1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ১৭

সতেরো

বাহাত্তর ঘণ্টা যেতে না যেতে নতুন দায়িত্বটার ওপর অভক্তি এসে গেল রানার। যতটা ভেবেছিল, অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। বাংলাদেশ থেকে আসা দুই বিজ্ঞানী বাদে রিসার্চারদের প্রতিটা দল আলাদা খাতির চাইছে, প্রত্যেকে প্রশ্ন তুলছে নিয়মকানুন, এমনকী নুমার খবরদারি নিয়েও।

আইসল্যাণ্ড থেকে আসা একটা গ্রুপ নালিশ ঠুকেছে, ইটালিয়ান গ্রুপ যে-এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে, তাতে ওদের বেজলাইন ডেটা সংগ্রহে অসুবিধে দেখা দিচ্ছে। স্প্যানিশ একটা গ্রুপ ধরা পড়েছে কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে ম্যাগনেটিক টাওয়ারে পতাকা বসাতে গিয়ে। পর্তুগিজরা খেপে আগুন। পুরনো আমল হলে এতক্ষণে পিস্তল নিয়ে ডুয়েলে নেমে পড়ত দু’পক্ষ।

অন্যদিকে জাপান থেকে তিনটে টিম এসেছে বলে নাখোশ হয়েছে চীনের প্রতিনিধি দল; তারাও বাড়তি টিম আনতে চায়। জাপানিরা সে-খবর পেয়ে বলেছে, চীনাদের একটা টিমেরও দরকার নেই; রিসার্চশেষে ওরা নাকি এমনিতেই, হ্যাকিং আর সাইবার অ্যাটাকের মাধ্যমে সব রিসার্চ ডেটা চুরি করে নিতে পারবে। এ-কথা শুনে তেলে- বেগুনে জ্বলে উঠেছে চীনারা।

জাতিসংঘকেও বিভিন্ন জাতির ভেতর এতসব ঝগড়াঝাঁটি সামলাতে হয় কি না সন্দেহ। তবে ঝামেলার শেষ ওখানেই নয়। মধ্যস্থতার পাশাপাশি লাইফগার্ডের ভূমিকাও পালন করতে হচ্ছে রানা, মুরল্যাণ্ড আর নেপচুনের ক্রুদের। বিজ্ঞানীরা নিজেদের ফিল্ডে দক্ষ, কিন্তু বেশিরভাগই সাগর সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ। কীভাবে পানির ওপরে বা নিচে বিচরণ করতে হবে, সে-বিষয়ে সামান্যই ধারণা রাখেন। ইতিমধ্যে দুটো বোটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে গেছে, কপাল ভাল যে কেউ আহত বা নিহত হয়নি। বোটদুটো মেরামতের জন্যে সান্তা মারিয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে সামলানো গেছে সমস্যাটা।

এ তো গেল পানির ওপরের ঘাপলা, ডাইভিং নিয়েও দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের বিপদ। একটা টিম তাদের এয়ার সিলিণ্ডারে বাতাসের ভুল মিশ্রণ ব্যবহার করে মরতে বসেছিল, নেপচুন থেকে রেসকিউ ডাইভার পাঠিয়ে উদ্ধার করতে হয়েছে তাদের। অন্য এক টিমের ডাইভাররা ডিকম্প্রেশন স্টপ ছাড়াই উঠে আসার চেষ্টা করছিল সারফেসে, তাদেরকে ঠেকাতে হয়েছে। ফরাসি এক বিজ্ঞানী ডুবে মরতে বসেছিলেন—তাঁদের টিমের অনভিজ্ঞ ডাইভমাস্টার তাঁর বেল্টে অতিরিক্ত ওজন বেঁধে দেয়ায় ভদ্রলোক পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলেন ভারী পাথরের মত।

তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে তাঁকে উদ্ধার করে আনে রানা ও মুরল্যাণ্ড। ওপরে পৌঁছুতে না পৌছুতেই দেখে, ফিনল্যাণ্ডের রিসার্চ টিমের ভাড়া করা বোটে আগুন লেগেছে। ঝামেলার পর ঝামেলা লেগে আছে এভাবে। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে রানা। মনে হচ্ছে, অপয়া ওই টাওয়ারটা আবিষ্কার না হলেই ভাল হতো।

এখন সন্ধ্যা গড়াতে শুরু করেছে। দিগন্তে ঢলে পড়েছে সূর্য, অবশেষে থেমেছে সমস্ত উৎপাত। ছোট ছোট বোটগুলো ফিরে চলেছে সান্তা মারিয়ায়। রানা অনুমান করল, দ্বীপের পানশালাগুলো ভরে উঠবে শীঘ্রি; সারাদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্পগুজবে মেতে উঠবেন বিজ্ঞানীরা। সত্যি-মিথ্যের মিশেল থাকবে তাঁদের গল্পে। অবশ্য না-ও হতে পারে। অবসরে বিজ্ঞানীরা কী করেন, সে-ব্যাপারে ধারণা নেই ওর। হতে পারে, রাতভর প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আঁটবেন, কাল সকালে ফিরে এসে নিত্যনতুন ঝামেলা সৃষ্টি করবেন রানা আর মুরল্যাণ্ডের জন্যে।

দায়িত্বটা নিয়ে ভুলই করল বোধহয়—ভাবতে ভাবতে নেপচুনের ব্রিজউইঙে এসে দাঁড়াল রানা। শেষ বেলার মুক্ত বাতাস উপভোগ করবে। কিন্তু সাগরের পানে তাকাতেই চোখ পড়ল পঞ্চাশ-ফুট দীর্ঘ কালো রঙের একটা মোটরবোটের ওপর, ওটা আগে দেখেনি।

‘ববি,’ ডাকল ও। ‘চিনতে পারছ বোটটা?’

পাশে এসে চোখ সরু করে তাকাল মুরল্যাণ্ড। বলল, ‘সকালে তো ছিল না।’

‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘জোডিয়াক নামাও। চলো দেখে আসি, এখনও কে বসে আছে ওখানে।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল নেপচুনের জোডিয়াক। দু’জন ক্রু নিয়ে রানা ও মুরল্যাণ্ড রওনা হলো বোটটার দিকে। কাছে গিয়ে চারপাশে ঘুরে এল এক চক্কর।

‘কাউকে দেখতে পাচ্ছ?’

রানার প্রশ্নে মাথা নাড়ল মুরল্যাণ্ড। বলল, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? বোটটা কিন্তু আমাদের এক্সক্লুসিভিটি জোনের বাইরে রয়েছে।’

ভুরু কোঁচকাল রানা। ‘কী বললে?’

‘টাওয়ারের চারদিকে এক মাইল পর্যন্ত এক্সক্লুসিভিটি জোন,’ জানাল মুরল্যাণ্ড। ‘আমাদের এখতিয়ার ওই পর্যন্তই। বোটটা এক মাইলের বাইরে।’

‘এই নিয়ম কে বানিয়েছে?’

‘আমি।’

‘তুমি আবার কবে থেকে ব্যুরোক্র্যাট হলে?’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসল মুরল্যাণ্ড। ‘আমাকে আমলাতান্ত্রিক কাজে লাগালে আরও অনেক কিছুই দেখতে পাবে।’

রানাও হাসল। ‘বেশ, এতই যদি তোমার ক্ষমতা, এক্সক্লুসিভিটি জোনের আয়তন বাড়ানো যাক।’

‘ভোটাভুটি ছাড়া আমি কোনও সিদ্ধান্ত নিই না।’

‘ওরেব্বাপরে! ভোট লাগবে?’

‘অবশ্যই। যারা যারা জোনের আয়তন বাড়াতে চাও, হাত তোলো।’

রানা আর দুই নাবিক হাত তুলল।

‘ঠিক আছে,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের f মেনে নিলাম। সামনের বোট পর্যন্ত এক্সক্লুসিভিটি জোনের সীমানা বাড়ানো হলো।’

কোনোমতে হাসি চাপল রানা। ‘চলো, বোটটায় ওঠা যাক।’

মোটরবোটের পাশে ভেড়ানো হলো জোডিয়াক। হাঁক- ডাকে সাড়া না পেয়ে চারজনে উঠে গেল ওটায়। কাউকে দেখা গেল না কোথাও। ডেকের ওপর পড়ে আছে স্পেয়ার ডাইভিং গিয়ার। পাইলটের কেবিনে পাওয়া গেল কিছু চার্ট আর রাশান হরফে লেখা বিভিন্ন কাগজপত্র।

‘সবই রাশান,’ বলল রানা। ‘রাশান কোনও টিম কি নাম লিখিয়েছে আমাদের কাছে?’

মাথা দোলাল মুরল্যাণ্ড। ‘ওদের সায়েন্স মিনিস্ট্রি থেকে আরও তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিল, কিন্তু নাম লেখায়নি কেউ।’

‘দেখে তো মনে হচ্ছে এসেছে। আমাদের জানায়নি।’

বোটের পেছনে চলে গেল রানা। নোঙর ফেলা হয়েছে। যদিও কোনও পতাকা লাগানো হয়নি, তারপরেও বুঝতে পারছে, নোঙরের শেকল ধরে পানিতে নেমে গেছে বোটের মালিক। ডাইভিং ল্যাডারের পাশে পড়ে আছে এক জোড়া জুতো।

‘স্রেফ এক জোড়া জুতো,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল ও।

‘একাকী ডাইভ দিয়েছে কেউ,’ পাশ থেকে বলল মুরল্যাণ্ড।

একাকী ডুব দেয়া বিপজ্জনক, আর ওপরে কাউকে না রেখে যাওয়া রীতিমত পাগলামি। সামান্য বাতাস বা স্রোতে সরে যেতে পারে, কিংবা জলদস্যুরা চুরি করে নিয়ে যেতে পারে বোট; ফেরার কোনও জায়গা থাকবে না ড্রাইভারের।

‘এটা দেখেছেন?’ পেছন থেকে বলে উঠল এক নাবিক।

ঘুরল রানা। পোর্টেবল একটা মনিটর রাখা হয়েছে ডেকে, পর্দায় দেখা যাচ্ছে আণ্ডারওয়াটার ক্যামেরা দিয়ে তোলা ঘোলাটে ভিডিও

‘লাইভ ফিড?’ জানতে চাইল ও।

‘দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।’ হাঁটু গেড়ে মনিটরের সামনে বসে পড়েছে নাবিক, পরীক্ষা করছে সেটআপটা।

পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্যটা মনোযোগ দিয়ে দেখল রানা। সংকীর্ণ একটা জায়গায় ঢুকেছে ডুবুরি। দু’পাশে ইস্পাতের দেয়াল আর ইকুইপমেন্ট দেখা গেল। ডুবুরির নড়াচড়ায় পানিতে পাক খাচ্ছে কাদা।

‘নিচের একটা রেকে ঢুকেছে মনে হচ্ছে,’ মন্তব্য করল মুরল্যাণ্ড।

‘বোকা, নাকি ওভার-কনফিডেন্ট?’ বিস্ময় প্রকাশ করল রানা। রেক-ডাইভিঙের মত বিপজ্জনক কাজ পানির নিচে আর দ্বিতীয়টি নেই। কেউ একাকী সে চেষ্টা করতে পারে, ভাবা যায়?

‘ডেকে জিজ্ঞেস করবে নাকি?’ বলল মুরল্যাণ্ড।

‘না, গিয়ে জিজ্ঞেস করব।’ বোটে পড়ে থাকা এয়ারট্যাঙ্কের সেটের দিকে ইশারা করল রানা। ‘বাতাস ভরা আছে ওগুলোয়?’

গজ চেক করল মুরল্যাণ্ড। ‘হ্যাঁ।’

‘আমি তা হলে নিচে যাচ্ছি।’

দ্রুত তৈরি হয়ে নিল রানা। নেমে পড়ল পানিতে। কম্প্রেসড় এয়ারে শ্বাস নিতে নিতে চেইন ধরে রওনা হলো নিচে। তলদেশের কাছাকাছি পৌঁছুতেই চোখে পড়ল এক চিলতে আলো। দিক পাল্টে এগোল সেদিকে।

অচেনা ডুবুরি কোথায় ঢুকেছে, টের পেল খানিক পরেই। ডুবে থাকা লকহিড কনস্টেলেশন বিমানটার ভেতর থেকে আসছে আলো। দু’টুকরো হয়ে গেছে ফিউয়েলায, মাঝখানে বিশাল এক ফাটল। সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে আলোর রশ্মি, নাচানাচি করছে ভেতরে। সন্দেহ হলো, মানুষটা বিপদে পড়েছে কি না।

দ্রুত পা নাড়ল রানা। সাঁতার কেটে পৌঁছে গেল বিমানের ট্রিপল টেইলের কাছে। আলোটা এখনও নড়াচড়া করছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। ফাটলের দিকে এগিয়ে গেল ও; বুঝল, কনস্টেলেশনের ফরোয়ার্ড সেকশন থেকে আসছে ওই আলো। যেভাবে নড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে পানিতে ঘুরপাক খাচ্ছে উৎসটা, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। ভয় হলো, নিঃসঙ্গ ডুবুরি হয়তো অক্সিজেনের অভাবে এরই মধ্যে মারা গেছে, লাশটা পাক খাচ্ছে পানিতে। কবজিতে বাঁধা ডাইভ লাইটটা হয়তো সে-কারণেই ঘুরতে ঘুরতে আলো ছড়াচ্ছে এভাবে।

ফাটলে শরীর গলিয়ে দিল রানা। জট পাকানো তারের কুণ্ডলী আর বাঁকা-ফাটা ইস্পাতের পাতের মাঝ দিয়ে সাবধানে নামল ফিউযেলাযের ভেতরে। ফরোয়ার্ড সেকশনের কাছে কাদামাটির মেঘ দেখতে পেল, তার মাঝ দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে ডাইভ লাইটের আলো। আবছাভাবে চোখে পড়ছে একটা মানুষের অবয়ব।

ওদিকে এগিয়ে গেল ও। কাছে যেতেই দেখতে পেল নিঃসঙ্গ ডুবুরিকে। নিচু হয়ে কী যেন করছে মানুষটা, এরপর শরীর বাঁকিয়ে-চুরিয়ে টানাটানি শুরু করল। লাইটটা তার বেল্টে বাঁধা। কাছে গিয়ে কাঁধে টোকা দিল রানা।

সঙ্গে সঙ্গে ঝট্ করে ঘুরল ডুবুরি। লাইটের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল তার হাতে ধরা ছুরির ফলা—আঘাত করার চেষ্টা করছে। হাত তুলে তাকে ব্লক করল রানা, কবজি ধরে মুচড়ে দিল, মুঠো থেকে খসে পড়ল ছুরিটা। দু’জনেরই রেগুলেটর থেকে বেরোচ্ছে রাশ রাশ বুদ, সেই সঙ্গে ঘোলা পানি… কেউই কাউকে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকমত।

ডুবুরির ডানহাত শক্ত করে ধরে রাখল রানা, বাম হাতে ছোবল দিল তার মুখের দিকে। আণ্ডারওয়াটার কমব্যাটের ক্লাসিক টেকনিক—ফেসমাস্ক খুলে দিতে চাইছে প্রতিপক্ষের। একেবারে শেষ মুহূর্তে থমকে গেল ও। বুদ্বুদের সারির মাঝ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে ডুবুরির চেহারা। একটা মেয়ে। মাস্কের ওপারে চোখের তারায় ফুটে উঠেছে আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব।

মেয়েটাকে ছেড়ে দিল রানা। হাতের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। মাথা ঝাঁকাল সে, কিন্তু কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে রইল। আঙুল দিয়ে পা দেখাল।

নিচে তাকাল রানা। ভেঙে বেরিয়ে এসেছে ফিউযেলাযের দেয়ালের একটা অংশ, পাশেই ইকুইপমেন্ট বক্স—তার মাঝখানে আটকা পড়েছে মেয়েটার পা। ইস্পাতের শিটের গায়ে আঁচড় দেখে বোঝা গেল, দেয়ালের ওই অংশটা কেটে নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল সে। মেয়েটাকে অপেক্ষা করতে বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকাল রানা, পা ঠেকাল ইকুইপমেন্ট বক্সের গায়ে। চাপ দিল সর্বশক্তিতে।

সারফেসে এই চাপে ভেঙেচুরে যাবার কথা বক্সটার, কিন্তু পানির তলায় তা ঘটল না। সামান্য সরে গেল কেবল। তবে ওটুকুই যথেষ্ট। পা টেনে বের করে নিল মেয়েটা। নিচু হয়ে ঘষতে শুরু করল গোড়ালি। একটু পর সোজা হলো।

হাতের ইশারায় জানতে চাইল রানা, সব ঠিক আছে কি না। ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। এরপর ইশারায় আরেকটা প্রশ্ন করল ও, সঙ্গে কেউ এসেছে কি না জানতে চাইল। এবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। যা ভেবেছে, একাই নেমেছে পানিতে।

বুড়ো আঙুল তুলে ওপরদিকে ইশারা করল রানা, সারফেসে ফিরে যাবার সঙ্কেত। দ্বিধা করল মেয়েটা, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। ডাইভ লাইটটা হাতে নিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করল ফাটলের উদ্দেশে। শেষবারের মত বিমানের ভেতরে একবার নজর বুলিয়ে রানাও পিছু নিল ওর।

একটামাত্র ডিকম্প্রেশন স্টপ নিতে হলো, এর কয়েক মিনিট পর দু’জনে প্রায় একই সঙ্গে ভেসে উঠল সারফেসে, মোটরবোটের খুব কাছে। সাঁতরে বোটের পেছনে চলে গেল মেয়েটা, ডাইভিং ল্যাডার বেয়ে উঠে গেল ওপরে। রানাও উঠল তার পিছু পিছু।

মুরল্যাণ্ড আর দুই নাবিক অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।

‘ওয়েলকাম ব্যাক,’ বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল মুরল্যাণ্ড।

পিঠ থেকে এয়ারট্যাঙ্ক নামিয়ে রাখল মেয়েটা, ফেসমাস্ক তুলে দিল মাথার ওপর। সুন্দর মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে অবাঞ্ছিত অতিথিদের দেখে।

পাত্তা দিল না রানা। নিজের ফেসমাস্ক খুলে বলল, ‘আপনার দুঃসাহস দেখে অবাক হতে হয়। কী করে একাকী নামলেন নিচে?’

‘আমি আনাড়ি নই,’ কিছুটা চড়া গলায় বলল মেয়েটা। ‘দশ বছর ধরে ডাইভ দিচ্ছি সাগরে।’

‘তা-ই? দশ বছরে ক’টা রেকে ডাইভ দিয়েছেন, জানতে পারি?’

জবাব পাওয়া গেল না। একটা তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছল মেয়েটা। এরপর বলল, ‘আমি কী করি না-করি, সে- কৈফিয়ত আপনাদেরকে দিতে যাব কেন? কে আপনারা? কেন আমার বোটে উঠেছেন?’

‘আমরা এসেছি দায়িত্বের টানে,’ বলল রানা। ‘এই এলাকায় সবাই যেন নিয়মকানুন মেনে চলে, বোকার মত কিছু করতে গিয়ে ডুবে না মরে—এসব দেখার দায়িত্ব আমাদের। দুটোই করছিলেন আপনি, তাই বাধ্য হয়ে ছুটে আসতে হলো।

‘অ! আপনারা নুমার লোক?’

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘এখানে যারা আসে, সবাইকে আমাদের রেজিস্টারে নাম লেখাতে হয়। আপনি লেখাননি কেন, জানতে পারি?’

‘কোথাও নাম লেখাতে বাধ্য নই আমি। এ-জায়গা আপনাদের অফিশিয়াল জোনের বাইরে… আপনাদের এখতিয়ারের বাইরে।’

‘কথাটা ঠিক নয়,’ মুরল্যাণ্ড বলল। ‘শুনে খুশি হবেন, জোনটা বড় করা হয়েছে।’

ভুরু কোঁচকাল মেয়েটা। ‘কখন?’

‘এই তো, একটু আগে, মুরল্যাণ্ডের মুখে অনাবিল হাসি। ‘রীতিমত ভোটাভুটি করে জোনের সীমানা বাড়ানো হয়েছে।’

পালা করে তার আর রানার দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘টিপিক্যাল পুরুষালি মনোভাব,’ বলল সে। ‘যখন যেটায় সুবিধে, সেটাকেই নিয়ম বানিয়ে নেয়া।’

‘আর আপনি দেখাচ্ছেন টিপিক্যাল মেয়েলি মনোভাব,’ বলল রানা। হাঁটু গেড়ে মেয়েটার এয়ারট্যাঙ্কের গজ দেখছে ও। রিজার্ভে ঠেকেছে কাঁটা। ‘যারা আপনার জীবন বাঁচাল, তাদের ওপরেই চোটপাট দেখাচ্ছেন। এই দেখুন, বড়জোর আর পাঁচ মিনিটের বাতাস ছিল আপনার ট্যাঙ্কে।’

গজের ওপর স্থির হলো মেয়েটার চোখ।

‘খুশি হওয়া উচিত আপনার, আমরা নাক গলিয়েছি বলে,’ রানা বলল। ‘নইলে এতক্ষণে সাগরতলের শোভা বাড়াতেন।’

কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল মেয়েটা। যখন চোখ তুলল, দৃষ্টি বদলে গেছে। নিচু গলায় বলল, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি। বড় বাঁচা বেঁচেছি। আ…আসলে…’ কথা খুঁজে না পেয়ে থেমে গেল। এরপর ছোট্ট করে বলল, ‘ধন্যবাদ।’

‘মোস্ট ওয়েলকাম। আমি মাসুদ রানা। আমার বাচাল বন্ধুটি ববি মুরল্যাণ্ড।’

আচরণ বদলে গেছে মেয়েটার, লক্ষ করল রানা। হাত মেলাল আন্তরিক ভঙ্গিতে। ক্ষীণ এক টুকরো হাসি ফুটেছে ঠোঁটে। ‘আপনারা এখানকার ইনচার্জ?’

‘দুর্ভাগ্যক্রমে,’ বলল রানা।

‘আমি ড. লামিয়া লিভানোভা। রাশার প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি। নিচের আবিষ্কারটা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ছিল।’

‘লিয়াজোঁ অফিসার আছে আমাদের। যদি চান তো আগামীকাল তার সঙ্গে…

‘আমি আসলে আজ রাতেই কথা বলতে চাইছি,’ হাসির আভাস ফুটল লামিয়ার ঠোঁটে। ‘একসঙ্গে ডিনার করলে কেমন হয়?’

চোখ উল্টাল মুরল্যাণ্ড। ‘শুরু হয়ে গেল! মাসুদ রানার জাদু-টানে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না…’

ওকে চোখ রাঙাল রানা। লামিয়ার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি একটু বেশিই আশা করছেন, ড. লিভানোভা। নতুন কিছু জানতে পারবেন না আমাদের কাছ থেকে।

চেইন টেনে ওয়েটসুটের ওপরের অংশ খুলে ফেলল লামিয়া। দেখা গেল তলার বিকিনি টপ, আর সুগঠিত ঊর্ধ্বাঙ্গ। যৌবন বাধ মানছে না। আসলে প্রলুব্ধ করছে রানাকে। মদির কণ্ঠে বলল, ‘নতুন কিছু তো আমিও জানাতে পারি। নিশ্চিন্ত থাকুন, ডিনারে গেলে ঠকবেন না।

‘আপনি সিরিয়াস?’

‘অবশ্যই। তা ছাড়া… রাতে তো না খেয়ে থাকবেন না। খাওয়ার সময় একজন সঙ্গী পেলে মন্দ কী?’

‘উত্তম প্রস্তাব!’ বলেই থমকে গেল মুরল্যাণ্ড, রানা চোখের ইশারা দিচ্ছে ওকে। মুখ কালো করে ফেলল। ‘কিন্তু দুর্ভাগ্য

যে, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। জরুরি কাজ আছে।’

রানাও যে যেতে খুব উৎসাহী, তা নয়। রাশান সুন্দরীর হাবভাব সন্দেহজনক—ডিনারের ছলে হয়তো ওর পেট থেকে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করবে। তাই বলে প্রস্তাবটা ফিরিয়েও দেয়া যায় না, সুযোগটা ও নিজেই মেয়েটার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। বলা যায় না, সত্যিই হয়তো কোনও নতুন খবর জানতে পারবে।

‘সান্তা মারিয়ায় থাকছেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘হুঁ।’

মুরল্যাণ্ডের দিকে ফিরল রানা। ‘আমি তা হলে ওঁর সঙ্গে যাচ্ছি। তোমরা নেপচুনে ফিরে যাও।’

‘জানতাম এ-কথাই বলবে,’ গোমড়ামুখে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘আমাদেরকে নিয়ে কি আর জমবে?’

চোখ টিপল রানা। ‘জমাতে চাইলে আরেকজন পাত্রী জুটিয়ে নাও। ইনি বুক হয়ে গেছেন।’

‘একেই বলে কপাল!’

বিদায় নিয়ে জোডিয়াকে চড়ল মুরল্যাণ্ড আর দুই নাবিক। রওনা হয়ে গেল নেপচুনের উদ্দেশে। নোঙর তুলে লামিয়াও বোট ছাড়ল।

‘শহরে গাড়ি আছে আপনার?’ জানতে চাইল রানা।

‘আছে,’ হাসল লামিয়া। ‘আর আমি জানি, ডিনারের জন্যে আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে।’

.

ভিলা দো পোর্তোর বন্দরের কাছে, একটা পে-ফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কুচিয়ো কর্টেজ। এসব জিনিস আজকাল উঠেই গেছে দুনিয়া থেকে, শেষ কবে একটা পে-ফোন দেখেছে, মনে নেই তার। তবে প্রযুক্তির দিক দিয়ে বাকি পৃথিবীর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে সান্তা মারিয়া, টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবে দ্বীপটা যতই নামডাক কামাক না কেন। দ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসী হতদরিদ্র, সেলফোন বা ল্যাণ্ডলাইন রাখার মত সঙ্গতি নেই তাদের। তাই আজও অসংখ্য পে- ফোন টিকে আছে দ্বীপের সবখানে।

একদিক থেকে ব্যাপারটা ভালই হয়েছে কর্টেজের জন্যে। সেলফোনের ডিজিটাল সিগনালে আড়ি পাতা সহজ, কিন্তু এই পে-ফোনে আড়ি পাততে চাইলে মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে ট্রাঙ্ক লাইন, যেটা অ্যাযোর্স থেকে শুরু হয়ে আটলান্টিকের তলা দিয়ে চলে গেছে ইয়োরোপ আর আফ্রিকা পর্যন্ত। যথেষ্ট ঝক্কি আছে তাতে। একেবারে যে অসম্ভব, তা নয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশান ট্রাঙ্ক লাইনে আড়ি পাতার রেকর্ড আছে আমেরিকানদের। তবে এত বছর পরে, তাও আবার অ্যাযোর্সের মত গুরুত্বহীন জায়গায় অত কষ্ট কেউ করতে যাবে বলে মনে হয় না। এর অর্থ, আনট্রেসেবল একটা কল করতে পারবে সে অনায়াসে।

ভাবনাটা স্বস্তি জাগাল কর্টেজের মনে। সাম্প্রতিক. ঘটনাগুলো বিপদের কালো ছায়া ফেলতে শুরু করেছে তার ওপরে। নিজের পরিচয় যতটা লুকিয়ে রাখা যায়, ততই ভাল।

রিসিভার তুলে ডায়াল করল কর্টেজ। যেন অনন্তকাল পর সাড়া দিল সিয়েরা লিওনের এক অপারেটর। আরও কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেল প্রতীক্ষায়, এরপর কানেকশন দেয়া হলো প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে। একজন এইড ফোন ধরল, তার খানিক পর ইয়ারপিসে ভেসে এল আকুম্বার গমগমে গলা।

‘আমাকে ফোন করছ কেন?’ বিরক্তস্বরে বললেন তিনি। কণ্ঠটা যেন একটা সুড়ঙ্গ থেকে ভেসে আসছে। পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহারের একটা অসুবিধে তো আছেই।

‘খবর আছে,’ বলল কর্টেজ। ‘কিছু ভাল। কিছু খারাপ।’

‘বলো। তাড়াতাড়ি।’

‘আপনার ধারণাই ঠিক। অন্তত বিশটা সায়েন্টিফিক টিম হাজির হয়েছে এখানে। আরও আসছে। ম্যাগনেটিক টাওয়ারটা নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে গেছে।’

‘জানা কথা। নইলে তোমাকে ওখানে পাঠিয়েছি কেন?’

‘ব্যাপারটা শুধু সায়েন্টিফিক ইন্টারেস্ট নয়। আমি মিলিটারির লোকও দেখেছি।’

পাত্তা দিলেন না আকুম্বা। ‘সেটাও অপ্রত্যাশিত নয়। তুমি যদি প্ল্যান মোতাবেক কাজ করো, তা হলে ওদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

‘হয়তো,’ বলল কর্টেজ। ‘কিন্তু আসল সমস্যাটা এখনও বলিনি আপনাকে। আরাতামা মারুতে যাদের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়েছিল, তারাও হাজির রয়েছে এখানে। ওদের জাহাজটা আমি বন্দরে দেখেছি। এখন অবশ্য ম্যাগনেটিক টাওয়ারের কাছে গিয়ে নোঙর করেছে। পর্তুগিজ অথরিটি বলছে, ওদেরকে পুরো প্রজেক্ট দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভেতরে ভেতরে অন্য কিছু চলছে বলে সন্দেহ করছি আমি।’

হাসলেন আকুম্বা। ‘বরাবরের মত শত্রুকে বড় করে দেখছ তুমি। ইচ্ছে করেই হয়তো করছ, যাতে তাকে পরাস্ত করার পর তোমার নামডাক ছড়ায়। কিন্তু এটা কি জানো, ব্যাপারটা প্যারানয়ার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে?’

‘কী বলতে চান?’ খাপ্পা হলো কর্টেজ।

‘যাদের সঙ্গে তোমার ঠোকাঠুকি লেগেছিল, তারা কোনও সৈনিক বা কমাণ্ডো নয়। নুমার কিছু ওশনোগ্রাফার আর ডাইভার… যাদের কাজ সাগরের তলায় জাহাজ খোঁজা, সাগর নিয়ে গবেষণা করা। এরা তোমাকে এমন নাকানি-চোবানি খাওয়াবে, কল্পনা করিনি। সাবধান হয়ে যাও, এসব যদি ফাঁস হয়ে যায়, তোমার দাম কমে যাবে। গলাকাটা ফি আর চাইতে পারবে না কারও কাছে।’

হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছেন প্রেসিডেন্ট, কিন্তু গায়ে বিছুটির জ্বালা শুরু হয়ে গেছে কর্টেজের।

‘কী, ভয় লাগছে আবার ওদের মুখোমুখি হতে?’ মোক্ষম খোঁচা দিলেন আকুম্বা।

‘শুনুন…’ গরম গলায় বলল কর্টেজ, কিন্তু থেমে গেল একটা শব্দ বলেই। চোখ চলে গেছে ডকের দিকে। কালো চুলের এক সুদর্শন যুবক হেঁটে আসছে এদিকে—একেই সেদিন আরাতামা মারুতে দেখেছিল। সঙ্গে সুন্দরী এক মেয়ে, তাকেও চেনে সে। রাশান বিজ্ঞানী, এর কথা আগেই জানানো হয়েছে কর্টেজকে। কাছে চলে এসেছে দু’জনে। যুবকের দিকে তাকিয়ে হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে গেল তার। সেদিন দূর থেকে দেখেছিল বলে বোঝেনি, এখন পরিষ্কার চিনতে পারল।

‘ভুল দেখছি না তো?’ আনমনে বলে উঠল কর্টেজ।

‘অ্যাই!’ খেঁকিয়ে উঠলেন আকুম্বা। ‘কীসের কথা বলছ?’ বুথের ভেতর একটু সেঁধিয়ে গেল কর্টেজ। পিঠ ঘুরিয়ে দিল আগুয়ান যুবক-যুবতীর দিকে। ওরা দূরে সরে না যাওয়া পর্যন্ত নড়ল না।

‘কুচিয়ো!’ অধৈর্য শোনাল আকুম্বার গলা। ‘হচ্ছেটা কী?’

বড় করে শ্বাস ফেলল কর্টেজ। মাথায় নতুন একটা প্ল্যান খেলা করছে তার। বলল, ‘নুমাকে আপনি যতটা নখদন্তহীন ভাবছেন, আদপে তারা তা নয়। আমার ধারণা, আবারও নাক গলাবে ওরা… বিশেষ করে ওদের টিমের একজন লোক। তাকে আমি ভাল করেই চিনি। আপদটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়াই ভাল হবে।’

‘ওদের খেপাতে যেয়ো না,’ বললেন আকুম্বা। ‘তাতে অকারণে, অসময়ে আমাদের ওপর নজর পড়বে সবার। খুব শীঘ্রি আমরা আমাদের চাল দিতে চলেছি।’

‘কিচ্ছু ভাববেন না। কেউ কিছুই টের পাবে না।’

‘তোমার প্রতিশোধস্পৃহার পেছনে টাকা ঢালব না আমি, কুচিয়ো।’

হাসল কর্টেজ। ‘কাজটা আমি বিনে পয়সায় করব।’ প্রেসিডেন্টকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সজোরে রিসিভারটা ক্রেইডলে নামিয়ে রাখল সে। অদ্ভুত একটা আনন্দ পেল শব্দটায়। বাটন টিপে সেলফোনের কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে এত আনন্দ পাওয়া যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *