1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ১৯

উনিশ

রেস্টুরেন্টের নাম এসকার্পা—পর্তুগিজ শব্দটার অর্থ করলে দাঁড়ায় পাহাড়চূড়া। নামের সঙ্গে মিল আছে বেশ। নিচু একটা বিল্ডিং, স্থানীয় পাথর দিয়ে গড়া, সুউচ্চ এক পাহাড়ের প্রায় চূড়ার কাছাকাছি গা মিশিয়ে রেখেছে ঢালে। আট মাইল দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ ধরে পৌঁছুতে হয় ওখানে।

আসার পথে উন্মুক্ত সবুজ মাঠ আর গাছপালায় ছাওয়া পাহাড়ি ঢাল পেরিয়ে এসেছে রানা আর লামিয়া। ছোট্ট একটা ক্লাবকেও পাশ কাটিয়েছে, ওখান থেকে টুরিস্টরা হ্যাঙগ্লাইডার আর আল্ট্রালাইট ভাড়া নিতে পারে; ওগুলোয় চেপে উড়ে বেড়াতে পারে সান্তা মারিয়ার আকাশে।

ভাড়া করা টয়োটা গাড়িটা পাগলের মত চালিয়েছে লামিয়া। পেরিয়ে এসেছে অন্তত এক ডজন বাঁক, কোনও রকম গতি না কমিয়ে। পাহাড়ি পথের পুরোটায় গার্ডরেইল নেই, থাকলেও কতটা কাজ হতো কে জানে, কয়েকবারই রানার মনে হয়েছে এই বুঝি ছিটকে রাস্তার বাইরে পড়ে গেল ওরা। তবে প্রতিবারই নিখুঁত দক্ষতায় স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছে মেয়েটা, সঠিক সময়ে ব্রেক চেপেছে, তারপর আবার চাপ দিয়েছে অ্যাকসেলারেটরে। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, সে পাকা ড্রাইভার। উন্মত্তের মত গাড়ি চালাচ্ছে স্রেফ রানার নার্ভ দেখার জন্যে।

নির্বিকার থেকেছে রানা। অলস ভঙ্গিতে খুলে দিয়েছে সানরুফ, ওপর থেকে উপত্যকা কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে— সে-বিষয়ক নানা রকম মন্তব্য করেছে।

‘তারমানে ড্রাইভটা উপভোগ করছ তুমি?’ বিস্ময় নিয়ে জানতে চেয়েছে লামিয়া। ইতিমধ্যে সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছে ওদের, পাল্টে গেছে সম্বোধন।

‘খুবই,’ হাসিমুখে বলেছে রানা। ‘শুধু কোনও গরুর গায়ে গুঁতো মেরে দিয়ো না।’

ভুরু কুঁচকেছে লামিয়া। ওর ভেতর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে যেন রোখ চেপে গেছে, আরও জোরে চালিয়েছে গাড়ি। চোখের পলক ফেলার আগেই পৌঁছে গেছে রেস্টুরেন্টে।

জানালার ধারের একটা টেবিল দখল করে বসে আছে দু’জনে, সমুদ্রের বুকে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছে মুগ্ধ নয়নে। ওয়েইটার এল অর্ডার নিতে। মেনু কার্ড রানার দিকে বাড়িয়ে দিল লামিয়া। কড ফিশ অর্ডার করল রানা, সেই সঙ্গে স্থানীয় সবজির স্যালাড। ওয়াইন লিস্টে চোখ বোলাল। নামকরা প্রায় সব ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ ওয়াইন রয়েছে ওতে, কিন্তু সান্তা মারিয়ায় এসে ওসব পান করার কোনও মানে হয় না। ওয়াইন তৈরির জন্যে সুখ্যাতি রয়েছে অ্যাযোর্সের দ্বীপগুলোর, ষোড়শ শতাব্দী থেকেই এর সঙ্গে জড়িত দ্বীপবাসীরা। রানা শুনেছে, এখনও নাকি হাতে বানায় ওরা সব ওয়াইন।

‘আমরা এক বোতল টেরাস ডি লাভা নেব,’ তালিকার নিচ থেকে স্থানীয় একটা ওয়াইন বাছল ও।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল লামিয়া। বলল, ‘ডেজার্টের অর্ডার কিন্তু আমি দেব।’ মুখে হাসি, যেন দর কষাকষিতে জিতে গেছে। ও।

রানাও স্মিত হাসল। ‘বেশ।’

অর্ডার নিয়ে চলে গেল ওয়েইটার। কাজের কথা পাড়ল ‘তা হলে তুমি রাশান সরকারের পক্ষ থেকে এসেছ?’

‘এমনভাবে বলছ, যেন সেটা খারাপ কিছু। কেন, তুমি আমেরিকান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছ না?’

‘সত্যি বলতে কী, না। আমি বাংলাদেশি মানুষ, নুমার সঙ্গে আছি স্রেফ শখের বশে। অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে আটকে গেছি এখানে।’

‘অনুরোধ?’

‘হ্যাঁ। পর্তুগাল আর স্পেন সরকার অনুরোধ করেছে, নুমা যেন তাদের মাঝে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।’

‘বিশাল সম্মানের ব্যাপার বলতে হবে,’ অ্যাপেটাইজারে ছোট্ট একটা কামড় বসাল লামিয়া। ‘যদ্দূর জানি, এরা শেষবার যখন মধ্যস্থতা চেয়েছিল, গিয়েছিল পোপের কাছে। দুই দেশের মাঝখানে সীমানারেখা টেনে মীমাংসা করেছিলেন তিনি।’

হাসল রানা। ‘দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের অত ক্ষমতা নেই।’

ওয়াইন এল। স্বাদ চেখেই ওটাকে স্বীকৃতি জানাল ওরা। এরপর সরাসরি কাজের কথা পাড়ল রানা।

‘এবার বলো, কেন তোমাকে পাঠানো হয়েছে এখানে?’

বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকাল লামিয়া। ‘ভেবেছিলাম আরও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে।’

‘আমি সোজা-সরল মানুষ,’ নিরীহ ভঙ্গিতে বলল রানা। শ্রাগ করল লামিয়া। বলল, ‘অযথা আমাকে সন্দেহ করছ। রাশার বিজ্ঞান পরিদপ্তরে কাজ করি আমি। এখানকার আবিষ্কারের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ জাগাটাই তো স্বাভাবিক। অদ্ভুত এক ম্যাগনেটিজম, যার টানে অন্তত ডজনখানেক জাহাজ ডুবে গেছে… যে-কেউই কৌতূহলী হয়ে উঠবে।’

অকাট্য যুক্তি, কিন্তু রানা পুরোপুরি মেনে নিতে পারছে না। কথা আর কাজে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে এই মেয়ের।

‘জাহাজডুবির জন্যে ম্যাগনেটিজমকে দায়ী করছে না কেউ,’ শুধরে দিল ও। ‘ডুবে যাবার পরে ওটার টানে টাওয়ারের কাছে চলে এসেছে ওগুলো।’

‘জানি,’ বলল লামিয়া। ‘নাটকীয়তার জন্যে বললাম আর কী। টাওয়ারটা যেন গ্রিক মিথোলজির সাইরেনদের মত ডেকে নিচ্ছে দুর্ভাগা জাহাজগুলোকে। রোমান্টিক, তাই না?’

‘রোমান্টিক, তবে সায়েন্টিফিক্যালি ভ্রান্ত।’

অদ্ভুত এক দ্যুতি ফুটল লামিয়ার চোখে। ‘তুমি শিয়োর? যতকিছুই হোক, সাগরের এই এলাকায় কারণ ছাড়াই বহু জাহাজ আর বিমান হারিয়ে যাবার রেকর্ড আছে।’

সেসব গল্পের অনেকগুলোই শুনেছে রানা, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। ‘আরেকটা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল?’

‘ভাবলে ক্ষতি কী?’

‘ক্ষতি হলো, খোদ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কিংবদন্তির নিজেরই কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ইউএস কোস্ট গার্ডের একটা স্টাডি বলছে, বারমুডায় যত জাহাজডুবি আর বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় মোটেও বেশি নয়। সাগর একটা বিপজ্জনক জায়গা, সেটা যেখানেই যাও না কেন।’

একটু যেন হতাশ হলো লামিয়া। ওয়াইনে চুমুক দিয়ে বলল, ‘পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে মানুষের বিশ্বাস বদলানো যায় না। শুনেছ কি না জানি না, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মত এ- জায়গাটারও একটা নাম দিয়ে ফেলেছে লোকে—ডেভিল’স্ ডোরওয়ে।’

‘কারা দিয়েছে?’

‘ঠিক জানি না। বিজ্ঞানীরা, কিংবা কোনও সাংবাদিক।’

এই প্রথম নামটা শুনছে রানা। ‘এখানে আসার পর থেকে পত্রিকায় চোখ বোলাবার সুযোগ পাইনি। এমন অদ্ভুত একটা নাম দেবার কারণ কী?’

‘নিচের রেকগুলো নাকি একটা ত্রিভুজের মত আকৃতি সৃষ্টি করেছে সি-ফ্লোরে,’ ব্যাখ্যা করল লামিয়া। ‘পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে—তীরচিহ্নের মত তাক হয়ে আছে টাওয়ারটার দিকে। ত্রিভুজের ডগাটা ডুবোপাহাড়ের ঢালে একটা সরু ফাটলে গিয়ে মিশেছে। ওই ফাটলের ভেতর দিয়ে স্রোত প্রবাহিত হবার সময় গতি বাড়ে, ওপাশে গিয়ে গভীর পানিতে মেশে। পেছনদিকে, যেখানে ত্রিভুজটা সবচেয়ে চওড়া, সেখানে রয়েছে দুটো উঁচু স্তম্ভ। ওটাকেই পানির নিচের ওই উপত্যকায় ঢোকার এন্ট্রি পয়েন্ট বলে ভাবা হচ্ছে…’

‘ঠিক দরজার মত, এবার বুঝতে পারছে রানা। ‘স্তম্ভদুটো দরজার পিলার। হুম, এক হিসেবে তো ডোরওয়েই বটে।’

‘এমন এক ডোরওয়ে, যেটা দিয়ে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরুনো যায় না,’ বলল লামিয়া। ‘ডেভিল’স্

ডোরওয়ে-নরকের প্রবেশপথ।’

মন্দ নয় নামটা, স্বীকার করতে বাধ্য হলো রানা। অফিশিয়ালি যে-নাম দেয়া হয়েছে—নর্থ সেন্ট্রাল আটলান্টিক ম্যাগনেটিক অ্যানোমেলি-তার চেয়ে অনেক ভাল শোনাচ্ছে।

‘হুম, জুৎসই নাম,’ বলল ও।

‘তা তো বটেই।’

‘কিন্তু এটা বোঝা গেল না, ওই ডোরওয়ের বাইরে পড়ে থাকা একটা এয়ারক্র্যাফটের ভেতরে তুমি ডাইভ দিচ্ছিলে কেন।’

‘ঠিক,’ অভিযোগটা মেনে নিল লামিয়া, কৈফিয়ত দেবার কোনও চেষ্টা করল না। ‘আরও একটা অসঙ্গতি আছে। লোহাবিহীন, নন-ম্যাগনেটিক অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি একটা বিমান কেন এখানে ক্র্যাশ করল? ডেভিল’স্ ডোরওয়ের অত কাছেই বা গেল কী করে?’

চিন্তার নতুন খোরাক পেল রানা, বিষয়টা আগে মাথায় আসেনি। নীরব হয়ে গেল ও।

গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিল লামিয়া। ‘চমৎকার ওয়াইন, বলল ও। ‘তুমি একটু বসবে? আমার ফ্রেশ হওয়া দরকার।’

ভ্রূকুটি করল রানা। আসার আগে লামিয়ার হোটেল হয়ে এসেছে ওরা। আধঘণ্টা ধরে পোশাক পাল্টেছে সে, চল বেঁধেছে, মেকআপ করেছে। এরপর আর ফ্রেশ হবার কী আছে? সে-তুলনায় ওর অবস্থা ঝড়ের কবলে পড়া কাকের মত। গায়ে সকাল থেকে পরে থাকা পোশাক। সাগরে ডাইভ দেবার পর গোসলটাও সারতে পারেনি।

রানার জবাবের প্রতীক্ষায় না থেকে উঠে পড়েছে লামিয়া। ও-ও ভদ্রতা দেখিয়ে উঠল। পেছন থেকে তাকিয়ে রইল মেয়েটার গমনপথের দিকে। কালো রঙের ককটেল ড্রেস আর হাই হিলে দারুণ আকর্ষণীয় লাগছে মেয়েটাকে। প্রতি পদক্ষেপে নিতম্বে উঠছে হিল্লোল। চোখের আড়াল হয়ে গেলে আবার বসে পড়ল। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে সেলফোন বের করে একটা এসএমএস পাঠাল মুরল্যাণ্ডকে।

‘ড. লামিয়া লিভানোভার ব্যাপারে ইনফরমেশন চাই আমি। কেন এখানে এসেছে। অতীতে কোথায় কাজ করেছে। আর যে-বিমানটায় ডাইভ দিচ্ছিল, সেটার ব্যাপারেও কিছু জানা যায় কি না দেখো।’

মিনিট পেরুবার আগেই জবাব চলে এল।

মুরল্যাণ্ড লিখেছে, ‘আমি তো অন্তর্যামী হয়ে গেছি, বন্ধু। তুমি বলার আগেই খোঁজ নিচ্ছিলাম। তোমার বান্ধবীর ব্যাপারে কয়েকটা ওয়েবপেজের লিঙ্ক পাঠালাম। আর বিমানটার ব্যাপারে যদ্দূর জানলাম, ১৯৫১ সালে সান্তা মারিয়া থেকে টেকঅফ করে হারিয়ে গিয়েছিল ওটা। সিভিল অ্যারোনটিক্স বোর্ডের ফাইল আর ক্র্যাশ রিপোর্ট চেক করে দেখেছি। সেসবের অনেকটাই সিআইএ-র নির্দেশে ক্লাসিফায়েড করে রাখা হয়েছে, তাই বিস্তারিত কিছু জানাতে পারছি না।’

সিআইএ! কেন যেন অবাক হতে পারছে না রানা। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার একটা বিমান, যেটার প্রতি রাশা আগ্রহী… এখানে আমেরিকান কোনও কানেকশন না থাকাই বরং অস্বাভাবিক।

মুরল্যাণ্ডের পাঠানো লিঙ্কগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও। জানা দরকার, রহস্যময়ী লামিয়া লিভানোভা আসলে কে।

.

মেয়েদের বাথরুমে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লামিয়া। লিপস্টিক দিচ্ছে না, বা মেকআপ ঠিক করছে না, চোখ আটকে আছে সেলফোনের স্ক্রিনে।

‘তাড়াতাড়ি!’ ডাউনলোডের ধীরগতি দেখে বিড়বিড় করল ও।

অবশেষে বদলে গেল স্ক্রিন। একটা ফাইল ওপেন হলো- মাসুদ রানার ডোশিয়ে। বেশ বড়, পুরোটা পড়ার সময় নেই। চোখ বুলিয়ে নিল লামিয়া। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো শুধু পড়ে নিল। তারপর একটা এসএমএস পাঠিয়ে জানাল, ফাইলটা পেয়েছে।

ফোনটা পার্সে রেখে আয়নায় নিজের চুল ঠিক করে নিল সে। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল দরজার উদ্দেশে।

.

রানাও নিজের সেলফোনে লামিয়ার বায়োডাটা পড়ছে। আড়চোখে ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে বাথরুমের দিকে। দরজা খুলে যেতে দেখে ফোন রেখে দিল পকেটে। উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল মেয়েটাকে। চেয়ার টেনে বসতে সাহায্য করল।

‘আগের চেয়ে ফ্রেশ দেখাচ্ছে তোমাকে,’ ঠাট্টার সুরে বলল ও।

‘থ্যাঙ্কস,’ লামিয়া বলল। ‘চেষ্টার ত্রুটি করিনি।’

জবাবটাও ঠাট্টার সুরে এসেছে, কিন্তু কোথায় যেন তার ভেতরে সত্যের ছোঁয়া অনুভব করল রানা। সমাজে শুধু যোগ্যতার জোরে মেয়েরা কিছু অর্জন করতে পারে না, তার সঙ্গে রূপও চাই। লামিয়া নিশ্চয়ই সেটা ঠেকে শিখেছে।

‘অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তোমাকে,’ প্রশংসার সুরে বলল রানা। ‘আমার সঙ্গে একদম মানাচ্ছে না। লোকে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছে আমাদেরকে দেখে।’

‘থাক, আর বিনয় করতে হবে না। তুমি নিজেও কম সুপুরুষ নও।’

‘স্বীকার করছি, সাজগোজের সুযোগ পেলে হয়তো বা তোমার সঙ্গী হিসেবে উৎরে যেতে পারব। কিন্তু এ-অবস্থায় … নির্ঘাত বন্দরের কোনও জেলের মত দেখাচ্ছে আমাকে।’

হেসে ফেলল লামিয়া।

হাসি-ঠাট্টা আর হালকা গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে কাটতে থাকল সময়। খাবার এল, সেই সঙ্গে আরেক দফা ওয়াইন। এবার পুরনো আলোচনার খেই ধরল রানা।

‘আমার প্রশ্নটার কিন্তু জবাব দাওনি,’ বলল ও। ‘বিমানটায় একাকী ডাইভ দিয়েছিলে কেন? বোটে দু’সেট এয়ারট্যাঙ্ক ছিল। পার্টনার নেই তোমার?’

‘এতকিছু জানতে চাইলে মুশকিল,’ মৃদু হেসে বলল লামিয়া। ‘ঠিক আছে, সংক্ষেপে তোমার কৌতূহল নিরসন করি। সরকারের আরেকজন প্রতিনিধির সঙ্গে সান্তা মারিয়ায় এসেছি আমি, তবে সে বিজ্ঞান পরিদপ্তরের কেউ নয়। অ্যাসাইনমেন্টটা আমার একার। আর দ্বিতীয় এয়ারট্যাঙ্ক… ওটা বোটের সঙ্গেই ছিল।’

দ্বিতীয় প্রতিনিধি নিশ্চয়ই লামিয়ার হ্যাণ্ডলার জাতীয় কেউ, অনুমান করল রানা। ওর ওপর নজরদারির জন্যে এসেছে। যতটুকু বুঝেছে, এ-মেয়ে কোনও প্রফেশনাল এজেণ্ট নয়, তাই একাকী পাঠানো হয়নি ফিল্ডে।

‘বেশ,’ মাথা ঝাঁকাল ও। ‘এবার তোমার পালা। কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারো।’

‘পদ্ধতিটা পছন্দ হয়েছে আমার,’ বলল লামিয়া। ‘তা হলে বলো, বোটে উঠে আসার পর ওভাবে রেগে গিয়েছিলে কেন? তোমাদের সাধের এক্সক্লুসিভিটি জোনে হানা দিয়েছিলাম বলে, নাকি অফিশিয়ালি নাম লেখাইনি বলে?’

‘কোনোটাই না,’ রানা মাথা নাড়ল। ‘রেগেছি তোমার বোকামি দেখে। নিচে মরতে পারতে তুমি…. মরতে বসেওছিলে।’

‘অ! মাসুদ রানা তা হলে একজন দরদী মানুষ? অপরের ভালমন্দের চিন্তায় অস্থির?’

‘যা খুশি ভাবতে পারো,’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘তবে অকারণ মৃত্যু আমি পছন্দ করি না।’

‘সেজন্যেই কি সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ো বিপদে? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও?’

রানার কপালে ভাঁজ পড়ল।

লামিয়া বলল, ‘বুঝতেই পারছ, তোমার বিষয়ে খানিকটা খোঁজখবর নিয়েছি আমি।’

‘কী জানলে?’

‘অজানা-অচেনা মানুষের বিপদেও ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যেস আছে তোমার।’

‘সেটা খারাপ?’

‘উঁহুঁ। আমি বরং তোমার এই অভ্যেসের কারণে কৃতজ্ঞ। আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ তুমি।’

‘ও কিছু না,’ বলল রানা। ‘আমিও খোঁজ নিয়েছি তোমার ব্যাপারে।’

‘আশা করি ভাল তথ্যই পেয়েছ।’

‘শুধু এটুকু জেনেছি যে, তুমি একজন জাত-প্রতিযোগী। জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছ আইস রিঙ্কে। স্কেটার হিসেবে স্থানীয়, জাতীয় আর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছ এক নাগাড়ে। লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাবার পরেও উইন্টার অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ মেডেল জিতে নিয়েছিলে প্রায়!’

‘ব্রোঞ্জ না, স্বর্ণপদক জিতে নিচ্ছিলাম,’ বলল লামিয়া। ‘শেষ জাম্পটার পর পড়ে গিয়েছিলাম। এক পায়ে শেষ করেছিলাম প্রোগ্রাম।’

‘এরপর তো প্রায় দু’মাস হাঁটতে পারোনি?’ ওয়েবসাইটে পড়া তথ্যগুলো স্মরণ করছে রানা। ‘এজন্যেই জাত-প্রতিযোগী বললাম। অন্য কোনও স্কেটার হলে তখুনি থেমে যেত। পা-টা বাঁচাত পরের কোনও কম্পিটিশনের জন্য।

‘পরের সুযোগটা কখনও কখনও পাওয়া যায় না,’ গম্ভীর গলায় বলল লামিয়া।

‘সেজন্যেই অমন ঝুঁকি নিয়েছিলে?’

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল লামিয়ার। আনমনে চামচ দিয়ে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করল। এরপর বলল, ‘অলিম্পিকে আমার আসলে যাবারই কথা ছিল না। শেষ মুহূর্তে একজন স্কেটার অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে সুযোগ দেয়া হয়। জানতাম, অমন সুযোগ দ্বিতীয়বার পাব না।’

‘তাই কিছু প্রমাণ করতে চেয়েছিলে?’ ওর মনোভাব খানিকটা বুঝতে পারছে রানা।

নিঃশব্দে মাথা ঝোঁকাল লামিয়া।

‘আর এবারের ব্যাপারটা?’ ভুরু নাচাল রানা। ‘এই যে ল্যাবরেটরির বাইরে একটা অ্যাসাইনমেণ্ট নিয়ে এলে… এটা তোমার জন্যে নতুন বলে ধারণা করছি। নিশ্চয়ই কাউকে ইমপ্রেস করতে চাইছ, আবারও কিছু প্রমাণ করতে চাইছ, নইলে ভবিষ্যতে তোমাকে কোনও সুযোগ দেয়া হবে না। ঠিক বলেছি?’

‘হয়তো,’ নিচু গলায় বলল লামিয়া।

‘এতে কোনও দোষ দেখি না,’ রানা বলল। ‘আমরা সবাই কারও না কারও চোখে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে চাই। তাই বলে সবখানে ঝুঁকি নেয়া চলে না, বিশেষ করে সাগরের তলায় ডুবে থাকা একটা বিমানের ভেতরে।’

‘তুমি কখনও এমন ঝুঁকি নাওনি?’ প্রশ্ন করল লামিয়া। ‘কাউকে দেখাতে চাওনি, তোমার ব্যাপারে তার ধারণা ভুল?’

‘কে কি ভাবল না-ভাবল, তা নিয়ে একদম মাথা ঘামাই না আমি।’

‘তা হলে বলতে চাইছ, তোমার জীবনে এমন কেউ নেই, যার চোখে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করা দরকার?’

‘আমি সে-কথা একবারও বলিনি।’

‘হুম, তার মানে আছে।’ চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হলো লামিয়ার। ‘কে সে? কোনও মেয়ে? মিসেস মাসুদ রানা বলে কি কেউ আছে, অথবা হতে চলেছে?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘অমন কেউ থাকলে আজ আমাকে এখানে পেতে না।

‘তা হলে কার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে চাও তুমি?’

শব্দ করে হেসে উঠল রানা। আলাপটা ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। ‘আগে যে-খবর জানাবার টোপ দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ, সেটা বলো। তারপর আমি আমার গুমর ভাঙব।’

‘মনে হচ্ছে না সে-সৌভাগ্য হবে। খবরটা শোনামাত্র ডিনার থেকে উঠে যেতে পারো তুমি।’

‘নির্ভর করছে তুমি কী জানাচ্ছ, তার ওপর।’

কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল লামিয়া। এরপর বলল, ‘গতকাল একজন ফ্রেঞ্চ ডাইভারকে বাঁচিয়েছ তোমরা।’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘ডুবুরি হিসেবে একদম আনাড়ি, বেল্টে প্রায় একশো পাউণ্ডের ওজন নিয়ে নেমে গিয়েছিল পানিতে। ডুবে গিয়েছিল।’

‘আসলে আনাড়ি না। তোমার ধারণা ভুল।’

‘মানে?’

‘পুরোটাই একটা সেটআপ। তুমি আর তোমার বন্ধু যখন তাকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, সেই ফাঁকে ফ্রেঞ্চ টিমের আরেক মেম্বার পাথরের ওই টাওয়ার থেকে চার ফুট গভীর একটা কোর স্যাম্পল তুলে নিয়ে এসেছে। বোকা বানিয়েছে তোমাদের। এই নিয়ে ওরা আড়ালে-আবডালে হাসাহাসিও করছে।’

চোখের পলকে মুড বদলে গেল রানার। নিঃশব্দ রাগে কঠিন হয়ে উঠল মুখ। খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। প্লেট ঠেলে দিল সামনে। টেবিলের ওপর ভাঁজ করে রাখল ন্যাপকিন।

‘ঠিকই বলেছিলে তুমি,’ বলল ও। ‘ডিনার শেষ।’

‘জানতাম,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লামিয়া। ‘চলো, আমিও উঠব।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ওরা। বিলের জন্যে টেবিলের ওপর কয়েকটা নোট রেখে দিল রানা, এরপর লামিয়াকে নিয়ে এগোল দরজার দিকে।

‘তোমার গুমর কিন্তু জানা হলো না,’ বলল মেয়েটা। ‘পরে শোনাব,’ রানা গম্ভীর।

দরজা থেকে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেরিয়ে এল দু’জনে। ঠিক তখুনি ছায়ার মধ্যে নড়ে উঠল কেউ। ডানদিক থেকে কিছু একটা ছুটে আসতে দেখল রানা- লোহার ডাণ্ডা বা ব্যাট জাতীয় কী যেন; সরাসরি আঘাত হানল ওর পেটে।

শরীর শক্ত করে ফেলেছিল রানা, কিন্তু লাভ হলো না তাতে। প্রচণ্ড আঘাতে হুঁক করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। পেট চেপে ধরে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *