1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৫০

পঞ্চাশ

গলার কাছে উঠে আসা বিপদটা ভালমতই টের পেতে শুরু করেছেন আকুম্বা। পার্টিকেল বিমের এক দফা প্রবাহ বেহুদাই খরচ করেছেন তিনি, কিচ্ছু হয়নি আমেরিকার রাজধানীর। কর্টেজকে পাওয়া যাচ্ছে না। জেনেছেন, নর্দার্ন স্টারে নাকি এক বাঙালি নচ্ছার তাণ্ডব ঘটিয়ে দিচ্ছে। এদিকে পিঠটান দেবার কোনও লক্ষণ নেই আমেরিকান বহরটার, আবারও হামলা চালাবার সুযোগ খুঁজছে।

‘কুচিয়ো কোথায়?’ রেডিওতে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

‘বাঙালি লোকটাকে খুঁজতে গেছে,’ জানানো হলো ওপাশ থেকে।

‘আর ফালক্রাম?’

‘এখনও কাজ করছে না, স্যর। আমাদের এখানে কোনও পাওয়ার নেই।’

ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে হেডসেট নামিয়ে রাখলেন আকুম্বা। পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, ব্যর্থ হতে চলেছেন তিনি। সাগরের দিকে তাকালেন। আমেরিকান একটা সাবমেরিন ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু অন্যটা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে গভীর পানি থেকে। ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে বিস্ফোরণের আওয়াজ, একে একে ঘায়েল হচ্ছে তাঁর সাবমেরিনগুলো।

চোখে বিনোকিউলার লাগালেন তিনি। দেখতে পেলেন কমলা রঙের কতগুলো লাইফ-র‍্যাফট। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সাবমেরিনের ক্রুরা ভাসছে ওতে।

‘ওদেরকে টার্গেট করো,’ শান্ত গলায় নির্দেশ দিলেন আকুম্বা।

ইতস্তত করল ম্যালোন। বিবেকের সায় পাচ্ছে না অসহায় মানুষগুলোকে খুন করতে।

‘আমরা মরতে চলেছি, মি. ম্যালোন,’ বললেন আকুম্বা। ‘যাবার সময় ওদের যে-ক’জনকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই সান্ত্বনা।’

কন্ট্রোল থেকে পিছিয়ে গেল ম্যালোন। প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘না! জান দেবার খায়েশ হলে আপনি দিন। আমি এখানে মরছি না।’

এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিলেন আকুম্বা। ঝট করে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করলেন তিনি, ট্রিগার চাপলেন। তিনটে গর্ত তৈরি হলো ম্যালোনের বুকে। উল্টে পড়ে গেল সে। তাতেও তৃপ্ত হলেন না তিনি। লাশের গায়ে খালি করলেন পুরো ম্যাগাজিন। এত বড় আস্পর্ধা!

‘আবারও ভুল প্রমাণিত হলে তুমি, মি. ম্যালোন;’ দাঁতে দাঁত পিষে বললেন প্রেসিডেন্ট।

কন্ট্রোল রুমের সবাই আতঙ্কে জড়সড় হয়ে গেছে। দৃষ্টি বিস্ফারিত। তাদের দিকে তাকালেন এবার।

‘লাইফ র‍্যাফটগুলোকে টার্গেট করো,’ আবার হুকুম দিলেন তিনি। ‘ফায়ার!’

.

নেট কেটে জলকন্যাকে ওপারে নিয়ে গেছে তানিয়া। এখন খুঁজছে এনার্জি ওয়েপনের এমিটার।

‘টু-নাইন-যিরো হেডিঙে এগোও,’ বলল আসিফ।

জলকন্যার মুখ ঘোরাল তানিয়া, নতুন কোর্স ধরল। এক্সটার্নাল লাইটগুলো এখনও জ্বলছে। নিভিয়ে দিতে পারলে ভাল হতো, কিন্তু আবারও কোনও বাধার মুখে পড়তে চায় না। তা ছাড়া, জায়গামত পৌঁছেই গেছে ছোট্ট রোবটটা। ক্যামেরায় বিশাল একটা স্ট্রাকচারের গোড়া দেখা যাচ্ছে। চওড়া একটা টিউব চলে গেছে স্ট্রাকচারটার দিকে, দেখতে অনেকটা বড় বড় শহরের সিউয়ারেজ পাইপের মত।

‘আমার মনে হচ্ছে এটাই পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটরের টিউব,’ ভিডিও ফিড দেখে বলল তানিয়া।

আসিফের সামনের স্ক্রিনেও দেখা যাচ্ছে একই ছবি। ও বলল, ‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। আর স্ট্রাকচারটা নিশ্চয়ই এমিটার। ওটার গোড়ায় যাও।’

পানি কেটে সামনে এগোল জলকন্যা। একটু পরেই ক্যামেরায় দেখা গেল এমিটারের গোড়া, পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ তৈরি করে সি-ফ্লোর থেকে উঠে গেছে ওপরে। দেখাচ্ছে ভাঁজ করা কনুইয়ের মত।

‘এবার?’ জিজ্ঞেস করল তানিয়া।

‘ওই ভাঁজের ভেতর নিয়ে যাও জলকন্যাকে,’ বলল আসিফ। ‘বিস্ফোরণটা তা হলে ভালমত লাগবে এমিটারের গায়ে।’

আবারও ভার্চুয়াল কন্ট্রোল অপারেট করল তানিয়া। ধীরে ধীরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল জলকন্যা। ঢুকে পড়ল এমিটারের তলার ছায়ায়।

‘ব্যস, আর এগোনো যাচ্ছে না।’

ডিটোনেটর টেনে নিল আসিফ, সেফটি ক্যাপ খুলল। ‘রেডি?’

জবাব দেবার আগে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল তানিয়া। খারাপ লাগছে ওর। প্রাণহীন রোবটটার সঙ্গে এত সময় কাটিয়েছে যে, মায়া পড়ে গেছে।

‘তানিয়া?’ নরম সুরে ডাকল আসিফ।

সংবিৎ ফিরে পেল তানিয়া। আবেগের রাশ টেনে বলল, ‘ডিটোনেট।’

সুইচ চাপল আসিফ।

সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের জন্যে আলোর ঝলকানি দেখা গেল স্ক্রিনে, তারপরেই কেটে গেল ভিডিও ফিড। বিস্ফোরণের চাপা আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে।

‘বিদায়, জলকন্যা,’ ফিসফিস করে বলল তানিয়া।

কয়েক মুহূর্ত পরেই ছুটে এল শকওয়েভ। সাবমারসিবলকে পেরিয়ে যাবার সময় ক্ষণিকের জন্যে টালমাটাল করে দিল ওদের, তারপর মিলিয়ে গেল দূরে।

.

কন্ট্রোল প্যানেলের সবক’টা রাতি চোখের পলকে লাল হয়ে যেতে দেখলেন আকুম্বা। চাপা গুমগুম আওয়াজ শুনে ঝট করে তাকালেন সামনে। অবিশ্বাসের চোখে দেখলেন, এমিটারের চারপাশে ছিটকে উঠেছে পানি আর কাদা, যেন ফুলঝুরি ছুটেছে ওখানে। টলে উঠল এমিটারের পুরো কাঠামো, হুড়মুড় করে ধসে পড়ল সাগরে, ছিটাল আরও একরাশ পানি।

হতভম্ব হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। কীভাবে ঘটল ব্যাপারটা, কিছুই বুঝতে পারছেন না। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ঠায়।

রেডার কনসোল থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল অপারেটর, ‘স্যর! আরও মিসাইল আসছে! এক মিনিটের মধ্যে হিট করবে আমাদেরকে!’

তার কথা কানে তুললেন না আকুম্বা। লঘু পায়ে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এলেন ব্যালকনিতে। দুরন্ত বাতাস যেন অভ্যর্থনা জানাল তাকে, রাতের কালো চাদর জড়িয়ে ধরল সর্বাঙ্গ। যেখানে একটু আগেও সগর্বে মাথা তুলে রেখেছিল তাঁর মারণাস্ত্র, সেখানে এখন সাগরের ঘূর্ণিপাক।

শূন্য চোখে দিগন্তের দিকে তাকালেন তিনি। দেখতে পেলেন ছোট ছোট কিছু আলোর বিন্দু। হারপুন মিসাইলের টেইল-এণ্ডের আগুন সেগুলো। ছুটে আসছে তাঁর দিকে। বাঁচার উপায় নেই।

‘তা হলে আমিও ব্যর্থ হলাম,’ আপনমনে বললেন আকুম্বা, ‘হানিবাল দ্য গ্রেটের মত।’

একটু পরেই তাঁর ডানে-বাঁয়ে আঘাত হানল সবক’টা মিসাইল। বিস্ফোরণগুলো একত্র হয়ে বিশাল এক আগুনের গোলা তৈরি হলো। তার ভেতর ভস্ম হয়ে গেলেন মহাপরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *