1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ২৬

ছাব্বিশ

কেবিনের দরজায় করাঘাত শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠল মুরল্যাণ্ড। অস্ফুট আওয়াজে সাড়া দিতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল এক নাবিকের কণ্ঠস্বর।

‘ক্যাপ্টেন আপনাকে ব্রিজে ডাকছেন, মি. মুরল্যাণ্ড।’

‘আসছি।’

চলে গেল নাবিক। বাঙ্ক থেকে নেমে প্যান্ট পরতে শুরু করল মুরল্যাণ্ড, আর তখুনি টের পেল, নেপচুন স্থির নেই। বাইরে থেকে ভেসে আসা পানির আওয়াজ আর মৃদু দুলুনিতে বোঝা গেল, বেশ দ্রুতগতিতে ছুটছে জাহাজটা। গায়ে শার্ট আর পায়ে স্নিকার গলিয়ে বেরিয়ে এল ও কেবিন থেকে। একটু পরেই হাজির হলো ব্রিজে।

‘ক্যাপ্টেন?’ কাছে গিয়ে ডাকল ও।

ঘাড় ফেরালেন ক্যাপ্টেন মিচাম। সৌজন্যের ধার না ধেরে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘মি. রানা কোন্ চুলোয় গেছেন, জানতে পারি?’

‘চুলো হতে যাবে কেন, গেছে তো স্বর্গোদ্যানে,’ স্বভাবসুলভ কৌতুকের স্বরে বলল মুরল্যাণ্ড।

‘মানে?’ ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন মিচাম।

‘অপরূপা এক সুন্দরীর সঙ্গে বেড়াতে গেছে। একসঙ্গে ডিনার করার কথা ওদের।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল ক্যাপ্টেনের। ‘সাগরের মাঝখানে বসে উনি ডিনার-ডেট জোগাড় করলেন কীভাবে?’

‘জাদু। বুঝলেন? সাগর-মরুভূমি, আকাশ-পাতাল … যেখানেই যাক না কেন, ডেট করার জন্যে সুন্দরী মেয়ে ঠিকই জোগাড় করে ফেলবে রানা। জাদুটা যদি আমিও জানতাম, খুব ভাল হতো। মাঝে মাঝে বড় একা লাগে, বুঝলেন…

‘মি. মুরল্যাণ্ড!’ কড়া গলায় ধমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন। ‘ঠাট্টা রাখুন। ব্যাপারটা সিরিয়াস। মি. রানা কার সঙ্গে গেছেন?’

এক মুহূর্তের জন্যে থমকাল মুরল্যাণ্ড। ক্যাপ্টেন অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। রানা কচি খোকা নয়, তা ছাড়া জাহাজে ফিরেই ওর যাওয়ার খবরটা ডিউটি অফিসারকে জানিয়ে দিয়েছিল সে।

‘কই, কথা বলছেন না কেন?’ ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে তাড়া।

‘রাশান এক সায়েন্টিস্টের সঙ্গে গেছে,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘মেয়েটাকে একটা রেক থেকে উদ্ধার করি আমরা। তার কাছে কী নাকি গোপন খবর আছে। সেটা জানার জন্যেই গেছে রানা।’

‘কখন ফেরার কথা তাঁর?’

‘সেটা তো নির্ভর করছে দু’জনের আলাপ কেমন জমে, তার ওপর।’

হতাশায় মাথা দোলালেন মিচাম। ‘আপনাকে তো বললাম ঠাট্টা না করতে!’

হেসে ফেলল মুরল্যাণ্ড। ‘কী হয়েছে বলুন তো। আপনাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ছে। কড়া শাসনে রাখতেন আমাকে, না বলে বাড়ি থেকে বেরুলে অস্থির হয়ে যেতেন আপনার মত।’

সংক্ষেপে গ্রুপারের ওপর হামলা আর আসিফ রেজার মুমূর্ষু অবস্থার কথা জানালেন ক্যাপ্টেন। শেষে যোগ করলেন, ‘আরাতামা মারুর ওপর কোনও ধরনের ধরনের ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েপন ব্যবহার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যারা এ-কাজ করেছে, তাদের কাছে সাবমেরিন আর টর্পেডোও আছে।’

গম্ভীর হয়ে গেল মুরল্যাণ্ড। ‘অ্যাডভেঞ্চারার এখন · কোথায়?’

‘ফুল স্পিডে পশ্চিমে ছুটেছে। আগামীকাল সকাল নাগাদ আমেরিকান নেভির একটা গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেটের রেঞ্জের মধ্যে পৌছে যাবে। তখন আর বিপদ থাকবে না ওদের। ড. রেজাকে ট্রান্সফার করা হবে একটা হসপিটাল শিপে।’

‘আর আমরা? আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘একাকী আমাদের এদিকে বসে থাকা বিপজ্জনক মনে করছেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। আরাতামা মারুর ব্যাপারে যারাই জানে, তাদেরকেই খতম করে দেবার চেষ্টা চলছে। সেদিক থেকে আমাদের জাহাজের… বিশেষ করে মি. রানা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। শত্রুদের পরের টার্গেট আমরাই হতে পারি। কাল সকালে স্প্যানিশ আর পর্তুগিজ নেভির সঙ্গে কথা বলে আমাদের জন্যে প্রটেকশনের ব্যবস্থা করবেন অ্যাডমিরাল। তার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে বন্দরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যেন জাহাজ থেকে না নামে। কেন অস্থির হচ্ছি, বুঝতে পারছেন তো? গত কয়েক ঘণ্টা থেকে লাগাতার চেষ্টা করছি, মি. রানা ফোন ধরছেন না।’

‘স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। ওরা বলল, কয়েক ঘণ্টা আগে দ্বীপের পাহাড়ি এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। দুটো গাড়ি আছড়ে পড়েছে পাহাড়ের ওপর থেকে। যেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত, সেখানে মি. রানার মত এক ভদ্রলোক ছিলেন, তবে গাড়ির ধ্বংসস্তূপে তার লাশ পাওয়া যায়নি।’

এবার মুরল্যাণ্ডও চিন্তায় পড়ে গেল। সান্তা মারিয়ার মত শান্ত জনপদে গোলাগুলি কোনও নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা নয়। ব্রিজের জানালা ভেদ করে সামনে তাকাল ও। দ্বীপের আলোগুলো দেখা যাচ্ছে দূরে।

‘বিশ মিনিটের ভেতর বন্দরে পৌছুব আমরা,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘এরপর মি. রানাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনার। কীভাবে কী করবেন জানি না… মাইক ভাড়া করবেন, ফ্লেয়ার ছুঁড়ে সঙ্কেত দেবেন, নাকি বিমান ভাড়া করে আকাশে ব্যানার ওড়াবেন… সেটা আপনি জানেন। কিন্তু যেভাবেই হোক, মি. রানাকে খুঁজে বের করা চাই।’

মাথা ঝাঁকাল মুরল্যাণ্ড। রাশান মেয়েটাকে দিয়ে শুরু করবে ও। হোটেলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাকে চিনবে।

.

আল্ট্রালাইটে চেপে ধীরে ধীরে ভিলা দো পোর্তোর দিকে নামছে রানা আর লামিয়া। কাজটা সহজ নয় মোটেই। খোলা ককপিটটা দিনের আলোতে, বিশেষ করে উষ্ণ আবহাওয়ায় ব্যবহারের উপযোগী করে বানানো। ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলে তাই কোনও বাতি নেই। তা ছাড়া, যদিও ছোট্ট আকাশযানটা পঞ্চাশ নটের বেশি গতিতে চলছে না, পাহাড়ি হিমেল হাওয়া তার দ্বিগুণ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওদের উপর, হাড্ডিমজ্জা জমিয়ে দিচ্ছে একেবারে।

আলো থাকলে যতটা সম্ভব মাটির কাছাকাছি থেকে এগোবার চেষ্টা করত রানা, রাতের অন্ধকারে ঠিক তার বিপরীত কাজটা করতে হয়েছে। অচেনা পাহাড়ি এলাকায় কোথায় কোন্ বাধা-বিপত্তি আছে জানা নেই, অন্ধকারে গাছপালা বা পাহাড়ি ঢালের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটতে পারে। তাই যতটা সম্ভব ওপরে উঠে এসেছে ও, খোলা আকাশে। এক পর্যায়ে একটা গাড়ির দেখা পেয়েছিল নিচে, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে শহরের দিকে চলেছে। গাড়ির আলো দেখে পিছু নিয়েছিল, পেরিয়ে এসেছে অনেকটা পথ, তবে সে- সৌভাগ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। রাস্তায় চলা একটা গাড়ির চেয়ে আল্ট্রালাইটের গতি কম। খুব শীঘ্রি ওদেরকে পেছনে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে গাড়িটা।

ভাগ্য ভাল, গাড়ির আলো মিলিয়ে গেলেও খানিক পর সামনে আরও কিছু আলো ভেসে উঠেছে—এক দেখাতেই বুঝেছে, ওটা ভিলা দো পোর্তোর আলো। আল্ট্রালাইটের মুখ ঘুরিয়ে এখন সরাসরি ওদিকে এগোচ্ছে রানা। আলোটা যেহেতু বাধা পাচ্ছে না, আশা করা যায় সামনে কোনও পাহাড়ও নেই, যেটার গায়ে আছড়ে পড়তে পারে ওরা।

শহরের আলো লামিয়াও দেখতে পেয়েছে। পেছন থেকে জানতে চাইল, ‘পৌঁছে গেছি নাকি?’ দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি খাচ্ছে ওর।

দুই আসনের ছোট্ট বাহনটার পেছনের সিটে বসে আছে মেয়েটা। ওর গায়ে যে পাতলা একটা সান্ধ্যপোশাক ছাড়া আর কিছু নেই, তা মনে পড়ল রানার। দমকা বাতাস আর চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার জন্যে মোটেই উপযোগী নয় পোশাকটা।

‘ঠাণ্ডা লাগছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘জমে মারা যাচ্ছি,’ বলল লামিয়া।

কথা বলে ওকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করল রানা। ‘আমার ধারণা ছিল, ঠাণ্ডা কাবু করতে পারে না রাশানদের।’

‘কারণ আমরা শীতের পোশাক পরতে জানি। যেমন ধরো, কয়েক পরত উল, হাতমোজা, পশমি টুপি আর উঁচু বুট। আছে নাকি তোমার দোকানে? তা হলেই দেখবে, Stet আমার কিছু করতে পারে কি না।’

হাসল রানা। ‘সামনে এগোও। আমাকে জড়িয়ে ধরো।’

‘আমি তো ভাবছিলাম বলবেই না!’

পিঠে লামিয়ার নরম শরীরের স্পর্শ পেল রানা, বগলের তলা দিয়ে এগিয়ে এল পেলব দুটো হাত, পেছন থেকে ওকে জাপটে ধরল মেয়েটা।

এগিয়ে চলল আল্ট্রালাইট। ইঞ্জিনের গুঞ্জন তুলে পেরিয়ে এল পাহাড়ি উপত্যকা আর গিরিখাত। সামনে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকল ভিলা দো পোর্তোর আলো। শহরটায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ বাস করে, ছোট্ট দ্বীপ সান্তা মারিয়ার হিসেবে ওটাকে মোটামুটি একটা মহানগরী বলা চলে।

‘ল্যাণ্ড কোথায় করবে?’ জানতে চাইল লামিয়া।

চিন্তাটা আরও আগেই রানার মাথায় এসেছে। দু’শো ফুট স্ট্রিপ পেলেই আন্ট্রালাইট অনায়াসে ল্যাণ্ড করতে পারে। দিনের বেলায় তেমন জায়গা খুঁজে পেতে অসুবিধে হতো না, কিন্তু রাতের অন্ধকারে সমীকরণ পাল্টে গেছে। কিছুই চেনা যাচ্ছে না। আন্দাজের বশে নামতে গেলে হয়তো ক্র্যাশ করবে কোনও বিল্ডিং বা গাছপালার গায়ে। যেসব জায়গায় আলো জ্বলছে, সেগুলো মোটামুটি চেনা যাচ্ছে… লম্বা একটা রাস্তা দেখে নেমে পড়লেই হয়। সমস্যা হলো, সবগুলো রাস্তার পাশে রয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি আর ওভারহেড লাইন। সেগুলোর কোনোটার সঙ্গে আল্ট্রালাইট বেধে গেলে সর্বনাশ।

সামনে তীক্ষ্ণচোখে নজর বোলাল রানা। হঠাৎ একটা ফুটবলের মাঠ দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে উঠল। নৈশকালীন কোনও ম্যাচ চলছে বোধহয়, ফ্লাডলাইট জ্বেলে আলোকিত করে রাখা হয়েছে মাঠটা। একশো বিশ গজ সমতল, ঘাসে ঢাকা জমিন… ল্যাণ্ডিঙের জন্যে আদর্শ। কোনও কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটারও ভয় নেই। মাঠ লক্ষ্য করে আল্ট্রালাইটের নাক ঘোরাল ও, কমাতে শুরু করল উচ্চতা। আটলান্টিকের দিক থেকে জোরালো বাতাস আসছে, কোর্সচ্যুত না হবার জন্যে বিমানকে ত্রিশ ডিগ্রি কাত করে রাখতে হলো।

পাঁচশো ফুটে নামতেই মাঠের চারধারে দর্শকদের ভিড় দেখতে পেল রানা, তবে মাঠে কোনও খেলোয়াড় নেই। লামিয়া ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, নড়াচড়া মুশকিল।

‘কিছু মনে কোরো না,’ বলল ও। ‘এবার বাঁধনটা একটু আলগা করতে হবে, ফ্লাইঙে অসুবিধে হচ্ছে।’

‘সরি,’ লামিয়া ছেড়ে দিল ওকে। ‘ঠিকমত ল্যাণ্ড করতে পারবে তো?’

‘কিচ্ছু ভেবো না,’ আশ্বস্ত করল রানা। ‘হেসেখেলে নামব মাটিতে।’

কথাটা বলার এক মিনিটের মাথায় কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো ওর। আড়াল থেকে খেলোয়াড়দের বেরিয়ে আসতে দেখল ও—মাঠে নামছে। খেলার শুরু, নাকি হাফটাইমের বিরতি শেষ হলো, কে জানে। ততক্ষণে মাটি থেকে একশো ফুট ওপরে পৌঁছে গেছে আল্ট্রালাইট, মাঠ থেকে মোটামুটি তিনশো ফুট দূরত্বে। ইঞ্জিনের আওয়াজ নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছে সবাই, তবে এ-আওয়াজ শুনে কেউ ছোটাছুটি করে সরে যায় না। কপাল না চাপড়ে উপায় কী?

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত পরমুহূর্তে কেশে উঠল ইঞ্জিন।

‘ফিউয়েল প্রায় শেষ,’ লামিয়াকে জানাল রানা। ‘জলদি নামো!’

পেছন থেকে চেঁচাল মেয়েটা।

মাঠের দিকে ধেয়ে গেল আল্ট্রালাইট। গাড়ির মত একটা হর্ন লাগানো থাকলে ভাল হতো, ভাবল রানা, নিদেনপক্ষে ভেঁপুর মত ভুভুযেলা থাকলেও চলত। খেলোয়াড়দেরকে হাত মেলাতে দেখতে পেল ও; সেন্টারে বলের ওপর এক পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে রেফারি, খেলা শুরুর বাঁশি বাজাবে। ইঞ্জিন কেশে উঠল আরেকবার, এবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল খেলোয়াড়রা। দর্শকদেরও চোখ ঘুরে গেছে আকাশের দিকে।

ভিড়ের ওপর দিয়ে উড়ে গেল রানা। একটা ফ্ল্যাগপোলের সঙ্গে বাড়ি খেল আল্ট্রালাইটের ডানা, ফ্রেমটা বেঁকে গেল বিশ্রীভাবে, ডানদিকে কাত হয়ে গেল পুরো কাঠামো। তাড়াতাড়ি বামদিকে স্টিক নেড়ে বাহনটাকে সিধে করার চেষ্টা করল ও। মাঠে ততক্ষণে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে, সাইডলাইনের দিকে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সবাই।

ধাম করে মাঠের ওপর আছাড় খেল আল্ট্রালাইট, পরমুহূর্তে ড্রপ খেয়ে উঠে এল বাতাসে। এবার সাবধানে ওটাকে নিচে নামাল রানা, পঞ্চাশ গজের লাইনের কাছে আলতোভাবে মাটিকে স্পর্শ করল চাকা। ব্রেক চাপল ও, কিন্তু কাজ হলো না। ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে পিছলে ছুটে চলেছে আল্ট্রালাইট—সরাসরি উল্টোদিকের গোলপোস্ট লক্ষ্য করে। গোলকিপার বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে, শেষ মুহূর্তে ডাইভ দিয়ে সরে গেল। খালি গোলপোস্টে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বিমান। গোলপোস্ট উপড়ে এল, প্রপেলারে জড়িয়ে গেল নেট। শেষ একটা কাশি দিয়ে থেমে গেল ইঞ্জিন, তবে আল্ট্রালাইটও থমকে দাঁড়িয়েছে একই সঙ্গে।

পিনপতন নীরবতা নেমে এল কিছুক্ষণের জন্যে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল রানা। খেলোয়াড়, রেফারি, দর্শক…. সবাই মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে তাকিয়ে। শেষে রেফারিকে নড়ে উঠতে দেখা গেল। লম্বা একটা হুইসেল দিল সে। চেঁচিয়ে বলল, ‘গো-ও-ও-ও-ল!’

হুল্লোড় করে উঠল দর্শকরা। মাঠের ওপর দিয়ে ছুটে এল আল্ট্রালাইটের দিকে। দু’হাত উঁচু করে এমনভাবে চেঁচাচ্ছে, যেন তাদের দল বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে। গোলপোস্টের কাছে এসে রানা আর লামিয়াকে জালের ভেতর থেকে বের করে আনল। হাসাহাসি আর হাততালির বন্যা বইছে। ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো সাইডলাইনে।

কেন এভাবে ল্যাণ্ড করতে বাধ্য হয়েছে, সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল রানা। ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছে, তা পুষিয়ে দেবে বলে কথা দিল। জানাল, জাহাজে ফিরে আল্ট্রালাইটটাও সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। নিজেদের নাম, ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে মিনিটদশেক পর ছাড়া পেল দু’জনে। ততক্ষণে বিমানটা মাঠ থেকে সরিয়ে খেলা শুরু হয়ে গেছে।

রাস্তায় এসে দাঁড়াল রানা আর লামিয়া। ক্যাব বা বাস ধরার ইচ্ছে। হেডলাইটের আলো দেখতে পেয়ে হাত নাড়তেই একটা মিনিভ্যান এসে থামল।

‘বন্দরে পৌঁছে দেবেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘নিশ্চয়ই,’ বলল ড্রাইভার। ‘আসুন।’

দরজা খুলে লামিয়াকে ভ্যানের পেছনের সিটে উঠিয়ে দিল রানা, তারপর নিজেও উঠে বসল ওর পাশে।

‘দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হলো,’ রানার দিকে তাকিয়ে বলল লামিয়া।

অন্তত তিনবার মরতে বসেছিল ওরা, ওর ভাড়া করা গাড়িটা পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে, ও নিজেও এখনও ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আছে… তারপরেও চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে উত্তেজনায়। হাবভাবে মনে হচ্ছে, জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে এল।

অদ্ভুত মেয়ে, মনে মনে ভাবল রানা। হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে নিল কাছে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। বাধা দিল না লামিয়া। বরং সাড়া দিল ওর আমন্ত্রণে। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রানাকে, দু’জোড়া ঠোঁট ব্যস্ত হয়ে উঠল পরস্পরকে নিয়ে… আলাদা হবার নাম নেই। হঠাৎ ড্রাইভার খুক করে কাশি দিয়ে ওঠায় সংবিৎ ফিরে পেল দু’জনে। তাড়াতাড়ি মুক্ত করল নিজেদের।

‘কাজটা কি ঠাণ্ডা দূর করার জন্যে করলে?’ মৃদু হেসে জানতে চাইল লামিয়া।

রানাও হাসল। ‘কাজ হয়নি?’

‘যতটা আশা করেছ, তার চেয়েও বেশি।’ মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল লামিয়া। দুপাশের গাছপালা শাঁই শাঁই করে সরে যাচ্ছে পিছনে। ফাঁকা রাস্তায় উদ্দাম বেগে চলছে মিনিভ্যান।

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। হঠাৎ লামিয়া বলল, ‘জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে। যদি ভুল না করে থাকি… ফ্রেঞ্চ টিমটা যে-বাড়িতে থাকছে, সেটা এখান থেকে বেশ কাছে।

‘তাই নাকি?’ দায়িত্বের কথা আবার মনে পড়ে গেল রানার। অবৈধভাবে একটা স্যাম্পল তুলে নিয়ে এসেছে দলটা-ওটা উদ্ধার করতে হবে। গভীর রাতে হানা দেয়াই ভাল, সকালে আবার বেরিয়ে পড়বে ওরা সাগরের উদ্দেশে।

‘যেতে চাও ওখানে?’ জিজ্ঞেস করল লামিয়া।

‘ঠিকানা জানো?’

‘প্রায়া ফরমোসার সৈকতের পাশে একটা কটেজে উঠেছে। শহরের সবচেয়ে দামি ভাড়া-বাড়ি।

মিলছে, ফরাসিরা বিলাসিতার ভক্ত। ড্রাইভারের দিকে তাকাল রানা। ‘এক্সকিউজ মি, প্রায়া ফরমোসায় নিয়ে চলুন আমাদের।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *