1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৭

সাতচল্লিশ

নুমা থেকে পাঠানো নতুন সাবমারসিবলের কমাণ্ড সিটে বসে আছে আসিফ। গ্রুপারের তুলনায় দৈর্ঘ্যে ছোট হলেও সাবমারসিবলটার উচ্চতা বেশি, ফলে সোজা হয়ে বসতে পারছে ও। জলকন্যাকে অপারেট করবার জন্যে তানিয়াকেও উপুড় হয়ে শুতে হচ্ছে না। এ-মুহূর্তে ভার্চুয়াল কন্ট্রোলের পুরো গিয়ার পরে আসিফের পেছনে বসে আছে ও। পোর্টহোল দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে।

পানির মাত্র দশ ফুট ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে সাবমারসিবল, ঝুলছে বিশাল এক সি-হক হেলিকপ্টারের তলায়—ওটাই উড়িয়ে নিয়ে চলেছে ওদের। নিচে সাঁই সাঁই করে সরে যাচ্ছে সাগরের পানি, রাতের আঁধারে জ্বলজ্বল করছে ঢেউয়ের মাথায় ফেনায়িত সাদা মুকুট। অদ্ভুত লাগছে দৃশ্যটা।

দক্ষিণ দিক থেকে ওদেরকে এয়ার-ড্রপ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে… ইভেন্ট হরাইজন লাইনের যতটা সম্ভব কাছে। সেখান থেকে ডুব দিয়ে ক্যানিয়নে ঢুকবে ওরা, সংকীর্ণ গিরিখাতটার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাবে সামনে। সঙ্গে থাকবে বিস্ফোরক-সহ জলকন্যা। ডাইভারশন সৃষ্টির জন্যে বিশ মিনিট পর প্রথম দফার বিমান হামলা চালানো হবে কোয়াডাঙ্গলে। মিসাইল আর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হবে শত্রুপক্ষকে, যাতে সাবমারসিবলটা ওদের চোখ এড়িয়ে নির্বিঘ্নে এগোতে পারে।

ওয়ান মিনিট টু ড্রপ পয়েন্ট,’ হেলিকপ্টার থেকে জানানো হলো।

‘রজার,’ সায় জানাল আসিফ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল তানিয়ার দিকে। ‘শুনে খুশি হবে, বাড়তি কিছু সাপ্লাই নিয়ে এসেছি আমি।’

‘কীসের সাপ্লাই?’ ভুরু কোঁচকাল তানিয়া।

ইশারায় সাবমারসিবলের পেছনটা দেখাল আসিফ। সেখানে রাখা হয়েছে ডাইভিং গিয়ার আর বাঞ্জি কর্ডের রোল। বলল, ‘গতবারের মত আবার যদি কোনও ঝামেলায় পড়ি, এবার খানিকটা শান্তিতে বাইরে সাঁতার কাটা যাবে।’

মৃদু হাসল তানিয়া। পরক্ষণে বড় হয়ে গেল চোখ। ‘তোমার কি সব মনে পড়ে গেছে?

মাথা ঝাঁকাল আসিফ। ‘সাবমারসিবলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে,’ বলল ও। ‘ছবির মত সবকিছু ভেসে উঠল মনে।’

বিষণ্ণ হলো তানিয়ার চেহারা। ‘খুব খারাপ।’

‘কেন? খারাপ কেন?’

‘ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ওটা। মনে না পড়লেই ভাল হতো।’

‘আমি অন্য চোখে দেখছি। আমার মতে, ওটা হলো বিরূপ পরিস্থিতিতে আমাদের টিমওয়ার্কের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এ নিয়ে গর্ব করা যায়, ভয় নয়।’

‘আল্লাহকে ডাকো, যাতে অমন দৃষ্টান্ত আবার দেখাতে না হয়।’

শব্দ করে হাসল আসিফ।

‘ত্রিশ সেকেণ্ড,’ জানানো হলো ওপর থেকে।

‘তুমি তৈরি?’ জিজ্ঞেস করল আসিফ।

বড় করে শ্বাস নিল তানিয়া। ‘হ্যাঁ।’

‘দশ সেকেণ্ড,’ শোনা গেল স্পিকারে।

বাইরে রোটরের আওয়াজ বদলে গেল, থেমে গেছে হেলিকপ্টার, হোভার করছে। মৃদু দোল খেয়ে সাবমারসিবলও স্থির হলো। কয়েক সেকেণ্ড পর ওজনশূন্যতা অনুভব করল স্বামী-স্ত্রী, ওদেরকে নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে। পানি ছিটকে ওঠার শব্দ শোনা গেল, সাগরে আছড়ে পড়ল সাবমারসিবল। ডাইভ দেবার জন্যে সব কন্ট্রোল সেট করে রাখা হয়েছে, কাজেই পানিতে পড়ামাত্র ডুব দিল বাহনটা।

থ্রটল ঠেলে দিল আসিফ, ডানদিকের রাডার অপারেট করে নির্ধারিত কোর্সে নিয়ে এল সাবমারসিবলকে।

‘পাঁচ মিনিটের ভেতর ক্যানিয়নে পৌঁছুব,’ জানাল ও। ‘তারপর পনেরো মিনিট লাগবে ওটার শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে। তারমানে বিশ মিনিট পর জলকন্যাকে ডেপ্লয় করতে হবে তোমাকে।’

মাথা ঝাঁকাল তানিয়া। বিশ মিনিট… শুনতে বেশি মনে হচ্ছে না, কিন্তু ও জানে, জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ বিশ মিনিট হতে চলেছে সময়টা।

.

সাগর থেকে প্রায় পনেরো তলা উঁচুতে, নিজের মারণাস্ত্রের কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে আছেন জোসেফ আকুম্বা। জানেন, যে- ভয়ঙ্কর জুয়া খেলায় তিনি নেমেছেন, সেটা খুব নাজুক একটা বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। আমেরিকার দু-দুটো স্যাটেলাইট ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি, আফ্রিকার আকাশকে বিদেশি স্পাই স্যাটেলাইটের জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এখন অপেক্ষা করছেন প্রতিপক্ষের পাল্টা চালের।

‘আমেরিকান নেভির একটা ক্যারিয়ার ফ্লিট আমাদের উপকূল থেকে দু’শো মাইল দূরে পজিশন নিয়েছে,’ পাশ থেকে জানাল তাঁর নৌবাহিনীর একজন কমাণ্ডার। ‘আমাদের মেইন রেডারে এখন পর্যন্ত চব্বিশটা এয়ারক্র্যাফট ডিটেক্ট করা হয়েছে। ওগুলো এদিকেই আসছে।’

‘সাবমেরিন?’ জানতে চাইলেন আকুম্বা।

‘এখনও পাওয়া যায়নি। আমেরিকান সাবমেরিন নিঃশব্দে চলাফেরা’ করে, ডিটেক্ট করা কঠিন। তবে চিন্তার কিছু নেই, অগভীর পানিতে এলে ঠিকই টের পেয়ে যাব আমরা, তখন আক্রমণ চালানো হবে।’

মাথা ঝাঁকালেন আকুম্বা। নির্দেশ দিলেন, ‘টর্পেডো নেট তোলো। এমিটার-টাও ওঠাও পানির ওপরে।’

রিগের নিচ থেকে সগর্জনে উপসাগরের মুখের দিকে রওনা হলো অনেকগুলো প্যাট্রোল বোট। রিগগুলো থেকে অ্যান্টি- সাবমেরিন মিসাইল নিয়ে টেকঅফ করল কয়েকটা হেলিকপ্টার।

দৃশ্যটা ভালই লাগল দেখতে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট জানেন, ওগুলো কোনও কাজের নয়। এনার্জি ওয়েপন যদি কাজ না করে, তা হলে তাঁর সব বোট আর হেলিকপ্টার আমেরিকানদের টার্গেট প্র্যাকটিসের ডামি হয়ে দাঁড়াবে।

কন্ট্রোল রুমের কাঁচ ভেদ করে সামনে তাকালেন আকুম্বা। চার নম্বর রিগ থেকে মাইলখানেক দূরে, পানির তলা থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে বিশাল এক র‍্যাম্প–অতিকায় এক জলদানবের মত। ঢেউয়ের সারি থেকে তিনশো ফুট ওপরে উঠে থামল ওটা, নিচে রয়েছে টেলিস্কোপিং টাওয়ার, ব্রিজের পিলারের মত ঠেলে ধরেছে র‍্যাম্পটাকে।

র‍্যাম্পের মাঝ বরাবর, একেবারে ডগায় রয়েছে একটা অর্ধবৃত্ত আকৃতির টিউব; সেটার ভেতরে রয়েছে সুপারকণ্ডাক্টর—পার্টিকেল বিমকে যেদিক খুশি সেদিকে ঘোরাতে পারে ওটা।

‘এমিটার অনলাইন,’ রিপোর্ট দিল এক টেকনিশিয়ান। ‘চুরানব্বই পার্সেন্ট পাওয়ার পাচ্ছি আমরা।’

কাছেই একটা প্যানেলের ওপর ঝুঁকে রয়েছে ম্যালোন।

‘অল রিডিং শুনে সে সন্তুষ্ট হবার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। বলল, ইণ্ডিকেটরস্ অনলাইন।’

‘মিসাইল আসছে!’ হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলল রেডার অপারেটর। ‘দক্ষিণ থেকে ছ’টা, পশ্চিম থেকে দশটা, আর আটটা উত্তর-পশ্চিম থেকে!’

‘পার্টিকেল বিম চালু করো,’ শান্ত গলায় হুকুম দিলেন আকুম্বা। ‘ধ্বংস করে দাও ওগুলো।’

ক্রমাগত কয়েকটা সুইচ টেপা হলো, চালু হলো কম্পিউটার প্রোগ্রাম। শক্তিশালী রেড়ার সচল হয়ে উঠল, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্র্যাক করতে শুরু করল আগুয়ান মিসাইলগুলোকে। এরপর মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে পার্টিকেল বিম নিক্ষেপ করল এনার্জি ওয়েপনের এমিটার।

সূচনা হলো যুদ্ধের।

ভ্রান্ত কোনও ধারণা রাখছেন না আকুম্বা; ভাল করেই জানেন, লড়াইটা সহজ হবে না। জিততে হলে শুধু আমেরিকানদের আক্রমণ প্রতিহত করলেই চলবে না, পাল্টা আঘাত হানতে হবে তাদের মূল ভূখণ্ডে। গত আড়াইশো বছরে কেউ যা পারেনি, তা-ই করতে হবে তাঁকে—নতি স্বীকার করাতে হবে আমেরিকাকে।

দিগন্তের কাছে অন্ধকার আকাশ আলোকিত হতে শুরু করেছে একের পর এক বিস্ফোরণে। ধ্বংস হচ্ছে মিসাইলগুলো। সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন প্রেসিডেন্ট।

কাজটা খুব একটা কঠিনও হয়তো হবে না।

.

কয়েক হাজার মাইল দূরে, পেন্টাগনের সিচুয়েশন রুমে জড়ো হয়েছেন আমেরিকান সরকার ও সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় মানুষেরা, বিশাল স্ক্রিনে প্রত্যক্ষ করছেন আফ্রিকার উপকূলে চলতে থাকা যুদ্ধটা। তাঁদের মাঝে আছেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। শেষ কবে এমন স্নায়ুপীড়ায় ভুগেছেন, মনে করতে পারছেন না। দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তিনি… দুশ্চিন্তা কেবল দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, যুদ্ধের ময়দানে তাঁর খুব প্রিয় দু’জন আছে বলেও।

টমাহক মিসাইলের দু’দফা হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। রেডার-জ্যামিঙের ক্ষমতাসম্পন্ন একটা বিমানকে ও নাগালের মধ্যে পেয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন আরেক দফা হামলার প্রস্তুতি চলছে।

স্ক্রিনে অনেকগুলো ছোট ছোট বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন অ্যাডমিরাল, ওগুলো আসলে এফ-এইটিন হরনেট ফাইটারের একটা স্কোয়াড্রন-বিভিন্ন দিক থেকে সিয়েরা লিওনের উপকূলের দিকে এগোচ্ছে। ইভেন্ট হরাইজন লাইন পেরিয়ে হামলা করার চেষ্টা করবে। লাইনের ওপারের যে-কোনও কিছুকে টার্গেট করার ক্ষমতা আছে এনার্জি ওয়েপনের, জানেন তাঁরা; তারপরেও নিশ্চিত হতে চাইছেন, আসলেই পারে কি না।

লাইন থেকে কয়েক মাইল দূরে থাকতেই একযোগে ফায়ার করা হলো অনেকগুলো হারপুন মিসাইল—নেভির সবচেয়ে দ্রুতগামী নিকটপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। বিভিন্ন দিক থেকে ছুটছে ওগুলো, অস্ত্রটা একসঙ্গে ক’দিক সামলাতে পারে, পরীক্ষা করা হচ্ছে। কপাল ভাল হলে এতগুলো টার্গেট এনগেজ করতে গিয়ে ওটার সিস্টেম ওভারলোডও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড যেতেই অ্যাডমিরাল টের পেলেন, পরীক্ষাটা ব্যর্থ হয়েছে। একটার পর একটা মিসাইলের গতিপথের রেখা মুছে যেতে শুরু করেছে স্ক্রিন থেকে।

বড় স্ক্রিনটার নিচে ছোট ছোট কয়েকটা স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে মিসাইলগুলোর নাকে বসানো ক্যামেরার ফিড। ধোঁয়া আর আগুনের ঝলক দেখিয়ে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ওগুলো। শেষ পর্যন্ত রইল না আর একটাও।

‘কী হলো?’ অস্থির গলায় জানতে চাইলেন ওয়েস্টলেক।

‘সবগুলো মিসাইল ধ্বংস হয়ে গেছে, স্যর,’ জানাল একজন টেলিমেট্রি অপারেটর।

স্পিকারে পাইলটদের গলা শোনা গেল… ওরাও একই রিপোর্ট দিচ্ছে। হঠাৎ একজন পাইলট চেঁচিয়ে উঠল, ‘মে-ডে! মে-ডে!! কন্ট্রোল ফেইলিওর…’

কথা শেষ হলো না তার, কেটে গেল কমিউনিকেশন।

আরেকজন পাইলটের রিপোর্ট শোনা গেল। ‘ওয়ান- ফাইভ-ফাইভ হেডিঙে বিস্ফোরণ দেখতে পাচ্ছি। দুটো… না, তিনটে এয়ারক্র্যাফট খতম হয়ে গেছে আমাদের।’

স্কোয়াড্রন কমাণ্ডার নির্দেশ দিল, ‘ড্রপ টু দ্য ডেক! পানির কাছে নেমে যাও। অ্যাবোর্ট মিশন!’

তার নির্দেশটা পালিত হবার আগে আরও দুটো ফাইটারের সিগনাল হারিয়ে গেল। স্কোয়াড্রন কমাণ্ডার জানাল, পাঁচটা ফাইটার হারিয়েছে সে। শেষে যোগ করল, ‘ভুল জায়গায় লাইন টেনেছি আমরা। অস্ত্রটার রেঞ্জ আরও বেশি।’

মুখ লাল হয়ে উঠল ওয়েস্টলেকের, গলার কাছে ফুলে উঠেছে রগ। দেখে মনে হলো, এক্ষুণি তাঁর মাথাটা বিস্ফোরিত হবে। অস্বস্তিতে পড়ে গেল সিচুয়েশন রুমে উপস্থিত সবাই।’

বিমান-হামলা ব্যর্থ হয়েছে, এবার সাবমেরিন দিয়ে চেষ্টা করা হবে। একই সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে স্যাবোটাজ ঘটানোর চেষ্টা কররে নুমার দুই স্টাফ—জানানো হলো সবাইকে। তবে এই হামলাটা বিমান হামলার মত দ্রুত হবে না, হবে আস্তে-ধীরে। যার যার আসনে নড়ে-চড়ে বসলেন সবাই। কেউ কেউ আবার উঠে হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন হাত- পায়ের জড়তা কাটাবার জন্যে।

একজন এইডকে সিচুয়েশন রুমে ঢুকতে দেখলেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। সোজা তাঁর দিকেই এগিয়ে এল সে। কাছে এসে সম্মান দেখিয়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ বাড়িয়ে ধরল।

‘নুমা হেডকোয়ার্টার থেকে মেসেজ, অ্যাডমিরাল।’

কাগজটা নিয়ে পড়লেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। গম্ভীর হয়ে গেল চেহারা। পাশে বসা ভাইস প্রেসিডেন্টকে দিলেন ওটা। পড়ার পর একই অবস্থা হলো তাঁরও। ইশারায় ডাকলেন ওয়েস্টলেককে।

‘ইয়েস, স্যর?’

কাগজটা দেখালেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ‘আর্জেণ্ট মেসেজ, ওয়েস্টলেক। এটার ইনফরমেশন যদি ঠিক হয়, আর দশ মিনিট পরেই পার্টিকেল বিমের সাহায্যে আঘাত হানা হবে ওয়াশিংটনের বুকে। ‘

‘হোয়াট!’ চমকে উঠলেন ওয়েস্টলেক। ‘কোত্থেকে এসেছে এই ইনফরমেশন?’

‘নুমার স্পেশাল প্রজেক্ট ডিরেক্টর মাসুদ রানার কাছ থেকে। আটলান্টিকের একটা জাহাজে এ-মুহূর্তে অপারেশন চালাচ্ছে সে। ওখান থেকেই পাঠিয়েছে মেসেজটা।’

‘পাগলের প্রলাপ,’ এক কথায় ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন ওয়েস্টলেক। ‘ব্যাপারটা যদি সত্যিই হয়, আরও আগেই জানাল না কেন? এখন জানিয়ে তো কোনও লাভ নেই। দশ মিনিটে কিছুই করা সম্ভব নয়।’

‘এর আগে হয়তো সুযোগ পায়নি জানানোর, বললেন হ্যামিলটন। ‘তা ছাড়া, কিছু করা যাবে না, এটা ঠিক নয়। ইমার্জেন্সি ব্রডকাস্ট সিস্টেম আছে আমাদের। একটা ঘোষণা দিয়ে শহরের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলতে পারি—বেজমেণ্টে, আণ্ডারগ্রাউণ্ড গ্যারাজে, বা মেট্রো স্টেশনগুলো…’

‘তাতে শুধু প্যানিকই সৃষ্টি করা হবে,’ মাথা নাড়লেন ওয়েস্টলেক। ‘অকারণে কিছু লোক মারা যাবে।’

‘চুপ করে বসে থাকলে সবাই বেঁচে যাবে বলে ধারণা আপনার?’

‘বললাম তো, এটাকে সিরিয়াসলি নেবার কিছু নেই। পার্টিকেল বিম সরলরেখায় চলে। আফ্রিকার উপকূল থেকে বাঁক নিয়ে আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছুবার কোনও উপায় নেই। আমাদের এফ-এইটিনগুলোর কথাই ধরুন। দিগন্তের নিচে চলে আসার পর ওগুলোর কিছু করতে পারেনি ওরা।’

‘এটা আপনার যুক্তি। এখানে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের মতামতটা জেনে নিলে হয় না?’

সামনে রাখা মাইক্রোফোন অন্ করলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। মনোযোগ আকর্ষণ করলেন সবার। রানার মেসেজটা পড়ে শুনিয়ে বললেন, ‘মি. ওয়েস্টলেক বলছেন, ওয়ার্নিংটা অমূলক। পার্টিকেল বিম এখানে পৌঁছুতে পারবে না। আপনাদের কারও যদি দ্বিমত থাকে, আমাদের সেটা ‘জানান।’

কামরার আরেকপ্রান্তে একজনকে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেল। তিনি আমেরিকার একজন শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞানী। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘এক্সকিউজ মি, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট। ছোট্ট একটা সম্ভাবনা আছে।’

‘কী সম্ভাবনা?’

‘আপনি হয়তো জানেন, পার্টিকেল বিমের গতি আর ডিরেকশন… দুটোই নিয়ন্ত্রিত হয় ম্যাগনেটের সাহায্যে। আমাদের একটা স্টাডি বলছে, ওই বিমের গতিপথে যদি যথেষ্ট শক্তিশালী একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করা যায়, বিমের ডিরেকশন বদলে দেয়া সম্ভব।’

তথ্যটা উদ্বেগ জাগাল সবার মাঝে। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন বললেন, ‘সিয়েরা লিওনের ওই বিমটা যদি ওয়াশিংটনে পৌছাতে হয়, তা হলে কী লাগবে?’

‘শক্তিশালী একটা ম্যাগনেটিক অ্যারে,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘ছোটখাট একটা শহরের সমান পাওয়ার দরকার হবে ওটার জন্যে।’

‘আর লোকেশন? কোথায় বসাতে হবে এই অ্যারে?’

‘এমিটার আর টার্গেটের মাঝামাঝি দূরত্বে।’

‘ব্যস, তা হলে তো প্রমাণই হয়ে গেল—খবরটা ভুয়া,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন ওয়েস্টলেক। ‘আটলান্টিকের মাঝখানে এমন কোনও দ্বীপ নেই, যেখানে এত পরিমাণে পাওয়ার জেনারেট করার মত প্ল্যান্ট বসানো যায়।’

‘নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর দিয়েও কাজটা করা যায়, মি. ওয়েস্টলেক,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘তার জন্যে খুব বেশি জায়গা দরকার হয় না। ইন ফ্যাক্ট, নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের রিঅ্যাক্টর দিয়েও কাজটা করা সম্ভব।’

‘আমাদের হাতে এমন কোনও ইনফরমেশন নেই যে, শত্রুদের হাতে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আছে।’

ওয়েস্টলেকের কথার সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। পেন্টাগনের যে-স্টাফ মনিটরটা অপারেট করছে, তার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘পুরো আটলান্টিকের ভিউ দেখাও আমাদেরকে।’

কেউ আপত্তি করল না। কি-বোর্ডের দুটো বাটন চাপতেই বদলে গেল স্ক্রিনের দৃশ্য। পুরো আটলান্টিক মহাসাগরের মানচিত্র ফুটে উঠল ওতে। বামে রয়েছে আমেরিকার পূর্ব- উপকূল, ডানপ্রান্তে আফ্রিকা, আর ওপরে ইয়োরোপের দক্ষিণ অংশ। আমেরিকান নেভির যুদ্ধবহরের আইকনগুলো জ্বলজ্বল করছে আফ্রিকার উপকূলে।

‘লাইবেরিয়ান ট্যাঙ্কার নর্দার্ন স্টারের পজিশন দেখাও এবার,’ বললেন অ্যাডমিরাল। রানার পাঠানো মেসেজটায় কো-অর্ডিনেটস্ দেয়া আছে, সেটা পাঠিয়ে দিয়েছেন অপারেটরের কাছে।

কয়েক সেকেণ্ড লাগল, তারপরেই স্ক্রিনে মিটমিট করে উঠল একটা নতুন বিন্দু। আর ওটার লোকেশন দেখে দম আটকে এল সবার। স্ক্রিনের একেবারে মাঝখানে…. ওয়াশিংটন আর কোয়াডাঙ্গলের ঠিক মাঝামাঝি দূরত্বে জ্বলজ্বল করছে ওটা।

‘মাই গড!’ আঁতকে উঠলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ঝট্ করে তাকালেন নেভি চিফের দিকে। ‘আমাদের সাবমেরিনগুলো কখন হামলা করবে?’

মুখ কালো হয়ে গেল নেভি চিফের। ‘আরও ত্রিশ মিনিট লাগবে পজিশনে পৌঁছুতে। ওদের ভরসায় থেকে লাভ নেই।’

এক মুহূর্ত দেরি না করে কাজে নেমে পড়লেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। নিজের সহকারীকে ডেকে হুকুম দিলেন, ‘সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলো, প্রেসিডেন্টকে এখুনি বাঙ্কারে নিয়ে যেতে হবে। ইমার্জেন্সি ব্রডকাস্ট সিস্টেমে সতর্ক করে দাও সবাইকে, শেল্টার নিতে বলো। সমস্ত ল-এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি আর পাওয়ার কোম্পানিকেও খবর দিতে হবে। রেডি থাকতে বলো সব হাসপাতাল আর ইমার্জেন্সি সার্ভিসকে।’

সঙ্গে সঙ্গে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সিচুয়েশন রুমে উপস্থিত সবাই। টেলিফোনে কথা বলছেন যার যার সংস্থায়। মাছের বাজারে পরিণত হলো জায়গাটা।

সেলফোন থেকে নুমার সমস্ত স্টাফকে মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। তারপর মুখ তুলে তাকালেন অ্যারন ওয়েস্টলেকের দিকে।

পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে এনএসএ-র ডেপুটি ডিরেক্টরের মুখ। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন করছেন নিজের স্ত্রীকে। অ্যাডমিরালকে তাকাতে দেখে বললেন, ‘ফোন ধরছে না। কী যে করি…’

‘চেষ্টা করতে থাকুন,’ বললেন অ্যাডমিরাল। মায়া লাগছে ভদ্রলোককে দেখে। ‘হাল ছাড়বেন না।’

আবার ডায়াল করলেন ওয়েস্টলেক। রিং হবার ফাঁকে অ্যাডমিরালকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ওই মাসুদ রানা… ও কি ওই জাহাজটায় উঠতে পেরেছে?’

‘আমি যদ্দূর জানি।’

ঢোক গিললেন ওয়েস্টলেক। দর্পচূর্ণ হয়েছে তাঁর। বললেন, ‘তা হলে তো ও-ই আমাদের শেষ ভরসা।’

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন অ্যাডমিরাল। কথাটা ঠিক। রানার হাতে এখন ওয়াশিংটন ডিসি-র কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ। ও কি পারবে ওঁদেরকে বাঁচাতে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *