ‘অনেক সাহায্য করলে তুমি, ডেমিয়েন। ববি, ওকে এবার ঘুম পাড়িয়ে দেবে?’

‘সানন্দে,’ বলে ফ্যাঙের চোয়ালে বিরাশি সিক্কার একটা ঘুসি চালাল মুরল্যাণ্ড। একটা ঝাঁকি খেয়ে নিথর হয়ে গেল লোকটা।

মুরল্যাণ্ডও উঠে দাঁড়াল এবার। অচেতন দেহটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘কী করবে এখন ওকে নিয়ে? জেগে ওঠার পর কুচিয়োকে সব জানিয়ে দিতে পারে। দলবল নিয়ে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেবারও চেষ্টা করতে পারে।’

‘সে-সুযোগ পেলে তো!’ মৃদু হাসল রানা। ‘আগামী কিছুদিনের জন্যে বিসিআইয়ের আতিথ্য গ্রহণ করতে হবে ওকে।’

পকেট থেকে সেলফোন বের করল ও। ডায়াল করল মাহবুবের নাম্বারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *